Pages

গল্পের ঝুলি : জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী : পল্লব বসু


।।১।।

হাসপাতালের বিছানায় অসহায়ভাবে শুয়ে আছে সিঙ্গুর মহামায়া স্কুলের গর্ব বিজন। পাশে বসে তার বিধবা মা ছায়া দেবী চোখের জল ফেলতে ফেলতে তার বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কী থেকে যে কী হয়ে গেলো! তাঁর সুস্থ সবল ছেলে এই সেদিন উচ্চমাধ্যমিকে জেলার মধ্যে প্রথম হল। সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টে র‍্যাঙ্ক করে মুর্শিদাবাদের এক বেসরকারি কলেজে পড়তে গিয়েছিল সে। আনন্দের চোখের জলে ভেসে আশীর্বাদের রক্ষাকবচ পরিয়ে তাকে কলেজ হস্টেলে রেখে এসেছিলেন ছায়া দেবী। বুকে পাথর চেপে জীবনে এই প্রথমবারের মতো তাকে চোখের আড়াল করেছিলেন তিনি। ছ’বছর বয়স থেকে বিজনকে একা মানুষ করে চলেছেন ছায়া দেবী। বাবার অভাব কোনোদিনও একটিবারের জন্যও তাকে অনুভব করতে দেননি। তিনিই তার একাধারে মা এবং বাবা। রেলের হকার শঙ্করবাবু কিছুমাত্র সঞ্চয় রেখে যেতে পারেননি। স্বামীর মৃত্যুর পর সরকারি অনুদানে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতেই জামাকাপড় সেলাই করে, লটারির টিকিট আর ধূপকাঠি বিক্রি করে ছেলের পড়াশোনার আর কোচিং ক্লাসের খরচা চালিয়েছেন। বাবা নেই বলে কখনো ভালো রেফারেন্স-বইটার অভাব হয়নি বিজনের, পুজোর সময়ে প্রতিবছর ঠিক নতুন জামাকাপড়ও সে পেয়ে গিয়েছে। আর সে যখন মাকে মলিন ছেঁড়া শাড়িটা সেলাই করে পরতে দেখে প্রশ্ন করেছে, ছায়া দেবী উত্তর দিয়েছেন, “আমি কি বেশি রাস্তাঘাটে বেরোই, যে ভালো শাড়ী পরে বসে থাকবো? তোকে এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাতে হবে না বাবা, তুই মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর, তাতেই আমার শান্তি।” 


বিজন জানতেও পারেনি, কতোদিন হাঁড়ির সবটুকু ভাত তাকে দিয়ে খিদের জ্বালায় বিনিদ্র রাত কেটে গিয়েছে তার মায়ের। নিজে আধপেটা খেয়ে, গভীর রাত অবধি সেলাইয়ের কাজ করে তিল তিল করে বিজনের উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থ সঞ্চয় করেছেন। অথচ অভাবের এতোটুকু গরম আঁচও তার গায়ে লাগতে দেননি ছায়া দেবী। রাজমিস্ত্রি যেভাবে একটি একটি করে ইট গেঁথে ইমারৎ গড়ে তোলেন, তেমনিভাবে সু-সংস্কার, ভালোবাসা, সময় সময় কিছু তিরস্কার, আর শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছেন বিজনকে। প্রতিদানে বিজনও জেলার সেরা ছাত্র হয়ে মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে। 
কতো স্বপ্ন আর আশা নিয়ে ছেলেকে দূরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। আর আজ নির্লজ্জ র‍্যাগিং-এর শিকার হয়ে তাঁর ‘অন্ধের যষ্ঠি’ মেধাবী ছেলে মারণরোগে শয্যাশায়ী। বিজনের উপর হস্টেলের সিনিয়র দাদারা ‘ইলেকট্রিক হিটার’ নিয়ে এমন এক জঘন্য উপহাস করেছিল, যার পরিণতিতে আজ তার দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তার কিডনির ‘গ্রুপ’ আর ‘এইচএলএ’ টাইপ দিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেননি। ‘ডায়ালিসিস’-এর মাধ্যমে কোনোক্রমে ছায়া দেবীর নয়নের মণিকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন ডাক্তাররা। 

অন্ধকার ঘরে ছায়া দেবী মাথা খুঁড়ে মরেন, - বিধাতা এতো কেন নিষ্ঠুর যে তাঁর নিজের কিডনিটা তাঁর ছেলের কোন কাজে এলো না, গ্রুপ, টাইপ কিছুই ছেলের সাথে মিললো না! কী অপরাধে প্রথমে ভগবান তাঁর স্বামীকে কেড়ে নিলেন, আর আজ একমাত্র ছেলে মৃত্যুশয্যায়?
।।২।।

ডাক্তার সেনের চেম্বারে আসেন ছায়া দেবী। ডাঃ সেন তাঁকে হাউস-স্টাফ মারফৎ দেখা করার কথা বলে পাঠিয়েছিলেন। চেয়ারে বসে ছায়া দেবী ওঁর মুখের দিকে বহু প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে থাকেন।

“বিজনকে বেশিদিন ডায়ালিসিসের উপরে কিন্তু রাখা যাবে না। খুব দ্রুত অন্তত একটা উপযুক্ত কিডনি আমার চাই।”

“কিন্তু আমি যে আজ অবধি কোনও উপযুক্ত ডোনার পেলাম না ডাক্তারবাবু! আপনি দয়া করে একটা উপায় করুন, আপনার দুটো পায়ে পড়ি।” ছায়া দেবীর সংযমের সব বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে, তিনি অঝোরে কেঁদে ওঠেন।

“রক্ত হলে আমি একটা ব্যবস্থা করে ফেলতাম ঠিকই, কিন্তু কিডনি পাওয়া যে এতো সহজ কথা নয়। তার উপরে ওর গ্রুপ আবার ‘এবি’ নেগেটিভ। অথচ, সময় হু হু করে বয়ে যাচ্ছে।”

একরকম গভীর অবসাদ আর হতাশা নিয়ে হাসপাতাল চত্বর থেকে রাজপথে পা রাখেন ছায়া দেবী। মন উদ্ভ্রান্ত, চোখ জলে ঝাপসা, গায়ে জ্বর। অটোস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে পথের ধারে জটলা চোখে পড়ে। ভিড় ঠেলে এগোতেই চোখে পড়ে একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা সংজ্ঞাহীন হয়ে রাস্তার উপরে পড়ে আছেন। কিছু পথচারী তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানারকম মন্তব্য করছেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন না। ছায়া দেবী নির্দ্বিধায় রাস্তার উপরে বসে পড়ে তাঁর মাথাটা কোলের উপরে নিয়ে ব্যাগের জলের বোতল বার করে তাঁর মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকেন।

রাস্তার পাশের পার্কের গাছের ছায়ায় বেদীর উপরে বসে ছায়া দেবী শুনলেন আর এক দুঃখিনী মায়ের কষ্টের কাহিনী। নীলিমা দেবীর স্বামী ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। সীমান্তের যুদ্ধে তিনি দেশের হয়ে বীরের মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তারপর থেকে নীলিমা দেবী তাঁর মেয়ে নিবেদিতাকে পিতার আদর্শে বড় করে তুলছিলেন। নিবেদিতা স্কাউট, এনসিসি ট্রেনিং-এ ভর্তি হয়েছিল। কোথাও বন্যা হয়েছে, কয়েকজন সম-মানসিকতার বন্ধুকে নিয়ে ত্রাণসামগ্রী ওষুধপত্র নিয়ে নিবেদিতা ছুটে যেতো সেখানে। ক্যাম্পে তাঁদের শুশ্রূষা করা, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া, গাড়ির ব্যবস্থা করে বেশি অসুস্থদের হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা, চাল, ডাল, পরিশুদ্ধ জল নিয়ে গিয়ে অসহায় মানুষগুলোকে রেঁধে খাওয়ানো, সব করতো ওরা সকলে। এসব করতে গিয়েই কদিন আগে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের একটা ক্যাম্পে ওকে সাপে কাটে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হলেও ওর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। ওর বন্ধুরা ওকে কলকাতার এই হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেয়, এখানেই মেল ওয়ার্ডে বিজন ভর্তি আছে। ডায়ালিসিস চলছিল, কিন্তু, এখন ডায়ালিসিসও আর নিবেদিতা নিতে পারছে না। এখুনি একটি কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। কিন্তু নীলিমা দেবীর কিডনি ম্যাচ করেনি। নিবেদিতার বন্ধুবান্ধবদের কারোর কিডনি ম্যাচ করেনি, আর এখনো অবধি কোনও উপযুক্ত ডোনারও নীলিমা দেবী পাননি। চোখের সামনে তিনি আর তিলে তিলে মেয়েকে মরে যেতে দেখতে পারছেন না। মাথার ঠিক নেই, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া নেই, মেয়েকে দেখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তাই হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন রাস্তায়।

ছায়া দেবী জানান, তাঁর জীবনের গল্পটাও অনেকটা কাছাকাছি। এরপর নীলিমা দেবীর হাতের কাগজপত্রের উপরে তাঁর চোখ পড়ে। সবার উপরেই রয়েছে নিবেদিতার কিডনির গ্রুপ আর টাইপের রিপোর্টটা। ছায়া দেবী ওঁর হাত থেকে কেড়ে নেন কাগজগুলো। নিবেদিতার রিপোর্টের ঠিক নীচের কাগজটিই নীলিমা দেবীর কিডনির গ্রুপ-টাইপের রিপোর্ট। বারংবার তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকেন দুটো রিপোর্টের কাগজকেই। কাগজগুলো ওঁর হাত থেকে খসে পড়ে ছড়িয়ে যায় মাঠের ঘাসে। জলে ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর চোখদুটো। জড়িয়ে ধরেন তিনি নীলিমা দেবীকে, আর হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন। ওঁর এই আকস্মিক ব্যবহারে বিহ্বল হয়ে যান নীলিমা দেবী।

যিনি বিপদ দেন, তিনি এমনি করেই বুঝি তার থেকে মুক্তির রাস্তাও তৈরি করে রাখেন। শুধু সেই পথটা ঠিকমতো খুঁজে পেলেই মানুষের সব কষ্টের অবসান হয়। নাহলে এমন কাকতালীয় সমাপতনও বুঝি ঘটে? আর, দুই অসহায়া বিপর্যস্ত মমতাময়ী মায়ের এমনি করে দেখা হয়ে যায়! আবার এমনি করে কিডনির রিপোর্ট দুটোও চোখে পড়ে যায়! আসলে, ছায়া দেবীর কিডনির গ্রুপ ও টাইপ নিবেদিতার সাথে মিলে গেছে, আর নীলিমা দেবীরটা বিজনের সাথে।

আজ দুই মমতাময়ী পরম কল্যাণময়ী মা তাঁদের পরস্পরের পুত্র ও কন্যাকে তাঁদের নিজেদের একটি করে কিডনি দান করে জীবনদান করেছেন। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে বিজন আর নিবেদিতা। আসলে, মায়েদের আশীর্বাদের লক্ষ্মণরেখা যাদের সর্বদা ঘিরে রেখেছে মৃত্যুরূপী রাবণের সাধ্য কি তাদের স্পর্শ করে! মা আর দেশ-মায়ের চেয়ে বড় আর আপন বুঝি আর কিছু নেই! 

'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী...'!

(সমাপ্ত)


অলংকরণ : সুকান্ত মণ্ডল

6 comments:

  1. বাঃ। মন ভালো করে দেওয়ার গল্প।
    সকলের শুভ হোক।

    ReplyDelete
  2. বাঃ। মন ভালো করে দেওয়ার গল্প।
    সকলের শুভ হোক।

    ReplyDelete
  3. বাঃ। মন ভালো করে দেওয়ার গল্প।
    সকলের শুভ হোক।

    ReplyDelete
  4. কোনো ভাষা নেই। অসাধারণ।

    ReplyDelete