বিবিধ নিবন্ধ : খেলা যখন জীবন : অনিন্দ্য রাউৎ





ফুলব্যাকে খেলার সুবিধা হলো, উঠে গোলের দুর্দান্ত পাস দেওয়া বা গোলও করা যায় আবার নেমে এসে বিপক্ষের উইঙ্গার বা স্ট্রাইকারের পা থেকে বল কেড়েও নেওয়া যায়। দুইদিকেই সমান মজা, সমান গুরুদায়িত্ব, সমান চ্যালেঞ্জ। ব্যাপারটা কঠিন, কিন্তু এটাই আমার করতে ভালো লাগে।

এখন যেমন পেছন থেকে দৌড়ে এসে সামনে এগোতে থাকা বিপক্ষ দলের প্লেয়ারের পা থেকে বলটা ছোঁ করে ছিনিয়ে আমি এগোতে থাকলাম সাইডলাইন ধরে উল্টোদিকে। বলের দিকে দৃষ্টি রেখেও বুঝছিলাম মাঝবরাবর মিত উঠছে। আমি মাঝমাঠ পেরিয়ে বলটা চিপ করে তুলে দিলাম, বলটা বিপক্ষ প্লেয়ারদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে পড়লো মিত-এর কাছে, মিত অনায়াস দক্ষতায় বলটা বুক দিয়ে রিসিভ করে মাটিতে পড়তে না দিয়েই থ্রু দিলো রোহনকে। রোহন ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখলাম ও পড়ে গেলো মাটিতে। ঠিক কি হয়েছে বুঝলাম না, তবে সেন্সগুলো ঠিক কাজ করে এ সময়ে। তাই চেঁচিয়ে উঠলাম, “ফাউল … ফাউল … পেনাল্টি … পেনাল্টি" বলে।

আমার মতো আরো সবাই চিৎকার করে উঠেছে। রেফারি দেখলাম কনভিন্সড। পেনাল্টির নির্দেশ দিল। আমরা সবাই ছুটে গেলাম বক্সের কাছে। দাঁড়ালাম বক্সের লাইন বরাবর, ওদের ডিফেন্ডাররাও দাঁড়িয়ে। রোহন বল হাতে নিয়ে বসালো পেনাল্টি স্পটে। ওদের গোলকিপার বিশ্ব আমার স্কুলের বন্ধু, শুধু অন্য পাড়ায় থাকে। দেখলাম ওর চোখ স্থির, কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। রোহন এগোলো, খুব জোরে শট নিলো গোলের ডান দিকে কোণ বরাবর। বিশ্ব শরীর ছুঁড়ে দিয়ে পুরোটা হাত বাড়িয়েও বলের নাগাল পেলো না। বল জড়িয়ে গেল জালে। খুব ভালো শট। আমরা উৎফুল্ল হয়ে জড়িয়ে ধরলাম একে অপরকে। রেফারির বাঁশি বাজলো আর কিছুক্ষণ পরেই। হইহই করে উঠলাম সবাই। ম্যাচ জিতে গেছি, রোহনের করা একমাত্র গোলে। খুব আনন্দ হচ্ছে। নূতন সংঘের সঙ্গে এই ম্যাচ হওয়ার কথা অনেকদিন থেকে হচ্ছিল। অপেক্ষায় তেতে ছিল সবাই। আজকের জয় তাই অন্যতম ভালোলাগা।

মাঠ থেকে বেরিয়ে কিটস গুছিয়ে ক্লাবঘরের দিকে যখন যাচ্ছি তখনও রাজাদাকে দেখতে পেলাম না। রাজাদা আমাদের গাইড করে। কোচই বলা যায়। আজ খেলা চলাকালীন অনেককিছুই বলছিলো কিন্তু শেষ হতেই দেখি আর নেই। হয়তো ক্লাবেই আছে। সবাই সেদিকেই যাচ্ছে।
ক্লাবে ঢুকতেই দেখি টিভিতে একটা ম্যাচ চলছে। কিছুক্ষণ দেখেই বুঝলাম কোন ম্যাচ।

জার্মানির ক্লিন্সম্যানের ডাইভ, অন্যায্য রেডকার্ড দেখেন আর্জেন্টিনার মনজন

দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায়। কী অন্যায়ভাবেই না পেনাল্টি দিয়ে জার্মানিকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ! আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে দেখে খারাপ লাগেই। ক্লাবে এরকম অনেক পুরনো ম্যাচের সিডি থাকে। তবে আজ রাজাদা হঠাৎ মাঠ ছেড়ে তাড়াতাড়ি এসে এই ম্যাচ দেখছে কেন? আমার রাগই হলো।
“রাজাদা, হঠাৎ এই ম্যাচটা কেন? খুব বাজে ম্যাচ এটা। ক্লিনসম্যান কেমন হলিউড অভিনেতার মতো পড়ে গিয়ে মনজন কে রেড কার্ড দেখানোর ব্যবস্থা করলেন, তারপর আবার ভলারের নাটক করে ডাইভ মারা আর জার্মানির পেনাল্টি পাওয়া। এরকম জঘন্য ফাইনাল আর হয়নি।”
১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল

রাজাদা টিভি থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে তাকালো। ততক্ষণে মিত, অভি, সান, দ্বীপ, আবির, শুভদা, রোহন আর বাকিরা জার্সি খুলে বসে পড়েছে এদিক ওদিক।
“ খারাপ লাগছে তোর? তোদের সবার বুঝি খারাপ লাগছে? ”
মিত বললো, “ হ্যাঁ, ভুল জিনিস খারাপ লাগবে না?”
“ তাহলে আজ যখন রোহন নিজে অভিনয় করে পড়ে গেল তখন পেনাল্টির দাবিতে গলা ফাটালি কেন?”

আমার দূর থেকে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ঐ মুহূর্তে পেনাল্টি চাইবো না? যেখানে হারানোর সুযোগ … নিজের কথা নিজেরই মনে বাধলো। আবার আমিই আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায় নিয়ে বলছিলাম? চুপ করে থাকলাম।

রাজাদা বললো, “ শোন, জানি অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েছিস নূতন সংঘের সঙ্গে খেলার, আগেরবারের হারের বদলা নেওয়ার। কিন্তু মাঠে পা দিলে আসল যেটা মাথায় রাখা উচিত সেটা হলো স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। ব্যাপারটা সবাই আমরা মুখে বলি কিন্তু কেউ প্র্যাকটিস করি না। সেটাই সবচেয়ে হতাশাজনক। আর নিজেরা না করলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কী করে শেখাবো? নিজের মনের প্রতি সৎ থেকে খেলা। অভ্যাস করলে খুব সহজ, দেখবি। আজ তোদের কিছু ঘটনা বলি। কিছু তোদের জানা আর কিছু অজানা। তাহলে হয়তো আরও ভালো করে বুঝবি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সঠিকভাবে খেলা, পারলে তোরাও বাকিদের বলিস।

১৯৩৪ সালে যখন বিশ্বকাপের আয়োজন ইউরোপে এলো তখন ইউরোপে টালমাটাল অবস্থা। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে খেলা সবটাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো। এই বিশ্বকাপেই কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আয়োজক দেশ ইতালি এবং স্পেন।

সেই প্রথমবার সবার সামনে এসে পড়ে ফুটবলের নোংরা দিক। ভীষণরকমের মারামারি চলে দুই দেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে। রেফারির ভূমিকা ছিল নগণ্য। কিংবদন্তী গোলকিপার রিকার্ডো জামোরা, যাঁর নামে স্প্যানিশ লিগে এখন বেস্ট গোলকিপারকে ‘জামোরা ট্রফি’ দেওয়া হয়, তিনি গুরুতর আহত হন ইতালির গোলের সময়। অনেক খেলোয়াড়কেই সেদিন স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে হয় এবং এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইতালির মারিও পিজ্জিওলো। তাঁর পা ভেঙে যাওয়ায় তাঁকে মাঠ ছাড়তে হয় এবং দুর্ভাগ্যবশত তিনি জীবনে আর কোনোদিনই খেলতে পারেননি। কী খারাপ, তাই না?
সেদিনের ঐ ম্যাচ ড্র হয়। তখন এখনকার মতো অতিরিক্ত সময়ে খেলা বা পেনাল্টি শুটআউট হতো না। তাই ইতালি এবং স্পেনের মধ্যে আবার ম্যাচ হলো এবং এই ম্যাচেও চললো মারামারি। শেষ অব্দি ইতালি ১-০ এ জিতে যায় স্পেনের রিকার্ডো জামোরার অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে। রাজনীতির প্রভাব মাঠে বা মাঠে খেলার প্রভাব রাজনীতিতে পড়েছিল কি না জানি না, তবে স্পেন - ইতালির মধ্যে সম্পর্কেও অস্থিরতা বেড়েছিল এরপর। এই একই বিশ্বকাপে রেফারির বিরুদ্ধে ইতালিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অনেক অভিযোগও উঠেছিল।

এটা গেল ১৯৩৪, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে আবার বিশ্বকাপ হয়। প্রায় প্রতি টুর্নামেন্টেই কিছু কিছু ম্যাচে মারামারি, বাজে রেফারিং, দর্শকদের মধ্যে হাতাহাতি ঠিক হয়েছিল। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখা যায় ১৯৬২ চিলি বিশ্বকাপে। সেই বছর যখন বিশ্বকাপ চিলিতে অনুষ্ঠিত হয় তখন ইউরোপের অনেক দেশেরই তা পছন্দ হয়নি, আর হয়তো সবার আগে নাম ছিল ইতালির। ইতালির সাংবাদিকরা চিলিকে এবং তার মানুষদের গরিব, অপুষ্টিতে ভোগা, নিরক্ষর, আবর্জনা, আস্তাকুঁড়ের দেশ বলে অভিহিত করেছিল। চিলির মানুষরা এটাকে একদমই ঠিকভাবে নেয়নি। তারাও ইতালিকে নানা বাক্যবাণে আক্রমণ করে।
বিশ্বকাপ ১৯৬২, চিলি - ইতালি ম্যাচ

সান্তিয়াগোতে যখন ম্যাচ শুরু হয় এই দুই দেশের মধ্যে তখন উত্তেজনা চরমে। ভাবতে পারবি না তোরা, প্লেয়াররা একে অপরকে ঘুষি, লাথি, ল্যাং, কনুই দিয়ে মারা, পায়ে পাড়া দেওয়া সব করেছিলেন, আর করেছিলেন বড় খোলাখুলি। চিলির প্লেয়ার লিওনেল স্যাঞ্চেজ ইতালির মারিও ডেভিডকে ঘুষি মারেন এবং তা রেফারির নজর এড়িয়ে যায়, ডেভিড কিছু মিনিট পর স্যাঞ্চেজের মুখে লাথি মারতে যান এবং রেফারি দেখতে পেয়ে ডেভিডকে মাঠ থেকে বের করে দেন। যদিও ডেভিড লাথিটা মিস করেছিলেন। এর আগেও ইতালির আরেক খেলোয়াড়কে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। মারামারি এমনই পর্যায়ে যায় যে সবাইকে সামলানোর জন্য পুলিশকে তিন-তিনবার মাঠে নামতে হয়। ভাব শুধু! এটা বিশ্বকাপের ফুটবল ম্যাচ?

আচ্ছা, তোদের সেই ঘটনাটা বলেছিলাম যখন অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি নিজেদের মধ্যে আক্রমণহীন, বোরিং ফুটবল খেলে দুই টিমই নিজেদের পরের রাউন্ডে ওঠা নিশ্চিত করেছিল?”

অভি বলে উঠলো, “ না রাজাদা। জানি না তো ? কি ব্যাপার?”

“১৯৮২ বিশ্বকাপে গ্রুপ স্টেজে অস্ট্রিয়া-জার্মানি ম্যাচের আগেই অস্ট্রিয়া কোয়ালিফাই করে গিয়েছিল পরের রাউন্ডে। অপরদিকে জার্মানির ওঠা অনিশ্চিত ছিল কারণ আলজেরিয়া ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল। জার্মানির হার বা ড্র মানে জার্মানি বেরিয়ে যায় বিশ্বকাপ থেকে এবং আলজেরিয়া কোয়ালিফাই করে পরের রাউন্ডে। কিন্তু সন্দেহ করা হয় দুই টিম নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিজেদের ওঠা নিশ্চিত করেছিল, ফলস্বরূপ এক জঘন্য বোরিং ফুটবল ম্যাচ দেখে দুই দেশের দর্শকরা।
১৯৮২ বিশ্বকাপ - জার্মানি-অস্ট্রিয়া ম্যাচ

দুই দেশের দর্শকরাই এই ধারহীন ম্যাচ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা ভেবেছিল ১৯৭৮ এর মতোই দারুণ একটা ম্যাচ হবে। কিন্তু কিছুই হয় না,সারা ম্যাচ জুড়ে চলে ব্যাকপাস, মাঝমাঠে পাস। জার্মানি ১-০ গোলে জিতে যায়। জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া দুই টিমই তাই কোয়ালিফাই করে। তোরা একবার ভাব আলজেরিয়ার অবস্থা! ঐ দেশের মানুষদের কীরকম লেগেছিল! আলজেরিয়ার মানুষরা ঐ ম্যাচকে “শেম অফ গিয়ন” নামে পরিচিতি দেয়। এটাও কিন্তু স্পোর্টসম্যান সুলভ আচরণ নয়। ফিফার দুই দেশের বিরুদ্ধে কিছু স্টেপ নেওয়া উচিত ছিল। কাউকে হারানোর জন্য অন্য কোনো টিমকে জিতিয়ে দেওয়া খুব ন্যক্কারজনক। যাইহোক, আর তারপর ১৯৯০ তে জার্মানির এই প্লে অ্যাকটিং করে জিতে যাওয়া।”

“সে তো মারাদোনাও হাত দিয়ে গোল করেছিলেন।” শুভদা বলে ওঠে।


মারাদোনার 'হ্যান্ড অফ গড'

“আমি সেটাও সমর্থন করি না শুভ। খুবই বাজে করেছিলেন। বা যখন মারাদোনা ড্রাগ টেস্টে পাশ করতে পারেননি, যতই তা বিতর্কের বিষয় হোক, যা আজ অব্দি প্রমাণিত তাতে মারাদোনার এই আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। বা সুয়ারেজের চেলিনিকে কামড়ে দেওয়া, সবই খুব অন্যায়।”

“ আর জিদানের ঢুঁসো?” রোহন বলে উঠলো।

২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল, জিদানের হঠকারিতা

“ হ্যাঁ। ফুটবল মাঠে যখন নামি তখন অনেক অনুভূতি বাইরে রেখে আসা শ্রেয়। হ্যাঁ, আমরা মানুষ, তাই আবেগ দিয়ে কাজ করি, ভালোবাসি, খেলি। কিন্তু মাঠে মাথাটাকে শান্ত রাখতেই হয়, উচিত। সবাই চায় খারাপটা করতে, কিন্তু সেই প্ররোচনায় আমরা পা দেবো না বা সতীর্থদেরও বোঝাবো যাতে না দেয়। জিদান হয়তো সারাজীবন আফশোস করেছেন ঐ গুঁতো দেওয়ার পর। নাহলে কে বলতে পারে ফ্রান্স দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ পেতো না?"

“ সত্যিই কী অদ্ভুত। কি থেকে কী হয়ে যায়! এত বড় স্টারের কেরিয়ার শেষ হয় এইভাবে! ভাবা যায়?”

“হয়তো হ্যাঁ, ভাবা যায়। আমরা মানুষ। সমস্ত ইমোশনকে কন্ট্রোল করে কিছু করা আমাদের সহজাত নয়। বরং অনুভূতি মিশিয়ে কিছু করলেই সেই কাজ আমরা ভালোভাবে করতে পারি। শুধু দেখতে হবে অনুভূতি আমায় বিপথে চালিত করছে না তো? মানুষ প্রথম যখন খেলা শুরু করে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল শরীর ও মন সুস্থ রাখা। তারপর আসে প্রতিযোগিতা, জিতলে পুরস্কৃত করবার প্রথা। লড়ে জেতার প্রবণতা সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষের মজ্জাগত। তাই প্রতিযোগিতাহীন কোনো খেলা মানুষদের ভালো লাগেনি। তবে এই অব্দিও কিছু খারাপ ছিল না। খারাপ শুরু হলো তখনই যখন মানুষ জেতার নেশায় পাগল হয়ে অপর দলের প্রতি অন্যায় আচরণ শুরু করলো। হ্যাঁ, খেলায় জেতাটা আমাদের লক্ষ্য কিন্তু তার থেকেও বড় লক্ষ্য মানবিকতা বজায় রাখা।

এই পৃথিবীতে সবার সমান অধিকার। শুধু কোনোভাবে আমি বেশি সুবিধা পেয়েছি মানে এই নয় যে আমি অন্যদের হেয় করবো, তাদের বেড়ে উঠতে দেবো না। বাইরের জগতে এই অন্যায় প্রায় দেখা গেলেও খেলায় এ ঘটনা নিন্দার অযোগ্য। হ্যাঁ, ফুটবল খেলায় বডি কন্ট্যাক্টস থাকবেই। বল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য ট্যাকল হবেই। কিন্তু খেয়াল সেটুকু রাখতে হবে যে সেই ট্যাকল, সেই চেষ্টা যেন কোনোভাবে ইচ্ছাকৃত আঘাতের জন্য না হয়। আমাদের মন টের পায় ঠিক দেখবি, ইচ্ছাকৃত কিছু করার আগেই আমাদের মন সেটা টের পায়।
আজ যখন রোহন নিজে ডাইভ মারলো ও জানতো ও ভুলটা করছে? তাই না রোহন?”

রোহন মাথা নিচু করে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো।

“সেটাই, যখনই আমরা এই অনুভূতি টের পাবো তখনই আমরা নিজেদের আটকাবো, থামিয়ে দেবো। ফুটবলার থেকে শুরু করে রেফারি, কোচ, দর্শক সবাইকে এটুকুই মাথায় রাখতে হবে যে খেলা আমাদের জীবনের প্রতিফলন। জীবনে আমরা যেমন অন্যের খারাপ সময়ে তার পাশে দাঁড়াই, যেমন অন্যকে নিজের আনন্দে ডেকে নিই, কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার আগে ভাবি না যে সে আমার নিজের কেউ হয় কিনা, ঠিক সেইরকমই হলো খেলার মাঠ, এখানেও সবসময় সঠিকটা করতে হবে।



তোরা দেখেছিস, এই সেদিন আইসল্যান্ডের প্লেয়ার পেনাল্টি মিস করার পর নাইজেরিয়ার এক প্লেয়ার এসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। বা মেসি যখন তেমন কন্ট্যাক্ট না থাকতেও পড়ে যান তখন নিজেই রেফারিকে ফ্রি কিক দিতে বারণ করেন বা ইজিপ্টের এক শারীরিকভাবে অক্ষম দর্শককে নিজেদের কাঁধে তুলে খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন অন্য দেশের দর্শকরা।


"সকলের তরে সকলে আমরা...."
এটুকুই শিখবো আমরা, এটুকুই মেনে চলবো দর্শক হয়ে, খেলোয়াড় হয়ে। আর কিছু না। অন্যের ন্যায্য অধিকার আমরা অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেবো না। দোষ করলে তা স্বীকার করার ক্ষমতা রাখবো। কেউ হেরে গেলে তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মনোবল বাড়াবো। জেতাটাই সব নয়, তার জন্য মারামারি, অন্যায় কোনোকিছুই আমাদের জিতিয়ে দেয় না। আরো নামিয়ে দেয় নিজেদের চোখে।

১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে রেফারির নির্দেশে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া প্রথম জার্মান প্লেয়ার এরিক বারবার নিজের দোষের জন্য অনুতাপ করেছেন, কেন তিনি সেদিন মাথা গরম করে সুইডেনের প্লেয়ারকে লাথি মেরেছিলেন। না মারলেই পারতেন। এইটুকুর খেয়াল তো রাখতে হবে আমাদের। কি, তাই তো? ”

আমরা সবাই সমস্বরে হ্যাঁ বললাম। দেখি রোহন মাথা নিচু করে আছে।

রাজাদা ডাকলো, “ রোহন, তুই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস, সেটাই যথেষ্ট। মনখারাপ করিস না আর। এই ব্যাপার রিপিট করিস না তাহলেই হবে। পারলে নূতন সংঘে একবার গিয়ে কথা বলে আসিস। ”
“ হ্যাঁ, রাজাদা। আমি যাব। আমি ক্ষমা চেয়ে আসবো ওদের থেকে। ”
আমি বলে উঠলাম, “ শুধু তুই না, আমরা সবাই যাবো।” সবাই আমার সঙ্গে সহমত হয়ে “হ্যাঁ, যাবো” বললো।

রাজাদার মুখে একঝলক হাসি খেলে গেল। জেতা-হারা হয়তো এক বিশেষ রকমের আনন্দ-দুঃখ দেয়, কিন্তু সঠিকভাবে, সৎ ভাবে ভালো খেলার চেষ্টা করলে, মাঠে সবার অনুভূতির খেয়াল রাখলে হয়তো মনে অনেকটা শান্তি থাকে।




(সমাপ্ত)


তথ্যসূত্র :
The Illustrated History of Football World Cup 1930-2018 by German Aczel
www.wikipedia.org
https://thesefootballtimes.co

ছবি : Wikipedia, Getty Images, Pinterest

2 comments:

  1. আন্তরিক ভাবেই বলছি,লেখার শুরুতে খেলার বিবরণ পড়তে পড়তে কখন যে মাঠে নেমে পড়েছিলাম, ঠিক বুঝতে পারিনি। বহুকাল হলো, শারীরিক ও ব্যক্তিগত কারণে মাঠে নেমে খেলা আমার বন্ধ, এই লেখা গুলো পড়ে আমার সাধপূরণ ঘটে।
    বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন প্রকাশিত এই লেখা, শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক বললে কম বলা হয়, ইতিহাস নির্ভর তথ্যসমৃদ্ধ এই প্রবন্ধমুলক গল্প, ছোটদের শুধুমাত্র মাঠে গিয়ে কৈশোর উপভোগ করতেই নয়, ফুটবলকে খুব আপন করে নিতেও উদ্যমী করে তুলবে সর্বান্তকরণে এই প্রার্থনা করি। যেকোনো খেলার মধ্যেই প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু জীবনের মূল্যবোধের ওপর যেন তা ভারী না হয় সেই শিক্ষা যেন আমরা কিছু কিছু করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করতে পারি, যাতে তারা নতুন আলো নিয়ে পথ চলতে পারে, হয়তো ঝাপসা হয়ে আসা আমাদের দৃষ্টিও আলোকিত করবে তারাই।

    ReplyDelete
  2. তুই ই পারিস, হ্যাঁ তুই ই। অনেক ভালোবাসা।

    ReplyDelete