গল্পের ঝুলি : পকেটমার চন্দন : স্বরূপা রায়



চন্দনের হাতের গুণটা ছোটবেলা থেকেই। জন্মের পর থেকেই সে সংসারে অভাব দেখে বড় হয়েছে। তাই পেটের জ্বালায় প্রথমদিকে অভাবে পকেটমারা শুরু করলেও পরে সেটা তার স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়।


চন্দনের বয়স এখন আঠারো। বাড়িতে আছে বাবা, মা আর বোন। ওর বাবা একেকসময় এক একটা কাজ করে। কখনো মিস্ত্রীর কাজ, কখনো পাহারাদার, তো কখনো ট্রেনে ট্রেনে হকারি। ওর মা লোকের বাড়ি কাজ করে। আর বোন কিছু করে না।

চন্দনকে ওর বাবা অনেকবার চেয়েছেন কোনও ভালো স্থায়ী কাজে ঢুকিয়ে দিতে। বাবার জোরাজুরিতে কাজে ঢুকলেও সে টিকতে পারেনি কোথাও। পকেটমারাটা তার এখন নেশায় পরিণত হয়েছে।

চন্দনদের একটা বড় গ্রুপ আছে। সবাই আশেপাশের গ্রামেরই ছেলে। সারাদিন ট্রেনে আর শহরে গিয়ে পকেটমারি করে। সন্ধেবেলা বসে তাদের স্টেশনের পেছনে জুয়া আর মদের আসর।

চন্দনের বাড়ির সবাই ওর এই আইনবিরোধী কাজের কথা জানে। অনেকবার পুলিশ ওকে হাতেনাতে ধরেছে। এক বা দুই রাত জেলেও কাটিয়েছে। কিন্তু ওর লজ্জা বা ভয় কোনওটাই নেই। চন্দনের বাবা আর মা সবসময় এটার জন্য বকাবকি করে। কিন্তু ও কারও কথা কানেই নেয় না।

দুদিন ধরে চন্দনের কাজ ভালো হচ্ছে না। তাই ওর মাথা খারাপ হয়ে আছে। গত পরশু লোকাল ট্রেনে একজনের পকেট মারল অনেক কষ্টে। কিন্তু পকেটে পেল মাত্র দুশো টাকা আর ডেবিট কার্ড। সে তো নিরক্ষর। ডেবিট কার্ড থেকে টাকা বের করা তার সাধ্যের বাইরে।

গতকাল আবার আরেক কাণ্ড। চন্দন সদ্য শিয়ালদহ স্টেশনের ভিড়ে একজন ছেলের পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। হঠাৎ ট্রেন স্টেশনে ঢোকার ঘোষণা। ছেলেটা এমন দৌড় মারল যে চন্দনের অবস্থা খারাপ। এইদিকে ঠাসাঠাসি ভিড়, আরেকদিকে পকেটে হাত আটকে। অনেক কষ্টে সে হাতটা বের করতে পারল। কিন্তু মানিব্যাগটা হাতে আসেনি। তাই আজ সে পণ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে যে, আজ মোটা টাকা লুফেই ছাড়বে।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই চা, মুড়ি খেয়ে চন্দন তৈরি হয়ে নিল। দুয়ারে দরজার মাথায় লাগানো দুর্গাঠাকুরের ছবিটায় প্রণাম করে বের হতেই যাবে এমন সময় ওর মা জিজ্ঞেস করল, "কোথায় যাচ্ছিস?"
"কাজে।"
"কী কাজ?"
"আমি কি আর কোনো স্থায়ী কাজ করি নাকি? যখন যেটা পাই। তোমাদের টাকা দিয়ে তো কথা।"
"পকেট মারা বন্ধ করেছিস তো? পেটে ভাত না জুটলে অত কষ্ট হয় না, যতটা পুলিশ তোকে মারলে হয়। অভাবে থাকতে পারি কিন্তু সম্মান আছে আমাদের একটা।"
"বুঝেছি। সকাল সকাল অত জ্ঞান দিও না তো।"
"আমি জ্ঞান দিচ্ছি না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম পকেট মারা বন্ধ করেছিস কিনা।"
"করেছি।"
"ঘন্টা করেছে। কয়েকদিন আগেই চম্পা বলল আমাকে, ওর দাদা দেখেছে স্টেশন থেকে দাদাকে রেল পুলিশ পকেট মারতে গিয়ে হাতেনাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।" চন্দনের বোন বলল।
"তুই চুপ করবি? ছোট ছোটর মতো থাক। বাজে কথা বলতে আসিস না।" চন্দন ওর বোনকে ধমক দিল।
"আমি বাজে কথা বলছি? মা, চম্পাকে তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।"
"দেখ, মাথা আমার বিশাল গরম হয়ে আছে। এরপর তোর গায়ে হাত তুললে কিছু বলতে পারবি না।"
"আয় দেখি গায়ে হাত তুলতে। আমিও দেখি কেমন পারিস! পকেটমারি করে বাবা-মায়ের সম্মান ডোবাচ্ছিস। তার উপরে আবার গলায় এত জোর?"
"মা দেখেছ, ওর কত সাহস হয়েছে।"
"খারাপ কী বলেছে? আমার মাথার দিব্যি দিয়েছিলাম তোকে। তাও তুই শুধরাসনি। আমি মরলেও তোর কিছু যায় আসে না। তাই না?" চন্দনের মা বলল।
"মা, তুমি ওর কথা বিশ্বাস করছ?"

"আমি জানি ও মিথ্যা বলবে না।"
"তাহলে আমি মিথ্যা বলি তোমাকে?"
"হ্যাঁ বলিস।"
"শোনো, যাই করি না কেন, এই সংসারের জন্যই করি। আমার টাকাতেও তো সংসারটা চলছে। কয়েক বছর বাদে তোমার এই মেয়ের বিয়েও হবে সেই টাকাতেই।"
"আমি আইবুড়ো থাকব, কিন্তু তোর ওই পকেটমারির টাকায় বিয়ে করবো
না।" চন্দনের বোন বলল।
"তাহলে আর বিয়ে হচ্ছে না তোর।"
"হবে না। কোনো ব্যাপার না।"
"সারাজীবন কি তোকে বসায় খাওয়াব?"
"নিজেরটা নিজে করে খাব।"
"দেখব, কত মুরোদ!"

"তোরা চুপ করবি? আমার আর ভাল লাগছে না।" চন্দনের মা বিরক্ত হয়ে রেগে বলল।
"আমি বেরোলাম।" বলে চন্দন বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।

"ধুর, সকাল সকাল মুডটা আরও বিগড়ে গেল। বাড়ির লোক এত অশান্তি করলে হয় নাকি? ওসব সৎপথে আজকাল কিস্যু হয় না। এরা যে সেটা কবে বুঝবে কে জানে!" মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে চলল চন্দন।

স্থানীয় স্টেশনে এসে উঠে পড়ল সে একটা শিয়ালদহগামী ট্রেনে। খুব ভিড় ট্রেনে। নিজেকে কোনোমতে ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল সে। একজন অফিসগামী ভদ্রলোকের পাশে নিজেকে সেট করে দাঁড়াল।

ভদ্রলোক এক হাতে ঝুলছেন, আরেক হাতে মোবাইলে টেপাটেপি করছেন। কখনো উনি গম্ভীর হয়ে মোবাইলে কিছু পড়ছেন। আবার কখনো মুচকি হাসছেন মোবাইলে কিছু দেখে।
চন্দন কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করল ভদ্রলোককে। তারপর আশেপাশের কেউ দেখছে কিনা দেখে নিল। তারপর আস্তে আস্তে নিজের ডান হাতটা ঢোকালো ভদ্রলোকের ফর্মাল প্যান্টের পকেটে। মানিব্যাগটা হাতে ধরেই চন্দন বুঝল যে, বেশ মোটা, প্রচুর টাকা আছে। ধীরেসুস্থে, খুব সাবধানে সে ভদ্রলোকের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। তারপরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার দেখে নিল যে কেউ দেখেছে কিনা। সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। কেউ দেখেনি আশ্বস্ত হয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকল যেন কিছুই হয়নি।

শিয়ালদহ স্টেশন এসে গেল। সবার সাথেই ঠেলাঠেলি করে চন্দনও নেমে গেল ট্রেন থেকে। তারপর তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে একটা নির্জন জায়গায় এসে মানিব্যাগটা বের করল পকেট থেকে। মানিব্যাগটা খুলতেই তার চোখ একেবারে চড়কগাছ। প্রচুর টাকার নোট। আর সবই প্রায় পাঁচশোর নোট।

চন্দন সব নোট, কয়েন গুনে হিসেব করে দেখল, মানিব্যাগটায় মোট ১০,২১৯টাকা আছে। সে খুশিতে একেবারে লাফিয়ে উঠল, "আজকে তো পার্টি হবে।"

মানুষের লোভ কখনো কমে না। যেখানে চন্দনের দুদিন ধরে কোনো কামাই ছিল না, সেখানে আজ এত টাকা পেল। কিন্তু তাও লোভ কমল না। যদি আরোও কিছু হাত সাফাই করতে পারে, সেই লোভে শিয়ালদহ স্টেশনেই এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল সে। আর সবাইকে দেখে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল যে, কাকে ফাঁদে ফেলা যায়।

মিনিট কুড়ি সবাইকে পর্যবেক্ষণ করার পর চন্দন টার্গেট করল একজন অল্পবয়সী যুবককে। সেই যুবক স্টেশনেই দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ট্রেন আসার অপেক্ষা করছে। তার আবার পিঠে ব্যাগ। চন্দন তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর সে যুবকটিকে জিজ্ঞেস করল, "কোথায় যাবেন?"
"নৈহাটি। আপনি?"
"আমি দমদম।"
"আচ্ছা।"

চন্দন লক্ষ্য করল যে, যুবকের পকেটে কিচ্ছু নেই। মানিব্যাগ পকেটে থাকলে উঁচু হয়ে থাকত।
"নিশ্চয়ই মানিব্যাগটা পিঠের ব্যাগটায় আছে।" সে ভাবল মনে মনে।

তারপর ধীরে ধীরে সে যুবকের পিঠের ব্যাগের পকেটের চেইনটা খুলল। সে ঠিকই ভেবেছিল। মানিব্যাগ এখানেই। ধীরেসুস্থে, খুব সাবধানতার সাথে সে মানিব্যাগটা বের করেই নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিল।

এরই মধ্যে ঘোষণা হল যে, শিয়ালদহ থেকে নৈহাটিগামী লোকাল ট্রেন আসছে। যুবকটি চন্দনকে বলল, "আমার ট্রেন আসছে।"

"হ্যাঁ ঘোষণা তো হল।"
"মা নৈহাটি জেলা হাসপাতালে ভর্তি। ক্যান্সার হয়েছে। টাকার জন্য চিকিৎসা আটকে আছে। অনেক কষ্টে এখান থেকে টাকাপয়সা জোগাড় করে আবার ফিরছি। আমার মায়ের জন্য প্রার্থনা করবেন। আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই। যাই হোক, আসছি এখন।" বলে যুবক চলে গেল।

চন্দন কিচ্ছু বলতে পারল না। এত বছরের জীবনে প্রথম তার কষ্ট হল কারও পকেট মেরে। নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। নৈহাটি যাওয়ার ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকল। মুহূর্তে স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়েও গেল।

চন্দন নিজের চোখের জল মুছে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। আজ সকালে শিয়ালদহগামী ট্রেনে ভদ্রলোকের পকেট মেরে পাওয়া ১০,২১৯ টাকাও এই যুবকের মানিব্যাগে ঢোকাল।
ঘন্টাখানেক বাদে আবার শিয়ালদহ থেকে নৈহাটিগামী আরেকটা ট্রেন ঢুকল স্টেশনে। চন্দন উঠে পড়লো তাতে। নৈহাটি পৌঁছে সে পৌঁছাল জেলা হাসপাতালে। অনেককে জিজ্ঞেস করে সেই যুবকের কাছে পৌঁছে হাতে তুলে দিল মানিব্যাগটা। যুবক খুশি হয়ে চন্দনকে গলা জড়িয়ে ধরল।

"আমি তো ভেবেছিলাম সব গেল। নৈহাটি স্টেশনে নেমে যখন দেখলাম মানিব্যাগটা নেই, তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। ধন্যবাদ ভাই। আজ আপনি না থাকলে আমি কী যে করতাম!" যুবক বলল।

"আমি এটা আপনি চলে যাওয়ার পরে পাই। প্ল্যাটফর্মে পড়েছিল। আপনাকে খুঁজে পাইনি আর। তাই চলে এলাম এখানে।"
"ধন্যবাদ ভাই। আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করলেন।"
"এতে কষ্টের কী আছে! আপনার মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক।" বলে চন্দন চলে এল।

বাড়ি ফিরে চন্দন ওর মায়ের হাতে একশো টাকা দিল। সাথে সাথেই ওর মা রেগে জিজ্ঞেস করল, "পকেট মেরে আজ মাত্র একশো কামাই হয়েছে?"

"এটা কারও পকেট মেরে না। নিজে খেটে কামাই করেছি। স্টেশনের কাছে একটা বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। ট্রেন থেকে নামতেই একটা বন্ধু এসে জানাল যে, ইট দোতলায় তোলার জন্য লোক লাগবে একজন। আমি রাজী হয়ে যাই। সেটা করেই এই টাকাটা কামাই করেছি।"

চন্দনের মুখে এই কথা শুনে ওর মা খুশিতে কেঁদে ফেলল। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলল, "আমি এই দিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।"

"আমি কথা দিলাম মা আজ তোমায়, আর কোনোদিন কারও পকেট মারব না। আমার পকেটমারির জন্য কারও প্রাণ পর্যন্ত যেতে পারে, এটা আমি আজ বুঝে গেছি। আর তা আমি চাই না।" 
চন্দন বলল। ওর চোখে জল।

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : আবির

No comments:

Post a Comment