'তোমরা গান গাইতে পার? আমি একজন লোকের কথা বলব সে একটা গান গাইতে পারত। তার নাম ছিল গুপি কাইন।.... গুপি কিনা একটা গান গাইতে পারত, আর সে গ্রামের আর কেউ কিছু গাইতে পারত না, তাই তারা তাকে খাতির করে বলতো গুপি 'গাইন'।...... গুপিদের গ্রামের কাছেই আরেকটা গ্রামে একজন লোক থাকতো, তার নাম ছিল পাঁচু পাইন। পাঁচুর ছেলেটির বড্ড ঢোলক বাজাবার শখ ছিল। বাজাতে বাজাতে সে বিষম ঢুলতে থাকতো, চোখ পাকাতো, ..... গ্রামের লোক তা দেখে হাঁ করে থাকত আর বলত, 'আহা!...' শেষে যখন 'হাঃ হাঃ! হা-হা!' বলে বাঘের মতো খেঁকিয়ে উঠতো, তখন সকলে পালাবার ফাঁক না পেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যেত। তাই থেকে সকলে তাকে বলতো 'বাঘা বাইন'।'
চেনা চেনা লাগছে নিশ্চয়ই? একদম ঠিক ধরেছো! এই সেই আমলকি গ্রামের গুপি আর হরতুকীতলার বাঘা, যাদের গান বাজনায় তিতিবিরক্ত হয়ে গ্রামের লোক তাড়িয়ে দিয়েছিলো গ্রাম থেকে আর দুজনে তখন গভীর জঙ্গলে দেখা পেয়েছিলো ভূতের রাজার! সত্যজিৎ রায়ের এই কালজয়ী সিনেমা 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' তো সবাই তোমরা দেখেছো, কিন্ত জানো কি এই গল্প কে লিখেছিলেন? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যিনি ছিলেন সত্যজিতের ঠাকুরদা।
আমি যখন ক্লাস ফোর, জন্মদিনে উপেন্দ্রকিশোরের একগোছা গল্প দিয়ে সাজানো বই 'গল্পের রাজা' উপহার দিয়েছিলো আমার দাদাভাই। আর সেই বইতেই আমি প্রথম গুপি বাঘার গল্প পড়ি। বইটিতে ছোটো বড় মিলিয়ে মোট তিরিশখানা গল্প ছিলো। গুপি বাঘার পরেই যে গল্পটি আমার সবথেকে প্রিয় তার নাম 'ঝানু চোর চানু'। গ্রামের এক গরীব ছেলে তার চালাকি আর বুদ্ধির জোরে কীভাবে ডাকাত দলকে শায়েস্তা করবে আর জমিদারকে নাস্তানাবুদ করবে সেই কাহিনী সবার পছন্দ হবেই। আমি তো এখনো অবধি যদি কেউ চালাকি বা ফাঁকিবাজি করে কোনো কাজ করে তাকে বলি "ঝানু চোর চানু হয়েছো?"
গল্পের রাজার বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে আছে পুরাণের গল্প। মা দুর্গার ছোটো ছেলে গণেশের মাথা হাতির মতন কেন? সূর্যের বউ যদি ছিলেন বিশ্বকর্মার কন্যা, সূর্যের ছেলে মেয়ে তবে কারা? পৃথিবীর নামকরণ কীভাবে হলো? গঙ্গানদীকে তো আমরা বলি গঙ্গাদেবী, সেই দেবীকে পৃথিবীতে কে আনলো? এই সব নানাবিধ পুরাণের আখ্যান একদম ছোটোদের উপযোগী করে নিজের লেখনীর গুণে গল্পের আকার দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। রামায়ণে রাম লক্ষ্মণের গুরু ছিলেন যে ঋষি বশিষ্ঠ, দুই অসুর ভাই ইল্বল-বাতাপি বা প্রচণ্ড শক্তিধারী ঋষি অগস্ত্য যিনি বিন্ধ্য পর্বত নড়িয়ে দিয়েছিলেন এদের সবার কথাই আছে গল্পের রাজাতে। মাইথোলজি অর্থাৎ পুরাণ আমার খুব পছন্দের বিষয়। পরবর্তীকালে হিন্দু, বিষ্ণু আর নানা দেশ বিদেশের মাইথোলজি পড়েছি, তোমরাও নিশ্চয়ই পড়বে। পুরাণের প্রতি আমার এই ঝোঁক গল্পের রাজা পড়েই প্রথম আসে।
ছোটোদের ভীষণ পছন্দের একটি বিষয় রূপকথা আর সেই সূত্র ধরেই 'গল্পের রাজা'তে বেশ কয়েকটি রূপকথার গল্পও স্থান পেয়েছে। এই রূপকথার গল্পের মধ্যে আবার প্রকারভেদ রয়েছে। একপ্রকার হলো রাজা-রানি, দত্যি-দানব, রাজপুত্র-রাজকন্যেদের নিয়ে। যার মধ্যে আমার সবথেকে প্রিয় গল্প ছিলো 'ঘ্যাঁঘাসুর'।
ঘ্যাঁঘার বাহারী লেজের পালক আনতে গিয়ে মানিককে বানাতে হবে এমন এক গাড়ি যা চলে ডাঙায়, ভাসে জলে আর ওড়ে আকাশে! তবে গিয়ে সে পাবে রাজত্ব আর রাজকন্যা। বানর রাজপুত্রের গল্পও আছে এই বইতে। আরেকপ্রকারের রূপকথা হলো সাধারণ গ্রামের গরীবগুর্বো লোক তাদের জীবনে দারুণ সব আজব আশ্চর্য কান্ডকারখানা। যেমন গুপি-বাঘার গল্পে দুই বেজায় গরীব ছেলে ভূতের রাজার বরে জগৎ জয় করেছিলো বা 'দুঃখীরাম' গল্পে দুখু তার মামার অত্যাচার থেকে বাঁচতে কতসব আজগুবি ঘটনা ঘটিয়েছিলো, আবার 'তিনটি বর' গল্পে শয়তানের হাত থেকে পালাতে কামারের কতশত ফন্দিফিকির! কেবলমাত্র রাজা রানি নয়, অতি সাধারণ মানুষদের জীবনও যে রূপকথার মতো হতে পারে এই গভীর ভাবনার বীজ কি অবলীলায় শিশুদের মনে রোপণ করেছেন উপেন্দ্রকিশোর। ওঁর গল্পেই আমরা শিখেছি শয়তানের পায়ে থাকে ছাগলের খুর!
গল্পের রাজার সূচীতে আরো একটি বিশেষ ধরনের গল্প স্থান পেয়েছে, সেটি হলো বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের গল্প। ঈশপের গল্পে যেমন আমরা জানি বিভিন্ন নীতিকথা প্রাণীদের মধ্যে দিয়ে বলা হয়, ঠিক সেইভাবেই উপেন্দ্রকিশোরও শিশুমনের উপযোগী করে নানান গল্প বলেছেন, উপদেশের কথা শুনিয়েছেন। 'তিন মাছের কথা' গল্পে আমরা জানতে পারি তিন বন্ধু মাছের কথা। 'অনাগত বিধাতা' যে কোনো বিপদ হওয়ার আগে তার উপায় করে রাখতো, 'প্রত্যুৎপন্নমতি' যে বিপদ এলে বুদ্ধি খাটিয়ে তা দূর করতো আর 'দীর্ঘসূত্র' যে আজ নয় কাল করে সময় কাটাতো আর বুদ্ধি তার ছিলো না, তাই বিপদ এলে তার রক্ষা থাকতো না। গল্পের রাজাতে যখন এই গল্প প্রথম পড়ি তখন এইসব কঠিন শব্দের মানে জানতাম না। কিন্ত এই গল্প পড়লে দেখবে কত সহজে তোমরা বেছে নিতে পারবে জীবনে চলতে গেলে কোন মাছের মতো হতে হবে।
জীবজন্তু বিষয়ক বাঘ আর শিয়াল এবং টুনটুনি আর বিড়ালের কয়েকটি গল্প আছে গল্পের রাজাতে। বাঘ-শিয়াল সিরিজের আর টুনটুনি সিরিজের সমস্ত গল্প পড়তে হলে তোমরা 'বাঘ শিয়ালের মেলা' আর 'টুনটুনির বই' পড়তেই পারো।
গল্পের পাশাপাশি মানানসই অলংকরণে বই পড়ার মজা দ্বিগুণ হয়ে যায়। রঙচঙে প্রচ্ছদ আর প্রতিটি গল্পের সাথে মজাদার ছবি যা ঠিক কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র নয়, অনেকটা হাসির মোড়কে তৈরি ইলাস্ট্রেশন। গল্পের রাজার প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করেছিলেন সঞ্জয় সরকার।
অনেক বছর আগে কেনা বলে বইয়ের প্রচ্ছদ আর অক্ষত নেই, দুঃখের বিষয়। তবু গল্পের সাথে আঁকা কিছু ছবি তুলে দিলাম। বইটি এখনো প্রকাশিত হয় কিনা তাও আমার জানা নেই। তবে আনন্দের কথা, উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র দে'জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত, গল্পের রাজার সব গল্প তোমরা ওতেই পাবে। বইটা জোগাড় করে ফেলতেই পারো, 'গল্পের রাজা'র সঙ্গে আরও অনেক মজাদার গল্পের খোঁজ পেয়ে যাবে একই বইয়ের মধ্যে।
গল্পের রাজার সাথে সেইবারে গরমের ছুটি আমার কী যে আনন্দে কেটেছিলো তা আর তোমাদের কি বলবো! তখন তো না ছিলো বাড়িতে ল্যাপটপ না ছিলো মোবাইল, এমনকী কেবল্ টিভিও না। গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটি বা ক্রিসমাসে বই ছিলো আমাদের একমাত্র সঙ্গী। এখনকার ব্যস্ত জীবনেও কিন্ত ঠাকুর দেখার ফাঁকে গুপি বাঘা আর ঝানু চোর চানুকে ফিরে দেখতেই পারো। পুুজোর দিনগুলো আনন্দে ভরে থাকবে।
(সমাপ্ত)
পড়েছি বেশ কিছু তাই খুব ভালো লাগলো এটা পড়ে 😊
ReplyDeleteআচ্ছা একটা কথা বলি, গুপির আসল নাম 'গুপি কাইন' ছিল নাকি 'কানু কাইন'??? আমি ভুলও হতে পারি।