গল্পের ঝুলি : ছুটির ঘন্টা : বিভাবসু দে




টং, টং, টং, টংটংটংটংটং...

ইয়ে, ছুটি ছুটি ! কী মজা !

হইহই করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাগুলো। পিঠে স্কুলব্যাগ। ছুটির ঘন্টা বাজলে আর এদের ধরে রাখে সাধ্যি কার ! সারাটা সকাল যেন এই ঘন্টা বাজার টানা টং-টং শব্দটা শোনার জন্যেই মুখিয়ে থাকে ওরা।

তবে বাকিদের মতো মিলির অত তাড়া নেই। ছুটি হলেও ও ধীরেসুস্থেই বেরোয়, সবার শেষে; আস্তে আস্তে নিজের ব্যাগট্যাগ সব গুছিয়ে নিয়ে। বারদুয়েক আবার দেখেও নেয় কিছু ফেলে-টেলে যাচ্ছে না তো। আসলে শুধু শুধু ওই হুড়োহুড়ি ওর একদম ভাল্লাগে না।

মিলি এবার ক্লাস ফাইভে। নেতাজী সুভাষ বিদ্যানিকেতনের মর্নিং সেকশন। পরের বছর থেকে ও দুপুরের স্কুলে চলে যাবে। ক্লাস টু-তে ভর্তি হয়েছিল এই স্কুলে, তারপর কখন যে হুশ করে তিনটে বছর পেরিয়ে গেল--- এখনও ভাবলে মনে হয় মাত্র যেন এই সেদিনের কথা।

ওদের স্কুলটা ভারী সুন্দর, অনেক পুরোনোও। ১৯৪৮-এ তৈরি। দু-দুটো মাঠ আছে। একটা ভেতরে, একটা বাইরে। বাইরের মেন-গেট দিয়ে ঢুকলে হাতের ডানপাশে পড়ে বড় মাঠটা। মাঠের গায়ে গায়ে পাকা রাস্তা, সোজা এগিয়ে গেছে স্কুলের দালানের দিকে। মিলিদের স্কুলটা দেখতে অনেকটা ওপর-খোলা চৌকো বাক্সের মতো। প্রথমেই একটা বড় লোহার গেট; ঢুকলেই ডানদিকে স্যার-দিদিমণিদের স্টাফরুম, হেড-স্যারের ঘর, অফিসঘর, লাইব্রেরি আর মিড-ডে মিলের রান্নাঘর। বাঁদিকে একটা দোতলা দালান, ওখানেই সব ক্লাস-টাস হয়। মাঝখানে চারকোণা ছোট মাঠটা। সেটা পেরিয়ে সোজা এগোলেই চোখে পড়বে নেতাজীর একটা আবক্ষ মূর্তি আর সেই মূর্তির ঠিক পেছনে সংস্কৃতি ভবন--- সকালবেলা ওখানেই প্রেয়ার-মিট হয় মিলিদের। তাছাড়া পঁচিশে বৈশাখ থেকে স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস, আগমনী, পুরস্কার বিতরণ সব অনুষ্ঠান ওই সংস্কৃতি ভবনেই। এককথায় সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট ওদের স্কুলটা।

কিন্তু এসবের মধ্যেও একজনকে বড্ড আলাদা লাগে মিলির। স্কুলের প্রথমদিন থেকে রোজ দেখে, আর রোজই অবাক হয় ও। ঘন্টা-কাকু ! হ্যাঁ, স্কুলের গ্রুপ-ডি স্টাফ প্রাণতোষবাবুকে বাচ্চারা সবাই ওই নামেই ডাকে। মিলিও।

রোগ-ছিপছিপে, লম্বাটে গড়ন, মাথায় প্রায় সব চুলই সাদা। তামাটে গায়ের রঙ, ঘিয়া শার্ট আর টেরিকটের প্যাণ্ট। শীতের দিনে তার ওপরে সোয়েটার আর কানঢাকা টুপি। খুব বেশি কথা না বললেও, মুখে সবসময় যেন একটুকরো হাসি লেগেই আছে।

মিলিদের স্কুল গরমদিনে শুরু ভোর ছ'টায় আর শীতের দিনে সাড়ে ছ'টায়, কিন্তু শীত গ্রীষ্ম নির্বিশেষে ঘন্টা-কাকু কিন্তু সবসময় সবার আগে এসে হাজির। এই তিনবছরে একদিনও ওঁকে ছুটি নিতে দেখেনি মিলি। ঘন্টা-কাকুর কি জ্বর-সর্দি কিছুই হয় না ?

রোজ নিয়ম করে সবার আগে এসে স্কুলের গেট খোলে, তারপর এক এক করে সবগুলো ক্লাসরুম, স্টাফরুম, সংস্কৃতি ভবন, সব। কিছুক্ষণ পর, যখন প্রায় সবাই এসে পড়ে, ঘন্টা-কাকু ওয়ার্নিং-এর ঘন্টা বাজায়। টং...টং...টং ! সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারা প্রতিটা ক্লাসরুম থেকে আস্তে আস্তে সার বেঁধে বেরিয়ে চলে যায় সংস্কৃতি ভবনে, প্রেয়ারের লাইনে। স্যার-দিদিমণিরাও। সবার সামনে দাঁড়ান হেড স্যার। ওয়ার্নিং-এর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ে। টং ! সবাই একসঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গায়। গান শেষ হলে আবার লাইন করে যে যার ক্লাসে। শুরু হয় পড়াশুনো। কোনওদিন একচুলও নড়চড় হয় না ঘন্টা-কাকুর ঘন্টা বাজানোয়।

মিলিদের প্রথম ক্লাসটাই হেড স্যারের, ইংরেজি পড়ান। বেজায় কড়া লোক। লম্বা, পেটানো গড়ন, টিকালো নাকের তলায় সরু গোঁফ। হেড স্যারের মুখে আজ অব্দি হাসি দেখেনি মিলি। এই ক্লাসে যেন সময় কাটতেই চায় না ওর। দু'চোখ বারবার চলে যায় ওপাশের স্টাফরুমের দিকে, যেখানে কাঠের বর্গার গায়ে ঝুলে আছে কালচে হয়ে আসা পেতলের গোল ঘন্টাটা। আর দরজার পাশে কাঠের হাতুড়ি। কখন যে ঘন্টা-কাকু আসবে, আর টং করে ঘা দেবে ওটার গায়ে ! মিলি মাঝে মাঝে ভাবে ঘন্টা-কাকুকে একদিন গিয়ে বলবে, প্রথম ক্লাসটা একটু ছোট করে দিতে। আগেভাগে ঘন্টা বাজিয়ে দিলেই তো তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ !

প্রথম ক্লাসের পর একটা ঘন্টা বাজে--- টং ! হেড স্যার বেরিয়ে যান। আসেন অঙ্কের গৌতম স্যার। এই স্যার খুব ভালো, একফোঁটা রাগ নেই। বকেন না, মারেন না, কান ধরে বেঞ্চের ওপর খাড়া করান না। কী সুন্দর করে প্রতিটা অঙ্ক ধরে ধরে বুঝিয়ে দেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসটা যে কখন ফুরিয়ে যায় টেরই পায় না মিলি। ইংরেজিটা একটু কমিয়ে বরং এই ক্লাসটা আরও লম্বা করে দিলে কী ক্ষতিটা হয় ? ঘন্টা-কাকু কেন যে বোঝে না ! ঠিক সেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই ঘন্টা বাজিয়ে দেয়--- টং-টং !


মিলি একটা জিনিস খেয়াল করেছে, ঘন্টা-কাকুর হাতে ঘড়ি নেই তবু কক্ষনও সময় ভুল হয় না ! এমনকী কোন ক্লাসের পর ক'বার ঘন্টায় ঘা পড়বে, সেটাও গুলিয়ে ফেলে না কোনওদিন। আর ছুটির ঘন্টা--- রোজ ঠিক সেই একই আওয়াজ, ঠিক একইভাবে টংটংটংটংটং ! কখনও এতটুকু এদিক-ওদিক হয় না ঘন্টা বাজানোর এই তাল। ভীষণ অবাক লাগে ওর।

মিলির মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয়, ঘন্টা-কাকু যদি কোনওদিন স্কুলে না আসে তবে কী বিপদটাই না হবে ! ইংরেজির রাগী রাগী হেড স্যার হয়তো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বদলে এক কি দেড়ঘন্টা কিংবা হয়তো গোটা দিনই ইংরেজি পড়িয়ে ফেললেন ! পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই মিলির মনে হয় ক্লাস ছেড়ে পালায়, আর আস্ত দিন ! উফ, ভাবলেও যেন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে ওর !

ঘন্টা-কাকু না থাকলে স্কুলের স্যার-দিদিমণিরাও তো বুঝবে না কার কখন ক্লাস। হয়তো অনিতা দিদিমণি সমাজবিদ্যা পড়াচ্ছেন, আর তাঁর ক্লাসের মাঝখানেই এসে ঢুকে পড়লেন বিজ্ঞানের অম্লান স্যার ! তারপরে দুজনে রীতিমত তর্কাতর্কি বেঁধে গেল যে এখন ক্লাসটা আসলে কার !

আর পরীক্ষার সময় ? কতবার এমন হয়েছে মিলি একটা প্রশ্নের উত্তর লিখছে তো লিখছেই, সময়ের হুঁশই নেই ! তখনই হঠাৎ, টং ! মানে একঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এদিকে মিলির এখনও বিস্তর বাকি--- কিন্তু হাতে আর মাত্র দুইঘন্টা। তাড়াতাড়ি যেমন-তেমন করে হাতের প্রশ্নটা শেষ করেই পরের প্রশ্নে ছুটেছে মিলি। ঘন্টা-কাকু ঘন্টা না বাজালে হয়তো ওই এক প্রশ্ন নিয়েই আড়াই ঘন্টা কাটিয়ে দিত ও !

কিন্তু ঘন্টা-কাকু না এলে সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার যেটা হবে তা হল, টংটংটংটং করে ছুটির ঘন্টাটাই তো বাজবে না ! ছুটি নেই, শুধু পড়া আর পড়া ! উফ, কী দুঃস্বপ্ন !


কিন্তু মিলি ভাবতেই পারেনি, একদিন আসলেই এই দুঃস্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাবে। সেদিন ছিল সোমবার। নভেম্বরের শেষদিক, তাই স্কুল শুরু হয় সাড়ে ছ'টায়। তবে ক্লাস আর বেশি দিন নেই, কারণ ক'দিন পর থেকেই পরীক্ষার ছুটি পড়ে যাবে। সামনেই অ্যান্যুয়াল পরীক্ষা।

তা সেদিনও স্কুলে ঢুকবার সময় ঘন্টা-কাকুকে দেখল মিলি, স্টাফরুমের দরজা খুলছে। ঘন্টা-কাকু হাসলও ওকে দেখে, সামনাসামনি পড়লে প্রায়ই যেমনটা হাসে। তারপর মিলি ব্যাগ কাঁধে রোজকার মতোই চলে গেল ওর ক্লাসে। কিছুক্ষণ পর ওয়ার্নিং, তারপর প্রেয়ারের ঘন্টা। প্রেয়ারও হল, যেমনটা হয় রোজ।

হেড স্যার এলেন, টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট একটা ইংরেজি কবিতা বোঝালেন। মিলি চার আনা বুঝল আর বাকি বারো আনা ওর মাথার ওপর দিয়ে কাগজের এরোপ্লেনের মতো হুঁই করে উড়ে চলে গেল ! ঘন্টা বাজল, টং। আহ, শান্তি ! গৌতম স্যার এলেন। স্যারের সিলেবাস শেষ, এখন শুধু রিভিশন চলছে। এসে অঙ্ক করতে দেন, আর যার যেখানে সমস্যা, বুঝিয়ে দেন। মজায় মজায় কেটে গেল আরও পঁয়তাল্লিশটা মিনিট। টংটং !

টিফিন ব্রেকের পর আরও দুটো ক্লাস। বাংলা আর বিজ্ঞান। কিন্তু আজব ব্যাপারটা ঘটল শেষ ক্লাসেই। বেশ কিছুক্ষণ পড়াবার পর অম্লান স্যার একবার ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, "সময় হয়ে গেছে, ছুটি।"

সবাই অবাক। মিলিও। ঘন্টা বাজল না যে এখনও ! স্যার বোধহয় ওদের মনের কথা বুঝেই বললেন, "আজ আসলে প্রাণতোষবাবুর চাকরির শেষ দিন। আজ থেকে ওঁর অবসর। তাই ছুটির ঘন্টা বাজানো হবে না আজকে। তোরা সবাই যাবার সময় লাইন করে স্টাফরুমের সামনে দিয়ে যাবি, প্রাণতোষবাবুকে প্রণাম করে।"

কিছুক্ষণ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেই পারল না মিলি। চাকরির শেষ দিন ! অবসর ! তবে কি ঘন্টা-কাকু আর ঘন্টা বাজাতে আসবে না ? তাহলে ক্লাস শেষ হবে কীভাবে ? প্রেয়ার, ওয়ার্নিং, ছুটি ? ঘন্টা-কাকুকে নিয়ে এতদিনের সব চিন্তাগুলো যেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একসঙ্গে ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল মিলির মাথায়। আর ক'দিন পরেই তো পরীক্ষা, তখন সময়মতো কাকু ঘন্টা না বাজালে কী করবে ও ?

"এই মিলি, চল।" তৃণার ডাকে হঠাৎ হুঁশ ফিরল মিলির, সবাই প্রায় বেরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বই-খাতা ব্যাগে ভরে সেও উঠে পড়ল। ছোট ক্লাসের বাচ্চারা চলে গেছে, এবার ওদের ক্লাস থেকে লাইন করে সবাই হেঁটে যাচ্ছে ওপাশের স্টাফরুমের দিকে। মিলি গলা বাড়িয়ে দেখল, ঘন্টা-কাকু অফিসঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে হেড স্যার। সবাই ঘন্টা-কাকুকে প্রণাম করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘন্টা-কাকুর মুখে রোজকার মতোই সেই ঝলমলে হাসি। কিন্তু একটু যেন অন্যরকম। ঠিক বুঝতে পারল না মিলি।

আজ থেকে ঘন্টা-কাকুর ছুটি ! ছুটি হলে সবাই যেমন খুশি হয়, কাকুও বোধহয় আজ তেমনি খুব খুশি। কিন্তু ঘন্টা-কাকুর কি একবারও এই স্কুল, ওই গোল ঘন্টা, কাঠের হাতুড়ির কথা মনে পড়বে না বাড়ি গিয়ে ?

মিলি এগিয়ে গেল। তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল ঘন্টা-কাকুকে, যেমনটা সবাই করছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের লাইন। কিন্তু গেটের পাশে গিয়ে হঠাৎ কেমন যেন থমকে গেল মিলি। চকচক করে উঠল ওর চোখদুটো।


সবার প্রণাম করা শেষ। প্রাণতোষবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তখন আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছেন হেড স্যার।

টং, টং, টং, টংটংটংটংটং...

চমকে পেছন ফিরলেন প্রাণতোষবাবু। সঙ্গে হেড স্যারও। বাচ্চা মেয়েটা দুইহাতে কাঠের ভারী হাতুড়িটা উঁচিয়ে ধরে ঘন্টা বাজাচ্ছে। ছুটির ঘন্টা।

প্রাণতোষবাবু এসে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালেন মিলির পাশে। মুখে হালকা হাসির রেখা। "কী গো, হঠাৎ ঘন্টা বাজাচ্ছ কেন ?"

"আজ থেকে যে তোমার ছুটি, তাই। তুমি তো সবার জন্যে বাজাও, তাই আমিও..."

কথাটা আর শেষ করতে পারল না মিলি। ওকে বুকে চেপে ধরলেন প্রাণতোষবাবু। ওর ঘন্টা-কাকু। মিলি অবাক হয়ে দেখল ঘন্টা-কাকুর সেই ঝলমলে হাসিটা একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : আবির

1 comment:

  1. এমন ঘন্টাকাকু আমাদের সবার ছিল। মনে পড়িয়ে দিলে। খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete