-"না, আর কিছু করার নেই। সব শেষ। বাঁচানো গেল না ওঁকে। আসলে ওষুধগুলোই ঠিক নয়।''
আফসোস ঝরে পড়ল ডাঃ হালদারের গলায়।
ধপ করে বসে পড়ল ছেলেটা। খুব চেষ্টা করেছিল, সব কিছু বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছিল। যা যা ওষুধ বলেছিলেন ডাঃ হালদার সব এনেছিল। তবুও...
খুব রাগ হচ্ছিল ছেলেটার। ফেটে পড়তে ইচ্ছা করছিল। হঠাৎ একটা জুনিয়র ডাক্তার এসে ডাঃ হালদারকে কিছু বলল। ভ্রু কুঁচকে ডাঃ হালদার সবটা শুনলেন। এই ছোট্ট নার্সিংহোমটা ওঁর বাড়ির একতলায়। একাই থাকেন, চারজন ডাক্তার আর কয়েকটা নার্সকে নিয়ে গরিবদের চিকিৎসা করছেন আজ দশ বছর। অশোকের মা হার্টের অসুখে ভুগছিল, এক সপ্তাহ ধরে ভর্তি ছিল এখানে। অশোক একটা ট্যাক্সি চালাত।
-" ওষুধগুলো কোথা থেকে এনেছিলে অশোক?''
ডাক্তার হালদারের প্রশ্নে মুখ তোলে অশোক। বলে,
-"আমার এক বন্ধু এনে দিয়েছিল কম দামে। ও একটা ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটারের ওখানে কাজ করে। কেন ?''
-"আমাদের সন্দেহ ঠিক, সব ডেট পার হয়ে যাওয়া ওষুধ। সব নষ্ট হয়ে বিষ হয়ে গেছে। এই সব আবার ঘুরে মার্কেটে চলে আসছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর হাত ধরে। ''
-'কী বলছেন আপনি!''
চমকে ওঠে অশোক। গাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছে মায়ের অসুখের চিকিৎসা করতে গিয়ে, তারপরও বাঁচাতে পারল না মাকে।
-''এখন মাথা ঠাণ্ডা করে বাড়ি যাও। তুমি আমি সাধারণ মানুষ। এরা সব রাঘব বোয়াল। বড় বড় মন্ত্রী জড়িত এ’সবে। কিছুই করতে পারবো না আমরা।''
চোয়াল শক্ত হয় অশোকের। চোখের জল শুকিয়ে আগুন জ্বলে ওঠে, বলে
-"আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।"
-"পনেরো বছর আগে আমার চাকরি গেছিল এদের জন্য। জাল ওষুধের এক কারবারিকে ধরেছিলাম। কিন্তু টাকার জোরে বেরিয়ে এসেছিল মাত্র তিন বছর জেল খেটে। আমাকেই মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে চাকরি কেড়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে আমি গরিবদের চিকিৎসা করি এখানে। ওদের হাত অনেক লম্বা অশোক। ভুলে যাও ওসব।”
ওর কাঁধে হাতটা রাখেন একবার, তারপর চলে যান ডাঃ হালদার।
অশোক সেদিকে চেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে । ওর আর কিছুই হারাবার নেই।
*************************
শীতের ছুটিটা এবার ঘরে বসেই কাটবে ভেবেছিল রুবাই। কিন্তু হঠাৎ বাবার একটা সেমিনার পড়ে গেল কলকাতায়। রুবাইয়ের বাবা রাজেশবাবু মালবাজার হাসপাতালের সুপার আর মা শ্রমণাদেবী মেয়েদের স্কুলের বড়দি। ওঁরও বড়দিনের ছুটি চলছিল। সবাই মিলেই তাই কলকাতা এসেছিল ছুটিতে। কলকাতায় রুবাইয়ের ছোটমামা থাকে। রুবাই কলকাতা আসতে খুব ভালোবাসে তার আরেকটা কারণ ছোটমামার অফিস। ওর ছোটমামার ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ আছে। ক্যানিং স্ট্রিটে ছোটমামার ছোট অফিসটা ওর ভীষণ প্রিয়। আসলে ঐ বাগড়ি মার্কেটের গায়ে অফিস আর গুদামটা, ওখানে পাওয়া যায় না এমন কোনও জিনিস নেই। রুবাই এর আগেও দু’বার এসেছে। এবার ছোটমামা ওদের নিজের নতুন অফিস দেখাতে নিয়ে এসেছিল ক্যানিং স্ট্রিটের মেহতা বিল্ডিং-এ। ওর মামা এখন এক বড় ওষুধ কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর। ক্যানিং স্ট্রিটের গলির ভেতর হাঁটাই যায় না এমনভাবে সব দোকান। চারদিকে খেলনা থেকে ন্যাপথলিন, বাড়ির সব রকম প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে দড়ি প্লাস্টিক, কী নেই!! রুবাইয়ের মা ঘরের টুকিটাকি জিনিস কিনতেই ব্যস্ত। তবে এমন ভিড়ে বাজার করতে ওরা কেউ অভ্যস্ত নয়, সব গলিগুলো একই রকম। নানারকম ইমিটেশন গয়না, ঘর সাজাবার জিনিস, ব্যাগ সুটকেস, কী নেই ঐ বাজারে। দোতলায় ছোটমামার বন্ধু কাশিম ভাইয়ের খেলনার দোকানে নিয়ে গেছিল মামা। রুবাই একটা ভিডিও গেম আর দূরবীন পেয়েই খুশি।
উল্টোদিকের মেহতা বিল্ডিং-এ মামার নতুন অফিসে গিয়ে রুবাই আরও অবাক। এমন পুরানো অন্ধকার বাড়ির ভেতর এমন ঝাঁ চকচকে আধুনিক অফিস থাকতে পারে ওর ধারণাই ছিল না। মামার নতুন এয়ার কণ্ডিশনড অফিসে বসে বাবা গল্প করছিল মামার ম্যনেজার দত্ত আঙ্কলের সাথে। ছোটমামা আর মা বেরিয়ে গেছিল বাজারে, কেনাকাটায়। রুবাই এক মনে আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত। ডিসেম্বরেও কলকাতায় দিনের বেলায় এসি লাগছে। ওদের মালবাজারে এ সময় সোয়েটার টুপি পরে থাকতে হয়। ছ’শো স্কোয়ার ফিটের সুন্দর সাজানো অফিস হলেও টয়লেট নেই নিজেদের। হাত ধোবে বলে রুবাইকে যেতে হল ঐ উইং এর শেষ প্রান্তের কমন টয়লেটে। অন্ধকার উইং এর দু’ধারে গুদাম আর ছোট ছোট খুপরি অফিস, ঘেমো গায়ে কুলিদের আনাগোনা, ওয়ারিং-এর ঝুলন্ত তার আর পানের পিক ভর্তি নোংরা দেওয়াল, এসব দেখে রুবাইয়ের গা ঘিনঘিন করছিল। এত নোংরা বাথরুম ও আগে কখনও দেখেনি। বিচ্ছিরি গন্ধ আর নোংরা জল চারদিকে। কোনও রকমে হাত ধুয়েই ও বেরিয়ে আসছিল। ঠিক তখনি করিডোরে লোকটার সাথে ধাক্কা লেগেছিল ওর । আসলে কী করে যেন পা-টা পিছলে গেছিল। টাল সামলাতে না পেরে ও পড়েই যাচ্ছিল। লোকটাকে ধরে ও যদিও সামলেছিল কিন্তু লোকটার হাতের দুটো বাক্স ছিটকে পড়েছিল। আর কিছু কাঁচের বোতল ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।
খুব ভয় পেয়ে গেছিল রুবাই। ‘সরি’ বলে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়েছিল লোকটার দিকে। হাল্কা চাপদাড়ি একটা আধময়লা সার্ট পরা লোকটা গুটখার পিক ফেলে, ওকে একটা নোংরা গালাগালি দিয়ে বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল ,
-"ইয়ে নুকসান কৌন ভরেগা অব?"
-"আমার বাবা দিয়ে দেবে। আপনি আসুন আমার সাথে।'' মুখটা কাঁচুমাচু করে বলেছিল রুবাই। ক্লাস সিক্সে পড়া রুবাই এমনিতে ভীষণ স্মার্ট, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কেমন যেন হয়ে গেছিল। লোকটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল। একটা পরিচিত গন্ধ পাচ্ছিল রুবাই ভাঙ্গা শিশিগুলো থেকে। ঠিক ওষুধের নয়, মনেও করতে পারছিল না ঠিক কীসের গন্ধ। ছোট্ট একটা জটলা তৈরি হয়ে গেছিল ওদের ঘিরে। হঠাৎ মামার একটা স্টাফ ওকে দেখে এগিয়ে এসেছিল। ততক্ষণে ঐ লোকটার দুই শাগরেদ বেরিয়ে এসেছিল পাশের একটা ছোট্ট গুদাম থেকে। ওরা কাঁচের টুকরো ও বাক্স পরিষ্কার করে তুলতে লেগেছিল। ঐ লোকটা মামার স্টাফটার সাথে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পরেছিল। রুবাই বারান্দার শেষ মাথায় মামার অফিসে দৌড়ে চলে এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে যাবে ভাবছিল। হঠাৎ একটা সাফারি পরা মাঝবয়সী লোক এসে চিৎকার করে উঠল -"ক্যায়া হো রহা হ্যয় ইধার ? কই মেলা লাগা হ্যায় ক্যায়া?"
সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল লোকটার কথায়। ঐ চাপদাড়ি লোকটা রুবাইকে দেখিয়ে বলল কী হয়েছে। রুবাইও বলল যা লোকসান হয়েছে ওর বাবা দিয়ে দেবে। লোকটা রুবাইয়ের বাবার নাম শুনে হাসল, বলল
-"ডাগতার বাবুকা বেটা? সোম-বাবু কা ভাগনা? তুম তো হামারা গেস্ট হো। কোই বাত নেহি। সব যাও আপনে আপনে কাম পর।"
ওর চুলটা ঘেঁটে দিয়ে লোকটা হাসল পান খাওয়া দাঁত বের করে। তারপর চাপদাড়িকে বলল,
-"এক কাম ভি ঢংসে নেহি হোতা তেরে সে!! জলদি সব সাফ কর, এক ভি কাঁচ কা টুকরা নেহি রহনা চাহিয়ে। কাম পে যাও বাকি সব। ''
লোকটার গলায় কিছু ছিল, ভিড়টা নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল। রুবাইও চলে গেল বাবার কাছে। মনটা বড্ড খচখচ করছিল। নিজেই বাবাকে খুলে বলল সবটা। আসলে লোকসান তো হয়েছিল। অতগুলো শিশি ভেঙ্গে ফেলল ও!! রাজেশবাবু শুনেই দত্তকে বললেন -"চলো তো দেখি!! কী কাণ্ড। দামটা না হয় দিয়েই দেবো।''
দত্ত বলল -''মনে হয় গোয়েল ফার্মা, ওদের গুদামটা ওখানে। আসুন দেখছি।''
রুবাইও ওদের পিছু পিছু গেলো। ছোট্ট গুদামটার ভেতর ভর্তি প্যাকিং বাক্স, ঢোকার জায়গা নেই। ভেতরের আরেকটা ঘর থেকে কথা ভেসে আসছিল। দত্তবাবুর ডাকে সেই সাফারি পরা লোকটা বেরিয়ে এলো। রাজেশবাবুকে দেখে বিগলিত। বলে উঠল
-"আরে ডাগতার বাবু হামারে ইধার? আইয়ে আইয়ে, লেকিন কাহা বৈঠায়ে আপকো! ইধার তো জাগা নেহি হ্যায়। উপর অফিসমে চলিয়ে সাব।''
রাজেশবাবু ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করছিলেন লোকটাকে চেনেন কিনা। অধিরাজ গোয়েল বলে একজনকে চিনতেন বহু বছর আগে। তবে লোকটা জাল ওষুধচক্রে জড়িয়ে জেল খেটেছিল।
-"গোয়েলজী, বাচ্চে নে কুছ নুকসান কর দিয়া আপকা শুনা...''
দত্ত আঙ্কলের কথার মাঝেই এক হাত জিভ কেটে লোকটা বলল,
-"আরে ও তো বাচ্চা হ্যায়, কিষণ ভগবান। ছোড়িয়ে দত্তাজী ও সব। আইয়ে অফিস মে। চায়ে পিজিয়ে আপলোগ। ''
ওঁর জোরাজুরিতে যেতেই হল ওঁর অফিসে, রাজেশবাবু বার বার দাম দিতে চাইলেও নিলো না। ওঁর একটাই কথা ওটা একটা এক্সিডেন্ট। রুবাই ভাবেনি লোকটা এত ভালো হবে। বাবাদের চা খাওয়ালো আর ওর জন্য এলো লস্যি। বড় একটা চকলেট বারও দিল ওকে। আবার আসতে বলল ওদের।
দত্ত আঙ্কলের সাথে গাড়িতে ফেরার পথে রাজেশবাবু বললেন -"লোকটা একটু বেশি অমায়িক মনে হল। কেমন যেন গায়ে পড়া... আমাকে চিনল কী করে?"
-''ও এই বাজারের বড় কন্ট্রোলার। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সাপ্লাই দেয় ওরা। তাই হয়তো আপনাকে চেনে। কত বড় মন্ত্রীদের সাথে ওঠাবসা। বড় স্টকিস্ট, তবে ভীষণ চতুর। বাদ দিন ওর কথা। সোম-বাবু সব জানে।''
সোম রুবাইয়ের ছোটমামার নাম।
রুবাই ভাবছিল শিশিগুলোর কথা, কী ওষুধ ছিল ও’গুলো? শিশিগুলো অন্যরকম। গন্ধটা অনেকটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত। এর আগে বেশ কয়েকটা রহস্য সমাধান করেছে রুবাই। চোখ কান ওর সর্বদা খোলা থাকে। এখানেও একটা রহস্যর গন্ধ পাচ্ছিল ও।
***************************
-"ডাক্তার বাবু, আমি কিছু খবর জোগাড় করেছি। প্রমাণ আছে বেশ কিছু। কিন্তু আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি কিছু করতে পারেন!''
ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেন না ডাঃ হালদার। ওকে ভেতরে ডেকে সবটা শুনলেন। ওর কমদামী মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন -''পুলিশে গিয়ে লাভ হবে না। মিডিয়াতে জানিয়ে দেখি কী হয়। অশোক তুমি কাল বিকালে এসো একবার। ''
অশোক চলে যেতেই এক পরিচিত খবর কাগজের এডিটর আর নিউজ চ্যানেলকে ফোনে সবটা জানান উনি। ওঁরাও বড় খবরের আশায় নড়েচড়ে বসেন।
অশোক ওঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বাড়ি আসে। মায়ের ফটোর বাসি ফুলের মালা ফেলে একটা ধূপ জ্বালে। ফোন আর ওষুধের স্যাম্পলগুলো গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। ভোরে উঠে বার হতে হবে কাজে। এক জোড়া চোখ যে ওকে বহুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে ও টের পায় না।
পরদিন সকালে কাজে যেতেই মালিক ওকে ডেকে পাঠায় গুদামে। একটু অবাক হয়েছিল অশোক। দু’মাস এই কাজে ঢুকেছে ও। গুদামে খুব পুরনো আর বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কাউকে ডাকে না মালিক। ওকে কাজটা দিয়েছিল পরাগের সুপারিশে। ওর কাজ ছিল বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি চালিয়ে মাল পৌঁছানো। অবশ্য সাথে লোক থাকে। মায়ের অসুখে ট্যাক্সিটা বেচে দিয়েছিল আগেই। পরাগকে বলে কাজটা পেয়েছিল। সকাল আটটায় বড় বাজার পুরো জেগে ওঠেনি তখনও। একটা দুটো করে দোকানের ঝাঁপ খুলছে। এত ফাঁকা ক্যানিং স্ট্রিট চোখেই পড়ে না। মেহতা বিল্ডিং এর দোতলায় গুদামে অবশ্য রাত দিন কাজ হয়। বসের অফিসে যখন ও ঢুকল আর কোনো অফিস খোলেনি। বস আর দুজন লোক রয়েছে অফিসে।
ওকে একটা বড় ডেলিভারির কাজ দেয় বস। কাজটা একাই করতে হবে বলে দেয়।
************************
রুবাই আজ মামার সাথেই খুব সকালে অফিসে এসেছে, বাবা মা গেছে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে। ও’দিকে নাকি প্রচুর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে স্কাই-ওয়াকের জন্য। অনেক ঘুরে যেতে হয় তাই ওকে সাথে নেয়নি। মামা দুপুরে ওকে সিনেমা দেখাবে আর চাইনিজ খাওয়াবে আজ। বাবা মা চায়না টাউনে চলে যাবে সোজা। মামা এতো সকালে এসেই একটা ভিডিও কনফারেন্সে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। রুবাই বাবার পুরনো একটা ফোন নিয়ে খুটখুট করছিল। বাবা এটা ওকে দিয়েছে ঘুরতে এসে। আজ তাড়াতাড়ি আসায় মেহেতা বিল্ডিং ফাঁকা। দূরবীনটা নিয়ে ও এদিক ওদিক দেখতে থাকে। বাগড়ি মার্কেট খোলেনি তখনও। আসলে ওর মন পড়ে রয়েছে কালকের সেই ঘটনায়। কী মনে করে রুবাই বেরিয়ে আসে করিডরে। দোতলায় গোয়েল আঙ্কলের অফিসটা চুপিচুপি একবার ঘুরে আসবে ভাবছিল । হয়তো খোলেইনি এখনও। কালকের সেই গুদামটা খোলা দেখতে পায়। কাজ চলছে ভেতরে। কালকের চাপদাড়িকে ঢুকতে দেখে রুবাই। কাকে যেন বলছে,
-"অউর থোড়া জলদি জলদি হাথ চালাও। আজ ইয়ে সব ডেলিভারি হোগা।''
কাছে এসে নাকে আবার সেই গন্ধটা পায় রুবাই। হঠাৎ মনে পড়ে সকালে মামাতো দিদির ড্রেসিং টেবিলে দেখেছিল শিশিটা। স্পিরিটের মতো গন্ধ। স্পিরিট লাগতেই পারে ওষুধের কোম্পানিতে। কিন্তু এখানে কী কাজে লাগে কে জানে!! কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না রুবাই। প্রথম ঘরটায় ঢুকে পড়ে, কেউ নেই! ওষুধের বাক্সের পিছনে লুকিয়ে ভেতরের ঘরে উঁকি দেয় রুবাই। কী করছে লোকগুলো বুঝতে পারে না প্রথমে। দুটো লোক তুলো দিয়ে ওষুধের পাতা ঘষছে। আরেকজন স্ট্যাম্প মারছে সে সব পাতায়। চাপদাড়ি আর আরেকজন সব গুছিয়ে রাখছে বাক্সে। কিছু যে একটা ভুল হচ্ছে বুঝতে পারে ও। হাতের মোবাইলটায় ভিডিও করে নেয় চুপচাপ । ওর ছোট্ট শরীরটা বাক্সের আড়ালে কেউ দেখতে পায় না। আবার পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ঠিক দরজায় দেখা হয়ে যায় একটা লোকের সাথে। এক দৌড়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে ও। না, কেউ আসেনি ওর পেছনে।
অশোক অবাক হয় ছেলেটাকে দেখে। বাচ্চাটা এই গুদামে কী করছিল কে জানে। মালিকের ছেলে নাকি! অত ভাবার সময় নেই ওর। পরাগকে ডেকে মাল রেডি করতে বলে ডেলিভারির জন্য। মুটের মাথায় মাল চাপিয়ে ব্রাবোর্ন রোডে ওর গাড়িতে মাল লোড করা শুরু হয়। দশটার ভিড় শুরুর আগেই বেরিয়ে যেতে হবে ওকে।
সাহসটা রুবাইয়ের বরাবরই একটু বেশি। গোয়েল আঙ্কল কী জানে কী হচ্ছে ওর গুদামে!! অফিস থেকে একটা গাড়ির নম্বর বলতে বলতে বার হচ্ছিল গোয়েল আঙ্কল। ওঁর কথা শুনে সিঁড়ির উল্টোদিকে কতকগুলো বস্তার আড়ালে লুকিয়ে যায় রুবাই। গাড়ির নম্বরটা চটপট নোট করে নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে গোয়েল আঙ্কল চাপা গলায় কথা বলছিল -"একদম খালাস কর দো। কোই সবুত না রহে, টিকটিকি কঁহিকা!''
রুবাই বোঝে কিছু একটা হয়েছে। ওকে আটকাতেই হবে ব্যাপারটা। গোয়েলকে নিচের গুদামে ঢুকতে দেখে ও লুকিয়ে একছুটে মামার অফিসে ঢুকে হাঁপাতে থাকে । মামার অফিসের ওয়াই-ফাই কানেক্ট করে ভিডিওটা বাবাকে পাঠিয়ে দেয় তক্ষুনি। কিন্তু মেসেজটা আনসিন হয়েই থাকে। বাবা যে কখন দেখবে!
মামার মিটিং শেষ, ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তক্ষুনি। গাড়ি চলেছে সল্টলেকের দিকে। সিটি-সেন্টার ওয়ানে একটা সিনেমা দেখবে ওরা প্ল্যান করাই ছিল। রুবাই মামাকে ভিডিওটা দেখাবে ভাবে, কিন্তু মামা তো গাড়ি চালাচ্ছে! উত্তেজনায় ঘামতে থাকে ও। সল্ট-লেকে ঢোকার মুখেই একটা বড়সড় দুর্ঘটনায় পুরো ই-এম বাইপাসে গাড়ি আটকে যানজট, ওরাও আটকে যায়। একটু আগেই হয়েছে ঘটনাটা, একটা ছোট ম্যাজিক ভ্যানকে ধাক্কা মেরেছে একটা দশ চাকার বড় ট্রাক। ট্রাকটা বেরিয়ে গেছে, ভ্যানটা পুরো উল্টে গেছে। তখনও চালককে বার করা যায়নি। বড় বড় বাক্স আর ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ওদের গাড়ির আগে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। পুলিশের গাড়ি আসছে সাইরেন বাজিয়ে। অনেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ওরা ফেঁসে গেছে মাঝখানে। ভিড়টা বেড়েই চলেছে। উঁকি দিয়ে কী হয়েছে দেখছিল রুবাই। গাড়ির নাম্বার প্লেটটা দেখে চমকে ওঠে!
ওদিকে ফোনটা বাজছে, বাবার ফোন। ধরতেই বাবার গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ে। ভিডিওটা কাউকে দেখাতে মানা করে বাবা। বাবা মাও সিটি-সেন্টারেই আসছে জানায়। রুবাই বলে দুর্ঘটনার কথা, যানজটের কথা। মামা ততক্ষণে খবর নিয়ে এসেছিল, কোনো চোরাই মালের গাড়ি, পালাচ্ছিল। ড্রাইভার গুরুতর আহত। হাসপাতালে নিয়ে গেছে পুলিশ। রুবাই ফোনে কথা বলতে বলতে এক-ঝলক দেখেছিল স্ট্রেচারে শোয়ানো লোকটার শরীর রক্তে ভাসছে, মুখটা বড্ড চেনা! দেখেছিল কোথাও... আজ সকালে ঐ গুদামে... গাড়ির নাম্বার প্লেটের ফটো তুলে রাখে রুবাই।
সিনেমাটা আর দেখা হল না রুবাইয়ের। যানজটে আটকে চায়না টাউনের বদলে বাইপাসের গ্লোবাল গ্ৰিলে বসেছিল বাবা মায়ের সাথে। ছোট মামা সব শুনে থ’। ওর ভিডিওটা খুঁটিয়ে দেখে মামা তখনই লালবাজারে নিজের বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রুবাই বারবার বলছিল ঐ দুর্ঘটনার গাড়ির নম্বরটাও ও বলতে শুনেছে গোয়েলকে।
ওদিকে খেয়ে বাড়ি ফিরে ওরা দেখে টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে খবরটা, ওষুধ চুরি করে পালাতে গিয়ে যুবক গুরুতর আহত। ছেলেটা নাকি ওষুধ চুরি করত গোয়েল ফার্মার। নতুন কাজে ঢুকেছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ একটা চ্যানেল বলছে ছেলেটাকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। দুর্ঘটনা নয় ওটা।
এক বয়স্ক ডাক্তার বলছিলেন যে ছেলেটা সৎ। ওকে ফাঁসানো হয়েছে চুরির দায়ে। রুবাইয়ের বাবা বললেন,
-"আরে, এ তো ডাঃ হালদার !! আমার স্যার। উনি এই কেসে কেন? ''
রুবাইয়ের সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কে ঠিক কে ভুল! ডাঃ হালদার বলছিলেন ঐ কোম্পানি ডেট পার হয়ে যাওয়া ওষুধের ডেট বদলে বাজারে ছাড়ে। বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দেয়। অন্য চ্যানেল বলছে ডাঃ হালদার নিজেই জাল ওষুধ কাণ্ডে সাসপেন্ড ছিলেন বহু বছর। রুবাইয়ের কিছুই ভাল লাগছে না। এবার ও বুঝেছে ওটা ছিল নেইলপালিশ রিমুভার, ওটা দিয়ে ওষুধের গায়ের আসল ডেট তুলে ওরা নতুন ডেট বসাচ্ছিল। এটাই হত ওখানে। ঐ ব্যস্ত এলাকায় কেউ কারোর খবর রাখে না। লালবাজারের নাকের ডগায় বসে ব্যবসা করত লোকটা।
হঠাৎ ছোটমামার ফোনে কল এলো একটা, মামা উঠে গিয়েছিল সাইডে। হাসি মুখে রুবাইকে থাম্বস-আপ দেখালো দূর থেকে।
টিভির পর্দায় আবার ব্রেকিং নিউজ। কলকাতার ক্যানিং স্ট্রিটের মত ব্যস্ত জায়গায় চলছিল জাল ওষুধের রমরমা কারবার। সব তারিখ পার হয়ে যাওয়া ওষুধ নতুন করে সেজে উঠত এখানে। আর আসল ওষুধের সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ত সব জায়গায়। প্রমাণসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছে মালিক দেবরাজ গোয়েল।
লাফিয়ে ওঠে রুবাই। ওর তোলা ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেছে। টিভিতে দেখাচ্ছে। মা এসে জড়িয়ে ধরে রুবাইকে। এই প্রথম ওর এই ধরনের কাজে মা এত খুশি হয়েছে।
না, এ বার রুবাইয়ের নাম গোপন রাখা হয়েছিল তদন্তের স্বার্থে। এই সব শয়তানদের হাত প্রচুর লম্বা। যাতে রুবাইয়ের কোনো ক্ষতি না হয় তাই ওকে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তবে রাজেশবাবু দাঁড়িয়েছিলেন ডাঃ হালদারের পাশে। বহু বছর আগে যখন দেবরাজের বাবা অধিরাজ গোয়েল এই ডাঃ হালদারকে ফাঁসিয়েছিল জাল ওষুধ কাণ্ডে তখন রাজেশবাবু স্টুডেন্ট ছিলেন। চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারেননি সেদিন। এতদিন পর সারের পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছিলেন অশোকের জন্য, ন্যায়ের জন্য।
বেকসুর খালাস পেয়েছিল অশোক। ওর সাক্ষ্য প্রমাণকে কেন্দ্র করেই কেস এগিয়েছিল। মা-কে দেওয়া কথা রেখেছিল ছেলেটা। হাসপাতালে রুবাইকে দেখে চিনতে পেরেছিল ও। বহুদিন যুদ্ধ করে অশোক এখন সুস্থ। রাজেশবাবু ওকে মালবাজারে ডেকে নিয়েছেন। বিশ্বাসী ড্রাইভার এখন পাওয়াই যায় না। ছেলেটা খুব কাজের। রুবাইয়ের সাথেও ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে অশোকের।
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল
খুব ভাল লাগল ☺️
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteঅনেক শুভেচ্ছা, তোমারটাও ভালো লেগেছে।
Deleteবাহ্। খুব ভালো লাগলো দেবদত্তা।
ReplyDeleteবাহ্। খুব ভালো লাগলো দেবদত্তা।
ReplyDeleteতোমারটাও দারুণ হয়েছে। শুভেচ্ছা
Deleteদারুণ ফাটাফাটি। আরও একটা টানটান গল্প উপহার পেলাম 😊
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
DeleteExcellent reality based story didi.
ReplyDeleteধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানাই
Delete