অনেক কাল আগেকার কথা। তখন লোকালয়ের বাইরে তপোবনে মুনি ঋষিরা আশ্রম তৈরি করে বাস করতেন। এই আশ্রমগুলোই ছিল তখনকার বিদ্যালয়। সাধারণ গৃহস্থের ছেলে থেকে ছোটো, বড়ো রাজা, মহারাজাদের ছেলেরাও এই সব আশ্রমে থেকে বিদ্যাচর্চা করত। আশ্রম জীবন কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। একদিকে যেমন নানান শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হত, অস্ত্র শিক্ষা করতে হত তেমন আশ্রমের অনেক কাজকর্মও করতে হত। কাউকে হয়তো বাগান, ক্ষেত ইত্যাদির পরিচর্যা করতে হত, কাউকে গরুর পাল নিয়ে প্রতি দিন চরাতে যেতে হত, কাউকে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে বনে যেতে হত, কেউ বা নদী থেকে কলসি কলসি জল তুলে আনত। গুরুর প্রতিটি নির্দেশ, প্রতিটি আদেশ শিষ্যদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হত। আর এই সমস্ত নিয়ম সব শিষ্যদের জন্যেই এক রকমের ছিল, রাজপুত্ররাও কোনও রকম আলাদা সুবিধে ভোগ করতে পারত না, তাদেরও রাজপ্রাসাদের সব রকম বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবন যাপন করতে হত। কেউ কোনও নিয়ম লঙ্ঘন করলে শাস্তি পাওয়া অবধারিত ছিল।
এরকমই এক তপোবনে আশ্রম ছিল ঋষি আয়োধধৌম্যর। আরুণি আর উপমন্যু নামে তাঁর দুজন শিষ্য ছিল। আরুণি পাঞ্চাল দেশ থেকে আয়োধধৌম্যের আশ্রমে এসেছিল বিদ্যা শিক্ষা করতে। একদিন আয়োধধৌম্য আরুণিকে তাঁর কৃষিক্ষেতে বাঁধ নির্মাণ করতে আদেশ দিলেন, যাতে ক্ষেতের জল বাইরে বেরিয়ে না যেতে পারে। গুরুর আদেশ মতো আরুণি গেল খেতে। সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চেষ্টা করল বাঁধ নির্মাণের, কিন্তু কিছুতেই সফল হল না। জল বেরিয়ে যেতেই লাগল। এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে, আশ্রমে ফেরার সময়। আর আশ্রমে ফিরলেই আয়োধধৌম্য জিজ্ঞেস করবেন সে ঠিক মতো তার কাজ সম্পন্ন করেছে কিনা। তখন সে কী বলবে? মিথ্যে কথা বলা অন্যায়, গুরুর আদেশ অনুযায়ী কাজ না করাও। আরুণি পড়ল সমস্যায়। অনেক ভেবে অবশেষে আরুণি এক উপায় খুঁজে পেল। বাঁধের যেখান দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছিল, আরুণি সেখানে শুয়ে পড়ল, নিজের শরীর দিয়ে জল আটকাল।
এদিকে সন্ধে গড়িয়ে রাত হল, অন্য শিষ্যরা আশ্রমে ফিরে এলেও আরুণি ফিরল না। আয়োধধৌম্যর চিন্তা হল, কোনও বিপদে পড়েনি তো সে? তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন আরুণির কথা।
“গুরুদেব, আপনি তো আরুণিকে ক্ষেতের বাঁধ দিতে পাঠিয়েছিলেন, সে নিশ্চয়ই সেখানেই আছে,” এক শিষ্য উত্তর দিল।
আয়োধধৌম্য তখন কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে সেই ক্ষেতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
রাত হয়েছে, ক্ষেত অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, আরুণিকেও না।
“আরুণি, কোথায় তুমি? কী করছ? আমরা তোমাকে খুঁজছি। তুমি অবিলম্বে এখানে এসো,” আয়োধধৌম্য চেঁচিয়ে বললেন।
“গুরুদেব, বাঁধের জল বেরোনো আটকানো যাচ্ছিল না, তাই তা আটকানোর জন্যে আমি সেখানে শুয়ে পড়েছিলাম,” আরুণি উঠে এসে বলল।
আয়োধধৌম্য প্রসন্ন হয়ে বললেন, “ক্ষেতের আলি বা বাঁধ ভেদ করে উঠে এসছ বলে আজ থেকে তোমার নামে হল উদ্দালক, এই নামেই তুমি একদিন প্রসিদ্ধ হবে। বেদ ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে তুমি বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করবে।”
ঋষি আয়োধধৌম্য একদিন উপমন্যুকে দায়িত্ব দিলেন গোচারণের। আশ্রমে অনেক গরু ছিল, তিনি উপমন্যুকে ডেকে বললেন, “এই সব গরুর ভার তোমাকে দিলাম, তুমি সযত্নে এদের রক্ষা করবে। দেখো কোনও হিংস্র পশুর আক্রমণে এরা মারা না যায় বা এরা অন্য কোথাও চলে না যায়। তুমি সারা দিন গোচারণ করবে, সন্ধেয় আশ্রমে ফিরে আসবে।”
“যথা আজ্ঞা” বলে উপমন্যু গরুর পাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
তপোবনের আশপাশে যেসব গ্রাম ছিল সেখানে গিয়ে গিয়ে শিষ্যদের খাবার সংগ্রহ করে আনতে হত। গ্রামবাসীরা খুশি মনেই ঋষির শিষ্যদের ভিক্ষে দিত। সেই সব খাদ্যদ্রব্য আশ্রমে নিয়ে আসতে হত, ঋষি তা থেকে সবাইকে খাবার ভাগ করে দিতেন। এই ছিল আশ্রমের নিয়ম।
উপমন্যু গেছে গরু চরাতে, সারা দিনই গরু চরাতে হবে, তার সঙ্গে কোনও খাবারও নেই। তাই সে এক গ্রামে গিয়ে ভিক্ষে করে কিছু খাবার নিজের জন্যে নিয়ে এল এবং খেল।
সন্ধেয় যখন সে আশ্রমে ফিরল আয়োধধৌম্য তাকে দেখে বেশ আশ্চর্য হলেন, বললেন, “সারা দিন তুমি বাইরে ঘুরে ঘুরে গোচারণ করেছ, তোমার সঙ্গে এক কণা খাবারও ছিল না, তাও তুমি বিন্দু মাত্র ক্লান্ত হওনি, তোমাকে দেখে ক্ষুধার্তও মনে হচ্ছে না। এ কী করে সম্ভব?”
উপমন্যু গুরুর সামনে মিথ্যে বলল না, সব সত্যি কথাই বলল।
শুনে আয়োধধৌম্য বললেন, “তুমি আশ্রমের নিয়ম লঙ্ঘন করেছ। খাদ্যদ্রব্য ভিক্ষে করে আশ্রমে নিয়ে আসা নিয়ম, নিজে খাওয়া নয়। তুমি আগামীকাল আবার গোচারণে যাবে। মনে রেখো, এবার ভিক্ষে করে খাদ্য সংগ্রহ করলে সর্বাগ্রে তা আশ্রমে নিয়ে আসবে।”
গুরুর আদেশ অনুযায়ী উপমন্যু পরের দিনও গোচারণে গেল। সেদিনও সন্ধেয় যখন সে আশ্রমে ফিরে এল তখন তাকে দেখে আয়োধধৌম্য বললেন, “আজ তুমি যা ভিক্ষা করে এনেছিলে তা আমাকে আগেই দিয়ে গেছ। তা থেকে আমি তোমাকে কিছুই দিইনি কিন্তু তা সত্ত্বেও তুমি আজও ক্লান্ত বা ক্ষুধার্ত নও। তুমি নিশ্চয়ই কিছু আহার করেছ, কী খেয়েছ বলো? কোথা থেকেই বা পেলে সে আহার্য?”
“প্রথমবার গ্রাম থেকে ভিক্ষে করে যা পেয়েছিলাম তা সবই আপনাকে দিয়ে দিয়েছিলাম, নিজের জন্যে কিছুই রাখিনি, আপনিও আমাকে কিছু দেননি। তার পরে আমি আবার গ্রামে গিয়েছিলাম খাদ্য সংগ্রহ করতে। দ্বিতীয়বার ভিক্ষেয় যা পেয়েছি তাই দিয়েই আমি উদর পূর্তি করেছি,” উপমন্যু উত্তর দিল।
আয়োধধৌম্য বললেন, “এ তুমি ভালো করোনি। দ্বিতীয়বার কেন ভিক্ষে করেছ? এ অনুচিত। তোমাকে দু'বার ভিক্ষাদান করার জন্যে হয়তো অন্য কেউ আজ একবারও ভিক্ষালাভে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু তুমিও লোভপরায়ণ হয়ে উঠছ। আর কখনও এরকম করবে না।”
উপমন্যু প্রতিশ্রুতি দিল যে আর কখনও এরকম কিছু করবে না। এদিকে গোচারণের দায়িত্বও তার ওপর। রোজই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গোরুর পাল নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়, আবার সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঠিকমতো আশ্রমে ফিরিয়ে আনতে হয়।
ফেরার পর আয়োধধৌম্য যথারীতি জিজ্ঞেস করেন সে সারা দিনে কী আহার করেছে।
উপমন্যু বলল, “গরু চরাতে চরাতে আমার খুব খিদে পেয়েছিল, তাই আমি গোরুর দুধ পান করেছি।”
আরোধধৌম্য অত্যন্ত রুষ্ট হলেন, বললেন, “আমি তোমাকে গোচারণের আদেশ দিয়েছি, গোরুর দুধ পান করার নয়। আমার আদেশ বিনা দুধ পান করে তুমি অন্যায় করেছ।”
উপমন্যুও অত্যন্ত লজ্জিত হল, বারবার সে গুরুর আদেশ অমান্য করছে, গুরুর অপ্রসন্নতার কারণ হয়েছে সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল উপমন্যু, এবার থেকে গোচারণে গিয়ে গুরুর আদেশ ছাড়া সে আর কিছুই খাবে না। দ্বিতীয়বার ভিক্ষা সংগ্রহেও যাবে না, গরুর দুধও খাবে না।
ভোর হতেই উপমন্যু গোরুর পাল নিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রতিজ্ঞা মতো সে সারা দিন কিছুই খেল না। ফলে এক সময় সে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। সামনেই একটা আকন্দ গাছ দেখতে পেয়ে খিদের জ্বালায় উপমন্যু আকন্দ পাতা খেয়ে ফেলল। এর ফল হল মারাত্মক। পাতার বিষক্রিয়ায় সে অন্ধ হয়ে গেল। নিজের ওপরেই খুব রাগ হল উপমন্যুর, মনে হল যদি খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারত, আকন্দ পাতা না খেত, তাহলে এই দশা তার হত না। সে কী করবে কিছুই ভেবে পেল না, কী করেই বা আশ্রমে ফিরে যাবে? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছে না! তাও সে চলার চেষ্টা করল, কখনও গাছে ধাক্কা খেল, কখনও পায়ে কাঁটা ফুটে গেল আর তারপর পড়েই গেল একটা কুয়োর মধ্যে।
ওদিকে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, উপমন্যু আশ্রমে ফেরেনি। আয়োধধৌম্য শিষ্যদের নিয়ে বেরোলেন তাকে খুঁজতে। সবাই মিলে উপমন্যুর নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন। এক সময় উপমন্যুও শুনতে পেল, সে-ও কুয়োর ভেতর থেকে উচ্চৈঃস্বরে উত্তর দিল।
আয়োধধৌম্য তাড়াতাড়ি কুয়োর কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কুয়োর ভেতর পড়ে গেলে কী করে?”
উপমন্যু সব বলল।
“তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদের স্তব করো। তাঁরা সন্তুষ্ট হলে তুমি নিশ্চয়ই তোমার চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে,” সব শুনে আয়োধধৌম্য বললেন।
গুরুর আদেশ মতো কুয়োর ভেতর বসে বসেই উপমন্যু অশ্বিনীকুমারদের স্তব শুরু করল। তার স্তবে প্রীত হয়ে অশ্বিনীকুমাররা তার সামনে এলেন এবং তাকে একটি পিঠে দিয়ে বললেন, “এই পিঠে খেলেই তুমি আবার তোমার চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে।”
উপমন্যু তো খুব খুশী, পিঠে সে প্রায় মুখেই দিতে যাচ্ছিল এমন সময় তার প্রতিজ্ঞা মনে পড়ল। অনেকবার সে গুরুর আদেশ অমান্য করেছে, এবার আর করবে না।
“আমায় ক্ষমা করুন, আমি আমার গুরুর অনুমতি না নিয়ে কোনও কিছুই খেতে পারব না, এমনকী এই পিঠেও নয়,” বলল উপমন্যু।
অশ্বিনীকুমাররা তাকে অনেক বোঝালেন যে পিঠে না খেলে সে আর কখনই দেখতে পাবে না, কাজেই দেরি না করে এক্ষুণি তার পিঠে খাওয়া উচিত। এর জন্যে গুরুর অনুমতির কোনওই প্রয়োজন নেই। কিন্তু উপমন্যু মানল না, গুরুর আদেশ ছাড়া যে সে আর কিছু খাবে না তা দৃঢ় কন্ঠে জানাল।
উপমন্যুর গুরুভক্তিতে অশ্বিনীকুমাররা খুব খুশী হয়ে তার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। উপমন্যুও আশ্রমে ফিরে গেল। সব শুনে ঋষি আয়োধধৌম্য প্রসন্ন হয়ে বললেন, “তোমার মঙ্গল হোক। শাস্ত্রজ্ঞানী হিসেবে জগতে তুমি প্রসিদ্ধি লাভ করো।”
(সমাপ্ত)
কাহিনী সূত্র – বেদব্যাস বিরচিত কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত।
অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল
বাহ্ খুব ভালো
ReplyDeleteVery good
ReplyDelete