পিকচার পোস্টকার্ড


প্রচ্ছদশিল্পী : সুকান্ত ও সুস্মিতা


 কী খবর ছোট্ট বন্ধুরা? রাত জেগে খেলা দেখা আর টিভির রিমোট দখলের লড়াই চলছে তো ঠিকঠাক? আর পরদিন ইস্কুলে গিয়ে টিফিনবাক্সে ধাঁই করে লাথি মেরে আগের দিন টিভিতে দেখা নতুন শটটা প্র্যাকটিস করা? সব চালিয়ে যাও মন দিয়ে, ওই শটটা মেরেই দেখবে একদিন নাইন সি কে হারিয়ে দেবে এইট বি-র বন্ধুরা!  তাই বলে নাইন সি-র বন্ধুরা আবার রেগে যেও না যেন! খেলায় হার-জিত থাকেই, আর সে হার-জিতে সিনিয়র জুনিয়র বলে কিছু হয় না। একদিন ছোট-রা জিতলো, আরেকদিন তোমরা জিতবে, এভাবেই এগিয়ে যাবে সামনের দিকে, সবাই মিলে, একসঙ্গে। রাগটাগের কোনও জায়গা কিন্তু খেলার মাঠেও নেই, পরীক্ষার হলেও নেই। স্পোর্টসম্যান স্পিরিটটাই হলো আসল, এর জোরেই হাত ধরে সবাই এগিয়ে যেতে পারবে স্বচ্ছ ভবিষ্যতের দিকে ।

তা, এসবের মাঝে মাঠে নেমে পড়েছে তোমাদের এক নতুন বন্ধু, আলাপ করবে তো তার সঙ্গে? এক্কেবারে নতুন তো, নতুন সবুজ কচি পাতার মতো নরম আর ঝলমলে সে, তার নামটিও অমন, 'ক্রমশঃ কিশলয়', সেজেগুজে সে অপেক্ষায় আছে কখন তোমরা তার কাছে আসবে, পাতা উল্টে খুঁজে খুঁজে নেবে তোমাদের মনের মতো লেখাজোখা, আঁকিবুকি, গপ্পসপ্প, ছড়াটড়া। এবারেই প্রথম তোমাদের মাঝে এসেছে সে। চলো দেখি, কী কী আছে তার ঝুলিতে?

আছে দশখানা মনমাতানো গপ্পের ডালি, আছে পাঁচটি বেজায় মিষ্টি ছড়া, পড়লেই মনে হবে আবার পড়ি, আরও পড়ি, রয়েছে এই মুহূর্তের 'মোস্ট হ্যাপেনিং' থিম ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে আলাদা আলাদা স্বাদের তিনখানা নিবন্ধ, রয়েছে তোমাদের খুব ভালো লাগার মতো তিনটে বিভাগ : ক্যুইজ, ধাঁধা আর তোমাদের নিজেদের ছবি আঁকার পাতা। আর থাকছে 'বই কথা কও', ফুটবল নিয়েই একখানা দুর্দান্ত বইয়ের গল্প নিয়ে দু'চার কথা বলা আছে সেখানে।

কিশলয়কে লেখাজোখা আঁকিবুকি দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন তোমাদের বন্ধুরা, তোমাদেরই জন্য। তাই, বন্ধুরা, সময় করে পড়ে ফেলো স-অ-ব ক'টা বিভাগ, যারা নিজেরা বাংলা পড়তে পারো না, তারা বড় বন্ধুদের, মানে বাবামায়েদের আর কি, বলো পড়ে শোনাতে, দেখবে, সব্বাই মিলে ক্রমশঃ কিশলয়ের বন্ধু হতে অ্যাত্তো ভালো লাগবে, মনে হবে সবার কাছে ছড়িয়ে দিই এই নতুন বন্ধুর খবর।

আমরা, তোমাদের বন্ধুরা অপেক্ষায় রইলাম, কিশলয়কে কেমন লাগলো সেই খবর তোমাদের কাছে জানব বলে। জানিও, নিজেদের আঁকা ছবি, আবৃত্তি পাঠিও, সেইসঙ্গে ক্যুইজ আর ধাঁধার উত্তরও পাঠিও অবশ্যই। খুব ভালো থেকো সবাই মিলে।

গল্পের ঝুলি : প্রতিবেশী : অনন্যা দাশ





“রায় বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে জানিস?” পাপাই উত্তেজিত হয়ে বলল।
“হ্যাঁ, শুনেছি,” জয় ক্লাসে ঢুকে কাঁধের থেকে ব্যাগটা বেঞ্চের উপর নামাতে নামাতে বলল।
মুখটা জয়ের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে পাপাই বলল, “কে কিনেছে জানিস?”
জয় মাথা নেড়ে বলল, “কই না তো! কে?”
ফিসফিস করে পাপাই বলল, “সমরজিৎ!”
জয়ের চোখ গোল গোল হয়ে গেল, “বলিস কী রে!”

সমরজিৎ টলিউডের নামকরা চিত্রতারকা। জয়, পাপাই আর ওদের ক্লাসের প্রায় সবাই ওঁর ফ্যান। ওঁর 'অ্যামাজনের জঙ্গলে' সিনেমাটা ওদের ক্লাসের অনেকেই চার-পাঁচবার দেখেছে! জয় নিজেই ওঁর 'মরণফাঁদ' সিনেমাটা দু'বার দেখেছে। একবার বাবা, মা, দিদির সাথে আর আরেকবার পাপাইদের সাথে। সিনেমাটার সব ডায়লগ ওর প্রায় মুখস্থ! সেই হেন সমরজিৎ কিনা রায়বাড়িতে এসে থাকবেন! ঠিক যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর।

“তুই ঠিক বলছিস?”  
“দেখ, আমি যা জানি তাই তোকে বললাম। এখন আমার খবর যদি ঝুঠো হয় তাহলে তো আর আমার কিছু করার নেই! কাল যখন মালপত্র বোঝাই ট্রাকগুলো বাড়ির সামনে এসেছিল তখন বিশুদা ওই লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করেছিল। ওরাই বলল। তবে কি, এটা হল ওঁর অনেকগুলো বাড়ির মধ্যে একটা। উনি এখানে এসে আদৌ থাকবেন কিনা সেটা কেউ জানে না। লিঙ্ক রোডে ওঁর এক মাসি না দিদা কে যেন থাকেন তাই এই বাড়িটা কিনেছেন উনি। তবে আমি আশা করছি একদিন না একদিন ওঁকে দেখতে পাবো! ওঁর সাদা মার্সিডিজ গাড়ি খুব পছন্দ। তোদের ওই রাস্তা হয়েই তো রায়বাড়ি যেতে হয় , তা তোদের রাস্তা দিয়ে যদি কোন সাদা মার্সিডিজ যেতে দেখিস তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করবি, বুঝেছিস?”

তক্ষুনি স্কুলের ঘন্টা পড়ে যাওয়াতে আর কথা হল না। পাপাই অন্য সেকশনে পড়ে তাই সে নিজের ক্লাসে চলে গেল। পড়ায় আর মন বসছিল না জয়ের। বার বার মনে হচ্ছিল, সত্যি সত্যি সমরজিৎ আসছেন কি?

“নকুল! কী হচ্ছে? টেবিলের তলায় ঢুকে কী করছ?”

টিচারের ধমকে চমক ভাঙল জয়ের। মাস দুয়েক হল নকুল বলে ছেলেটা ওদের ক্লাসে এসে ভর্তি হয়েছে। নেহাতই সাদাসিধে গোবেচারা গোছের ছেলে। পড়াশোনায় বেশ কাঁচা তাই টিচারদের কাছে প্রায়ই বকুনি খায় আর নিরীহ বলে অনীক আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা বিরক্ত করে।

টিচারের কথায় নকুল টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “আমার পেনটা টেবিলের তলায় পড়ে গিয়েছিল, সেটাকেই তুলছিলাম।"
“ঠিক আছে, তোলা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে পড়ায় মন দাও।  তারপর বলবে বুঝতে পারিনি!”

নকুল সোজা হয়ে বসতেই ওর সামনে বসা অনীক টুক করে আবার ওর পেনটা নিচে ফেলে দিল। টিচার দেখতেও পেলেন না।

বেচারা নকুল যখন সেটাকে তোলার জন্যে যেই আবার নিচে ঝুঁকেছে অমনি টিচার দেখতে পেয়ে আবার ওকে বকলেন, 
“নকুল! বার বার পেন নিচে ফেলছ কেন?”
নকুল আমতা আমতা করে বলল, “আমি না...অনীক ফেলে দিয়েছিল!”
এবার টিচার বুঝতে পেরে অনীককে ধমক দিলেন।

পরের পিরিয়েডে পি. টি. ছিল। ক্লাসে মাঝপথে পি. টি. স্যারকে প্রিন্সিপাল জরুরি কাজে ডেকে পাঠালেন । ওদের বাধ্য হয়ে থাকতে বলে স্যার প্রিন্সিপালের ঘরে চলে গেলেন।

সুযোগ পেয়েই অনীক আর তার বন্ধুরা নকুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথার বাণে জর্জরিত করে তুলল ওকে। নকুল ছুটে পালাতে গিয়ে একটা গাছের গোড়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মাথাটা দমাস করে গাছের গায়ে ঠুকে গেল।

জয়ের খুব মায়া হচ্ছিল ওকে দেখে। সে ছুটে গিয়ে নকুলকে তুলল।
মাথায় হাত দিয়ে নকুল বলল, “আমি কোথায়?” 

ওকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

ক্লাসের অন্যরা সবাই হেসে ফেলল। অনীক ফোড়ন কাটল, “তুই কি ভাবলি স্বর্গে পৌঁছে গেছিস নাকি? কোথাও যাসনি! স্কুলের মাঠে পি.টি. ক্লাসে চিৎপটাং হয়েছিলি এখন উঠে দাঁড়িয়েছিস!”

নকুল যেন কিছুই বুঝতে পারছে না এমন ভাবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

অনীক এবার বলল, “কী রে? বাবার নাম ভুলে গেলি নাকি? নিজের নাম মনে আছে তো?”

সেই শুনে ওর সাঙ্গোপাঙ্গোদের সে কী হাসি! সবাই চিৎকার জুড়ে দিল, “ভেবলুচাঁদ ভেবলেছে! হি হি হি!”

জয় দেখল আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। সে চটপট নকুলকে টেনে নিয়ে চলল। নকুল তখনও টলছে। ওর যে মাথায় চোট লেগেছে সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না জয়ের।

“চল নকুল!” 

বলে ওকে একরকম হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল জয়।

অনীক আর দল রেগে বলল, “অরিঞ্জয়টা একেবারে যা তা! কেমন মজাটা হচ্ছিল সব মাটি করে দিল!”

জয় অবশ্য ওদের কথায় কান দিল না। ওকে যা করার করতে হবে সেটাই ওকে বাবা-মা শিখিয়েছেন।

প্রিন্সিপালের অফিসটাই ওখান থেকে সব থেকে কাছে তাই সেখানেই নিয়ে গেল ওকে। জগদীশদা, মানে প্রিন্সিপালের সেক্রেটারি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “কী ব্যাপার, এখানে কেন? স্যার মিটিঙে আছেন, এখন কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না।”

“নকুল পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছে জগদীশদা! 'আমি কোথায়, আমি কোথায়' করছে। ওকে মনে হয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”

“এই খেয়েছে! এটা তো সিরিয়াস ব্যাপার! দাঁড়াও তাহলে স্যারকে বলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে,” বলে তড়িঘড়ি অফিসের ভিতর ঢুকে গেলেন জগদীশদা। 

কয়েক মিনিট বাদেই প্রিন্সিপাল স্যার পি. টি. স্যারকে সাথে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। নকুলকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওঁরা। সেই সুযোগে সেখান থেকে সরে পড়ল জয়। ওর কাজ হয়ে গেছে।



*****


তিনদিন পর, রবিবার দিন দুপুরবেলা একটা সাদা মার্সিডিজ গাড়ি এসে থামল জয়দের বাড়ির সামনে আর সেটা থেকে নামলেন স্বয়ং সমরজিৎ! 

জয় দেখে ভাবল, ‘আরে উনি ভুল বাড়িতে চলে এসেছেন নাকি?’ 

যাই হোক পাপাইকে জানাতেই হবে, না হলে পাপাই ওকে কোনওদিন ক্ষমা করবে না। সেই কথা ভেবে সে ছুটে পাপাইকে একটা ফোন করেতে গেল।

ও ফোন সেরে আসতে আসতে সমরজিৎ ওদের বাড়িতে ঢুকে বাইরের ঘরের সোফায় বসেছেন। বাবা-মা দুজনেই তো থ!

সমরজিৎ বললেন, “এটাই অরিঞ্জয় সামন্তর বাড়ি তো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ! কী করেছে জয়?” বাবা বেশ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

ততক্ষণে জয় ঘরে এসে ঢুকেছে। সমরজিতের সাথে ওটা আবার কে? ও মা নকুল!

সমরজিৎ বলে চলেছেন, “আমি অরিঞ্জয়কে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। নকুল আমার ভাগ্নে।"

বাবা-মা তো বুঝতেই পারছিলেন না কী ঘটছে। নকুলের ঘটনাটা জয় ওঁদের বলেনি যে!

“সেদিন পড়ে গিয়ে ওর ভালো রকম কনকাশন হয়ে গিয়েছিল, ওকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারত। নকুল আমাকে বলেছে জয়ই ওকে ধরে তুলেছিল, প্রিন্সিপালের অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। তাই আমি জয়ের সাথে নিজে দেখা করতে এলাম। তুমি জয় তো? এসো, এখানে বসো।"

নকুল ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। কী লাজুক ছেলে রে বাবা! সমরজিৎ যে ওর মামা হন সেটা কাউকে বলেনি। বললেই তো সব অত্যাচার থেমে যেত!

সমরজিৎ যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই বললেন, “আমিই ওকে বারণ করেছিলাম কাউকে বলতে। জানাজানি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে খুব ঝামেলা হয় তাই।"

সমরজিতের পাশে বসে ওঁর সই করা নতুন সিনেমার ডিভিডিটা হাতে নিয়ে জয় বলল, “আপনি একটু বসবেন তো? আমি আমার খুড়তুতো ভাই পাপাইকে ফোন করেছি, ও এই এসে পড়ল বলে। ও না আপনার প্রবল ফ্যান! যদি এসে দেখে আপনি চলে গেছেন তাহলে আমাকে আর কোনওদিন ক্ষমা করবে না।"


(সমাপ্ত)

অলঙ্করণঃ সুকান্ত মণ্ডল

গল্পের ঝুলি : প্র্যাকটিস : অনুষ্টুপ শেঠ






সারা শরীর টানটান অ্যালার্ট ছিল, মোড় ঘুরতেই চোখের কোণে দূরের নড়াচড়াটা ধরা পড়ে যায়। অমনি রুবাই নিখুঁত নিশানায় গুলিগুলো পর পর বিঁধিয়ে দেয়। কালো পোশাকের লোকটা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে চোখের সামনে। রুবাইয়ের সারা শরীর জুড়ে চোরা উল্লাস পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়ে।
ইয়েস!
এই লেভেলটায় গত তিন দিন ধরে আটকে ছিল।

"এখনো উঠিসনি!"

রাগে মাথা জ্বলে যায় রুবাইয়ের। মা কিছুতেই নক করে ঘরে ঢোকাটা শিখবে না। একটা তেরো বছরের ছেলের যে জীবনে কিছু প্রাইভেসি লাগে সেটা কিছুতেই বলে বোঝাতে পারছে না মাকে।

"আমি বেরোচ্ছি, বাজার যাচ্ছি। তুই ওসব ছেড়ে এবার পড়তে বোস বাবু! দেখছিস তো কী অবস্থা হচ্ছে!"

ব্যস। তিনদিনের লাগাতার একাগ্রতায় শেষ অবধি লেভেল টপকানোর আনন্দ মুহূর্তে উধাও।
বিছানা থেকে উঠে পা টেনে টেনে পড়ার টেবিলের দিকে যায় রুবাই। ব্রেকফাস্টের লুচি কপিচচ্চড়ির স্বাদ এই একটু আগে অবধি জিভে লেগে ছিল, এখন শুধুই একটা তিতকুটে ভাব। ঢকঢক করে জল খেয়েও সে তিক্ততা যায় না।

ধপ করে চেয়ারে বসে অঙ্ক বইটা টেনে নেয় সে। অমনি, গন্ধটা, খুব তীব্র হয়ে নাকে ঢোকে। শরীর অস্থির লাগে।
খুব চেনা গন্ধ, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না কিসের।
এই নিয়ে তিনবার হ'ল কাল থেকে।



---------------------


কাল ঘুম থেকে উঠেছিল দেরিতে। বাবার ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট প্রায় শেষ, কাগজ হাতে বসে আছে। বাবা-মা দুজনের মুখই কেমন গম্ভীর।

প্রথমে ভেবেছিল উঠতে দেরি করেছে বলে। এরা যে কী বিরক্তিকর! ছুটির দিন, একটু তো আয়েশ করাই যায়।  তারপর ফ্রেঞ্চ টোস্টে সস ঢালতে ঢালতে খেয়াল হল, আজ ৯ তারিখ। আজই রেজাল্ট মেইল করবে বলেছিল স্কুলটা। বুকটা একটু গুড়গুড় করে উঠেছিল। সবকটা অঙ্ক চেনা প্যাটার্নের ছিল না। ইংলিশটা নিয়ে ভাবে না, কিন্তু অঙ্কগুলো...

কারো মুখেই কথা নেই। শেষে আর থাকতে না পেরে, দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, "রেজাল্ট এসেছে, মা?"

ব্যস! বাবা কাগজটা হাতে নিয়ে বোধহয় এই অপেক্ষাতেই ছিল। প্রশ্নটা শোনামাত্র ফেটে পড়ল।

 "এতক্ষণে সেটা তোমার হুঁশ হচ্ছে? বাবা এত দৌড়াদৌড়ি খাটাখাটনি করে মরছে আর তুমি খেলে ঘুমিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছো, লজ্জা করে না?"

চিবোনো থেমে যায় রুবাইয়ের।

"ফেল করেছো, বুঝলে? সেনগুপ্ত বাড়ির কোনও ছেলে যা করেনি কখনো। শুধু যে পাশের নম্বর পাওনি তাই নয়, লিস্টে সবার শেষে তোমার নাম, সবচেয়ে কম স্কোর - ছি ছি ছি..."

আর গলা দিয়ে কিছু নামতো না রুবাইয়ের। উঠে পড়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
এই প্রথমবার মা বলেনি, "খাওয়াটা শেষ করে যা"।

সেই তখন গন্ধটা পেয়েছিল রুবাই। টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই একটা পোড়া পোড়া ধোঁয়া ধরা গন্ধে নাকের দুই ফুটো জ্বালা করে উঠেছিল।



-----------------


তখন এ নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থা ছিল না। মারকাটারি না হলেও, নেহাৎ খারাপ স্টুডেন্ট তো নয় ও! পরীক্ষাও তো ভাল দিয়েছিল বলেই ওর ধারণা। আর স্কুলটা তো এমন ভালো ফ্যামিলির ছেলেকে নিতে মুখিয়ে আছে বলেই মনে হয়েছিল, টেস্ট তো জাস্ট ফর্ম্যালিটি, বলেছিলেন এক্স্যামের ইন-চার্জ ভদ্রলোক। তাঁর থেকে সিলেবাস নিয়ে এসে রোজ টাস্ক দিয়ে প্র‍্যাক্টিস করিয়েছে মা।

তাহলে এমন হয় কী করে?

রাগটা গোঁত্তা খেয়ে গিয়ে মা আর বাবার ওপরেই গিয়ে পড়ে। সে তো সব টাস্কই রোজ প্র‍্যাকটিস করেছে গত সাত দিন। এমনকী টাস্ক শেষ না করে গেমও খেলেনি এই ক'দিন। শেষ দুদিন পার্ফেক্ট আন্সার শীট জমা দিয়েছে!

তাতেও যদি না হয়, তাহলে নিশ্চয় সেগুলোই যথেষ্ট ছিল না! আরো কিছু ছিল হয়তো যা মিস হয়েছে।
আর এরা এমন করছে যেন সবই তার দোষ। হিংস্র ভাবে গেমিং কনসোলটা তুলে নিয়েছিল রুবাই, তারপর ডুবে গিয়েছিল তার স্ক্রিনে। যেটুকু শান্তিতে থাকা যায়!
দুর্গের নিচের চোরাকুঠুরিগুলোয় ঘুরতে ঘুরতে গন্ধটার কথা, পরীক্ষার কথা সবই মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ওর।


-------------------


দ্বিতীয়বার গন্ধটা পেল সন্ধ্যাবেলা।

সকালের রাগারাগির জের চলছে তখনো। দুপুরে নামমাত্র ভাতের পাতে বসেছে সে। মায়ের এই টানা চুপ করে থাকাটা ওকে ভিতরে ভিতরে টেনশনে ফেলে দিয়েছে বেশ, এত বছরে এমন সিরিয়াস অবস্থা সে দেখেনি। তবু, ওর নিজের রাগও পড়েনি এদের ওপর।
এখন যে স্কুলে পড়ছে সেটার রেজাল্ট গত তিন বছর লাগাতার সাদামাটা, লোককে ডেকে ডেকে বলার মতো কিছু হচ্ছে না। সেজন্যই বাবা চেয়েছিল এই নামী ও দামী স্কুলটায় ট্রান্সফার হোক। এখন সেভেন, এখনই না করলে পরের বছর আর পারবে না।

পাশের বাড়ির ডোডো ওখানে পড়ে। ডোডোর মা রমা আন্টি, সামনের ফ্ল্যাটের দত্ত আঙ্কল, সবাই বলেছিল আরামসে হয়ে যাবে, ওরা নেওয়ার জন্য মুখিয়েই থাকে। ডোনেশন দিতে পারলেই হয়ে যায়। ও-ও ভেবেছিল হয়ে যাবে। ভেবেছিল তো পরীক্ষা ভালো হয়েছে। ভালো হয়েইছিল তো!
তবু।
ফেল। বটম লাস্ট। ভাবলেও কেমন মুখ চোখ গরম হয়ে উঠছে আগুনের হল্কার মত।

মন ভাল করতে কাল ভাত খেয়ে এসে আবার খেলতে লেগে গিয়েছিল, তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঘুম ভাঙল বেশ লেটে। উঠে মায়েদের ঘরের বাথরুমটায় ঢুকেছিল রুবাই। বসে বসেই টের পেল বাবা ফিরে এসেছে।

বাবার গলা এমনিতে চড়া না। কিন্তু স্পষ্ট। প্রতিটা শব্দ ওর কানে এসে আছড়ে পড়ছিল।
“খাচ্ছে না তো আমি কী করব? ফেলু ছেলেকে নিয়ে আদিখ্যেতা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এত কষ্ট করে ধরে করে লাস্ট মোমেন্টে লিস্টে নাম ঢোকালাম, স্ট্রেট ফরোয়ার্ড এক্সাম তাও ক্লিয়ার করতে পারে না! এ ছেলের ডোনেশনের জন্য লোন নিচ্ছি! বাদ দাও, ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না।”

রুবাই বসেই থাকে।
যদি অন্য কোথাও চলে যাওয়া যেত! এত একা কোনোদিন লাগেনি আগে।

ঠিক তখনই বাথরুম আচমকা ঐ গন্ধটায় ভরে ওঠে। দম আটকে আসার মত তীব্র, ভলকে ভলকে আসা গন্ধ, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় সে।
বেরিয়েই বাবা ছেলে মুখোমুখি হয়ে যায়। দুজনের কেউই এক পলকের বেশি অন্যজনের চোখে চোখ রাখতে পারে না।
বড় বেশি রাগ অন্যজনের চোখে।

রাগ? নাকি ঘেন্না?

-------------------


সকালে বাবা বেরিয়ে যাবার পর ঘর থেকে বেরিয়েছে আজ। ইচ্ছে করেই। রাগটা রাত্রে ঘুমিয়ে কমেনি, বরং বেড়েছে।

মা নিশ্চয় পড়াতে পারেনি ঠিকমতো। বাবাও তো একটু দেখে দিতে পারত! রোজ রাত ন'টা অবধি কাজ থাকে কেন? কই দত্ত আঙ্কলের তো থাকে না, সন্ধেবেলা মিষ্টিদিদিকে কোচিং-এ দিয়ে আসে নিয়ে আসে তো।
মায়ের দোষ। বাবার-ও। রুবাই ওর যা করার করেছিল। কিন্তু এখন ওদের চোখে ও-ই দায়ী।

অসহ্য!

মন বসছে না।। গোটা চারেক প্রবলেম সল্ভ করল। উত্তর মিলিয়ে দেখতেও উৎসাহ পেল না, খাটে ফেরত চলে গেল। হালকা খিদে পাচ্ছে যেন। মা এলে বলবে একটা ওমলেট করে দিতে।

“রুবু! তুমি এখনো শুয়ে আছো? কী বলে গেলুম বল তো!”
মা কখন ফিরেছে শুনতেই পায়নি। এই খেলাটা এমন মগ্ন করে রাখে! যাক, তুই-এ নেমেছে মানে রাগ পড়েছে মায়ের।

কী মুশকিল! তাই বলে কান্নাকাটির কী হ’ল? মায়ের চোখের নিচে স্পষ্ট জলের দাগ। শুকিয়ে গেছে, কিন্তু ওর চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়।

মানে, ঠিক আছে, একটা স্কুলে আছে তো এখন – এমন তো নয় পড়া ঘুচে গেল!

ওর পাশে খাটে বসে পড়ে মা। ধরা গলায় বলে, “বাজার সেরে ফেরার পথে একবার ঘুরে এলাম বুঝলি। অনেক করে বললাম, খাতা আনতে তো দিল না, কিন্তু দেখালো। ফোটো তুলে এনেছি দ্যাখ। এতগুলো সহজ জানা জিনিস ভুল করলি কী করে বাবু?”

রুবাই মায়ের ফোনে এক এক করে দেখে। আরে, এটা তো ৭ হয়, ও ১ লিখেছে কেন যোগ করে? এ বাবা, এই অঙ্কটা তখন বুঝতে পারেনি, এটা তো মাল্টিপ্লাই করার ছিল আরেকবার ব্যস! ইশ! এটা…এটা তো ঠিকই আছে, তাহলে?

পরের ছবিটায় গিয়ে আর কিছু বলার মতো খুঁজেই পায় না। পুরো অঙ্ক ঠিক করে, শেষ লাইনে ডেসিমেলের পর একটা ডিজিট স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে। কেন, জানে না।

ইংলিশ পেপারও! এই বানানগুলো ও ভুল করেছে! নিজের হাতের লেখা না হলে বিশ্বাস হ’ত না রুবাইয়ের যে এটা ও করতে পারে। কিন্তু এখন অস্বীকার করে কেমন করে, এই তো পরিষ্কার জ্বলজ্বল করছে ছবির পর ছবিতে, লাল কালি দিয়ে গোল করা।
সহজ। জানা জিনিস।

“আমারই হয়তো আরো দেখা উচিত ছিল এ ক'টা দিন … কী জানি, তোর বাবা যে এত কথা বলছে এম এ ডিগ্রি হয়েও সামান্য সেভেন এর পড়া তৈরি করাতে পারছি না ছেলের … ভুল কী বলছে বল!”

কী ভাঙাচোরা শোনায় মায়ের গলাটা।

এই প্রথম, ফেল করার জন্য লজ্জা দুঃখ রাগ ছাপিয়ে একটা কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে রুবাইয়ের বুকে। মাকে কী ভীষণ বেচারী লাগছে দেখতে, উঠে যেতে যেতে আপনমনে বলছে, “কী করি বল, আমি যে তোর দিদুনের মত সবদিক সামলে উঠতে পারি না, রান্নাবান্না বাজার দোকান সবই তো ছিল, আমি আর পেরে উঠিনি, তোকে হয়তো আরো সময় দিতে হ’ত রে…”

দিদুন?

গন্ধটা ধাঁ করে মনে পড়ে যায়।

ছোট্ট রুবাই বারান্দার চেয়ারে বাবু হয়ে বসে আছে। সামনে মাটিতে দিদুন বসেছে একটা এতবড় কাপড় সামনে ছড়িয়ে। তাতে লতা পাতা আঁকা। পাশে স্টোভে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে মোম গলছে। বাটি নামিয়ে গলানো মোম তুলির দ্রুত টানে কাপড়ের ডিজাইনে বুলিয়ে দিচ্ছে দিদুন। শুকিয়ে গেলে রঙ এ চোবাবে। সাদা কাপড়ে রঙ ধরবে, শুধু মোমে ঢাকা জায়গাগুলো সাদা থেকে যাবে।
পুরো সাদা নয়, মোম ক্র‍্যাক হবে নাড়াচাড়ায়। সেই ক্র‍্যাক দিয়ে রঙ চুঁইয়ে ঢুকে আঁকিবুঁকি কাটবে সাদার মধ্যে। তারপর শুকিয়ে গেলে মোম তুলে ফেলা হবে, অমনি অপূর্ব কারুকার্য।

বাটিক। শাড়িটা মা এখনো পরে মাঝেমধ্যে। সেই মোম-গলানো স্টোভের ধোঁয়ার গন্ধ এটা।

দিদুনের চোখ শেষদিকে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শিরা শুকিয়ে যাচ্ছিল, তার নাকি কোনও চিকিৎসা ছিল না। রুবাইয়ের আট বছরের জন্মদিনের পাঞ্জাবিটাই শেষ বাটিক দিদুনের। স্টোভটা নিভিয়ে বলেছিল মাকে, "প্যাক করে ওপরে তুলে দিস তিন্নি, আর এসব লাগবে না।"

কাঁথাস্টিচের ফোঁড় তোলা বন্ধ। দুপুরবেলার সেলাই মেশিনে বসে পর্দা সেলাই বন্ধ। বই পড়া বন্ধ। প্রায় কিছুই দেখতে পেত না শেষ কয়েক মাস।

হার্ট অ্যাটাকের খবরটা আসার আগে শেষ যেবার গিয়েছিল ডানলপের বাড়িতে, দিদুন বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসতো রোজ সকালে। কোলে নেভি ব্লু উলের বল, অভ্যাসে মুখস্ত হয়ে যাওয়া প্যাটার্নে হাত চালানো, হাতড়ে হাতড়ে ওর পিঠ বগলের মাপ নেওয়া।

"কী করে পারো দিদুন? না দেখে?"
"প্র‍্যাকটিস, দাদুভাই। প্র‍্যাকটিস। প্র‍্যাকটিস আর ইচ্ছে। এই দুটো দিয়ে সব সম্ভব হয় গো, বুঝলে?"

এখন গায়ে ছোট হয়ে গেছে, স্কুলে পড়েছিল সে বছর সোয়েটারটা।

স্কুল। টেস্ট। ফেল।
কী করে এই এতগুলো ভুল ও করল!

কানের কাছে উত্তরটা স্পষ্ট শুনতে পায়। গলাটা ওর নিজের, কিন্তু বলছে যেন দিদুন।
"জানো না, দাদুভাই? মন কোথায় থাকত তোমার বলো তো? মা টাস্ক দিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেলেই ওই যন্তরটা মনে মনে হাতে তুলে নিতে না? কোনওরকমে লেখা শেষ করে খেলায় ফিরে যেতে প্রাণ হাঁপাত না? নিজে নিজেও তো একটু বই থেকে পড়তে পারতে, করেছিলে?"

কাকে মিথ্যে বলবে রুবাই? নিজেকে?

পরীক্ষার হলে বার বার গেমটার কথা মনে পড়ছিল তো! খালি মনে হচ্ছিল এটা হয়ে গেলেই মুক্তি, বাকি পুরো ছুটিটায় সারাদিন ধরে খেলে সব লেভেল ক্রস করে ফেলবে ও।

এতগুলো ভুল কী করে হ'ল, ও জানে।

উঠে, গেমিং কনসোলটা আলমারিতে তুলে দেয় রুবাই। রোববার সকালে বাবার সঙ্গে এক ঘন্টা ছাড়া ওটা আর বেরোবে না, বাড়িতে গেস্ট এলেও না।

বিছানার চাদর টান টান করে পাতে। টেবিলের বইগুলো গুছিয়ে নিয়ে জুত করে বসে।

স্কুল কেন যেন পাল্টাচ্ছিল বাবা? ওর স্কুল লোককে ডেকে বলার মত রেজাল্ট করতে পারছিল না বলে, তাই না?
দেখা যাক। তিন বছর সময় আছে ওর হাতে।  প্র‍্যাকটিস করার জন্য যথেষ্ট সময়।

অঙ্ক বই আর খাতা নিয়ে ঠিক সেই একাগ্রতায় ঝুঁকে পড়ে রুবাই, যা দিয়ে একটু আগেই ওই গেমের কঠিন লেভেলটা পেরিয়ে গিয়েছিল।

এই লেভেলটাও পারবে, ও জানে।


(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু

গল্পের ঝুলি : কাকতাড়ুয়া : দিব্যেন্দু গড়াই





-‘আচ্ছা মা, পশুপাখিরা কি আমাদের বন্ধু নয়?’

-‘সবাই না হলেও অধিকাংশ পশুপাখি তো মানুষের বন্ধু। কেন বল তো?’

-‘তাহলে যে ক্লাসে মিস বলছিল, আগেকার দিনে নাকি পাখিদের তাড়ানোর জন্য চাষীরা কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করত?’

-‘ও কাকতাড়ুয়া! কেমন দেখতে হয় বল তো কাকতাড়ুয়া?’

-‘ঐ তো, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি কাঠামোর ওপর মাটির হাঁড়ি বসানো মুন্ডু। তাতে আবার চোখ-মুখ আঁকা। গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া, আলখাল্লা জামা। ঠিক বলেছি?’

-‘হ্যাঁ। গ্রামবাংলার চাষজমিতে কাকতাড়ুয়ারা এরকমই দেখতে হয়। তবে তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম যখন এর আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন মোটেই এরকম দেখতে ছিল না।’

-‘কোথায় মা? আমাদের দেশে?’

-‘না রে বাবাই। ভারতে নয়। তবে এদেশের মতো নদ-নদীতে ভরা মিশর দেশে। মিশরের নীলনদের তীরবর্তী চাষের জমিতে তখন নানারকম পাখি আসত শস্যদানার লোভে। তাদের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য মানুষ প্রথম কাকতাড়ুয়ার প্রয়োজন অনুভব করে। তখন অবশ্য কাক নয়, কোয়েলজাতীয় পাখির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য জমিতে কাঠ দিয়ে কাঠামো তৈরি করে জাল জড়িয়ে রাখত তারা। পাখিদের ঝাঁক জমিতে এলে তাড়া করত ঐ জাল-লাগানো কাঠামোর দিকে। যে ক'টা পাখি জালে আটকাতো তাদের ধরে পেটপুজো করত। খাওয়াও হল আবার ফসল রক্ষাও। এক ঢিলে দুই পাখি।’

-‘পাখিদের মেরে খেয়ে ফেলত? বদমাইশ লোকজন।’

-‘না রে, ঠিক বদমাইশ নয়। সে তো আমরাও চিকেন-মাটন খাই। তার বেলা? আর শুধু মানুষ কেন, দেবতারাও কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করত।’

-‘কোথায় মা, কোথায়?’

-‘গ্রীস দেশে। গ্রীকদেবী অ্যাফ্রোদিতির ছেলে হল প্রিয়াপাস। অত্যন্ত কদাকার দেখতে। সে যখন আঙুরক্ষেতে খেলে বেড়াত, ভয়ে কাকপক্ষীরা ধারেকাছে ঘেঁষত না। ফলে, আঙুরের ফলনও হত অনেক। তাই না দেখে চাষীরা প্রিয়াপাসের মূর্তি তৈরি করে আঙুরক্ষেতে রাখতে শুরু করল। ফলও পেল হাতেনাতে। সেই কাকতাড়ুয়ার একহাতে থাকত মুগুর আরেক হাতে কাস্তে।’

-‘কাস্তে আমি দেখেছি মা, দাদুর বাড়িতে। মদনকাকু ঘাস কাটছিল, আমায় দেখিয়েছে।’

-‘মদনদাকে ছোটবেলায় আমরা কাকতাড়ুয়া বানাতেও দেখেছি। বিশ্রী গন্ধযুক্ত তেলও ছড়িয়ে দিত কাকতাড়ুয়ার জামায়। বলত, ঐ গন্ধে পাখিরা পালায়। জানিস তো, জাপানে প্রথম এইরকম পচা গন্ধযুক্ত কাকতাড়ুয়া ব্যবহার শুরু হয়। নাম ছিল ‘কাকাশিস’। মানে ‘দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু’।  বাঁশের কাঠামোতে ছেঁড়া চট, মাছ-মাংসের হাড় এইসব জড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত। তীব্র পচা, কটু গন্ধে পশুপাখি ধানক্ষেতের আশেপাশে ভিড়ত না। পরে অবশ্য জাপানীরা বাঁশের কাঠামোতে পুরনো রেনকোট জড়িয়ে দুর্গন্ধবিহীন কাকতাড়ুয়া বানাত। তবে কাকতাড়ুয়া মানে শুধু জড়বস্তু নয় কিন্তু, ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষরা অনেক সময় দলবদ্ধভাবে আওয়াজ করে, পটকা ফাটিয়ে পাখি তাড়াত। ৯-১০ বছর বয়সী বাচ্চাদের কাজে লাগানো হত অনেক জায়গায়। তাদের হাতের থলেতে থাকত ছোটো পাথরের টুকরো। তাই ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফসলের ক্ষেত থেকে পাখি তাড়ানো ছিল একটা পেশা।’

-‘তুমি ছোটোবেলায় কাকতাড়ুয়া দেখেছ, তাই না মা?’

-‘শুধু দেখিনি রে, মদনদার সাথে আমরা ভাইবোনেরা মিলে কাকতাড়ুয়া তৈরি করতাম। দুটো বাঁশ আড়াআড়িভাবে বেঁধে তার ওপর খড় জড়ানো হত। তারপর ছেঁড়াফাটা জামা পরিয়ে মাথার জায়গায় ভুষোকালি মাখানো মাটির হাঁড়ি চড়াতাম। চড়ানোর আগে অবশ্য বিকট চোখমুখ আঁকা হত। কে আঁকবে তাই নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি লেগে যেত আমাদের মধ্যে। সন্ন্যাসীপাড়ার হুতুম তো একবার সেই কাকতাড়ুয়া নিয়ে দারুণ কান্ড করেছিল।’

-‘কী কাণ্ড? বলো না মা, বলো না।’

-‘আরে গলাটা ছাড় আগে। তারপর বলছি।’

*****

ন’দশ বছরের ছেলেটা জন্মাবধি ওর অবিবাহিত পিসির কাছেই মানুষ। স্কুলে যেত ঠিকই। তবে বইখাতার চাইতে কাঠবেড়ালি, চড়াই-বুলবুলি, হাঁস-মুরগির সাথেই সখ্যতা ছিল বেশি। স্কুলের সময় ছাড়া তাকে মাঠেঘাটে অথবা পুকুর-নদীতেই বেশি দেখা যেত। খিদে পেলে তবেই বাড়ির শরণাপন্ন হত হুতুম। নামটা যার দেওয়াই হোক না কেন, ছিল কিন্তু জম্পেশ। রাত-বিরেতেও বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়ায় যে ছেলে, তার হুতুম নাম তো সার্থক। ভয়ডর ছিল ভয়ানকভাবে কম। সমবয়সী হওয়ায় আমার সাথে ভালোই ভাব ছিল। 

সেবার কালীপুজোর পর ঘটনাটা ঘটল। গ্রামে সেবার বিঘের পর বিঘে ধানজমিতে প্রচুর ফলন হয়েছিল। চাষীদের মুখে চওড়া হাসি। শেষ মুহূর্তে ফসলের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি সবার। এক পূর্ণিমার রাতে ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। মন্ডলপাড়ার হরেনকাকু জমি থেকে ফেরার সময় দ্যাখে, কাকতাড়ুয়া ক্ষেতের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। সেকথা শুনে গ্রামবাসীরা কেউ বলল হরেনখুড়োর চোখে নিশ্চয় ছানি পড়েছে। কেউ আবার রসিকতা করে বলল, কাকতাড়ুয়ার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চয় পা ব্যথা করছিল, তাই হাত-পায়ের গিঁট খুলতে আর ফুরফুরে হাওয়া খেতে যাচ্ছিল নদীর পাড়ে, পথে হরেনখুড়োকে দেখে লজ্জায় আর যেতে পারেনি। সে যাইহোক, কাকতাড়ুয়ার নড়াচড়া নিয়ে সবাই বেশ আলোচনায় মেতে উঠল। আমাদের মাঝারিদের দলেও তখন আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু ঐ কাকতাড়ুয়া। লখাদা আমাদের দলের মধ্যে বয়সে ছিল সবচেয়ে বড়। তার সুবিধেও নিতো খুব। একে-ওকে হুকুম করা ছিল রোজকার ব্যাপার। অনেকে মানতে বাধ্য হলেও হুতুম মানত না। তাই সুযোগ পেলেই লখাদা হুতুমকে টাইট দেওয়ার চেষ্টা করত। এই কাকতাড়ুয়ার ঘটনার পর একদিন সবাই মিলে ঝিলের মাঠে খেলাশেষে বসে আছি। হঠাৎ করে লখাদা বলল, 

‘এ্যাই হুতুম। তুই তো খুব সাহসী শুনেছি। পারবি রাতের বেলায় কাকতাড়ুয়ার কাছে একা একা যেতে?’

চট করে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে নিলো হুতুম। বলল, 
-‘শুধু যেতে নয়, তিনদিন পর যে অমাবস্যা আসছে, সে রাতটা আমি কাকতাড়ুয়ার সাথেই কাটাতে রাজি। তবে, একটা শর্তে।’

-‘কী শর্ত?’ লখাদার উৎসুক দৃষ্টি। 

-‘তোমাকে তার আগের দিন রাতের বেলায় গিয়ে কাকতাড়ুয়ার হাতে সুতো বেঁধে আসতে হবে।’

চমকে উঠল লখাদা। বেজায় ভীতু লখাদার কাছে এরকম প্রস্তাব খালি হাতে বাঘের মোকাবিলা করার মতোই ভয়ানক। কিন্তু যেহেতু প্রথমে কথাটা লখাদাই তুলেছিল আর হুতুমের প্রস্তাবে পিছিয়ে গেলে সবাই দুয়ো দেবে, তাই নিমের পাঁচন গেলার মত মুখ করে লখাদা রাজি হল। 

দু’দিন পরে সেই রাত উপস্থিত। দুরুদুরু বক্ষে একগাছি লালসুতো নিয়ে লখাদা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমাদের গ্রুপে হাজির। বলল, পায়ে খেজুর কাঁটা ফুটে গেছে, তা সত্ত্বেও সে নিজের কথা রাখার জন্য কাকতাড়ুয়ার হাতে সুতো বাঁধতে রেডি। অতটা পথ খুঁড়িয়ে যেতে কষ্ট হবে, তাই একজন কাউকে শুধু সাথে যেতে হবে। তাও ক্ষেতের আগে আলপথ অব্দি গেলেই হবে। বাকিটা সে একাই যাবে। বুঝলাম পায়ে কাঁটা ফোটা সব নাটক। আসল উদ্দেশ্য একা না গিয়ে দোকা যাওয়ার। যাইহোক রবিনকে সাথে নিয়ে লখাদা বেড়িয়ে পড়ল। আমরাও যে যার বাড়ির পথ ধরলাম। যাওয়ার আগে লখাদা বলে গেল,

-‘হুতুমকে তো দেখতে পাচ্ছি না। বলে দিস, কাল কিন্তু ওর পালা।’

সে রাতে সবাই এলেও হুতুম কিন্তু আসেনি।

পরেরদিন রবিনের মুখে শুনলাম লখাদা ওকে ধমকেধামকে কাকতাড়ুয়ার কাছ অব্দি নিয়ে গিয়েছিল। তারপর যেই সুতো বাঁধতে গেছে অমনি কাকতাড়ুয়া হাত সরিয়ে নিয়েছে। প্রথমবার চোখের ভুল ভেবে দ্বিতীয়বার রবিনকে আদেশ দিয়েছিল সুতো বাঁধার। কিন্তু কাকতাড়ুয়া কিছুতেই হাতে সুতো বাঁধতে দেয়নি। আবার হাত সরিয়ে নিয়েছিল। আর যায় কোথায়, সুতো-টুতো ফেলে গোঙাতে গোঙাতে লখাদা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মেরেছে দৌড়। পায়ে কাঁটা ফোটা যে মিথ্যে কথা, ঐ দৌড় দেখলে যে কেউ হলফ করে বলতে পারতো। রবিনও টেনে দৌড় মেরে বাড়িতে পৌঁছানো অব্দি আর পেছন ফিরে তাকায়নি। লখাদার করুণ কাহিনী জনে জনে প্রচার হয়ে গিয়েছিল গ্রামে। লখাদা শেষ চেষ্টা করেছিল হুতুমকে দোষী প্রমাণ করার, কিন্তু সে চেষ্টাও বৃথা। কারণ ঐ রাতে হুতুম ধুমজ্বরে শয্যাশায়ী ছিল, প্রতিবেশীরা তার প্রমাণ। 

*****

-‘তাহলে সে দিন কী হয়েছিল মা? কাকতাড়ুয়া নড়লো কী করে? কেউ নিশ্চয় লখাদাকে ভয় দেখানোর জন্য কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে ছিল। কে সে? কার এত সাহস?’

-‘হুতুমের এক প্রিয় বন্ধু যখন দেখল জ্বর হওয়ার জন্য হুতুমের প্ল্যান মাঠে মারা যাচ্ছে তখন সে নিজেই কাকতাড়ুয়া সেজে ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ছিল। লখাদার হামবড়া ভাবসাবের বেলুনকে চুপসে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। আর তাতে সে পুরোপুরি সফল হয়েছিল।’

-‘কে ছিল সেই অসমসাহসী বন্ধু?’

-‘আমার বাবাই-এর মতো সাহসী ছেলের মা ছাড়া অার কে হতে পারে বলে তোর মনে হয়?’

-‘ মাআআআ তুমিইইইইই!!!’ 

-‘ওরে ছাড়, ছাড়। মেলা কাজ পড়ে আছে। তুই ততক্ষণে একটা কাকতাড়ুয়ার ছবি আঁক দেখি।’


(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : দিব্যেন্দু গড়াই

গল্পের ঝুলি : হারিয়ে যাওয়া পুঁথি : দেবদত্তা ব‍্যানার্জী






সুপারি গাছের আড়ালে কাঠের দোতলা বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে একটা জোরালো আলো জ্বলছে। বহু দূরে ঘড়ি-মোড়ের বড় ঘড়িটা হঠাৎ দু’বার বেজে উঠে জানান দিলো রাত দুটো বাজে। ডঃ বড়ুয়া একটা বহু পুরানো চামড়ার পুঁথির পাঠোদ্ধারে ব‍্যস্ত। আতসকাঁচ আর একটা সাঙ্কেতিক ডায়রি নিয়ে তিনদিন হল নাওয়া-খাওয়া ভুলে লেগে রয়েছেন। এমন সময় ভাইব্রেশনে রাখা ফোনটা কেঁপে  উঠতেই বিরক্ত হলেন তিনি। অচেনা নম্বরের ফোন, একটু দোনামোনা করে, নিয়েই নিলেন কলটা। এই মার্চের প্রথমে উত্তরবঙ্গে ঠাণ্ডার রেশ ভালোই রয়েছে। তবুও ওঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল ফোনের ওপারের কথা শুনে। গম্ভীর মুখে ফোনটা রেখে উঠে এলেন তথাগতর বড় মূর্তিটার সামনে। প্রদীপের পলতেটা উস্কে দিয়ে প্রণাম করলেন ওঁর ঈশ্বরকে। পুঁথিটা জায়গা মত রেখে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম এলো না। এক অজানা বিপদের আশঙ্কায় মনটা ভার। ছটফট করে রাতটা কাটল, ভোর রাতে উঠে বেরিয়ে গেলেন হাতে একটা ব‍্যাগ নিয়ে। সারা শহর তখন ঘুমন্ত।


 *********


ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, এবার সেভেন হবে রুবাইয়ের। এই সময়টা রুবাইয়ের খুব ভালো লাগে। ঠাণ্ডাটা বেশ কমে একটা আরামদায়ক ওয়েদার, চারদিকে নাম না জানা ফুলের মেলা। আজকাল রুবাই একটু সাইকেল নিয়ে একা বেরোতে পারে বন্ধুদের বাড়ি। একটু বড় হয়েছে, তাই মা আর বকে না। ওর মা শ্রমণা দেবী মেয়েদের স্কুলের প্রিন্সিপাল। আর বাবা রাজেশবাবু বড় ডাক্তার। বেশ কড়া শাসনে রাখা হয় রুবাইকে।

ওদের বাড়ির পিছনেই রেললাইন। সারাদিনে মাত্র একটা ট্রেন চলে। কুচবিহার থেকে চ‍্যাংড়াবান্দা হয়ে শিলিগুড়ি যায় ডি. এম. ইউ. ট্রেনটা। রোজ সন্ধ‍্যায় ট্রেনটা ফিরে গেলে ওরাও আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরে আসে।

সেদিন ওরা ওদের বন্ধু রাজনের বাড়ি গিয়েছিল। রাজনদের বাড়ি রেললাইনের ওপারে বুদ্ধ মন্দিরের পিছনে। বিশাল সুপারি বাগানে ঘেরা বহুদিনের পুরানো বড় বাড়ি। এদিকটায় আসলে কেমন যেন গা ছমছম করে রুবাইয়ের। আসলে ওদের বাড়ির পাশেই একটা চীনাদের পরিত‍্যক্ত কবরখানা আছে। জায়গাটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা। রাজনের জ্যেঠু ডঃ পিনাকী বড়ুয়া তিব্বতী ও পালি ভাষার উপর রিসার্চ করে ডক্টরেট। দীর্ঘ দিন উনি তাওয়াং এ ছিলেন। তিব্বতেও কাটিয়েছেন কিছু সময়। দু’মাস হলো বাড়ি ফিরেছেন। বিয়ে করেন নি। বাচ্চাদের উনি খুউউব ভালোবাসেন। ওঁর কাছে এলে খুব ভালো গল্প শোনা যায়। জেঠুর গল্পের লোভেই ওদের রাজনদের বাড়িতে যাতায়াত বেড়েছে আজকাল।

ওদের সাথে নিচের বড় হলেই জেঠুর দেখা হলো। অরুণাচলের বুমলা পাসের গল্প বলছিলেন জেঠু। চীনা সৈন‍্যরা কিভাবে রাতারাতি ভারত দখল করতে এগিয়ে এসেছিল শুনতে শুনতে ওরাও পৌঁছে গিয়েছিল সেই যুদ্ধক্ষেত্রে। চারদিকে তখন মাইন বিছানো চলছে। এমন সময় জেঠুর ফোনটা বেজে উঠেছিল। উনি ফোনটা অন করে এক দু'বার হ‍্যাঁ বলার পর ওঁর মুখের পেশীর বদলে যাওয়া আর কপাল কুঁচকে যাওয়া দেখে রুবাই বুঝতে পেরেছিল কিছু হয়েছে। ওঁর ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল আর কপালের উপর দুটো শিরা ফুলে উঠেছিল। বেশ জোরের সাথে দু’ বার না বলে উনি ফোনটা কেটে দিলেন।  ফোনটা রেখেই উনি ঢকঢক করে জল খেলেন কিছুটা। রুবাই, আকাশ আর রাজন চুপ করে অপেক্ষা করছিল।

কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে উনি বললেন -"আজ আর গল্প হবে না। কাল ভোরে আমায় লাভা মনাস্ট্রি যেতে হবে। তোমরা পরে একদিন এসো। "

আকাশ আর রুবাই উঠে পড়ল। রাজনের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে শুনলো জেঠু ফোনে গাড়ি বুক করছেন পরেরদিনের জন‍্য। রাজন ওদের এগিয়ে দিল রেল লাইন অবধি।


হুইসল বাজিয়ে ট্রেনটা চলে গেলো ওদের সামনে দিয়ে। লাইন পার হতে হতে আকাশ রুবাইকে বলল -"কি এতো ভাবছিস তখন থেকে?"

-"কিছু একটা হয়েছে মনে হল। কিন্তু ....."

-"হয়তো কোনো পারিবারিক সমস‍্যা।"

-" না মনে হয়। ফোনটা পরিবারের কেউ করে নি। নম্বরটা সেভ করা ছিল না। "

আসলে বয়স আন্দাজে রুবাইয়ের আই. কিউ. লেভেলটা বেশি। গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে ও মাথাটাও খাটাতে চায় সর্বদা। সব কিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখে রুবাই। ওর জন‍্য বেশ কিছু অপরাধী ধরাও পড়েছে। পুরস্কার পেয়েছে রুবাই এসবের জন‍্য। এলাকায় সবাই ওকে চেনে তাই।

বাড়ি ফিরেই রুবাই দেখে ওর মাসির পরিবার এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে। পরদিন রিশপ আর কোলাখাম  যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে সবাই মিলে। দু'দিনের জন‍্য এমন হুটহাট ঘুরতে যেতে ওর ভালোই লাগে ।


*********


পরদিন ভোরে রুবাই-এর বাবা ডাঃ রাজেশবাবুর নতুন কেনা বড় ট্রাভেরা ওরা চলল পাহাড়ের পথে। টাউন ছাড়াতেই সবুজ চা-বাগানের ভেতর ঢেউ খেলানো পথে ওরা এগিয়ে চলল গরুবাথানের দিকে। পাহাড়ের নিচে উচ্ছল চেল নদীর ধারে বসে মোমো আর কফি দিয়ে ব্রেকফাষ্ট করে ওরা এগিয়ে চলল পাপরক্ষেতির দিকে। মাসির দুই মেয়ে টায়রা আর টিকলির সাথে রুবাই বসেছিল মাঝের সিটে। পিছনে ওর মা শ্রমণা দেবী, মাসি আর মেসো। রাজেশবাবু সামনে। পাপরক্ষেতির বড় ঝর্ণায় নেমে প্রচুর ফটো তোলা হলো। এরপর ছবির মত সুন্দর পাহাড়ী গ্ৰাম ছাড়িয়ে ওরা চলল লাভার রাস্তায়। প্রথম যাবে কোলাখাম, ছাঙ্গে ফলস দেখে আজ ওখানেই থাকবে। চড়াই পথে গাড়ি বেশ কিছুটা উঠে ঢুকে পড়েছে পাইনবনে। মাঝে মাঝেই মেঘ এসে সব ঝাপসা করে দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার কামড় বাড়ছে। সবাই শীতের পোশাকে নিজেদের মুড়ে নিয়েছে। হঠাৎ একটা মোড় ঘুরতেই ড্রাইভার বাবুয়াদা বিচ্ছিরি ভাবে ব্রেক কষতেই রুবাইয়ের মাথাটা জানালায় ঠুকে গেলো। টিকলিও সামনের সিটে আছড়ে পড়েছিল। টায়রা সামনের সিট ধরে ফেলেছিল বলে ব‍্যথা পায়নি। রুবাইয়ের মা আর মাসিও লাফিয়ে উঠেছিলেন।

আসলে সামনে একটা ওয়াগন-আর -এর  দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাড়িটা হেলে পড়েছে পাহাড়ের দিকে আড়াআড়ি ভাবে।


বাবুয়াদা গাড়িটা পার্ক করে নেমে দেখলো সামনের গাড়ির ড্রাইভার জখম হয়ে পড়ে রয়েছে। জ্ঞান নেই।

বাবুয়াদা বলল এটাও মালবাজারের গাড়ি। পলু বলে একটা ছেলে চালায়। তবে এ অন‍্য ড্রাইভার। পলুকে ফোন করে দিল বাবুয়াদা। রাজেশ বাবু ফোন করলেন লাভা চেকপোস্টে। ডাক্তার বলে এসব নম্বর ওঁর ফোনেই রয়েছে। লাভা চেকপোস্টে ওঁর পরিচিত একজন রয়েছেন।

হঠাৎ রুবাইয়ের মনে হল আগের দিন জ্যেঠু পলু বলেই কাউকে ফোন করেছিলেন গাড়ির জন‍্য। দশ মিনিট পার হয়ে গেলো অথচ কারো দেখা নেই। এই পথে গাড়ি কম চলে বলে তখনো জ‍্যাম হয়নি। বাবুয়াদা সবাইকে নামিয়ে কায়দা করে খাদের ধার দিয়ে ওদের গাড়িটা বার করে আনলো। সবাই গাড়িতে উঠে এগিয়ে চলল আবার। বাবা অবশ‍্য লাভা থানায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে।  রুবাই কিন্তু হঠাৎ করে বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। মায়ের ফোন থেকে রাজনদের বাড়ি ফোন করে জেনে নিল জেঠু ভোর বেলায় লাভার পথে পাড়ি দিয়েছেন একটা ওয়াগন-আর-এ।

লাভায় ঢোকার মুখেই লাভা মনাস্ট্রির আগে ডানদিকে নেওড়া ভ‍্যালি ফরেষ্টের ভেতর দিয়ে পাথুরে পথ নেমে গেছে কোলাখামের দিকে। প্রাচীন সব গাছের জঙ্গল পেরিয়ে ঘন্টা পোকা আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মাঝে ওদের গাড়ি সে পথে এগিয়ে চলল। খাদের ধারে লাভা মনাস্ট্রি লুকোচুরি খেলছে ওদের সাথে। নানারকম পাখি দেখা যায় এ’পথে। মেসো আর বাবা কখনো গাড়ি থামিয়ে পাখি দেখছেন, ফটো তুলছেন। টায়রা টিকলির খুনসুটি চলছে। কিন্তু রুবাই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে ওরা কেউ খেয়াল করেনি। ছাঙ্গে ফলস যাওয়ার পথেই ওদের রিসর্ট, সেখানে নেমে লাঞ্চ সেরে সবাই ছাঙ্গে যাবে তাই ঠিক ছিল। রুবাই আরেকবার রাজনকে ফোন করে অনুরোধ করল ওর জেঠু লাভা পৌঁছে গেছেন কিনা জেনে নিতে। রাজন বলল ওর জেঠুর ফোন নট রিচেবল বলছে যা পাহাড়ে হয়েই থাকে। লাঞ্চের পর হাঁটাপথে ওরা সবাই চলল ছাঙ্গে ফলস দেখতে। জঙ্গলের ভেতর সরু পায়ে চলা পথ। আজকাল প্রচুর নতুন রিসর্ট হয়েছে এই জঙ্গলের ভেতরেও। কয়েকটা তৈরি হচ্ছে এখনো।


বিকেলের পর থেকে চেনা অচেনা পাখির মেলা বসে গেলো চারদিকে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখা যাচ্ছিল। খাদের ওধারে পাহাড়ী গ্ৰাম রিশপের আলোগুলো জ্বলতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে। এমন সময় রাজনের ফোন এলো যে ওর জেঠু লাভায় পৌঁছাননি। পরিত‍্যক্ত গাড়িটা লাভার দশ কিমি আগে পাওয়া গেছে। ড্রাইভারের এখনো জ্ঞান ফেরেনি, মালেই ভর্তি করা হয়েছে তাকে। ওর বাবা লাভায় রওনা দিয়েছেন খবর পেয়েই।

রুবাই এই ভয়টাই পাচ্ছিল। পরদিন সকালে ওরা  রিশপের পথে লাভা মনাস্ট্রিতে গিয়ে রাজনের বাবার সাথে দেখা করেছিল। উনি বড্ড ভেঙে পড়েছেন। জানা গেলো ওঁর দাদার সংগ্ৰহে একটা বহু প্রাচীন পালি ভাষায় লেখা পুঁথি ছিল যা তিব্বতের কোনো প্রাচীন মঠে বহুকাল অবহেলায় পড়েছিল। পুঁথিটার ঐতিহাসিক মূল‍্য প্রচুর। সেটা নিয়ে দু’একটা সেমিনারে উনি বক্তব‍্য রেখেছিলেন। কিছুদিন যাবৎ ঐ পুঁথিটার জন‍্য ওঁর কাছে ফোন আসছিল। কেউ ওটা কিনতে চায়। প্রচুর টাকার অফার এসেছিল। কিন্তু উনি ছিলেন এক নির্লোভ মানুষ। পুঁথিটা লাভা মনাস্ট্রিতে দিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। ওটা দিতেই আসছিলেন হয়তো। মঠের অধ‍্যক্ষও পুঁথিটার কথা বললেন। পুলিশ কালিম্পং জেলার ছোট বড় সব হোটেল রিসর্ট চেক করেছে সারা রাত ডঃ বড়ুয়ার খোঁজে। ডুয়ার্স শিলিগুড়িতেও খোঁজ চলছে। কিন্তু কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।

রুবাই হঠাৎ সব শুনে বলল -"পুঁথিটা পেয়ে গেলে ওরা ওঁকে ছেড়ে দিত। নয় কিছু করত। একটা লোককে আটকে রাখবে কেন?"

মঠের অধ‍্যক্ষ বললেন-"পুঁথিটা নিয়ে আসছিলেন কিনা আমিও ঠিক জানি না। ওটা নিয়ে কথা বলতেই আসছিলেন হয়তো। আমায় ফোনেও জানিয়েছিলেন  আসার কথা। "

-"তবে ওঁর সাথেই আছে, লুকানো। এখনো ওদের হাতে পড়েনি।" রুবাই দৃঢ় গলায় বলল।

রুবাইয়ের এসব ব‍্যাপারে আগ্ৰহ রয়েছে। এর আগেও দু'একটা রহস‍্য উদঘাটন করেছে ও। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দু'একটা কথা বলে একটু পরেই ওরা রিশপ চলে গেলো। যদিও ঘোরায় আর কারোর মন ছিল না। সবার মন ভারাক্রান্ত। ডাঃ বড়ুয়ার খবর না পেলে এই চিন্তা দূর হবে না। কাঞ্চনজঙ্ঘাও ঢাকা সেদিন মেঘের আড়ালে।বিকেল থেকে আকাশ কালো করে বৃষ্টি এসেছিল। পাহাড়ে এসব দুর্যোগ কতটা ভয়ঙ্কর হয়  তা’ না দেখলে বোঝা যায় না। ওদের খাদের ধারে কাঠের কটেজটা পিচবোর্ডের বাড়ির মত কাঁপছিল।

বড় বড় পাথর মাটি ধ্বসে পড়ছিল আশেপাশে। জলস্রোত নতুন নতুন ঝরণা সৃষ্টি করে নেমে যাচ্ছিল খাদের দিকে। মাঝে মাঝে বিদ‍্যুতের চমকে এই তাণ্ডব দেখা যাচ্ছিল। ভোরের দিকে শান্ত হয়ে গেলো প্রকৃতি। সকালে উঠে বিধ্বস্ত এই পাহাড়ি গ্ৰামের ছবি দেখে সবাই অবাক, বেশ কিছু বাড়ি ধসে গেছে। রাস্তা ভেঙ্গে পড়েছে। পাহাড় ধসে রাস্তা বন্ধ খবর এলো। রুবাইদের ট্রেক করে লাভা যেতে হবে , কারণ ড্রাইভার বলল গাড়ি যাবে না এই পথে। লাভা থেকে অন‍্য গাড়ি ভাড়া করে ফিরতে হবে। রাস্তা সারাতে দু'দিন লাগবে। তারপর গাড়ি ফিরিয়ে নেবে বাবুয়াদা। রুবাইয়ের বাবা মাকে ফিরতেই হবে সেদিন। অগত‍্যা হাঁটাপথে সবাই চলল লাভার দিকে। চার কিমি পথ পুরোটাই উৎরাই । নেওড়া ভ‍্যালির আদিম অরণ‍্যর মাঝ দিয়ে এই পথ। বড় বড় গাছের গায়ে পুরু শ‍্যাওলার আস্তরণ, পরগাছায় নাম না জানা ফুলের সমারোহ, কোথাও বা অর্কিডের ফুল দেখতে দেখতে পথ চলা। কোথাও আবার পথ নেই, ধসে গেছে, ওদের ফরেস্টের ভেতর দিয়ে আসতে হচ্ছিল। জোঁকের উপদ্রব রয়েছে এ’পথে। জোঁক গায়ে লাগলে প্রথমে টের পাওয়া যায় না। ছোট্ট জোঁক রক্ত খেয়ে ফুলে বড় হয় এক সময় টুপ করে খসে পড়ে। তখন আর রক্ত বন্ধ হয় না। একমাত্র লবণ এই জোঁকের হাত থেকে বাঁচায়। যদিও ওরা সবাই ফুল জ‍্যাকেট, জিনস, মোজা জুতো পরা তবুও সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল। লবণ আনা হয়েছিল জোঁকের ভয়ে।

জঙ্গলের মাঝে দুটো বস্তি চোখে পড়ল মাঝপথে। গভীর জঙ্গলে একটা ফরেস্টের বাংলো রয়েছে। দূরবীন দিয়ে রুবাই দেখেছিল ঐ বাংলোর সামনে একটা ল‍্যান্ড রোভার রয়েছে দাঁড়িয়ে। এই দুর্গম পথে এই গাড়িই চলে একমাত্র। ভেতরে লোক রয়েছে মনে হচ্ছে কিন্তু সব দরজা জানালা বন্ধ। রুবাই এগিয়ে গিয়েছিল ওদিকে, কৌতূহল সর্বদা ওর একটু বেশি। ঘড়িতে দেখে এগারোটা। ট্যুরিস্ট থাকলে এসময় ঘরে কেন? ও ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছিল। মা মাসি একটা কাঠের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। টায়রা ফটো তুলতেই ব‍্যস্ত। টিকলি অর্কিড দেখছে। রুবাই বাবাকে কী একটা বলতে গিয়ে থমকে যায়। একটা নেপালী ছেলে বেরিয়ে এসেছে প্রথম ঘরটা থেকে, মুখটা কেমন যেন। একটা মাঙ্কি ক‍্যাপ পরা, কালো জ‍্যাকেটটা রঙ চটা। ছেলেটা হিন্দিতে বাবাকে জিজ্ঞেস করে কিছু। বাবা হেসে জানায় যে রাস্তা ধসে গেছে বলে এ পথে ফিরতে হচ্ছে ওদের। কিছুক্ষণ পর আবার হাঁটতে শুরু ওরা।  কিছুটা নামতেই লাভা চেকপোস্ট।

কালকের পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেলো রুবাই। বাবা এগিয়ে গিয়ে কথা বলছিল ওঁর সাথে। রুবাই এগিয়ে যায়। বলে  -" একটা কথা বলব আঙ্কেল , এই বনের ভেতর যে ফরেস্ট বাংলোটা আছে ওটা দেখবেন তো একবার। একটা গাড়িও রয়েছে দেখলাম।"

-"ওটায় তিনটে নেপালী ছেলে আছে আজ দু'দিন হলো। গেছিলাম কাল।" পুলিশ অফিসার জানান।

একটু ইতস্তত করে রুবাই বলে,

-"এসব বাংলোয় ট্যুরিস্ট এসে কি টানা এতদিন থাকে? আর নেপালীরা পাহাড়েই থাকে। ফরেস্ট বাংলো বুক করে ঘোরে কি? ওদের দেখেও ট্যুরিস্ট মনে হল না কিন্তু। "

-"ক’দিনের বুকিং? কী নামে বুকিং ? একটু খোঁজ নিন প্লিজ। পারলে ফোর্স আনিয়ে নিন।" রাজেশবাবু বলে ওঠেন।

এক কিশোরের মুখে এসব শুনে যে কেউ হয়তো বিরক্ত হত বা রেগে যেত। কিন্তু অফিসারটি ভালো লোক, উনি রাজেশবাবুকে চেনেন, রুবাইয়ের নামও হয়তো  শুনেছেন। তাই একটু হেসে বললেন তিনি এখনই সব খোঁজ নিচ্ছেন।

লাভা থেকে ওঁর সাহায‍্যে গাড়ি ভাড়া করে ওরা মালে পৌছালো দু'ঘন্টা পর। মাসি মেসো মেয়েদের নিয়ে ঐ গাড়িতেই ফিরে গেলেন জলপাইগুড়ি। রুবাই এসেই আকাশকে নিয়ে ছুটল রাজনদের বাড়ি। গিয়েই শুনল রাতে নাকি চোর ঢুকেছিল চিলেকোঠায়। জেঠুর ঘর লণ্ডভণ্ড। তবে কিছু চুরি হয় নি। যদিও সেই পুঁথি কোথায় কেউ জানে না। রাজন বলল সে আগেও খুঁজে দেখেছে। পুঁথিটা কোথাও নেই।

রুবাই এমনটাই আশা করেছিল। এমন সময় খবর পাওয়া গেল ডাঃ বড়ুয়াকে পাওয়া গেছে। উনি ঘুমের ওষুধে আচ্ছন্ন। আপাতত ওঁকে মালবাজার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে আনা হচ্ছে। খবর পেয়েই সবাই হাসপাতালে চলে গেলো। রুবাইয়ের বাবা রাজেশবাবু এই হাসপাতালের ডাক্তার। উনি ছুটিতে থাকলেও খবর পেয়েই এসে গিয়েছিলেন।  বিকেল পাঁচটায় পুলিশের গাড়িতে ডাঃ বড়ুয়া এসে পৌঁছলেন হাসপাতালে। আচ্ছন্নতা তখনো রয়েছে। ভীষণ দুর্বল এই দু'দিনেই।

রাজেশবাবু ওঁর জন‍্য কেবিনের ব‍্যবস্থা করেছিলেন। পরীক্ষা করে স্যালাইন চালিয়ে বললেন -"ওঁকে হরমোনাল ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল কথা বের করার জন‍্য। হাই ডোজের ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়েছে। একটা রাত কাটলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন উনি। "

লাভা থানার সেই অফিসার রুবাইয়ের চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললেন -"আপকে লিয়ে আজ হাম ডঃ সাব কো ঢুন্ড পায়ে। হামারি আঁখোকে সামনে ও বাংলো মে দো দো দিন উন লোগোঁ নে উনহে রাখা। আজ সুবহ আপনে যব বোলা উসকে বাদ হামনে চুপচাপ ছাপা মারা, দো লড়কোঁ কো ভি পাকড়া। কালিম্পং থানা মে হ‍্যায় ও দো। লেকিন ডঃ সাব কুছ না বোল সকে। কুছ ভি পুছো বোলতে হ‍্যায় 'সব তথাগত কে পাস হ্যায়। সব উনকি মরজি।' "

রুবাই মন দিয়ে সব শুনছিল। রাজনের বাবা কিছুই বোঝেননি। বাকিটা খুলে বললেন রাজেশ বাবু। সকালে ঐ বাংলোর সামনে দিয়ে আসার সময় নেপালী ট্যুরিস্ট দেখে রুবাইয়ের সন্দেহ হওয়ার কথা এবং পুলিশে সবটা জানানোর কথা, যার ফলেই এত তাড়াতাড়ি ওঁকে পাওয়া গেল। রাজনের বাবা রুবাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন -"আরো অনেক বড় হও।''

রাজনও খুব খুশি।

পরদিন সকালে ডাঃ বড়ুয়ার জ্ঞান ফিরতেই সবাই ছুটে গিয়েছিল। রাতে রাজেশবাবু ছিলেন ওঁর কাছে। পুলিশ তো ছিলই, ওঁর ভাইও ছিলেন।

জ্ঞান ফিরে সবাইকে আশেপাশে দেখেও উনি খুব চুপচাপ ছিলেন। পুলিশকে জানালেন পুঁথিটার জন‍্যই ওঁকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওঁর সাথে পুঁথিটা না থাকায় ওঁকে ইনজেকশন দিয়ে সত‍্যি কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনটে ছেলে ছাড়াও তাংসুই লামা বলে একজন রোজ আসত। লোকটা সিকিমিজ। বইটা পালি ভাষায় লেখা এক যুগান্তকারী দলিল। কোনোভাবে তিব্বতের প্রাচীন মঠে উনি ওটা পান। বইটার ঐতিহাসিক মূল‍্য প্রচুর। তাংসুই-এর মাথার উপর চোরাবাজারের কোনো বড় মাথা রয়েছে। তবে সে কে উনি জানেন না। হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন এটুকু বলেই। রাজেশ বাবু ওঁকে রিল‍্যাক্স করতে বললেন। কোনো তাড়া নেই আপাতত।

পুলিশ অফিসার জানালেন ঐ তাংসুই লামাও ধরা পড়েছে রোংলি বাজারের কাছে। ওর ফোন ট্রেস করে ওকে ধরেছে সিকিম পুলিশ। কান টানলে যেমন মাথা আসে এবার পুরো দলটাই ধরা পড়বে হয়তো।

অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল রাজন। এবার বলল -"কিন্তু জেঠু পুঁথিটা কোথায় গো? ওটা তো তোমার ঘরেও নেই!!"

ধীরে ধীরে উঠে বসেন ভদ্রলোক, রুবাইকে ইশারায় কাছে ডাকেন। বলেন -"তোমার তো অনেক বুদ্ধি। আমায় তো উদ্ধার করলে। এবার পুঁথি উদ্ধার করো দেখি!''

ওঁর চোখে কৌতুক ফুটে ওঠে। রুবাই ভ্রু কুঁচকে বলে -"আমি কি করে জানব?''

-''আজকের দিনটা সময় দিচ্ছি। আমি ক্লু দিচ্ছি, ভেবে দেখো একটু,- সব রয়েছে তথাগতর কাছে, ওঁর ইচ্ছাই সব।'' মিটিমিটি হাসতে থাকেন ডাক্তার বড়ুয়া। রাজনকে বলেন -"তুই কি পারবি?''

ও মাথা নাড়ে।  সব মিটলে পুলিশরা ফিরে যেতেই ডঃ বড়ুয়ার ভাই রাজেশবাবুর সাথে আলোচনা করে ওঁর ছুটি করিয়ে নেন। রাজন ওর বাবার সাথে জ্যেঠুকে বাড়ি নিয়ে যায়।

রুবাইও বাড়ি ফিরে মাথা ঘামাতে বসে যায়। তথাগত মানে বুদ্ধ ও জানে। জেঠুর স্ট‍াডিতে বড় মূর্তি রয়েছে তথাগতর। কিন্তু তার কাছে মানে তো ঐ ঘরেই। রাজন তো খুঁজে দেখেছিল। চোরও খুঁজেছিল। কেউ পায়নি। তবে আর কোথায় হতে পারে?

নেট খুলে বসে রুবাই। বুদ্ধদেব এবং বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে পড়তে থাকে। জেঠুর বলা কথাটা মনে পড়ে। অফিসার বলেছিলেন ঘোরের মধ‍্যে এই কথাটাই উনি বলেছিলেন বারবার। এই কথাটাই টাইপ করে এবার রুবাই। ওর সামনে বেশ কয়েকটি জানালা খুলে যায়। পড়তে পড়তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রুবাইয়ের মুখ। বিকেলে রাজেশবাবু আর শ্রমণা দেবীর সাথে আবার রুবাই যায় রাজনদের বাড়ি। অনেকেই এসেছিল ডাঃ বড়ুয়াকে দেখতে। রুবাই রাজনকে নিয়ে বেরিয়ে যায় একটু। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা চলে যেতেই ওরা ফিরে আসে, ততক্ষণে অনেকেই চলে গেছে। বাড়ি প্রায় ফাঁকা।

ডাঃ বড়ুয়া অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। রুবাইকে দেখে মিটিমিটি হেসে বললেন -"ক্যাপ্টেন, কী খবর ? খোঁজ পেলে নাকি?"

রুবাই হেসে বলল -"আছে তো, তথাগতর কাছে খুব যত্নেই রয়েছে। আমি এইমাত্র দেখে এলাম। ''

রাজন সহ সবাই ওর দিকে তাকালো সাথে সাথে। রাজন বলল -"আমরা তো বুদ্ধ মন্দির গিয়েছিলাম এখনি। কোথায় দেখলি তুই?''

রুবাই হাসে জেঠুর দিকে তাকিয়ে। ডাঃ বড়ুয়া সোজা হয়ে বসেন। বলেন -"তোরা মন্দিরে গিয়েছিলি? ''

-"আগেকার দিনে যখন কেউ কোনো কাজে বাইরে যেত নিজেদের অমূল‍্য সম্পদ ধন রত্ন মঠে গচ্ছিত রাখত। তথাগতর ভরসায় সব রেখে নিশ্চিন্তে সবাই ভ্রমণে যেত। আপনিও তাই করেছেন। বুদ্ধ মন্দিরেই গচ্ছিত রেখেছেন আপনার সম্পদ। যদি আমার ভুল না হয় মূর্তির পায়ের কাছে বিভিন্ন পুঁথি ও ধর্মগ্ৰন্থর ভেতর রয়েছে ওটা।"

ডাঃ বড়ুয়ার চোখ মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে।
এগিয়ে এসে রুবাইকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। বলেন -"আমি এতটা আশা করিনি। সত‍্যিই তুমি জিনিয়াস। আমি জানতাম লাভায় ওটা নিয়ে পৌঁছনোর আগেই ওটা ওরা কেড়ে নেবে। আমার ফোন ট‍্যাপ হতো। তাই বাধ‍্য হয়ে এটা করেছিলাম। মালের মঠ এত ছোট যে কারো মাথায় আসবে না আমি ওটা ওখানে রেখেছি। কিন্তু তুমি পারলে! এবার বলো কী চাও আমার কাছে? তোমার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় আমি বাড়ি ফিরতে পেরেছি আজ।''

-"তুমি সুস্থ হলে ঐ চীন ভারত যুদ্ধের গল্পটা পুরো শুনতে চাই। এমন গল্প আরো অনেক অনেক শুনতে চাই। '' রুবাই বলে।

সবাই হেসে ফেলে ওর দাবী শুনে।

ঘড়ি মোড়ের ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত ন’টা বাজে।



(সমাপ্ত)


অলঙ্করণঃ রঞ্জন দাস


গল্পের ঝুলি : ভূতের বেগার : প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

                     



খাড়াবুরু পাহাড় থেকে সবচাইতে কাছের রেলস্টেশন পাহাড়িগঞ্জে আসতে হলে ছ’সাত ঘন্টা লাগে। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে একই পাহাড়ি নদীকে চারবার পার করার পর একটা ঘন জঙ্গল পার হতে হয়। নদী পারাপারের সুবিধে আর জঙ্গলের রাস্তায় শঙ্খচূড়ের কামড় থেকে বাঁচবার জন্য পুরোটাই আসতে হয় ঘোড়ায় চড়ে।

একটিমাত্র প্যাসেঞ্জার ট্রেন, মহানগর থেকে সকালে এসে সন্ধেতে ফেরে। মহানগর যাবার এই ট্রেন ধরতে খাড়াবুরু ক্যাম্প থেকে ভোরবেলায় বেরিয়ে বিকেল নাগাদ পাহাড়িগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছালাম।

ওয়েটিং রুমের চাবি চাইতেই স্টেশন মাস্টার খবর দিলেন যে লাইনে ধস নেমেছে। সন্ধের প্যাসেঞ্জার কাল ভোরের দিকে আসতে পারে। এই লাইনে এটা প্রায় হয়। ওয়েটিং রুমও সেই কারণে বেশ বড়। রাতের শোয়া থাকার বন্দোবস্ত, এমনকি রেলের ওপর মহলে অলিখিত বোঝাপড়ার দরুন ওয়েটিং রুমের আঙিনায় আমাদের কোম্পানি রান্নাঘরের একটা চালাও বানিয়ে নিয়েছে।

মাস্টারমশাই বললেন ওয়েটিং রুমে সেই দুপুর থেকে আর এক বাঙালি প্যাসেঞ্জার শঙ্করবাবু আছে।  লোকটি ঘরে চাবি দিয়ে ওয়েটিং রুমের সহকারী বুধুয়াকে সঙ্গে নিয়ে বোধ করি হাটে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। 
হাটের কথায় মনে পড়ল আজ বুধবার। এই তল্লাটের সবচাইতে বড়ো হাট, এই স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তায় একটু গেলেই শুরু হয়।
সাপ্তাহিক এই হাটে আনাজ আর গ্রাম-গ্রামান্তরের টাটকা সবজিই যে বিক্রি হয় তাই নয়, বেশ কয়েকটা খাবারের দোকানও বসে।

গণেশ হালুইকরের বিখ্যাত চপ জিলিপি খাওয়া শুরু করতে যাব, দেখি বুধুয়ার সাথে একজন লোক দোকানে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কুচকুচে কালো, লম্বা,শীর্ণকায় লোকটির টিপিক্যাল বাঙালি ছাঁদের মুখ দেখে আন্দাজ করলাম এ নিশ্চয় সেই শঙ্কর।
আমার অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করে, শঙ্কর মিনিট পাঁচেক আমার কাছে বসে, রাত্রে ওয়েটিং হলে একসাথে একটু মাংসভাত খাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেল। সে  যাবার পর দেখি পাশের সারির  টেবিলে বসা দু’জন স্থানীয় লোক আমাকে দূর থেকে নমস্কার করছে। আমার কাছে এসে বসতেই চিনলাম ওদের একজনকে। আমি বললাম,
“কী খবর মংলু? বহুদিন পর দেখা হল, কেমন আছ?”

বছরখানেক আগে, পিনাক পাহাড়ে কাজ করবার সময়, এই মংলু সর্দার ছিল আমাদের লোকাল গাইড। চা খেতে-খেতে মংলু আমাদের ক্যাম্পের সবার খবর নিচ্ছিল । হঠাৎ গলার স্বর নামিয়ে বলে,
“সাহেব, একটু আগে রেলের বুধুয়ার সাথে যে বাঙালি বাবু ছিলেন, তার সাথে কতদিনের জান-পহচান?”

আমি অবাক হয়ে বলি,
“এই দোকানেই আলাপ। ওয়েটিং হলে উঠেছেন আমার আগে। তুমি চেনো নাকি ওঁকে?”

“ আলাপ নেই সাহেব। কিন্তু লোকটা সুবিধের নয়। আমার সঙ্গের এই বন্ধুর কাছেই শুনুন ওঁর কীর্তি কাহিনী।”

মংলুর বন্ধু বলে,
"সাহেব, এই লোকটা আজ প্রায় একমাস আগে আমাদের গ্রামে আসে। আমাদের প্যাটেলকে (মোড়ল) পটিয়ে নিয়ে ও আমাদের মারাং থানে (আদিবাসীদের দেবতাদের বেদী) এসে একটা পুতুল বার করে কিসব মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে, বেশ কয়েকদিন ধরে পুজো করতে থাকে।"

আমার দেখা অরণ্যের আদিবাসীরা অত্যন্ত খোলা মনের লোক। গ্রামের মোড়লের অনুমতি থাকলে, ওঁদের দেব-দেবীদের থানে এসে পুজো যে কেউ করতে পারে। সে আদিবাসী না হলেও কিছু যায়-আসে না।
মংলুর কথা শুনে আমি বলি,
“তাতে দোষের কী আছে?”

মংলু বলে,
“সাহেব, আমার এই বন্ধু দেখেছে যে ওই লোকটা  তার পুজোর শেষদিনে অনেকক্ষণ ধরে মন্ত্র পড়ে একটা বড় মানুষ-পুতুল থানে ছেড়ে দিয়ে নিজে পাশের ঝোপে লুকিয়ে ছিল”। 

আমি কিছুটা আন্দাজ করলাম, কিন্তু পুরোটা আগে শুনে নিই। তারপর কিছু না হয় বলা যাবে মংলুকে।
মংলুর বন্ধু  বলে, “সাহেব, এরপর ওই মানুষ-পুতুলটা একবার এগোয়, একবার পিছোয়, শেষটায় মারাংকে (বড় শিলা, যাকে ওরা দেবী বলে মানে) চারপাশ ঘুরে একদম মাটিতে পড়ে শুয়ে থাকল। আর এই লোকটা তখন পুতুলটাকে তুলে নিজের ঝোলায় পুরে ফেলল।”
মারাং-থানে থাকে এক বিশাল শিলা। সেটি একটি বড়ো গাছের তলায় থাকে। শঙ্কর, মনে হচ্ছে, এই গাছে বা মারাং-শিলাতে কোনও পোকামাকড়, বা  কোনও পাখি দেখেছে।
এদের আওয়াজ রেকর্ড করবার জন্য টেপ-রেকর্ডার আর কোনও মেশিন লাগানো রিমোট পুতুল টাইপের রিসিভার লাগিয়ে দিয়ে আড়ালে ছিল। আমি শুনেছি এই রকমের আওয়াজের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে খুব চাহিদা আছে। সেইসব কাজ করছে বোধহয়।

আমি কিছু বলছি না দেখে মংলুর বন্ধু বলে, “মারাং এর সাথে থাকবার আর পুজো পাবার জন্য বেশ কিছু অশরীরীরাও, সেখানকার গাছের ডালে বা মারাং এর চারপাশে থাকেন। সাহেব, এই মারাং-তলায়, প্রতি বুধবার, মারাং চোঁতাই (আদিবাসীদের পুরোহিত)-এর ওপর, এইসব আত্মাদের ভর হয়। এরা গ্রামের লোকদের রোগে-অসুখে, জড়িবুটির নিদান বা নানা বিপদ-আপদের খবর চোঁতাই-এর মুখ দিয়ে বলে দেয়। 
কিন্তু এই লোকটা যাবার পর, মারাং চোঁতাই-এর ওপর, এঁদের ভর হয়নি। জড়িবুটির নিদান আর আপদবিপদের সাবধানবাণী জানতে না পেরে সাধারণ মানু্‌ষ, একটু ভয়ে-ভয়ে আছে।"

মংলু বলে, “ এইরকম কখনো-কখনো যে হয় না তা নয়। তবে সেটা বসন্তকালে। দেবী তখন মহাদেব পাহাড়ে যান, তাঁর ভৈরবের সঙ্গে হোলি খেলতে। সেই সময় এদিক-ওদিক ঘুরে অশরীরীরা নতুন সঙ্গী-সঙ্গিনীর খোঁজ করে । আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এই লোকটার পুতুলে কোনো জাদুর ফাঁদ নেই তো?"

আমি বলি “তার মানে?”

মংলু বলে “ সাহেব এই অপদেবতারা বা অশরীরীরা কিন্তু অনেকটা আমাদের মতো । সেইরকম শক্তিমান কোনো সিদ্ধাই কোনো কিছুর লোভ দেখালে এরা তার বশে এসে তার সঙ্গে চলে যায়। অনেক আগে এইরকম ব্যাপারটা লোহাগাঁওয়ের লোকেরা করেছিল। কিন্তু অপদেবতারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে, ফিরে এসেছিলেন”।

এই জঙ্গলে, সাপ ধরতে অনেক লোক আসেই। এছাড়া, বেশ কিছু লোক এখান থেকে বাঁদর বা পাখি ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে অপদেবতা বা ভূত কি বাঁদর না পাখি যে তাকে ফাঁদে ফেলে ধরে নিয়ে যাবে কেউ?   

আমাদের ওপর খুব কড়া নির্দেশ আছে, কোনো অবস্থাতেই স্থানীয় লোকের বিশ্বাসে ঘা দিয়ে কোনো মন্তব্য যেন না করি। এই কারণে, ওদের মুখে যা শুনলাম তাতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করলাম।

***********
ওয়েটিং হলের বাথরুমে পাহাড়ি ঝরনা থেকে হিমশীতল ঠান্ডা জল আসে। সেই জলে ভালো করে স্নান করতেই সারাদিনের ক্লান্তি মুছে গেল। হলের বাইরে বাঁধানো গাছতলাটায় যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম শঙ্কর ওয়েটিং হলে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।

ব্যাপারটা বেশ চোখে পড়ার মতো। গভীর রাতেও এই ওয়েটিং হলে ঠাণ্ডা বাতাস পাবার জন্য আমরা কেউ কখনো দরজা লাগাই না। তবে কি সত্যি সত্যি এই শঙ্করের কোনো রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার আছে?
আজ অন্ধকার পক্ষ। আকাশ থেকে এক বোতল কালি চারদিকে ছড়িয়ে, আঁধার নামলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে শঙ্কর রিটায়ারিং রুম থেকে বেরিয়ে  আমার কাছে এসে বসলো। একটু পরে আমাকে ও বলে “রাতের রান্নার কিছুটা এগিয়ে রাখলাম”।

আমি শঙ্করকে বলি,
“চলো, তোমাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করি। অবশ্য আমি বিশেষ কিছু পারি না।”
শঙ্কর বলে “ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। চা এসেছে আপনার জন্য, খেয়ে দেখুন।”

টর্চের আলোয় দেখি, ট্রে-তে, রীতিমত টিকোজি ঢাকা টি-পটে, চা এনেছে। চা জিভে আসতে মনে হল এ তো রংলি-রংলিয়টের বাগানের। অরেঞ্জ পিকো চা-পাতার ভুরভুরে গন্ধওয়ালা চা।
হঠাৎ মনে পড়লো, শঙ্কর বলছিল, চা এসেছে আপনার জন্য। এই চা এইখানে আনলে কে? আমি স্পষ্ট দেখেছি শঙ্কর এখানে এসেছে একদম খালি হাতে। হতে পারে এই গভীর অন্ধকারে আমার দেখায় কিছু ভুল হয়েছে।
চা খেতে-খেতে শঙ্কর অকপটে বলছিল নিজের জীবনের কথা।

অনাথ আশ্রমে কেটেছে ওর শৈশব। তারপর রুজির কারণে একাধিক পেশা। শেষটায় কপাল ঠুকে হাইওয়ের ধারে ধাবা। একসময়ে, ভাতের হোটেলে কাজ, আর লাইন-ট্রাকে খালাসি থেকে ড্রাইভার হবার কর্মজীবনের সূত্রে, কম পুঁজি দিয়ে ছোটো ধাবা শুরু করে। কিন্তু বড়ো ধাবার মালিক হতে তার বেশি দেরি লাগেনি।

এই ধাবাতেই আলাপ হয়ে যায় এককালের জমিদার বংশের সন্তান জিগনেস সিংহের সাথে। এর এখন অনেক প্যাসেঞ্জার গাড়ি আর ট্রাকের বিজনেস আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে জঙ্গলের ভেতর পূর্বপুরুষদের এক শিকারবাড়ি পেয়েছে, জিগনেস শঙ্করকে বলে যে শঙ্কর চাইলে দুজনে যৌথ মালিকানায় সেখানে রিসর্ট খুলতে পারে। শঙ্কর হোটেল আর রেস্তোরাঁ চালাবে।

জিগনেসের গাড়িগুলোতে এয়ারপোর্ট অথবা স্টেশন থেকে পর্যটকদের আনাগোনা চলবে।

জঙ্গলে পাহাড়ের চুড়োর কাছে এই শিকারবাড়ির ছাদ থেকে পুরো জঙ্গল, আর এঁকেবেঁকে যাওয়া এক পাহাড়ি নদী দেখা যায়। এই রকম জায়গায় আসা-যাওয়ার সুযোগ-সুবিধে থাকলে লোকের অভাব হয় না। এছাড়া বিদেশী পর্যটকরাও এই জায়গাটাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করলো।

সমস্যা দাঁড়ালো হোটেলে কর্মীর অভাব নিয়ে। চার-পাঁচগুণ বেশি মাইনে, ভালো থাকা-খাওয়ার সুযোগ সুবিধে দিয়েও এই বন-জঙ্গলে কাজ করতে লোকে আসতেই চায় না, তার ওপর আর এক ভয়।

কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যেতে অন্ধকার আরও চেপে বসেছে। নিজের হাত পা দেখা যাচ্ছে না। শঙ্করের আওয়াজ একবার বাড়ছে, একবার কমছে। এই অন্ধকারে ও কথা বলার সময় চলছে কী করে? তাহলে কি মংলু ঠিকই বলছিল এর ব্যপারে? এই শঙ্কর মনে হয় সিদ্ধাই না হলেও তার আশেপাশে কিছু একটা হবে। নয়তো এইরকম মিশকালো আঁধারে ও দেখতে কী করে পায়?

মনের ভয় মনে চাপলেও আমি একটু কাঁপা গলায় শুধালাম,
“ভয়ের কী ব্যাপার হল? চিতাবাঘ হামলা করেছিল নাকি?"

শঙ্কর বলে, “সে হলে উপায় তো ছিল। কিন্তু এঁদের থেকে কিছু তো করার নেই । তবে বিদেশী গেস্টদের খুব ভালো লাগতো এঁদের উপস্থিতি।”

“ব্যপারটা খোলসা করে বলুন তো।”   

শঙ্কর বলে, “পুরানো আমলের কিছু লোকজন এই শিকারবাড়িতে অশরীরী হয়ে এখনো রয়ে গেছেন। তাঁদের উপস্থিতি আমাদের কাজের লোকজন টের পেতে থাকলো আর পালালো। শেষটায় এমন হল যে, কাজের লোকের অভাবে গেস্টদের সবাইকে সসম্মানে এয়ারপোর্ট বা স্টেশন ছেড়ে আসতে হল। গেলেন না শুধু এক স্কটিশ গেস্ট, ব্লেয়ার সাহেব। শেষ অবধি ওঁর জন্যই হোটেল আবার চলতে লাগলো বেশ রমরমিয়ে।”

ব্লেয়ার সাহেব কী নিদান দিয়েছিলেন, সেটা জানবার আগেই, পুরো জায়গাটা মাটন কাটলেটের সুগন্ধে ভরে উঠল। সেই সময় পাইলট ইঞ্জিনের আলো এসে পড়ায় শঙ্করের মুখ দেখা যাচ্ছিল। শঙ্করের পেছনে কে একজন একটা ঢাকা দেওয়া ট্রে আনছে। শঙ্কর আমার কাছে এসে বসে বলে, 
“তখন শুধু চা খাওয়ালাম। এখন এই কয়েকখানা কাটলেট খান। আপনার প্রিয় কফি আসছে এরপর।”

কিন্তু এ কী! ইঞ্জিনের সার্চ লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ট্রে এগিয়ে আসছে, কিন্তু শূন্যে। এতো জোরালো আলোতেও ট্রে কে আনছে দেখা যাচ্ছে না। লাইট ইঞ্জিন আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় দেখলাম বাঁধানো গাছতলায় যেখানে আমরা দু’জনে বসেছিলাম, খুব নিপুণ ভাবে অদৃশ্য কেউ আমাদের দুজনের মাঝখানে মাটন কাটলেটের ঢাকা দেওয়া ট্রে রাখল। 

আমার পা থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনে হল শরীরটা নিস্পন্দ হয়ে গেছে।  সাড়ে চার বছর অরণ্যবাস করছি। বহুবার বাঘ, পাইথন, জংলি শুয়োরের সাথে সামনাসামনি দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু এইরকম অবস্থা আমার কখনো হয়নি।
কিন্তু শঙ্কর নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি এইরকম ভাবখানা করে সে মাটন কাটলেটের প্লেটের ঢাকনা খুলে কাঁটাচামচ আর ছুরি ধরে একটুকরো মুখে পুরে নিলে।

আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে শঙ্কর বলে,  
“যা দেখলেন তা নিয়ে বেশি ভাববেন না। এসব সেই ব্লেয়ার সাহেবের অবদান। আপনি নির্ভয়ে কাটলেট খান আর খেতে খেতে ব্লেয়ার সাহেব কীভাবে আমার রিসর্ট বাঁচিয়ে দিলেন সেই কাহিনীটা শুনুন।”

আমার মনে পড়ে গেল, একটু আগে শঙ্কর বলছিল বটে, জঙ্গলের মধ্যে তার রিসর্টে অশরীরীর উৎপাতের কথা, যা এই ব্লেয়ার সাহেবের জন্যই মিটে যায় এবং রিসর্ট আবার রমরমিয়ে চলতে থাকে।

আমি কাটলেট শেষ করে দেখি কফি আসছে, ঠিক সেই মাটন কাটলেটের ট্রে নিয়ে আসার  মতো। যে আনছে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। এবার আর ভয় করছিলো না,  হঠাৎ কাপে চামচের আওয়াজে চমকে উঠি।

শঙ্কর বলে, “ওয়েট্রেস জানতে চাইছে কফি আপনি বানিয়ে নেবেন না ও বানিয়ে দেবে?” 
'মিস্টার ইন্ডিয়া' সিনেমার মতো একটা শো দেখা যেত কিন্তু সাহসে কুলালো না। নিজে বানাবো জানালাম।

একটা হাল্কা ফরাসি পারফিউমের গন্ধ মিলিয়ে যেতেই শঙ্কর হেসে বলে, “স্যার, দিতিয়েনের হাতের কফি একবার খেলে সহজে ভুলতে পারতেন না। খাঁটি ফরাসি কায়দায় বানান। উনি ফ্রান্স থেকে এদেশে আসবার সময়, বিমান দুর্ঘটনার পর আমাদের কাছেই রয়ে গেছেন। উনি আমার হোটেলের একজন অন্যতম শেফ এবং ভি. আই. পি. গেস্টদের ওয়েট্রেস।”

নাঃ, এই শঙ্কর দেখছি একথা-সেকথায় ব্লেয়ার সাহেব কী নিদানে ওর রিসর্ট বাঁচিয়েছিলেন সেটা এড়িয়ে যেতে চাইছে । কিন্তু আমিও ছাড়বার লোক নই।
 আমি বলি,
"শঙ্কর, এবার কিন্তু ব্লেয়ার সাহেবের কথাটাই বলো।”

কফিতে চুমুক দিয়ে ও সেই কাহিনী বলতে শুরু করলো।

“পুরো হোটেলে তখন শুধু ব্লেয়ার সাহেব আর আমি। এক রাতে খেতে- খেতে ব্লেয়ার সাহেব আমায় শুধালে, “ স্যাঙ্কি, এই হোটেলে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড সেলার আছে কি?”

সাহেব-গেস্টদের সাথে আলাপের দরুন আমি বুঝে গেলাম ব্লেয়ার সাহেব কী বলছে। আমি মাথা নাড়তেই, ও বলে, “তুমি না জানলেও, টুমরো মর্নিঙে আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব এই বিল্ডিঙের কোথায় আছে সেটা।”

পরদিন ভোরবেলাতে সাহেবের সাথে নেমে পাতালঘরের একদম নিচে পাওয়া গেল অক্ষত অবস্থায় শ্রী শ্যাম-রাইয়ের যুগল অষ্টধাতুর  মূর্তি, নৃত্যরত মুদ্রায়। সেইসাথে আরও আটটি নারী-পুতুল।
সাহেব আমায় বললে যে এই মূর্তিগুলি শিকার বাড়ির পিছনে যে বিগ্রহহীন মন্দির আছে সেখানে রাখতে । ব্লেয়ার সাহেবের কথা অনুযায়ী, হয়তো কোনো লুটেরা দস্যুর হাত থেকে বিগ্রহকে রক্ষা করতে এই বাড়ির মালিকেরা এঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন আর সাথে দিয়েছিলেন এই আটটি সঙ্গী ও সঙ্গিনী।

সাহেব শোনালে, তার গ্রামে এইরকম এক প্রাচীন দুর্গে ভূত আছে বলে শোনা যেত। সেখানে এইরকম পাতালঘরে কিছু মূর্তি পেয়ে উনি সেগুলো দুর্গের  গির্জাতে নিয়ে আসেন। এই মূর্তিগুলি অত্যন্ত পবিত্র এবং এতে অশরীরীরা প্রবেশ করলে তাঁদের মুক্তি হয়।   
শঙ্কর আমার দিকে চেয়ে বলে “সাহেবের কথা আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। কিন্তু ওঁর কথা অনুযায়ী কাজ করে দারুণ সব ব্যাপার ঘটতে লাগলো।”

আমি শুনছিলাম শঙ্করের সব কথা। কফির কাপের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখি, সেটা কখন শেষ করে ফেলেছি নিজেই জানি না।

শঙ্কর বলে “ স্যার, পটে অনেক কফি আছে, আপনাকে আর এক কাপ দিয়ে দিই। কফি খেতে খেতে শুনুন বাকিটা।”

পাতালঘর থেকে ফিরে ব্লেয়ার সাহেবকে দুপুরের লাঞ্চের জন্য কোনোমতে দু’খানি হাতে-গড়া রুটি আর স্যুপ সার্ভ করে ঘুমিয়ে গেছিলাম। ঘুম যখন ভাঙ্গে, দেখি বিকেল পার হয়ে গেছে। সাহেব এই সময় কফি আর স্যান্ডউইচ খায়। দেরি হয়ে গেছে ভেবে নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে কিচেনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। দেখি ব্লেয়ার সাহেব কিচেনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি, লজ্জিতস্বরে কিছু বলবার চেষ্টা করার আগেই সাহেব বলে উঠলো, 
“স্যাঙ্কি, স্ট্রেঞ্জ থিং হয়েছে। আমি বিকেলে বরাবরের মতো, ঝরনার ধারের বাঁধানো গাছতলায় বসে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, এটা তো আমার কফি খাবার সময়। শ্যাঙ্কির তো ভুল হয় না।
চোখ তুলে দেখি, প্রায় মানুষের কোমরের সমান উচ্চতায় একটি কফি আর স্যান্ডউইচ সমেত হোটেলের ট্রে আসছে, কিন্তু কেউ কোথা নেই। ট্রে সাবধানে গাছতলার সিমেন্টের বেদীতে নেমে এলো। কফি এতটুকুও ছলকে পড়লো না। আমার কফি আর স্যান্ডউইচ খাওয়া হতেই ট্রে যেভাবে এসেছিল  সেভাবেই ফিরে গেল কিচেনের দিকে।”
আমি ব্লেয়ার সাহেবের কথা শুনে কিচেনে গিয়ে দেখি, সারা কিচেন স্যান্ডউইচ গ্রিল করার গন্ধে ম-ম করছে। কফিসেট আর গ্রিল মেশিন দেখে বুঝলাম সেগুলো সদ্য ধোওয়া।  তবে আমি বিস্মিত হলেও সাহেব কিন্তু নির্বিকার।

সন্ধে হতেই দেখি, আবার আগের মতো সব ক'টা দেওয়াল-গিরি জ্বলে উঠেছে। ব্লেয়ার সাহেব হোটেলের ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। 
আমায় দেখে বলে, 
“ এক্সেলেন্ট ডিনার স্যাঙ্কি, গো ইনসাইড। দারুণ রান্না করা ডিনার তোমার জন্য অপেক্ষা করছে”।

ভেতরে গিয়ে দেখি, আমার রেস্তোরাঁর পুরানো গোয়ানিজ কুকের মতো সেভেন কোর্স ডিনার তখনো গরম আছে। ভয়ে ভয়ে চেখে দেখি, প্রতিটি পদ কন্টিনেন্টাল, আর পাকা হাতের রান্না।

সাহেব বাইরের বাগানে বসে ছিল। আমাকে ঈশারায় ডেকে বলে, 
“জয়েন মি হিয়ার, স্যাঙ্কস। আমার ইন্টিউশন বলছে সামথিং মোর স্ট্রেঞ্জ উইল হ্যাপেন। একটু অপেক্ষা করে দেখো।”

সাহেব তার স্কটল্যান্ডের গল্প করছিল। সেখানে এইরকম অনেক  হানাবাড়ি আর দুর্গ আছে।  এইরকম পবিত্র পুতুল রেখে দিলে সেখানের অশরীরীরা খুশি হয়ে ঘরবাড়ি, দুর্গ এইসব পরিষ্কার করে রাখে। সাহেবের এইসব কথা শুনে আমি ঢুলছিলাম মাঝেমাঝে।
সাহেব আমার পিঠে হাল্কা চাপড় দিয়ে বলে, 
“স্যাঙ্কর, গেট আপ, শুনতে কিছু পাচ্ছ”?

শিকার বাড়ির পেছনে সেই পুরানো মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে।  মাঝে মাঝে  মৃদঙ্গ-খোল-করতাল-খঞ্জনি বেজে উঠছে।

সাহেব আর আমি এরপর মন্দিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে যাই। দেখি সবক'টা দেওয়ালগিরি জ্বলছে। আটচালাতে ঢাকা দিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা বাদ্যযন্ত্রগুলোর একটাও নেই। যে বিগ্রহ আমি পাতালঘর থেকে এনে নিজে মন্দিরের ভেতরে সিংহাসনে বসিয়েছিলাম,  সেটি এখন নাটমন্দিরে। সেই আটটা পুতুল হাত নামিয়ে-উঠিয়ে, কখনো বা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, বিগ্রহকে গোল করে ঘিরে মেলার কাঠপুতলির নাচের মতো নেচে চলেছে। সুরেলা মধুর বংশীধ্বনি হচ্ছে আর সেইসাথে মৃদঙ্গ, শ্রীখোল আর খঞ্জনি বেজে চলেছে। 

আমরা একদম নিশঃব্দে তাঁদের নাচ কিছুক্ষণ দেখে ফিরে এলাম হোটেলে। আসবার পথে, আমাকে সাহেব একটা দারুণ জিনিস শোনাল, 
“স্যাঙ্কর, জাস্ট ইমাজিন, তুমি গৃহহারা হয়ে গেছ। ঘরে তোমার বেডরুম, লিভিংরুম, কিচেন সবকিছু ছিল। যেটা যেখানে থাকবার, সেগুলো সুন্দর গোছানো ছিল। কিন্তু গৃহহারা হবার পর, সব জিনিস তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন কেউ যদি তোমাকে আবার একটা ছোটোমতোও ঘর দেয়, তুমি খুব আনন্দিত হয়ে তার কোনও দুঃখ বা কষ্ট দূর করতে চাইবে। এইখানেও তাই হয়েছে”।

আমি বোকার মতো সাহেবের দিকে চেয়ে আছি দেখে সাহেব আমায় বললেন, 
“স্যাঙ্কর, আমাদের শরীরের এক-একটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ  ঘরের এক-একটা রুমের মতো। মারা গেলে শরীরের সাথে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো হারিয়ে আমরা ওই গৃহহারা মানুষের মতো তালগোল পাকানো অবস্থায় থাকি। এই হোলি পুতুলগুলো ছোটো ঘরের মতো। এইখানে ঘুরে বেড়ানো অশরীরীরা এই পুতুলগুলোর কাছে আশ্রয় পেয়ে, কিছুটা শরীরী মানুষের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে পেরে স্বস্তি পেয়েছে আর সেই আনন্দে এই গডের মূর্তিকে ঘিরে নাচছে। হতে পারে, এখানের অশরীরীরা সবাই বৈষ্ণব ছিল। জীবিত অবস্থায় তারা এইভাবে ওই হোলি গড আর গডেসের চারপাশে ঘিরে নাচত। বহুকাল পরে আবার সেই অবস্থাটা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এই সাথে তোমাকেও ওরা ভোলেনি। ওরা দেখেছে কাজের লোকজনের অভাবে তোমার হোটেল এখন বন্ধ হতে চলেছে। তাই ওরা এগিয়ে এসেছে তোমাকে হেল্প করতে। ওরা এই হোটেলের কুকিং, ক্লিনিং, রুম-সার্ভিসিং এইসব কাজ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।”

আমি বললাম, “ব্লেয়ার সাহেব, গেস্টরা যখন দেখবে এসব, তখন তো তাদের অর্ধেক হার্টফেল করে মারা যাবে, আর আমাকে তো জেলেই পচতে হবে।”

ব্লেয়ার সাহেব বললেন, 
“আজ বিকাল আর পরে সন্ধ্যেবেলাতে যা দেখলাম, তা একটা রেয়ার ওয়ান্ডারফুল একসাইটিং অভিজ্ঞতা। আমি তোমাকে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, পৃথিবীর অন্য কোথাও এইরকম ম্যাচিং আরণ্যক পরিবেশে, যেখানে অদৃশ্য সার্ভাররা তোমাকে তোমার রুমে বা ডাইনিং হলে খাবার পরিবেশন করছে বা পুরো রিসর্ট ক্লিন করছে, এইরকম ভৌতিক শিহরণ পাওয়া দৃশ্য দেখা যাবে না। এই দেখতে, আমাদের দেশ থেকে প্লেন ভর্তি লোকেরা আসবে।  এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিতে তারা আসবেই আসবে।”

আমি বিস্মিত হয়ে বলি, “তার মানে এখানে গেস্টের অভাব কখনো হবে না!”

ব্লেয়ার সাহেব নিজের মোবাইল হাতে নেবার আগে আমায় বললেন, “আগামী একমাসের জন্য আমি তোমার সব ঘর বুক করে নিলাম। ফুল পেমেন্ট অ্যাডভান্স করে দিচ্ছি”।

ব্লেয়ার সাহেব একঘণ্টা পরে আমাকে বললেন, 
“কাল এয়ারপোর্টে সকাল আটটার আগে দশটা স্করপিও পাঠিও। আমার চল্লিশজন বন্ধু, যাঁরা এখন ইন্ডিয়া ট্যুর করছেন, তাঁরা আমার কাছে খবর পেয়ে কালই আসছেন।”

শঙ্কর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, 
“চল্লিশজন গেস্টদের কে বা কারা সামলালো তা আপনি বুঝতেই পারছেন। এঁরা স্বেচ্ছায় লিখিত গ্যারান্টি দিয়েছিলেন যে, এই হোটেলে তাঁদের বসবাসকালে, তাঁদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির কোনোপ্রকার দায়দায়িত্ব হোটেলের ওপর বর্তাবে না। সেই থেকে আমার হোটেলে গেস্টদের মালপত্র রুমে নিয়ে যাওয়া থেকে, তাঁদের রুম সার্ভিস বা ডাইনিং হলে অর্ডার নেওয়া, সার্ভ করা, দেশি- বিদেশি রান্না করা, এইসব কাজ অশরীরীরাই করে থাকে।
মন্দিরের বাইরে গ্যালারি মতো বানিয়ে দিয়েছি। প্রতি সন্ধেবেলায় হোটেলের গেস্টরা বিগ্রহকে ঘিরে কাঠপুতুলের নাচ অবাক হয়ে দেখেন। এছাড়া এখানকার অরণ্যের নয়ন-মনোহর শোভাও তারা তারিয়ে তারিয়ে দেখেন। ফাঁক-ফুরসত আর হানাবাড়ির খবর পেলে আমি কাঠপুতুলদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সেইসব হানাবাড়িতে থাকা অশরীরীদের কেউ যদি এইখানে আসতে চান, তবে আমার সাথে যে পুতুলেরা থাকে তারা তাদেরকে নিজের অঙ্গে মিশিয়ে নেয়।”

আমি শঙ্করকে বলি, “এই অরণ্যের আদিবাসী গ্রামগুলোতে তুমি তাহলে এই পুতুল নিয়ে এইজন্য ঘুরেছ।”

শঙ্কর বলে, “এঁরা অরণ্যের আদিবাসী, অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। আমি প্রতিটি মারাং-থানে গিয়ে ওঁদেরকে আমার হোটেলের চারপাশে আরণ্যক পরিবেশে ঘুরে বেড়াবার আমন্ত্রণ দিয়েছি। যাঁরা আসতে চেয়েছেন, তাঁরা ওই কাঠপুতুলের মধ্যে চলে এসেছেন। এঁরা এই রিসর্টে এসে থাকবেন আর নতুন আরণ্যক পরিবেশে ঘুরে বেড়াবেন। পরে এরা যদি খুশি হয়ে গাইড হতে চান, তাহলে রিসর্টের গেস্টরা, যাঁরা এইখানের চারপাশের অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে চান, তাঁদের নিরাপদে ঘুরিয়ে আনতে পারবেন।”

আমি আর থাকতে না পেরে বলেই উঠি, “ শঙ্কর তুমি তো দারুণ প্ল্যান এঁটেছ!”

একটু নীরবতার পর শঙ্কর বলে,
“ স্যার, ডি. এফ. ও. সাহেব বলছিলেন, আপনি একজন নামডাকওয়ালা জিওলজিস্ট তো বটেই, সেই সাথে আপনি ঐতিহাসিক এক রাজবংশের বংশধর?”

কিছু তিক্ত স্মৃতি আছে আমার এইসব নিয়ে। আমি এইপ্রসঙ্গে বাইরের কারো সাথে আলোচনা খুব অপছন্দ করি। বিরক্তিভরে বাইরের দিকে  তাকাতে-তাকাতে শঙ্করকে বলি, 
“দেখ ভাই, ওসব অনেক পৌরাণিক যুগের কথা। আমি একজন সাধারণ মানুষ। সেইটাই এখন আমার পরিচয়। ডি. এফ. ও. সাহেব আর কী বলেছেন আমাকে নিয়ে?”

শঙ্কর বলে, “উনি যখন আপনার গ্রামের ও'দিকে ছিলেন, তখন জঙ্গলের মধ্যে পরিখা ঘেরা আপনাদের পূর্বপুরুষের রাজপ্রাসাদ আর দেবী দুর্গার মন্দির দেখেছেন। শুনেছেন সেই সাথে আরও অনেক কথা।”

শঙ্কর বলে, “ পুরোটাই বলব আপনাকে স্যার। আমি শুনেছি সেই জঙ্গলের দুর্গামন্দিরে নাকি একবার...”

আমি ওর মুখের কথা কেড়ে বলি,
“ভোগের রান্নার সব কাঁচা উপকরণ মন্দিরের ভাঁড়ার  ঘরে রাখা ছিল। রাত্রে প্রবল বৃষ্টিতে সেই মন্দিরে যাওয়া যাচ্ছিল না। সকালে বৃষ্টি থামলে লোকে গিয়ে দেখে দেবীর ভোগের রান্না সব তৈরি হয়ে গেছে।"

শঙ্কর বলে, “এই সব নাকি অনেক বছর আগে প্রয়াত এক হরুঠাকুর দেবীর ভোগ রান্না করতো, সে বানিয়েছে!”

আমি বলি, “এই ছাড়াও আমি শুনেছি, কতগুলো বিশেষ তিথিতে জঙ্গল মহালের এই দুর্গাদালানে, কারো যাওয়া নিষেধ। সেই সব রাতে সন্ধ্যারতি করতে যায় একদল লোক।  তারা নাটমন্দিরে সব ঝাড়বাতিগুলো জ্বেলে আসে। গভীর রাতে সেই আমলের প্রয়াত দেবদাসীরা নাচ করে। তবে সেই নাচ কেউ দেখবার চেষ্টা করলে তার সেখানেই মৃত্যু অবধারিত।”

ওই অন্ধকারেও মনে হল শঙ্কর আমার কথাগুলো শুনছে নয়, গিলছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 
“আপনারা এইসব অশরীরীদের মুক্তির কোনও ব্যবস্থা করেন না?”

আমি বলি, “শান্তি-স্বস্ত্যয়নে বা যাগ-যজ্ঞে তেমন কিছু ফল হয়নি। তবে ভোগ রান্না আর হয়নি। যাক, এসব পুরানো কাসুন্দি।” 
শঙ্কর বললে, “ স্যার, আপনাদের ওখানে একবার যাবো”।

বুঝলাম আমার দেশের জঙ্গলমহালের  দুর্গাদালানের  অশরীরী হরুঠাকুর আর দেবদাসীদের ও নিজের রিসর্টে নিয়ে আসবে। হরু ঠাকুরের ভোগ আর দেবদাসীদের নাচ, এই দুইয়ে বিগ্রহ আর হোটেলের কৃষ্ণভক্ত গেস্ট সবাই সন্তুষ্ট থাকবেন। ভূতেরা বেগার খাটবে আর ওর রিসর্টের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে । ভূতদের দিয়ে এইরকম কাজে লাগিয়ে নেওয়ার কাহিনী আমি আগে শুনি নি।

বিরিয়ানির সুগন্ধ টের পাচ্ছি এখানে বসেই। হ্যারিকেনের আলো এগিয়ে আসছে দেখে বুঝলাম মাস্টার সাহেব আর বুধুয়া আসছে রাতের খাবার খেতে। 

আজ সন্ধেয় চা, কফি কে বা কারা দিয়ে গেল আর  বিরিয়ানি রান্না ওর ব্যাগের মধ্যে রাখা কোন্ পুতুলের কীর্তি কে জানে? খাওয়া চুকলে একবার শঙ্করকে জিজ্ঞেস করতে হবে, এখনও পর্যন্ত শঙ্কর কতগুলো এইরকম বেগার খাটা ভূত ধরেছে? 


(সমাপ্ত )

অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস










           

গল্পের ঝুলি : তিলতিল আর মিতিল আর চড়াইপাখিরা : মহাশ্বেতা রায়





ঘুম থেকে উঠে, চোখ কচলাতে কচলাতে, টয়লেটের দিকে না গিয়ে প্রথমেই বারান্দার দিকে পা বাড়ালো মিতিল। দরজার পর্দাটা  সাবধানে সরিয়ে উঁকি দিল। শীত শেষের দিকে। তাই সকালের আলো দিব্যি ফুটেছে। সূয্যিমামা এখনো পুরো তেজে সেজেগুজে অফিস খুলে বসেননি। বেশ একটা নরম নরম আলো চারিদিকে। কোণের দিকের গ্রিলের গায়ে বাঁধা রয়েছে দুটো মাটির হাঁড়ি। মিতিল সেই হাঁড়ি দুটোর দিকে ভালো করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নাহ! আজকেও আসেনি। মনমরা হয়ে ফের বিছানামুখো হল মিতিল। ধুস... ভাল্লাগে না।


কিন্তু বিছানায় একটা পা ওঠানোর আগেই ঘরে ঢুকলেন মা।

-" গু-উ-উ-ড মর্নিং মিলুসোনা। তুমি নিজেই উঠে পড়েছ ঘুম থেকে? কী দারুণ ব্যাপার। আর দাদা এখনো ঘুমাচ্ছে? স্কুলে যেতে হবে না নাকি..."

-"ও মোটেও দাদা নয়। ও তো মোটে  দুই মিনিটের বড়..."  খাটে উঠে পড়ে বলল মিতিল।

-"আচ্ছা, ঠিক ঠিক, ও দাদা নয়...তিলুবাবু, ও তিলুবাবু, ওঠ এবার, স্কুলে যাবে না নাকি? ওঠ, ওঠ, এবার দেরি হয়ে যাবে- আজকে একটা দারুণ টিফিন দিয়েছি , চলো চলো, স্কুলে না গেলে টিফিনটার কী হবে..."- মা  বিছানা থেকে টেনে তুলে বসালেন তিলতিলকে। তিলতিল দু-হাত বাড়িয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমে তলিয়ে যেতে  লাগল। মা, ছেলের আগোছালো চুলে বিলি কাটতে কাটতে  বললেন- “আর ঘুমায় না বাবা, চলো- অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে...” । মিতিল সেই  দৃশ্য দেখে  পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে  উল্টোদিকে ফিরে শুতে শুতে মাকে বলল- "আগে আমাকেও ও'রকম করে আদর করো, না হলে আমি স্কুলে যাব না..."


তিলতিল আর মিতিল সাত পেরিয়ে আটে পা দিল। মাত্র দুই মিনিটের বড় বলে তিলতিল যদিও মাঝে মাঝেই নিজেকে বড় দাদা বলে দাবী করে, এবং সেই সুবাদে বোনকে ধমক-ধামক দেওয়ার চেষ্টা করে, মিতিল সে সবকে মোটেও পাত্তা দেয় না। তিলতিলের তুলনায় মিতিলেরই বরং মারপিট করার স্বভাবটা বেশি, বেশি ছটফটে, সব সময়ে বেশি বেশি বকবক করছে। তিলতিলের তুলনায় তার সাহসও অনেক বেশি। যখন কালবৈশাখির সময়ে খুব জোরে বাজ পড়ে , তিলতিল তখন খুব ভয় পেয়ে যায়। মা- বাবা- বীণাপিসি, যাকেই সামনে পায়, জাপ্‌টে ধরে বসে থাকে; মিতিলের সে সব বালাই নেই। কিংবা গরমকালে সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে গেলেই তিলতিল একেবারে চিল চিৎকার জুড়বে, "আলো কই, আলো কই" করে। কিন্তু মিতিল তখন ছুটবে ব্যালকনিতে। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, শুধু লোকজনের কথাবার্তা হইচই শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না, অনেক দূরে  লম্বা লম্বা বাড়িগুলোর জানলায় সাদা, হলুদ আলো জ্বলছে - এসব দেখতে তার দারুণ লাগে। একটু একটু ভয় করে ঠিকই। বীণাপিসি একবার বলেছিল অন্ধকারে ভূত বেরোয়। কিন্তু মা সেদিন বীণাপিসিকে বকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভূত -টুত কিছু হয় না। ওসব মানুষের কল্পনা শুধু। তাছাড়া গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখেছে  মিতিল। সেখানে তো কত্ত ভূত। কই, তারা তো কেউ খারাপ না, বা ভয় দেখায় না। বরং ভূতের রাজা কেমন দিব্যি সব বর-টর দিলো গুপী বাঘাকে। তাছাড়া মা বলেছেন, আরেকটু বড় হলে, একটা বই পড়তে দেবেন। সেই বইটা ভর্তি শুধু ভালো ভূতেদের গল্প। মা যখন তিলতিল-মিতিলের মত ছোট্ট ছিলেন, তখন দাদুন বইমেলা থেকে কিনে দিয়েছিলেন বইটা। সেটা পড়েই তো মায়ের ভূত-টুত নিয়ে একদম ভয় নেই।

ভূতের ভয় অবশ্য তিলতিলেরও নেই। কিন্তু অন্ধকার হলে, বা বাজ পড়লে কীরকম মনে হয়, এই বুঝি আর মা'কে দেখতে পাবে না, বাবাকে দেখতে পাবে না, মিতিলকে দেখতে পাবে না। তাই সেরকম কিছু হলেই তিলতিল নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে, ততক্ষণ যতক্ষণ না মা এমারজেন্সি লাইট জ্বালাচ্ছেন। আলো এসে গেলে, সবাইকে দেখতে পেলেই সে আবার একদম সাহসী তিলতিল। বাবা মাঝে মাঝে বলেন- “তোর মা তোর নাম তিলতিল শুধু শুধুই রাখলেন। তুই তো মোটেও সেই তিলতিলের মতো নোস। তার কত সাহস ছিল! আর তুই কিনা লোডশেডিং হলে ভয় পাস।”

এই কথা শুনে তিলতিল মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। একে তো তিলতিল নামটা তার মোটেও পছন্দ নয়। কীরকম মেয়েদের মত নাম। ঋজু, অর্ক, বাবাই, দীপ- সবার কিরকম বেশ ছেলে ছেলে নাম। আর তার নামটা দেখ একবার- তিলতিল! মা যে কী না! নতুন কেউ তাকে আজকাল তার ডাকনাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে “তিলু”- অন্তত এটা একটু ছেলে ছেলে নাম। কী দরকার ছিল সেই 'নীল পাখি' গল্পের তিলতিল আর মিতিলের নামে তাদের দুজনের নাম রাখার? মা অবশ্য কারণটা বলেছেন অনেকবার। সেই মা যখন অনেক ছোট ছিলেন, তখন মা 'নীল পাখি' নাটক দেখেছিলেন। সে হল দুই সাহসী ভাই-বোনের গল্প, যাদের নাম তিলতিল আর মিতিল। তারা দুজনে এক ছদ্মবেশী পরীর আদেশে তার অসুস্থ মেয়েটাকে সুস্থ করার জন্য নীল পাখি খুঁজতে যায়। তাদের সাথে সঙ্গী হয় ঘরের আলো, ফায়ারপ্লেসের আগুন, রুটি, দুধ, পোষা কুকুর, বেড়াল সবাই। গল্পটা মা বলেছিলেন একবার। আসল গল্পটা ফরাসী, লেখকের নামটা বেশ খটোমটো, সে আর এখন তিলতিলের মনে নেই। মা বলেন, সেই গল্পটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই যেদিন তিলতিল আর মিতিলের জন্ম হল, ভাই-বোন দুজনকে একসাথে দেখে মা তখনি তাদের নাম দিয়ে দেন তিলতিল আর মিতিল। তিলতিল যখন মাঝে মাঝে মায়ের বুকের কাছে শুয়ে অনুযোগ করে- “তুমি আমার এ'রকম নাম রাখলে কেন?" মা তখন তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে বলেন- “তোরা যে আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট্টবেলা রে - তাই তো তোদের নাম রেখেছি ছোট্টবেলার ভালোলাগা স্মৃতির সাথে মিলিয়ে...তোর পছন্দ নয়?"- বলতে বলতে মায়ের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে, তখন তিলতিলের বুকের ভেতরটা কেমন শুকনো-শুকনো কষ্ট কষ্ট হয়, আর সে মা'কে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে- “না, না, আমার খুব পছন্দ এই নাম, আর বদলাতে হবে না।”

(২)

শীতের ছুটিতে দাদুন-দিদুন এসেছিলেন। দাদু্ন-দিদুনের কাছে তিলতিল-মিতিলের যাওয়া একটু কমই হয়। বাবা-মায়ের কাজ, স্কুলের পরীক্ষা এইসবের ফাঁকে ছুটি আর কতটুকুই বা পাওয়া যায়? তাই  দাদুন-দিদুনই সুযোগ পেলে চলে আসেন তাদের কাছে। তখন কিন্তু খুব মজা হয়। বাড়িটা সবসময় বেশ ভরা ভরা। দাদু্নের  কাছে বসে অঙ্ক করা, সায়েন্স পড়া; আর দিদুনের কাছে বসে বাংলা আর ইংলিশ। দাদুন তো স্কুলে পড়াতেন, সব ছেলেমেয়েরা নাকি খুব ভয় পেত। দাদু্ন যে খুব কড়া টিচার ছিলেন সেটা বলেছেন মায়ের বন্ধু সোনালি মাসি। সোনালি মাসি দাদুনের কাছে পড়েছেন। কিন্তু তিলতিল আর মিতিলের দাদুনের কাছে পড়তে কিন্তু একটুও ভয় করে না। কারণ দাদুন তো ওদের বকেনই না। শুধু যখন খুব মাথা ধরে, তখন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকেন। তখন বেশি কথা বলেন না, পড়াতেও চান না। তখন মায়ের কথামতো মাঝে মাঝে তিলতিল, মাঝে মাঝে মিতিল দাদু্নের  মাথা টিপে দেয়।





দাদুনের কাছে কত্ত গল্প শোনে দুই ভাই -বোন। গাছপালার গল্প, চাঁদ-সূর্যের গল্প; সোলার সিস্টেমের গল্প; দাদুনের ছোট্টবেলার গল্প; আর দিদুন নানারকমের সব খাবার বানিয়ে দেন – নাড়ু, গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া; যেবার দিদুন প্রথম মোয়া বানালেন বাড়িতে, তিলতিল আর মিতিলের সে কী উৎসাহ; গুড়ে পাক দেওয়া গরম গরম মুড়িকে কিরকম দিদুন হাতে অল্প তেল লাগিয়ে ফটাফট বলের মতো পাকিয়ে দিচ্ছেন। আর সেটা গরম গরম আর পরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা খেতেও মন্দ লাগেনি।  তারপরে সেই যে, রবিবারের সকালবেলা লুচি আর বেগুনভাজা খেতে খেতে দিদুন সেই ছড়াটা শিখিয়েছিলেন-


ফুলকো লুচি ফুলকো লুচি পেট্‌টা ফুলে ঢাক

ফুলকো লুচি ফুলকো লুচি পেটের  ভিতর ফাঁক...


এইটুকু বলেই প্লেটের ফুলকো লুচি গুলোর পেট ফাটিয়ে দিতে হবে! সেই নিয়ে তো সেদিন দুই ভাই বোনে ছোটখাটো একটা যুদ্ধই হয়ে গেল; নিজেদের থালার লুচিগুলোর পেট ফাটিয়ে শুরু হল যুদ্ধ- কে ক'টা লুচির পেট ফাটাতে পারে। দাদুনের থালা, দিদুনের থালা, মায়ের থালা সবের ওপরে ঘোরতর আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল; জলখাবার খাওয়া প্রায় মাথায় ওঠে আর কী! মিতিল আবার তার মধ্যে বীণাপিসিকে গিয়ে একটু ধমকেও এল- সবগুলো লুচির যেন পেট্‌টা ফুলে ঢাক হয়, নাহলে কিন্তু...নেহাত রবিবার ছিল, আর বাড়িতে বাবা ছিলেন, তাই বাবা যখন পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে- “কী হচ্ছে এসব-" বলে একবার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তখন দুই ভাই বোন থামলো। বাবা অবশ্য সেদিন বেশি বকেননি। দাদুন-দিদুন থাকলে বাবা বা মা, কেউই বেশি বকাবকি করেন না।

ফ্ল্যাটের ছোট্ট বারান্দায় মায়ের শখের ছোট্ট বাগান। মা বলেন “আমার কুঞ্জ”। নানারকমের পাতাবাহার। কোনোটার পাতা ঝিরিঝিরি, কোনোটা কলাপাতার মতো, একটার গায়ে আবার সবুজের মধ্যে সাদা আর গোলাপির ছিটছিট। সঙ্গে একটা নয়নতারা, একটা জবা। দাদুন এলে সেইসব গাছগুলোর পেছনে সময় দেন মাঝে মধ্যে। একটু টবের মাটি খুঁচিয়ে দেন, কোনোটার শুকনো পাতা আলাদা করে দেন। সেই করতে করতেই দাদুনের চোখে পড়ে যায় চড়াইপাখি দু'টোর দিকে। ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে বারান্দার আশেপাশে। মাঝে মধ্যে ঢুকে আসছে ভেতরে, মাঝে মাঝে গ্রিলের ওপর বসছে কয়েক মুহূর্ত, আবার উড়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তার উল্টোদিকে কাঠবাদামগাছের ডালে, আবার ফিরে আসছে তাদের বারান্দার দিকে।

চড়াই পাখি দুটোকে দেখতে দেখতে দাদুন বলেছিলেন- "ওরা বাসা বানাবার জায়গা খুঁজছে। এখন ওদের ডিম পাড়ার সময়..."

তাই শুনে তো তিলতিল আর মিতিলের চক্ষু চড়কগাছ। অ্যাঁ, তাই নাকি? কিন্তু গাছের ডালে বাসা না বেঁধে ওরা ব্যালকনির কাছে জায়গা খুঁজছে কেন?

"চড়াই পাখিরা গাছের ডালে বাসা বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে এইরকম পাকা বাড়ির আনাচে-কানাচেও বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। সেই যে তোমাদেরকে গল্প বলেছিলাম, মনে নেই?"

"সেই চড়াই আর চড়নীর গল্প?" মিতিল বলে;

"হ্যাঁ হ্যাঁ... চড়াই আর বাঘের গল্প... কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো  ওইরকম মাটির ইয়ে ঝোলানো নেই; তাহলে ওরা বাসা বাঁধবে কী করে?" তিলতিল প্রশ্ন করে।

"ইয়ে আবার কী?" দাদুন হা হা করে হেসে উঠেছিলেন।

"ভুলে গেছি...ইয়ে...কলসী” লাজুক লাজুক মুখে হেসে উত্তর দিয়েছিল তিলতিল।

"কলসী না, হাঁড়ি, সেই গল্পে যেটার কথা লেখা ছিল সেটা হাঁড়ি। কিন্তু তোমাদের এই ফ্ল্যাটের দেওয়ালে তো ঘুলঘুলি নেই, ওরা বাসা বাঁধবে কী করে? ওদের জন্য আমাদের আলাদা বাসার ব্যবস্থা করতে হবে। যেটা জোগাড় করতে হবে, সেটা যদি পাওয়া যায়, তাহলে দেখবে সেটাকে অনেকটা কলসীর মতই দেখতে। কিন্তু সেসব হওয়ার আগে তো তোমাদের মা-বাবার থেকে পারমিশন নিতে হবে।”

এইসব কথাবার্তা হওয়ার পরে পরেই, এক রবিবার সকালে বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক 'হাটে' গিয়ে পাখিদের জন্য আলাদা করে এক দিকে গর্ত করা হাঁড়ি কিনে আনা হল। এই ' হাঁড়ি-বাড়ি' কিনে আনার অভিযানে বাবা আর দাদুনের সঙ্গে গেল তিলতিল আর মিতিলও। 'হাট বসেছে শুক্রবারে, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপাড়ে'  - সেই হাট যে সত্যি সত্যি হয় সেটাই তো জানা ছিল না। ওদের বাড়িতে তো বেশিরভাগ বাজার বীণাপিসি করে, না হলে বিগ বাজার। মাঝে মাঝে হোম ডেলিভারিও হয়। সেই 'হাট' অভিযানে সেদিন মা আর দিদুনও সঙ্গে গেছিলেন, কী সব নানারকমের শাকসবজি কেনা হয়েছিল, যেগুলি নাকি এমনিতে পাড়ার দোকানে পাওয়া যায় না। তবে গরুর গাড়ি দেখতে পাওয়া যায়নি একটাও, যে দোকান থেকে পাখিদের বাড়ি কেনা হলো তাঁরা নাকি ম্যাটাডোর গাড়িতে সব জিনিস নিয়ে আসেন।


সেইসব কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে আসতে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল বলে সেদিন আর চড়াই পাখিদের জন্য বারান্দার গ্রিলে হাঁড়ি-বাড়ি বাঁধা হয়নি। সেই নিয়ে খানিক কান্নাকাটি -মান অভিমান হলেও কিছুই করার ছিল না। কিন্তু পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে এসেই দুই ভাই-বোনের আর আনন্দ ধরে না। বারান্দার গ্রিলে শক্তপোক্ত করে বাঁধা দুটো 'হাঁড়ি-বাড়ি'; তাদের খোলা মুখগুলো অবশ্য বাইরের দিকে যাতে মিস্টার চড়াই আর মিসেস চড়নী সহজেই যাতায়াত করতে পারেন। হাঁড়ি-বাড়ির ওপরে একটা করে মাটির ছোট থালার মত ঢাকা দেওয়া, সেগুলিকে 'সরা' বলে। দাদুন-দিদুনের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে হাঁড়ি-বাড়ির একটু নিচে জল রাখার আর খাবার রাখার পাত্রেরও ব্যবস্থা করা হল। জলের পাত্রে জল আর খাবারের পাত্রে কিছু ছোলা রেখে দিল তিলতিল আর মিতিল।


সেই থেকে চলছে অপেক্ষা। কবে চড়াই আর চড়াইয়ের বউ এসে বাসা বাঁধবে তিলতিল আর  মিতিলের দেওয়া হাঁড়ি-বাড়িতে। পাত্রের জল শুকিয়ে গেল কয়েকদিন পরে, ছোলা খেয়ে গেল পিঁপড়ে আর কাকে, কিন্তু যাদের জন্য এত আয়োজন, তাদের দেখা নেই। ঘুম থেকে উঠে আর স্কুল থেকে ফিরে রোজ খেয়াল রাখে মিতিল, কিন্তু হাঁড়ি-বাড়িতে কেউ ঢোকেও না, কেউ বেরোয়ও না। তিলতিল তো দুঃখের চোটে আর ফিরেও দেখে না। মনমরা হয়ে দাদুনকে ফোন করে মিতিল,

"ও দাদুন, এলো না তো..."

"কে এলো না ?"

"ওই যে, ওরা..."

"ও আচ্ছা, মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস চড়াই? সত্যি, কী হল বলতো? ওদের হয়ত ঘরগুলো পছন্দ হয়নি..."

"কিন্তু জল দিয়েছি তো, আর ছোলাও দিয়েছি তো..." কাঁদোকাঁদো গলায় জানায় মিতিল।

ফোনের ওপাশ থেকে দাদুন বলেন, "আচ্ছা, শোনো শোনো, কেঁদো না, চড়াই পাখিদের নিয়ে একটা অন্য কথা আছে..."  মিতিলের মন খারাপ দূর করার জন্য চড়াইদের নিয়ে নতুন গল্প বলতে থাকেন দাদুন, ফোনের ও'পাশ থেকে।


(৩)


এক রবিবার সকালবেলা  যখন তিলতিল আর মিতিল  খুব মন দিয়ে হোমটাস্ক করছিল, তখন বাবা এসে চুপিচুপি ডেকে বললেন, "আয়, দেখে যা, তোদের চড়াই আর চড়নী কেমন বাসা বাঁধছে। চুপিচুপি কিন্তু, আওয়াজ করলে ওরা ভয় পাবে। বাসা বাঁধার আগেই আবার পালিয়ে যাবে।” প্রায় একবছর ধরে বারান্দার গ্রিলে বাঁধা হাঁড়িদুটোকে খুলতে দেয়নি তিলতিল আর মিতিল। তবে রোজ সকালে উঠে হাঁড়িগুলোর হাল-হকিকত জানার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিল। এতদিন পরে তাহলে আশা পূর্ণ হল! বইখাতা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠল দুজনে।


বাবার সঙ্গে দরজার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয় তিলতিল আর মিতিল। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে, এমনকী কে সামনে দাঁড়াবে সে নিয়ে ঝগড়াও করে না। কিঁচ-কিঁচ, কিঁচ-কিঁচ – শোনা যাচ্ছে চড়াইদের কথাবার্তা, অবশ্যই একটা হাঁড়ির ভেতর থেকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কিছুই। কী করে দেখা যাবে? হাঁড়ি-বাড়ির দরজা তো খোলা আকাশের দিকে মুখ করে রয়েছে। পেছন দিক থেকে দেখা যায় নাকি? বেশ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তিলতিল আর মিতিল যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন দেখতে পেলো, একটা চড়াই হুশ করে হাঁড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল। ফিরে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তারপরে আবার উড়ে গেল, আবার ফিরে এলো।


"ওটা কি বাবা চড়াই? মা চড়াই কি নেস্টের ভেতরে আছে?" প্রশ্ন করে তিলতিল।

" হ্যাঁ , হতে পারে সেটা। মিসেস চড়াই হয়ত ভেতরে ডিমে তা দিচ্ছেন।” বাবা হেসে উত্তর দেন।

" কিন্তু তুমি জানলে কী করে ওরা বাসা বেঁধেছে? আমি তো বুঝিনি..." মিতিল জানতে চায়।

" আমি গত কয়েকদিন ধরেই ওদের কথাবার্তা শুনছি তো সকাল বেলায়। তোরা সকাল উঠেই  স্কুলের জন্য রেডি হতে শুরু করিস, তাই খেয়াল করিসনি।”

"কিন্তু আমরা দেখব কি করে, ওদের ডিম... তারপরে যখন ডিম ফুটে ছানা বেরোবে... হাঁড়িগুলো তো উঁচুতে আর খোলা গর্তটাও বাইরের দিকে..."

"ঠিক, আমরা ওদের দেখতে পাবো না। চাইলে পারি, কিন্তু সেটা করলে ওরা ভয় পেয়ে যেতে পারে। এমনিতেই এতদিন ধরে দেখে দেখে, ভরসা করে ওরা এখানে বাসা বাঁধতে এসেছে। ওদের এখন একদম বিরক্ত করা উচিত নয়। বরং আমরা ওদের জন্য আবার জল আর খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।”

"বাবা, ও বাবা, চড়াইপাখিদের বাচ্চা হলে আমরা ওদের খাঁচায় পুষবো?"  মনের ইচ্ছেটা জানায় তিলতিল।

"হ্যাঁ হ্যাঁ, খাঁচায় পুষবো-" উৎসাহে হাততালি দেয় মিতিল।

"একদম না," বলতে বলতে ঘরে ঢোকেন মা। “ছানাদের কষ্ট হবে না মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে? আর চড়াই  মা আর বাবা, তাদের কষ্ট হবে না? ধর যদি কেউ তোদেরকে আমাদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে গিয়ে একটা খাঁচায় পুরে রাখে - কেমন লাগবে ভাবতে পারছিস?"

"এ মা, আমাদের কে ধরে রাখবে খাঁচায়? আমরা কি পাখি নাকি?"  অবাক হয়ে প্রশ্ন করে  মিতিল।

"পৃথিবীর সব মানুষের জীবন একরকম হয় না মিতিল। এই দুনিয়ায় তোমাদের মতো বয়সী কত ছেলেমেয়ে আছে জানো, যাদেরকে নানারকমের কারণ দেখিয়ে জোর করে তাদের বাবা-মায়েদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে? বা তারা বিপদে পড়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে? কান্নাকাটিও করেও কোনও লাভ হচ্ছে না ... তোমাদের কী আর এমনি এমনি বলি তোমরা যেটুকু  পাচ্ছো, অনেক পাচ্ছো... " মা গম্ভীর গলায় বলেন।

"আহা, ঠিক আছে , " বলে বাবা মা'কে ইশারা করেন আর না বকতে ," তিলু, মিলু, ঝটপট  হোমওয়ার্ক শেষ করে ফেলো। এইসব কথা পরে হবে।”


একে তো মায়ের হঠাৎ বকুনি, তারপরে মা-বাবার থেকে আলাদা হয়ে অনেক দূরে একা একটা খাঁচার ভেতর আটকে থাকার কথা ভেবেই ভয় আর দুঃখ আর মন খারাপ- সব একসঙ্গে হল! দুই ভাইবোনে আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে গেল হোমটাস্ক শেষ করতে। মা আর বাবা অবশ্য লক্ষ্য করলেন, তিলতিল ঘন ঘন চোখের জল মুছছে; মিতিল অবশ্য খুব গম্ভীর মুখে সব টাস্ক শেষ করল। দুপুরের খাওয়ার সময়ে নিজের পাতের ডিমটা বড় না তিলতিলের পাতেরটা, সে নিয়েও কোনও ঝামেলা করল না।


(৪)

খাওয়াদাওয়ার পরে বাবা দুই ভাইবোনকে বিছানায় ডেকে নিলেন। অন্য রবিবার হলে বাবা এই সময়ে গল্পের বই পড়েন, কিন্তু আজ বাবার কোলে ল্যাপটপ। তিলতিল আর মিতিলকে নিজের দুই পাশে বসিয়ে বাবা পরপর অনেকগুলো ছোট ছোট ফিল্ম দেখালেন। সেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কথা, যারা বেশিরভাগই যুদ্ধের কারণে, নিজেদের পরিবার এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অনেকেরই বাবা-মা হারিয়ে গেছেন চিরকালের মতো। অনেককে নতুন দেশের আইন জোর করে বাবা-মায়ের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। কবে আবার তারা একসঙ্গে হতে পারবে জানে না। অজানা দেশের অচেনা শরণার্থী শিবিরে, তাঁবুর মধ্যে, বা সত্যি সত্যি জেলখানার মত ঘরের মধ্যে মনমরা হয়ে বসে আছে কত ছেলেমেয়েরা, তারা অনেকেই অসুস্থ, কারোর কারোর যুদ্ধে গুলি কিংবা বোমের টুকরো গায়ে লেগে রক্ত ঝরছে। ফিল্ম দেখার মাঝে মাঝে বাবা বলে দিলেন, কোন্ কোন্ দেশে যুদ্ধ হচ্ছে, কোন্ কোন্ দেশের ছেলেমেয়েরা কত কত দূর দেশে একা একা থাকতে বাধ্য হচ্ছে।  দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলল তিলতিল, মিতিলের চোখ জলে ভরে এলেও ডলে ডলে মুছে ফেলল ।

"এই চড়াই বাবা-মায়ের কাছ থেকে ওদের ছানাদের আলাদা করে জোর করে খাঁচায় বন্দী করে রাখলে ওদেরও খুব কষ্ট হবে, ঠিক এই বাচ্চাগুলোর মতো, তাই না বাবা?”

" আমরা কোনওদিন পাখির ছানাদের ওদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে এনে পুষব না। হ্যাঁ বাবা?”

"আমি ওপরের ঢাকনি সরিয়ে ওদের বাসা দেখতে চাইব না,  খালি ওদের জল আর খাবার দেব, তাই না বাবা?"

"একদম ঠিক," বলতে বলতে পাশে এসে বসলেন মা।” আমরা যেমন সবাই মিলে এক সঙ্গে আনন্দ করে, নিশ্চিন্তে থাকতে চাই, পৃথিবীর সব মানুষ, সব পশু-পাখি সেভাবেই থাকতে চায়। আমরা তো সবাইকে সবসময়ে সাহায্য করতে পারব না, কিন্তু এই চড়াইপাখিদের পরিবারটাকে এখন সাহায্য করব। আজ বিকেলে আমরা পুরনো বাজারে যাব, আর সেখানে থেকে পাখিদের খাওয়ার জন্য ঘাসের বীজ কিনে আনব, কেমন?"

এই কথা শোনার পরে  মায়ের কোলে একসঙ্গে গুটিসুটি হয়ে, কাঁদতে কাঁদতে আর হাসতে হাসতে আদর না খেয়ে তিলতিল আর মিতিল কীই বা করে!


(সমাপ্ত )

অলঙ্করণঃ সুস্মিতা কুণ্ডু