ছোটোবেলায় খুব মজার একটা জায়গা ছিল মামারবাড়ি। আমার মামারবাড়িটা ছিল শহর থেকে দূরে বেশ সুন্দর একটা জায়গায়। চারদিকে গাছগাছালি আর ঝিল থাকার জন্য নানারকম পাখিদের আনাগোনা ছিল। গরমের ছুটি আর শীতের ছুটিতে চলে যেতাম মায়ের সঙ্গে। মামারবাড়িতে থাকত দাদু আর দিদা। আর কয়েকজন পরিচারক। আমার খুব প্রিয় জায়গা ছিল বাড়ির লাগোয়া ছোট একটা পুরানো শিবমন্দির আর বিশাল একটা চাঁপা গাছ। মন্দিরের পেছনেই ঝিল ছিল। শিবরাত্রি আর নীলের দিন বেশ ভিড় হতো। আমার মা আর দিদাও উপোস করে জল ঢালতো শিবের মাথায়। দিদা বলত ব্রহ্মদত্যির গল্প যে শিবমন্দিরে ভোর বেলায় পুজো দিতে আসে।
" কেন ভোরবেলায় ঘণ্টার আওয়াজ পাসনি?"
ঢং ঢং করে ভোর রাতে ঘণ্টার আওয়াজ শুনেছি তবে সেটা ব্রহ্মদত্যির পুজো করা বলে মানতে পারিনি। আমি আবার এসব বিশ্বাস করতাম না। দিদা আরও বলত এই ব্রহ্মদত্যি ছিল আমার দাদুরই এক পূর্বপুরুষ। চারশ' বছর আগে এই বংশের একটি ছেলে মারা যায় পৈতে হবার পর পর। উপনয়নের সময় নাকি একটা আলাদা ঘরে তিনদিন থাকতে হয়। তা ছেলেটি মারা যাবার পর ব্রহ্মদত্যি হয়। এখনও তার মুক্তি হয়নি। সে এই বংশের সবাইকে খুব ভালবাসে। কেউ বিপদে পড়লে সেই আত্মা নাকি তাকে রক্ষা করে। আমি গল্প শুনি কিন্তু মানি না। এখনকার দিনে কেই বা এসব মানে! আমার বন্ধুরা শুনে ঠোঁট উল্টোয়। আমার এই পুরানো বাড়ি কড়ি বরগার ছাদ খড়খড়ির জানলা দালান জীর্ণ শিবমন্দির আর ঝিল আমবাগান দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক খুব ভাল লাগতো। ছুটিতে কোথাও যেতে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করতো না। এই বাড়ির মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম। একদিন ঘটে গেল এক অঘটন। দুপুরে দিদা আর মা ঘুমাচ্ছিল বড় দোতলার ঘরে। দাদু বাড়ি ছিলেন না। চাকরবাকর সবাই একতলায় ঘুমাতো। বাড়ি এত ঠান্ডা ছিল এসি লাগাবার কথা ভাবতেই পারত না কেউ। শীতেও তেমনই ঠান্ডা লাগতো। আমি শিবমন্দির ঘুরে ঝিলের কাছে এলাম। সাদা সাদা বক আর পানকৌড়ি দেখা যাচ্ছে। শীতে প্রচুর পাখি আসে এখানে।
বাতাবিলেবু ফুলের মিষ্টি গন্ধ আসছে হাওয়ায়। আমি জলে নামলাম। সাঁতার না জেনেও নামলাম। জানি না কেন এমন দুঃসাহস হল। কখন যে শেষ ধাপে পা দিয়েছি বুঝতে পারিনি। পা পিছলে জলে পড়ে যাই। ধরার কিছু নেই। জল ঢুকছে নাক মুখ দিয়ে। জ্ঞান হারিয়ে যেতে বসেছে। জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছি ঠিক তখনই মনে হল কেউ মাথার চুল ধরে আমায় পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। যখন জ্ঞান হল দেখলাম শিবমন্দিরের মধ্যে বসে আছি। কে আমায় বাঁচালো বুঝতে পারলাম না। বাড়িতে যখন আসি তখন সন্ধে হচ্ছে। দিদা চা করেছে। দাদু ফিরে এসেছে। আহ সেই সব দিন খুব মজার ছিল! দিদার হাতের চা খুব ভাল লাগতো। আর কারোর চা এত ভাল লাগে না।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। দাদু দিদা কেউ নেই। মায়েরও বয়স হয়েছে। আমিও চশমা পরা এক বুড়ো। মাথা ভর্তি টাক। অঙ্ক করাই স্কুলে। ভূত ভগবান অলৌকিকে অবিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হয়েছে। মা আর যাতায়াত বেশি করতে পারেন না। এখনও ছুটি পড়ে তবে এই ছুটি অন্যরকম। মামাহীন মামারবাড়িতে একদিন এলাম কোনও এক ছুটির দিনে। কালীপুজোর আগের দিন ছিল। এখন দুজন কাজ করে এখানে। অর্থাৎ দেখাশোনা করে। বাড়িটা বিক্রি করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু শেষ অব্দি বেচেই দিতে হবে। বাড়ির কিছু শরিক আছে যারা বিদেশে থাকে। শিবমন্দির আছে বলেই বাড়ি বিক্রি করার কথা কেউ ভাবতে পারি না। ব্রহ্মদত্যির কথাটাও এরা সবাই বিশ্বাস করে। এখানে মাঝে মাঝেই আসি। এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। প্রচুর দোকানপাট হয়েছে। মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকে আট থেকে আশি। দেখলেও বিরক্ত লাগে। ঘুঘুর ডাক অনেক কমে গেছে। চড়াই শ্যামা দোয়েল ফিঙে সবাই এখান থেকে চলে গেছে। গাছগাছালি নেই। বহুতল বাড়ি উঠছে। পুকুর বুজিয়ে কিছু ফ্ল্যাট হয়েছে। ঝিল এখন অনেক কমে গেছে আয়তনে আর পাখি আসাও বন্ধ হয়েছে। শহরের হাত থেকে কারোর নিস্তার নেই।
আমি এখানে এসে আর সেই আগেকার আনন্দ পাই না। তবু ঝিল আর শিবমন্দির ভালই লাগে। এইবার যেদিন এলাম কালীপুজোর আগের দিন ছিল। দোতলার একটা ঘর পরিষ্কার করাই থাকে। কেয়ারটেকার হরি আর ওর বৌ কমলা সব গুছিয়ে রাখে। রান্নাও করে দেয়। চোদ্দ প্রদীপ দিয়ে ঘর সাজালো কমলা সন্ধেবেলায়। মন্দির আলোয় সেজে উঠেছে। রাতে শোবার সময় কিছু ম্যাগাজিন নিয়ে শুতে গেলাম। কারেন্ট চলে গেল। কার্তিক মাস হলেও বেশ গুমোট। মাথার কাছে জানলা একটা খুলে দিলাম। বাইরে ঘন অন্ধকার। ঠান্ডা হাওয়ার ঝলকে ঘুম এসে গেছিল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি ঠিক জানি না, ঘুমটা ভেঙ্গে গেল মশার বিন বিন আওয়াজে। কারেন্ট এখনও আসেনি অথবা এসে চলে গেছে। বাইরের হাওয়া বেশ ঠান্ডা। জানলা দিয়ে হাওয়ার দাপটের সঙ্গে ভেতরে ঢুকল একটা কাগজের টুকরো। অদ্ভুতভাবে সেটা নাচছে। আমি কখনও এরকম সাদা কাগজের নাচ দেখিনি। নাচছে এমন ভাবে যেন বাতাসে পাক খাচ্ছে। দুলতে দুলতে দরজার দিকে চলে গেল। এই নাচ দেখতে দেখতে আমি কেমন হয়ে গেলাম। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম কাগজের টুকরোটা। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছিলাম। আর সেই কারণেই জেদ বেড়ে যাচ্ছিল। দরজার ছিটকিনি খুলতেই কাগজের টুকরোটা বেরিয়ে গেল বাইরে। হাওয়ায় স্থির ভাবে ভেসে রইল কয়েক সেকেণ্ড। আবার নাচতে শুরু করল। আমায় যেন ছেলেমানুষিতে পেয়েছে। ছুটে ধরতে গেলাম। কাগজটা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে আমিও ছুটছি। বাইরের দরজা খুলে বাইরে চলে এসেছি। একসময় মনে হল কেউ আমার একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। আমার সম্বিত ফিরতে দেখি আরেকটু হলে ঝিলের জলে নেমে পড়েছিলাম।
সেই কাগজের টুকরোটা এখন স্থির হয়ে ভেসে আছে। নিস্ফল আক্রোশে জ্বলছে। আর আমার হাত ধরে যে পিছনদিকে টানছে তার কুয়াশার মতন সাদা আবছা মূর্তি ফুটে উঠেছে। মাথায় টিকি পায়ে খড়ম পরা এক বালব্রহ্মচারী মূর্তি বাতাস কেটে এগিয়ে চলেছে। মাটিতে তার পা পড়ছে না। আমিও শূন্যে ভেসে চলেছি। শিবমন্দিরের ভেতর সে প্রবেশ করল। আমাকে একপাশে বসিয়ে সে পুজো শুরু করল ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে। স্তোত্রপাঠ করতে লাগল জলদগম্ভীর স্বরে। আমি হাতজোড় করে পুজো দেখতে লাগলাম।
পরের দিন যখন ঘুম ভাঙলো দেখলাম আমি মন্দিরের ভেতর শুয়ে আছি। ঘুমের মধ্যে হাঁটার রোগ তো আমার ছিল না। কাল যা দেখেছি তা নিশ্চয় স্বপ্ন নয়। আমার প্যান্টের পায়ের কাছে কাদা লেগে আছে। কাল ঝিলের জলে সত্যি নামতে যাচ্ছিলাম। রক্ষা করেছেন সেই ইশ্বর। যাকে বিশ্বাস করতাম না।
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : আবির
অলঙ্করণ : আবির
No comments:
Post a Comment