Pages

গল্পের ঝুলি : অপহরণের আড়ালে : শেলী ভট্টাচার্য (অন্তহীনা)



'ও খুকি ও সোনা
মুখখানা কেন ভার?
আমার কাছেতে আছে
ম্যাজিকের সম্ভার।'

**********************

"প্রভাতদা, স্বপ্ননীড় কমপ্লেক্স এরিয়ার কেসটার তো কিছুতেই কোনো ক্লু বের করা যাচ্ছে না। আজ আবার একটা বাচ্চার মিসিং রিপোর্ট লজ হল।"
সাব ইন্সপেক্টর বিভাস দাসের কথায় হাতের কাজটা নামিয়ে রেখে বকুলতলার সিনিয়র ইন্সপেক্টর প্রভাত সরকার উত্তর দিলেন,

"কী বলছো দাস? আবার বাচ্চা মিসিং হল?"

"হুম। কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে উপর থেকে ওসিও চাপ দিচ্ছেন। আর সত্যি মানবিক দিক থেকেও বড্ড খারাপ লাগছে।"

"আচ্ছা, ওই কেস হিস্ট্রিটা বের করো দেখি। একবার চোখ বুলিয়ে নি। তারপর জীপ বের করো। একবার বাচ্চাটার ঘরে যাব।"

বিভাস কাগজগুলো বের করতে করতে বললো,
"একই কমপ্লেক্সে একটা বাচ্চা এক মাস আগে নিখোঁজ হবার পরও কি বাপ মায়েদের একটু হুঁশ হলো না, যে বাচ্চাদের একটু নজরে নজরে রাখবে! নিজেরা খেয়াল রাখবে না, আর কিছু হলেই ছুটে আসবে আমাদের কাছে।"

প্রভাত বাবু তখন বেশ মনোযোগ সহকারে পাতাগুলো উলটে পালটে দেখছিলেন। অত:পর বললেন,
"আচ্ছা, প্রথম বাচ্চাটার নাম তো মিলি ছিল, বয়স ছয়। বাবা প্রাইভেটে কাজ করেন। মা গৃহবধূ। বাচ্চা পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিল। মার্কস বাজে আসায় ঘরে বকাঝকা হয়েছিল। এরপর একদিন বিকালবেলায় খেলতে বেরিয়ে সে আর ঘরে ফেরেনি। আর সেই নিখোঁজ হওয়ার ডেটটা ছিল ১২ই জুলাই।
এবার আজকের কেসটা যতটুকু তুমি জানো বলো তো আমায়।"

বলে মি: সরকার তাকালেন বিভাসের দিকে।

বিভাস বলা শুরু করলো,

"আজকের বাচ্চাটার বয়স আট বছর, নাম বিদিশা। বাচ্চাটির বাবা ব্যাঙ্ক কর্মী। মা গৃহবধূ। এই বাচ্চাটি স্কুল থেকে ঘরে ফেরার সময় স্কুলভ্যান তাকে অ্যাপার্টমেন্ট গেটে নামিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু তাকে তারপর আর দেখতে পাওয়া যায়নি। বাচ্চাটি বেশ শান্ত স্বভাবের ছিল। আর মিলির খুব ভালো বন্ধুও ছিল।"

"সত্যিই চিন্তার বিষয়। একটা কমন এরিয়া থেকে কীকরে পরপর দুটো বাচ্চা নিখোঁজ হয়ে গেল? আর কারো চোখে কিছুই পড়লোই না? আর কিডন্যাপিংই যদি হতো, তো একই এরিয়া থেকে এক মাসের মাথায় দুটো বাচ্চা পরপর তুলে নিতে কিডন্যাপারের সাহস হল কী করে? এই অপহরণের আড়ালের উদ্দ্যেশ্যটাই বা কী? মেয়েপাচার?"

চিন্তান্বিত প্রশ্ন করে উঠলেন মি: সরকার।

"হতে পারে, অপহৃত দুটো বাচ্চাই তো মেয়ে। তবে যা বুঝছি, খুব চতুর কারো কাজ এটা। আর অবশ্যই তার সাংঘাতিক বুকের পাটা আছে। কিন্তু এমন রিস্কি কাজ সে এতো ঘনঘন করবেই বা কেন? যেখানে আগের ঘটনার পর আমরা পাঁচ-ছয়বার করে রাউন্ডে গিয়েছি। পরের দশদিন এক হাবিলদারকেও আশেপাশে নজর রাখতে বসিয়েছিলাম।"


"কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না তাতে। একবারও তো কিডন্যাপারের টিকিও ধরা যাচ্ছে না। আমার কেন জানি কমপ্লেক্সের মধ্যের কারো জড়িত থাকার কথা মনে হচ্ছে। নইলে ..."

কথোপকথনের মধ্যেই কনস্টেবল বিশু এসে জানিয়ে গেল, জীপ রেডি আছে।

তখন প্রায় বিকেল চারটে হবে। কমপ্লেক্সের মধ্যে পুলিশের গাড়ি ঢুকতেই ভেতরের একটা স্বাভাবিক উত্তেজনা ঘিরে ধরলো গাড়িটাকে। চারদিকের প্রশ্নগুলোও খুব মর্মান্তিকভাবে আসতে শুরু করলো। মি: সরকার আর মি: দাস কোনোরকমে সব কাটিয়ে ব্লক ৬, ফ্ল্যাট ৪- সিয়ের দরজার সামনে দাঁড়াতেই শিলাদিত্য চন্দ, মানে মিসিং মেয়ের বাবা বেরিয়ে এলেন। ঘরে ঢুকে পুলিশ বুঝলেন পরপর দুটো বাচ্চা মিসিং হওয়ায় মারাত্মক এফেক্ট ফেলেছে মাবাবার উপর। বাচ্চাটির মা কিছুক্ষণ পর পর ফিট হয়ে যাচ্ছেন। বাবা কোনোরকমে কথা বলার অবস্থায় আছেন। 

শোনা গেল, বাচ্চাটি সেদিন স্কুলে যেতোই না যদি না পুকাই তাকে ডাকতে আসতো। কারণ তার মা আগের ক'দিন বাড়িতে ছিলেন না। আশপাশ থেকে বাচ্চাটির মা বাবার মধ্যের দাম্পত্যকলহের ইঙ্গিত পাওয়া গেল তার কারণস্বরূপ। সব শুনে পুলিশ একবার পুকাইকে ডেকে কথা বললেন। পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে পুকাই, তেমন কিছুই সঠিকভাবে বলতে পারে না। তার উপরে পুলিশ দেখলে তোতলায়। তাও ভাঙা ভাঙা ভাবে বললো "মিট্টি, বিল্টু সবাই বললো বিদিশাদি দু'দিন স্কুল যায়নি, আজ ডেকে আন। তাইতো ডাকতে গিয়েছিলাম।"

ফেরার পথে গাড়ির মধ্যে মি: সরকার ও মি: দাস দুজনেই স্তব্ধ ছিলেন। সেটা ফ্ল্যাটের লোকেদের কটূক্তি বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কারণে নয়। বরং নিজেদের আরো সচেতন না থাকার কারণটাই বিবেকে পিন ফোটাচ্ছিল যেন। বাচ্চার কেস, সত্যিই ভীষণ সেন্সিটিভ হয়। সেখানে পরপর দুটো জলজ্যান্ত বাচ্চা নিখোঁজ হয়ে গেল। মি: সরকার থানায় গিয়েই এক গোপন অনুসন্ধানকারী শিবুকে ডেকে পাঠালেন। আর ওকে টানা ওই এরিয়াতে বিবিধ ক্যাজুয়াল পোষাক পরে নজর রাখতে বললেন। পারলে আরো একজনকেও জোগাড় করতে বললেন ওর কাছেপিঠে থাকার জন্য। 

অতঃপর চিন্তান্বিত কণ্ঠে মি: সরকার মি: দাসকে বললেন, 
"পারলে একটু বাচ্চাদুটোর পারিবারিক দিকে কোনো শক্র আছে কিনা খবর নিন তো। এখন মানুষ নামেই মানুষ আছে শুধু, আসলে পিশাচ হয়ে গেছে। হতে পারে দুটো কেসের ভিউ আলাদা আলাদা। আরো ইনভেস্টিগেশন চালাতে হবে।"

"হ্যাঁ স্যার, ঠিকই বলেছেন। হতে অনেককিছুই পারে। আমি আজই লোক লাগাচ্ছি।" 

সম্মতিসূচক সুরে বললেন মি: দাস। 

কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ঘটনার সাতদিন কেটে যাওয়ার পরও কোনো সুরাহা করা সম্ভব হল না।

**********************

পুকাইয়ের দাদা অদ্রীশ মিশনারিজ স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। বেশ মেধাবী ছাত্র সে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে ছুটিতে আসে। সেরকমই সে এসেছে ঝুলন আর রাখীপূর্ণিমার ছুটি 
উপলক্ষ্যে। এসেই এসব খবর শুনে খুব মন খারাপ হয়ে যায় তার। ছোটো ছোটো বোনদুটোর মুখগুলো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পুলিশের নির্দেশে সব বাচ্চাদের বিকালের খেলার মাঠে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে ওরা বসে গল্প করতে থাকে। 

বাড়িতে আসলেই অদ্রীশ অ্যাপার্টমেন্টের ব্লক ৫ এর একটা ফ্ল্যাটে যায়। সেখানে একজন বয়স্কা মহিলা থাকেন, যাঁকে সবাই মামমাম বলে ডাকে। তিনি প্রায় বছর দেড়েক ধরে বেশ অসুস্থ। ছেলে বাইরে থাকেন। ঘরে চব্বিশ ঘন্টার জন্য একজন আয়া মিনতিমাসি থাকে। এই মামমাম অদ্রীশের ঠাকুমার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তাই ঠাকুমা মারা যাওয়ার পরও অদ্রীশ তার কাছে এসে ঠাকুমাদের আগের জীবনের গল্প শোনে। মনটা ভালো হয়ে যায় তার। 


সেদিনও তাই সেখানে আসতে দেখলো লিফটটা খারাপ, তাই তিনতলায় সিঁড়ি বেয়েই উঠতে লাগলো। অত:পর একতলা ক্রস করে দোতলার দিকে যেতেই অচেনা দুজনের কথোপকথন কানে আসে তার। একজন বয়স্ক মহিলার কণ্ঠ আর একটি অল্পবয়সী ছেলের গলা ...
"বুবুন তুই বুঝছিস না, এসব করে কিচ্ছু হবে না।"


"না মা, তুমি জানো না। ওই বাবা বলেছেন, এভাবেই হবে। তুমি কি চাও না তোমার এই ছেলেটা বাঁচুক?" 


"আমি অবশ্যই চাই বাবা। কিন্তু তার জন্য এতো বড় রিস্কের কাজ আর করিস না তুই।"


"দেখো মা যেটার যা নিয়ম, তা তো করতেই হবে। তুমি শুধু তিন নম্বরটার ব্যবস্থা করে দাও আমায়। ব্যস, তবেই আপাতত আমার কাজ শেষ।"


"বুবুন, বোঝার চেষ্টা কর। ও খুবই ছোটো। তাছাড়া লোকজন এখন খুব সচেতন হয়ে গেছে ..." 


এমন সময় পেছন থেকে অদ্রীশের কাঁধে হাত পড়লো একজনের,

"কীরে, এখানে কী করছিস? মামমামের সাথে দেখা করতে এসেছিস?"

অদ্রীশ চমকে পেছনে চেয়ে দেখলো বিতান আঙ্কেল। খেয়াল করলো উপরের কথোপকথনটা আর শোনা যাচ্ছে না। তারপর আঙ্কেলের দিকে চেয়ে উত্তর দিল "হ্যাঁ"। তারপর দুজনের কিছু কুশলমঙ্গলজাত কথোপকথনের সময় অদ্রীশের নজরে এলো একটা কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে উপরের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে তাকে ক্রস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারোর দিকে কৌতূহলবশতও চেয়ে দেখলো না সে। ছেলেটার গায়ের রঙ চাপা। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। আর কেমন একটা দীর্ঘ অসুখে ভোগা চেহারার ছাপ রয়েছে চোখে মুখে। অত:পর অদ্রীশ উপরে মামমামের ঘরে উঠতে উঠতে ভাবলো, কোন মহিলার সাথে এই ছেলেটা কথা বলছিল? 


এই অ্যাপার্টমেন্ট বেশ পুরানো। প্রথমদিকের অনেকেই নিজেদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে শহরের বুকে ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট নিয়েছে। তাই সবাইকে এখন চেনেও না সে। তারপর আবার সে এখানে মাঝেমধ্যে আসে। এসব ভাবতে ভাবতে সে এসে পৌঁছালো মামমামের ফ্ল্যাটের সামনে।


সেদিন রাতে শুয়ে অদ্রীশের চিন্তায় ঘুরতে লাগলো ওই সিঁড়িতে শোনা কথাগুলো। কী বিষয়ে কথা হচ্ছিলো ওদের? কে ওই ছেলেটা? আর লোকজনের সচেতনতার প্রসঙ্গ কেন উঠেছিল মহিলার মুখে? অনেকক্ষণ ধরে ভেবেও অদ্রীশের মাথায় তেমন কোনোকিছুই আসলো না ওই কথাগুলোকে ঘিরে। অগত্যা ধরে নিল, হয়তো এমনিই মা ছেলের মধ্যের কোনো কথা হচ্ছিলো।

**********************

প্রায় দিন দশেক পরে অদ্রীশ আবার ফেরে ফ্ল্যাটে, হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের একটা ছোট্ট ছুটিতে। সেদিন বাড়ি ফিরবার পথে ওদের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের খেলার মাঠে ওর পরিচিত দু'তিনটে বাচ্চা ওর চোখে পড়ে। তাদের মায়েরাও ছিল কাছেপিঠে। একা না ছাড়লেও ওরা এখন যে মায়েদের সাথে বাইরে খেলতে বেরিয়েছে, সেটা দেখে ভালো লাগে অদ্রীশের। সামনে এগোতেই দেখে এক বয়স্ক বেলুনওয়ালা দাঁড়িয়ে। বেলুন বিক্রির জন্য বাচ্চাদের দিকে চেয়ে আকর্ষক ডাক দিচ্ছে সে। তাকে পাশ কাটিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে একটা ছোট্ট মেয়ে পরির মতো ফ্রক পরে কুটুস কাটুস করে কথা বলতে বলতে একজন মাঝবয়সী মহিলার সাথে গেটের দিকে যাচ্ছে। বাচ্চাটা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে শিশুসুলভ উত্তেজনায় বলছে 'বেলুন'। অত:পর নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকে অদ্রীশ। ঠিক তখনই হঠাৎ তার খেয়াল হয়, ওই বেলুনওয়ালাকে আগে কোথাও যেন দেখেছে ও। একমনে চিন্তা করতেই মনে পড়ে যায় সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা ছেলেটার মুখটা। কিন্তু সে বেলুনওয়ালার বেশে বয়স্ক লোক সেজে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? তবে কি সে-ই ছেলেধরা?


ভাবতেই আঁৎকে ওঠে ওর ভেতরটা। এক মুহূর্ত দেরি না করে ও ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে যায় সেই জায়গায়। কিন্তু সেই বেলুনওয়ালাকে আর কোথাও দেখতে পায় না সে। তারপর বাচ্চাগুলোকে ডেকে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে যে, বেলুনওয়ালা নাকি গত দু'দিন ধরে এখানে আসছিল। আগে তাকে কোনোদিনই দেখা যায়নি। বুকের ভেতরটা একটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে অদ্রীশের। সে তখনই বাবাকে ফোন করে সবটা জানায়। আর এক ঘন্টার মধ্যে তার বাবার সাথে পৌঁছে যায় থানায়। সেখানে সব কথা খুলে বলে অদ্রীশ। ঠিক তখনই ওদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফোন আসে।

আর জানা যায় যে, মামমামদের বিল্ডিংয়েরই একটা ফ্ল্যাটে থাকা এক পরিবারের তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটিকে বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাথে তার আয়াটিরও কোনো পাত্তা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে তার কর্পোরেটে কর্মরত মা বাবা থানায় এলে অদ্রীশের মনের আশঙ্কাটা বাস্তবরূপ পায়, বাচ্চাটির আর তার মধ্যবয়স্কা আয়ার ছবি দেখে। অদ্রীশের সাথে আরো কথা বলে আর পারিপার্শ্বিকতা বিচার করে পুলিশ যেন এতোদিনে একটা সূত্র খুঁজে পায় তিন তিনটে অপহরণের অন্তরালকে হাতড়ানোর।


এমন সময় একজন সিনিয়র কনস্টেবল বিশু মি: দাসকে ডেকে একটা কথা বলে, যা শোনার পর টনক নড়ে যায় সবার। সে সমস্ত কথাবার্তাগুলো দরজায় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে শুনছিল। আগের ঘটনাগুলোতেও সে গিয়েছিল অ্যাপার্টমেন্টে। তাই সে এই কেসটার মোটামুটি সবই জানে। সে জানায় যে, বাচ্চা তিনটির অপহরণের তারিখগুলো সবকটিই প্রতি মাসের অমাবস্যার আগের দিনের। হয়তো পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয় হতেও পারে। কিন্তু তার অন্য একটা সম্ভাবনাও থেকে যায়। তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কনস্টেবল বলতে শুরু করে যে, সে শুনেছে তার গ্রামে নাকি এক তান্ত্রিক বাবার কথায় একজন বাচ্চাদের অমাবস্যার আগে তুলে আনতো, আর বলি দিত তার নিজের বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য। শুনে সবার গা শিউরে ওঠে। কিন্তু তারিখ সংক্রান্ত যুক্তিটা এক্কেবারে ফেলে দেবার মতোও নয়। 


অত:পর অদ্রীশের মুখের বর্ণনা অনুযায়ী এক এক্সপার্টকে ডেকে বেলুনওয়ালা বা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা অজ্ঞাত ছেলেটির স্কেচ করান পুলিশ ইন্সপেক্টর মি: সরকার। আর সেটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এলাকার আনাচকানাচের সব তথাকথিত 'বাবা'দের খোঁজে। কিছু বাবারা তো এতোটাই ভণ্ড যে দূর থেকে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেয়েই নিজেদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পড়িমরি করে পালাতে থাকে। কেউ বা তার কপালের উজ্জ্বল দীর্ঘ লাল তিলকে আর পরনের গেরুয়া বসনে কনফিডেন্স দেখিয়ে কথাবার্তা বলে পুলিশের সাথে। 


এমন করতে করতেই পরেরদিন এক বাবার ডেরায় গিয়ে পুলিশ এই ভয়ানক জটিল কেসের একটা দিশার সন্ধান পায়। সেই তান্ত্রিক বাবা ছেলেটির স্কেচ দেখে তাকে চেনে বলে জানায়। আর এও বলে যে, ছেলেটি নাকি তার কাছে সাড়ে তিনমাস আগে এসেছিল। এসে বলছিল যে তার উপরের দুটো দাদা মরে গেছে বাইশ বছর বয়সে। তার এখন একুশ চলছে। বড্ড রোগে ভুগছে সে। তাই তারও মনে হচ্ছে যে, সেও ওই বাইশ বছর বয়সে মরে যাবে। তাই বাবার কাছে এর প্রতিকারের কোনো বিধান চায় সে। কোনোভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে সেদিন ফেরানো গেলেও পরের দিন সে আবার আসে সেখানে। আর বলে যে, শাস্ত্রে আছে কুমারী পূজা করলে মঙ্গল হয়। এই বলে একটা কাগজ ধরে সে পড়তে থাকে বিভিন্ন বয়সী কুমারীদের কী বলে ও তাদের পূজা করলে কী কী উপকার হতে পারে। তাই সে-ও কুমারী পূজা করতে চায়। আর সেরকম বাচ্চা জোগাড় করে প্রতি অমাবস্যায় এখন থেকেই পূজা শুরু করতে চায় সে। এতোগুলো সম্ভব না হলেও, অন্তত তিনটে বাচ্চার জোগাড় করবেই সে। আর দুর্গাষ্টমীর দিন তাদের একসাথে পূজা করার পরিকল্পনা করে। দরকার হলে বলিও দেবে বলে জানিয়েছিল ছেলেটি। বাবার কথামতো, ছেলেটির মানসিক স্থিরতা নেই। নিজের জীবন সে যেকোনো মূল্যেই বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

এসব শুনে তো সবার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা প্রায়। ছেলেটিই যদি অপরাধী হয়, তবে এই কেসের ক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যহীনতা একজনকে কতো বড় অপরাধের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে ভেবে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। পুলিশের আরো কিছু ধমক চমকে সেই তান্ত্রিক বাবা ছেলেটির এক গোপন ডেরার কথা জানায়। যেখানে গিয়ে সে গত দুই অমাবস্যায় পূজা করে এসেছে। হয়তো আজও ছেলেটি আবার আসবে সন্ধের দিকে তাকে নিয়ে যেতে। সেই বাবা পুলিশের পায়ে পড়ে বলতে থাকে, সে পূজায় কিছু টাকা পাওয়া ছাড়া আর এসবের কিচ্ছুটির মধ্যেও ছিল না। 


তারপর পুলিশ, অদ্রীশ, আর অদ্রীশের বাবা নিজেদের লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করে সেই তান্ত্রিকের ডেরার পেছনে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। সন্ধে প্রায় সাতটার দিকেই অদ্রীশের চেনা চেহারার সেই চিমড়ে ছেলেটি এসে উপস্থিত হয় সেখানে। অত:পর তান্ত্রিক বাবাও পুলিশের কাছে অপরাধীকে ধরিয়ে দেওয়া ও বাচ্চাগুলোকে বাঁচিয়ে দেওয়ার শর্তে নিজেকে এই কেস থেকে মুক্ত করতে পারবে বলে আশ্বস্ত হয়ে, ছেলেটিকে কিছু না বুঝতে দিয়ে সেই ডেরায় যায়।


সেখানে একটা স্যাঁতসেঁতে মাটির ঘরের প্রদীপের আলোতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসেছিল তিনটে বাচ্চা। অত:পর পুলিশ তাদের পিছু নিয়ে সেখানে পৌঁছেই সামনে এসে দাঁড়ায় রিভলভার বের করে। অদ্রীশ মুহূর্তে ছুটে গিয়ে বাচ্চা তিনটের হাত পায়ের বাঁধন আলগা করে দেয়। ওদের অবস্থা দেখে কান্না পেয়ে যায় তার। ছেলেটির মা ওই ঘরেই কাঁচুমাচু মুখ করে একপাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সারা ঘর ভর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বিবিধ পূজার জিনিসপত্র। অত:পর অপরাধী ছেলেটির নাম জানা যায় 'বীরেন'। তার মা জানায়, সে ছোটো থেকেই তার বাবাকে, আর পরপর দুই দাদাকে চোখের সামনে তিলতিল করে মরতে দেখে এমন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছিল। একটা মৃত্যুভয় ওর মনে সবসময় চেপে বসে থাকতো। আর বলতো, "আমি বাঁচবোই, সবকিছুর প্রতিকার করা যায়, আমি করবো।" 
তার মায়ের কথা অনুযায়ী, সে ছেলেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। 

এসব কথা শোনার পর ছেলেটিকে পুলিশ এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে সে প্রথমে চুপ করে থাকে। তারপর পুলিশের রুলের বাড়িতে উঠে আসে তার অবান্তর যুক্তিগুলো। প্যান্টের পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বের করে কেমন একটা এলোমেলো দৃষ্টিতে সে পড়তে থাকে
... ছয় বছরের কুমারীর নাম উমা। যার পূজা করলে শত্রুনাশ হয়ে যায়।
... আট বছরের কুমারীর নাম কুম্ভিকা। যার পূজা করলে শত্রুকে মোহিত করা যায়। আর
... তিন বছরের কুমারীর নাম ত্রিধামূর্তি। যার পূজা করলে আয়ুবৃদ্ধি হয়।


কথাগুলো বলতে বলতে সে এক একটা বাচ্চার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখায়। পুলিশ বুঝতে পারে, তান্ত্রিকের কথাগুলো সঠিকই ছিল। পুলিশের আরো চাপাচাপিতে সে জানায় যে, তার মায়ের কাছে শুনেছিল সে যে প্রথম বাচ্চাটি, মানে মিলির পড়াশোনাতে অমনোযোগের জন্য তাকে ফ্ল্যাটের বাইরে বের করে দাঁড় করিয়ে রাখে তার মা। তাই তাকে একদিন বিকেলবেলায় খেলার মাঠে গিয়ে সে ম্যাজিক পেন দেওয়ার লোভ দেখাতে সে চলে আসে। বাচ্চাটি বিশ্বাস করেছিল, ম্যাজিক পেনে লিখলে সব ঠিক হবে। দ্বিতীয় বাচ্চাটিকে, মানে বিদিশাকে স্কুল ফেরত অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার পথে বীরেন বলেছিল যে, তার মা বাবার সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাওয়ার ম্যাজিক শেখাবে সে। আর সেটা শিখতে গেলে তার সাথে তার বন্ধু মিলিরও দেখা হবে। তাই সে চলে এসেছিল এখানে। তার মাবাবার সম্পর্ক সম্বন্ধে তথ্যও যে বীরেনকে তার মা-ই দিয়েছিল, তা অনুমান করতে পারে পুলিশ। তৃতীয় বাচ্চাটি খুব ছোটো ছিল, তাই বেলুনের লোভই তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল সেদিন।

সব শুনে তো পুলিশ অবাক হয়ে বসে পড়ে। এই ছেলে নাকি অপ্রকৃতিস্থ? যে তার মায়ের কাছ থেকে জানা তথ্যের ওপর নির্ভর করে বুদ্ধি খাটিয়ে এক একটা বাচ্চাকে তুলে এনেছে এখানে ... আর শাস্ত্রের বুলি আওড়াচ্ছে। আর তার মা বলতে চাইছে যে, ছেলে নাকি মানসিক ভারসাাম্যহীন! মি: সরকার সব শুনে রাগে গর্জে বলে ওঠেন,

 "কেউ পাগল নয়, সব শয়তান। তোলো এদের সব। থানায় নিয়ে গিয়ে একটু খাতিরদারি করি এদের।" 

অত:পর বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করে বীরেন আর তার মায়ের যোগ্য ব্যবস্থা করে পুলিশ।

**********************

বাচ্চাগুলো যে যার ঘরে নিজের মা বাবার কাছে ফিরে যাওয়াতে অ্যাপার্টমেন্টে একটা খুশির বাতাবরণ তৈরি হয়। অ্যাপার্টমেন্ট কমিটির হেড নরেশবাবু পূজা ফাংশনের স্টেজে অদ্রীশের হাতে একটা পুরস্কার তুলে দিয়ে বলেন,

"আজকের এই পূজার দিনে সবার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনার পেছনে ছিল এই ছেলেটির বিচক্ষণতা ও উপস্থিত বুদ্ধি। তবে সব মা বাবাদেরকেও একটা কথা বলি, সতর্ক থাকবেন সবসময়। আর চেষ্টা করবেন বাচ্চাদের বড় করতে গিয়ে আপনাদের আচরণের মধ্য দিয়ে যেন কোনোভাবেই তাদের মনের ঘরগুলোতে ভয়ের আঁধার ঢুকে না পড়ে। তাদের ঘরের প্রতি বিশ্বাস ভেঙে যায়। আপনারা যে তাদের কতটা আপন, সেটা তারা এবং আপনারা উভয়ই উপলব্ধি করে বাঁচুন।"

(সমাপ্ত)



অলঙ্করণ : শেলী ভট্টাচার্য

2 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো দিদি 😊

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে।

    ReplyDelete