গল্পের ঝুলি : ইচ্ছেপূরণ : সুকন্যা দত্ত




ছুটি মানে অবসর। দৈনন্দিন একঘেয়েমি থেকে মুক্তির আশ্বাস। আর সেই ছুটির অপেক্ষায় থাকে সবাই। আসলে ছুটি থাকে মনেই, তাকে শুধু খুঁজে নিতে হয়। রিয়ার স্কুলে এখন গরমের ছুটি। কিন্তু ছুটি বললেই কি আর ছুটি হয়? পড়ার নেই কোনো ছুটি। স্কুলে হয়ত যেতে হয় না, কিন্তু একগাদা হোমটাস্কের ভিড়ে ছুটির মানেটাই যেন বদলে যায়। আর সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত ছুটির জন্য কত আশা নিয়ে বসে থাকে শিশুমন।

তবে যতই পড়ার চাপ থাকুক না কেন, রিয়ার মন কিন্তু অতটা খারাপ হচ্ছে না। তার কারণ হল- তাদের পাড়ার শিশুসাথী ক্লাবের এক অভিনব উদ্যোগ –‘ছুটি’। সময় সামনের রবিবার সকাল ৯টা। বুঝলে না তো? না বোঝারই কথা। ভাবছ, কী আর নতুন হবে? হবে রে বাবা, হবে। শুনলে তোমরা আনন্দে নেচে উঠবে। তাহলে ব্যাপারটা খুলেই বলি। পাড়াতে ৫ থেকে ১৬ বছর অব্দি যত বাচ্চা আছে তাদের নিয়ে হবে একটা ইভেন্ট। না, এই ইভেন্টে কোনো হারা-জেতা নেই। সবাই মনের আনন্দে ছুটবে। তাইতো এর নাম ‘ছুটি’। কচিকাঁচারা তো আনন্দে আত্মহারা। একে তো স্কুল ছুটি, তার ওপর ‘আয় মোরা সবাই মিলে ছুটি’। এত আনন্দ। আর কী চাই!

তবে, আর একটা ব্যাপারও আছে। তা হল- ছোটাছুটি শেষ হবার পর প্রত্যেক বাচ্চাকে বলতে হবে – ‘তারা কী শিখল আজ’।

সব মিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট ব্যাপার। রবিবার। বাচ্চারা সবাই হাজির। ঠিক করা হল যে - একটা নির্দিষ্ট রাস্তা ধরেই ছোটা হবে। রাস্তার দু’ পাশে বড়রা থাকবে, যাতে কোনো বাচ্চার অসুবিধে না হয়। বাচ্চাদের প্রত্যেককে ‘ছুটি’ লেখা একটা টি-শার্ট দেওয়া হয়েছে। বাচ্চারা সবাই স্টার্টিং লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন বাঁশি বাজবে। ও, আর একটা কথা তো বলাই হয়নি- এই ‘ছুটি’ ইভেন্টে যারা অংশগ্রহণ করবে, তাদের প্রত্যেককে একটা করে চারাগাছ দেওয়া হবে। সবুজ যাতে শিশুদের বন্ধু হয়ে ওঠে, তার জন্য এটা একটা ছোট প্রচেষ্টা।

বাঁশি বাজল। কচিকাঁচাদের দৌড় শুরু। যারা বয়সে তুলনামূলকভাবে বড়, তারা এগিয়ে গেল। খুব ছোট যারা, তারা একটু দৌড়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের বাবা-মা, অন্য বড়রা উৎসাহ দেওয়ায় তারা আবার দৌড়তে লাগল। সত্যি তো, একটু ছুটির জন্য শিশুমন কত অপেক্ষা করে। তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা তো নিয়মের বাইরেই প্রকাশ পায়। তাই এই ছুটির দিনে তাদের ছুটতে থাকা সরল, প্রাণচঞ্চল মুখগুলো সত্যি বড় আনন্দ দিচ্ছে।

রিয়াও ছুটছে। রিয়ার ক্লাস সিক্স। প্রত্যেক রবিবার পড়া না থাকলেও বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি ক্লাসেই রিয়ার সময় কেটে যায়। আজ যেন সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। কতদিন আকাশ দেখেনি রিয়া। আজ এই রাস্তায় যানবাহন বন্ধ। তাই সবাই মনের আনন্দে ছুটছে। কোনো চিন্তা নেই, কোনো মনখারাপ নেই, দু’পাশের পৃথিবী এক নিমেষে কেমন বদলে যাচ্ছে। রিয়াও প্রাণভরে ছুটছে, মাঝেমধ্যে আকাশ দেখছে। দু’পাশের গাছপালা রিয়ার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ‘সত্যি কী সুন্দর এই পৃথিবীটা! চারদিকে শুধু শান্তি। এইভাবে না ছুটলে হয়ত বুঝতেই পারতাম না- কতকিছু শেখার আছে এই পৃথিবী থেকে।‘ — রিয়ার মন বলল।

একসময় দৌড় শেষ হল। বাচ্চারা মহা খুশি। তারা আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। এবার তারা একটু বিশ্রাম নেবে। ঘন্টাখানেক পর স্টেজে এক এক করে বাচ্চাকে ডাকা হল। তারা এক এক করে বলবে তারা আজ ছুটতে ছুটতে কী দেখল। কেউ বলল - ‘আকাশ দেখেছে প্রাণভরে’, কেউ বলল – ‘গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোকিল দেখেছে’। পিংকি বলে একটা ছোট্ট মেয়ে আধো আধো স্বরে বলল- ‘আমি হনুমান দেখেছি।‘ কারোর ভালো লেগেছে পথের পাশে নাম-না-জানা ফুল, কারোর ভালো লেগেছে গোটা রাস্তাটাই। কারোর বা আবার মৃদু হাওয়া। কেউ ভালোবেসেছে আকাশ দিয়ে যাওয়া এরোপ্লেন, কোথাও দলবেঁধে খেলা শিশুর দল। এমনই কত না অনুভূতি।

বাচ্চাদের মুখে এমন গল্প শুনতে শুনতে বড়রাও কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এবার রিয়ার নাম ডাকা হল। রিয়া বলল- ‘আমি ছুটতে ছুটতে দেখলাম - সুবল জেঠুর মেয়ে দিশা  বারান্দায় চুপ করে বসে আছে। তোমরা তো জানো- দিশা ছোট থেকেই হাঁটতে পারে না। আমার ওকে দেখে খুব কষ্ট হল। আমরা কেমন ছুটছি আর দিশা পারছে না। অঙ্কনদাও তো গত বছর অ্যাক্সিডেন্টে একটা পা বাদ যাওয়ার পর আর ভালো করে হাঁটতে পারে না। অঙ্কনদাকে দেখলাম বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না? দিশা আর অঙ্কনদা চাকা লাগানো চেয়ারে বসবে আর আমরা ঠেলে ঠেলে ওদের ছোটাবো। এই ছোটার মজা তো সবার পাওয়া উচিত- তাই না?

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বড়দের সাথে ছোটরাও হৈ হৈ করে উঠল। তারপর দিশা আর অঙ্কনদাকে চেয়ারে বসিয়ে বাচ্চারা সবাই মিলে ছুটতে লাগল। হ্যাঁ, এবার বড়রাও ছিল তাদের সাথে। সবাই মিলে না ছুটলে তো বোঝাই যায় না যে, ঠিক কতটা সম্পর্ক লুকিয়ে থাকে আমাদের মধ্যে। এই যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভালোবাসা, সহানুভূতি সবকিছু নতুন করে চিনিয়ে দিল এই রাস্তাগুলো। পথে নেমে বাচ্চারা চিনল পথিক হয়ে খুঁজে নিতে হয় পথের বন্ধুকে। পথ কখনো শেষ হয় না। জীবনের অনুভূতিগুলো দিয়ে প্রতি মুহূর্তে গড়তে থাকে নতুন গল্পগাথা। পথে ছুটতে ছুটতেই ঠিক ধরতে পারা যায় চেনা মুখের থেমে থাকা অচেনা সময়গুলো। আর তাদের নতুন করে চলার আনন্দেও সামিল করা যায়। আজকের ছুটির দিনে ‘ছুটি’ শব্দের যথার্থতা সত্যিই চিনিয়ে দিল এই ছোট্ট, পবিত্র মনগুলো।

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : আবির



No comments:

Post a Comment