Pages

গল্পের ঝুলি : আমাদের স্বাধীনতা: প্রিতম দাস




মনটা একদম ভালো লাগছে না বিতানের। স্কুল থেকে ফিরে কোনওমতে পিঠের ভারি ঢাউস ব্যাগটা খাটের উপর ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে আছে ও। খেয়েদেয়ে দু’ঘন্টা ঘুমিয়েই আবার পড়তে বসতে হবে ওকে। সাড়ে পাঁচটায় দিদিমণি আসবেন বাড়িতে, বিতানকে পড়াতে। ক্লাস ফোরেই এই পড়ার চাপ, ফাইভে উঠলে যে কী হবে কে জানে! মা বলেছে ক্লাস ফাইভ থেকে আরও ভালো করে মন দিয়ে পড়তে হবে, না হলে ভালো রেজাল্ট হবে না।


রোজ রোজ এই এক রুটিন আর ভালো লাগে না! মানে রোজ বলতে রোজ ঠিক না, সপ্তাহে পাঁচদিন। শনি, রবি ছুটি। স্কুলও থাকে ওই পাঁচদিনই। তবে তোমরা কিন্তু আবার ভেবে বোসো না যে এই ছুটির দু’দিন বিতান মজাসে খেলে, ঘুমিয়ে, কার্টুন দেখে, কমিক্স পড়ে কাটাতে পারে! তার কোন উপায় নেই। শনিবার দিনটা পুরোটাই কেটে যায় উইকেন্ডের টাস্ক করতে। রোববার সকালটা অবশ্য ফাঁকা থাকে, তবে বিকেলেই থাকে আবার আঁকার ক্লাস। তোমরাই বলো এসবের মাঝখানে বেচারা বিতান একটু দম ফেলবে কখন?


যাই হোক, কাল ১৫ই আগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। কালকে স্কুলে কোনও ক্লাস হবে না। স্বাধীনতা দিবস পালন হয়েই ছুটি। এইটা একটা ভাল কথা। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে 'ছোটা ভীম' একটু বেশি সময় নিয়ে দেখা যাবে! তবে খারাপ খবরও যে নেই তা নয়। ওদের ক্লাসটিচার ম্যাম বলেছেন সবাইকে কিছু না কিছু ভাবে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেই হবে। মানে কিছু একটা পারফর্ম করতে হবে আর কী! বিতানের এমনিতে এইসব কালচারাল ফাংশনে অংশগ্রহণ করতে একদম ভালো লাগে না! দর্শকটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু মঞ্চে উঠলেই মনে হয় সবাই যেন হেডদিদিমণির মত রাগী চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে! ওর সব কেমন গুলিয়ে যায়।


বিতান ঠিক করেছে অংশগ্রহণ যখন করতেই হবে, ও একটা কবিতাই আবৃত্তি করবে কাল। মাকে বলাতে মা বললেন কুসুমকুমারী দাশের লেখা 'আদর্শ ছেলে' কবিতাটা আবৃত্তি করতে। ওটাই সবচেয়ে ভালো হবে। কিন্তু আবৃত্তি করবে বললেই তো আর করা হয়ে গেল না, তার জন্য কবিতাটা ভাল করে মুখস্থ করতে হবে। তারপর বেশ কয়েকবার আবৃত্তির মতো করে বলা প্র্যাক্টিস করতে হবে। তাই আজ দিদিমণি চলে যাওয়ার পরও সব সেরে ঘুমাতে ঘুমাতে ঘুমাতে মনে হয় বেশ রাত হয়ে যাবে। কী আর করা, ক্লাসটিচারের নির্দেশ। অমান্য তো আর করা যাবে না।


বিতানের বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার পথে বস্তি পড়ে একটা। বিতান আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে আজকের বস্তির কোনও তফাৎ খুঁজে পেলো না। ও একটু অবাকই হলো। আসার সময় ওদের পাড়াতেই তো দেখলো কী সুন্দর ভারতের পতাকা টাঙানো হয়েছে একটা! ওকে দুটো লজেন্সও দিলো ওদের পাড়ার দীপকাকু। অথচ এখানে তো তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না বিতানের! তবে কি এখানে স্বাধীনতা দিবস আসেনি? না, ওই তো খালি গায়ে ওর বয়সী দুটো ছেলে একটা পুরোনো টায়ার নিয়ে গড়াতে গড়াতে এই দিকেই আসছে। হাতে একটা ছোট লাঠি। ওরা তো বিতানের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন! কী সুন্দর নিজের মনের সুখে ওরা খেলেধুলে বেড়াতে পারছে! তবে কেন ওরা পালন করছে না স্বাধীনতা দিবস, আর বিতান স্বাধীনতা দিবস পালন করতে যাচ্ছে স্কুলে? বিতান ভাবলো মাকে প্রশ্নটা একবার করলে হতো, কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলালো ও। বিতান জানে স্কুল যাওয়ার সময় মাকে এইসব আবোলতাবোল প্রশ্ন করলে, মার ধমক খাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।


স্কুলে পৌঁছে বিতান দেখলো, ওদের স্কুলের মাঠটায় বড় একটা মঞ্চ বানানো হয়েছে। আর তার সামনেই স্ট্যান্ড বানানো হয়েছে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য। ফুল আর মালা দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে জায়গাটা। আজ স্টুডেন্টদের সঙ্গে সব অভিভাবকরাও উপস্থিত। সমস্ত মাঠ জুড়ে অনেক চেয়ার রাখা হয়েছে সবার বসার জন্য। তবে সামনের সারিগুলো স্টুডেন্টদের জন্য আর পিছনেরগুলো অভিভাবকদের। মানে তেমনি নির্দেশিত আর কী! বিতান দেখলো অনেকেই ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। এমনকি ওর বেস্টফ্রেন্ড রণজয়ও চলে এসেছে ওর আগেই। ওকে দেখেই রণজয় হাত নাড়লো, 'শুভম এইদিকে আয়’। ওহ্, তোমাদের তো বলাই হয়নি আমাদের বিতানের ভালো নাম শুভম সেনগুপ্ত। বিতান গিয়ে বসলো রণজয়ের পাশে। আর ওর মা রণজয়, অর্ণব, মধুরিমা এদের মায়েদের সঙ্গে গিয়ে বসলেন পিছনের সারিতে।


অনুষ্ঠান শুরু হল। সকলে উঠে দাঁড়ালে বড়দিম্যাম এসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন একদম প্রথমেই। এরপর সকলে মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পর শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিতিপ্রিয়া, সৌমিলি, অনুষ্কা সমবেত নৃত্য পরিবেশন করলো। রণজয় খুব সুন্দর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলো। অনুরাগ আবৃত্তি করল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটা। আমাদের বিতানও অবশ্য খারাপ করেনি। বেশ ভালোই হাততালি পেয়েছে ওর আবৃত্তিও।


সবশেষে বক্তব্য রাখতে মঞ্চে উঠলেন বড়দিম্যাম। মাইক হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন মঞ্চের একদম সামনে,


-“স্বাধীনতা। চার অক্ষরের একটা শব্দ। মানেটা কিন্তু অনেক বড়। আমরা স্বাধীনতা বলতে ঠিক কী বুঝি? আচ্ছা স্টুডেন্টস তোমাদের যদি বলা হয় একদিনের জন্য তোমরা স্বাধীন, যা ইচ্ছে তাই করতে পারো, কেউ তোমাদের বকবে না, কেউ তোমাদের মারবে না, তাহলে তোমরা কি করবে? একে একে বলো সকলে।”


বলে বড়দিম্যাম মাইকটা এগিয়ে দিলেন একদম সামনের সারির রৌনকের হাতে। সকলে একে একে বললো তাদের মনের সুপ্ত ইচ্ছের কথা। কেউ বললো আমি সারাদিন ভিডিও গেম খেলতাম। কেউ বললো আমি সারাদিন গল্পের বই পড়তাম। কেউ বললো আমি সারাদিন কার্টুন দেখতাম। বিতান অবাক হয়ে দেখলো কেউই বললো না আমি সারাদিন পড়াশোনা করতাম। এমনকি ক্লাসের ফার্স্টগার্ল সুস্মিতা পর্যন্ত পড়াশোনার কোনো ইচ্ছাই প্রকাশ করলো না! অথচ ওর মোটা চশমার পিছনে গোল গোল চোখ দেখে বিতান ভাবতো পড়াশোনা ছাড়া এ মেয়ে বোধহয় আর কিছুই বোঝে না। পড়াশোনাই বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় সুস্মিতার। কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে সুস্মিতা বলে উঠলো,

-“আমার ঘুরতে খুব ভাল লাগে ম্যাম। সুযোগ পেলে আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম, নতুন নতুন জায়গায়।”

মাইকটা সবার হাত ঘুরে আবার ফেরত গেল বড়দিম্যামের হাতে। মাইকটা নিয়ে তিনি আবার বলা শুরু করলেন,

-“দেখলে তো সুযোগ পেলে আমরা সবাই সব কিছুই করতাম কিন্তু কেউই পড়াশোনা করতাম না! আমরা যদি একটুও পড়াশোনা না করি তবে পরীক্ষার সময় আমরা কী করে পাশ করবো? পাশ না করলে উঁচু ক্লাসে উঠবো কী করে, নতুন জিনিস শিখবো কী করে? সেই কারণেই বাবা মা অভিভাবকরা আমাদের জোর করে পড়তে বসান। তবে একটা কথা আমি অভিভাবকদেরও বলবো, সবসময় অতিরিক্তি চাপ দেবেন না। ওদের একটু খেলাধুলোও করতে দিন, কমিকস পড়তে দিন, গল্পের বই পড়তে দিন। তবেই তো ওদের পড়াশোনাতেও আগ্রহ তৈরি হবে। আমরা তো সকলেই জানি জ্যাকের কথা, 'All work and no play makes Jack a dull boy' , কি, জানি না?
আর স্টুডেন্টস তোমাদেরও বলছি পড়াশোনার সময় পড়াশোনা আর খেলাধুলোর সময় খেলাধুলো, দুটোই যেন সমানভাবে চলে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে স্বাধীনতার যেন কোনও অপপ্রয়োগ আমরা না করি। মনে রাখবে 'with great power comes great responsibility' , আর স্বাধীনতার থেকে বড় শক্তি, বড় power আর কী-ই বা আছে? তাই আমাদের স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার করতে হবে আমাদেরই। আর এটাই প্রকৃত স্বাধীনতার মানে।”


বক্তব্য শেষ করলেন বড়দিম্যাম। হাততালিতে তখন মাঠে কান পাতা দায়! বিতান বুঝলো আজ সকালে স্কুল আসার সময় ওর বয়সী ছেলেদুটোকে দেখে ওর যা মনে হয়েছিল, তা আসলে ভুল ছিলো। সারাদিন খেলে বেড়ানোর স্বাধীনতা মোটেও ভালো কথা নয়। হয়তো ওরাও চায় না এমন স্বাধীনতা! ওরাও হয়তো চায় বিতানের মতোই স্কুলে এসে পড়াশোনা করতে! বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রেয়ার করতে! টিফিন টাইমে সবাই মিলে একসাথে টিফিন ভাগ করে খেতে! হয়তো ওদের কাছে স্বাধীনতা মানে এগুলোই, ইচ্ছেমতো ওই ঘুরে বেড়ানোটা নয়! বিতান ভাবলো আমরা বোধহয় কেউই আমাদের মনের মতো স্বাধীনতা কোনোদিনই পাই না। সুমিত যে স্বাধীনতাটা চেয়েছিলো সেটা হয়তো সুমন পাচ্ছে, আবার সুমনেরটা পাচ্ছে হয়তো অন্য কেউ। কী আর করা যাবে, সুমন না হয় সুমিতের স্বাধীনতাটা নিয়েই খুশি থাকুক। ক্ষতি কী?


(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : আবির

2 comments:

  1. ভালো। একটা সুন্দর বার্তা আছে গল্পের মধ্যে। 😊

    ReplyDelete