Pages

গল্পের ঝুলি : অন্য রকম ছুটি : মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস




"সবাই বেড়াতে যাচ্ছে মা, আমরা যাব না?" ঝিনুক আর শঙ্খ দুই যমজ ভাইবোন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে৷ 

মা বলেন, "ছাড়, ছাড়, পড়তে বস৷" 

"উফ্ মা, সবে তো ছুটি পড়লো, চলো না মা, কোথাও যাই আমরা৷ এই পাড়ার গুবলু রনি শিনা ওরা কেউ আত্মীয় বাড়ি, কেউ ঠান্ডা টুরিস্ট স্পটে গেছে৷ যারা এখনও যায় নি, তারাও যাবে যাবে করছে এক দু'দিনের মধ্যে৷ আর আমরা যাবো না, মা?"

মা সবই জানেন কিন্তু মায়ের হাত পা বাঁধা৷ ঝিনুক আর শঙ্খর বাবা অফিসের কাজে দিন দশেকের জন্য বাইরে৷ ওদের ঠাম্মি গত কয়েক মাস যাবৎ শয্যাশায়ী৷ না হলে বাবা দু'দিন ছুটি নিয়ে হয়ত মাকে বলতেন ওদের নিয়ে আশেপাশে কোথাও দু একবেলার জন্য ঘুরে আসতে৷ কিন্তু তার কোনোও উপায় নেই৷

মা বলেন, "ছুটি মানে কি শুধু বাইরে বেড়াতে যাওয়া না কি? ছুটির মজা বাড়িতেও হয়৷"

মুখ গোঁজ হয়ে যায় শঙ্খের৷ ঝিনুক রাগ করে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে বসে জোরে জোরে পা নাড়াতে নাড়াতে দূরে রাস্তার বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ 

ঐ বাঁকের পাশে একটা ছোট্ট খোলা জায়গা আছে৷ পাশে একটা বড় পুকুর৷ পানায় ঢাকা৷ ঐখানেই ওদের বিকেলটা কাটে৷ মানে যাদের টিউশনি বা অন্য কিছু করার থাকে না বিকেলে তারা এসে জোটে ইস্কুলের পর৷ বার বার বল পড়ে যায় পানার দঙ্গলে আর ভাবতে হাসি পায় লম্বা বাঁশটাঁশ এনে বল খুঁজে বার করতে করতেই হঠাৎ টুপ করে সূর্যমামা পুকুরের পশ্চিম পাড়ের নির্মীয়মান বহুতলটার পেছনে টুপ করে হারিয়ে যায়৷ ঐ বহুতলটা কয়েক বছর ধরে আধখাপচা হয়ে পড়ে আছে কেন কে জানে! ঝিনুকের বাবা বলেন, "যতদিন না হয় ততদিনই ভাল৷ শেষ হলেই তো পাড়াতে লোকজন আর হৈ হল্লা আরও বেড়ে যাবে৷"

সন্ধের মুখে ঠাম্মির ঘরের আয়াপিসি এল৷ মা ফ্রেশ হয়ে এসে সন্ধ্যা জ্বেলে ডাক দিল ওদের৷ গরম গরম পেঁয়াজি আর মুড়ি ওদের ভীষণ ভাল লাগে৷ মা বাইরের খাবার খুব বেশি কিনে দিতে পছন্দ করেন না৷ মাথা ঠান্ডা হয়েছে দেখে মা বললেন, "শোন, তোরা যদি ইচ্ছে করিস ছুটিটা শুয়ে বসে কাটাবি না তবে তোদেরই ভাবতে হবে তোরা কী করবি৷ এমন কিছু কর এ ক'দিনে যাতে তোদের বন্ধুরা ছুটির শেষে ফিরে তোদের গল্প শুনে বোঝে তোদের ছুটিটা সব থেকে ভাল কেটেছে৷ তার জন্য ঠিকঠাক প্ল্যান করে যদি আমাকে শোনাতে পারিস তবে প্রয়োজনে আমার পূর্ণ সহযোগিতা পাবি৷"

ছুটি চলছে ঠিকই কিন্তু ছোট থেকে বাবার নির্দেশ, অন্ততঃ হাতের লেখা, অল্পস্বল্প অঙ্ক আর ইস্কুলের ছুটির পড়া করতেই হবে৷ আজ কিন্তু পড়তে বসে দুইজনে আলোচনায় মেতে গেল কিভাবে নতুন কিছু মজা এবার ছুটিতে করা যায়৷
কত রকম প্ল্যান আসে মাথাতে৷ 

শঙ্খ বললো, "আচ্ছা, আমরা যদি কার্ড ডিজাইন করি, তারপর পুজোর আগে স্কুলের বন্ধুদের কাছে বিক্রি করব বিজয়ার গ্রিটিংস হিসাবে৷ আর যা টাকা পাবো তা দিয়ে বাগদীপাড়ার ছোটদের নতুন জামা কিনে দেব পুজোর জন্য৷" 
বাগদীপাড়া থেকে ঝর্ণামাসি ওদের বাড়ি আসে ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করার জন্য৷ ওঁর মুখেই শোনে ও পাড়াতে অনেকেরই খুব দারিদ্র্য
ঝিনুক বলে, "তাহলে তাই করি৷ কালই আমাদের ভাঁড় ভেঙে টাকা বার করব৷ অনেক আর্ট পেপার আর রঙ লাগবে৷ মায়ের কাছেও কিছু চাইতে হবে৷"
"আচ্ছা, যদি আমাদের কার্ড বিক্রি না হয় ? তবে কী হবে?"
"কেন হবে না? সবাই আমাদের আঁকার কত তারিফ করে৷"

তারপর রাতের খাওয়া থেকে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আরও কত রকম আইডিয়া ওদের মাথায় এল তার ঠিক নেই৷ মা এখন ঠাম্মির ঘরের সামনেটাতেই সোফাতে৷ আয়ামাসি থাকলেও মায়ের দরকার থাকে৷ দুই ভাইবোন আলোচনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল কখন৷

ভোর ভোর কাউকে না বলেই ওরা দরজা খুলে চলে এল খেলার জায়গায়৷ সঙ্গে এনেছে মাটি-খুপড়ি আর ভাঙা বালতি একটা৷ গরমকাল যদিও এখন, মাঝে মধ্যে কালবৈশাখীর দাপটে ভেজে মাটি৷ তাই বড় বড় ঘাসে, আকন্দ বনতুলসির ঝোপে জায়গাটা বড় অপরিচ্ছন্ন৷ আর হয়ে আছে গোছা গোছা পার্থেনিয়াম৷ খোলা জায়গায় পুকুর ধারে হয়ে থাকা এই গাছগুলো নাকি দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা ছিল৷ কোনোভাবে ভারতে এসে পড়া সহজে বেড়ে ওঠা এই গাছগুলো বিষাক্ত৷ 

ওরা ঠিক করে ফেলেছে এগুলো রাখা চলবে না৷ তাই সাফ করতে লেগে পড়ল৷ ওরা কাজ করছে এমন সময় একজন পথচারী এসে দাঁড়ালেন৷ 

"কী করছ তোমরা?"

"আমরা এসব আবর্জনা সাফ করছি৷ আমরা বন্ধুরা এখানে খেলি তো৷ শুনেছি এসব গাছপালা ক্ষতিকারক৷"
"তোমরা একা পারবে?"
"একদিনে তো পারব না৷ আস্তে আস্তে করে ফেলব৷"

ওরা যতটা পারল সাফ করে বাড়ি চলে গেল৷ এবার ব্রেকফাস্ট না করলে মা বকবে৷
মাকে ওরা প্ল্যানটা জানালো মোটামুটি৷ মা উৎসাহ দিলেন৷ যদিও নিজেও ভাবছিলেন ওরা এত ভারী কাজ করে উঠতে পারবে কি না৷
বাইরে প্রচন্ড রোদ এখন৷ তাই আর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ সামান্য পড়া করে নিয়ে ওরা বাড়িতেই কাজে লেগে পড়ে৷ অব্যবহৃত গোয়ালঘরটাতে নানা যন্ত্রপাতি ও টুকটাক জিনিসপত্র রাখে বাবা৷ ওরা একটা শক্তপোক্ত কাঠের তক্তা খুঁজে নিয়ে করাত চালিয়ে মাপমত কেটে নাইলন দড়ি দিয়ে দুই ধার বাঁধল৷
পরের দু এক দিনও ওরা সকাল সকাল কিছুটা সাফাই করতে পারল জমিটা৷ একদিন দুপুরে খাওয়ার পর প্রচন্ড ঝড় উঠল৷ ঝড় থামলেও বৃষ্টি আর থামেই না৷ ওরা খুশিই হল৷ মাটিও আলগা হল আর গরম কমল৷ কাজের সুবিধা হবে৷
পরদিন সকালে মাঠে গিয়ে অবাক৷ বাকি আগাছা ঘাসটাস সব কে যেন সাফ করে দিয়েছে৷ বেশ ঝকঝকে লাগছে জায়গাটা৷ ওরা একটু অবাক হয়ে পরবর্তী কাজ নিয়ে আলোচনা করছে এমন সময় গতদিনের আগন্তুক এসে হাজির৷
"কেমন? পছন্দ হয়েছে?"
"মানে?" ওদের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে কথাটা৷
"তোমাদের দেখে আমার মনে হল ভদ্রঘরের ছেলেপুলে, এসব কাজে অভ্যাস নেই৷ অথচ একটা কাজের মত কাজ করছো৷ কাল আমার তাঁতের কাজ বন্ধ ছিল৷ আমি দুপুরবেলা এসে সব সাফ করে গেছি৷ কাজে যাওয়ার পথে তোমাদের সাথে দেখা হয়ে ভালই হল৷ বাড়ি তো চিনি না যে কথাটা বলে যাব৷"

প্রচন্ড খুশি আর কৃতজ্ঞতা কিভাবে প্রকাশ করবে বুঝতে না পেরে শঙ্খ তো মানুষটাকে জড়িয়ে ধরল৷ ওদের বাড়ির দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে ঝিনুক বলল উনি যেন ওদের বাড়ি গিয়ে বাবা মার সাথে আলাপ করে যান৷ জানা গেল মানুষটির নাম সিদ্ধেশ্বর সাধু৷

সিদ্ধেশ্বর কাকু চলে যাবার পর ঝিনুক খেয়াল করল পুকুরের একদম গা ঘেঁষে কচুপাতারা যেখানে পিটুলি গাছের নিচে মাথা তুলেছে সেখানে পড়ে আছে ইতস্তত প্ল্যাস্টিক পলিথিন৷

"দেখছিস ঐ লাল বাড়ির ফিঙে ঠাকমা আবার জানালা থেকে এঁটো কাটা আবর্জনা প্ল্যাস্টিকে মুড়ে ফেলছে৷"
"ধুর, বুড়িটা কারোর কথা শোনে না৷ ওকে দীনেশ জেঠু সেদিন বারণ করেছিল৷ কী সব যাচ্ছেতাই গালাগালি দিল জানিস? ওগুলো তো দেখতেও খারাপ লাগে৷ আর তারপর পুকুরে ভেসে গিয়ে আরও যাচ্ছেতাই হচ্ছে৷"

ততক্ষণে ঝিনুক গলি ধরে হাঁটা দিয়েছে লালবাড়িটার প্রবেশ পথের দিকে৷ বাধ্য হয়েই পিছু নেয় শঙ্খ৷
"ঠাকমা, ঠাকমা...." ডাক দেয় দরজা থেকে৷
বুড়ির সাত কূলে কেউ নেই মনে হয় কারণ বাড়িতে আর কাউকে ঢুকতে বার হতে দেখে না৷ বুড়ি অবশ্য মাঝেমধ্যে দোকান বাজার করে৷ একা একা থেকেই কি না কে জানে খুব খিটখিটে৷ কিছু বলতে গেলেই গালাগাল দেয়৷ সবাই যেন ওর শত্রু৷
ডাকাডাকিতে বুড়ি দরজা খুলে অবাক চোখে তাকায়৷
"সেন বৌদির নাতি নাতনি না?"
চেনে তবে! শঙ্খ মুখে বলে, "হ্যাঁ৷"
"তা, কী মনে করে?"
আমতা আমতা করে বলেই ফেলে ঝিনুক যা মাথায় আসে, " না, বলছি, ভাল আছেন?"

এবার সুর চড়ে বুড়ির, " এ পাড়ায় কে আর আমার খবর নেয়? আমি যে আছি একথাটাই কারো মনে থাকে?"

শঙ্খ সামাল দেয়, " আসলে আমাদের ছুটি তো৷ ভাবলাম আপনার খবর নিই৷ আমাদের ঠাম্মি তো খুবই অসুস্হ৷ উনিই আমাদের গল্প বলতেন৷ বাবা মায়ের তো এসব সময় নেই৷ আপনি আমাদের গল্প শোনাবেন?"

বুড়ির মুখের অবাক ভাব কাটেই না৷ বলে, "বলি কী যে বলছো, মাথাতেই ঢুকছে না৷ ওই মোড়াটায় বসে বল দেখি৷"

দুই ভাই বোন ভাঙাচোরা মোড়া আর মেঝেতে বসেই পড়ল৷ ঘন্টাখানেক পর যখন ওরা বাতাসা চিবোতে চিবোতে বাইরে এল তখন মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি৷ ফিঙে ঠাকমা কথা দিয়েছেন আর পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন করবেন না৷ তাছাড়া বিকেল বেলায় খেলার জায়গায় এসে ওদের সাথে সময় কাটাবেন৷ গল্প করবেন৷"

বাড়ি ফিরে এসে এসব কথা মাকে বিস্তারিত বলল৷ মা তো হেসে বাঁচেন না৷ তোরা ঐ পাগলি ফিঙে পিসিমাকেও শায়েস্তা করে এলি?"
"হ্যাঁ, তবে বড়দেরও বলে দেবে কিন্তু যেন অকারণে ওঁর পেছনে না লাগে", ঝিনুক বলল৷

মা সময় করে একবার ওদের কান্ড কারখানা পর্যবেক্ষণ করে আসেন৷ মা পাড়ার লোকের কথায় বুঝতে পারেন ছেলেমেয়ের উদ্যোগ অনেকেরই চোখে পড়েছে৷ মা খুশি হয়ে কিছু টাকা দিয়ে ওদের ঝর্ণামাসির সাথে পাঠালেন নার্সারিতে৷

দেখে শুনে মালিকাকুর সাথে পরামর্শ করে ওরা কিনে আনল কিছু গাছের চারা৷ আর আসার সময় পাশের পাড়ার লাল্টুদাকে বলে এল কতগুলো কঞ্চির ঘেরাটোপ বানিয়ে পরেরদিন সকাল বেলা যেন মাঠে পৌঁছে দেয়৷ 

পরদিন ওরা খেলার জায়গার সীমানায় ও পুকুরের ধারে বেশ কিছু বকুল, গন্ধরাজ, কৃষ্ণচূড়ার ছোট গাছ লাগিয়ে দিল ঘেরাটোপের সুরক্ষা দিয়ে৷ পাশের বাড়ির রকিদাদা দেখে নিজের থেকেই এসে ওদের সাথে হাত লাগাল৷ ওদের ভালই হল৷ এরপর দু'বেলা জল দিতে দিতে গাছগুলো বেশ ধরে গেল৷

ইতিমধ্যে বাবাও ফিরে এসেছেন৷ বাবা সব শুনে খুব খুশি৷ মাকে বললেন "তোমারও বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না৷"

মা হেসে বললেন, " আমি সব থেকে বেশি খুশি হব যেদিন ওরা ওদের ঠাম্মির হাত ধরে ওদের সাজানো মাঠটা দেখাতে নিয়ে যেতে পারবে৷"

পরে বাবা ওদের অপটু হাতে বানিয়ে রাখা দোলনা দেখে হেসে গড়াগড়ি৷ কিন্তু নিজেই দোলনাখানা উপযুক্ত করে ওদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে টাঙিয়ে দিলেন পুকুরের ধারে একটা জামগাছের নীচু ডালে৷ 
বললেন, "পুকুরের হাওয়া খেতে খেতে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে যাস না৷ জলে পড়ে যাবি৷"

প্রায় সকলেই ছুটির শেষে ফিরে এসেছে৷ খেলার জায়গাটার এমন ভোল বদলে কী যে অবাক ওরা! অন্যবার সবাই এক জায়গায় হয়ে বেড়ানোর গল্প করে৷ এবার সবাই শঙ্খ আর ঝিনুকের তারিফে অস্হির৷ 

তবে ওরাও বলে দিয়েছে, ভাল বললেই হবে না৷ জায়গাটা যাতে এরকমই ছিমছাম থাকে তার জন্য সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে৷ টুনি গুবলু ঝুমা নন্টে সকলে একসাথে বলছে "নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই৷"


আর টুবাইএর হাত থেকে অতি উত্তেজনায় ছুড়ে দেওয়া চকোলেটের মোড়কটা সযত্নে কুড়িয়ে হাতে রেখে ডাব্বু বলল, 
"যেখানে সেখানে এসব আর ফেলা একদমই চলবে না—আনন্দে রাগে দুঃখে কোনো কোনো অবস্হাতেই নয়৷ সকলে একথা শুনেহো হো করে হাসতে হাসতে পরিষ্কার মাঠে গড়াগড়ি খেতে লাগল৷

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

No comments:

Post a Comment