বেশ কিছুক্ষণ হল বাইরে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এবার খুব জোরে একটা বাজ পড়তেই ঘরের আলোটা দপ করে নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘর জুড়ে শুরু হয়ে গেল ভূতের কেত্তন। জয়ন্ত বেশ জোরে ধমক দিয়ে বলল,
"কী হচ্ছেটা কী? চুপ করে বসো। আমি জেনারেটর অন করে আসি।"
আটজন ছেলেমেয়ে বোধ হয় তৈরি হয়েই ছিল। প্রায় একসঙ্গেই চিৎকার শুরু করে দিল,
“প্লিজ দাদা! আজ আর পড়ব না! এরকম বৃষ্টি আর লোডশেডিং-এর সময় পড়তে ইচ্ছে করে নাকি?”
জয়ন্ত হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
"তাহলে কী করবি? এখন তো বাইরেও বেরোনো যাবে না।"
"একটা গল্প বলুন না দাদা! বেশ গা ছমছমে ভূতের গল্প!"
"একটা গল্প বলুন না দাদা! বেশ গা ছমছমে ভূতের গল্প!"
গোল গোল চোখ করে বলে উঠল সুপ্রিয়া। বাকিরাও সঙ্গে সঙ্গে তাল মেলালো।
জয়ন্ত এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
জয়ন্ত এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
"বাঃ! চমৎকার! ক'দিন পর মাধ্যমিক পরীক্ষা ...আর এখন কিনা লেখাপড়া ফেলে ভূতের গল্প! কী আবদার!"
সবচেয়ে সিরিয়াস ছাত্র মোহিত বলল,
সবচেয়ে সিরিয়াস ছাত্র মোহিত বলল,
"একটাই তো দিন! মাঝে মাঝে এরকম ব্রেক নিলে ভালোই লাগে। পড়ায় মন বসে। পরের দিন নাহয় একটু বেশি পড়িয়ে দেবেন।"
জয়ন্ত এবার হো হো করে হেসে ফেলে বলল,
জয়ন্ত এবার হো হো করে হেসে ফেলে বলল,
"তুইও? আচ্ছা বেশ... তাহলে একটা মোমবাতি জ্বেলে আনি...মোমের আলোতেই এই গল্প ভালো জমবে।"
গোটা ঘরে এখন পিন ড্রপ সাইলেন্স । টেবিলের উপর রাখা মোমবাতির শিখা একটু একটু কাঁপছে। জয়ন্ত তার গল্প শুরু করল...
"দেখ, এখন আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি। আর আমরা যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছি, তারা তো কোনোমতেই কুসংস্কারে বিশ্বাসী নই। এমন অনেক ঘটনাই আছে, যাকে অলৌকিক বা ভৌতিক বলা হয়, তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও কিন্তু চেষ্টা করলে বের করা যায়। তবে বছরদুয়েক আগে আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা ঠিক করে আমি আজও করতে পারিনা।
তখন আমি এম.এস.সি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে ইউনিভারসিটির কাছেই একটা মেসে থাকতাম। কথায় কথায় একদিন আমাদের মধ্যে জোর তর্ক লেগে গেল। কেউ বলল ভূত, প্রেতাত্মা এসব কিছুই নেই, মানুষের মনের ভুল। আবার কেউ বলল- এই পৃথিবীতে আজও অনেক ঘটনা ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। আমি ছিলাম সেই নাস্তিকদের দলে। খুব করে যুক্তি দিয়ে নানারকম উদাহরণ তুলে কথা বলছিলাম। তখন বিপক্ষ শিবিরের এক বন্ধু ঝপ করে বলে বসল- "ওই যে, মাঠের ওপারে একটা পরিত্যক্ত কবরখানা রয়েছে, তুই রাত দুটোর সময় পারবি ওখানে একা একা যেতে?" সত্যি বলতে কি... কথাটা শুনে আমি একটু থতমত খেয়ে গেছিলাম। বাকি বন্ধুরাও কথা বন্ধ করে চুপ করে গেল। এদিকে রনি, মানে সেই ভূতবিশ্বাসী বন্ধু চেঁচিয়েই চলেছে-“কী রে ব্যাটা, বোলতি বন্ধ্? এতক্ষণ তো খুব সাহস দেখাচ্ছিলি, এবার? ভয় করছে খোকা?”
আমি বেশ কঠিন গলায় জবাব দিলাম- “না ...ভূতের ভয় নয়। অন্ধকারে ওই ভাঙাচোরা কবরের মধ্যে সাপখোপ থাকার খুবই চান্স আছে। শীত পড়তে তো বেশ কিছুদিন দেরি, সাপেরা এখন থেকেই নিশ্চয় শীতঘুমে চলে যায়নি !”
“তাহলে তুই কী করতে চাস?” বাবলু নামে আর এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল ।
আমি বললাম- "আমার স্মার্টফোনটা সঙ্গে রাখতে চাই। ওর মধ্যেই টর্চ আছে। আর তাছাড়া, আমি যে সত্যি ওখানে গেছি, তার প্রমাণ তো চাই। আমি মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলে আনব। ছবিগুলো তোলার ডেট অ্যান্ড টাইম...সবই তোরা দেখতে পেয়ে যাবি।"
রনি একটু ভেবে বলল- “সে ভালো কথা। গ্রেভ-ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফিও তুলে নিস। তুই নিজে গেছিস, না অন্য কেউ গেছে, দেখতে হবে তো!”
রাত দেড়টা নাগাদ যখন রেডি হচ্ছি, তখন আর বন্ধু রাহুল বলল- "আর একবার ভেবে দেখ ভাই, হুট করে যা ইচ্ছে ডিসিশন নিস না। কোনো বিপদ হয়ে গেলে আমরা নিজেদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।"
গোটা ঘরে এখন পিন ড্রপ সাইলেন্স । টেবিলের উপর রাখা মোমবাতির শিখা একটু একটু কাঁপছে। জয়ন্ত তার গল্প শুরু করল...
"দেখ, এখন আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি। আর আমরা যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছি, তারা তো কোনোমতেই কুসংস্কারে বিশ্বাসী নই। এমন অনেক ঘটনাই আছে, যাকে অলৌকিক বা ভৌতিক বলা হয়, তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও কিন্তু চেষ্টা করলে বের করা যায়। তবে বছরদুয়েক আগে আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা ঠিক করে আমি আজও করতে পারিনা।
তখন আমি এম.এস.সি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে ইউনিভারসিটির কাছেই একটা মেসে থাকতাম। কথায় কথায় একদিন আমাদের মধ্যে জোর তর্ক লেগে গেল। কেউ বলল ভূত, প্রেতাত্মা এসব কিছুই নেই, মানুষের মনের ভুল। আবার কেউ বলল- এই পৃথিবীতে আজও অনেক ঘটনা ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। আমি ছিলাম সেই নাস্তিকদের দলে। খুব করে যুক্তি দিয়ে নানারকম উদাহরণ তুলে কথা বলছিলাম। তখন বিপক্ষ শিবিরের এক বন্ধু ঝপ করে বলে বসল- "ওই যে, মাঠের ওপারে একটা পরিত্যক্ত কবরখানা রয়েছে, তুই রাত দুটোর সময় পারবি ওখানে একা একা যেতে?" সত্যি বলতে কি... কথাটা শুনে আমি একটু থতমত খেয়ে গেছিলাম। বাকি বন্ধুরাও কথা বন্ধ করে চুপ করে গেল। এদিকে রনি, মানে সেই ভূতবিশ্বাসী বন্ধু চেঁচিয়েই চলেছে-“কী রে ব্যাটা, বোলতি বন্ধ্? এতক্ষণ তো খুব সাহস দেখাচ্ছিলি, এবার? ভয় করছে খোকা?”
আমি বেশ কঠিন গলায় জবাব দিলাম- “না ...ভূতের ভয় নয়। অন্ধকারে ওই ভাঙাচোরা কবরের মধ্যে সাপখোপ থাকার খুবই চান্স আছে। শীত পড়তে তো বেশ কিছুদিন দেরি, সাপেরা এখন থেকেই নিশ্চয় শীতঘুমে চলে যায়নি !”
“তাহলে তুই কী করতে চাস?” বাবলু নামে আর এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল ।
আমি বললাম- "আমার স্মার্টফোনটা সঙ্গে রাখতে চাই। ওর মধ্যেই টর্চ আছে। আর তাছাড়া, আমি যে সত্যি ওখানে গেছি, তার প্রমাণ তো চাই। আমি মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলে আনব। ছবিগুলো তোলার ডেট অ্যান্ড টাইম...সবই তোরা দেখতে পেয়ে যাবি।"
রনি একটু ভেবে বলল- “সে ভালো কথা। গ্রেভ-ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফিও তুলে নিস। তুই নিজে গেছিস, না অন্য কেউ গেছে, দেখতে হবে তো!”
রাত দেড়টা নাগাদ যখন রেডি হচ্ছি, তখন আর বন্ধু রাহুল বলল- "আর একবার ভেবে দেখ ভাই, হুট করে যা ইচ্ছে ডিসিশন নিস না। কোনো বিপদ হয়ে গেলে আমরা নিজেদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।"
আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম "আচ্ছা বাপু, ভয়ে দাঁত-কপাটি লাগলে নাহয় তোদের ফোন করে ডেকে নেব।"
আমার কথা শুনে কেউ হাসল না। রাহুল গম্ভীরভাবে বলল-"আমরা জেগে থাকব কিন্তু। ভালোভাবে ফিরে আয়।"
রনি হাসতে হাসতে বলল-“ আরে দেখ না, ও এক্ষুণি ফিরে আসবে। কবরখানার কাছে গেলেই ওর দম শেষ হয়ে যাবে ...হাহাহা...”
আমিও ওর হাসির জবাবে একগাল হেসে বেরিয়ে পড়লাম মেস থেকে।
চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে রাতচরা পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আকাশে সরু একফালি চাঁদ রয়েছে, তার আলোও কেমন যেন ম্লান। বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে, গাছগুলো কেমন দুলে দুলে উঠছে। মনে হচ্ছে –কালো কাপড় পরে কারা যেন নাচ করছে!
আমার হাসি পেয়ে গেল। লোকে এসব দেখেই যতসব উদ্ভট কল্পনা করে নেয়। আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটা লাইন মনে পড়ে গেল- মানুষ আসলে ভূতকে নয়, অন্ধকারকে ভয় পায়।
কবরখানার গেটে অনেকদিন ধরেই একটা মরচে পড়া তালা লাগানো রয়েছে। আমি তার পাশে ভাঙা পাঁচিল গ'লে ভেতরে ঢুকে গেলাম। দিনের বেলা বেশ কিছু গরু ছাগলও ঘাস খেতে ঢোকে এখান দিয়ে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চিরে আমার মোবাইল টর্চের আলো এগিয়ে চলল। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দু-একটা ছবি তুলতে লাগলাম মাঝে মাঝে। বেশিরভাগ কবরের প্রস্তরফলক ভেঙ্গে পড়েছে। নামগুলোও পড়া যাচ্ছে না। আমি আর একটু ভিতরের দিকে এগিয়ে চললাম। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে মনে হল একটা কবর এখনো কিছুটা আস্ত আছে। ফলকের উপর আবছা হয়ে থাকা এপিটাফ- 'ইন লাভিং মেমরি অফ মিস ফ্রিডা গোমস (১৯৬৫-১৯৮৪)' চেষ্টা করলে এখোনো পড়া যায়। আমি সেই এপিটাফের একটা ফোটো তুললাম। লেখাগুলো পড়া সম্ভব হবে না ফটোতে। তারপর সেই কবরের পাশে বসে একটা সেলফি নিলাম। কেমন যেন মনটা খারাপ লাগছিল। মাত্র উনিশ বছরেই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হল মেয়েটাকে। হয়ত খুব ছটফটে প্রাণচঞ্চল মেয়ে ছিল! জীবনকে ঘিরে হয়ত অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। জীবন কত অনিশ্চত! কাল কী হবে, কেউ জানিনা।
কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে ছিলাম ওই কবরের উপর। তারপর ধীরে ধীরে উঠে পড়লাম। এবার ফিরে যাওয়া। কী মনে হতে পাশের বুনো ফুলগাছ থেকে কয়েকটা ফুল তুলে নিলাম। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিলাম ফ্রিডার কবরের উপর। ফিসফিস করে বললাম-“ ভালো থেকো বন্ধু”। আজও বুঝতে পারি না, 'বন্ধু' কথাটা মুখ দিয়ে কীভাবে আর কেন বেরিয়ে গেল!
যতটা সতর্ক হয়ে কবরখানায় ঢুকেছিলাম, ঠিক ততটাই অন্যমনস্ক হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, তাই হয়ত পায়ের কাছে মূর্তিমান যমকে দেখতে পাইনি। যখন টের পেলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার সরু কালো চাবুকের মতো শরীরটা টান হয়ে রয়েছে। ফণা তুলে ছোবল মারার ঠিক আগের মুহূর্ত! আর পালানোর পথ নেই,সময়ও নেই বোধ হয়। এই কালসাপ কোথা দিয়ে কখন আমার পায়ের একেবারে কাছে এসে পড়ল, আমি টের পাইনি। এতটাই আনমনা ছিলাম আমি? কেন?
আমার তখন একেবারেই মাথা কাজ করছিল না। কিন্তু অবাক হয়ে আমি দেখলাম, সাপটা আমার পায়ে ছোবল মারার চেষ্টা করছে, অথচ কিছুতেই পারছে না! কোনো অদৃশ্য হাত যেন তার মাথা ধরে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। প্রচণ্ড রাগে ফোঁসফোঁস করছে সাপটা! বারবার তার ছোবল গিয়ে পড়ছে আমার পায়ের পাশে মাটির উপর! একবার এদিকে, একবার ওদিকে! কিন্তু কোনোভাবেই আমার শরীর স্পর্শ করতে পারছে না! কিছুক্ষণ পর সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পড়ল সেই বিষাক্ত সাপ। মরল,কী অজ্ঞান হয়ে গেল...কে জানে!
এবার আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়েছি! পাগলের মতো ছুটে চলেছি ভাঙ্গা পাঁচিলের দিকে। ঠিক যখন পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখনি পায়ের কাছে ছপ করে কী একটা এসে পড়ল! ও বাবা! আবার সাপ নাকি! আমি আঁতকে উঠে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি একগোছা বুনো ফুল! এখানে কী করে এল? এই ফুলের গাছ তো পাঁচিলের আশেপাশে নেই! এ তো ফ্রিডার কবরের পাশে ছিল, এরকম কিছু ফুলই তো আমি তার কবরে দিয়ে এসেছি!
কেন জানি না, আমার একটুও ভয় হল না। ফুলের গুচ্ছ হাতে তুলে নিয়ে নিজের কপালে ঠেকালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের জমাট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম –“ভালো থেকো বন্ধু!”
জয়ন্ত একটানা গল্প বলে এবার জলের বোতলটা টেনে নিল। কয়েকজন ছাত্র বলে উঠল,
আমিও ওর হাসির জবাবে একগাল হেসে বেরিয়ে পড়লাম মেস থেকে।
চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে রাতচরা পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আকাশে সরু একফালি চাঁদ রয়েছে, তার আলোও কেমন যেন ম্লান। বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে, গাছগুলো কেমন দুলে দুলে উঠছে। মনে হচ্ছে –কালো কাপড় পরে কারা যেন নাচ করছে!
আমার হাসি পেয়ে গেল। লোকে এসব দেখেই যতসব উদ্ভট কল্পনা করে নেয়। আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটা লাইন মনে পড়ে গেল- মানুষ আসলে ভূতকে নয়, অন্ধকারকে ভয় পায়।
কবরখানার গেটে অনেকদিন ধরেই একটা মরচে পড়া তালা লাগানো রয়েছে। আমি তার পাশে ভাঙা পাঁচিল গ'লে ভেতরে ঢুকে গেলাম। দিনের বেলা বেশ কিছু গরু ছাগলও ঘাস খেতে ঢোকে এখান দিয়ে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চিরে আমার মোবাইল টর্চের আলো এগিয়ে চলল। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দু-একটা ছবি তুলতে লাগলাম মাঝে মাঝে। বেশিরভাগ কবরের প্রস্তরফলক ভেঙ্গে পড়েছে। নামগুলোও পড়া যাচ্ছে না। আমি আর একটু ভিতরের দিকে এগিয়ে চললাম। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে মনে হল একটা কবর এখনো কিছুটা আস্ত আছে। ফলকের উপর আবছা হয়ে থাকা এপিটাফ- 'ইন লাভিং মেমরি অফ মিস ফ্রিডা গোমস (১৯৬৫-১৯৮৪)' চেষ্টা করলে এখোনো পড়া যায়। আমি সেই এপিটাফের একটা ফোটো তুললাম। লেখাগুলো পড়া সম্ভব হবে না ফটোতে। তারপর সেই কবরের পাশে বসে একটা সেলফি নিলাম। কেমন যেন মনটা খারাপ লাগছিল। মাত্র উনিশ বছরেই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হল মেয়েটাকে। হয়ত খুব ছটফটে প্রাণচঞ্চল মেয়ে ছিল! জীবনকে ঘিরে হয়ত অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। জীবন কত অনিশ্চত! কাল কী হবে, কেউ জানিনা।
কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে ছিলাম ওই কবরের উপর। তারপর ধীরে ধীরে উঠে পড়লাম। এবার ফিরে যাওয়া। কী মনে হতে পাশের বুনো ফুলগাছ থেকে কয়েকটা ফুল তুলে নিলাম। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিলাম ফ্রিডার কবরের উপর। ফিসফিস করে বললাম-“ ভালো থেকো বন্ধু”। আজও বুঝতে পারি না, 'বন্ধু' কথাটা মুখ দিয়ে কীভাবে আর কেন বেরিয়ে গেল!
যতটা সতর্ক হয়ে কবরখানায় ঢুকেছিলাম, ঠিক ততটাই অন্যমনস্ক হয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, তাই হয়ত পায়ের কাছে মূর্তিমান যমকে দেখতে পাইনি। যখন টের পেলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার সরু কালো চাবুকের মতো শরীরটা টান হয়ে রয়েছে। ফণা তুলে ছোবল মারার ঠিক আগের মুহূর্ত! আর পালানোর পথ নেই,সময়ও নেই বোধ হয়। এই কালসাপ কোথা দিয়ে কখন আমার পায়ের একেবারে কাছে এসে পড়ল, আমি টের পাইনি। এতটাই আনমনা ছিলাম আমি? কেন?
আমার তখন একেবারেই মাথা কাজ করছিল না। কিন্তু অবাক হয়ে আমি দেখলাম, সাপটা আমার পায়ে ছোবল মারার চেষ্টা করছে, অথচ কিছুতেই পারছে না! কোনো অদৃশ্য হাত যেন তার মাথা ধরে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। প্রচণ্ড রাগে ফোঁসফোঁস করছে সাপটা! বারবার তার ছোবল গিয়ে পড়ছে আমার পায়ের পাশে মাটির উপর! একবার এদিকে, একবার ওদিকে! কিন্তু কোনোভাবেই আমার শরীর স্পর্শ করতে পারছে না! কিছুক্ষণ পর সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পড়ল সেই বিষাক্ত সাপ। মরল,কী অজ্ঞান হয়ে গেল...কে জানে!
এবার আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়েছি! পাগলের মতো ছুটে চলেছি ভাঙ্গা পাঁচিলের দিকে। ঠিক যখন পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখনি পায়ের কাছে ছপ করে কী একটা এসে পড়ল! ও বাবা! আবার সাপ নাকি! আমি আঁতকে উঠে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি একগোছা বুনো ফুল! এখানে কী করে এল? এই ফুলের গাছ তো পাঁচিলের আশেপাশে নেই! এ তো ফ্রিডার কবরের পাশে ছিল, এরকম কিছু ফুলই তো আমি তার কবরে দিয়ে এসেছি!
কেন জানি না, আমার একটুও ভয় হল না। ফুলের গুচ্ছ হাতে তুলে নিয়ে নিজের কপালে ঠেকালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের জমাট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম –“ভালো থেকো বন্ধু!”
জয়ন্ত একটানা গল্প বলে এবার জলের বোতলটা টেনে নিল। কয়েকজন ছাত্র বলে উঠল,
“তারপর কী হল দাদা? আপনি মেসে ফিরে গেলেন?”
জয়ন্ত খানিকটা জল খেয়ে বোতলের ঢাকনা বন্ধ করে বলল,
জয়ন্ত খানিকটা জল খেয়ে বোতলের ঢাকনা বন্ধ করে বলল,
“ফিরে গেলাম এবং হিরো হলাম! বন্ধুরা টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। ফোন করার চেষ্টাও নাকি করেছে! কিন্তু প্রতিবারই আমার ফোন নট রিচেবল ছিল। তখন সবাই মিলে প্ল্যান করেছিল-আর পনেরো মিনিটেও আমি যদি না ফিরি, তো ওরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়বে। সবচেয়ে ভয় পেয়েছিল সেই রনি-পাগলা! ভেবেছিল আমি হয়ত ভূতের হাতে শেষ হয়ে গেছি। ফিরে আসার পর আমায় জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল।"
"তাহলে কি আপনি এখন আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন দাদা?" ছাত্রী অনুপমা জানতে চাইল।
জয়ন্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"তাহলে কি আপনি এখন আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন দাদা?" ছাত্রী অনুপমা জানতে চাইল।
জয়ন্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"হয়ত করি। হয়ত বা করি না। হয়ত কবরখানার ওই সাপটা অসুস্থ ছিল... আমায় কামড়ানোর ইচ্ছে তার ছিল না... নিজের কষ্টেই ছটফট করছিল! আর সেই ফুল? হতে পারে...আমার জামায় আটকে গেছিল কোনোভাবে। পাঁচিলের কাছে এসে সেটা খসে পড়েছিল। কিন্তু, তাও মাঝে মাঝে মনে হয়...অনেক দূরের কোনো বন্ধুর শুভেচ্ছা আমার সঙ্গে আছে এবং থাকবে।"
ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। কারেন্টও এসে গেছে। জয়ন্তর বাড়ির লাগোয়া কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে এল ছাত্রছাত্রীরা। রাস্তার সব আলো জ্বলছে, তবুও কেমন গা ছমছম করছিল...প্রত্যেকেরই !
(সমাপ্ত)
ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। কারেন্টও এসে গেছে। জয়ন্তর বাড়ির লাগোয়া কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে এল ছাত্রছাত্রীরা। রাস্তার সব আলো জ্বলছে, তবুও কেমন গা ছমছম করছিল...প্রত্যেকেরই !
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল
ছোট অথচ কি সুন্দর একটা গল্প 😊
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ।খুব খুশি হলাম।
Deleteখুব ভালো
ReplyDeleteঅনেক ভালোবাসা রুমেলা
Deleteপড়ার পর বলি- ভাল তো থাকবেই, ভাল লিখবেও। তাই আমিও দূর থেকে একগুচ্ছ ফুল দিলাম - ছপ্
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা। আপনি ও খুব ভালো থাকুন এবং ভালো লিখুন।
Delete