পিকাই যেদিন প্রথম বুঝল-- মা একবার আগুনটা জ্বেলে দিলে একটা ওমলেট ভেজে ফেলাটা তেমন কোনো সমস্যাই নয়-- সেদিন ওর চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল ওর মা।
"অ্যাঁ! এইটুকু ছেলে, কেলাস সেভেনে পড়ে-- সে রান্না করবে! এ আবার কেমনতরো কথা গো!"
বেজায় অবাক হয়ে কথাটা তিনি বললেন বাবাকে।
বাবা যে মা-র সব কথাতেই সায় দিয়ে চলেন-- সেটুকু পিকাই খুব বোঝে। তা মা বাবার চেয়ে ঢের বেশি গম্ভীর আর রাগী বটে! দিদিমণি মানুষ কিনা, তায় চোখে চশমা আছে। তা বাপু, গরমের ছুটিতে ওই অত অত খাতা দেখতে হলে মানুষ একটু-আধটু রাগী হয়েই যায়। এদিকে রাত্তিরে মা-র হাতটা গায়ে না রাখলে পিকাইয়ের আবার ঘুম আসে না-- সেটাও সত্যি। বাবা ইস্কুলে যায় না, অফিসে যায়। ফলে তার গরমের ছুটিও নেই, খাতাও নেই। তাই রাগও নেই।
তা মা দেখেশুনে যতই অবাক হয়ে গালে হাত দিক না কেন-- পিকাইয়ের রান্নার ব্যাপারটায় বাবা খুব দেড়েকষে সাপোর্ট করলেন। তিনি নিজে রান্নাটান্না কিচ্ছুটি পারেন না, ফলে কিছু স্পেশাল খাওয়ার ইচ্ছে হলে তাঁকে পিকাইয়ের মা-র দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়-- এই নাকি তাঁর ভারি দুঃখ। কাজেই তিনি সুযোগ পেয়ে খুব করে পিকাইকে বোঝালেন-- নিজে রান্না করতে পারার মানে হলো যখন খুশি, যা ইচ্ছে রেঁধে নিয়ে খাওয়া আর বন্ধুদের (মানে এক্ষেত্রে তাঁকে) খাওয়ানো। মা তেড়ে উঠলেন বটে, কিন্তু 'নিজের কাজ নিজে করে নেওয়াই তো ভাল, স্বাবলম্বী হওয়া যায়'-- এই যুক্তির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলেন না। নিমরাজি হয়ে শুধু বললেন--"খবদ্দার আগুন নিজে নিজে জ্বালাবি না!"
পিকাই নিজে আগুনে বড্ড ভয় পায়, কাজেই এ কথাটা না-বললেও চলত।
এরপর শুরু হলো পিকাইয়ের রন্ধন-উৎসব। যেটুকু সময় ছুটি পায়-- হয় মাইক্রো-ওভেনের সঙ্গে পাওয়া মস্ত মোটকা বইটা ঘাঁটছে, নাহয় ইউটিউব থেকে নতুন রান্না শিখছে। টিনটিন আর 'বুড়ো আংলা'-য় ধুলো জমে গেল, নতুন রান্নার নামে পুড়ে-যাওয়া কাবাব খেয়ে বাবার পেট খারাপ হওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু পিকাই উদ্দেশ্যে অবিচল। লাভের মধ্যে এই-- তাঁকে আর ঘন্টায় ঘন্টায় উঠে গিয়ে চা বা কফিটা করতে হচ্ছে না, পিকাই নিজেই গিয়ে জিজ্ঞেস করছে--"ও বাবা, কফি করে দিই?" বাবাও অমনি আগের কাপটা টুক করে ওর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। অবশেষে যেদিন হাফইয়ার্লি পরীক্ষার পরের দিন সকালে পিকাই নিখুঁত ধোসা বানিয়ে ফেলল-- সেদিন বাবা আর মা-- দু'জনেই একেবারে যাকে বলে হাঁ! এ যে একেবারে সত্যিকারের ধোসা গো! দোকানের মতোই খেতে হয়েছে! অবিশ্যি রান্নাঘরের অবস্থা দেখে মা-র চোখ কপালে উঠে গেল, তা ওইটুকু বাচ্চা আর কতদিক সামলাবে-- বলো দেখি! বাবা নিজেই কোমর বেঁধে সব সাফ করে ফেললেন। মা-ও খুশ হয়ে গেলেন।
হাফইয়ার্লি পরীক্ষার ক'দিন পরেই মা আর পিকাই-- দু'জনের স্কুলেই গরমের ছুটি পড়ে গেল। বাবা একা একা বেজার মুখে অফিসে যেতে লাগলেন। দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে পিকাই দেদার গল্পের বই পড়তে লাগল, আবার টি.ভি. চালিয়ে 'ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা'-ও দেখতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে চলতে লাগল হোমটাস্ক। মা খাতা দেখতে লাগলেন, আর মাঝেমাঝেই ঘুমোতে লাগলেন। বেলা দশটার পর থেকেই মা সব জানলা-দরজা বন্ধ করে দেন-- নাকি লু ঢুকবে। ফলে অন্ধকার ঘরগুলো কেমন ঝিমঝিম করে, যেন গোটা দুপুরটাই ছায়ায় ঢুকে আড়াল পেয়ে পড়ে পড়ে ঝিমোচ্ছে। রোদ্দুরের চোটে বেরুনোর সাধ্যি হচ্ছে না, নইলে এই সময় বাবলুদা-দের বাড়ির উঠোনে, লিচুগাছের ছায়ায় খাসা ক্যারাম খেলা হয়। কিন্তু একে সেখানে ভয়ানক কাঠপিঁপড়ে, তায় আবার পিকাই বড্ড ছোট বলে ওকে কেউ নিতে চায় না। কাজেই ও বসে বসে ওইসবই করে। আর ইউটিউব থেকে রান্না শেখে। বাবা বাড়িতে না-থাকলে অবিশ্যি ওর রান্নার ঝোঁক একটু কমে যায়। সমঝদার না-থাকলে গান গেয়ে লাভ কি! বিকেল পাঁচটার আগে মাঠেও যাওয়া যাচ্ছে না-- এমনি রোদের তেজ।
সেদিন একটা চমৎকার রেসিপি ঘুরছিল পিকাইয়ের মাথায়। 'চিকেন চেট্টিনাট' নামের এই খাবারটা মা করেছিল সপ্তাহ দু'এক আগেই। থালা চেটে সাদা করে ফেলেছিল পিকাই আর ওর বাবা। একটা মশলা লাগে এটা রান্না করতে, বলতে গেলে সেটাই আসল। ধনে, জিরে, গরম মশলা-- আরও কী সব মিশিয়ে, তাদের শুকনো কড়াইতে ভেজে, গুঁড়ো করে বানাতে হয় মশলাটা। সেটারই নাম হলো চেট্টিনাট মশলা। একবারে অনেকখানি বানিয়ে একটা কৌটোতে রেখে দিয়েছে মা ফ্রিজের মাথায়। বেশ, অর্ধেক কাজ তো এগিয়েই আছে। এবার পেঁয়াজ, আদা, এইসব মিক্সিতে মিক্স করে নিতে হবে। এটায় অবিশ্যি মা-র ঘুম ভেঙে যাওয়ার একটা চান্স আছে। দেখা যাবে। তারপর এগুলোকে অল্প জল দিয়ে একবার মাইক্রো-ওভেনে বসিয়ে বের করতে হবে দশ মিনিট পর। তারপর ম্যারিনেট করা চিকেন...এই রে...সেটা কোথায় পাওয়া যাবে! ও না, সকালেই তো মা ফ্রিজে রাখল ম্যারিনেট করা চিকেন, রাতে কী যেন করবে বলছিল। বা বা, সবই তো রেডি! শুধু নারকোল আর টম্যাটো...যাক গে, এ দু'টো নেই তো নেই। কারিপাতা বাড়ির উঠোনেই এন্তার হয়ে আছে-- ছিঁড়ে আনলেই হয়। বেশ! শুরু করা যাক তবে!
পা টিপে টিপে প্রথমেই পিকাই উঁকি দিল মা-র ঘরে। হাতে পেন, খাতায় মাথা দিয়ে মা ঘুমোচ্ছে। রাস্তা সাফ। দরজাটা সাবধানে ভেজিয়ে দিয়ে লম্বা করিডোর পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল পিকাই। জিনিসপত্তর জুটিয়ে নিয়ে লেগে পড়ল একা একা। আজ মা একেবারে থ' হয়ে যাবে। মাইক্রো-ওভেনে সব দু'শো গ্রামের হিসেবে টাইমার অ্যাডজাস্ট করা আছে। দু'শো গ্রাম মানে কতটা চিকেন হবে-- কে জানে বাবা! আন্দাজমতন অল্প একটু নিল। খারাপ হলে অল্পের উপর দিয়ে যাওয়াই ভাল, কম বকা খেতে হবে। তারপর রান্নায় মগ্ন হয়ে গেল পিকাই।
রান্না যখন শেষ হলো-- ততক্ষণে ও ঘেমে নেয়ে গেছে, গা দিয়ে যেন নদী বইছে। তা হোক, যা একখানা খুশবু বেরিয়েছে-- তাতেই ওর মন খুশি হয়ে গেল। তবু, বিশ্বাস নেই। প্রথমেই আঙুল ডুবিয়ে মুখে পুরে দিল ও। কী ভালো যে হয়েছে-- সে আর বলার নয়! দুটো পাউরুটি মেশিনে টোস্ট করে নিয়ে, ছোট্ট একটা বাটিতে এক পিস মাংস আর একটুখানি ঝোল নিয়ে আস্তে করে বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে বসল পিকাই। এবার আরাম করে, একটু একটু করে খাওয়া যাক। মা যখন উঠবে-- তখন ভাল করে খাবে দু'জনে, আর বাকিটা রেখে দেবে বাবার জন্য। বাবা গলা ছেড়ে সাবাস সাবাস বলে। মা নিজে দারুণ রান্না করতে পারে কিনা, তাই বলে--"আর একটু নুন দিলে পারতিস!"
তার চেয়ে বাবা-ই ভাল। কিচ্ছু পারে না, তাই সবকিছুর দেদার প্রশংসা করে। প্লাস্টিকের চেয়ারটা বাইরে টেনে এনে পা ছড়িয়ে খাওয়ার জন্য রেডি হলো পিকাই।
আর ঠিক সেই সময় গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো সমর। ওর স্কুলেই পড়ে সমর, ফাইভে। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই স্কুলে যায় না। ওর অনেকগুলো ভাই আর বোন আছে। তাদের ওকেই নাকি দেখতে হয়। ওদের বাড়িটা কাছেই, একটা রাস্তার ওপাশে। সেই বাড়িটা পিকাই চেনে, খুব ছোট আর টালির চালের বাড়ি এ পাড়ায় একটাই। ওর মা অনেক বাড়িতে কাজ করে, আর বাবা ভ্যান চালায়। আগে, যখন পিকাই সাইকেল চালাতে পারত না-- সমরের বাবা-ই পিকাইকে স্কুল থেকে নিয়ে আসত আরও তিনজন বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু সমর একা একা হেঁটে হেঁটে ফেরে। আজ বোধহয় ওর মা বাড়িতে আছে, আর ও ছুটি পেয়ে পাড়ায় ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। যাক গে, ওর সাথে পিকাই কথা বলে না। ওইটুকু ছেলের সঙ্গে আবার কথা কী! সমরও ওদের বাড়িতে ঢোকে না। ও কারুর বাড়িতেই ঢোকে না। শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে।
কিন্তু আজ সমর কোথাও যাচ্ছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিলের পাশের আমগাছটার ছায়ায়, আর তাকিয়ে আছে পিকাইয়ের দিকে। কেন এভাবে তাকিয়ে আছে ও? কিছু বলার থাকলে তো ভিতরে এলেই হয়! পিকাই তো আর বাঘ-ভাল্লুক কিছু না! এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায়? এত কষ্ট করে রাঁধল পিকাই, আর শান্তিতে খেতে পারছে না! বাইরে এসে বসাটাই ভুল হয়েছিল। কিন্তু এখন সমরকে দেখে উঠে যাওয়াটাই বা কেমন দেখায়-- বলো দেখি!
খানিকক্ষণ বাটি-রুটি হাতে নিতে চুপটি করে চেয়ারে বসে পা দোলালো পিকাই। তারপর আর থাকতে না-পেরে হাত নেড়ে সমরকে ডেকে ভিতরে আসতে বলল। মাথা নেড়ে ওখান থেকেই না করে দিল সমর। বাধ্য হয়ে চাপা গলায় পিকাই আবার ডাকল ওকে। চিল্লিয়ে ডাকতে সাহস হচ্ছে না-- মা-র ঘুম ভেঙে যাবে। এবার কেমন একটু হেসে গেট খুলে উঠোনে ঢুকল সমর, তারপর ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পা ঘষছে মাটিতে। এই প্রথম পিকাই খেয়াল করল-- ওর পায়ে চটি নেই। খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল কী করে! তারপর খেয়াল করল, সমর বারান্দায় উঠছে না। দূর থেকেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। না। ওর দিকে নয়। ওর হাতের বাটিটার দিকে। এক মুহূর্ত পরেই পিকাইয়ের সেভেনে পড়া মাথায় কথাটা ঝাঁ করে ঢুকে গেল।
সমরের খিদে পেয়েছে। নির্ঘাত ও সকাল থেকে কিছু খায়নি। ভয়ানক খিদেতে ও লজ্জা করতেও ভুলে গেছে। ছেলেমানুষ!
আরও মিনিট-খানেক স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে পিকাই বলল--"পাউরুটি খাবি?"
ঘনঘন মাথা নাড়ল সমর। খাবে না।
পিকাই বলল--"মাংস আছে।"-- বলে বাটিটা নিচু করে দেখাল ওকে।
একটা ঢোক গিলল সমর। ওর রোগা গলায় কণ্ঠার হাড়টা একবার ওঠানামা করে স্থির হলো। পিকাই এবার মৃদু তর্জনের গলায় বলল--"আয় বলছি!"
পা টেনে টেনে বারান্দায় উঠে এল সমর। তারপর হাত বাড়ালো।
ওর হাতে বাটিটা ধরিয়ে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল পিকাই।
বলল--"তুই এটা খা। আমি আর এক বাটি নিয়ে আসি। খেয়ে দ্যাখ, যা হয়েছে না! আমি নিজে রেঁধেছি!"
বলতে গিয়ে ওর গলায় ফুটে উঠল গর্বের সুর।
একটু পরে আর একটা চেয়ার টানতে টানতে ফিরে এল পিকাই। অন্য হাতে আর এক বাটি মাংস, আর খানকয়েক পাউরুটি। সমরের হাতে আরও দু'টো পাউরুটি ধরিয়ে দিয়ে ও নিজেও খেতে বসে গেল পাশেই। পা দোলাতে দোলাতে খেতে লাগল দু'জনে। পিকাই ওকে বুঝিয়ে বলছিল-- কেমন করে রাঁধতে হয় 'চিকেন চেট্টিনাট'।
সশ্রদ্ধ ভঙ্গীতে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে গোগ্রাসে খাচ্ছিল সমর। আর বারবার বলছিল--"যা দারুণ হয়েছে না পিকাইদা!"
রান্না করতে ভাল লাগে। খেতেও। কিন্তু খাওয়াতে যে এত ভাল লাগে-- তা জানাই ছিল না পিকাইয়ের!
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল
সাবাস পিকাই বাবু ☺️
ReplyDeleteআহ কত সহজ সুন্দর একটা গল্প। বড্ড বড্ড ভাল
ReplyDeleteKi j valo lagay mon ta bhore gyalo..aha!!!apurbo!!!
ReplyDeleteBhison suswadu hoechhe.
ReplyDeleteআহা! আহা!! আহা!!!
ReplyDeleteআহা! আহা!! আহা!!!
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল :)
ReplyDeleteKub shanthi pelam golpo ta pora, khaiya ato tipti pao jai ta aaj janlam
ReplyDeleteঅসম্ভব সুন্দর হয়েছে।
ReplyDeleteখুব সুন্দর গল্প, শেষটা দারুণ
ReplyDeletekheye ghumote jabar age golpoti pore j abar khide peye gelo!!
ReplyDeleteবাহ পিকাইবাবু বাহ । রান্নাটা খুব ভালো হয়েছে।
ReplyDeleteঅসাধারণ গল্প।আমার ছেলের সাথে দারুণ মিল পেলাম। ওকে বলবো এটা।
ReplyDeleteবাঙালরা খাওয়াতে ভালো বাসে, তা আমি জানি। কিন্তু সেই ভালবাসা এমন করে লেখাতেও ফোটানো...
ReplyDeleteফাটায়ে দেসেন!
কি ভালো যে লাগলো!
ReplyDeleteদারুন লাগল।
ReplyDeleteরাজাদা, এরকম অসাধারণ গল্প শুধুমাত্র আপনিই পারেন লিখতে। অপূর্ব।
ReplyDeleteবেজায় ভালো।
ReplyDeleteসুন্দর গল্প
ReplyDelete