Pages

গল্পের ঝুলি : ভজামামা ও ভিক্স কি গোলি : হিমাংশু চৌধুরী






ভজামামা বললো, " আমার মামাবাড়িতে যে আমগাছ ছিলো না? তার কাছে এসব আম নস্যি! তার খোসারও যোগ্য নয়।"

আমগুলো টাবলুই এনেছিলো, ওর পিসেমশায় পাঠিয়েছেন চন্দননগর থেকে। এতক্ষণ ধরে গুছিয়ে খেয়ে আঁটি চুষে খটখটে করে তবে ছেড়েছে ভজামামা, মনে হচ্ছিলো, পারলে আঁটিগুলোও বোধহয় খেয়ে ফেলবে। খোসাগুলোও ছাড়েনি, চুষতে চুষতে সেলোফেন পেপারের মতো করে ফেলেছে। তারপরে হাত-ফাত ধুয়ে বিশাল একটা ঢেকুর তুলে সেই মামাবাড়ির আমের গল্প জুড়ে বসেছে। টাবলু তো রেগে কাঁই। 

"সেই একই গল্প তো কবে থেকে শুনিয়ে যাচ্ছো, খাওয়ালে তো আর না!"

ভজামামা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললো, "আরে সে আমবাগান কি আর এখন আছে, থাকলে দেখতিস।"

ভজামামাকে এইসময় একটু তাতিয়ে দিতে পারলে একটা গপ্প বাঁধা। সবাই মিলে কলে হাত ধোওয়ার সময়ে তাই বললাম, "কোনওকালেই কি ছিলো ভজামামা?" 
আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভজামামা শুরু করলো।


"আমার কুট্টিমামার বাড়ি যে পলাশীর কাছেই আমডাঙা গ্রামে, তা তো তোরা জানিসই। মামার প্রপ্রপ্রপ্রপ্রপিতামহ হেরম্বচন্দ্র ছিলেন কলকাতায় লর্ড ক্লাইভের মুনশি।  মুনশিগিরি করে তিনি অনেক পয়সা কামিয়েছিলেন। পৈতৃক সম্পত্তি বহুগুণ বাড়িয়ে প্রায় গোটা গ্রামে উনি জমিদারি পত্তন করেছিলেন।

সন ১৭৬৬, লর্ড ক্লাইভ তখন দ্বিতীয় দফায় বড়লাট হয়েছেন। একদিন তিনি তার বিশ্বস্ত মুনশির জমিদারিতে ছুটি কাটাতে এলেন। এছাড়াও, এখানেই সিরাজদ্দৌল্লার সাথে সেই বিখ্যাত ব্যাটল অফ প্লাসি হয়েছিলো, যার পরে বেঙ্গলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মসনদ কায়েম হয়। সেই যুদ্ধস্থল ঘুরে দেখারও একটা আগ্রহ ছিলো ক্লাইভের। আমবাগানের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে। জষ্ঠি মাস, কিন্তু রোদের প্রখর তাপ গাছের চাঁদোয়া ভেদ করে নীচে পৌঁছাতে পারেনি। বাগানের মধ্যে আম পেকে পেকে গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে, গন্ধে মাতোয়ারা চারিদিক। ঘোড়ায় চেপে যেতে যেতে ক্লাইভ সে আমের গন্ধে পাগল হয়ে উঠলেন। ততদিনে তিনি বেঙ্গলের আমের বিশাল ভক্ত হয়ে উঠেছেন। বললেন, "মুনশি, ইহা কি জাটির আম আছে?" 

আসলে জানিস তো, আমার মামাবাড়ির গোলাপখাস আম এক দেখার মতো জিনিস ছিলো। পুরো আমটাই সাহেবের ফর্সা গালের মতো গোলাপি। পাতলা খোসা, দেখলে মনে হবে, খোসাই নেই, আর সেরকমই গন্ধ! তিনটে আমে এক সের ওজন হবে। সাহেবের আগ্রহ দেখে হেরম্বচন্দ্র বুদ্ধি করে বললেন,
"সাহেব, এই আমের নাম সাহেবখাস।" 
"সাহেবখাস টো সাহেবকো খিলাও!"  হা হা করে হেসে ক্লাইভ বললেন।

তখনও বাড়ি দুই ক্রোশ দূরে। অগত্যা, সেখানেই তাঁবু ফেলে আম পাড়া হলো। পুষ্করিণীর ঠান্ডা জলে সেই আম দু'দণ্ড ভিজিয়ে রেখে তয়ের করা হলো। লোক চলে গেলো ঘোড়ায় চেপে জমিদারবাড়ি।  সেখান থেকে গিন্নীমা আম কাটার আর পরিবেশন করার সরঞ্জাম পাঠিয়ে দিলেন।

তারপরে হেরম্বচন্দ্র নিজের হাতে হাতির দাঁতের বাঁটঅলা ছুরি দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে বাঁখারির পাতলা চোঁচ দিয়ে আম কেটে ফুলকারি করা বিলিতি চিনামাটির প্লেটে করে বড়লাটকে দেন, আর তিনিও খেয়ে চলেন, একের পর এক। এর মধ্যে কি হলো, একটা আম হেরম্বচন্দ্র খোসা ছাড়াতে ভুলে গেছেন, খোসা না ছাড়িয়েই কেটে ফেলেছেন। আর সাহেবও খেয়াল না করে খোসাসমেত খেয়ে ফেলেছেন। সে এমন পাতলা খোসা, খাওয়ার আগে বোঝার উপায় নেই কোনও। বাঙালি হলে হয়তো খাওয়ার সময় বুঝতে পারতো, কিন্তু সাহেব অতশত খেয়াল করেননি, নেশার মতো খেয়ে চলেছেন। এবারে খাওয়ার পরেই তো সাহেবের গলা চুলকাতে শুরু করেছে। দ্যাখ না দ্যাখ, গলা ফুলে ঢোল হয়ে গেল। হেরম্বচন্দ্রের তো তখন ভয়ে আধমরা অবস্থা। তাঁর বাগানের আম খেতে গিয়ে যদি বড়লাট মারা পড়েন, তাহলে তো তাঁর গর্দান যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। পালকি বেহারা লাগিয়ে সাথে সাথে তিনি বড়লাটকে এনে ফেললেন তাঁর বাসায়। সেখানে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবছেন কি করা যায়। বিখ্যাত হেকিম ডাক্তার কবিরাজ সবাইকে আনতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন চতুর্দিকে, এমন সময়ে পত্নী বিক্রান্তাদেবী ঘরে ঢুকে বললেন, "সাহেবকে একটু আরক তৈরি করে দিচ্ছি, খাইয়ে দেখো তো।"

বিক্রান্তাদেবী মৈথিলী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। পিতা হরিবংশ শর্মা ভিষগাচার্য হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার শিক্ষা কিছুটা তার মেয়ের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তো তিনি বেশি করে পুদিনা, যষ্টিমধু, বচ, লবঙ্গ আর আদ্রকচূর্ণ আর কি কি জানি মিশিয়ে প্রস্তুত করা ঘন আরক কয়েক ফোঁটা খাইয়ে দিলেন বড়লাটকে। ব্যস, নিমেষে সাহেবের গলার চুলকানি কমে গেলো। আরো দু দাগ খাওয়ানোর পরে ব্যথাও ভ্যানিশ। লর্ড ক্লাইভ তো লাফাতে লাগলেন উত্তেজনায়।

"হোয়াট মেডিসিন ইউ গেভ মি বাবু?"
"সার, মাই বিবি বিক্রান্তা মেড দিস।"
"ওয়েল, উনাকে হামার কাছে আনো, হামি শুনিবে।"

 আসলে হয়েছে কি, সাহেবগুলো ইন্ডিয়াতে আসার পর থেকেই হোমসিক হয়ে পড়তো। তখন হোমের কথা মনে করার জন্য বরফ এনে খেত, গায়ে মাখাতো, এইসব করতো। তখনও কোনও বরফকল ছিলো না কোলকাতায়। বড় বড় বরফের জাহাজ সাগর পাড়ি দিয়ে এসে ভিড়তো খিদিরপুর ডকে। সেখান থেকে টুকরো টুকরো করে বিক্রি হতো। নেটিভরা সরবৎ খাওয়ার জন্য, বড়মানুষিয়ানা দেখাবার জন্যে, আর সাহেবরা গরম কমাবার জন্য, আর হোম ওয়েদারের কথা মনে করার জন্য ওই বরফ কিনে নিয়ে যেত। এখন কলকাতার ঐ প্যাচপেচে গরমে আদেখলার মতো বরফ মেখে সাহেবরা সবসময় সর্দিকাশিতে ভুগতো। ক্লাইভ দেখলেন, এই আরক তৈরি করার প্রণালীটা জেনে নিলে সেটা তিনি কলকাতায় গিয়েও তৈরি করতে পারবেন, আর বাকি সাহেবদের চিকিৎসার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত হবে, কোম্পানির কর্মচারীদের এফিশিয়েন্সি বাড়বে। তার নিজেরও এ-বাবদ কিছু রোজগার হবে।

হেরম্বচন্দ্র অন্দরমহলে খবর পাঠালেন গিন্নিমাকে ডেকে দেবার জন্যে। বিক্রান্তাদেবী এসে পৌঁছালে হেরম্বচন্দ্র তাকে বললেন, "দেখো তো গিন্নি, সাহেব তোমার আরক কি কি দিয়ে তৈয়ার করো আর তৈয়ারিপ্রণালী জানতে চেয়েছেন। উনি শিখতে চান।"

তারপরে দরজার আড়াল থেকে বিক্রান্তাঠাকুমা তার ওষুধের ফর্মুলা বললেন, আর সাহেবকে হেরম্বচন্দ্র তা অনুবাদ করে শোনালেন। সাহেব সেটা তার নোটবইতে টুকে নিলেন। তারপরে কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাহেব তার ভাই বেরাদরদের গলায় খিচখিচ এই আরক খাইয়ে ঠিক করে চললেন। কি খাওয়ানো হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলতেন "ভিক'স ফর্মুলা," বিক্রান্তাদেবীর পুরো নাম ঐ সাহেবি জিভে উচ্চারণ করতে পারতেন না।"

"তারপর?"

"তারপরে আর কি! লর্ড ক্লাইভের সাথে কাউন্সিলের ঝামেলা চলছিলো। ১৭৬৭ সালে তিনি একেবারে ইংল্যান্ডে ফিরে যান, আর ভারতে আসেননি কোনওদিন। সেখানে তিনি মেয়েকে এই 'ভিক'স ফর্মুলা' তৈরি করতে শিখিয়ে দেন। বংশপরম্পরায় এই ফর্মুলার জ্ঞান তাঁর পরিবারেই সীমাবদ্ধ থাকে। ক্লাইভের মেয়ের দৌহিত্রের নাতনী,  মেরি লিন, বিয়ে করেন লুন্সফোর্ড রিচার্ডসন নামে এক আমেরিকানকে। তিনি ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন।  বিয়ের পরে তারা থিতু হন নর্থ ক্যারোলিনায়, রিচার্ডসনের পৈতৃক বাড়ির কাছেই। রিচার্ডসন ছিলেন কেমিস্ট, এবং বৌয়ের কাছ থেকে এই ভিক'স ফর্মুলাটি হাতিয়ে তার আধুনিকীকরণ করে ১৮৮৫ সাল নাগাদ মলম, লোশন আর বড়ির আকারে বাজারজাত করেন, আর নাম দেন, ভিক'স ম্যাজিক ফর্মুলা ফর কাফ এন্ড কোল্ড, ভিক'স ভেপোরাব, ইত্যাদি। একবছরের মধ্যে তা সুপারহিট হয় আর রিচার্ডসন হয়ে যান মিলিয়নেয়ার- সবই আমার ঐ প্রপ্রপ্রপ্রপ্রপিতামহী বিক্রান্তাঠাকুমার আরকের দৌলতে, বা বলতে পারিস মামাবাড়ির ঐ সাহেবখাস আমের দৌলতে।  আর এখন তোরা যে ভিক্স কি গোলি খাস, সে-ও আমার ঐ বিক্রান্তাঠাকুমারই আবিষ্কৃত আসলে।"

এই বলে টাবলুর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটা একটা চাঁটি মেরে বন্ধ করে দিয়ে ভজামামা তার লম্বা লম্বা পা চালিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল কে জানে।

(সমাপ্ত )


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী


13 comments:

  1. গল্পটা পড়ে ছবি আঁকতে আঁকতে মনে হয়েছিল, চমৎকার একটা ছোটদের নাটক হয়ে যায়, কিছুটা টেনিদার আষাঢ়ে কিন্তু সত্যি মনে হওয়া গল্পের মত। Absolute Favourites এর তালিকায় রইলো এই গল্পখানা। 😄

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুধু বলি, এত্ত সুন্দর একটা ছবি দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। গল্প আপনার ভালো লেগেছে, আমি খুব খুশি তার জন্য। আরো খুশি কিশলয়ের জন্মলগ্নের সাক্ষী হতে পেরে।

      Delete
    2. This comment has been removed by the author.

      Delete
  2. গল্পটা পড়ে মনে হল শুকতারা বা আনন্দমৈলায় কোনো হাসি র সংখ্যা পড়ছি। এত ভালো ছোটদের হাসির গল্প বহুদিন পর পড়লাম। ভজা মামার নতুন গল্পের আশায় থাকলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেবী, ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা তোমার জন্য। তোমার গল্পটাও ভালো লাগলো খুব।

      Delete
    2. দেবী, ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা তোমার জন্য। তোমার গল্পটাও ভালো লাগলো খুব।

      Delete
  3. প্রথমত, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এত্ত সুন্দর একটা ছবি উপগার দেওয়ার জন্য। আপনার ভালো লেগেছে, আমি খুব খুশি। দ্বিতীয়ত, কিশলয়ের জন্মলগ্নের সাক্ষী হতে পেরে গর্ব অনুভব করছি। প্রিয় লেখক লেখিকাদের সাথে আমার লেখা... ফিলিংটা জাস্ট অসাম। এখন যাদের জন্য লেখা, সেই পাঠকরা কি বলে দেখা যাক।

    ReplyDelete
  4. অসা গল্প! টেনিদা-ঘনাদা ঘরানায় ভজামামা-র আরও কিছু অ্যাডভেঞ্চার তথা গুলগল্প পাব ভবিষ্যতে, এই আশায় রইলাম।

    ReplyDelete
  5. হা হা হা....ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আরো এরকম গুল্প আসতেই পারে, যদি কিশলয় কর্তৃপক্ষ চান।

    ReplyDelete
  6. হা হা হা....ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আরো এরকম গুল্প আসতেই পারে, যদি কিশলয় কর্তৃপক্ষ চান।

    ReplyDelete
  7. বেশ হয়েছে গল্পটা। এরকম আরো পড়ার আশায় রইলাম। খুব ভালো দাদা। আর স্বর্ণ- ছবিটা খাসা হয়েছে রে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরীর আঁকা ছবিটা জবরদস্ত হয়েছে। তাকেও ধন্যবাদ।

      Delete
    2. অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরীর আঁকা ছবিটা জবরদস্ত হয়েছে। তাকেও ধন্যবাদ।

      Delete