Pages

ধারাবাহিক গল্প : বনস্থলীর নব্য পুরাণ (অন্তিম পর্ব) : টিম কিশলয়



।।৫।।

বিশুপাগলকে এমনিতে বনস্থলীর লোকজন বিশেষ মান্যিগন্যি করেনাকো, তবে তাই নিয়ে বিশুর তেমন কোনও আক্ষেপ নেই। ও এই পশুপাখিদের দলে মিশেই দিব্যি আছে। তার ওপর  দানিসায়েবের বাংলোতে রাজ্যের আজবগজব যন্ত্রপাতি নেড়ে ঘেঁটে দেখতে দেখতেই বিশুর বেলা বয়ে যায়, পাড়া বেড়ানোর আর সময় কোথায়?

দানিসাহেবের এই অদ্ভুত ল্যাবরেটরির সন্ধানও বেশ অদ্ভুতভাবে পেয়েছিল বিশু। বনস্থলীর সব বুড়ো লোকেরা বলত দানিসায়েব নাকি মানুষ ছিলেন না। এমন এমন সব কলকব্জা বানাতেন, এমন এমন সব কাণ্ড ঘটাতেন যা নাকি কোনও মনিষ্যির পক্ষে সম্ভব নয়। এক পারে ভূতে নয়তো বা ভগবানে।
এই সব কথাও যথারীতি কেউ পাত্তা দিত না। দানিয়েল রজার আসলে ছিলেন এই বনস্থলী টিম্বার প্রসেসিং ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা। এখানের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই ওঁর তত্ত্বাবধানে বানানো যা প্রায় এক’শ বছর পরও দিব্যি ঘটরঘট করে চলছে। বিশুর তাই মনে মনে সন্দেহ হয় দানিসাহেব ভূত বা ভগবান কোনওটাই ছিলেন না। উনি ছিলেন এলিয়েন, মানে ভিনগ্রহের প্রাণী। ভূত বা ভগবান যন্ত্র বানিয়েছে এমন অশৈলী কথা কেউ শুনেছে কখনও? এলিয়েনরাই বরং কত উন্নত সব যন্ত্র বানিয়ে চাকতির মত মহাকাশযানে চেপে পৃথিবীতে আসে।

বিশুর বরাবরের শখ অন্য একটা গ্রহে যাওয়ার, সেখানের শুঁড়ওয়ালা চারটে চোখওয়ালা সবুজ রঙের এলিয়েনদের সাথে ভাবসাব করার। দানিসাহেবের পরিত্যক্ত বাংলোয় তাই প্রায়শই এসে ঢুঁ মারত বিশু যদি স্পেসশিপটার দেখা মেলে। স্পেসশিপের দর্শন না হলেও বিশুর হাতে এল দানিসায়েবের ডায়রি। খোলা বাংলোর এ ঘর সে ঘর ঘুরতে ঘুরতে অদ্ভুতভাবেই একটা ভাঙাচোরা খালি দেরাজের এক কোণে পেল ডায়রিটা। ভূতের ভয়ে বেশি লোক বাংলোর ধারেপাশে আসে না, তাই অনেক জিনিসই অক্ষত থেকে গেছে এই বাড়ির।

সেই শতবর্ষ পুরনো ডায়রির পাতা কোন কেরামতিতে এখনও অক্ষত। একটু হলুদ হয়ে গেছে বটে কিন্তু তার থেকে বেশি ক্ষতি কিছু হয়নি। ডায়রিটা ইংরেজিতে লেখা। তাতে কোনও অসুবিধে নেই কারণ বিশুক্ষ্যাপা গড়গড়িয়ে ইংরেজি পড়তে পারে! কে শিখিয়েছিল, কবে শিখিয়েছিল এসব কিছুই বিশুর মনে নেই, যেমন ওর মনে নেই ওর ভালো নাম কী, পদবী কী, বাবার মায়ের নাম কী, আসল বাড়ি কোথায়। এসব রাজ্যের প্রশ্ন বিশুর মাথার অলিগলিতে পথ হারানো বেড়ালছানার মত ঘুরেই বেড়ায় শুধু, জবাব আর মেলে না। ওইজন্যই তো বিশু আরও মোলাকাত করতে চায় এলিয়েনদের সাথে। যদি ওদের সব যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশুর মাথার কলকব্জাগুলো ঠিক করে দিতে পারে।

যাই হোক! দানিসাহেবের ডাযরি পড়ে বিশু বুঝল সাহেবের এই বাংলোতেই আছে একটা বিশ্বকর্মার ল্যাবরেটরি। হরের কিসিমের যন্ত্রপাতি বোঝাই সেখানে। আর বিশুকে পায় কে! এলিয়েন বা স্পেসশিপের সন্ধান না পেলেও যন্তরমন্তরের হদিশ পেয়েছে। এবার আর কে আটকায় বিশুকে। ডায়রিতে দেওয়া নির্দেশ অনুসারে বাংলোর দক্ষিণপ্রান্তে গিয়ে দেখল কোনও ঘরটর নেই কেবল একটা দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে খোদাই করা একটা কিম্ভুতকিমাকার মূর্তির গায়ে চাপ দিতেই দেওয়ালটা সরে গিয়ে একটা বিশাল বড় ঘর দেখা গেল। ঘরটা যন্ত্রপাতিতে ভরা।

*****

আজ বিকেলে যখন বোমকাইয়ের পোষা ছাগল পুঁটিলাল আর কাবলি বেড়াল ফেলিসিয়া এসে হাজির হ’ল বিশুর কাছে তখনই বিশু বুঝেছিল এই সমস্যার সমাধান একমাত্র দানিসাহেবের যন্তরমন্তর ঘরেই আছে। দানিসাহেবের ডায়রি পড়ে পড়ে অনেকগুলো যন্ত্রপাতিরই ব্যবহার সুবিধে অসুবিধে এখন বিশুর নখদর্পণে।

 যাকগে আপাতত এই ছানা হাতিটাকে তার মা বাবার কাছে পৌঁছনোর উপায় আছে এই যন্ত্রের মধ্যেই। জায়ান্ট হুইলটায় চাপিয়ে মিশকুনকে জঙ্গলে ওর মা বাবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু এখন সমস্যা একটা নয় দু’টো। আতিফ ইশান আর অ্যালেক্সের পরিবারগুলোও নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত। সেটারও সমাধান করতে হবে। বাচ্চাগুলো ভরসা করে আছে বিশুর ওপর। বিশুর আবার একদম ঝগড়াঝাটি ভালো লাগে না। সবাই মিলেমিশে কেমন সুন্দর থাকবে, তবেই তো জীবনটা সুন্দরভাবে কাটবে। এই যে সেবার বোমকাই ওর জন্মদিনে সব্বাইকে ডাকল, বিশুও গেল, কত আনন্দ হ’ল, কেক কাটা হ’ল। বোমকাইয়ের মা লুচি পায়েস আরও কত্ত কী করে খাওয়ালেন সকলকে। শুধু কী জন্মদিন! এই বনস্থলীতে আতিফদের ঈদের পরব, ঈশানদের দুর্গাপুজো, অ্যালেক্সদের ক্রিসমাস, সবকিছুই সারা পাড়ার লোক মিলে করে। এইগুলো ভাবতে ভাবতে বিশুর মাথায় বিদ্যুৎচমকের মত একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কিন্তু এটার জন্য দরকার বোমকাইকে।

বিশু পুঁটিলালের দিকে ফিরে বলল,
“হ্যাঁ রে পুঁটি, বোমকাইকে একবার এখানে নিয়ে আসতে পারবি?”
পুঁটি ঘাড় হেলিয়ে বলল,
“কেন পারব না? এতক্ষণে ওর পড়া হয়ে গেছে। এখন মাও বসে সিরিয়াল দেখে আর বোমকাই ছবি আঁকে। আমি টুক করে ওকে পেছনের দরজা দিয়ে নিয়ে এসে হাজির হ’ব। আমি এই গেলুম আর এই এলুম।”

(সুস্মিতা)


।।৬।।

ওদিকে হয়েছে কি, পুঁটিলাল আর ফেলিসিয়া চুপিচুপি বোমকাইদের বাড়ির বার হয়ে যাওয়ার একটু পরেই বোমকাইয়ের একটু জলতেষ্টা পেয়েছিল, মানে ঠিক জল নয়, পুঁটিকে দেখার তেষ্টা। এই সন্ধেবেলাটায় পুঁটির মনে বড্ড 'কী করি কী করি' ভাব জাগে, বোমের মতো পড়তে বসতে পারে না বেচারা, বরং খাতাকাগজ দেখলেই কচমচিয়ে চিবোনোর সাধ জাগে মনে। তাই বোমকাইয়ের মায়ের কড়া নিয়ম, নামতাময় সন্ধেবেলায় পড়ার ঘরে পুঁটির ঢোকা চলবে না। পড়া হয়ে যাক, তারপর যত খুশি দুভাইয়ে ঢুঁসোঢুঁসি করো, চরকিপাক নাচো, মা কিচ্ছুটি বলবেন না। কিন্তু পড়ার সময় সেঘরে পুঁটির শিঙের দেখা পেলেই মা বলে দিয়েছেন পাখাপেটা করবেন তাকে। তাই রোজ সন্ধেয় বোমকাই যতক্ষণ পড়ে, পুঁটিলাল ততক্ষণ ঠায় কাঁঠালগাছের গোড়ায় বসে ঝিমোয় আর মাঝেমাঝে তুড়ুক তুড়ুক ল্যাজ নেড়ে মশা তাড়ায়। পড়ার ফাঁকে একদুবার বোমের পুঁটিতেষ্টা পায়, বাগানে উঁঁকি মেরে গাছের গোড়ায় জমে থাকা অন্ধকার, থুড়ি পুঁটিকে দেখে আবার গিয়ে পড়তে বসে। আজও তেমনই উঁকি মেরে বাগানে দেখতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল বোমকাই, কই, কাঁঠালগাছের নিচে পুঁটি বসে নেই তো! চাপা গলায় দুবার তাকে ডেকেওছিল। বেশি ডাকতে ভয় করল, মায়ের কানে গেলেই হয়েছে! পুঁটি বোম দুজনের কপালেই কানমলা জুটবে তাহলে। পুঁটির সাড়াশব্দ না পেয়ে বাধ্য হয়ে ঘরে গিয়ে আবার অঙ্কখাতা নিয়ে বসেছিল ও। তবে মাথায় দুশ্চিন্তা ঘুরলে কি আর অঙ্ক হয়? এরও তাই হলো, সাত বারোং কত হয় লিখতে গিয়ে "সাত দুগুণে চোদ্দর চার হাতে রইলো ..." বিড়বিড় করে মায়ের কাছে চোখরাঙানি জুটলো। পড়ার পাট চুকতেই তড়িঘড়ি বাগানে দৌড়ল পুঁটিকে খুঁজতে। নাহ, কোত্থাও নেই। মা ওদিকে টিভি চালিয়ে বসেছে, সিরিয়ালের গান আর বিজ্ঞাপনের গান মিলেমিশে যাচ্ছে, এদিকে বেচারা বোমকাই ঘর বারান্দায় পায়চারি করছে টেনশনে, বাবা একটু আগে ডিউটি থেকে ফিরে চা খেয়েই আবার বেরিয়েছে, প্ল্যান্টে নাকি আজ হেব্বি মারপিট হয়েছে, জোসেফকাকু রতনকাকা ইরফানকাকারা এ ওকে মেরে মাথা ফাটিয়েছে, নাক ভেঙেছে, সেই নিয়েই জটলা চলছে কলোনির মাঠে, বাবাও গেছে সেখানেই। বাবার কাছে শুনতে শুনতে বোমকাইয়ের মনে পড়ছিল গতবারের জন্মদিনের কথা। আতিফ, ঈশান, অ্যালেক্স, সাবিত্রী, তুলিদিদি সবাই কেমন এসেছিল সেবার ওদের বাড়িতে, মায় বিশুদা অব্দি! জোসেফকাকু যে অত ভালো গান গায় আর ইরফানকাকা অত ভালো একতারা বাজায় ওর জন্মদিনে না এলে বোঝাই যেতো না! কাটোয়ার দাদু ওকে যে একতারাটা দিয়েছিলেন জন্মদিনে, সেটা নিয়ে জমিয়ে বসেছিল সবাই। বিশুদা হাঁড়ি বাজাচ্ছিল, আর ওরা দুজন গান আর একতারা, বোমকাইদের বাড়িটা কেমন আলো আলো হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল, জামায় টান পড়েছে, নিশ্চয়ই পুঁটি।
"অ্যাই বাঁদর, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?"

উত্তরে পুঁটি কিচ্ছু বলল না, জামা ধরে গেটের দিকে টানতে লাগল কেবল। কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে? দেখা যাক, মা তো এখন সিরিয়াল দেখছে, ও যাবে আর আসবে, ভেবে পুঁটিলালের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল বোমকাই।

"এই রে, অ্যাই পুঁটি, খোয়াবঝোরার রাস্তায় যাচ্ছিস কেন?" বোমকাইয়ের ভয় করল। ওদিকে তো সন্ধের পর কেউ যায় না। দানিসায়েবের বাংলো নিয়ে কীসব গল্প শোনা যায়। এগোবে কি এগোবে না ভাবছে ও, শুনতে পেলো, "ঈশান! ঈশান!" "আতিফ! আতিফ!" "অ্যালেক্স! অ্যালেক্স!" হাঁকাহাঁকি করছে কাকারা, কী হয়েছে?

"বোমকাই, তুই এখানে? একা একা কী করতে এসেছিস? যা বাড়ি যা!" চমকে তাকিয়ে বোমকাই দেখল ওর বাবাও আছেন রতনকাকাদের সঙ্গে।
"ঈশানরা কোথায় বাবা? ওদের নাম ধরে ডাকাডাকি করছ কেন?"
"জানি না রে, বুঝতে পারছি না ওরা কোথায়। তিনজনকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।"
"জোসেফদা, বিশুপাগলা কোত্থাও নেই। ওর ঝুপড়ি ফাঁকা, ঝড়তিপড়তি বেড়ালকুকুরগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরেটায়।" কোত্থেকে যেন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল রাণাদা।
"সে কী! ওদিকে বিশু, এদিকে এরা তিনজন! গেল কোথায়?"
"চল তো বাংলোর দিকে। ওদিকটা দেখা বাকি এখনও।" বোমকাইয়ের বাবা এগোলেন। বাকিরাও তাঁর সাহস দেখে এগোলো পিছুপিছু। রতন, জোসেফ আর ইরফান একে অন্যকে দেখে ফুঁসছে তখন, কী জানি, ভাবছে হয়তো বড়দের মন্দির মসজিদ চার্চ নিয়ে অনর্থক ঝগড়া চারিয়ে গেছে ছেলেগুলোর মধ্যেও!
বাংলোয় যাওয়া হচ্ছে বুঝতে পেরে পুঁটিলালের লাফঝাঁপ যেন বেড়ে গেল মনে হল। বোমকাইয়ের জামা টেনে প্রায় ছিঁড়ে ফেলে আর কি! তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে প্রায় দৌড়ে যেতে হলো বোমকাইকে।

দানিসায়েবের বাংলোয় ঢোকার পর গোটা দলটাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল পুঁটিলালই, এরা সব ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটছে তখন, দেখে বোঝার উপায় নেই যে বিকেলেই ভয়ানক মারদাঙ্গা হয়েছে। ঘুটঘুটে আঁধার চারপাশে, কেবল একদিক থেকে ক্ষীণ আলো আসছে, পুঁটিও ছুটে সেদিকেই চলল। বাকিরাও এগোলো পিছুপিছু।

মশাল জ্বলছিল ঘরটার দোরগোড়ায়, তাই ভেতরে দেখতে অসুবিধা হলো না কিছু।

"ওই তো অ্যালেক্স!"ছুটে গেল জোসেফকাকু,
তার পিছনেই ছুটল রতনকাকা, "ঈশান, কী করছিস এদের সঙ্গে?" বলতে বলতে।
"আতিফ, বেরিয়ে চ এখান থেকে" এবার এগোলো ইরফানকাকা, "মিশতে বারণ করেছি না ওদের সঙ্গে!"

হাত তুলে থামাতে যাচ্ছিল বিশুদা, চোখ পড়ল বোমকাইয়ের দিকে।
"বোম, কুইক, এদিকে আয়।"

বিশুদার হাতে একটা হেলমেট, তার থেকে আবার বেরিয়ে আরও দুটো বিদ্ঘুটে যন্ত্রের মধ্যে ঢুকেছে গাছের গুঁড়ির মতো মোটা মোটা পাইপ। বোমকাই হাঁ হয়ে এগিয়ে গেল, এগিয়ে যেতেই বিশুপাগল ঝপ করে হেলমেটটা ওর মাথায় পরিয়ে খট করে কোথায় কী একটা বোতাম লাগিয়ে দিলো, আর ওদিক থেকে ঈশান, আতিফ আর অ্যালেক্স এসে খপ করে বোমের দুটো হাত চেপে ধরে রইলো। ওদের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো ওদের বাবারা, যে যার নিজের ছেলেকে টেনে বাড়ি নিয়ে যাবে ব'লে। বড়দের কথা না শুনে ঈশান আতিফ অ্যালেক্স মেশামেশি করেছে, মন্দির মসজিদ গির্জা থাকলে কী, না থাকলেই বা কী, সেসব নিয়ে না ভেবে বড়দের মধ্যে আগের মতো ভাব করিয়ে দেওয়া যায় কী করে, সে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, ওদের কখনও একসঙ্গে থাকতে দেওয়া চলে? কিন্তু রতনকাকা ইরফানকাকারা কি পারল ওদের আলাদা করতে? নাকি নিজেরাই বেশিক্ষণ আলাদাভাবে ভাবতে পারল আর? বোমকাই সেই যে হেলমেট পরলো, তারপর?

বোমকাই হেলমেট মাথায় দিয়ে কেমন যেন ভেবলে গেল, মনে হচ্ছে যেন ও মাথাটাকে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে, আর কে যেন অনেক দূর থেকে কিছু বলে পাঠাচ্ছে।

"বোমকাই, জন্মদিন... জ-ন্-ম-দি-ন... আগের বছরের জন্মদিন... ভাব সেদিনের কথা...হাঁড়ি, একতারা, গান... হইচই..." বিশুদার গলা না? বোমকাই তো সত্যিই আসার আগে জন্মদিনের কথা ভাবছিল। বিশুদার কথায় মনে পড়ে গেল আবার সেদিনের সব কথা। জোসেফকাকুর দরাজ গলায় "সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে..", আহা! মনে পড়ে ওর এখনও একপাক নেচে নিতে ইচ্ছে করছে। এরা বড়রা যা শুরু করেছে, আর কি জমে উঠবে ওরকম একখানা আসর? গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে উঠল বোমকাইয়ের। মনে পড়ে গেল আরেকদিনের কথা।

সেদিন বিকেলে ঝড় হয়েছে খুব, বাবা সদরে ফ্যাক্টরির হেড অফিসে গিয়ে ফিরতে পারেননি, এদিকে সন্ধেবেলা বাথরুমে পড়ে গিয়ে বোমকাইয়ের মায়ের মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড! কী করবে কিচ্ছু বুঝতে না পেরে ও পাশের বাড়ির সাবিত্রীর মাকে ডেকে এনেছিল। লোকের মুখে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসেছিল ইরফানকাকু জোসেফকাকু রতনকাকারা। তারপর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, রক্ত জোগাড় করা, এমনকি মাঝরাতে বাইক নিয়ে সদরে গিয়ে বড় ওষুধের দোকান থেকে ইঞ্জেকশন কিনে গেস্ট হাউস থেকে বাবাকে নিয়ে ফেরা, সব করেছিল ওরা সবাই মিলে। শেলীকাকিমা অ্যালেক্সকে নিয়ে বোমকাইদের বাড়িতে এসে ছিলেন সেরাতে, অ্যালেক্সদের ঘর পাহারা দিয়েছিলেন ঈশান আর আতিফের মায়েরা।
তখনও তো মন্দির মসজিদ চার্চ সবই ছিল, আলাদা আলাদা, তবে কেন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে সেদিন বোম দেখেছিল ওদের ঠাকুরঘরে চোখ বুজে বসে আছেন শেলীকাকিমা? কেন পরদিন ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই ওর কপালে ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন নিজের গলায় ঝুলতে থাকা ক্রসের লকেটটা? আবার আজ, সেই মন্দির মসজিদ চার্চ নিয়ে কথা উঠতেই গডচাচাকে মার খেতে হলো, মাথা ফাটলো হাত ভাঙলো বাকিদের, কেন? কীসে যে সবাই এক, আর কীসে যে আলাদা, কিচ্ছু বুঝতে পারে না বোমকাই। ওর শুধু কান্না পায়, হেলমেটটা পরার জন্য কিনা বোঝে না, ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা মা জোসেফকাকু আর শেলীকাকিমার কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ঢুকছেন, দুপুরে ঈশান আতিফ অ্যালেক্স আর বোমকাই খেতে বসেছে, ভাত এনেছেন আতিফের মা, ডাল আর বেগুনভাজা এনেছেন ঈশানের মা, এসব দেখতে দেখতে বোমকাই টের পায় ওর গাল বেয়ে ঠোঁটের ওপর গড়িয়ে নামছে নোনতা গরম জল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে গিয়ে খেয়াল হয় ওকে ছুঁয়ে আছে আতিফ ঈশান অ্যালেক্স আর বিশুদা, চটকা ভাঙে, ঘুরে তাকায় ও।

বোমকাই ঘুরে তাকাতেই ঘোর কাটল বাকিদেরও। জোসেফ বুঝতে পারলেন হেলমেট পরা বোমকাইয়ের দেখানো ছবি দেখতে দেখতে কখন যেন তিনি গলা ছেড়ে গেয়ে উঠেছিলেন, "লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে...", অবাক হয়ে দেখলেন রতনের হাত রয়েছে ওঁর কাঁধে, ওদিকে ইরফানের হাত রয়েছে বোমকাইয়ের বাবার পিঠে, তিনি হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছেন। ওপাশে বিশুর চোখও শুকনো নেই। বড়রা সবাই আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়াল বিশুর পাশে।
"বিশু, তুমি অসাধ্য সাধন করলে যে! পুলিশ ডেকে লাঠির বাড়ি মেরে যে গোলমাল মেটেনি তা তুমি এক নিমেষে মিটিয়ে দিলে?" বোমকাইয়ের বাবার অবাক প্রশ্ন।

"আমরা সব ভুলে গেছিলাম গো ঘোষালদা, সব হইহই আনন্দ কষ্ট ভাগ করে নেওয়া, সব বিপদে একে অন্যের সঙ্গে থাকা, সব যে একসঙ্গে করেছি, ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস বিশুদা আর ছেলেগুলো ছিল!" রতনকাকার স্বীকারোক্তি শুনে মাথা হেঁট হয়ে গেল বাকিদেরও।

"আমরা নিজেরা তো পচে যাচ্ছিলামই, নতুন তাজা মানুষগুলোকেও পচিয়ে দিচ্ছিলাম, বল রতনা? ছি ছি, কত বড় অন্যায়!" ইরফানকাকু মাথা নাড়লেন আফসোসে।

"কাল হাসপাতালে যাব রে ইরফান, গডচাচার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমরা।" জোসেফকাকুর কথায় সায় দিল সক্কলে, ভুল শোধরাতে হবে যে।

বিশুর এখন গলা খুলে গান গাইতে ইচ্ছে করছে, "আজকে মোদের আরাম বড় শেষ হয়েছে মোদের কাজ...", সত্যিই তো, কলোনির সবাই আবার মিলেমিশে গেল, বড় আরাম, বড় আরাম! বিড়বিড় করতে করতে বিশু এগোচ্ছিল দরজার দিকে, নজর গেল মিশকুন পুঁটি আর ফেলিসিয়ার দিকে।

"আ খেলে যা! আরাম কোথা? হাতিটা যে এখনও বাপমায়ের কাছে যেতে পারল না।"

বিড়বিড় করতে করতে যন্ত্রগুলোর কাছে ফিরে এল বিশু, হাঁক দিল আতিফদের,

"বাচ্চা হাতিটাকে নিয়ে আয়, দোলায় বসা, আমি স্টার্ট দিই।"
"আমরাও যাব বিশুদা, পিলিজ!"
"হ্যাঁ হ্যাঁ মানা কোরো না, আমরা কক্ষনও জঙ্গলে যাইনি, এইবেলা ঘুরে আসা হবে!"
বিশু তো হাঁ হাঁ করে উঠল শুনে,
"আরে পাগলা জঙ্গল কি ঘুরতে যাওয়ার জায়গা? বাচ্চা ছেলেরা জঙ্গলে যায় না।"
"আমরা কিচ্ছু করব না দাদা, চুপ করে থাকব, একটু নিয়ে চলো না আমাদের!"
ছেলের দলের নাছোড় বায়নায় বিশু আর কী করে, "আচ্ছা ঠিইক আছে, ওঠ সবাই।"
বলে কলকব্জা নাড়তে লাগল।

ততক্ষণে মিশকুনকে নিয়ে হুইলের বাকেটগুলোয় বসে পড়েছে একে একে চারটে ছেলে, পুঁটিলাল আর ফেলিসিয়া।

সবাই উঠে বসলে জায়ান্ট হুইলটার ধুলোটুলো ঝেড়েটেড়ে কলকব্জা নেড়েচেড়ে স্টার্ট দিল বিশু, ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ার ধাক্কায় আশপাশ থেকে একরাশ ধুলো উড়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। বহুবছরের জমা ধুলো, পরিমাণ কম নয়, ঘরময় ধুলোর মেঘে ছেয়ে গেল যেন, ছোট বড় সক্কলে চোখে হাত, থাবা, খুর ইত্যাদি সব চাপা দিতে বাধ্য হলো, মিশকুনের শুঁড়ে সুড়সুড়ি, "হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁচ্চোওও"...... তারপর?

(ধূপছায়া)


।।৭।।

জায়েন্ট হুইলটা ঘুরল কিনা সেটা বোঝা গেল না, কিন্তু চাকা ঘোরার মত ঘ্যাড় ঘ্যাড় করে শব্দ হল একখানা। আর সে কী শব্দ, মিশকুনের পাখার মত বিশাল বিশাল কানদু’টোতে তালা লেগে গেল একেবারে। আর সঙ্গে চোখ ধাঁধানো আলোর ছটা। চমকানি ঝলকানি হুড়ুদ্দুমে পুরোপুরি ভেবলে যাওয়া মিশকুন আবার যখন জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পেল, তখন দানিসাহেবের ল্যাবরেটরি থেকে সে আর তার নতুন বন্ধুবান্ধবরা এসে পৌঁছে গেছে তার জঙ্গলে। ওই তো, ওই তো হেলে পড়া সেই নাম-না-জানা গাছটা! ওর পাশের গাছটায় গা ঘষতে মিশকুনের মা ভারি ভালোবাসে। শুঁড় বাতাসে তুলে মায়ের গায়ের গন্ধ খোঁজে মিশকুন। এই তো, এই তো! আছে মা, কাছাকাছিই আছে! উত্তেজনায় কান নাড়িয়ে, শুঁড় দুলিয়ে সবাইকে ডাকে হাতির ছানা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জঙ্গলের আরো গভীরে কোথাও থেকে ভেসে আসে হাতির ডাক। মায়ের গলা, মায়ের গলা! লাফিয়েঝাঁপিয়ে ফিরতি হাঁকাড় পাড়ে মিশকুনও। তার বন্ধুরাও সব লাফিয়ে ওঠে আনন্দে।

আর তখনই, বিশুর পায়ের মাঝখান দিয়ে সুট করে বেরিয়ে আসে ফেলিসিয়া। মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ে একখানা থাবা চাটতে চাটতে টেরিয়ে দেখে সবাইকে। বলে, “আরেদ্দাঁড়াও! লাফালে হবে? খুব তো যাচ্ছ গোলটুটাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে, এটা ভেবে দেখেছ যে মানুষের ছোঁয়া লাগলে হাতির মা ছানাকে নাও ফিরিয়ে নিতে পারে?”

এক ধাক্কায় সক্কলের মুখ শুকিয়ে যায়। সত্যিই তো, পেপারে তো পড়াই যায় এরকম! মানুষের গন্ধ গায়ে পেলে নাকি হাতির দল ফিরিয়ে নেয় না ছানাকে! এইটা তো মাথায় আসেনি এতক্ষণ! ভয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সকলে। শুকনো গলায় বোমকাই বলে, “কী হবে গো বিশুকা?”
বিশু নিজেও বুঝি জানে না কী হবে। মাথা চুলকে বলে, “কী জানি রে কী হবে। সব কিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গিয়েও শেষরক্ষা কি হবে না?”

এদিকে অন্ধকার জঙ্গল দাপিয়ে ছুটে আসছে আরো অন্ধকার এক বিশাল চেহারা। মিশকুনের মা আসছে ছানার আওয়াজ পেয়ে। মিশকুন আনন্দে ভয়ে মাখামাখি মুখখানা বাড়িয়ে মায়ের আসার রাস্তা দেখে। কী হবে? মা কি নেবে না ওকে? পুশকুনকেও তো মানুষরাই বাঁচিয়েছিল, পুশকুনকে তো ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সবাই কত আনন্দ করে!

এটা ভেবে মনে একটু জোর পায় মিশকুন। কিন্তু মুখে সে কথা বলতেই চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ায় ফেলিসিয়া। বলে, “মানুষের বাচ্চা ছিল তো ওরা। বাচ্চাদের গায়ে কি ঝগড়াঝাঁটি মারামারি কাটাকাটির গন্ধ থাকে নাকি?”

বিশু বলে, “তা’ এরাও তো বাচ্চা। আর আমাকে তো আমি নিজেই মানুষের মধ্যে ধরি না। অসুবিধে হবে না বল?”

ফেলি তাও মাথা নাড়ায়। বলে, “দ্যাখো বাপু, এরা বাচ্চা বটে, কিন্তু এদের বাবারা মারামারি লাঠালাঠি করে যা একখান কান্ড করল ক’দিন! লড়াই ঝগড়ার গন্ধ বড় আঁশটে জানো, রক্তের মত টক টক। ছোঁয়াচ যদি লেগে গিয়ে থাকে ওদের গায়েও?”

আর কিছু ভাবার সময় পায় না কেউ। কারণ ততক্ষণে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের মত এক মা-হাতি। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে বুঝি, দৌড়ে এসেছে তো কত দূর থেকে! মা কে দেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে মিশকুন। তার ইচ্ছে করছে ছুট্টে গিয়ে মাকে শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে, সেঁধিয়ে যায় গুটিসুটি মেরে তার পেটের তলায়। কিন্তু, কিন্তু মা যদি আর ভালো না বাসে তাকে? কোথায় যাবে সে, কী করবে?

আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে মিশকুনের মা। বিশুর ইশারায় ওরা সবাই পেছনে সরে আসে পা পা করে। ভয়ে নয়। মা ছানার মধ্যে থাকতে চায় না বলে সরে আসে। দম বন্ধ করে দেখে সবাই, মিশকুনের গায়ে শুঁড় বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছে মা, শুঁকছে বুঝি। সময়ের গতি কমে যায় যেন। এক একটা মিনিটকে যেন কে লম্বা করে দেয় টেনে। তারপর এক সময়ে শুঁড়ে জড়িয়ে মিশকুনকে কাছে টেনে নেয় তার মা। মা-ছানা দু’জনেই শুঁড় উঁচিয়ে ডেকে ওঠে আনন্দের ডাক।

নেচে ওঠে বিশু, নেচে ওঠে আতিফ ঈশান অ্যালেক্স বোমকাই।
“পায়নি, পায়নি, মা হাতি ছানার গায়ে ঝগড়াকুটে মানুষের গন্ধ পায়নি!”
ফেলিসিয়ার মুখেও যেন হাসি ফোটে। মোটকা ল্যাজখানা দুলিয়ে নিয়ে সে বলে,
“যাক বাবা, সব ভালো যার শেষ ভালো!”

মা আর মিশকুন ফিরে যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে৷ সবার গলার কাছটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। মিশকুনেরও করছে। জঙ্গলের মধ্যে কেমন স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা ঠান্ডা কিনা, তাই বোধ হয়। যেতে যেতে ফিরে তাকায় মিশকুন, ফিরে তাকায় তার মা। শুঁড়খানা কপালে ঠেকিয়ে ডাক ছেড়ে কী যেন বলে মা হাতি। হাতির ভাষা না বুঝলেও হাত নাড়িয়ে টা টা বাই বাই করে সবাই। আতিফ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে বিশুকে, “কী বলল গো বিশুকা?”
আলতো হাসে বিশু, বলে, “তেমন কিছু না। বলল, তোমরা খুব ভালো। মানুষ ভালো। থ্যাঙ্ক ইউ।”

মানুষ ভালো। জাতপাত মন্দির মসজিদ সব কিছুর শেষ কথা এই - মানুষ ভালো। এই জানাটুকু বুকে নিয়ে বনস্থলীর দিকে ফিরে চলে ওরা - ক’জন মানুষ আর দু’জন না-মানুষ৷ সন্ধের অন্ধকারেও যেন একখানা নরম আলো ছুঁয়ে থাকে ওদের দুনিয়াটাকে।

(দেবলীনা)

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু


আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করো নিচের লিঙ্কগুলিতে :
ধারাবাহিক গল্প : বনস্থলীর নব্য পুরাণ (প্রথম পর্ব)
ধারাবাহিক গল্প : বনস্থলীর নব্য পুরাণ (দ্বিতীয় পর্ব)

No comments:

Post a Comment