Pages

গল্পের ঝুলি : অচেনা সাথী : দেবদত্তা ব‍্যানার্জী




ছোট্ট বাংলোটা একটা টিলার ওপর, ঢালু জমিতে প্রচুর ফুল গাছ, একটা দোলনাও আছে। ঠিক পেছনেই ঝাউ বন। আর একটু দূরেই সবুজ চা বাগান। নীল রঙের টয়ট্রেন চা বাগানের ভেতর দিয়ে কু ঝিক ঝিক করতে করতে চলে যায় মেঘের দেশে। ঢেউখেলানো পাহাড়ের গায়ে মেঘের দল লুকোচুরি খেলে। পিছনে সাদা তুষার শৃঙ্গ অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসে ভেসে আসে তুষারের গন্ধ, নাম না জানা ফুলের দল পাহাড়ের গায়ে গায়ে পসরা সাজিয়ে রাখে কার অপেক্ষায়।


তিতিরের বাবা এখানকার এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে এসেছেন দু'মাস আগে। তিতির ওর মায়ের সাথে কলকাতায় থেকেই পড়াশোনা করে। কারণ বাবা তো আবার বদলি হবেই। কত বার ও স্কুল বদলাবে! দু'দিন হল গরমের ছুটি কাটাতে কার্শিয়াং-এ এসেছে ও মায়ের সাথে। স্কুলে বলে ওর ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছে মা। তাই ওর এখন ভীষণ মজা। এই মেঘ আর চা-বাগানের দেশে সব কিছুই খুব সুন্দর। হঠাৎ বৃষ্টি নামে, মেঘ এসে ভিজিয়ে দেয়, আবার রোদ লুকোচুরি খেলে পাহাড়ের পিছন থেকে। কিন্তু একা একা ঘুরতে কার ভাল লাগে! তাই গল্পের বই হাতেই সময় কাটে তিতিরের। বাবা বিকেলে ফিরে ওদের মার্কেটে নিয়ে যায়।

সেদিন দুপুরে দোলনার ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজটা কানে যেতেই ও উঠে পড়েছিল গল্পের বই ফেলে। ওধারের বড় কাচের জানালাটা দিয়ে দেখে একটা ছোট্ট মেয়ে ওদের বাগানের দোলনাটায় দুলছে একা একা। তিতির পা টিপে টিপে দোলনার সামনে যেতেই মেয়েটা এক লাফে নেমে পড়ে। ও ধরতে যেতেই এক ছুট। ঢালু জমিটা যেখানে গিয়ে পাইন-বনের সাথে মিশেছে ঠিক সেখানে কাঁটাতারের বেড়া গলে পালিয়ে যায় মেয়েটা। তিতির ছুটে গিয়েও ধরতে পারে না আর। আরও দুদিন চেষ্টা করেও ধরতে পারে না মেয়েটাকে ও। রোজ দুপুরেই মেয়েটা আসে ওদের বাগানে।

এর পরদিন দুপুরে তিতির লক্ষ্য রেখেছিল। মেয়েটা আসতেই একটা ঝোপের আড়াল থেকে পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে ও। মেয়েটা কিন্তু ওকে দেখে ভয় পায়নি। ভাঙ্গা বাংলায় ওকে বলে -''তুমি কে গো ? আমি তো রোজ এখানে খেলতে আসি, তোমায় তো আগে দেখিনি?''

-''আমার বাবার বাংলো এটা। আমি কলকাতা থেকে ঘুরতে এসেছি এখানে। এটা আমার দোলনা।'' গম্ভীর গলায় বলে তিতির ।

-''তোমার দোলনা? ঘুরতে এসেছ মানে আমাদের অতিথি তুমি। কিন্তু দোলনাটা তো তোমার নয়। '' কোমরে হাত দিয়ে রুখে দাঁড়ায় মেয়েটা।

ওর সহজ সরল কথায় হেসে ফেলে তিতির। মেয়েটার বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে। ফরসা একমাথা কোঁকড়া চুল, ছোট চোখ, চ্যাপটা নাক, নেপালিদের মত বেশ মিষ্টি দেখতে। তিতিরের বয়স এগারো বছর, বেশ একটা বড় বড় ভাব এসেছে ওর মধ্যে। ঐ টুকুন একটা পুঁচকে বাচ্চার মুখে এমন সব কথায় রাগ করতে পারে না তিতির।

হেসে ফেলে বলে -''আসলে বাংলোটা এখন আমাদের, তাই দোলনাটাও আমাদের। তোমায় আসতে বাধা দেবো না যদি তুমি আমার বন্ধু হও।''

-''ঈশ, তোমাদের না ছাতা। কদিন পরেই তো চলে যাবে তোমরা। আমিই থাকব এই বাগান আর দোলনা ঘিরে।''

-''তোমায় তো এখনো আসতে বললাম রোজ। একা একা আমার আর ভালো লাগে না। তুমি আর আমি খেলব রোজ। তুমি আমায় ঘুরিয়ে দেখাবে তোমাদের এই ছোট্ট পাহাড়ি শহর?''

মেয়েটা একটু গম্ভীর হয়ে বলে -'' ঠিক আছে, আগে তোমার নাম বলো?''

-''তৃষাণ, তবে তুমি আমায় তিতির দাদা বলে ডেকো। তোমার নাম কী?''

-''রুমেলা, তুমি যদি আমায় বৈনি বল তবেই দাদা ডাকবো। ''

এরপরের দুপুর গুলো দুই ভাইবোনে দুষ্টুমি আর খুনসুটি করেই কাটাত। কখনো পাইন বনের ভেতর হাঁটা পথ ধরে ওরা পৌঁছে যেত পাহাড়ি ঝর্ণার ধারে। পাহাড়ি ঝর্ণাতে রুমাল দিয়ে মাছ ধরেছে দুজনে। কখনো চা-বাগানের অলিগলিতে হারিয়ে যেত ওরা।চা গাছের ফাঁকে লুকোচুরি খেলত দুজন। তিতির কুকিজ বিস্কুট জমিয়ে রাখত এক সাথে খাবে বলে। বৈনি বলেছিল বাড়িতে কাউকে ওর কথা বলতে না। কারণ ও তো লুকিয়ে আসে। পাইন বনের ফাঁক দিয়ে যে নিচের বস্তিটা দেখা যায়, সেখানে খাদের ধারে সিডার আর রডডেনড্রন গাছ আছে দুটো। তার ফাঁকে গোলাপি বাড়িটায় ও আর ওর মা থাকে। বাবা নেই ওখানে। কোথায় যেন চলে গেছে বাবা। ওর মা বাগানে কাজ করে। দুপুরে থাকে না কখনও। তখন আসে চুপিচুপি।

তিতির যে সারা দুপুর না ঘুমিয়ে দস্যিপনা করে তা তো আর মাকে বলা যায় না। মা সারা দুপুর টিভি সিরিয়াল দেখে। ঐ সময় মা এক অন্য জগতে চলে যায়। তাই তিতির বলেনি কিছুই। এই স্বাধীনতার স্বাদ ও একাই উপভোগ করছিল।

বৈনির সাথে গিয়ে ও দু দিন টয়-ট্রেনেও চেপে এসেছে। টয়-ট্রেন জিগজ‍্যাগ করে পাহাড়ে ওঠে। কিছুটা উঠে আবার পিছিয়ে আসে, আবার ওঠে।সে সময় অনেক বাচ্চা উঠে পড়ে ট্রেনে। আবার নেমে যায় একটু ওপরে। বৈনি ওকে কমলা বাগান ঘুরিয়ে এনেছে একদিন। গাছ গুলোতে সবুজ সবুজ কচি কমলা এসেছিল সবে। টক আর তিতকুটে স্বাদের কমলা চেখেও দেখেছে তিতির।

বৈনি ওকে অনেক গল্প বলত পাহাড়ের, জঙ্গলের। কখনো লটকা বলে একটা টক মিষ্টি ফল আনত ওর জন্য। কখনো আনত তিতোরা, এক ধরনের টক শুকনো আচার, যা নুন দিয়ে শুকানো হয়। তিতির ওকে গল্প পড়ে শোনাতো, কলকাতার গল্প বলত। ও অবাক হয়ে শুনত। এভাবেই আস্তে আস্তে তিতিরের ছুটি ফুরিয়ে আসেছিল।

সেদিন দোলনায় বসে তিতির বৈনিকে বলেছিল সে পরদিন চলে যাচ্ছে। বৈনি যেন সকাল সকাল একবার এসে দেখা করে যায়। রুমেলার চোখে বড় বড় মুক্তোবিন্দু এসে জমেছিল। তিতির বুঝিয়ে বলে ও আবার আসবে পূজার ছুটিতে। অভিমানী মেয়েটা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।

একটু পরে বলে -'' আর চারদিন থাকতে পারো না? চারদিন পর যে রাখি । আমি কখনো কাউকে রাখি  বাঁধিনি।''

-''না, টিকিট যে কাটা হয়ে গেছে। স্কুল খুলে গেছে অনেক আগেই। আমি স্পেশাল পারমিশন নিয়ে এসেছিলাম। এখন ফিরতেই হবে বৈনি। আবার আসব পরের ছুটিতে।''

তিতির বলে আস্তে আস্তে। ওর গলাটাও ভারি হয়ে আসে।

ছলছল চোখে মেয়েটা ফিরে যায়।সেদিকে তাকিয়ে চোখ মোছে তিতির।


পরদিন সকাল থেকেই বার বার বাগানের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল তিতিরের। ওরা একটায় বেরিয়ে যাবে বাবা বলেছে। বৈনি সবসময় দুপুরে আসে। ওর মা কাজে যায় তখন। সাড়ে এগারোটার পর তিতির আর থাকতে পারে না। এক ছুটে নেমে যায় পাইন বনের ভেতর দিয়ে ঐ বস্তিতে। গোলাপি বাড়িটা দূর থেকে দেখেছিল ও। সামনে একটা রডডেনড্রন আর সিডার গাছ । কিন্তু বাড়িটার সামনে গিয়ে মনে হয় কেমন যেন পরিত্যক্ত। ফাঁকা, বাগানে আগাছা ভর্তি। দরজা জানালা দেখলেই মনে হয় বহুদিন খোলা হয় না। বৈনি বলে দুবার ডেকেও সাড়া পায় না তিতির। এবার ও রুমেলা বলে কয়েকবার ডাকতেই পাশের বাড়ি থেকে একটা লোক বেরিয়ে আসে। ও এগিয়ে গিয়ে রুমেলার কথা জিজ্ঞেস করতেই আরও কিছু লোক জুটে যায়। ওর বাবার পরিচিত একজন এগিয়ে এসে বলে -''তুম তো ম্যানেজার সাব কা লেড়কা হো? ইধার ক‍্যাসে আয়ে?''

-''এখানে একটা মেয়ে থাকত। রুমেলা....'' ও ভয়ে ভয়ে বলে।

-''তুম উসে ক‍্যাসে জানতে হো বেটা?'' আরেকজন প্রশ্ন করে।

এর মধ্যে কেউ ওর বাবাকে ফোন করে দিয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে বাবা মা কে দেখে আরও ভয় পেয়ে যায় তিতির।


সামনের একটা চায়ের দোকানে ওদের নিয়ে বসায় সবাই। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেন -'' এই বাড়িতে আজ দশ বছর কেউ থাকে না। তার আগে একটা পরিবার থাকত। বাবা মা আর ছোট্ট রুমেলা। একবার একটা দুর্ঘটনায় মা আর মেয়ে মারা যায়। বাবাটা এর পর মনের দুঃখে কোথাও চলে যায়। বাড়িটা সেই থেকে বন্ধ পড়ে রয়েছে। ''

-''কিন্তু গত এক মাস রোজ মেয়েটা আমাদের বাগানে খেলতে আসত। ও আমায় দাদা ডাকত।'' তিতির বলে।

-''ও বেঁচে থাকতে ঐ বাংলোয় খেলতে যেত ঠিকই, তোমার বয়সী একটা ছেলে থাকত ওখানে। পরে তারাও বদলি হয়ে চলে গেছিল। তবে অনেকেই বলে রুমেলাকে ঐ বাংলোর বাগানে দেখেছে। ''


এরপর নানারকম আলোচনা শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ বলছিল বাংলোয় পূজা করাতে। কেউ বলছিল এই বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলতে। দেরি হচ্ছে বলে বাবা মায়ের সাথে ফিরে এসেছিল তিতির। গাড়িতে সব জিনিস তোলা হয়ে গেছিল। শেষবারের মত বাগানটা ঘুরে দেখছিল ও। হঠাৎ ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে ও ঘুরে তাকায়। ওর মনে হল দোলনাটা অল্প দুলছে। ছুটে গিয়ে দেখে দোলনায় একটা রাখি  আর এক থোকা লটকা রাখা রয়েছে।

তিতির ওগুলো হাতে নিয়ে বলে -''থ‍্যাংকিউ বৈনি, আমি জানি তুই আছিস। আমি আবার আসবো তোর জন্য। খুব তাড়াতাড়ি আসব।'' 

ওর চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। 

অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু 

2 comments:

  1. পড়ে খুব ভালো লাগলো। বহিনি ডাক টি উত্তরবঙ্গে এবং সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় খুব প্রচলিত। তিতিরের যে হ্যলুসিনেসন হয় সেটা কোনো পূর্ব ইতিহাস বা তার মানসিকতা বা গল্পের সেট আপে একটু দেওয়া থাকলে ভালো হত ।

    ReplyDelete