Pages

পিকচার পোস্টকার্ড



ক্রমশঃ কিশলয় 
কচিকাঁচাদের মনের সবুজ সাথী
পঞ্চম সংখ্যা
জুন, ২০১৯

কেমন আছ সবাই? স্কুলে স্কুলে গরমের ছুটি ফুরোতে চলল তো? আমার ছানার দু' মাসের ছুটি কবেই ফুড়ুৎ - ব্যাগ কাঁধে তার স্কুল যাতায়াত চালু হয়ে গেছে আবার। দীর্ঘদিনের ছুটিতে বাড়িতে সময় কাটানোও বেচারার কাছে দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

স্বাভাবিক ভাবেই নিজের ছেলেবেলা মনে পড়ে যায়। আমাদের ছুটি কাটত কেমন করে? নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা - তখন তো ফোন-ট্যাবলেট দূরস্থান, টিভিও ছিল না বেশির ভাগ বাড়িতে। থাকলেও তাতে গাদাগুচ্ছের কার্টুন সহজলভ্য ছিল না।দুপুরে 'ছুটি ছুটি’ হত, কিন্তু সে তো দৈনিক এক না দেড় ঘন্টা। টিভি দেখে ছুটি কাটানো যায়, সে সম্ভাবনা মাথাতেই আসেনি কখনো।

পুজোর ছুটির ব্যাপার আলাদা ছিল কিন্তু। পুজোর জামা আর ঠাকুর গুনে, বার্ষিক বরাদ্দ এগ রোলের আর বিলাসিতার নীল গ্যাস বেলুনের সুখস্বপ্নে অর্ধেক কেটে যেত। তারপর লক্ষ্মী পুজো কালী পুজো। তখন দিওয়ালি  কেউ বলত না। 'শুভ দীপাবলী’ উইশ করার চলও ছিল না বোধ হয়। মামার বাড়ি থাকলে লক্ষ্মীপুজোর আলাদারকম হুল্লোড় হত। ময়দা দিয়ে আঠা বানিয়ে চিনে কাগজের শিকলি তৈরি করা, কলার ভেলা বানানো। উচ্চশিক্ষিত আত্মীয়স্বজন মুখ বাঁকিয়ে বলতেন, "শিকলি আবার কী কথা! শিকল বলতে পারিস না!” আমি আজও পারি না। সেই শিকলির সঙ্গে রং মেলানো কটকটে গোলাপী, ফটফটে সাদা, ক্যাটক্যাটে হলুদ চিনির মঠ আসত, কদমা আসত। দেখতে দিব্যি লাগত, খেতে ভাল্লাগত না একেবারেই। গুচ্ছের নাড়ু হত, আর ছাঁচে গড়া নারকেলের সন্দেশ। তারপর তো রংমশাল-চরকি-ফুলঝুরির দিন। বাজিতে ভয় পেতাম চিরকালই, তাই মন খুলে আনন্দ করতে পারতাম না ভাইবোনদের সাথে পাল্লা দিয়ে। তারপর ভাইফোঁটা। কত কিছু।

গরমের ছুটিতে এই এত কিছুর কিছুই থাকত না আবার। রুখাশুখা ছুটি। পূজাবার্ষিকী বইপত্তরের মত গ্রীষ্মবার্ষিকী বেরোলে তাও বুঝি সময় কাটত কিছু। হলিডে হোমটাস্কের সমুদ্দুর অতিক্রম করে নিলে অগতির গতি মামাবাড়ির দিকে পাড়ি জমাতাম আবার৷ মামাতো পিসতুতো ভাইবোন মিলে পাঁচজন ছিলাম, সঙ্গীসাথীর অভাব ছিল না। বাবা পৌঁছে দিয়ে এক রাত কাটিয়ে চলে আসতেন, আসার সময় হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসতেন। বলতেন, “ ভাইবোনেরা মিলে কিছু কিনে খেও।” তবে এই ‘কিছু’র মধ্যে যথেষ্ট গন্ডগোল ছিল। গরমের দিনে আইসক্রিম আর প্লাস্টিকের পাইপে জমানো রঙিন জলের ‘পেপসি'র আকর্ষণই তো সব থেকে বেশি ছিল। ঠিক বানানের ‘কোয়ালিটি’ আইসক্রিম খাওয়া বারণ ছিল। ভুল বানানেরটা বাদে সবই নাকি নর্দমার জল দিয়ে বানানো হত। পয়সা বেশি থাকাকালীন ভাল জিনিসই খেতাম, তারপর আস্তে আস্তে কমদামী জিনিসের দিকে যেতে হত। মনে পড়ে একবার বাবা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার নিরিখে পঞ্চাশ টাকা অনেক অনেক টাকা। তার সবটাই আমরা আইসক্রিম খেয়ে উড়িয়ে ফেলেছিলাম। তারপর দিদার কাছ থেকে কেঁদেকেটে আরো নিতে হয়েছিল।

মামাবাড়ির বাগানে আমগাছ ছিল না। কাঁঠালের আবার কমতি ছিল না। মন ভরে খাওয়া হত। এখন আর ভাল লাগে না। সকালে ধোঁয়া ওঠা পাতলা ডাল দিয়ে ভাত আর কুলের আচার। বছরভর বয়ামে কুল, আমড়া, আমের আচার বানানো থাকত। শৌখিন জিনিসের তালামারা আলমারিতে ডালডার কৌটোর মধ্যে করে তিন চার রকম চানাচুর। দিদার আঁচলে বাঁধা চাবির থেলো থেকে বেছে বেছে চাবি নিয়ে খুলে দিতেন। চেয়ে চেয়ে তিন চার বার খাওয়ার পরে মা দিদাকে বলতেন, “ও মা কত দিচ্ছ? পেট খারাপ করবে তো!” দিদা মা কে উলটো বকা দিতেন, “যাও তো! তুমি খেতে না নাকি ছোটবেলায়?” মায়ের বকা খাওয়াতে কী যে আনন্দ পেতাম!

নারকেলগাছ ছিল অনেক। ডাবের শাঁস, সকালে কখনো নারকেল কোরা, চিনি দিয়ে মুড়ি। বিকেলে আম দুধ দিয়ে মুড়ি মাখা। দিদা ফ্রিজের জিনিস খেতেন না। ফ্রিজ কিনেও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, ব্যবহার হত না বলে। কিন্তু ঠান্ডা জলের অভাবে কষ্ট পেতাম বলে মনে পড়ে না। ডিপ টিউবওয়েলের জলের যেমন মিষ্টি স্বাদ ছিল, তেমন ছিল ঠান্ডা। বাতাবি লেবু মাখা হত। কালোজিরে কাঁচা লঙ্কা কুচি নুন চিনি, আহা সে কী স্বাদ!

আমি বই পড়তে ভালবাসি চিরকালই। আমি গেলেই বড়মামার বাড়ি থেকে দাদা বইয়ের ডাঁই দিয়ে যেত গুড্ডি পড়বে বলে। দাদা বোনেরা যে দুয়েক দিন আসত না তার মধ্যে গোগ্রাসে গিলতাম সে সব। শেষ হয়ে গেলে পুরনো জিনিসের স্তূপ ঘেঁটে বের করতাম হলদে পাতার বই সব। পুরনো পূজাবার্ষিকী, বিদেশী গল্পের অনুবাদ, দস্যু মোহন। অ্যাডভেঞ্চার গল্প, যাতে পেড্রো আর গঞ্জালেস নামের বিচ্ছিরি সব লোকজন থাকত। একবার আর কিছু হাতে না পেয়ে পড়ে ফেলেছিলাম ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’।

ভাইবোনরা থাকলে লেখাপড়া টড়া হত না। খালি পায়ে বাগান, মুরগীর ঘর দাপিয়ে বেড়াতাম যতক্ষণ পারা যেত। দাদু ঘরের জানালা থেকে নিষ্ফল হাঁক পাড়তেন, “দিদা, স্যান্ডেল পায়ে দাও!” মেরেধরে স্নান করাতে নিয়ে যেতে হত। দুপুরটুকু ঘরে থাকতাম বোধ হয়। কী করতাম মনে পড়ে না। দুপুরে ঘুমের অভ্যেস ছিল না। তবে দুপুরবেলার বাগানটাকে অচেনা লাগত। নিঝুম নিঃশব্দ, ভূতুড়ে কেমন। মা ছড়া কেটে বলতেন, “ঠিক দুক্কুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।” ভূতের ভয়ে ভেতরেই থাকতাম নিশ্চয়ই।

রাতে আবার ভূত না হলে চলত না। বড় তিন ভাইবোন দিদার বড় খাটে শুয়ে ভূতের গল্পের আবদার করতাম। বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেলে দিদার ভূতদের তিন চারটে করে মাথা, দশ বারোটা করে হাত, পনেরো কুড়িটা করে পা গজিয়ে যেত। তখন আর শুনতে ভাল লাগত না।

মামাবাড়িতে কুকুর বেড়াল প্রচুর ছিল। কালো হলে কালু, লাল হলে লালু, অন্য যে কোনো রঙের কুকুর ভুলু হয়ে যেত। বেড়াল ছিল বুড়ি, সে আর কোনো বেড়ালকে বাড়িতে থাকতে দিত না। সে আর তার ছানাপোনারা মিলে রাজত্ব করত। মোটের ওপর মাতৃতান্ত্রিক ব্যাপার ছিল - হুলোগুলো কেমন মিনমিনে ছিল, বুড়ির ব্যক্তিত্বের কাছে সুবিধে করতে পারত না। বেড়ালছানা হলে কয়েকদিন দারুণ মজা হত। একবার সেজমামা এক কুকুরের ছানাকে নিয়ে এসেছিলেন, তার ল্যাজখানা টিকটিকির ল্যাজের মত সোজা ছিল। সে সবাইকে অকারণে দাঁত খিঁচুনি দিত, আর খবরের কাগজ থেকে বিছানার চাদর অবধি সব খেত। তার ভয়ে দিন কয়েক চটি কোলে উঁচু খাটে বসে কাটিয়েছিলাম। শেষটায় অতিষ্ঠ হয়ে তাকে মাঠে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে সে বহুদিন বহাল তবিয়তে থেকে পথচারীদের তাড়া করে বেড়াত।

মায়ের কাছে টাইগার বলে এক কুকুরের গল্প শুনেছিলাম। বাগানে গরু ঢুকেছিল, কুকুর সমেত মা মামারা ছিলেন ছাদে। “টাইগার ছুঃ” বলায় টাইগার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল। মনিবের কথা শুনতে হবে সেটাই মনে ছিল, ছাদ থেকে পড়লে পা ভাঙবে সেটা খেয়াল থাকেনি।

শেষদিকের কালবৈশাখী ঝড় মনে পড়ে। লোডশেডিং হয়ে যেত। অন্ধকারে ঝুপঝাপ নারকেল পড়ত গাছ থেকে। মামারা অস্থির হতেন, সকাল হতেই তুলে না নিতে পারলে পাড়ার ছেলেরা নিয়ে যাবে। বাজ পড়লে শাঁখ বাজানো হত।

আমার ছোটবেলার ছুটি বোধহয় মামাবাড়ির সমার্থক ছিল। এখনো রেললাইন দেখলেই, উঁচু পাঁচিলের পাশে নারকেল গাছ দেখলেই মনে হয়, মামাবাড়ি। কুবো পাখির লাল চোখ দেখিনি কতদিন। লোহার গেটে দোল খেতাম, তার মাথার ওপর মাধবীলতা জড়িয়ে থাকত। আর নেই। কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝের বারান্দা নেই। সেই ডিপ টিউবওয়েল নেই। বাঁধানো কলপাড়ে খোদাই করে কে লিখে রেখেছিল বাড়ির কর্তা গিন্নি পাঁচ ছেলেমেয়ের নাম। নেই।

এখন ছুটির রকমসকম পালটে গেছে। ছেলের বন্ধুদের অনেককেই সামার ক্যাম্পে ভর্তি করা হচ্ছে। সময় কাটে না যে। আমার ছুটি কেটে যেত বড্ড তাড়াতাড়ি। ফেরার দিন মাকে বার বার বলতাম, “বাবাকে বোলো না দুষ্টুমি করেছি। আর করব না, পরের বার আর করব না।” পরের বারের অপেক্ষাটুকু অনন্ত মনে হত।

ছুটি আমার কাছে নস্টালজিয়া। তোমাদের মা বাবাদের, দাদু-ঠাম্মা-দিম্মাদের জিজ্ঞেস কোরো তো, তাঁদের ও কি তাই? ছুটি স্পেশাল কিশলয় পড়তে ভুলো না যেন। তোমাদের ছুটির গল্প জানিও আমাদের।

প্রচ্ছদ : সুকান্ত মণ্ডল
কলমে : দেবলীনা দাস 

1 comment:

  1. বাহঃ কী সুন্দর লেখা। আমার ছোটবেলার গরমের ছুটির কত কথা মনে পড়ে গেল। :)

    ReplyDelete