Pages

সাক্ষাৎকার : পর্বতাভিযাত্রী পিয়ালী বসাক



গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তে নেপালের মানাসলু শৃঙ্গের শিখরে পা রেখেছেন পর্বতাভিযাত্রী পিয়ালী বসাক। প্রথম অসামরিক ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনি বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম (৮১৬৩ মিটার) এই শৃঙ্গ জয় করলেন।

তাঁদের চন্দননগরের বাড়িতে বসে আলাপচারিতায় জানা গেল পাহাড়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও তাঁর বিভিন্ন অভিযান নিয়ে নানা কথা। বন্ধুদের জন্য রইলো সেই আলাপচারিতার বিবরণ।


প্রশ্ন : পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছের শুরু কোথা থেকে?

  • শুরু বলতে ছোটবেলায় কিশলয় বইয়ের একটা লেখা, তেনজিং নোরগে ও এডমণ্ড হিলারির এভারেস্ট বিজয়, সেই লেখাটা পড়ে প্রথম ইচ্ছে হয়েছিল আমিও যাব। আমাকেও এভারেস্টে যেতে হবে।

প্রশ্ন : তখন তো বোধহয় ক্লাস ওয়ান বা টু?

  • হ্যাঁ, ওইরকমই। প্রথমে ঠিক করেছিলাম তেনজিং নোরগের সঙ্গেই যাব, তারপর যখন একটু একটু বুঝতে শিখলাম, ভাবলাম একাই যাব। তখন তো আর চারপাশে কী হয় না হয় সে নিয়ে কোনও ধারণা নেই! তারপর আমরা নেপাল গেলাম। ওখানে পোখরা লেকে গিয়ে প্রথম দেখি অন্নপূর্ণা ১। মাঝরাতের একটু পরে বাস ছাড়বে, আমরা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, শুরু হলো সানরাইজ। অসাধারণ সেই দৃশ্য। প্রথমে নীলচে একটা অন্ধকার, তারপর বেগনি, তার মধ্যে চূড়াটা ঝকঝক করছে, তারপর আস্তে আস্তে লাল, কমলা, সোনালী, মুখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আর কখনও ওই জিনিস দেখার সুযোগ হয়নি।


প্রশ্ন : পরে যেসব অভিযানে গেছ, সেসব জায়গায়?
  • না, আর কোথাওই ওই সানরাইজ দেখিনি। তারপর গেলাম কেদারনাথ। এর পরে যেসব পাহাড়ি জায়গায় বেড়াতে যেতাম, সব জায়গাতেই কিছুটা করে ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হতো।


প্রশ্ন : তখন তো তোমরা অনেকটাই ছোট?

  • ওই সাত আট বছর হবে। কেদারের পর গঙ্গোত্রী গোমুখ, বৈষ্ণোদেবী, তারপর ২০০০ সালে অমরনাথ। সেই সময় পহেলগাঁওতে জঙ্গি আক্রমণ হয়েছিল, বহু মানুষ নিহত হয়েছিলেন। সে অন্য এক কাহিনী। যাইহোক, এরপর আমি রক ক্লাইম্বিংয়ের কোর্স করি, লালবাগান বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তখন আমি।

প্রশ্ন : তখনও তো বোধহয় মাধ্যমিক পরীক্ষা দাওনি?

  • না, রক ক্লাইম্বিংয়ের কোর্স শুরু করি যখন আমার বয়স দশ বছর। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউণ্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে বেসিক এবং অ্যাডভান্সড কোর্স করি। এরপর এক্সপিডিশনে যাওয়া শুরু ২০১০ থেকে। 

প্রশ্ন : প্রথম অভিযান কোথায় ছিল?

  • মুলকিলা ১০। তারপর কামেট। তারপর ২০১৩ সালে ভাগীরথী ২ এর জন্য বেরিয়েছিলাম, ইণ্ডিয়ান মাউণ্টেনিয়ারিং ফাউণ্ডেশন থেকে সিলেক্টেড একটা টিম, পাঁচজনের, কিন্তু সেই সময় উত্তরাখণ্ডে ক্লাউড বার্স্ট হয়, প্রচণ্ড দুর্যোগের মুখে পড়েছিলাম আমরা, সামিটের হাজার দুয়েক ফিট নীচ থেকে আমাদের ফিরে আসতে হয়। 

প্রশ্ন : ভাগীরথী ২ এর উচ্চতা কত মোটামুটি?

  • ৬৫১২ মিটার। মানে ধরো ২১৪০০ ফিট মোটামুটি। আমরা ফিরে এসেছিলাম সামিট ক্যাম্প থেকে। মারাত্মক তুষারঝড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওখানে তো বৃষ্টি হয় না, নিচে বৃষ্টি মানে ওখানে তুষারঝড়।


প্রশ্ন : সাংঘাতিক ব্যাপার তো!

  • হ্যাঁ। তার মধ্যে আবার ঝড় যখন শুরু হয়েছে, আমি তখনও সামিট ক্যাম্পে পৌঁছাতে পারিনি। বাকিরা তক্ষুনি পৌঁছেছে, আমি তিরিশ চল্লিশ ফুট নীচে, ঝড় শুরু হয়ে গেল। হাওয়ার ধাক্কা হঠাৎ হঠাৎ এসে প্রায় ফেলে দেওয়ার জোগাড়! আগে থেকে বোঝারও উপায় নেই কখন হাওয়ার ধাক্কা আসবে। আর বুঝলেও নিজেকে বাঁচানোর তেমন জায়গা নেই, পুরোটাই খাড়াই। যাইহোক, কোনওমতে উঠছি, হঠাৎ ওরকম একটা হাওয়ার ধাক্কায় ডিসব্যালান্সড হয়ে গেলাম। পড়ে যাওয়া আটকাতে একটা বড় পাথর আঁকড়ে ধরলাম, সেটাও দেখলাম গড়িয়ে আমার দিকে চলে আসছে, আর তার পিছনে অন্য পাথরগুলোও নড়বড় করছে।

প্রশ্ন : তখন তুমি একা?

  • হ্যাঁ। বাকিদের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, তিরিশ চল্লিশ ফুট ওপরেই ক্যাম্প, কিন্তু হাওয়া উল্টোদিকে বলে আমার গলার আওয়াজ ওরা শুনতে পাচ্ছে না। আমি তো কোনওমতে ব্যালান্স করে এক পা দুই পা করে এগোচ্ছি। এর মধ্যে আমার দেরি দেখে শেরপাস্যার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখতে এসেছেন। জায়গাটা কীরকম বলো তো? পুরো খাড়াই উঠে গিয়ে একটু সমান মতো জায়গা, সেখানে ক্যাম্প। স্যার সেই সমান জায়গাটার ধারে এসে আমায় দেখতে পেলেন। তারপর তো তাড়াতাড়ি এসে হেল্প করলেন, সামিট ক্যাম্পে পৌঁছোলাম। তারপর সারা রাত চলল তুষারঝড়। তাঁবুর ছাদে বরফ জমে যাচ্ছে, সেগুলো অনবরত ঝেড়ে ফেলতে হচ্ছে, নইলে বরফে চাপা পড়ে যাবো। এর মাঝে আবার আমার তাঁবুতে যে মেয়েটি ছিলো, তার অসহ্য মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তার একটু আধটু দেখভাল আর তাঁবুতে জমা বরফ ঝেড়ে ফেলা, এই করে সেরাতটা কাটলো। পরদিন ভোরবেলায় আমাদের লিডার ম্যাম শেরপা স্যারকে খবর পাঠালেন স্যাটেলাইট ফোনে, নেমে আসতে। ওয়েদার ভালো হওয়ার কোনও চান্স নেই।

প্রশ্ন : এখানে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এই যে সামিটের এত কাছে এসেও সেখানে না পৌঁছে ফিরে যেতে হচ্ছে, সেটা ভেবে কেমন লাগছিল?

  • সেটার জন্য তো খারাপ লাগা ছিলোই, তবে কী বলো তো, ওই সময়টায় প্রাণ বাঁচিয়ে নিচে নেমে আসার চিন্তা ছাড়া আর বিশেষ কিছু মাথায় ছিল না। আর তখন এমন পরিস্থিতি, সকালবেলাও ঘন অন্ধকার, তাঁবু বরফে প্রায় ডুবে গেছে, বরফ খুঁড়ে তাঁবু উঠিয়ে নামতে শুরু করলাম কোনওমতে। 


প্রশ্ন : নামা মানেও তো সেই খাড়াই বেয়ে, সঙ্গে বরফের ঝড়?

  • হ্যাঁ। চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে আছে, ঝড়ের ধাক্কা আসছে ক্রমাগত, সানগ্লাস পরিষ্কার করছি, কয়েক সেকেন্ডে আবার বরফে ঢেকে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আছে মেঘের গর্জন, বিদ্যুৎ আর অ্যাভালানশ। পুরো জায়গাটা তখন থরথর করে কাঁপছে। ভাবছি এই বুঝি সব একসঙ্গে নিয়ে চলে গেলো নিচে! গ্লেসিয়ারে ফাটল ধরে যে ক্রিভাসগুলো তৈরি হয় সেগুলোও কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না, সবই তো বরফ ঢাকা! কোনওমতে নিচে নামলাম এইসমস্ত পেরিয়ে। অ্যাডভান্সড বেসক্যাম্পে বাকিরা ছিলেন, সেখানকার তাঁবুও বরফে ঢাকা পড়ে গেছে। আমরা কোনওমতে বার্নার জ্বালিয়ে একটা তাঁবুর মধ্যে রইলাম, চারিদিকে উঁচু হয়ে আছে বরফের স্তুপ, খাবার বলতে চানাচুর, বিস্কুট আর ফ্রুটির ছোট ছোট কাগজের প্যাকে বরফ নিয়ে বার্নারে গলিয়ে পাওয়া জল। এই বার্নার থেকে আবার আরেক বিপত্তি শুরু হলো। আমাদের তাঁবু যেটুকু গরম হয়েছিল, সেই তাপে আশপাশের উঁচু হয়ে থাকা বরফ গলতে শুরু করলো, তাঁবুতে জল ঢুকতে শুরু করলো। আমরা সব পায়ে প্লাস্টিক বেঁধে ব্যাগের ওপর বসে রাত কাটালাম। পরদিন বেসক্যাম্পে এলাম, তারপর নিচে নামা। বরফে ঢাকা গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার পেরিয়ে নামছি, কোথায় ফাটল আছে কিছুই বুঝছি না, পাহাড়ী হরিণ আইবেক্সের পায়ের ছাপ দেখে দেখে হাঁটছি। 

প্রশ্ন : ওরা পেরিয়েছে মানে সেখানে চলার রাস্তা আছে, নাকি?

  • হ্যাঁ। এভাবে গোমুখ পেরিয়ে গঙ্গোত্রী এলাম। গঙ্গোত্রীতে তখন প্রায় একশোজন মতো তীর্থযাত্রী আটকে রয়েছেন। তো যাইহোক, কোনওরকমে তাঁদের নিয়ে নিচে নামা হলো।

প্রশ্ন : সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা! শুনতেই গায়ে কাঁটা দেয়। এরপরের অভিযান কোথায়?

  • এরপর ২০১৫ সালে হিমাচলের বড়া সিগরী গ্লেসিয়ার, আইএমএফ-এর সিলেক্ট করা টিমের মেম্বার হয়ে গিয়েছিলাম। ওটা ছিল লিডারশিপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম। টিম ম্যানেজমেন্ট, নিজেরা রুট প্ল্যান করে নিজেদের বেছে নেওয়া একটা ছ'হাজারি পীক সামিট করতে হবে, এইসব ছিলো প্রোগ্রামে। সেটা করার পর একটা কনফিডেন্স এলো, এবার আটহাজার মিটারের কথা ভাবা যায়।
প্রশ্ন : এটা ছিলো তোমার চার নম্বর অভিযান?

  • হ্যাঁ। আমার আরেকটা ব্যাপার হয় খেয়াল করেছি, লো অল্টিটিউডের চেয়ে হাই অল্টিটিউডে আমার শরীরের জোর বলো, এনার্জি বলো, অনেক বেড়ে যায়। অনেকেরই হাই অল্টিটিউড সিকনেস নানারকম হয়, এর মধ্যে পালমোনারি ইডিমা, সেরিব্রাল ইডিমা এগুলো মারাত্মক, যদি সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিচে নামানো না হয়, মৃত্যু অবধারিত। আমার বলতে নেই এখনও অব্দি তেমন কোনও সমস্যা হয়নি, বরং একটু কোনও অসুস্থতা নিয়ে পাহাড়ে গেছি, হাই অল্টিটিউডে গিয়ে সুস্থ হয়ে গেছি, এরকমও হয়েছে। কাজেই আটহাজার মিটার উচ্চতার সামিট করার ইচ্ছেটা হচ্ছিলো।

প্রশ্ন : অভিযানের খরচের ব্যাপারটা কীরকম?

  • সেটা তো একটা বিরাট বড় ব্যাপার। এবার মানাসলু যাওয়ার আগেই অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যে স্পন্সরশিপ পাওয়া যায়, তার শর্ত হলো গত পাঁচ বছরে চারটে ছ'হাজার মিটারের শৃঙ্গজয়ের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু আমার ছিলো দুটো, মুলকিলা ১০ আর তিঞ্চেনকাং। সেজন্য রাজ্য সরকারের স্পন্সরশিপ আমি পাইনি। 

প্রশ্ন : খরচ পুরোটাই নিজের?

  • হ্যাঁ। কিছুটা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে, বাকি নিজে জোগাড় করে। এখনও নেপালে বেশ কিছু জায়গায় খরচ মেটানো বাকি রয়েছে। তবে একটা কথা সত্যি, ওখানকার মানুষের কাছে প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। ওঁদের বিশ্বাস আর সাহায্য না পেলে আমার মানাসলু অভিযান সফল হওয়া সম্ভব হতো না। 



প্রশ্ন : এবারের অভিযানে তুমি একা ছিলে? নাকি কোনও টিমের সঙ্গে?

  • কাঠমান্ডু পর্যন্ত আমি একা। কাঠমান্ডু পৌঁছোই সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ। তারপর ১০ তারিখ অব্দি অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটলো। আদৌ অভিযানে বেরোনো হবে কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না। এজেন্সিকে টাকা দিতে পারছি না, ওরাও বুঝতে পারছে না আমায় নিয়ে যাবে কি না। 

প্রশ্ন : তোমার কাছে কারও রেফারেন্স ছিল? নাকি একেবারেই নিজে গিয়েছিলে?

  • নিজে। এর আগে জুন মাসে বাবামায়ের সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম। তখন সাল্লেরি থেকে নামচেবাজার অব্দি একা ট্রেক করেছিলাম। নামচেবাজার থেকে ডানদিকে গেলে এভারেস্টের বেসক্যাম্প, আমি গিয়েছিলাম বাঁদিকে, তেনজিং নোরগের বাড়ি যেখানে, সেই থামে গ্রামে। উনি আমার কাছে ভগবানের মতো, ছোট্ট থেকেই ইচ্ছে ছিল ওঁর জন্মস্থান দেখব। এটা সবমিলিয়ে ছিল চারপাঁচদিনের ট্রেক, একাই ছিলাম। লোকাল লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে গিয়েছিলাম। তো, ওখান থেকে ফেরার পর ডিসিশন নিই যে আমি আটহাজার মিটারের সামিট করবো। কিন্তু তখন আর দুমাস বাকি।

প্রশ্ন : মোটামুটি কতদিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়?

  • বছরখানেক আগে থেকে তো বটেই। টাকাপয়সার জোগাড়, অন্যান্য প্রিপারেশন এসব তো থাকেই। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, যাব ভেবেছি যখন, সেপ্টেম্বরেই যাবো।

প্রশ্ন : টাকাপয়সা জোগাড়ের সমস্যা হয়েছিল নিশ্চয়ই?

  • হ্যাঁ, হয়েছিল। কোনওমতে সেসব জোগাড় করে নেপাল পৌঁছে ওই দশদিন অপেক্ষা করতে হলো। তারপর, হঠাৎ এগারো তারিখে আমায় বলল, একঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে রওনা হতে হবে। সেইমতো রেডি হয়ে শেরপাস্যারের সঙ্গে বেরিয়ে ট্রাকে করে রওনা হয়ে পরদিন পৌঁছোলাম আড়িক্ষেত। তখন হাতে বেশি সময় নেই। অন্যান্য অভিযাত্রীরা ততক্ষণে বেসক্যাম্প পৌঁছে গেছেন। কিন্তু ওয়েদার খারাপ বলে সামিট ক্যাম্পের দিকে কেউই রওনা হতে পারছেন না। আমাকেও এদিকে আরিক্ষেতে ওয়েট করতে হলো আরও দিনদুয়েক। তারপর হেলিকপ্টারে করে গেলাম সামাগাঁও।

প্রশ্ন : হেলিকপ্টার কেন?

  • তখন তো আর সময় নেই হাতে। আরিক্ষেত থেকে বেসক্যাম্প প্রায় সাতদিনের ট্রেক। তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে হেলিকপ্টারই ভরসা। সামাগাঁও পৌঁছালাম ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৬ তারিখ হেঁটে বেসক্যাম্পে পৌঁছালাম। ঘণ্টাপাঁচেকের রাস্তা, পুরোটাই বৃষ্টি মাথায় করে গেছি, ঠান্ডা লেগে অবস্থা খারাপ, বেসক্যাম্পে স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার পরেও কাঁপুনি থামছে না, এমন দুর্দশা! কোনওমতে রাতটা কাটালাম, কেননা জানি হাই অল্টিটিউডে গিয়ে আমি অনেকটা বেটার ফীল করবো। পরেরদিন ওয়েদার পরিষ্কার হলো। 

প্রশ্ন : সেদিনই তোমরা ওপরে ওঠা শুরু করলে?

  • না। আবহাওয়া ভালো হলেই ওঠা শুরু করতে নেই। ওপরে তো প্রচুর বরফ জমে আছে, আবহাওয়া ভালো হওয়ার পরেই অ্যাভালান্স নামার চান্স বেশি থাকে। একটা দিন সময় দিতে হয় সেইজন্য। সেদিন আমরা সবাই বেসক্যাম্পেই রইলাম, জুতো পরে হাঁটাচলা প্র্যাকটিস করলাম। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর আমরা সবাই, দেড়শো জন ক্লাইম্বার একসঙ্গে বেসক্যাম্প থেকে রওনা হলাম ক্যাম্প ১ এর দিকে। তার পরদিন পৌঁছোলাম ক্যাম্প ২।

প্রশ্ন : ক্যাম্পগুলোর হাইট মোটামুটি কত?

  • বেসক্যাম্পের হাইট ৪৮৯৫ মিটার। ক্যাম্প ১ ৫৭০০ মিটার। ক্যাম্প ২ এর হাইট ৬৪০০ মিটার। এই ওঠাগুলো সবই অ্যাক্লাইমেটাইজেশনের পার্ট, সেইসঙ্গে মালপত্র নিয়ে যাওয়ার কাজও সেরে রাখা হলো। ২০ তারিখ সবাই বেসক্যাম্পে ফিরে এলাম। নেমে আসার পর ২১ থেকে আবার ওয়েদার খারাপ হলো। ফোরকাস্টে দেখা গেল পঁচিশের পর থেকে আবহাওয়া ভালো হবে। সেইমতো ওয়েট করে চব্বিশ তারিখ আমরা গেলাম ক্যাম্প ১ এ, তার পরেরদিন ক্যাম্প ২ তে। ক্যাম্প ২ এ আমরা বাকিদের চেয়ে আগে পৌঁছেছিলাম, কাজেই ঠিক করলাম আমরা সেদিনই ক্যাম্প ৩ এর জন্য রওনা হবো। 

প্রশ্ন : ক্যাম্প ৩ এর হাইট কত?

  • ৬৮০০ মিটার। তবে আমার শরীর যেহেতু হাই অল্টিটিউডে বেটার পারফর্ম করে, একইদিনে এতটা উঠতে সমস্যা হয়নি। তবে এই রিস্ক না নিয়ে অ্যাক্লাইমেটাইজেশন করেই ওঠা উচিত। 


পত্রিকা : কিশলয়ের বন্ধুরা, মনে রেখো কথাটা। আচ্ছা, এবার বাকিটা শুনি।

  • হ্যাঁ। ক্যাম্প ৩ থেকে ক্যাম্প ৪ এ যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। এই ক্যাম্পটা আবার একটু খাড়াইয়ের ওপর। সেদিন আবার সব মালপত্তরের সঙ্গে যোগ হয়েছে অক্সিজেন সিলিণ্ডার। তো যাইহোক, আমরা মোটামুটি সবার আগেই পৌঁছে গেলাম। তারপর রাত আড়াইটে নাগাদ বেরিয়ে চলা শুরু হলো সামিটের দিকে। আমরা ছিলাম, আর অস্ট্রেলিয়ান অভিযাত্রীদের একটা টিম ছিল। এরপর ফাইনালি সকাল সাতটা নাগাদ আমরা সামিটে পৌঁছোলাম।


পত্রিকা : বাঃ, আটহাজার মিটারের অভিযান তাহলে তোমার এভাবেই শুরু হলো। এবার নেক্সট কী প্ল্যান?

  • এভারেস্টের ইচ্ছে তো রয়েছেই, কিন্তু খরচ জোগাড়টা একটা বিরাট বড় ফ্যাক্টর। দেখা যাক, কী হয়। 

পত্রিকা : সে তো বটেই। বিভিন্ন লেখায় যা পড়েছি, মাউণ্টেনিয়ারিং-এর খরচ জোগাড়, স্পন্সরশিপ পাওয়া, এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আশা করি, তোমাদের এইসব সফল অভিযান ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে স্পন্সর করার ব্যাপারে। একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। পাহাড়ে কেন যাও?


  • পাহাড়ে আমি ভালো থাকি। এখানে মন টেকে না। আর আমার শরীরও এখানকার চেয়ে পাহাড়ে অনেক বেশি ভালো থাকে। জ্ঞান হয়ে থেকেই আসলে পাহাড় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।

পত্রিকা : একটা কথা বলো, ব্যর্থতা, মানে কোনও অভিযানে বেরিয়ে ফাইনালি শিখরে না পৌঁছাতে পারা, সামিট না হওয়া, এই ব্যাপারটা তোমায় কতটা প্রভাবিত করে?

  • সেই মুহূর্তে মন খারাপ হয়, তাছাড়া সামিট করা ব্যাপারটা পরবর্তীকালে স্পন্সরশিপ পেতেও অনেক কাজে লাগে, সেসব অবশ্য অনেক পরে বুঝতে শিখেছি। তবে সামিট না হলেও যেসব অভিজ্ঞতা হয় ওই অভিযানগুলোয়, সেগুলো পরের অভিযানে খুব কাজে লাগে। কোনও অভিযানই ব্যর্থ হয় না। 

প্রশ্ন : মাউণ্টেনিয়ারিং ছাড়া তোমার শখ কী?

  • ছবি আঁকা, যদিও এখন সময় খুব কম পাই। এছাড়া তাইকোণ্ডো করি, ন্যাশনাল লেভেলে খেলেছি। 

প্রশ্ন
 : আমাদের ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কিছু যদি বলো...


  • একটাই কথা বলবো, যেটা আমি নিজেও করেছি ছোট থেকে, পড়াশোনা তো অবশ্যই করতে হবে, তার সঙ্গে যার যেটা করতে ভালো লাগে, নাচ গান আঁকা খেলাধুলো, যেটা হোক, সেটাই মন দিয়ে করতে হবে। 


পত্রিকা : খুব ভালো লাগলো তোমার সঙ্গে কথা বলে, তোমার পর্বতাভিযানের নানা অভিজ্ঞতা শুনে। ভবিষ্যতে আরও অনেক সফল অভিযানে জয়ী হও, এই শুভেচ্ছা রইলো কিশলয় পত্রিকা আর বন্ধুদের পক্ষ থেকে। ভালো থেকো।




ছবি : পিয়ালী বসাক
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : ধূপছায়া

No comments:

Post a Comment