“রায় বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে জানিস?” পাপাই উত্তেজিত হয়ে বলল।
“হ্যাঁ, শুনেছি,” জয় ক্লাসে ঢুকে কাঁধের থেকে ব্যাগটা বেঞ্চের উপর নামাতে নামাতে বলল।
মুখটা জয়ের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে পাপাই বলল, “কে কিনেছে জানিস?”
জয় মাথা নেড়ে বলল, “কই না তো! কে?”
ফিসফিস করে পাপাই বলল, “সমরজিৎ!”
জয়ের চোখ গোল গোল হয়ে গেল, “বলিস কী রে!”
সমরজিৎ টলিউডের নামকরা চিত্রতারকা। জয়, পাপাই আর ওদের ক্লাসের প্রায় সবাই ওঁর ফ্যান। ওঁর 'অ্যামাজনের জঙ্গলে' সিনেমাটা ওদের ক্লাসের অনেকেই চার-পাঁচবার দেখেছে! জয় নিজেই ওঁর 'মরণফাঁদ' সিনেমাটা দু'বার দেখেছে। একবার বাবা, মা, দিদির সাথে আর আরেকবার পাপাইদের সাথে। সিনেমাটার সব ডায়লগ ওর প্রায় মুখস্থ! সেই হেন সমরজিৎ কিনা রায়বাড়িতে এসে থাকবেন! ঠিক যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর।
“তুই ঠিক বলছিস?”
“দেখ, আমি যা জানি তাই তোকে বললাম। এখন আমার খবর যদি ঝুঠো হয় তাহলে তো আর আমার কিছু করার নেই! কাল যখন মালপত্র বোঝাই ট্রাকগুলো বাড়ির সামনে এসেছিল তখন বিশুদা ওই লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করেছিল। ওরাই বলল। তবে কি, এটা হল ওঁর অনেকগুলো বাড়ির মধ্যে একটা। উনি এখানে এসে আদৌ থাকবেন কিনা সেটা কেউ জানে না। লিঙ্ক রোডে ওঁর এক মাসি না দিদা কে যেন থাকেন তাই এই বাড়িটা কিনেছেন উনি। তবে আমি আশা করছি একদিন না একদিন ওঁকে দেখতে পাবো! ওঁর সাদা মার্সিডিজ গাড়ি খুব পছন্দ। তোদের ওই রাস্তা হয়েই তো রায়বাড়ি যেতে হয় , তা তোদের রাস্তা দিয়ে যদি কোন সাদা মার্সিডিজ যেতে দেখিস তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করবি, বুঝেছিস?”
তক্ষুনি স্কুলের ঘন্টা পড়ে যাওয়াতে আর কথা হল না। পাপাই অন্য সেকশনে পড়ে তাই সে নিজের ক্লাসে চলে গেল। পড়ায় আর মন বসছিল না জয়ের। বার বার মনে হচ্ছিল, সত্যি সত্যি সমরজিৎ আসছেন কি?
“নকুল! কী হচ্ছে? টেবিলের তলায় ঢুকে কী করছ?”
টিচারের ধমকে চমক ভাঙল জয়ের। মাস দুয়েক হল নকুল বলে ছেলেটা ওদের ক্লাসে এসে ভর্তি হয়েছে। নেহাতই সাদাসিধে গোবেচারা গোছের ছেলে। পড়াশোনায় বেশ কাঁচা তাই টিচারদের কাছে প্রায়ই বকুনি খায় আর নিরীহ বলে অনীক আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা বিরক্ত করে।
টিচারের কথায় নকুল টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “আমার পেনটা টেবিলের তলায় পড়ে গিয়েছিল, সেটাকেই তুলছিলাম।"
“ঠিক আছে, তোলা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে পড়ায় মন দাও। তারপর বলবে বুঝতে পারিনি!”
নকুল সোজা হয়ে বসতেই ওর সামনে বসা অনীক টুক করে আবার ওর পেনটা নিচে ফেলে দিল। টিচার দেখতেও পেলেন না।
বেচারা নকুল যখন সেটাকে তোলার জন্যে যেই আবার নিচে ঝুঁকেছে অমনি টিচার দেখতে পেয়ে আবার ওকে বকলেন,
“নকুল! বার বার পেন নিচে ফেলছ কেন?”
নকুল আমতা আমতা করে বলল, “আমি না...অনীক ফেলে দিয়েছিল!”
এবার টিচার বুঝতে পেরে অনীককে ধমক দিলেন।
পরের পিরিয়েডে পি. টি. ছিল। ক্লাসে মাঝপথে পি. টি. স্যারকে প্রিন্সিপাল জরুরি কাজে ডেকে পাঠালেন । ওদের বাধ্য হয়ে থাকতে বলে স্যার প্রিন্সিপালের ঘরে চলে গেলেন।
সুযোগ পেয়েই অনীক আর তার বন্ধুরা নকুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথার বাণে জর্জরিত করে তুলল ওকে। নকুল ছুটে পালাতে গিয়ে একটা গাছের গোড়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মাথাটা দমাস করে গাছের গায়ে ঠুকে গেল।
জয়ের খুব মায়া হচ্ছিল ওকে দেখে। সে ছুটে গিয়ে নকুলকে তুলল।
মাথায় হাত দিয়ে নকুল বলল, “আমি কোথায়?”
ওকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।
ক্লাসের অন্যরা সবাই হেসে ফেলল। অনীক ফোড়ন কাটল, “তুই কি ভাবলি স্বর্গে পৌঁছে গেছিস নাকি? কোথাও যাসনি! স্কুলের মাঠে পি.টি. ক্লাসে চিৎপটাং হয়েছিলি এখন উঠে দাঁড়িয়েছিস!”
নকুল যেন কিছুই বুঝতে পারছে না এমন ভাবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
অনীক এবার বলল, “কী রে? বাবার নাম ভুলে গেলি নাকি? নিজের নাম মনে আছে তো?”
সেই শুনে ওর সাঙ্গোপাঙ্গোদের সে কী হাসি! সবাই চিৎকার জুড়ে দিল, “ভেবলুচাঁদ ভেবলেছে! হি হি হি!”
জয় দেখল আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। সে চটপট নকুলকে টেনে নিয়ে চলল। নকুল তখনও টলছে। ওর যে মাথায় চোট লেগেছে সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না জয়ের।
“চল নকুল!”
বলে ওকে একরকম হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল জয়।
অনীক আর দল রেগে বলল, “অরিঞ্জয়টা একেবারে যা তা! কেমন মজাটা হচ্ছিল সব মাটি করে দিল!”
জয় অবশ্য ওদের কথায় কান দিল না। ওকে যা করার করতে হবে সেটাই ওকে বাবা-মা শিখিয়েছেন।
প্রিন্সিপালের অফিসটাই ওখান থেকে সব থেকে কাছে তাই সেখানেই নিয়ে গেল ওকে। জগদীশদা, মানে প্রিন্সিপালের সেক্রেটারি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “কী ব্যাপার, এখানে কেন? স্যার মিটিঙে আছেন, এখন কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না।”
“নকুল পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছে জগদীশদা! 'আমি কোথায়, আমি কোথায়' করছে। ওকে মনে হয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
“এই খেয়েছে! এটা তো সিরিয়াস ব্যাপার! দাঁড়াও তাহলে স্যারকে বলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে,” বলে তড়িঘড়ি অফিসের ভিতর ঢুকে গেলেন জগদীশদা।
কয়েক মিনিট বাদেই প্রিন্সিপাল স্যার পি. টি. স্যারকে সাথে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। নকুলকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওঁরা। সেই সুযোগে সেখান থেকে সরে পড়ল জয়। ওর কাজ হয়ে গেছে।
*****
তিনদিন পর, রবিবার দিন দুপুরবেলা একটা সাদা মার্সিডিজ গাড়ি এসে থামল জয়দের বাড়ির সামনে আর সেটা থেকে নামলেন স্বয়ং সমরজিৎ!
জয় দেখে ভাবল, ‘আরে উনি ভুল বাড়িতে চলে এসেছেন নাকি?’
যাই হোক পাপাইকে জানাতেই হবে, না হলে পাপাই ওকে কোনওদিন ক্ষমা করবে না। সেই কথা ভেবে সে ছুটে পাপাইকে একটা ফোন করেতে গেল।
ও ফোন সেরে আসতে আসতে সমরজিৎ ওদের বাড়িতে ঢুকে বাইরের ঘরের সোফায় বসেছেন। বাবা-মা দুজনেই তো থ!
সমরজিৎ বললেন, “এটাই অরিঞ্জয় সামন্তর বাড়ি তো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ! কী করেছে জয়?” বাবা বেশ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ততক্ষণে জয় ঘরে এসে ঢুকেছে। সমরজিতের সাথে ওটা আবার কে? ও মা নকুল!
সমরজিৎ বলে চলেছেন, “আমি অরিঞ্জয়কে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। নকুল আমার ভাগ্নে।"
বাবা-মা তো বুঝতেই পারছিলেন না কী ঘটছে। নকুলের ঘটনাটা জয় ওঁদের বলেনি যে!
“সেদিন পড়ে গিয়ে ওর ভালো রকম কনকাশন হয়ে গিয়েছিল, ওকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারত। নকুল আমাকে বলেছে জয়ই ওকে ধরে তুলেছিল, প্রিন্সিপালের অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। তাই আমি জয়ের সাথে নিজে দেখা করতে এলাম। তুমি জয় তো? এসো, এখানে বসো।"
নকুল ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। কী লাজুক ছেলে রে বাবা! সমরজিৎ যে ওর মামা হন সেটা কাউকে বলেনি। বললেই তো সব অত্যাচার থেমে যেত!
সমরজিৎ যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই বললেন, “আমিই ওকে বারণ করেছিলাম কাউকে বলতে। জানাজানি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে খুব ঝামেলা হয় তাই।"
সমরজিতের পাশে বসে ওঁর সই করা নতুন সিনেমার ডিভিডিটা হাতে নিয়ে জয় বলল, “আপনি একটু বসবেন তো? আমি আমার খুড়তুতো ভাই পাপাইকে ফোন করেছি, ও এই এসে পড়ল বলে। ও না আপনার প্রবল ফ্যান! যদি এসে দেখে আপনি চলে গেছেন তাহলে আমাকে আর কোনওদিন ক্ষমা করবে না।"
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণঃ সুকান্ত মণ্ডল
অলঙ্করণঃ সুকান্ত মণ্ডল
পড়লাম। বেশ লাগলো।
ReplyDeleteকমেন্সে এপ্রুভলের প্রয়োজন আছে ? এর আগে দেখিনি তো ?
ReplyDeleteদারুন গল্প দিদি
ReplyDeleteভালো লাগল। সঙ্গের ছবিও সুন্দর :)
ReplyDeleteছবি এবং গল্প দুটোই পরম উপাদেয়। চেটে পুটে খেলাম।
ReplyDeleteবেশ ভালো লাগলো।
ReplyDeleteছোটোদের গল্পের আড়ালে বুলিইং-এর বাস্তবটা খুব ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই সুন্দর গল্পটায়। বেশ ভালো লাগল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো দিদি।
ReplyDelete