ছুটির সাথে পরিশ্রমের এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়লেই ছুটির কথা বেশি করে মনে পড়ে। অলস ব্যক্তির ছুটির প্রয়োজন হয় না। সব সময়েই সে ছুটিতে। কাজের কথা বললেই তার শরীর জুড়ে আলস্য। বিছানায় শুয়ে বসে, বা মোবাইলে গান শুনে, কিম্বা সিনেমা দেখে সে নিরবিচ্ছিন্ন ছুটি উপভোগ করে। কিন্তু ছুটির আসল মজাটা তার আর পাওয়া হয়ে ওঠে না। সপ্তাহান্তে ব্যস্ত কাজের দিনগুলো ফুরিয়ে গেলেই ছুটি খুব দামী হয়ে ওঠে। তখন মন সেই ছুটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়।
হাজার হাজার বছর আগে মানুষ যখন জঙ্গলবাসী ছিল, তখন ছুটির কথা খুব সম্ভব তার মাথায় আসত না। পেট চালানোর তাগিদে সে বনের পশুদের পিছনে তাড়া করে শিকার ধরত। শিকার করা পশুর মাংস কেটে খাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা ছিল আর এক শ্রমসাধ্য কাজ। তারপর শুরু হল কৃষিভিত্তিক যৌথ জীবন যাপন। সে জীবনেও ছিল অনেক পরিশ্রম।
কৃষিভিত্তিক যৌথ জীবন যাপন করতে করতে একদল মানুষের হাতে অতিরিক্ত শস্য ভাণ্ডার জমা হতে লাগল। সমাজে তাদের প্রতিপত্তি বাড়তে লাগল। তারাই সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে ছোট ছোট রাজ্য তৈরি করে শাসন করতে লাগল। শস্য ছাড়া অন্যান্য সম্পদ সৃষ্টি করল মানুষ — যেমন সোনা, রুপো ও হীরে। সেই সব সম্পদের অধিকারী হল রাজা ও অমাত্যেরা। রাজ্যের প্রজারা চাষ আবাদ করে তার এক অংশ রাজাকে দিত খাজনা হিসাবে। এই খাজনা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রজা রাজার কাছ থেকে সুরক্ষা আশা করত। রাজার সেনাবাহিনী সেই সুরক্ষা দিত প্রজাদের।
ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী শাসকেরা লোভী হয়ে উঠল। যে সব রাজাদের সাম্রাজ্য বিশাল ছিল, সৈন্যবাহিনী, লোক-লস্কর, ঠাট-বাট বজায় রাখার জন্য তাদের অনেক অনেক সম্পদের প্রয়োজন হল। রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের অত্যাচার করে রাজস্ব আদায় করা হত। প্রজাদের মধ্যে ছিল কৃষক, পুরোহিত, সৈন্য ও কারিগর। নানাভাবে তাদের উপর চাপ দিয়ে কাজ করানো হত। কাজের কোনও নির্দিষ্ট বাঁধাধরা সময় ছিল না। আরও বেশি সম্পদ সৃষ্টি করবার জন্য দিনের বেশির ভাগ সময় মেহনতি মানুষেরা শাসকের স্বার্থে বেশি সময় কাজ করেই কাটাত। তখনো সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ছুটির দাবি নিয়ে রাজার বিরুদ্ধাচরণ করবার কথা মানুষ ভাবতেও পারত না। যদি কেউ সেই সাহস করে রাজা বা তার অমাত্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসত, বিচারে তার প্রাণদণ্ড হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার ভয়ে কেউ মুখ খুলত না।
মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পৃথিবী পা রাখে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে যোগদান করে শিল্প। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পালে সহসা প্রবল হাওয়া লাগে। নতুন নতুন আবিষ্কারের হিড়িক পড়ে যায় পৃথিবীর অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশগুলিতে— যেমন আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝ পর্যন্ত সময়ে ঘটে গেল শিল্প-বিপ্লব। কৃষিকাজে সম্পদ জমা হতে সময় লাগত। কিন্তু শিল্পের উন্নতির ফলে অত্যন্ত দ্রুত সম্পদ সৃষ্টি হতে লাগল সমাজে। এর ফলে একশ্রেণীর মানুষের হাতে অজস্র সম্পদ জমা হতে লাগল। অপরদিকে শিল্পে যে সমস্ত শ্রমিক জড়িত ছিল তারা আরও গরিব হতে থাকল। আরও বেশি সম্পদ লাভের আশায় মালিকেদের অধিকাংশই শ্রমিকদের দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে নিতে লাগল। অতিরিক্ত শ্রমের কারণে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনধারণের মান হয়ে গেল অনেক নিম্ন মানের। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে দেখা দিল অসন্তোষ।
১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকাতে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে দিনে আট ঘণ্টার কাজের দাবীতে এক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করার পর একদিনের ছুটির দাবীতে প্রায় চার লক্ষ শ্রমিক এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। চৌঠা মে শ্রমিকদের একটি দল শান্তিপূর্ণ সভা করে হে মার্কেট স্কোয়ারে। ভিড়ের মধ্যে কেউ পুলিশকে লক্ষ করে বোমা ছোঁড়ে এবং ছ’জন পুলিশ ঘটনাস্থলে মারা যায়। এই ঘটনার সাথে সাথে পুলিশ ধর্মঘটী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। ফলে বেশ কিছু শ্রমিকের মৃত্যু হয়, অনেকেই গুরুতরভাবে আহত হন। আমেরিকার ইতিহাসে এই ঘটনা ‘হে মার্কেট বিপর্যয়’ বলে কুখ্যাত।
হে মার্কেট ঘটনায় প্রচুর শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। চারজন শ্রমিক নেতার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে শ্রমিকেরা আরও একত্রিত হয়। বহু সংগ্রামের পর, ১৮৮৮ সালে আমেরিকায় শ্রমিকদের আট ঘণ্টার কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শ্রমিকদের দিনে আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন ও আট ঘণ্টা বিশ্রামের মঞ্জুরি দিয়ে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ক্রমশ অন্যান্য দেশও শ্রমিকদের এই অধিকারের আইন করে স্বীকৃতি দেয়।
ছুটির প্রয়োজনীয়তা মানুষ কবে থেকে বুঝতে পেরেছে, সে বিষয়ে সঠিক সাল তামামি বলা মুশকিল। কৃষিজীবী মানুষ ফসল ঘরে তোলার পর আনন্দ উৎসব পালন করত, সেকথা আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশে যেমন আসামে বিহু, পাঞ্জাবে লোহড়ি ও বৈশাখী, দক্ষিণ ভারতে ওনাম এবং পশ্চিমবঙ্গে ও উত্তর ভারতে মকর সংক্রান্তি পালন করা শুরু হয় ফসল কাটার উৎসব উপলক্ষে। এই উৎসবগুলিতে নাচ গান, খাওয়া দাওয়া, পরিবার পরিজনের সাথে সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন রীতি রেওয়াজের প্রচলন দেখে বোঝা যায়, এই উৎসব অতি প্রাচীন।
একটানা কাজের একঘেয়েমি মানুষের শরীর ও মন দুটির উপরে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি বিরামহীন কাজের ফলে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। সপ্তাহান্তে ছুটিই হোক, বা গ্রীষ্ম ও শীতকালীন ছুটি, মানুষের মন আবার নতুন উদ্যম নিয়ে কাজে যোগ দিতে উৎসাহ পায়। কিন্তু কেবলমাত্র আলস্যে ছুটি অতিবাহিত করলে তার কোনও ফল লাভই হয় না।
No comments:
Post a Comment