“ চল, চল, চল বের কর। আরো কত বস্তা? ”
“ আরো পাঁচ বাকি। ঘোটনকে দেখেছিস? কোথায় গেলো ও? শেষ মুহূর্তে কেস খাওয়াবে না তো? ”
“ না না চিন্তা করিস না, ওই তো খবর দিলো, এতটা রিস্ক নিলো। নিশ্চয়ই বাড়ি আগলাচ্ছে। ”
“ সত্যি ওর বাপ জানলে ...”
এক এক করে বস্তাগুলো বেরোতে থাকে গুটি গুটি পায়ে। ছোট ছোট দেহগুলো এমনভাবে বস্তাগুলোকে বের করছে, এই অন্ধকারে দূর থেকে দেখলে মনে হয় বস্তাগুলো নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে যাচ্ছে। ভিন্ন বয়সের দুইজোড়া সজাগ চোখ কড়া নজরে সবটা দেখছিল। টেনশন হচ্ছে, চাপ বাড়ছে। মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে বারান্দার পেছনে থাকা বন্ধ দরজাগুলোর দিকে, যদিও বাইরে থেকে হুড়কো টানা, তবু যদি ঘুম ভেঙে যায়, দরজায় ধাক্কা পড়ে তাহলে কেলেঙ্কারি। বারান্দায় দাঁড়ানো বয়স্ক মানুষটি বলে উঠলেন,
“ কেমন লাগছে দাদুভাই? ”
“ ভয় করছে দাদা। তবে খুব ভালোও লাগছে। ”
“ আমারও। খুব ছোটবেলায় বাবামায়ের মুখে শুনেছি বিভিন্ন জমিদার বা মহাজনদের বাড়িতে বিপ্লবীরা খাদ্যের সামগ্রী বা আনাজ লুন্ঠন করতেন। আজ যেন নিজে সেই রোমাঞ্চ টের পাচ্ছি। ”
কিশোর ছেলেটির চোখ চকমক করে উঠলো। মনে হচ্ছে শেষ বস্তাটিও বেরিয়ে যাচ্ছে। দোতলার বারান্দা থেকে ওরা দেখলো, গেটের বাইরের গাড়িটার হেডলাইট জ্বলে উঠলো।
“ দাদা, আমরা পেরেছি। ”
ঘোটনের ভালো নাম কেউ তেমন জানে না। ভালো নাম একটা আছে বটে, ব্রজ লাহিড়ী। কিন্তু কেউ একবার ‘ঘোটন’ নামটা শুনলে আর অন্য নামে ডাকতে চায় না সে স্কুলেই হোক আর পাড়ায়। ঘোটনদের সম্ভ্রান্ত পরিবার, মূলতঃ তার বাবার জন্যই। দেশের স্বাধীনতার আগে তাদের বিশেষ কিছু ছিল না। তার ঠাকুর্দাও এক সাধারণ স্কুল শিক্ষক ছিলেন চাকুরিজীবি হিসাবে। কিন্তু বাবা বিশ্বেশ্বর লাহিড়ী ঐ পথে হাঁটেননি। তাঁর নিজস্ব বড় মুদির দোকান আছে এই মফস্বলে, যেখানে সংসারের যাবতীয় সামগ্রী পাওয়া যায়, এমনকী কানাঘুষোয় শোনা যায় তিনি চড়া সুদের কারবারও করেন। ঘোটন স্বাভাবিকভাবেই কোনোদিন এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। তার মন পড়ে থাকে খেলার মাঠে বা তাদের বাড়ির পেছনের পুকুরে, ওখানে যে ছিপ ফেলে ভালো মাছ ধরা যায়। বাবার সঙ্গে সারাদিনে তার তেমন দেখা হয় না, তাই মানুষটা সম্পর্কে এক অজানা ভয় আর শ্রদ্ধা মিশে থাকে। বাবা বেশি স্নেহও করেন না, দরকারি কথা ছাড়া সেও তাই পারতপক্ষে বাবার কাছে ঘেঁষে না। ঘোটনের কাছে তার ঠাকুর্দাই হলো সবকিছু, তার নিজের দাদা।
অন্যদিনের মতো ঘোটন স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়ে নিয়ে দৌড় লাগালো মাঠের দিকে। আজ ক্রিকেট ম্যাচ আছে। তেমন ভালো ব্যাটিং, বোলিং না পারলেও টিমের সেরা ফিল্ডার ও। ওর দুইপাশে চারহাতের সীমানায় কোনো বল গলতে পারে না। কিন্তু মাঠে গিয়েই মাথায় বজ্রপাত। টিমের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যান আজ খেলতে আসেনি, কানু আর ভানু। কানু-ভানুদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয় বলে খেলার যাবতীয় সরঞ্জামের খরচ ক্লাবই বহন করে। সেই ব্যাট, প্যাড সব মাঠের এক পাশে শোয়ানো। ওদের দেখা নেই।
“ কেউ গেছিলি ওদের বাড়িতে? ” ঘোটন জিজ্ঞেস করলো।
বাবুল বললো, “ হ্যাঁ, আমি যখন ডাকতে গেছিলাম ওরা বাড়ি ছিল না, কী কাজে বেরিয়েছে যেন। ওরা তো ক্রিকেট-পাগল, তাই ভেবেছিলাম, ঠিক চলে আসবে। ”
হতাশায় সবার কাঁধ ঝুঁকে গেল। এত ভালো দুজনকে ছাড়া ওরা খেলবে কি করে?
খেলা শুরু হলো, আর ফলও হলো আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে। ওরা গোহারান হেরে ভূত হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। ঘোটনের খুব মনখারাপ। এভাবে কেউ হারে? ব্যাটিং করতে নেমে একজনও দাঁড়াতে পারলো না, কানু ভানু থাকলে নিশ্চয়ই এরকম হতো না। কানু ভানুর কথা মনে হতেই ওর খুব রাগ হলো দুজনের ওপর। এভাবে কেউ শেষমুহূর্তে ডুবিয়ে দেয়? এই ওদের খেলার প্রতি, বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা? ওদের জবাব দিতে হবে। ঘোটন দ্রুত সাইকেল বের করে কানু ভানুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
“ মা, এই কুড়ি টাকা। ”
“ মোটে কুড়ি টাকা? এত মাল বয়ে দিলি আর মোটে কুড়ি টাকা! এই টালির বাড়িটাও আর রাখতে দিবি না তোরা? যা, দূর হয়ে যা। ”
কানু আর ভানু আর কোনো কথা বলতে পারল না। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। ওরা যে সারাদিন খাটলো, মা একবারও তা দেখলো না? সারাদিন না খেয়ে খিদেয় পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে, তাও টের পেল না মা? আজ খেলার মাঠে না গিয়ে সব বন্ধুদের কাছে বিশ্বাসঘাতক হয়ে দাঁড়ালো যে ওরা, সেটাও দেখলো না বুঝি মা? ওরা কি আর কোনোদিনও খেলতে যেতে পারবে মাঠে? পারবে কোনোদিন আর স্কুলে যেতে? বাবার শরীর ঠিক হচ্ছে না, মা বিরক্ত ওদের ওপর আর ওরা যেন ঠিক ঠাহর করতে পারছে না কেন হয়ে চলেছে এরকম।
এক কামরার ঘর ওরা থেকে বেরিয়ে এসেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। ঘোটন? এখন? এখানে?
ঘোটন যতটা রাগ করে এসেছিল সেইমতো কিছুই করতে পারলো না। দরজায় টোকা দিতে গিয়ে ঘরের সমস্ত কথা ওর কানে গেছে। ওর মাথায় শুধু এটাই ঢুকছে না, কানু ভানু মাল বইতে কেন গিয়েছিলো?
ঘোটন কানু ভানুকে নিয়ে চলে এলো চৌমাথার ধারের বটগাছের তলায়।
“ কি হয়েছে তোদের? খেলার মাঠে আসিসনি কেন? ”
দুজনেই চুপ থাকে। কোনো কথা বলে না। ঘোটন অন্য প্রশ্ন করে, “ তোরা খেলতে না এসে মাল বইতে কেন গেছিলি? কি হয়েছে বল না। ”
এবারও দুজনে চুপ। ভানু যেন উশখুুশ করতে থাকে। হঠাৎ বলে ফেলে, “ ঘোটন কিছু খাওয়াবি? খুব খিদে ...”
কানু শক্ত করে ভানুর হাত চেপে ধরে। ভানু চুপ করে যায়।
ঘোটন বুঝতে পারছে বড়সড় কিছু গন্ডগোল হয়েছে কিন্তু কি হয়েছে তা ঠিক বুঝতে পারে না। পকেটে হাত দিয়ে দেখে একটা দশটাকা রয়েছে। ও কানুর বারণ উপেক্ষা করে মুড়িমাখা কিনে আনে।
“ বল না কানু, কি হয়েছে? তোরা আজ খেলতে এলি না, মাল বইতে গেছিলি, আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ”
কানু না চাইতেও একমুঠো মুড়ি মুখে চালান করে। দুই ভাই পুরো মুড়িটা শেষ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘোটনের দিকে। “কিছু জানতে চাস না ঘোটন। তুই এই খাওয়ালি এতেই সব মিটে গেল। আর কিছু জানতে চাস না।”
ঘোটন আরো অবাক হয়ে যায়। “ কি মিটে গেল? আমি কি করেছি? ”
“তুই নয় তোর বাবা।” ভানু চোয়াল শক্ত করলো। কানু ভানুকে একটা ধাক্কা মেরে বললো, “চুপ থাক তুই। ঘোটন আমরা আজ আসি।”
ঘোটনের সব গুলিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্নরকম অনুভূতি কাজ করছে। ওর বাবা কি করলো? একটা ভয় চেপে বসছে মনে। ওর জানার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ও কানুর হাত ধরে আটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ কি করেছে আমার বাবা? ”
দুজন কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কানু বলে উঠলো, “শোন ঘোটন, তুই জেনে কিছু করতে পারবি না কিন্তু তবু জেনে রাখ, আশা করি তুই এরকম খারাপ কোনোদিন হবি না।
তোর বাবা চড়া সুদে কারবার করে। ধারবাকিতে জিনিস দিয়ে তার ওপর চড়া সুদ লাগায়। মেটানোর সময় দেয় অল্প। নিজে লোক লাগিয়ে অন্যের জমির ফসল তুলে নেয়, তারপর সে সাহায্য চাইতে এলে তাকেই উল্টে তার নিজের জমি তোর বাবাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য টোপ দেয়, মানতে না চাইলে সুদের হার আরো বাড়িয়ে দাম মেটাতে বলে, ফেরত দিতে না পারলে জমি বন্ধক দিতে বলে। তারপর ধীরে ধীরে অন্যের বাসভূমি, চাষের জমি গ্রাস করে। আমার বাবার সঙ্গেও তাই হয়েছে। এই সপ্তাহের মধ্যে টাকা না দিলে আমাদের বাড়ি ভেঙে দেবে তোর বাবা।”
“কী যা তা বলছিস? মুখ সামলে কথা বল।”
“তোকে বলেইছিলাম তুই পারবি না সাহায্য করতে, তবে আমি যা বলছি তা ১০০% সত্যি।”
ঘোটনের চোখে জল চলে আসে কষ্টে, অপমানে। ওর বাবা এরকম? যা কানাঘুষো শুনতো ও ওর বাবার সম্পর্কে বাবা কী তার থেকেও বাজে?
কানু ভানু উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাড়ি ফেরার জন্য পেছন ফিরতেই ঘোটন বলে ওঠে, “ দাঁড়া, আমি তোদের সাহায্য করবো। চল আমার সঙ্গে, দাদার কাছে। ”
ঘোটনের ঠাকুর্দা ওরফে দাদা শিবেশ্বর লাহিড়ী আদর্শবাদী মানুষ। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে এখন অবসর নিয়েছেন। বহু ছাত্রছাত্রীদের মানুষ করতে গিয়ে বুঝেছেন কোথাও একটা তাল কেটেছে। তাঁর নিজের ছেলেই হয়তো সৎ পথে নেই। নাতি ঘোটন আর তার দুই বন্ধুর সব কথা শুনে তিনি তাই বিশেষ আশ্চর্য হলেন না। শুধু মনটা তীব্র এক যন্ত্রণায় ছেয়ে গেল। ছোটবেলার অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো, ওঁর বাবার শোনানো অনেক কাহিনী। নিজের মনকে শান্ত করতে ঘোটন আর তার দুই বন্ধুর কাছে আউড়ে গেলেন অনেক কথা যা ঐ তিন কিশোরের কাছে সম্পূর্ণ অজানা।
“জানো দাদুভাইরা, মানুষই মানুষের চিরশত্রু। যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে চলেছে। একজন মানুষ বাকি সবাইকে ঠিক তারই মতো মানুষ বলে মনে করতে পারে না। ১৯৪২-৪৩ সালে যখন সারা বিশ্ব প্রমাদ গুণছে যুদ্ধের ভয়াবহতায়, তখন এই ভারত বা তথা বাংলায় এসে পড়ে সম্পূর্ণ অন্য এক সমস্যা। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায় খাদ্যের অভাবে, অপুষ্টিতে, ম্যালেরিয়া আরো নানান রোগের মহামারীতে ,যা মূলতঃ হয়েছিল কিছু মানুষের দুরভিসন্ধি বা চক্রান্তে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ সাধারণত দেখা যায় প্রকৃতির খেয়ালখুশি চলনের ফলে। কিন্তু আমি যে দুর্ভিক্ষের কথা বলছি তার জন্য প্রধানত দায়ী ছিল মানুষদের ভূমিকা। মনুষ্যকৃত দুর্ভিক্ষ। জিনোসাইড বা সুপরিকল্পিত ভাবে মানুষ মারার অবস্থা তৈরি করা যা আপাতভাবে সবার চোখে প্রাকৃতিক মনে হলেও আসল কারণ আলাদা।
বছরের পর বছর বৃষ্টির অভাব, অপর্যাপ্ত চাষযোগ্য জমি, বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফলনের উন্নতি না হওয়ায় সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল। এর ফলে ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছিল। আর এর মধ্যে একটা বিশাল অংশ ধারদেনায় ডুবে থাকতো মহাজনদের কাছে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে। এই অবস্থাটা ভীষণভাবে ব্যাপকতা পায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে। ইংরেজরা মিত্রবাহিনীর নামে যথেচ্ছ ভাবে ভারতীয়দের নিজেদের আপন যুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করলো। নাহলে ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। সেনাবাহিনীর খাবারের জোগানের জন্য জমি দখল হতে লাগলো একের পর এক। বড়লোকরা আর ইংরেজদের প্রিয়পাত্ররা ফসল বাজারে ছাড়ার পরিবর্তে নিজেদের ঘরে জমাতে শুরু করলো। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তে লাগলো জোগানের অভাবের ফলে। ভারতে চালের এক অংশ তখন মায়ানমার বা বার্মা থেকেও আসতো। কিন্তু ১৯৪২ সালে জাপান বার্মা দখল করার পর সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো ভারতের সঙ্গে, যেহেতু ভারত ইংরেজ অধীনস্থ ছিল। উপরন্তু ব্রিটিশ সরকার শুধুমাত্র মিলিটারি, সরকারি চাকুরে আর বিশেষ কিছু শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে সরবরাহ সীমাবদ্ধ রেখেছিল। ”
“ দাদা, তাহলে কি সাধারণ মানুষ কিছুই পেতো না? ”
“ পেতো দাদুভাই, তবে অন্যরকমভাবে, অনেক বেশি দামে, ব্ল্যাক মার্কেট বলে যেটাকে। যেখানে দামের কোনো নির্দিষ্ট মূল্য নেই। লোকদের মধ্যে প্যানিক বাড়লো কারণ খাবারই পৌঁছোত না তাদের কাছে। বার্মা থেকে চালের জোগান বন্ধ হওয়া এবং তৎকালীন সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল দেওয়া শুরু করলো মানুষরা। যেসব বাঙালিদের খাবার কিনে খেতে হতো তাদের পক্ষে রোজকার দিন কাটানো মুশকিল হয়ে গেল। তাই মনে করা হয় এক নির্দিষ্ট ভূমিহীন কৃষক বা শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৩০% মানুষই মারা গেছিলো এই দুর্ভিক্ষে।
অনেকেই মনে করেন তখনকার ব্রিটেনের নেতা উইনস্টন চার্চিলের ভারতের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব এই দুর্ভিক্ষ ঘটার অন্যতম কারণ। চার্চিল ভারতীয়দের থেকে খাবার ছিনিয়ে ব্যবহার করেছিল তার দেশের সেনাবাহিনীর পেছনে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা গম ব্যবহার করা যেতো ভারতীয়দের জন্য কিন্তু তা কাজে লাগানো হলো মধ্যসাগরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর জন্য। আর শুধু এই নয় ব্রিটিশরা কানাডা এবং আমেরিকা থেকে খাদ্য সরবরাহের সুযোগও প্রত্যাখ্যান করে। যদি চার্চিলের জায়গায় অন্য কেউ থাকতো তাহলেও হয়তো ভারত বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণের সুযোগ সুবিধা পেতো। কিন্তু চার্চিল ভারত এবং ভারতীয়দের ঘৃণা করতো। বিভিন্ন জায়গায় তার উক্তিতে এই কথা স্পষ্ট যে ভারতীয়রা মারা গেলে তার কিছু যায় আসে না। প্রথম কিছু মাস চার্চিল মনেই করেনি আদৌ এই বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে। মানুষের পর মানুষ মারা যাওয়ার পরও তার নজর এড়িয়ে থাকতো। তাই কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি এই দুর্ভিক্ষ রোধ করার জন্য। ৩০ লক্ষ প্রাণের আর্তি সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি চার্চিলদের মনে।”
“দাদা, দুর্ভিক্ষ শেষ হলো কিভাবে তাহলে?”
“ প্রকৃতি, প্রকৃতিই এই বাংলাকে আবার শস্যশ্যামলা করে তুলেছিল ১৯৪৪ সালে। সাধারণ ফলনের থেকে অনেক বেশি ফলন হয়েছিলো সেইবার। এত মানুষের বলিদান হয়তো ভূমি মা আর বেশিদিন নিতে পারেননি।
খারাপ মানুষরা চিরকাল সমস্যা জিইয়ে রাখতে চায়, তারা চায় অন্যদের কন্ট্রোল করতে। যাতে অন্য মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তারা ফুলেফেঁপে ওঠে। তখনও এই কাজ করতো কিছু মহাজনরা আর এখন আমার নিজের ছেলে করছে। তখন বিপ্লবীরা রুখে দাঁড়িয়েছিল আর এখন আমরা রুখে দাঁড়াবো কানু ভানুর পরিবারের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। খাবার অনেক দামি দাদুভাই। সামান্য এক গ্রাস খাবার না পেয়ে কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে, যায়। তাই তোমায় খাওয়ার সময় খাবার নষ্ট না করতে বলি। ঐ নষ্ট হওয়া খাবার অন্য মানুষের কাছে বেঁচে থাকার উপকরণ। ”
ঘোটন বলে ওঠে, “আমি আর কোনোদিন খাবার নষ্ট করবো না দাদা। তুমি শুধু কানু ভানুর পরিবারকে বাঁচিয়ে দাও।”
“ হ্যাঁ, আচ্ছা বল তো তোদের কতজন বন্ধু আছে? রাত্রিবেলা বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে? ”
হ্যাঁ, এইভাবেই কানু ভানুর পরিবার তাদের ন্যায্য অধিকার আবার পেয়ে যায়। ঘোটন, দাদু আর ঘোটনের বন্ধুরা মিলে ঘোটনের বাবার গুদামঘরে মজুত থাকা বস্তার পর বস্তা লুট করে। পৌঁছে দেওয়া হবে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে যারা কষ্টে আছে, যাদের খাবার জোগাড় করতে দিনের পর দিন চলে যায়।
“প্রাচীন যুগে খাবারের সংস্থান করতেই প্রতিটা দিন চলে যেতো। মানুষ সারাদিন ঘুরতো আর খাদ্য সংগ্রহ করতো। কিন্তু তারপর কৃষিকাজের আবিষ্কার হয়, খাদ্যের জন্য আর জায়গায় জায়গায় ঘুরতে হতো না, ধীরে ধীরে বাসস্থান গড়ে তুললো এক নির্দিষ্ট জায়গায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সর্বোপরি মানুষ খাবার জোগাড় করা ছাড়াও অনেককিছু ভাবার সুযোগ পেলো। গান, খেলাধুলো, পড়াশুনো সবকিছু এক এক করে জায়গা নিতে থাকে মানুষের মধ্যে। তাই আজও যদি মানুষকে খাদ্যের জন্যই জীবন দিতে হয় তার থেকে বড় অক্ষমতা মানবসমাজের আর নেই। একটা মানুষের উচিত আরেক মানুষ যাতে ভালোভাবে বাঁচে তার সুযোগ করে দেওয়া। বুঝলে দাদুভাই?”
“হ্যাঁ দাদা, আমি কোনোদিন কারোর ক্ষতি করবো না। একসঙ্গে থাকবো। কিন্তু এখন কি করবো দাদা? বাবাকে ...”
“হ্যাঁ, তোমার বাবাকে তার ভুল বোঝাতে হবে। যাতে সে নিজে আবার সৎ পথে ফিরে আসে। ঠিক বোঝাতে পারবো আমরা দুজন মিলে। আর এখন চলো, তোমার বাবা জেগে ওঠার আগেই আমরা সিন্দুক থেকে জমি বন্ধক রাখার দলিলগুলো সরিয়ে ফেলি। তুমি কাল খুঁজে খুঁজে দিয়ে আসবে। পারবে না দাদুভাই?"
“ঠিক পারবো দাদা।” ঘোটনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“ঐ দেখো খাবারের গাড়ি চলে যাচ্ছে দূরে। বিভিন্ন মোড় ঘুরে তোমার বন্ধুদের খাবারের গাড়ি পৌঁছে যাক সবার বাড়িতে, একা আমরা না, সবাই আমরা ভালো থাকি।”
তথ্যসূত্র :
Churchill's Secret War by Madhusree Mukherjee,
ibtimes.com,
Wikipedia - Bengal famine
ছবি :
Sketch by Zainul Abedin : 1943 Famine
childrenarewaiting.org
ছবি :
Sketch by Zainul Abedin : 1943 Famine
childrenarewaiting.org
খুব ভালো লাগল । কলম চলুক এইভাবেই ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে ...
Deleteসকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলাম,কখন পড়বো লেখাটা,তথ্যগুলো সাথে মিলিয়ে যে গল্প বেরিয়েছে , তাকে অনবদ্য বললেও খুব কম বলা হয়। 😊 স্বাধীনতা দিবসের সংখ্যায় পড়া অসাধারণ একটি রচনা। ♥️
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
Deleteদারুণ হয়েছে!
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে 😊
DeleteKhuuuuuuuuuuub sundor...Likhte thako ☺
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে ☺️
Deleteদারুন ❤️
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ 🙂
Deleteঅপূর্ব অসাধারণ। ভীষণ ভালো মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। 😊
ReplyDeleteকিন্তু কানু ভানুর বাড়িটা কি বেঁচে যাবে?
ReplyDelete