সে অনেক বছর আগেকার কথা। সাত সমুদ্র, তেরো নদী আর তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ছিল একটা দেশ, নাম অচিনপুর। ভারী সুন্দর সেই দেশ। মাঠে মাঠে সবুজ ঘাস, গ্রামের ক্ষেতে ক্ষেতে সোনালী ধানের ঢেউ, বহুদূরে চোখ ফেরালে দেখা যেত সোনালী রূপোলি পাহাড় আর কাশবন। শরৎকালে সেই কাশের বনে যেন সাদা মেঘ নেমে আসত আকাশ থেকে। অচিনপুরের গাছগুলোও সারা বছর ভরে থাকত গাঢ় সবুজ পাতায় আর রস-টুসটুসে সব ফলে। ভারী সুন্দর একটা নদীও ছিল সেই দেশে। দেশের ঠিক মধ্যিখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল নদীটা, নাম ইরাবতী। সেই নদীর জল যে কী মিষ্টি আর ঠান্ডা, তা বলে বোঝানো যায় না। ঠিক যেন অমৃত !
অচিনপুরের রাজা তখন অচিন্ত্যনারায়ণ। তাঁর রাজত্বে সবাই ভীষণ সুখী। রাজা ভারী ভালো মানুষ। প্রজাদের নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। তাঁর সুশাসনে কারও ঘরে কোনও দুঃখ-কষ্ট ছিল না, কোনও অভাব ছিল না। রাজার দরজা ছিল সবার জন্যে খোলা। রোজ সক্কাল সক্কাল দরবারে বসে প্রজাদের সব কথা শুনতেন তিনি; যার যা সমস্যা নিজেই সমাধান করে দিতেন। এমনকি প্রয়োজনে প্রজাদের বাড়ি গিয়েও দেখতেন সবাই ভালো আছে কি-না।
এমন রাজা পেয়ে অচিনপুরে সবাই ধন্য ধন্য করত, দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করত তাদের প্রিয় রাজাকে।
দেশের উত্তরদিকে যে সোনালী পাহাড় ছিল, তার ওপর ছিল রাজা অচিন্ত্যনারায়ণের রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদের কথা কী আর বলব...দেওয়ালগুলো তার সাতরঙা স্ফটিকে গড়া; সূর্যের আলো পড়লে মনে হত যেন পাহাড়ের ওপর রামধনু উঠেছে। পাহাড়ের নিচ থেকে শ্বেতপাথরের পালিশ করা সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে প্রাসাদের সদর দুয়ার অব্দি। সেই দরজা দিনরাত খোলা থাকত, যার যখন দরকার সে তখনই আসত রাজার কাছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ঠিক সামনে ছিল রাজার দরবার আর তার পেছনে দাসদাসীদের থাকবার ঘর। সেগুলো পেরিয়ে গেলে পড়ত অন্দরমহল, রানি পদ্মাবতী থাকতেন সেখানে আর থাকত রাজা-রানির নয়নের মণি, সাত রাজার ধন এক মাণিক, রাজপুত্র অনিন্দ্যকুমার।
অনিন্দ্যকুমার ভারী ভালো ছেলে। রাজা-রানি আর রাজ্যের সবাই যেমন ওকে ভালোবাসে, সে-ও তেমনি মা-বাবাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু একটাই সমস্যা, সে ঠিক আর পাঁচটা রাজকুমারের মতো ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সে একটু অন্যরকম। অনিন্দ্যকুমার ভালোবাসত গান গাইতে, ছবি আঁকতে; যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রচালনা শিখতে মোটেই ভালো লাগত না ওর। সে পাখিদের সঙ্গে খেলা করতে চাইত, চাইত সবুজ ঘাসের বুকে শুয়ে কবিতা লিখতে; রাজনীতির মারপ্যাঁচের পাঠে কিছুতেই মন বসত না তার। আকাশের ওই উড়ে উড়ে আসা মেঘের সঙ্গে কোন নাম-না-জানা কল্পনার রাজ্যে যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াত ওর মন; কূটনীতির মোটা মোটা বই পড়তে একটুও ভাল্লাগতো না।
অনিন্দ্যর মন রাজা বুঝতেন, তবু ভাবতেন বাচ্চা ছেলে, হয়তো বড় হলে ঠিক বুঝে যাবে। হাজার হোক সে রাজপুত্র; যুদ্ধ, রাজনীতি, কূটনীতি, তির-ধনুক চালানো না শিখলে চলবে কী করে ? অচিন্ত্যনারায়ণের পর ওকেই তো সামলাতে হবে অচিনপুরের প্রজাদের দায়িত্ব।
অনিন্দ্যও বুঝত বাবার মনের কথা। তিনি তো আর ভুল কিছু চাইছেন না; সে রাজার একমাত্র ছেলে, তার ওপর যে অনেক দায়িত্ব। সে যদি যোগ্য রাজা না হতে পারে তাহলে যে বাবা দুঃখ পাবে। অনিন্দ্য বড় ভালো ছেলে, বাবাকে বড় ভালোবাসত সে। চেষ্টা যে সে করত না তা নয়। বাবাকে খুশি করতে সে মুখ গুঁজে পড়ত সেইসব ইয়া মোটা মোটা কালো কালো অক্ষরে ঠাসা ছবি-ছাড়া বই, রোজ বিকেলে নিয়ম করে যুদ্ধের পাঠিও নিতে যেত, জোর করে মন বসাত রাজনীতির তর্কবিতর্কেও।
কিন্তু হায়, মন কী এত সহজে মানে! সকালবেলা যখন জানালায় ওই রঙিন পাখিগুলো এসে কিচিরমিচির জুড়ে দিত, অনিন্দ্য পড়া ভুলে তাকিয়ে থাকত ওদের দিকে। ওই দূরের মাঠে যখন রাখাল ছেলে বাঁশি বাজিয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরত, অনিন্দ্য ভাবত সে-ও যদি সেই রাখাল ছেলের মতো হত! নীল আকাশে মেঘের ভেলা কখন যে ওর মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত সে টেরই পেত না; সামনে খোলা কূটনীতির ওই বিশাল বইটার পাতা আপনা-আপনি উল্টে যেত বাতাসে!
সময় আরও কিছুটা এগিয়ে গেল, অনিন্দ্যকুমারও বড় হয়ে উঠল। ওর স্কুলের পড়া শেষ, এবার রাজশিক্ষার কলেেজে যেতে হবে ওকে। রাজা ভাবলেন ছেলে বড় হয়ে গেছে, এখন আর আগের মতো উড়ু উড়ু মন নেই ওর। কিন্তু অনিন্দ্যর মনে তখন অন্য চিন্তা। সে ভাবছে স্কুলের শিক্ষা তো হয়েই গেল, এবার সে মনের মতো করে নিজের ভালোবাসার জিনিস করে বেড়াতে পারবে। ঠিক সেই আগের মতো সে খেলে বেড়াবে পাখিদের সঙ্গে, গান গাইবে, ছবি আঁকবে রূপোলি পাহাড়ের ঢালে বসে, কবিতা লিখে শোনাবে ওই যাযাবর মেঘেদের। এখন তো সে বড় হয়ে গেছে, আর চিন্তা কী!
তাই অনেক ভেবে বেশ সাহস করে একদিন সে মনের কথাটা বলেই ফেলল তার বাবার কাছে। রাজা কিছু বললেন না, শুধু মুখটা কালো হয়ে গেল ওঁর। অনিন্দ্য বুঝল বাবা কষ্ট পেয়েছেন। বাবাকে সে বড্ড ভালোবাসে। বাবার মনে কিছুতেই কষ্ট দিতে পারবে না সে। বুকের ভেতরটা কান্নায় ভেঙে এল ওর, কিন্তু হাসিমুখে বলল, "বাবা, আমি রাজশিক্ষাই শিখব, কলেজে যাব।"
রাজা খুশি হলেন। বাবার হাসিমুখ দেখে অনিন্দ্যও যেন সব দুঃখ ভুলে গেল। কী একটা যেন রোখ চেপে গেল ওর। মনে হল বাবার ওই হাসিমুখ দেখাবার জন্যে সে সবকিছু করতে রাজি।
তারপর একদিন শুভ দিন দেখে দূরের এক কলেজে ভর্তি হতে চলে গেল সে। সেই কলেজ অচিনপুর থেকে অনেক দূরে। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে রাজপুত্র, রাজকন্যারা আসে রাজবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো করতে। ভারী সুন্দর সেই কলেজ। কিছুদিনের মধ্যেই কিশোর অনিন্দ্যরও মন বসে গেল সেখানে। খুব মন দিয়ে পড়তে লাগল সে। বাবার চোখে সেই খুশি বারবার দেখার একটা লোভ যেন পেয়ে বসেছিল তাকে। একটু একটু করে সে ভুলেই গেল তার নিজের সেই স্বপ্নগুলোর কথা, তার সেই একলা বিকেল, সেই বেনামী কবিতার খাতা আর রূপোলি পাহাড়ের ঢালে বসে ছবি আঁকার ইচ্ছেগুলো।
প্রথম বছরের পরীক্ষায় প্রথম হল সে। অচিনপুরে খবর পৌঁছতেই যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল সেখানে। রাজা প্রজা সবার বুক গর্বে ভরে উঠল অনিন্দ্যর জন্যে। তারপর এক এক করে বছর পেরোতে লাগল, আর প্রতিটি পরীক্ষাতেই প্রথম হতে লাগল সে। রাজার গর্ব আর ধরে না এমন সোনার টুকরো ছেলেকে নিয়ে। রাজা খুশি, রানি খুশি, অচিনপুরে সবাই খুশি আর তাদের খুশিতে রাজকুমারও খুশি।
বেশ চলছিল সবকিছু। একটু একটু করে অচিনপুরের যোগ্য ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছিল অনিন্দ্য, ঠিক মহারাজ অচিন্ত্যনারায়ণ যেমনটা চাইতেন।
সামনেই পরীক্ষা, বেশ মন দিয়ে রাজনীতির একটা ইয়া গাবদা বই পড়ছিল অনিন্দ্যকুমার। বাইরে তখন বিকেলের শেষ আলো একটু একটু করে ম্লান হয়ে আসছে, দূরের ঝাউবনে নেমে এসেছে সন্ধের অন্ধকারের প্রথম ছোঁয়া। ঠিক এমন সময় হঠাৎ অনিন্দ্য চমকে উঠল একটা গান শুনে। দূরে কে যেন ভারী উদাস-করা সুরে গাইছে গানের প্রথম কলিটা...
"আমি স্বপ্ন দেখি স্বপ্ন হয়ে বাঁচার,
আমি স্বপ্ন দেখি আবার ভালোবাসার..."
বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু-হু করে উঠল অনিন্দ্যর। কী একটা অদ্ভুত পাগল-করা সুর সেই গানের। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। পুবের ওই বড় বটগাছটার কাছ থেকেই ভেসে আসছে গানটা। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে দেখতে পেল না; এদিক-ওদিক, গাছের চারপাশে খুঁজতে লাগল অনিন্দ্য। কিন্তু কেউ নেই। এমন সময় হঠাৎ ওপর থেকে কে যেন খসখসে গলায় বলে উঠল, "কী গো রাজপুত্তুর, স্বপ্ন খুঁজছ নাকি?"
অনিন্দ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল গাছের ওপর বসে আছে একটা পাখি। এমন পাখি সে কোনওদিন দেখেনি। গায়ে রামধনুর মতো সাতরঙা পালক, মাথায় বাহারি রঙের ঝুটি আর ডানায় ভারী সুন্দর সব নকশা কাটা।
"তুমিই কি গান গাইছিলে ?" অনিন্দ্য জিগ্যেস করল।
পাখি ঘাড় নেড়ে চোখ নাচিয়ে বলল, "নইলে আর কে শুনি ?"
"আমায় গান শেখাবে পাখি ?"
পাখি কেমন যেন চোখ পাকিয়ে বলল, "সে কী কথা রাজপুত্তুর ? তোমার না সামনে পরীক্ষা, তোমায় রাজা হতে হবে। আগে সেটা হও, তারপর সময় পেলে ওসব গানটান করবে'খন।"
কেমন একটা বিদ্রুপের সুর ছিল সেই পাখির গলায়।
বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল অনিন্দ্যর। বহুকাল নিজের যে স্বপ্নগুলো সে ভুলে ছিল আজ সেগুলোই যেন আবার কালবৈশাখীর পাগল হাওয়ার মতো এসে আছড়ে পড়তে লাগল তার চোখের তারায়। সে কাতর গলায় বলে উঠল, "না পাখি, আমি রাজা হতে চাই না, আমি গান গাইতে চাই, আমি ছবি আঁকতে চাই। আমি মেঘেদের সঙ্গে উড়ে বেড়াতে চাই দেশে দেশে। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি পাখি, ভালো রাজপুত্র হতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি।"
পাখির গোলাপি ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। "সত্যি বলছ রাজপুত্র ?"
"হ্যাঁ গো, তিন সত্যি।" কিন্তু কথাটা বলেই মুখটা হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল অনিন্দ্যর। কী একটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারল না।
"কী হল ? আবার কী ভাবছ অত ?" ওর মনের কথা বুঝেই যেন জিগ্যেস করল সেই সাতরঙা পাখি।
"আমার স্বপ্নগুলো যে হারিয়ে গেছে। এখন যে আর চাইলেও আগের মতো সব ভুলে গান গাইতে পারি না, বিকেলে কচি ঘাসের উপর শুয়ে ভেসে যেতে পারি না কল্পনার দেশে। শুধু মনে হয় আমায় ভালো রাজা হতে হবে, আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু বিশ্বাস করো পাখি, আমি কোনওদিন রাজা হতে চাইনি। আমি মেঘেদের মতো যাযাবর হতে চাই।" চোখ দুটো ছলছল করে উঠল অনিন্দ্যর।
পাখি বলল, "স্বপ্নরা কখনও হারায় না গো রাজপুত্র, তারা জমা থাকে স্বপ্নপরীর কাছে।"
"স্বপ্নপরী ! তাকে কোথায় পাবো ?"
"সেই স্বপ্নপরীর দেশ যে ঠিক কোথায় তা কেউ জানে না। কিন্তু শুনেছি যারা স্বপ্নের পথে হাঁটে, স্বপ্নপরী নিজেই তাদের কাছে আসে।"
"তাহলে আমি এখন কী করবো পাখি ?" ব্যাকুল স্বরে জিগ্যেস করল অনিন্দ্য।
পাখি আবার বাঁকা হাসল অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে, তারপর হঠাৎ কিছু না বলেই ডানা ঝাপ্টে উড়ে গেল আকাশের দিকে। অনিন্দ্য হাত নেড়ে ডাকতে লাগল, "পাখি যেও না, শুনে যাও..."
কিন্তু পাখি আর ফিরে তাকাল না, শুধু যেতে যেতে তার গলা থেকে ভেসে এল সেই গান...
"আমি স্বপ্ন দেখি স্বপ্ন হয়ে বাঁচার,
আমি স্বপ্ন দেখি আবার ভালোবাসার..."
রাজপুত্র কী আর করবে, দু'হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে এল নিজের ঘরে। কিন্তু পড়ায় আর মন বসল না তার। বহুদূর থেকে ভেসে আসা সেই গানের সুরটাই যেন এখনও বাজছে ওর কানে। সে-ও গুনগুন করে গাইতে চাইল, কিন্তু গলায় সুর আর এল না। রাজনীতি কূটনীতির বইগুলো সরিয়ে ফেলে খাতা খুলে বসল ছবি আঁকবে বলে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মনের মতো করে আঁকতে পারল না অনিন্দ্য। বুকের ভেতর ভীষণ একটা কষ্ট হতে লাগল ওর। সে এতদিন কীসের ঘোরে যেন ভুলেই গিয়েছিল নিজের স্বপ্নগুলোকে। আজ যখন বুঝতে পেরেছে, তখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সেই সুন্দর বিকেল, সেই উদাসী গানের সুর আর সেই পাহাড়ের ঢালে একলা বসে আঁকা ছবিগুলোকে। সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। যা সে চায়নি তা পেয়েছে অনেক, কিন্তু যা চেয়েছিল তা যেন আজ বহুদূরে। হয়তো সেই স্বপ্নপরীর দেশে। কিন্তু কোথায় সেই দেশ ?
বড্ড কান্না পেল অনিন্দ্যর। কী যে করবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। এই কলেজ, এই মোটা মোটা বই, এই শ্রেষ্ঠ রাজপুত্রের তকমা সব যেন অসহ্য লাগছে তার কাছে। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। বাইরে তখন পূর্ণিমার ভরা জ্যোৎস্না। দূরের ঝাউবনগুলো নীলাভ কালো রঙে কেমন যেন অদ্ভুত মায়াময় হয়ে আছে। আর কিছু না হোক, যাযাবর হয়ে দেশে দেশে তো সে ঘুরতেই পারে; এই ভেবে সেই ঝাউবনের দিকেই পা বাড়াল অনিন্দ্য।
মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে সে। কোথায় যে যাচ্ছে নিজেও জানে না। বন পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে নদী, হেঁটেই চলেছে সে পাগলের মতো। আকাশের গায়ে ঝিকিমিকি তারা আর এই জ্যোৎস্নাভেজা রাত, কী এক নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অনিন্দ্যকে। যেন কোনও এক অজানা অন্ধকারের চাদর গায়ে জড়িয়ে তার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। যেন তারা খুব কাছেই কোথাও আছে, তবু তাদের দেখতে পাচ্ছে না অনিন্দ্য।
এভাবেই অনেকটা হাঁটার পর একসময় আস্তে আস্তে পা দুটো বেশ টনটন করতে শুরু করল। বুকেও বেশ হাঁপ ধরেছে। না, একটু বসতেই হবে এবার। ওই যে ওদিকে একটা দেবদারু গাছ দেখা যাচ্ছে, ওটারই নিচে গিয়ে দু'পা ছড়িয়ে বসে পড়ল অনিন্দ্য। হাঁটতে হাঁটতে বড্ড ঘেমেও গেছে। গায়ে জড়ানো মখমলের উত্তরীয় দিয়ে কপালটা একবার মুছে নিল সে। কী যে হবে কিছুই জানে না। সে কি খুঁজে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে?
দূরের ওই চাঁদের দিকে তাকাল অনিন্দ্য। কী সুন্দর এই আলো ! হালকা হালকা বাতাস বইছে উত্তরদিকে। গাছের পাতাগুলো দুলে দুলে উঠছে মাঝে মাঝে। অনিন্দ্যর মনে পড়ল এমনই এক জ্যোৎস্না রাতে অচিনপুরের রাজবাড়ীর ছাদে বসে একটা কবিতা লিখেছিল সে। ছোট্ট একটা কবিতা, পাঁচটে মাত্র লাইন। তবু যেন কী এক অদ্ভুত আনন্দ ছিল সেই সামান্য সৃষ্টিতেও। ওর চোখের পাতা সেই সুদূর জ্যোৎস্নারাতের স্মৃতিতে একটু একটু করে ভারী হয়ে আসতে লাগল।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিন্দ্য নিজেও বুঝতে পারেনি। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো খুব মিষ্টি একটা গানের সুরে। কিন্তু ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসতেই চমকে গেল সে ; এই গানটাই তো সেই সাতরঙা পাখিটা গাইছিল বিকেলবেলা। এখানে এই গান কে গাইছে ? তবে কি সেই পাখিই? আরেকটু ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করল অনিন্দ্য। না, এটা তো সেই পাখির গলা নয়, এ যে কোনও বাচ্চা মেয়ের গলা। চোখ রগড়ে সোজা হয়ে উঠে বসল সে। এদিক সেদিক দেখতে লাগল, কিন্তু গানটা যে ঠিক কোন দিক থেকে ভেসে আসছে কিছুতেই ঠাহর করতে পারল না।
এমন সময় হঠাৎ কে যেন ভারী মিষ্টি গলায় বলল, "আমাকে খুঁজছ ?"
চমকে ফিরে তাকাল অনিন্দ্য। একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে ওর ঠিক পাশে, একটা পাথরের ওপর বসে আছে। মুক্তোর মতো দাঁতে একগাল হাসি নিয়ে।
"তুমি কে ?" অনিন্দ্য জিগ্যেস করল।
"বলব না। আগে বলো তুমি কে ?" বাচ্চা মেয়েটা বড়দের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলল।
"আমি অচিনপুরের রাজপুত্র অনিন্দ্যকুমার।"
"রাজপুত্র ? তা এতো রাতে এই বনে কেন ?"
অনিন্দ্য মনে মনে ভাবল বড্ড পাকা মেয়ে তো। মুখে বলল, "এমনি, ভালো লাগছিল না তাই। কিন্তু তুমি এখানে একা একা কী করছ ?"
"আমারও ভালো লাগছিল না, তাই !" ভারী বিজ্ঞের মতো ঠোঁট উল্টে বলল মেয়েটি।
অনিন্দ্য একটু গম্ভীর গলায় বলল, "এই, বেশি পাকামো কোরো না। এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে কিনা একা একা রাতবিরেতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তোমার মা-বাবা কোথায় ? সত্যি কথা বলবে কিন্তু।"
"হুহঃ ! তুমি নিজে যেন খুব সত্যি কথা বলো !"
"মানে ?" গলাটা আরেকটু গম্ভীর করার চেষ্টা করল অনিন্দ্য।
"আমি সব জানি। সাতরঙা পাখি আমায় সব বলেছে।" কথাগুলো বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা।
এবার ভীষণ অবাক হল অনিন্দ্য। "তুমি চেনো সেই সাতরঙা পাখিকে ?"
"চিনব না কেন ? যারা স্বপ্ন দেখে, সেই পাখি তাদের সবার কাছে যায়।"
"আচ্ছা, তাহলে তুমি কি স্বপ্নপরীর ঠিকানাও জানো ?"
অনিন্দ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা এমনভাবে হেসে উঠল যেন সে ভারী বোকার মতো কিছু একটা জিগ্যেস করে ফেলেছে। তারপর হাসি থামলে মেয়েটা বলল, "এই তবে আসল কারণ ! তুমি বুঝি স্বপ্নপরীকে খুঁজতে বেরিয়েছ ?"
কাতর গলায় অনিন্দ্য বলল, "হ্যাঁ গো, আমার স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে, আমি আবার সেই স্বপ্নগুলোকে ফিরে পেতে চাই।"
"কেন ? তুমি তো রাজপুত্র, রাজবিদ্যার পরীক্ষায় তোমার এতো ভালো ফল, তুমি তো দেশে গিয়ে এক দারুণ রাজা হতে পারো। কী করবে স্বপ্ন দিয়ে ?"
"বাঁচব। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচব। সত্যি বলছি মেয়ে, আমি কোনওদিন রাজা হতে চাইনি। আমি স্বপ্ন দেখতাম কবিতা লিখবার, আমি স্বপ্ন দেখতাম ছবি আঁকবার আর সবুজভরা মাঠে মাঠে গান গেয়ে বেড়াবার। কিন্তু কীভাবে যে নিজের সেই সোনালী স্বপ্নগুলো হারিয়ে ফেললাম... । বলো না, সেই স্বপ্নপরীকে কোথায় পাবো? তুমি নিশ্চয়ই জানো তার ঠিকানা!"
মেয়েটি নিজের ছোট্ট কচি-কচি দুটো হাতে অনিন্দ্যর হাতটা ধরে বলল, "স্বপ্নপরীকে বাইরে কোথাও পাবে না গো রাজপুত্র, সে আমাদেরই মনের ভেতর লুকিয়ে থাকে। ছোটবেলা সবাই স্বপ্ন দেখে যেমন তুমি দেখতে; তারপর বড় হতে হতে জীবনের ইঁদুর দৌড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সেই স্বপ্নগুলো, হারিয়ে যায় সেই স্বপ্নপরীও। তখন যে আমরা অনেক বড় হয়ে যাই রাজপুত্র, স্বপ্ন তখন আমাদের কাছে অবাস্তব হয়ে যায়।"
"তাহলে কি তাকে আর কোনওদিন খুঁজে পাব না ?" ছলছলে চোখে জিগ্যেস করল অনিন্দ্য।
"যদি স্বপ্নের টানে বাস্তবকে হেলায় সরিয়ে দিতে পারো, তবেই আবার স্বপ্নপরীকে খুঁজে পাবে। যারা স্বপ্ন দেখে স্বপ্ন হয়ে বাঁচার, স্বপ্নপুরী তাদের কাছেই যায়।" মেয়েটা আবার সেই মিষ্টি সুরে গাইতে শুরু করল,
"আমি স্বপ্ন দেখি স্বপ্ন হয়ে বাঁচার,
আমি স্বপ্ন দেখি আবার ভালোবাসার..."
অনিন্দ্য অবাক হয়ে দেখল সেই মেয়েটার সারা শরীর থেকে রামধনুর সাত রঙ ঠিকরে বেরোচ্ছে। ভরা জ্যোৎস্নার আলোও যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেই আলোতে। মেয়েটা একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে লাগল সেই আলোর মধ্যে। অনেক অনেক দূর থেকে যেন ভেসে আসছে তার মিষ্টি গলা, "স্বপ্ন হয়ে বাঁচো রাজপুত্র, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচো..."
"যেও না স্বপ্নপরী, আমি চিনেছি তোমাকে। যেও না।" কিন্তু অনিন্দ্যর কথাগুলোও যেন কোথায় মিলিয়ে যেতে লাগল সেই রামধনুর স্রোতে। আলোটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল। অনিন্দ্য শুনতে পেল দূর থেকে কে যেন ডাকছে তাকে..."রাজকুমার, ওঠো।"
হঠাৎ ঘুম ভেঙে হকচকিয়ে জেগে উঠল অনিন্দ্যকুমার। অবাক চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, এ যে অচিনপুরের রাজবাড়ী। সে তার নিজের ঘরেই পড়তে পড়তে কখন যেন ওই মোটা বিচ্ছিরি রাজনীতির বইটার ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বাইরে ঝলমল করছে নতুন সকাল। সূর্যের আলোয় সাতরঙা রামধনু ঠিকরে পড়ছে প্রাসাদের দেয়াল থেকে। অনিন্দ্য দেখল তার পাশেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা, মহারাজ অচিন্ত্যনারায়ণ। রাজা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "এই দেখো অনিন্দ্য কী এনেছি তোমার জন্যে!"
রাজার হাতের দিকে তাকাতেই যেন একরাশ আনন্দ আর বিস্ময় একসঙ্গে কেঁপে উঠল অনিন্দ্যর চোখে। মহারাজ ওর জন্যে রং, তুলি, ছবি আঁকার ক্যানভাস আর বেশ কিছু কবিতার বই নিয়ে এসেছেন।
"বাবা !"
"হ্যাঁ অনিন্দ্য, তুমি তোমার নিজের মতো করেই এগিয়ে যাও। স্বপ্ন বড় দামি জিনিস, একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না।"
"আর রাজশিক্ষার কলেজ ?"
"কলেজে যাবে বৈকি। কিন্তু রাজশিক্ষার নয়, তুমি সেই কলেজে যাবে যেখানে তোমার মনের মতো জিনিস শিখতে পারবে। যেখানে তুমি জীবনের জালে জড়িয়ে পড়বে না, বরং বাঁচবে স্বপ্নের সোনালী জাল বুনে।"
জল থই-থই চোখে অনিন্দ্য জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে। আজ যেন সে আবার নতুন করে চিনল এই মানুষটাকে। রাজা ওর চুলে আলতো করে আঙুল বোলাতে লাগলেন। তাঁর চোখের কোণেও যেন কিছু একটা চিকচিক করে উঠল। হয়তো শুধুই চোখের জল, কিম্বা হয়তো কোনও হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন।
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল