সুপারি গাছের আড়ালে কাঠের দোতলা বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে একটা জোরালো আলো জ্বলছে। বহু দূরে ঘড়ি-মোড়ের বড় ঘড়িটা হঠাৎ দু’বার বেজে উঠে জানান দিলো রাত দুটো বাজে। ডঃ বড়ুয়া একটা বহু পুরানো চামড়ার পুঁথির পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত। আতসকাঁচ আর একটা সাঙ্কেতিক ডায়রি নিয়ে তিনদিন হল নাওয়া-খাওয়া ভুলে লেগে রয়েছেন। এমন সময় ভাইব্রেশনে রাখা ফোনটা কেঁপে উঠতেই বিরক্ত হলেন তিনি। অচেনা নম্বরের ফোন, একটু দোনামোনা করে, নিয়েই নিলেন কলটা। এই মার্চের প্রথমে উত্তরবঙ্গে ঠাণ্ডার রেশ ভালোই রয়েছে। তবুও ওঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল ফোনের ওপারের কথা শুনে। গম্ভীর মুখে ফোনটা রেখে উঠে এলেন তথাগতর বড় মূর্তিটার সামনে। প্রদীপের পলতেটা উস্কে দিয়ে প্রণাম করলেন ওঁর ঈশ্বরকে। পুঁথিটা জায়গা মত রেখে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম এলো না। এক অজানা বিপদের আশঙ্কায় মনটা ভার। ছটফট করে রাতটা কাটল, ভোর রাতে উঠে বেরিয়ে গেলেন হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে। সারা শহর তখন ঘুমন্ত।
*********
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, এবার সেভেন হবে রুবাইয়ের। এই সময়টা রুবাইয়ের খুব ভালো লাগে। ঠাণ্ডাটা বেশ কমে একটা আরামদায়ক ওয়েদার, চারদিকে নাম না জানা ফুলের মেলা। আজকাল রুবাই একটু সাইকেল নিয়ে একা বেরোতে পারে বন্ধুদের বাড়ি। একটু বড় হয়েছে, তাই মা আর বকে না। ওর মা শ্রমণা দেবী মেয়েদের স্কুলের প্রিন্সিপাল। আর বাবা রাজেশবাবু বড় ডাক্তার। বেশ কড়া শাসনে রাখা হয় রুবাইকে।
ওদের বাড়ির পিছনেই রেললাইন। সারাদিনে মাত্র একটা ট্রেন চলে। কুচবিহার থেকে চ্যাংড়াবান্দা হয়ে শিলিগুড়ি যায় ডি. এম. ইউ. ট্রেনটা। রোজ সন্ধ্যায় ট্রেনটা ফিরে গেলে ওরাও আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরে আসে।
সেদিন ওরা ওদের বন্ধু রাজনের বাড়ি গিয়েছিল। রাজনদের বাড়ি রেললাইনের ওপারে বুদ্ধ মন্দিরের পিছনে। বিশাল সুপারি বাগানে ঘেরা বহুদিনের পুরানো বড় বাড়ি। এদিকটায় আসলে কেমন যেন গা ছমছম করে রুবাইয়ের। আসলে ওদের বাড়ির পাশেই একটা চীনাদের পরিত্যক্ত কবরখানা আছে। জায়গাটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা। রাজনের জ্যেঠু ডঃ পিনাকী বড়ুয়া তিব্বতী ও পালি ভাষার উপর রিসার্চ করে ডক্টরেট। দীর্ঘ দিন উনি তাওয়াং এ ছিলেন। তিব্বতেও কাটিয়েছেন কিছু সময়। দু’মাস হলো বাড়ি ফিরেছেন। বিয়ে করেন নি। বাচ্চাদের উনি খুউউব ভালোবাসেন। ওঁর কাছে এলে খুব ভালো গল্প শোনা যায়। জেঠুর গল্পের লোভেই ওদের রাজনদের বাড়িতে যাতায়াত বেড়েছে আজকাল।
ওদের সাথে নিচের বড় হলেই জেঠুর দেখা হলো। অরুণাচলের বুমলা পাসের গল্প বলছিলেন জেঠু। চীনা সৈন্যরা কিভাবে রাতারাতি ভারত দখল করতে এগিয়ে এসেছিল শুনতে শুনতে ওরাও পৌঁছে গিয়েছিল সেই যুদ্ধক্ষেত্রে। চারদিকে তখন মাইন বিছানো চলছে। এমন সময় জেঠুর ফোনটা বেজে উঠেছিল। উনি ফোনটা অন করে এক দু'বার হ্যাঁ বলার পর ওঁর মুখের পেশীর বদলে যাওয়া আর কপাল কুঁচকে যাওয়া দেখে রুবাই বুঝতে পেরেছিল কিছু হয়েছে। ওঁর ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল আর কপালের উপর দুটো শিরা ফুলে উঠেছিল। বেশ জোরের সাথে দু’ বার না বলে উনি ফোনটা কেটে দিলেন। ফোনটা রেখেই উনি ঢকঢক করে জল খেলেন কিছুটা। রুবাই, আকাশ আর রাজন চুপ করে অপেক্ষা করছিল।
কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে উনি বললেন -"আজ আর গল্প হবে না। কাল ভোরে আমায় লাভা মনাস্ট্রি যেতে হবে। তোমরা পরে একদিন এসো। "
আকাশ আর রুবাই উঠে পড়ল। রাজনের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে শুনলো জেঠু ফোনে গাড়ি বুক করছেন পরেরদিনের জন্য। রাজন ওদের এগিয়ে দিল রেল লাইন অবধি।
হুইসল বাজিয়ে ট্রেনটা চলে গেলো ওদের সামনে দিয়ে। লাইন পার হতে হতে আকাশ রুবাইকে বলল -"কি এতো ভাবছিস তখন থেকে?"
-"কিছু একটা হয়েছে মনে হল। কিন্তু ....."
-"হয়তো কোনো পারিবারিক সমস্যা।"
-" না মনে হয়। ফোনটা পরিবারের কেউ করে নি। নম্বরটা সেভ করা ছিল না। "
আসলে বয়স আন্দাজে রুবাইয়ের আই. কিউ. লেভেলটা বেশি। গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে ও মাথাটাও খাটাতে চায় সর্বদা। সব কিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখে রুবাই। ওর জন্য বেশ কিছু অপরাধী ধরাও পড়েছে। পুরস্কার পেয়েছে রুবাই এসবের জন্য। এলাকায় সবাই ওকে চেনে তাই।
বাড়ি ফিরেই রুবাই দেখে ওর মাসির পরিবার এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে। পরদিন রিশপ আর কোলাখাম যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে সবাই মিলে। দু'দিনের জন্য এমন হুটহাট ঘুরতে যেতে ওর ভালোই লাগে ।
*********
পরদিন ভোরে রুবাই-এর বাবা ডাঃ রাজেশবাবুর নতুন কেনা বড় ট্রাভেরা ওরা চলল পাহাড়ের পথে। টাউন ছাড়াতেই সবুজ চা-বাগানের ভেতর ঢেউ খেলানো পথে ওরা এগিয়ে চলল গরুবাথানের দিকে। পাহাড়ের নিচে উচ্ছল চেল নদীর ধারে বসে মোমো আর কফি দিয়ে ব্রেকফাষ্ট করে ওরা এগিয়ে চলল পাপরক্ষেতির দিকে। মাসির দুই মেয়ে টায়রা আর টিকলির সাথে রুবাই বসেছিল মাঝের সিটে। পিছনে ওর মা শ্রমণা দেবী, মাসি আর মেসো। রাজেশবাবু সামনে। পাপরক্ষেতির বড় ঝর্ণায় নেমে প্রচুর ফটো তোলা হলো। এরপর ছবির মত সুন্দর পাহাড়ী গ্ৰাম ছাড়িয়ে ওরা চলল লাভার রাস্তায়। প্রথম যাবে কোলাখাম, ছাঙ্গে ফলস দেখে আজ ওখানেই থাকবে। চড়াই পথে গাড়ি বেশ কিছুটা উঠে ঢুকে পড়েছে পাইনবনে। মাঝে মাঝেই মেঘ এসে সব ঝাপসা করে দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার কামড় বাড়ছে। সবাই শীতের পোশাকে নিজেদের মুড়ে নিয়েছে। হঠাৎ একটা মোড় ঘুরতেই ড্রাইভার বাবুয়াদা বিচ্ছিরি ভাবে ব্রেক কষতেই রুবাইয়ের মাথাটা জানালায় ঠুকে গেলো। টিকলিও সামনের সিটে আছড়ে পড়েছিল। টায়রা সামনের সিট ধরে ফেলেছিল বলে ব্যথা পায়নি। রুবাইয়ের মা আর মাসিও লাফিয়ে উঠেছিলেন।
আসলে সামনে একটা ওয়াগন-আর -এর দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাড়িটা হেলে পড়েছে পাহাড়ের দিকে আড়াআড়ি ভাবে।
বাবুয়াদা গাড়িটা পার্ক করে নেমে দেখলো সামনের গাড়ির ড্রাইভার জখম হয়ে পড়ে রয়েছে। জ্ঞান নেই।
বাবুয়াদা বলল এটাও মালবাজারের গাড়ি। পলু বলে একটা ছেলে চালায়। তবে এ অন্য ড্রাইভার। পলুকে ফোন করে দিল বাবুয়াদা। রাজেশ বাবু ফোন করলেন লাভা চেকপোস্টে। ডাক্তার বলে এসব নম্বর ওঁর ফোনেই রয়েছে। লাভা চেকপোস্টে ওঁর পরিচিত একজন রয়েছেন।
হঠাৎ রুবাইয়ের মনে হল আগের দিন জ্যেঠু পলু বলেই কাউকে ফোন করেছিলেন গাড়ির জন্য। দশ মিনিট পার হয়ে গেলো অথচ কারো দেখা নেই। এই পথে গাড়ি কম চলে বলে তখনো জ্যাম হয়নি। বাবুয়াদা সবাইকে নামিয়ে কায়দা করে খাদের ধার দিয়ে ওদের গাড়িটা বার করে আনলো। সবাই গাড়িতে উঠে এগিয়ে চলল আবার। বাবা অবশ্য লাভা থানায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে। রুবাই কিন্তু হঠাৎ করে বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। মায়ের ফোন থেকে রাজনদের বাড়ি ফোন করে জেনে নিল জেঠু ভোর বেলায় লাভার পথে পাড়ি দিয়েছেন একটা ওয়াগন-আর-এ।
লাভায় ঢোকার মুখেই লাভা মনাস্ট্রির আগে ডানদিকে নেওড়া ভ্যালি ফরেষ্টের ভেতর দিয়ে পাথুরে পথ নেমে গেছে কোলাখামের দিকে। প্রাচীন সব গাছের জঙ্গল পেরিয়ে ঘন্টা পোকা আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মাঝে ওদের গাড়ি সে পথে এগিয়ে চলল। খাদের ধারে লাভা মনাস্ট্রি লুকোচুরি খেলছে ওদের সাথে। নানারকম পাখি দেখা যায় এ’পথে। মেসো আর বাবা কখনো গাড়ি থামিয়ে পাখি দেখছেন, ফটো তুলছেন। টায়রা টিকলির খুনসুটি চলছে। কিন্তু রুবাই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে ওরা কেউ খেয়াল করেনি। ছাঙ্গে ফলস যাওয়ার পথেই ওদের রিসর্ট, সেখানে নেমে লাঞ্চ সেরে সবাই ছাঙ্গে যাবে তাই ঠিক ছিল। রুবাই আরেকবার রাজনকে ফোন করে অনুরোধ করল ওর জেঠু লাভা পৌঁছে গেছেন কিনা জেনে নিতে। রাজন বলল ওর জেঠুর ফোন নট রিচেবল বলছে যা পাহাড়ে হয়েই থাকে। লাঞ্চের পর হাঁটাপথে ওরা সবাই চলল ছাঙ্গে ফলস দেখতে। জঙ্গলের ভেতর সরু পায়ে চলা পথ। আজকাল প্রচুর নতুন রিসর্ট হয়েছে এই জঙ্গলের ভেতরেও। কয়েকটা তৈরি হচ্ছে এখনো।
বিকেলের পর থেকে চেনা অচেনা পাখির মেলা বসে গেলো চারদিকে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখা যাচ্ছিল। খাদের ওধারে পাহাড়ী গ্ৰাম রিশপের আলোগুলো জ্বলতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে। এমন সময় রাজনের ফোন এলো যে ওর জেঠু লাভায় পৌঁছাননি। পরিত্যক্ত গাড়িটা লাভার দশ কিমি আগে পাওয়া গেছে। ড্রাইভারের এখনো জ্ঞান ফেরেনি, মালেই ভর্তি করা হয়েছে তাকে। ওর বাবা লাভায় রওনা দিয়েছেন খবর পেয়েই।
রুবাই এই ভয়টাই পাচ্ছিল। পরদিন সকালে ওরা রিশপের পথে লাভা মনাস্ট্রিতে গিয়ে রাজনের বাবার সাথে দেখা করেছিল। উনি বড্ড ভেঙে পড়েছেন। জানা গেলো ওঁর দাদার সংগ্ৰহে একটা বহু প্রাচীন পালি ভাষায় লেখা পুঁথি ছিল যা তিব্বতের কোনো প্রাচীন মঠে বহুকাল অবহেলায় পড়েছিল। পুঁথিটার ঐতিহাসিক মূল্য প্রচুর। সেটা নিয়ে দু’একটা সেমিনারে উনি বক্তব্য রেখেছিলেন। কিছুদিন যাবৎ ঐ পুঁথিটার জন্য ওঁর কাছে ফোন আসছিল। কেউ ওটা কিনতে চায়। প্রচুর টাকার অফার এসেছিল। কিন্তু উনি ছিলেন এক নির্লোভ মানুষ। পুঁথিটা লাভা মনাস্ট্রিতে দিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। ওটা দিতেই আসছিলেন হয়তো। মঠের অধ্যক্ষও পুঁথিটার কথা বললেন। পুলিশ কালিম্পং জেলার ছোট বড় সব হোটেল রিসর্ট চেক করেছে সারা রাত ডঃ বড়ুয়ার খোঁজে। ডুয়ার্স শিলিগুড়িতেও খোঁজ চলছে। কিন্তু কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।
রুবাই হঠাৎ সব শুনে বলল -"পুঁথিটা পেয়ে গেলে ওরা ওঁকে ছেড়ে দিত। নয় কিছু করত। একটা লোককে আটকে রাখবে কেন?"
মঠের অধ্যক্ষ বললেন-"পুঁথিটা নিয়ে আসছিলেন কিনা আমিও ঠিক জানি না। ওটা নিয়ে কথা বলতেই আসছিলেন হয়তো। আমায় ফোনেও জানিয়েছিলেন আসার কথা। "
-"তবে ওঁর সাথেই আছে, লুকানো। এখনো ওদের হাতে পড়েনি।" রুবাই দৃঢ় গলায় বলল।
রুবাইয়ের এসব ব্যাপারে আগ্ৰহ রয়েছে। এর আগেও দু'একটা রহস্য উদঘাটন করেছে ও। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দু'একটা কথা বলে একটু পরেই ওরা রিশপ চলে গেলো। যদিও ঘোরায় আর কারোর মন ছিল না। সবার মন ভারাক্রান্ত। ডাঃ বড়ুয়ার খবর না পেলে এই চিন্তা দূর হবে না। কাঞ্চনজঙ্ঘাও ঢাকা সেদিন মেঘের আড়ালে।বিকেল থেকে আকাশ কালো করে বৃষ্টি এসেছিল। পাহাড়ে এসব দুর্যোগ কতটা ভয়ঙ্কর হয় তা’ না দেখলে বোঝা যায় না। ওদের খাদের ধারে কাঠের কটেজটা পিচবোর্ডের বাড়ির মত কাঁপছিল।
বড় বড় পাথর মাটি ধ্বসে পড়ছিল আশেপাশে। জলস্রোত নতুন নতুন ঝরণা সৃষ্টি করে নেমে যাচ্ছিল খাদের দিকে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে এই তাণ্ডব দেখা যাচ্ছিল। ভোরের দিকে শান্ত হয়ে গেলো প্রকৃতি। সকালে উঠে বিধ্বস্ত এই পাহাড়ি গ্ৰামের ছবি দেখে সবাই অবাক, বেশ কিছু বাড়ি ধসে গেছে। রাস্তা ভেঙ্গে পড়েছে। পাহাড় ধসে রাস্তা বন্ধ খবর এলো। রুবাইদের ট্রেক করে লাভা যেতে হবে , কারণ ড্রাইভার বলল গাড়ি যাবে না এই পথে। লাভা থেকে অন্য গাড়ি ভাড়া করে ফিরতে হবে। রাস্তা সারাতে দু'দিন লাগবে। তারপর গাড়ি ফিরিয়ে নেবে বাবুয়াদা। রুবাইয়ের বাবা মাকে ফিরতেই হবে সেদিন। অগত্যা হাঁটাপথে সবাই চলল লাভার দিকে। চার কিমি পথ পুরোটাই উৎরাই । নেওড়া ভ্যালির আদিম অরণ্যর মাঝ দিয়ে এই পথ। বড় বড় গাছের গায়ে পুরু শ্যাওলার আস্তরণ, পরগাছায় নাম না জানা ফুলের সমারোহ, কোথাও বা অর্কিডের ফুল দেখতে দেখতে পথ চলা। কোথাও আবার পথ নেই, ধসে গেছে, ওদের ফরেস্টের ভেতর দিয়ে আসতে হচ্ছিল। জোঁকের উপদ্রব রয়েছে এ’পথে। জোঁক গায়ে লাগলে প্রথমে টের পাওয়া যায় না। ছোট্ট জোঁক রক্ত খেয়ে ফুলে বড় হয় এক সময় টুপ করে খসে পড়ে। তখন আর রক্ত বন্ধ হয় না। একমাত্র লবণ এই জোঁকের হাত থেকে বাঁচায়। যদিও ওরা সবাই ফুল জ্যাকেট, জিনস, মোজা জুতো পরা তবুও সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল। লবণ আনা হয়েছিল জোঁকের ভয়ে।
জঙ্গলের মাঝে দুটো বস্তি চোখে পড়ল মাঝপথে। গভীর জঙ্গলে একটা ফরেস্টের বাংলো রয়েছে। দূরবীন দিয়ে রুবাই দেখেছিল ঐ বাংলোর সামনে একটা ল্যান্ড রোভার রয়েছে দাঁড়িয়ে। এই দুর্গম পথে এই গাড়িই চলে একমাত্র। ভেতরে লোক রয়েছে মনে হচ্ছে কিন্তু সব দরজা জানালা বন্ধ। রুবাই এগিয়ে গিয়েছিল ওদিকে, কৌতূহল সর্বদা ওর একটু বেশি। ঘড়িতে দেখে এগারোটা। ট্যুরিস্ট থাকলে এসময় ঘরে কেন? ও ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছিল। মা মাসি একটা কাঠের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। টায়রা ফটো তুলতেই ব্যস্ত। টিকলি অর্কিড দেখছে। রুবাই বাবাকে কী একটা বলতে গিয়ে থমকে যায়। একটা নেপালী ছেলে বেরিয়ে এসেছে প্রথম ঘরটা থেকে, মুখটা কেমন যেন। একটা মাঙ্কি ক্যাপ পরা, কালো জ্যাকেটটা রঙ চটা। ছেলেটা হিন্দিতে বাবাকে জিজ্ঞেস করে কিছু। বাবা হেসে জানায় যে রাস্তা ধসে গেছে বলে এ পথে ফিরতে হচ্ছে ওদের। কিছুক্ষণ পর আবার হাঁটতে শুরু ওরা। কিছুটা নামতেই লাভা চেকপোস্ট।
কালকের পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেলো রুবাই। বাবা এগিয়ে গিয়ে কথা বলছিল ওঁর সাথে। রুবাই এগিয়ে যায়। বলে -" একটা কথা বলব আঙ্কেল , এই বনের ভেতর যে ফরেস্ট বাংলোটা আছে ওটা দেখবেন তো একবার। একটা গাড়িও রয়েছে দেখলাম।"
-"ওটায় তিনটে নেপালী ছেলে আছে আজ দু'দিন হলো। গেছিলাম কাল।" পুলিশ অফিসার জানান।
একটু ইতস্তত করে রুবাই বলে,
-"এসব বাংলোয় ট্যুরিস্ট এসে কি টানা এতদিন থাকে? আর নেপালীরা পাহাড়েই থাকে। ফরেস্ট বাংলো বুক করে ঘোরে কি? ওদের দেখেও ট্যুরিস্ট মনে হল না কিন্তু। "
-"ক’দিনের বুকিং? কী নামে বুকিং ? একটু খোঁজ নিন প্লিজ। পারলে ফোর্স আনিয়ে নিন।" রাজেশবাবু বলে ওঠেন।
এক কিশোরের মুখে এসব শুনে যে কেউ হয়তো বিরক্ত হত বা রেগে যেত। কিন্তু অফিসারটি ভালো লোক, উনি রাজেশবাবুকে চেনেন, রুবাইয়ের নামও হয়তো শুনেছেন। তাই একটু হেসে বললেন তিনি এখনই সব খোঁজ নিচ্ছেন।
লাভা থেকে ওঁর সাহায্যে গাড়ি ভাড়া করে ওরা মালে পৌছালো দু'ঘন্টা পর। মাসি মেসো মেয়েদের নিয়ে ঐ গাড়িতেই ফিরে গেলেন জলপাইগুড়ি। রুবাই এসেই আকাশকে নিয়ে ছুটল রাজনদের বাড়ি। গিয়েই শুনল রাতে নাকি চোর ঢুকেছিল চিলেকোঠায়। জেঠুর ঘর লণ্ডভণ্ড। তবে কিছু চুরি হয় নি। যদিও সেই পুঁথি কোথায় কেউ জানে না। রাজন বলল সে আগেও খুঁজে দেখেছে। পুঁথিটা কোথাও নেই।
রুবাই এমনটাই আশা করেছিল। এমন সময় খবর পাওয়া গেল ডাঃ বড়ুয়াকে পাওয়া গেছে। উনি ঘুমের ওষুধে আচ্ছন্ন। আপাতত ওঁকে মালবাজার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে আনা হচ্ছে। খবর পেয়েই সবাই হাসপাতালে চলে গেলো। রুবাইয়ের বাবা রাজেশবাবু এই হাসপাতালের ডাক্তার। উনি ছুটিতে থাকলেও খবর পেয়েই এসে গিয়েছিলেন। বিকেল পাঁচটায় পুলিশের গাড়িতে ডাঃ বড়ুয়া এসে পৌঁছলেন হাসপাতালে। আচ্ছন্নতা তখনো রয়েছে। ভীষণ দুর্বল এই দু'দিনেই।
রাজেশবাবু ওঁর জন্য কেবিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরীক্ষা করে স্যালাইন চালিয়ে বললেন -"ওঁকে হরমোনাল ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল কথা বের করার জন্য। হাই ডোজের ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়েছে। একটা রাত কাটলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন উনি। "
লাভা থানার সেই অফিসার রুবাইয়ের চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললেন -"আপকে লিয়ে আজ হাম ডঃ সাব কো ঢুন্ড পায়ে। হামারি আঁখোকে সামনে ও বাংলো মে দো দো দিন উন লোগোঁ নে উনহে রাখা। আজ সুবহ আপনে যব বোলা উসকে বাদ হামনে চুপচাপ ছাপা মারা, দো লড়কোঁ কো ভি পাকড়া। কালিম্পং থানা মে হ্যায় ও দো। লেকিন ডঃ সাব কুছ না বোল সকে। কুছ ভি পুছো বোলতে হ্যায় 'সব তথাগত কে পাস হ্যায়। সব উনকি মরজি।' "
রুবাই মন দিয়ে সব শুনছিল। রাজনের বাবা কিছুই বোঝেননি। বাকিটা খুলে বললেন রাজেশ বাবু। সকালে ঐ বাংলোর সামনে দিয়ে আসার সময় নেপালী ট্যুরিস্ট দেখে রুবাইয়ের সন্দেহ হওয়ার কথা এবং পুলিশে সবটা জানানোর কথা, যার ফলেই এত তাড়াতাড়ি ওঁকে পাওয়া গেল। রাজনের বাবা রুবাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন -"আরো অনেক বড় হও।''
রাজনও খুব খুশি।
পরদিন সকালে ডাঃ বড়ুয়ার জ্ঞান ফিরতেই সবাই ছুটে গিয়েছিল। রাতে রাজেশবাবু ছিলেন ওঁর কাছে। পুলিশ তো ছিলই, ওঁর ভাইও ছিলেন।
জ্ঞান ফিরে সবাইকে আশেপাশে দেখেও উনি খুব চুপচাপ ছিলেন। পুলিশকে জানালেন পুঁথিটার জন্যই ওঁকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওঁর সাথে পুঁথিটা না থাকায় ওঁকে ইনজেকশন দিয়ে সত্যি কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনটে ছেলে ছাড়াও তাংসুই লামা বলে একজন রোজ আসত। লোকটা সিকিমিজ। বইটা পালি ভাষায় লেখা এক যুগান্তকারী দলিল। কোনোভাবে তিব্বতের প্রাচীন মঠে উনি ওটা পান। বইটার ঐতিহাসিক মূল্য প্রচুর। তাংসুই-এর মাথার উপর চোরাবাজারের কোনো বড় মাথা রয়েছে। তবে সে কে উনি জানেন না। হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন এটুকু বলেই। রাজেশ বাবু ওঁকে রিল্যাক্স করতে বললেন। কোনো তাড়া নেই আপাতত।
পুলিশ অফিসার জানালেন ঐ তাংসুই লামাও ধরা পড়েছে রোংলি বাজারের কাছে। ওর ফোন ট্রেস করে ওকে ধরেছে সিকিম পুলিশ। কান টানলে যেমন মাথা আসে এবার পুরো দলটাই ধরা পড়বে হয়তো।
অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল রাজন। এবার বলল -"কিন্তু জেঠু পুঁথিটা কোথায় গো? ওটা তো তোমার ঘরেও নেই!!"
ধীরে ধীরে উঠে বসেন ভদ্রলোক, রুবাইকে ইশারায় কাছে ডাকেন। বলেন -"তোমার তো অনেক বুদ্ধি। আমায় তো উদ্ধার করলে। এবার পুঁথি উদ্ধার করো দেখি!''
ওঁর চোখে কৌতুক ফুটে ওঠে। রুবাই ভ্রু কুঁচকে বলে -"আমি কি করে জানব?''
-''আজকের দিনটা সময় দিচ্ছি। আমি ক্লু দিচ্ছি, ভেবে দেখো একটু,- সব রয়েছে তথাগতর কাছে, ওঁর ইচ্ছাই সব।'' মিটিমিটি হাসতে থাকেন ডাক্তার বড়ুয়া। রাজনকে বলেন -"তুই কি পারবি?''
ও মাথা নাড়ে। সব মিটলে পুলিশরা ফিরে যেতেই ডঃ বড়ুয়ার ভাই রাজেশবাবুর সাথে আলোচনা করে ওঁর ছুটি করিয়ে নেন। রাজন ওর বাবার সাথে জ্যেঠুকে বাড়ি নিয়ে যায়।
রুবাইও বাড়ি ফিরে মাথা ঘামাতে বসে যায়। তথাগত মানে বুদ্ধ ও জানে। জেঠুর স্টাডিতে বড় মূর্তি রয়েছে তথাগতর। কিন্তু তার কাছে মানে তো ঐ ঘরেই। রাজন তো খুঁজে দেখেছিল। চোরও খুঁজেছিল। কেউ পায়নি। তবে আর কোথায় হতে পারে?
নেট খুলে বসে রুবাই। বুদ্ধদেব এবং বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে পড়তে থাকে। জেঠুর বলা কথাটা মনে পড়ে। অফিসার বলেছিলেন ঘোরের মধ্যে এই কথাটাই উনি বলেছিলেন বারবার। এই কথাটাই টাইপ করে এবার রুবাই। ওর সামনে বেশ কয়েকটি জানালা খুলে যায়। পড়তে পড়তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রুবাইয়ের মুখ। বিকেলে রাজেশবাবু আর শ্রমণা দেবীর সাথে আবার রুবাই যায় রাজনদের বাড়ি। অনেকেই এসেছিল ডাঃ বড়ুয়াকে দেখতে। রুবাই রাজনকে নিয়ে বেরিয়ে যায় একটু। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা চলে যেতেই ওরা ফিরে আসে, ততক্ষণে অনেকেই চলে গেছে। বাড়ি প্রায় ফাঁকা।
ডাঃ বড়ুয়া অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। রুবাইকে দেখে মিটিমিটি হেসে বললেন -"ক্যাপ্টেন, কী খবর ? খোঁজ পেলে নাকি?"
রুবাই হেসে বলল -"আছে তো, তথাগতর কাছে খুব যত্নেই রয়েছে। আমি এইমাত্র দেখে এলাম। ''
রাজন সহ সবাই ওর দিকে তাকালো সাথে সাথে। রাজন বলল -"আমরা তো বুদ্ধ মন্দির গিয়েছিলাম এখনি। কোথায় দেখলি তুই?''
রুবাই হাসে জেঠুর দিকে তাকিয়ে। ডাঃ বড়ুয়া সোজা হয়ে বসেন। বলেন -"তোরা মন্দিরে গিয়েছিলি? ''
-"আগেকার দিনে যখন কেউ কোনো কাজে বাইরে যেত নিজেদের অমূল্য সম্পদ ধন রত্ন মঠে গচ্ছিত রাখত। তথাগতর ভরসায় সব রেখে নিশ্চিন্তে সবাই ভ্রমণে যেত। আপনিও তাই করেছেন। বুদ্ধ মন্দিরেই গচ্ছিত রেখেছেন আপনার সম্পদ। যদি আমার ভুল না হয় মূর্তির পায়ের কাছে বিভিন্ন পুঁথি ও ধর্মগ্ৰন্থর ভেতর রয়েছে ওটা।"
ডাঃ বড়ুয়ার চোখ মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে।
এগিয়ে এসে রুবাইকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। বলেন -"আমি এতটা আশা করিনি। সত্যিই তুমি জিনিয়াস। আমি জানতাম লাভায় ওটা নিয়ে পৌঁছনোর আগেই ওটা ওরা কেড়ে নেবে। আমার ফোন ট্যাপ হতো। তাই বাধ্য হয়ে এটা করেছিলাম। মালের মঠ এত ছোট যে কারো মাথায় আসবে না আমি ওটা ওখানে রেখেছি। কিন্তু তুমি পারলে! এবার বলো কী চাও আমার কাছে? তোমার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় আমি বাড়ি ফিরতে পেরেছি আজ।''
-"তুমি সুস্থ হলে ঐ চীন ভারত যুদ্ধের গল্পটা পুরো শুনতে চাই। এমন গল্প আরো অনেক অনেক শুনতে চাই। '' রুবাই বলে।
সবাই হেসে ফেলে ওর দাবী শুনে।
ঘড়ি মোড়ের ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত ন’টা বাজে।
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণঃ রঞ্জন দাস
দারুণ গল্প দেবদত্তা।
ReplyDeleteধন্যবাদ হিমুদা, আমি এখন পড়বো।
Deleteবাহঃ দারুণ গল্প। খুব ভালো লাগল পড়তে :)
ReplyDeleteধন্যবাদ,
Deleteবাহ্ খুব ভালো। এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম।
ReplyDeleteBah khub valo laglo!
ReplyDelete