ধারাবাহিক গল্প : বনস্থলীর নব্য পুরাণ (দ্বিতীয় পর্ব) : টিম কিশলয়



।।৩।।

চৌকির ওপর বসে রাস্তার দিকের জানলাটার দিকে উদাস মুখে তাকিয়ে রয়েছে ঈশান, সামনে খুলে রাখা অঙ্ক বই, এক্স প্লাস ওয়াই ইজ ইক্যুয়াল টু জেড, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলা ইত্যাদি। অন্যদিন হলে ঝটাঝট দু'তিনটে প্রশ্নমালা শেষ করে বইখাতা গুছিয়ে রেখে উঠে পড়ত, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে খানিক আগড়ম বাগড়ম বকে উঠোনে বেরিয়ে আতিফের নাম ধরে হাঁক পাড়তো। সে হাঁক শুনে আতিফের সঙ্গে সঙ্গে অ্যালেক্সও বেরিয়ে আসতো, তারপর উঠোনের একধারে কৃষ্ণচূড়া গাছটার গোড়ায় বসে গ্রুপ ক্যাপ্টেন অ্যালেক্স বিশ্বাস, স্কোয়াড্রন লিডার ঈশান সাহা আর উইং কমাণ্ডার আতিফ আহমেদের জোরদার মিটিং চলতো। ওই কালো আকাশটার বুক চিরে সাঁ করে উড়ে যাওয়া এরোপ্লেনগুলো, নীল আকাশে সাদা মেঘ ছড়িয়ে উড়ে যাওয়া গম্ভীর জেটগুলো, আর ছাব্বিশে জানুয়ারি টিভিতে দেখা গেরুয়া সাদা সবুজ রং ছড়িয়ে উল্টেপাল্টে খেলা করা ফাইটার প্লেনগুলোকে দেখেটেখে ওরা ঠিক করে নিয়েছে যদি কোথাও যেতেই হয় এয়ারফোর্সেই যাওয়া ভালো। ওদের এই বনস্থলী টিম্বার প্রসেসিং ইউনিটের ছোট্ট কলোনির ছেলেপুলে হয়ে এয়ারফোর্সে যাওয়ার ইচ্ছেটিচ্ছেকে আজগুবিই বলা যায়, বিশেষ করে যখন ওদের তিনকুলে কেউ কোনওদিন এয়ারফোর্সে ছিলো না, কী করে ওসব জায়গায় পৌঁছাতে হয়, সে নিয়েও কোনও ধারণা নেই এদের, তবে রাতের আবছায়াতে কৃষ্ণচূড়ার ডালপালায় আটকে যাওয়া চাঁদের আলোয় তিনমূর্তিতে মিলে এসব গোপন কথা আলোচনা করতে বেশ ভালো লাগে। মায়েদের কাছ থেকে রাতের খাওয়ার হাঁকড়ানি আসার আগে পর্যন্ত কথাবার্তা চলতে থাকে, মানে কাল অব্দি তাইই হয়েছে। 

আজ দুপুরের পর যে কী হল, কেমন জানি সব ঘেঁটেঘুঁটে গেল। বিশুপাগলা বলে না, 'ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে সব' সেই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল ব্যাপারস্যাপার! ভাবতে ভাবতে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে ঈশানের বুক খালি করে। খাট থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ায় সদর দরজার সামনে। মা এখন সাত ভাই চম্পা দেখছে, শুনতে পাবে না, ও আস্তে আস্তে ছিটকিনি খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাস্তার আলো এসে পড়েছে উঠোনে, আতিফ আর অ্যালেক্সের বারান্দার আলো নেভানো, স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবুও ঈশান জানে, আরও দুটো শরীর ওর মতোই অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে যার বাড়ির সদর দরজায়। মিনিটকয়েক ভেবে উঠোনে নামলো ঈশান, ওর দেখাদেখি বাকি দুটো ছায়াও এগিয়ে এলো আলোর দিকে, আতিফ, অ্যালেক্স আর ঈশান তিনমূর্তিতে গিয়ে বসল কৃষ্ণচূড়ার গোড়ায়।

"গডচাচা কেমন আছে রে? আর ইরফানকাকু?" ফিসফিস করে শুধোলো ঈশান।

"বাবার মাথায় স্টিচ পড়েছে দুটো, শুয়ে আছে ঘরে। গডচাচাকে শুনলাম দু'দিন হাসপাতালে রাখবে।"

"রতনকাকারা হেব্বি ক্ষেপে গেছে। লোকজন নিয়ে বড়সায়েবের কাছে মিটিং করতে গেছে। সত্যি, গডচাচার গায়ে কেন হাত তুলল বল তো বাবারা?" অ্যালেক্স ডানপায়ের বুড়ো আঙুলটা মাটিতে ঘষতে ঘষতে বলে উঠলো।

"কী নাকি মন্দির মসজিদ চার্চ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে বলেছিল গডচাচা, 'ইয়ে সব ঝুট হ্যায়' বলে চিৎকার করছিল ফ্যাক্টরি ক্যান্টিনের বাইরে দাঁড়িয়ে, তাইতেই নাকি জোসেফকাকু আর রাণাদা গডচাচাকে ধাক্কা মেরেছিল, তারপরেই গোলমাল বাধে।"

গডচাচা, মানে বনস্থলী টিম্বার প্রসেসিং ইউনিটের আদিযুগের মিস্তিরি মাথার ব্যামোর রুগি ভগবান দাসের দুটো এলোমেলো কথায় সে নাকি এমন গোলমাল বেধে গিয়েছিল, যাতে সবাই একেবারে হাত খুলে সবাইকে মারধর করতে শুরু করে দিয়েছিল, রতন সাহা, ইরফান আহমেদ, জোসেফ বিশ্বাস, যারা সেদিন সকালেও একই টিপকল থেকে জল তুলে বালতিতে জল বয়ে নিয়ে গেছে ইস্কুলের ছেলেদের মতো লাইন করে, তারা সব ক্ষ্যাপা মোষের মতো এ ওর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এইসান লড়াই লড়েছে যে কারও মাথা ফেটেছে, কারও হাত ভেঙেছে, শেষে দারোগা অবনী মল্লিক এসে পড়ায় মারামারি থেমেছে।

"হ্যাঃ, গডচাচা তো ওসব বলেই, মনে নেই, শিল্ড ফাইনালের দিন সারাক্ষণ মাঠের ধারে চেঁচাচ্ছিল, "মার, মার ব্যাটাদের, জাতের নামে বজ্জাতি সব, লাথি মেরে দে ব্যাটাদের বদন বদলে, ওই ওই ফুটবল দিয়েই গুঁড়িয়ে দে মন্দির মসজিদ চার্চ যা আছে সব....", সেই শুনে কি আমরা তেড়ে মারতে গেছি চাচাকে?"

"সত্যি বাবা, এই দামড়া লোকগুলো আর মানুষ হলো না!" 
এক্কেবারে শেলীকাকিমার মতো করে সুর টেনে বলে উঠলো অ্যালেক্স, বাকি দুজন হো হো করে হেসে উঠতে গিয়েও 'শশশ' করে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে গেল। বড়রা শুনতে পেলে বেধড়ক ঠ্যাঙাবে, আজ দুপুরের পর থেকে আতিফ ঈশান অ্যালেক্সদের বাড়ির লোকেদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ যে! বিকেলে বল নিয়ে লাথালাথি না করলে যাদের সন্ধেটা তেঁতুল ছাড়া আলুকাবলির মতো পানসে লাগে, তাদের আজ থেকে নাকি একসাথে খেলতে যাওয়াই বারণ হয়ে গেছে! হুঁঃ, মানুষের যত বয়স বাড়ে, বুদ্ধি তত কমে।

"এই এই দ্যাখ দ্যাখ!" 
আতিফ হঠাৎ চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। ওর ডাকে সবাই মুখ তুলে দেখল ঝুপসোল্যাজ কাবলি বেড়াল ফেলিসিয়া, দিনভর নেচে বেড়ানো বোমকাইয়ের পোষা ছাগল পুঁটিলাল (একে ছাগল বললে বোম ক্ষেপে ব্যোম হয়ে যায়) আর বিশুপাগল হন্তদন্ত হয়ে খোয়াবঝোরার দিকে চলেছে, আর, কী কাণ্ড, দেখে তিনমূর্তির মুখের হাঁ-গুলো দশটাকা দামের বোম্বাই রসগোল্লার মতো হয়ে গেল, ফেলিসিয়াদের পিছু পিছু হেলেদুলে চলেছে অন্ধকারের একটা মিশকালো ডেলা, ফটাফট কান নাড়াতে নাড়াতে আর শুঁড় নাচাতে নাচাতে, চাঁদের আলোয় চকচক করছে লম্বা দুটো দাঁত।

"হাআআতিইই!!" হাঁ হয়ে যাওয়া মুখগুলো দিয়ে আওয়াজ বেরলো অবশেষে!

"ই কী কাণ্ড! বিশুপাগল হাতি পুষছে কবে থেকে?"

"পুষছে নাকি?"

"নইলে সন্ধেরাতে হাতি বগলে ঝোরার দিকে হাঁটা লাগিয়েছে কেন? আবার পুঁটি আর কাবলিটাও আছে!"

"যাবি ওদের পিছু পিছু? কোথায় যাচ্ছে কী করছে একটু দেখে আসি!" ঈশানের প্রস্তাবে একরকম নেচেই উঠলো বাকি দুই মক্কেল।

ওই বিশুপাগল অনেকরকম তুকতাক জানে। সেই সেবারে জিতুর পিসি আর কাঞ্চনের কাকিমার ভয়ানক ঝগড়া বেধেছিল, কলোনি ছাড়িয়ে পাশের পাড়াতেও নাকি ওদের গলার আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছিল। বিশুপাগল দু'টুকরো পাকা পেঁপে দু'হাতে ধরে কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে টুকরোদুটোয় বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়ে সেদুটো গুঁজে দিয়েছিল দুই ঝগড়ুটের মুখে। ব্যস, সেই যে ঝগড়া থেমেছিল, আজ ন'দশমাস হয়ে গেছে দুই বাড়িতে আর চেঁচামেচি শোনা যায়নি। তাছাড়া বিশুর আস্তানার পাশ দিয়ে যেতে যেতে লোকে যদি একটু খেয়াল করে, দেখবে তার ঘরের সামনে সার বেঁধে বসে আছে কলোনির যত ঘিয়েভাজা কুকুর, কানছেঁড়া বেড়াল, একঠেঙে কাক, হাতভাঙা বাঁদরবাচ্চারা, আর বিশু কখনও ভৌঔ ডেকে, কখনও মিঁয়াও, ফ্যাঁস, কক্কঃ, ইত্যাদি বিচিত্র ভাষায় তাদের সঙ্গে আলাপ করছে। এসব দেখেশুনে বড়রা বিশুকে বলে ভেকধরা পাগল, আসলে সে টেররিস্ট কিংবা স্পাই হলেও কেউ নাকি অবাক হবে না। কিন্তু আতিফ বোমকাইদের মতো বুদ্ধিমান মানুষদের ধারণা, বিশুপাগল নোবেলজয়ী না হলেও ওরই কাছাকাছি লেভেলের কোনও জিনিয়াস বিজ্ঞানীটিজ্ঞানী হবেন, মানবজাতির স্বার্থেই তাঁকে ছদ্মবেশে থাকতে হয়। তাই আজ যখন অ্যালেক্সদের জীবনে এত বড় একটা সমস্যা, আধবুড়ো লোকজন নিজেরা অকারণে মারামারি করছে আর খেলা বন্ধ হচ্ছে ওদের, তখন তিনজনেরই মনে হল, ব্যাপারটা বিশুকে খুলে বললে হয় তো!

"চল তবে!" 
বলে আস্তে আস্তে চটি পায়ে গলিয়ে তিনমূর্তিতে হাঁটা লাগালো খোয়াবঝোরার দিকে। শুকিয়ে আসা ঝোরার ধারেই একটা পোড়ো বাড়ি, এককালের দানিসায়েবের বাংলো, এরা দূর থেকে দেখতে পেলো বিশু আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সেই বাড়িতেই ঢুকলো।

(ধূপছায়া)


।। ৪ ।।


পৃথিবীটা ঠিক কতটা বড়? বিশু বারবার বোঝার চেষ্টা করে। শ্রীকৃষ্ণ ঠাকুরের এক হাঁ-এর মধ্যে নাকি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তু এঁটে যায়! তা বহু চেষ্টা করেও কৃষ্ণ ঠাকুর দেখা দেননি, হয়তো বিশুর বাক্সবোঝাই প্রশ্নের বহর দেখে আর আসেননি, নাহলে বেশ বোঝা যেত। 

অবশ্য গডচাচা বলেন, 
“কেউ নেই, ওসব কেউ নেই। মানুষ, পুজো করতে হলে এই রক্তমাংসের মানুষকে পুজো কর, তার সততা, পরিশ্রমকে পুজো কর। যে অভাবনীয় শক্তি এই প্রকৃতির মধ্যে, জীবজগতের মধ্যে আছে, তাইই ঈশ্বর।” 

তা ভুল কিছু বলেন না গডচাচা, বিশু উপলব্ধি করেছে। বাবুই পাখি কীভাবে ঠোঁট দিয়ে ডালপালা, পাতা এনে বুনে ফেলে ঐ আশ্চর্য বাসা, পিঁপড়ে কীভাবে তার শরীরের থেকে অত ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে চলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়! সেবার যখন আফ্রিকা গেল ও, দেখেছিল এক জায়গায় প্রবল বৃষ্টির ফলে পুরো গ্রাম ভেসে যায়। জলের মধ্যে চলে যায় অনেক কিছু। ঐ জলের তোড়ে ক্ষয়ে যায় মাটি, নষ্ট হয় পিঁপড়েদের বাসা। তবু ওরা ভেসে তলিয়ে যায় না, সবাই একসঙ্গে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে একটা গোল বৃত্তের মতো আকার নিয়ে জলের ওপর ভেসে থাকে, অত গভীর জলে সাঁতার কেটেও বাঁচতে পারবে না, কিন্তু একসঙ্গে এত পিঁপড়ে ঐভাবে থাকাতে ঠিক ভেসে থাকে ওরা জলের ওপরে। 

ও বোঝে জীবজগতেই এক অবিনশ্বর শক্তি আছে, আর তাইই সব। 

বিশু কর গুনে পৃথিবী মাপে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেউ কিছু বলছে কিনা। এইভাবেই পেয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ কতকিছুর সন্ধান! সেবার রাস্তায় পড়ে থাকা একটা আধুলিকে ছুঁতেই ও পৌঁছে গিয়েছিল কত রাজাগজাদের মধ্যে, তারপর আরেকবার আবিষ্কার করে একটা ভাঙা তানপুরা, হাতে ধরতে না ধরতেই কোন বাদশাহ বলে ওঠে, ‘গান করো তানসেন’, সে মস্ত ফাঁপরে পড়েছিল সেবার। বিশু বোঝে কিছুই ফেলনার নয়, কেউই নয়, সবার কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। ও তাই নিজের ঘরের বারান্দায় ঠায় বসে শুনতে থাকে কানছেঁড়া বেড়াল, একঠেঙে কাক, হাতভাঙা বাঁদরবাচ্চাদের মনের কথা, আহা ওদের কত কী বলার থাকে, একটু নয় শরীরটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ওদের সঙ্গে, তাই বলে ওদের সমাজ থেকে দূরে রাখতে হবে! ও ঠিক করেছে এরকম সব্বাইকে নিজের কাছে এনে রাখবে। আর এদের সবারও এখন বিশু না হলে চলে না। জীবজন্তুরাও এই ভালোবাসার কথা বোঝে, শুধু মানুষগুলোই বোঝে না, উল্টে তারা আবার ওকে পাগল বলে! বিশু ভাবতেই নিজে হেসে ওঠে হঠাৎ জোরে জোরে। 
মিশকুন ঐ হাসি শুনে শুঁড় দিয়ে ফেলিসিয়ার ল্যাজ টানে, ফেলিসিয়া একটা বুঝদারের হাসি হেসে বলে, “ভয় পেয়ো না, ও বিশুদা একটু ওরকম, নিজের মনেই হঠাৎ হঠাৎ হেসে ফেলে। তবে বুদ্ধি কিন্তু অনেক, এখন তোমাকে আর ঈশান, আতিফদের বাঁচাতে পারে শুধু বিশুদাই। ”

দানিসায়েবের বাংলোর দরজা ঝুরঝুরে, কেউ হাত দেওয়ারও সাহস পায় না, দিলেই ভেঙে যাবে, আসলে কেউ এদিকে আসারই সাহস পায় না। বিকেলের পর থেকে এই জায়গা সবাই এড়িয়ে চলে, অনেকরকম প্রেতভূতদের দেখা মেলে নাকি! তা এইরকম জায়গার দিকে পা বাড়ানো ইস্তক পুঁটিলাল একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে। শুধু ফেলিদিদি আছে বলে শান্তি। বড্ড ধীরস্থির এই ফেলিদিদি, বটুকদাদা হলে এতক্ষণ তিন-চারবার ভিরমি খেত এই অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে। এতটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার, খালি চোখে আশেপাশে ঝোপের অস্তিত্ব শুধু টের পাওয়া যাচ্ছে, দেখা যায় না। 
তো এই একজন মানুষ, একটা বিড়াল, একটা ছাগল আর একটা হাতি ঢুকলো বাংলোর মধ্যে। বাংলো বলেই মিশকুন অনায়াসে পারলো, নাহলে দরজাতেই এঁটে যেত। মিশকুনের গা ছমছম করছে, ইরু, শীলুর সঙ্গে ওর খুব ভাব ভালোবাসা কিন্তু ওদের বাড়িতে ঢোকেনি ও, এই প্রথম কোনো বাড়িতে ঢুকলো, ঢুকে একদম ভালো লাগলো না। ধুস, গাছগাছালি নেই, হাওয়া কম, দৌড়ে বেড়ানো যাবে না, নদী নেই, বদ্ধ কেমন, কেমন যেন বিচ্ছিন্ন, এরকম জায়গায় মানুষগুলো থাকে কীভাবে? 

বিশু বাংলোতে ঢুকে কিছুটা হেঁটে গিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে ঢুকলো। পিছু পিছু ঢুকলো আরো তিনজন। ওর সঙ্গে একটা হ্যারিকেন ছিল। হ্যারিকেন থেকে আগুন নিয়ে ও দরজার দুইদিকে রাখা মশালগুলো জ্বালিয়ে দিলো। ঘরটা অনেকটা আলোময় হতেই জিনিসপত্রের ওপর রাখা সাদা কাপড়টা তুলে ফেলে দিলো ও। আর বেরিয়ে পড়ল কতকগুলো কিম্ভুতকিমাকার যন্ত্র। বিশু হাততালি দিয়ে উঠলো। 

“অনেকদিন এগুলোর কাছে আসা হয় না। কী যে আনন্দ হয় এগুলোকে দেখে! আজব আজব কাজ করতে পারে কিন্তু এরা।”

বিশুর উৎসাহ দেখে পুঁটিলালের কাঁপুনি একটু কমেছে। এই অদ্ভুত জিনিসগুলো কী? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু বিশুদা বোমকাইয়ের মতো লাফাচ্ছে। বোমকাই যখন খেলার জন্য বাড়ি থেকে বেরোয় এরকম লাফায়। ও উৎসুক হয়ে এগিয়ে গেল যন্ত্রগুলোর দিকে। 

“এগুলো কী করতে পারে বিশুদা?”

“এটা?” গ্রামোফোনের মাইকের মত একটা যন্ত্রকে দেখিয়ে বলতে থাকলো বিশু,

“ এই মাইকের মুখে হাসির কিছু বললে তাতে আনন্দের দশগুণ মাত্রা বেড়ে গিয়ে পৌঁছে যাবে তার কাছে, যার কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিতে চাও। আবার দুঃখের, ভয়ের, চিন্তার কিছু বললে সেটাও দশগুণ বেড়ে গিয়ে পৌঁছে যাবে তার কাছে। 

আর এই যে দেখছো হেলমেট, এটা মাথায় পরলেই যেমন ইচ্ছে স্মৃতি তুমি আনতে পারবে নিজের মাথার মধ্যে। কোনো ঘটনা বা তারিখ বললেও সেই ঘটনা বা সেই দিনে হওয়া সমস্ত কিছু দেখতে পাবে। আর শুধু তাই নয়, এমনকী একজন পরলে বাকি সবাই যদি তাকে ছুঁয়েও থাকে তাহলে তারাও ঐ স্মৃতি, ভাবনা সব দেখতে পাবে। 

আর এইটা হচ্ছে জায়ান্ট হুইল, এর ভেতরে চেপে বসলেই যেখানে খুশি যেতে পারবে। 

তবে এই তিনটে যন্ত্রই পরস্পরের সঙ্গে জড়িত, দেখো এই মোটা মোটা গাছের গুঁড়ির মতো পাইপ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে আছে। তাই এগুলো ব্যবহারের কিছু নিয়ম আছে। যন্ত্রগুলো তো খুব পুরানো, তাই একবছরে একবারই এই তিনটে যন্ত্রের মধ্যে যেকোনো দুটো যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। তারপর এক বছর ধরে আর করা যায় না, তখন এদের খাওয়াদাওয়া চলে। তখন আর এদের ডিস্টার্ব করা যায় না। ”

“কী খায় এরা?”

সবাই চমকে উঠলো। চারজন ছাড়াও যে ঘরে আরো তিনজন ঢুকে পড়েছে তা তো বোঝেইনি কেউ। তাই হঠাৎ গলা শুনে ঘাবড়ে গেছে সবাই। বিশু বললো, “আয় ঈশান, আতিফ, অ্যালেক্স, আয় তোরা ভেতরে, আমি জানতাম তোরা আসবি।”

“তুমি সত্যিই বিজ্ঞানী, বিশুদাদা, কীরে আতিফ তোকে বলতাম না আমি?”
ঈশান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। 

বিশু হো হো করে হেসে উঠলো। “না রে পাগল, এসব কি আমার নাকি? এসব বহু প্রাচীন যন্ত্র, অবস্থার হেরফেরে আমার হাতে এসে পড়েছে, খুঁজে পেয়েছি বলতে পারিস।

হ্যাঁ, তোর আগের প্রশ্নের উত্তর, এরা গাছের মতোই জল, হাওয়া, রোদ খায়। আর কিছু না।”


মিশকুনের ভারী পছন্দ হয়েছে সব যন্ত্রগুলো। ঠিক কী কী কাজ কীভাবে করে তা ও বোঝেনি, তবু খুব ভালো লেগেছে। এই প্রথম ওর বিশ্বাস হচ্ছে যে ও আর হারিয়ে গিয়ে থাকবে না, ও নিশ্চয়ই এবার ফিরে যেতে পারবে মায়ের কাছে। শুঁড় তুলে ও বললো, “বিশুদাদা, আমার দুই বন্ধু ইরু, শীলুকে ডেকে দেবে এই যন্ত্রের মাধ্যমে বা আমার বন্ধু পুশকুনকে বা আমার মা বাবাকে?”

“হ্যাঁ, দেবই তো, ঐ জন্য তো তোমাদের আনলাম এখানে। দাঁড়াও।” বিশু এগোতে গেল গ্রামোফোনের মতো দেখতে যন্ত্রটার দিকে। 

“বিশুদাদা, আমাদের বাবাদের মধ্যে সব ঠিক করে দাও না! সবাই যাতে আবার একসঙ্গে থাকি সারাজীবন, কারোর মধ্যে যেন কোনো ঝামেলা না হয় আর! ঠিক করে দাও না সব!” আতিফ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো।

বিশু থেমে গেল। সত্যিই তো, এই সমস্যাও তো দূর করতে হবে। সবার সমস্যার সমাধান হয় এমন কিছু পথ বের করতে হবে। কারণ একবার দুটো যন্ত্র ব্যবহার হয়ে গেলে আর এক বছর এগুলো ব্যবহার করা যাবে না। 

(অনিন্দ্য)


(পরের পর্ব আগামী সংখ্যায়)


অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু


প্রথম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করো নিচের লিঙ্কে 👇 :
ধারাবাহিক গল্প : বনস্থলীর নব্য পুরাণ (প্রথম পর্ব)

1 comment:

  1. এটার জন্যই প্রধানত অপেক্ষা করছিলাম। দারুণ। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম 😊

    ReplyDelete