Pages

গল্পের ঝুলি : হরিণের বুদ্ধি : সিদ্ধার্থ সিংহ





আফ্রিকার উপকূলের কাছে একটি ছোট্ট দ্বীপে এক গরিব লোক থাকত। 'লোক' বলতে যে রকম হোমরা-চোমরা বোঝায়, ঠিক সেরকম নয়। তবে কিশোর বলা না গেলেও, তাকে যুবক বলা যায় অনায়াসেই। তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউই ছিল না। কোনও বন্ধু-বান্ধবও না। সেই ছোট্টবেলা থেকেই তার একমাত্র সঙ্গী ছিল একটি হরিণছানা।

ছেলেটির নাম ছিল হামদানি। রোজ সকাল হলেই সে তার হরিণটাকে সঙ্গে নিয়ে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ত। গাঁয়ের মেয়েরা যে সব খাবার-দাবার নিয়ে বাজারে বিক্রি করতে যেত, তাদের কাছ থেকে কিছু কিছু খাবার চেয়ে সে আর হরিণ মিলে খেত। এক-একদিন কোনও খাবারই জুটত না তাদের।

না, হামদানির কোনও ঘরবাড়ি ছিল না। পাহাড়ের একচিলতে খাঁজে বা যে কোনও গুহায় কিংবা ঝাঁকড়া-মাথাওয়ালা বড় কোনও গাছের তলায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিতে সে। তার কোনও লেপ-কাঁথাও ছিল না। তাই কনকনে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য সে হরিণটাকেই জড়িয়ে কুঁকড়েমুকড়ে শুয়ে থাকত।

একদিন সন্ধ্যার সময় বনের মধ্যে একটা বড় গাছের তলায় বসে হামদানি তার হরিণটাকে বলল, "আমি তোমার অনেকদিনের বন্ধু। কিন্তু তোমাকে কোনওদিনই আমি পেট ভরে খেতে দিতে পারিনি। আজ আমাদের দু'জনের খাবার বলতে আছে শুধু তিনটে কলা আর এক মুঠো কড়াইশুঁটি। আমার মনে হয়, আর এখানে নয়, তুমি বরং বনে গিয়ে বুনো হরিণদের সঙ্গে থাকো। সেখানে আর কিছু না হোক, তুমি অন্তত পেট ভরে দু'বেলা ঘাস-পাতা খেতে পারবে।"

হরিণ বলল, "না, আমি যাব না। শত খিদে সহ্য করতে হলেও আমি তোমার কাছেই থাকব।"

চমকে উঠল হামদানি। তার হরিণ যে মানুষের মতো কথা বলতে পারে, এত দিন একসঙ্গে থেকেও সে-কথা সে জানত না। তাই সে অবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তার পোষ্যটি আর পাঁচটা সাধারণ হরিণের মতো নয়। হরিণটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলল, "খিদের জ্বালায় আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমার মনে হল তুমি বুঝি বলছ..."

হরিণটি তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, "হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছ, আমি বলছিলাম--- তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। তুমি আমাকে এত দিন ধরে অনেক ভালবেসে এসেছ। সেই ছোট্টটি থেকে এত বড় করে তুলেছ। আজ যখন তোমার এসব কথা মনে হচ্ছে, ঠিক আছে। আমি আর তোমার কাছে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। এবার থেকে আমি রোজ সকালে বেরিয়ে সারাদিন এখানে সেখানে চরে নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করে নেব। আর সন্ধ্যা নামলেই তোমার কাছে ফিরে আসব। তুমি যা খাবার পাবে, তা তুমি একাই খাবে। আমার জন্য আর রাখতে হবে না।"

তার কথা শুনে হামদানি কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথায় কোনও কর্ণপাত করল না সে।

পরদিন সকাল হওয়ামাত্রই হরিণটি সোজা বনে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, "আমি যদি বেশি খাবার পাই, তা হলে তোমার জন্য নিয়ে আসব।"

হরিণটি ঘুরতে ঘুরতে বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় কিছু ঘাস দেখতে পেল। পেট ভরে সেই ঘাস খেয়ে একটু ঝিমুনি আসতেই সে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। আর বসামাত্রই হঠাৎ তার মনে হল, পায়ের কাছে কী যেন একটা মাটি থেকে একটুখানি বেরিয়ে আছে। সূর্যের আলো পড়ে তা থেকে যেন রকমারি আলোর ছটা ঠিকরে বেরোচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুর দিয়ে মাটিতে আঁচড়াতেই জিনিসটা বেরিয়ে এল। হাতে তুলে নিয়ে দেখল, সেটা একটা হিরে। না, এমনি ছোটখাটো, সবার কাছেই যেমন থাকে, এটা ঠিক সেরকম যেমন-তেমন হিরে নয়।

হরিণ ভাবল, হিরে তো খাওয়া যায় না। তবে এটা খুব দামি জিনিস। হামদানিকে দিলে সে এটা বিক্রি করে অনেক টাকা পাবে। কিন্তু সে তো গরিব মানুষ। বাজারে এটা বিক্রি করতে গেলে লোকে ভাবতে পারে, সে বুঝি এটা চুরি করে এনেছে। তখন তাকে জেলেও পুরে দিতে পারে। তা হলে কী করা যায়! কী করা যায়! কী করা যায়!

হীরকখণ্ডটি মুখে নিয়ে গালের একপাশে রেখে অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগল সে। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে নদী পার হয়ে শহরের দিকে তীরবেগে ছুটতে লাগল।

শহরে ঢুকেই মানুষের মতো গলায় হরিণ বলতে লাগল, "সব সরে যাও, সরে যাও। আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।"

হরিণ একদম মানুষের মতো কথা বলছে দেখে শহরের সব লোক অবাক হয়ে দেখতে লাগল তাকে।

সুলতান তখন প্রাসাদের বাইরে একটি ইজি-চেয়ারে বসে বিশ্রাম করছিলেন। একটি হরিণ তার মনিবের প্রতিনিধি হয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে হরিণকে তাঁর কাছে আসার অনুমতি দিলেন। হরিণটি সামনে আসতেই তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার মনিব কে?"

হরিণ জানে, তার মনিবের আসল পরিচয় দিলে তার উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাই সে মিথ্যে কথা বলল। বলল, "আমার মনিব হচ্ছেন সুলতান দরাই। তিনি আপনার জন্য একটি উপহার পাঠিয়েছেন।" 

বলেই, সে তার মুখ থেকে হীরকখণ্ডটি বার করে সুলতানের পায়ের কাছে রাখল। তার পর মাথা নত করে এবং সামনের দিকের পা-দুটি বেশ খানিকটা ঝুঁকিয়ে সুলতানকে অভিবাদন জানাল।

হিরেটা দেখে সুলতান বললেন, "এ তো দেখছি মহামূল্যবান রত্ন। তোমার মনিব হঠাৎ করে এত মূল্যবান রত্ন আমাকে উপহার দিলেন কেন?"

হরিণ বলল, "তিনি শুনেছেন আপনার এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যা আছে। তাই প্রথম উপহার হিসেবে তিনি এটা পাঠিয়েছেন। আপনি যদি আপনার মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন, তা হলে তিনি এর চেয়েও আরও অনেক অনেক অনেক মহামূল্যবান ধনরত্ন আপনাকে উপহার দেবেন।"

সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, "সুলতান দরাই কে? তিনি কি খুব দূরে বাস করেন?"

হরিণ বলল, "এখান থেকে তাঁর বাড়ি তিনদিনের রাস্তা। আপনি যদি এ বিয়েতে এখনই মত দেন, তা হলে আমি আজই রওনা হয়ে সাতদিনের মধ্যে আমার মনিবকে এখানে নিয়ে আসব।"

সুলতান হীরকখণ্ডটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। সেটা তখন সমুদ্রের উপর সূর্যকিরণের মতো আলো ছড়াচ্ছে। এত বড়, এত সুন্দর এবং এ রকম অদ্ভুত রঙের হিরে এর আগে তিনি কখনও চোখে দেখেননি। তাই মনে মনে ভাবলেন, এমন হিরে যিনি অনায়াসে একজনকে উপহার হিসেবে পাঠাতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই যে সে লোক নন। রাজা-মহারাজা তো বটেই, হয়তো তার থেকেও বড় কিছু হবেন।

তাই সুলতান বললেন, "ঠিক আছে, তুমি তোমার মনিবকে নিয়ে সাতদিনের মধ্যে চলে এসো। আমি এর মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করছি।"

সুলতানের কথা শোনামাত্রই, হাওয়ার বেগে ছুটতে ছুটতে নগর, নদী, প্রান্তর পার হয়ে অবশেষে বনের ধারে সেই গুহার সামনে এসে দাঁড়াল হরিণ।

হামদানি দৌড়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কি আমার জন্য কোনও খাবার এনেছ?"

হরিণ বলল, "খাবারের থেকেও অনেক অনেক অনেক মূল্যবান জিনিস আমি পেয়েছিলাম। সেটার যা ব্যবস্থা করার আমি করে এসেছি। তুমি যদি আমার কথা মতো চলো, তা হলে সাতদিনের দিন তুমি সুলতানের অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে।"

হামদানি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি হরিণের কথা। ভেবেছিল, তার সঙ্গে বুঝি সে মশকরা করছে। কিন্তু সে যখন বারবার করে একই কথা বলতে লাগল, তখন সে বিশ্বাস না করে পারল না। সে কথা দিল--- "ঠিক আছে, তুমি যা বলবে, আমি সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।"

ছ'দিন ধরে তারা দু'জনে সেখানেই গা ঢাকা দিয়ে রইল। বনের ফলমূল আর নদীর জল খেয়ে কাটাল। সাতদিনের দিন হামদানিকে নিয়ে সেই সুলতানের রাজধানীর দিকে রওনা দিল হরিণ। নদী পার হয়ে নগরে পৌঁছনোর একটু আগেই একটা পাহাড়ের ধারে এসে হরিণ বলল, 
"তুমি তোমার জামা খুলে এইখানে শুয়ে পড়ো। আমি একটা লাঠি দিয়ে তোমার পিঠে এমন ভাবে বেধড়ক মারব, যাতে তোমার পিঠে কালশিটে দাগ পড়ে যায়। কিছু মনে কোরো না, তোমার ভালোর জন্যেই আমি এইসব করছি।"

হামদানি আগেই টের পেয়েছিল, এই হরিণ সাধারণ হরিণ নয়, মানুষের চেয়েও বুঝদার। বুদ্ধিও অনেক। তাই সে হরিণের কথায় জামা খুলে সেখানে শুয়ে পড়ল। হরিণ তার পিঠে লাঠি দিয়ে দমাদ্দম করে বেধড়ক মারল। তার পিঠ একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল।

তার পর হরিণ বলল, "আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত, যে যা-ই বলুক, তুমি এখানেই মড়ার মতো পড়ে থাকবে।"

এই বলেই পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হরিণ চলে গেল সুলতানের প্রাসাদের দিকে।

সেখানে গিয়ে হরিণ দেখল, আজ রাতে সুলতানের মেয়ের বিয়ে হবে বলে সমস্ত নগর-সহ পুরো প্রাসাদটাকে আলো আর রংবেরঙের তোরণ দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পাঁচদিন ধরে ভোজ হবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলবে উৎসব। তার জন্য বিরাট প্রস্তুতি চলছে।

হরিণ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রাসাদে গিয়ে দ্বাররক্ষীদের বলল, "সুলতান কোথায়? আমি এক্ষুনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। খুব জরুরি দরকার।"

সুলতান বেরিয়ে আসতেই হরিণ বলল, "হুজুর, আমি আমার মনিবকে নিয়ে আপনার কাছেই আসছিলাম। আমাদের সঙ্গে অগাধ ধনরত্ন ছিল। কিন্তু নদীর ধারে পাহাড়ের কাছে আসতেই, একদল ডাকাত হঠাৎ করে এসে আমাদের সব কিছু লুঠপাট করে নিয়ে গেছে। দিতে চাননি দেখে আমার মনিবকেও খুব মেরেছে। এমনকী হিরে-মানিকখচিত তাঁর জমকালো রাজসিক পোশাক-আশাকও সব খুলে নিয়ে গেছে। তিনি এখন প্রায় নগ্ন হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন পাহাড়ের ধারে। তাঁর জন্য কিছু ভালো পোশাক আর একটা ঘোড়া দিন। তাঁকে নিয়ে আসি।"

সঙ্গে সঙ্গে সব চেয়ে দামি এবং ভাল পোশাক আর একটা দুর্দান্ত ঘোড়া দিয়ে সুলতান তাঁর সৈন্যদের বললেন হরিণের সঙ্গে যেতে। 
কিন্তু হরিণ বলল, "না, তাঁর গায়ে যেহেতু কোনও পোশাক নেই, তাই সৈন্যদের দেখে তিনি লজ্জা পেতে পারেন। আপনি বরং পোশাকগুলো একটা পুঁটলিতে ভরে আমার পিঠে বেঁধে দিন, আর যে ঘোড়াটা দিচ্ছেন, তার লাগামটা আমার মুখে দিয়ে দিন। আমি ঠিক আমার মনিবকে নিয়ে আসব।"

সুলতান সেই মতোই সব ব্যবস্থা করে দিলেন।

হরিণ ফিরে এল হামদানির কাছে। তাকে বলল, "এক্ষুনি উঠে নদীর জলে স্নান করে নাও। তারপর এই পোশাক পরে ঘোড়ায় চেপে সুলতানের প্রাসাদে চলো। আজ রাতেই সুলতানের মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে। মনে রাখবে, তোমার নাম কিন্তু আর হামদানি নয়। তোমার নাম এখন থেকে--- সুলতান দরাই। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, বলবে--- তোমার প্রাসাদ এখান থেকে তিনদিনের পথ। সেই প্রাসাদে অনেক ধনরত্ন আছে। আছে অসংখ্য দাস-দাসী।"

সুলতানের কাছে গিয়ে হামদানি তাঁকে অভিবাদন জানাল। সুলতানের সৈন্য এবং দেহরক্ষীরাও অভিবাদন জানাল হামদানিকে। সেই রাতেই মহা ধুমধাম করে হামদানির বিয়ে হয়ে গেল। হামদানি দেখল সুলতানের মেয়ে সত্যিই খুব রূপসী।

কিন্তু পরদিন সকালে উঠে হামদানি দেখল তার হরিণ আশপাশে কোথাও নেই। না, অনেক খুঁজেও কেউ তার কোনও হদিশ দিতে পারল না।

সুলতানের মেয়ে বারবার তাকে তার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল। আর সে প্রতিবারই শুধু বলতে লাগল, সময় হলে সব দেখতে পাবে, সব।

তবে হামদানির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার হরিণ নেই মানে, সে নিশ্চয়ই তার আসন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য কোনও না-কোনও একটা ফন্দি আঁটছে। সে চুপচাপ বসে থাকার বান্দা নয়।

সত্যিই চুপ করে বসে ছিল না হরিণ।

হামদানির বিয়েটা হয়ে যেতেই হরিণ টানা দু'দিন ধরে সমানে পথ হাঁটতে লাগল। একটা পাহাড়ের পাদদেশে এক বিরাট প্রাসাদ দেখতে পেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রাসাদটার আশেপাশে কতগুলো কুঁড়েঘর।

হরিণ সেই প্রাসাদের বন্ধ দরজায় টোকা দিতেই এক বুড়ি এসে দরজা খুলে বলল, 
"কী চাও? তোমার কি কোনও ভয়ডর নেই? জানো না, এই প্রাসাদটা পাঁচ-মাথাওয়ালা এক প্রকাণ্ড সাপের? সে তোমাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গিলে খেয়ে ফেলবে?"

বুড়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই মুহূর্তের মধ্যে চট করে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে পড়ল হরিণ। বুড়িকে বলল, "আমি তো তাকেই চাই।" 
বলেই মূল ফটকের দরজা বন্ধ করে দিল। তার পর দরজার আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগল সে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, তার মাথার ওপরে দেওয়ালের গায়ে টাঙানো রয়েছে একটা ধারালো তরবারি। সে সঙ্গে সঙ্গে সেটা নামিয়ে হাতের কাছে রাখল।

ঠিক তখনই প্রবল ঝড়ের মতো শোঁ শোঁ শব্দে গোটা এলাকা থরথর করে কেঁপে উঠল। কয়েক মুহূর্তমাত্র। 
তার পরেই শোনা গেল, পাঁচ-মাথাওয়ালা সাপের বিকট গর্জন--- "প্রাসাদের দরজাটা এখনও খুলিসনি কেন? আমি যে আসছি টের পাসনি?"

ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বুড়ি আসছিল দরজা খুলতে। কিন্তু হরিণ তার আগেই দরজাটা একটু ফাঁক করে দিল। আর সেই ফাঁক দিয়ে ঢোকার জন্য সাপটা তার একটা মাথা গলিয়ে দিতেই, সেই তরবারি দিয়ে এক কোপে ঘচাৎ করে সেই মাথাটা কেটে ফেলল হরিণ। তার পর একের পর এক সাপটা যতগুলো মাথা ঢোকালো, ওই একইভাবে একে একে সাপটার সবগুলো মাথাই কেটে ফেলল হরিণ।

মুণ্ডুকাটা সাপের বিশাল দেহটা দাপাতে দাপাতে এক সময় নিথর হয়ে গেল। আর তখনই সেই বুড়ি, প্রাসাদের চাকর-বাকর আর আশপাশের কুঁড়েঘরের লোকজনেরা সবাই ছুটে এসে ধন্য ধন্য করতে লাগল। 
তারা বলল, "এই সাপটা জাদুবলে আমাদের বন্দি করে রেখেছিল। তুমি এতদিনে আমাদের সবাইকে শাপমুক্ত করলে। এ বার থেকে তুমিই হবে এ প্রাসাদের মালিক এবং আমাদের রাজা।"

হরিণ বলল, "আমি নই। রাজাদের রাজা, সম্রাটদের সম্রাট, স্বয়ং ঈশ্বরের দূত, সুলতান দরাইকে আমি খুব শিগগিরই এখানে নিয়ে আসব। তার আগে এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা এই তাল তাল মণিমুক্তোর ঢিপি থেকে আপাতত বেশ কয়েক বস্তা তুলে আমার পিঠে চাপিয়ে দাও।"

ওরা তা-ই করল।

বিয়ের উৎসব শেষ হতেই ছয় দিনের দিন সক্কালবেলায় হরিণ এসে হাজির হল সুলতানের প্রাসাদে। মণিমুক্তোগুলো সুলতানের হাতে দিয়ে সে বলল, "এই হল আপনার বাকি উপহার।"

সুলতান অত ধনরত্ন দেখে গদগদ হয়ে হামদানিকে বললেন, "তোমার মতো জামাই পেয়ে আমি সত্যিই খুব খুশি। নিজেকে ধন্য মনে করছি।"
বলেই, মেয়ে আর জামাইয়ের যাওয়ার জন্য দুটো ভাল ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। হরিণ তাদের পথ দেখিয়ে-দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

অবশেষে তারা গিয়ে উঠল পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচ-মাথাওয়ালা সাপের চোখ ধাঁধানো সেই অসম্ভব সুন্দর প্রাসাদে। এখানে সেখানে অবহেলায় অনাদরে পড়ে থাকা সুলতান দরাইয়ের ধনরত্ন আর ঐশ্বর্য দেখে অবাক হয়ে গেল তার স্ত্রী।


হামদানিকে সবাই রাজা হিসেবে মেনে নেওয়ার পরেই হরিণ চলে গেল বনে। তার বুদ্ধির জন্য বনের পশুরা তাকে বনের রাজা করে দিল। আর সুলতান দরাই-রূপী হামদানি তার স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করতে লাগল পাহাড়তলির সেই চোখ ধাঁধানো প্রাসাদে।


(সমাপ্ত)

(রূপকথার কাহিনী Puss in the Boots এর ছায়া অবলম্বনে)

অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

No comments:

Post a Comment