গল্পের ঝুলি : কাকতাড়ুয়া : দিব্যেন্দু গড়াই





-‘আচ্ছা মা, পশুপাখিরা কি আমাদের বন্ধু নয়?’

-‘সবাই না হলেও অধিকাংশ পশুপাখি তো মানুষের বন্ধু। কেন বল তো?’

-‘তাহলে যে ক্লাসে মিস বলছিল, আগেকার দিনে নাকি পাখিদের তাড়ানোর জন্য চাষীরা কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করত?’

-‘ও কাকতাড়ুয়া! কেমন দেখতে হয় বল তো কাকতাড়ুয়া?’

-‘ঐ তো, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি কাঠামোর ওপর মাটির হাঁড়ি বসানো মুন্ডু। তাতে আবার চোখ-মুখ আঁকা। গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া, আলখাল্লা জামা। ঠিক বলেছি?’

-‘হ্যাঁ। গ্রামবাংলার চাষজমিতে কাকতাড়ুয়ারা এরকমই দেখতে হয়। তবে তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম যখন এর আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন মোটেই এরকম দেখতে ছিল না।’

-‘কোথায় মা? আমাদের দেশে?’

-‘না রে বাবাই। ভারতে নয়। তবে এদেশের মতো নদ-নদীতে ভরা মিশর দেশে। মিশরের নীলনদের তীরবর্তী চাষের জমিতে তখন নানারকম পাখি আসত শস্যদানার লোভে। তাদের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য মানুষ প্রথম কাকতাড়ুয়ার প্রয়োজন অনুভব করে। তখন অবশ্য কাক নয়, কোয়েলজাতীয় পাখির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য জমিতে কাঠ দিয়ে কাঠামো তৈরি করে জাল জড়িয়ে রাখত তারা। পাখিদের ঝাঁক জমিতে এলে তাড়া করত ঐ জাল-লাগানো কাঠামোর দিকে। যে ক'টা পাখি জালে আটকাতো তাদের ধরে পেটপুজো করত। খাওয়াও হল আবার ফসল রক্ষাও। এক ঢিলে দুই পাখি।’

-‘পাখিদের মেরে খেয়ে ফেলত? বদমাইশ লোকজন।’

-‘না রে, ঠিক বদমাইশ নয়। সে তো আমরাও চিকেন-মাটন খাই। তার বেলা? আর শুধু মানুষ কেন, দেবতারাও কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করত।’

-‘কোথায় মা, কোথায়?’

-‘গ্রীস দেশে। গ্রীকদেবী অ্যাফ্রোদিতির ছেলে হল প্রিয়াপাস। অত্যন্ত কদাকার দেখতে। সে যখন আঙুরক্ষেতে খেলে বেড়াত, ভয়ে কাকপক্ষীরা ধারেকাছে ঘেঁষত না। ফলে, আঙুরের ফলনও হত অনেক। তাই না দেখে চাষীরা প্রিয়াপাসের মূর্তি তৈরি করে আঙুরক্ষেতে রাখতে শুরু করল। ফলও পেল হাতেনাতে। সেই কাকতাড়ুয়ার একহাতে থাকত মুগুর আরেক হাতে কাস্তে।’

-‘কাস্তে আমি দেখেছি মা, দাদুর বাড়িতে। মদনকাকু ঘাস কাটছিল, আমায় দেখিয়েছে।’

-‘মদনদাকে ছোটবেলায় আমরা কাকতাড়ুয়া বানাতেও দেখেছি। বিশ্রী গন্ধযুক্ত তেলও ছড়িয়ে দিত কাকতাড়ুয়ার জামায়। বলত, ঐ গন্ধে পাখিরা পালায়। জানিস তো, জাপানে প্রথম এইরকম পচা গন্ধযুক্ত কাকতাড়ুয়া ব্যবহার শুরু হয়। নাম ছিল ‘কাকাশিস’। মানে ‘দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু’।  বাঁশের কাঠামোতে ছেঁড়া চট, মাছ-মাংসের হাড় এইসব জড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত। তীব্র পচা, কটু গন্ধে পশুপাখি ধানক্ষেতের আশেপাশে ভিড়ত না। পরে অবশ্য জাপানীরা বাঁশের কাঠামোতে পুরনো রেনকোট জড়িয়ে দুর্গন্ধবিহীন কাকতাড়ুয়া বানাত। তবে কাকতাড়ুয়া মানে শুধু জড়বস্তু নয় কিন্তু, ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষরা অনেক সময় দলবদ্ধভাবে আওয়াজ করে, পটকা ফাটিয়ে পাখি তাড়াত। ৯-১০ বছর বয়সী বাচ্চাদের কাজে লাগানো হত অনেক জায়গায়। তাদের হাতের থলেতে থাকত ছোটো পাথরের টুকরো। তাই ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফসলের ক্ষেত থেকে পাখি তাড়ানো ছিল একটা পেশা।’

-‘তুমি ছোটোবেলায় কাকতাড়ুয়া দেখেছ, তাই না মা?’

-‘শুধু দেখিনি রে, মদনদার সাথে আমরা ভাইবোনেরা মিলে কাকতাড়ুয়া তৈরি করতাম। দুটো বাঁশ আড়াআড়িভাবে বেঁধে তার ওপর খড় জড়ানো হত। তারপর ছেঁড়াফাটা জামা পরিয়ে মাথার জায়গায় ভুষোকালি মাখানো মাটির হাঁড়ি চড়াতাম। চড়ানোর আগে অবশ্য বিকট চোখমুখ আঁকা হত। কে আঁকবে তাই নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি লেগে যেত আমাদের মধ্যে। সন্ন্যাসীপাড়ার হুতুম তো একবার সেই কাকতাড়ুয়া নিয়ে দারুণ কান্ড করেছিল।’

-‘কী কাণ্ড? বলো না মা, বলো না।’

-‘আরে গলাটা ছাড় আগে। তারপর বলছি।’

*****

ন’দশ বছরের ছেলেটা জন্মাবধি ওর অবিবাহিত পিসির কাছেই মানুষ। স্কুলে যেত ঠিকই। তবে বইখাতার চাইতে কাঠবেড়ালি, চড়াই-বুলবুলি, হাঁস-মুরগির সাথেই সখ্যতা ছিল বেশি। স্কুলের সময় ছাড়া তাকে মাঠেঘাটে অথবা পুকুর-নদীতেই বেশি দেখা যেত। খিদে পেলে তবেই বাড়ির শরণাপন্ন হত হুতুম। নামটা যার দেওয়াই হোক না কেন, ছিল কিন্তু জম্পেশ। রাত-বিরেতেও বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়ায় যে ছেলে, তার হুতুম নাম তো সার্থক। ভয়ডর ছিল ভয়ানকভাবে কম। সমবয়সী হওয়ায় আমার সাথে ভালোই ভাব ছিল। 

সেবার কালীপুজোর পর ঘটনাটা ঘটল। গ্রামে সেবার বিঘের পর বিঘে ধানজমিতে প্রচুর ফলন হয়েছিল। চাষীদের মুখে চওড়া হাসি। শেষ মুহূর্তে ফসলের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি সবার। এক পূর্ণিমার রাতে ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। মন্ডলপাড়ার হরেনকাকু জমি থেকে ফেরার সময় দ্যাখে, কাকতাড়ুয়া ক্ষেতের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। সেকথা শুনে গ্রামবাসীরা কেউ বলল হরেনখুড়োর চোখে নিশ্চয় ছানি পড়েছে। কেউ আবার রসিকতা করে বলল, কাকতাড়ুয়ার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চয় পা ব্যথা করছিল, তাই হাত-পায়ের গিঁট খুলতে আর ফুরফুরে হাওয়া খেতে যাচ্ছিল নদীর পাড়ে, পথে হরেনখুড়োকে দেখে লজ্জায় আর যেতে পারেনি। সে যাইহোক, কাকতাড়ুয়ার নড়াচড়া নিয়ে সবাই বেশ আলোচনায় মেতে উঠল। আমাদের মাঝারিদের দলেও তখন আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু ঐ কাকতাড়ুয়া। লখাদা আমাদের দলের মধ্যে বয়সে ছিল সবচেয়ে বড়। তার সুবিধেও নিতো খুব। একে-ওকে হুকুম করা ছিল রোজকার ব্যাপার। অনেকে মানতে বাধ্য হলেও হুতুম মানত না। তাই সুযোগ পেলেই লখাদা হুতুমকে টাইট দেওয়ার চেষ্টা করত। এই কাকতাড়ুয়ার ঘটনার পর একদিন সবাই মিলে ঝিলের মাঠে খেলাশেষে বসে আছি। হঠাৎ করে লখাদা বলল, 

‘এ্যাই হুতুম। তুই তো খুব সাহসী শুনেছি। পারবি রাতের বেলায় কাকতাড়ুয়ার কাছে একা একা যেতে?’

চট করে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে নিলো হুতুম। বলল, 
-‘শুধু যেতে নয়, তিনদিন পর যে অমাবস্যা আসছে, সে রাতটা আমি কাকতাড়ুয়ার সাথেই কাটাতে রাজি। তবে, একটা শর্তে।’

-‘কী শর্ত?’ লখাদার উৎসুক দৃষ্টি। 

-‘তোমাকে তার আগের দিন রাতের বেলায় গিয়ে কাকতাড়ুয়ার হাতে সুতো বেঁধে আসতে হবে।’

চমকে উঠল লখাদা। বেজায় ভীতু লখাদার কাছে এরকম প্রস্তাব খালি হাতে বাঘের মোকাবিলা করার মতোই ভয়ানক। কিন্তু যেহেতু প্রথমে কথাটা লখাদাই তুলেছিল আর হুতুমের প্রস্তাবে পিছিয়ে গেলে সবাই দুয়ো দেবে, তাই নিমের পাঁচন গেলার মত মুখ করে লখাদা রাজি হল। 

দু’দিন পরে সেই রাত উপস্থিত। দুরুদুরু বক্ষে একগাছি লালসুতো নিয়ে লখাদা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমাদের গ্রুপে হাজির। বলল, পায়ে খেজুর কাঁটা ফুটে গেছে, তা সত্ত্বেও সে নিজের কথা রাখার জন্য কাকতাড়ুয়ার হাতে সুতো বাঁধতে রেডি। অতটা পথ খুঁড়িয়ে যেতে কষ্ট হবে, তাই একজন কাউকে শুধু সাথে যেতে হবে। তাও ক্ষেতের আগে আলপথ অব্দি গেলেই হবে। বাকিটা সে একাই যাবে। বুঝলাম পায়ে কাঁটা ফোটা সব নাটক। আসল উদ্দেশ্য একা না গিয়ে দোকা যাওয়ার। যাইহোক রবিনকে সাথে নিয়ে লখাদা বেড়িয়ে পড়ল। আমরাও যে যার বাড়ির পথ ধরলাম। যাওয়ার আগে লখাদা বলে গেল,

-‘হুতুমকে তো দেখতে পাচ্ছি না। বলে দিস, কাল কিন্তু ওর পালা।’

সে রাতে সবাই এলেও হুতুম কিন্তু আসেনি।

পরেরদিন রবিনের মুখে শুনলাম লখাদা ওকে ধমকেধামকে কাকতাড়ুয়ার কাছ অব্দি নিয়ে গিয়েছিল। তারপর যেই সুতো বাঁধতে গেছে অমনি কাকতাড়ুয়া হাত সরিয়ে নিয়েছে। প্রথমবার চোখের ভুল ভেবে দ্বিতীয়বার রবিনকে আদেশ দিয়েছিল সুতো বাঁধার। কিন্তু কাকতাড়ুয়া কিছুতেই হাতে সুতো বাঁধতে দেয়নি। আবার হাত সরিয়ে নিয়েছিল। আর যায় কোথায়, সুতো-টুতো ফেলে গোঙাতে গোঙাতে লখাদা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মেরেছে দৌড়। পায়ে কাঁটা ফোটা যে মিথ্যে কথা, ঐ দৌড় দেখলে যে কেউ হলফ করে বলতে পারতো। রবিনও টেনে দৌড় মেরে বাড়িতে পৌঁছানো অব্দি আর পেছন ফিরে তাকায়নি। লখাদার করুণ কাহিনী জনে জনে প্রচার হয়ে গিয়েছিল গ্রামে। লখাদা শেষ চেষ্টা করেছিল হুতুমকে দোষী প্রমাণ করার, কিন্তু সে চেষ্টাও বৃথা। কারণ ঐ রাতে হুতুম ধুমজ্বরে শয্যাশায়ী ছিল, প্রতিবেশীরা তার প্রমাণ। 

*****

-‘তাহলে সে দিন কী হয়েছিল মা? কাকতাড়ুয়া নড়লো কী করে? কেউ নিশ্চয় লখাদাকে ভয় দেখানোর জন্য কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে ছিল। কে সে? কার এত সাহস?’

-‘হুতুমের এক প্রিয় বন্ধু যখন দেখল জ্বর হওয়ার জন্য হুতুমের প্ল্যান মাঠে মারা যাচ্ছে তখন সে নিজেই কাকতাড়ুয়া সেজে ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ছিল। লখাদার হামবড়া ভাবসাবের বেলুনকে চুপসে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। আর তাতে সে পুরোপুরি সফল হয়েছিল।’

-‘কে ছিল সেই অসমসাহসী বন্ধু?’

-‘আমার বাবাই-এর মতো সাহসী ছেলের মা ছাড়া অার কে হতে পারে বলে তোর মনে হয়?’

-‘ মাআআআ তুমিইইইইই!!!’ 

-‘ওরে ছাড়, ছাড়। মেলা কাজ পড়ে আছে। তুই ততক্ষণে একটা কাকতাড়ুয়ার ছবি আঁক দেখি।’


(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : দিব্যেন্দু গড়াই

4 comments:

  1. বাহ্, বেশ ভালো লাগলো...

    ReplyDelete
  2. বেশ সুন্দর।

    ReplyDelete
  3. কি দারুণ, খুব ভালো মজার গল্প।

    ReplyDelete