গল্পের ঝুলি : সাহিত্যিক মেজদা : সহেলী চট্টোপাধ্যায়




গল্পের নাম দেখে অবাক হচ্ছ নিশ্চয়ই? ভাবছ বৈজ্ঞানিক মেজদা কী করে সাহিত্যিক মেজদায় পরিণত হলো ? সেই ঘটনাই তো বলছি ।

মেজদা এখন খুব বিজি।  নতুন একটা কাজে হাত দিয়েছে। একটা উপন্যাস লেখার কাজে ব্যস্ত। যে সে উপন্যাস নয়, এক্কেবারে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস!  পাতায় পাতায় রহস্য। দম বন্ধ করে পড়তে হবে।

এমন গোপন খবর আমি কী করে জানতে পারলাম? আসলে গোপন ব্যাপারস্যাপার একটু জোরেই বলে ফেলে মেজদা। বাগানে এত এত সাদা কাগজ ছেঁড়া পড়ে থাকতে দেখে সেজোজেঠু মেজদাকে ডেকে পাঠায়। কে কী গোলমাল করছে আমার জেঠুরা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে। স্বচ্ছ ভারত অভিযান নিয়ে অনেক কথা বলে। অঙ্ক কষে কষে খাতার পাতাগুলো জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়া মোটেও উচিত হয়নি।
মেজদা বলল, "এগুলো অঙ্ক নয়, উপন্যাস কষার চেষ্টা করছি।"
 "উপন্যাস আবার কষা যায় নাকি!"
"হ্যাঁ। একদম সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্ক কষার মতই ব্যাপারটা। রহস্য উপন্যাস লিখব। বাদশাহী আংটির মতো।"

 আমার জেঠুরা এবার বোঝাবার চেষ্টা করল ,
"ওরে উপন্যাস লিখে তোর কী উপকারটা হবে শুনি?"

 গল্প উপন্যাস লিখে সত্যি নিজের কোনও উপকার হয় কি না জানিনা তবে নিজেকে অনেকটা ভাল রাখা যায়। এটা আমার মনে হয়। আমার ভাবনাচিন্তাগুলো আবার মোটেও ভাল নয়। দুঃখের কথা আর কাকে বলি! পেন খাতা ছাড়া।

মেজদা বলল, "আমার জীবনে যা যা বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে সব লিখব। আগে রহস্য উপন্যাস লিখব।"

তারপর সে দরজা জানলা বন্ধ করে একগাদা কাকাবাবু ফেলুদা ব্যোমকেশ বক্সী কিরীটি জয়ন্ত মাণিক সবাইকে নিয়ে বসে পড়ল।

বলল, "আমি এইবার যে চরিত্র বানাবো তা এদের সবাইকে ছাপিয়ে যাবে। নাম দেব টুলুদা।"

 বড়দা বলল, "তার চেয়ে টুলুপিসি দিলেই তো পারিস। টুলুপিসি খুব খুশি হবে শুনলে।"

টুলুপিসি নামে আমাদের একজন পিসি আছে। ফেলুপিসি টুলুপিসি দুজনেই আছে।

মেজদা বলল, "নাহ থাক। আমি তোমাদের সঙ্গে আর আলোচনা করব না।"

বড়দা, মেজদা আর ছোড়দা শুধু ভাই-ই নয়, খুব ভাল বন্ধু একে অপরের (নাকি শত্রু বলব?)। বড়দার কাগজের অফিস, ছোড়দা সাংবাদিক, মেজদা বৈজ্ঞানিক। কেম্ব্রিজের একটা কলেজে পড়াতো এক সময়। এখন বাড়িতেই আছে, নানারকম গবেষণা করে।
এখন তার শখ হয়েছে গোয়েন্দা গল্প লিখবে।

মেজদা খুব পড়ছে। লাইব্রেরি থেকে অনেক অনেক বই আনছে আর পড়ছে। সব বই থেকে একটু করে টুকবে বোধহয়, যেমন মেগা সিরিয়ালে হয়ে থাকে।

মেজদা নিজের লেখা রহস্য উপন্যাস প্রথম পড়তে দিল ছোড়দাকে। ছোড়দার ওপর অগাধ ভরসা। আমাদের তো পড়তেই দিচ্ছে না। ফাইলের দিকে তাকালেই ভীষণ রাগী রাগী মুখ করে তাকাচ্ছে।

ছোড়দা পড়ে বলল, "খুব ভাল লিখেছ মেজদা। কিন্তু কে কাকে খুন করল, কে অপরাধী, কে গোয়েন্দা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথা ঘুরছে। তুমি এক কাজ করো। এর সঙ্গে একটা মানে-বই লেখো। যেমন ছোটবেলায় আমাদের একটা মানে-বই থাকত। ছাত্রবন্ধু।"

"ছাত্রবন্ধু না বলে ছাত্রশত্রু বলা উচিত। কারণ ওই বইতে সোজা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া থাকত আর কঠিনগুলো বলতো নিজে করো।"
বড়দা বলতে বলতে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। নায়ক প্রসেনজিৎ রেগে গেলে যেভাবে কথা বলেন।

বুঝতে পারলাম এত বছর পরেও বড়দার ছাত্রবন্ধুর ওপর রাগ একটুও যায়নি।

 মেজদা বলল, "তুমি চুপ করো না বড়দা! তোর মাথা ঘুরছে ছোট, তাহলে তো উতরে গেছি। পাঠকের পড়ে যদি মাথা না ঘোরে তাহলে তা রহস্য উপন্যাসই নয়।"

"কই বাদশাহী আংটি পড়ে তো মাথা ঘোরেনি!"

" আরে সেই যুগ আর আছে নাকি! অমন সহজ সরল রহস্য সমাধান আবার একটা ব্যাপার নাকি? আমি তো প্রথমেই সব বুঝে গেছিলাম যে দাড়িওলা লোকটাই বদমাশ হবে। আরে বাবা দাড়িওলা লোক কখনও ভাল হয় না।"
"তাই নাকি! তাহলে নিজের দাড়িটা আগে কাটো।"

মেজদা নিজের গালে হাত দিয়ে চমকে ওঠে।
"ইস তাই তো! কত্তদিন দাড়ি কাটিনি।  আচ্ছা একটা কথার উত্তর দে তো, বাদশাহী আংটি মানে সেই বাচ্চাটা জাতিস্মর ছিল সেই গল্পটা তো?"
" আরে না না। সোনার কেল্লা নয়। এখানে তো আংটি চুরি হবে। ভুলে গেলে?"
"আই সি। সোনার কেল্লায় তো গণেশ চুরির কেস। বদমাশ মগনলাল গণেশ চুরি করে আন্দামানের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে রাখে। ফেলুদা জয়ন্ত আর মাণিককে নিয়ে আন্দামানে যায়। জারোয়াদের সঙ্গে আলাপ করে গণেশ উদ্ধারের চেষ্টা করে।"

  এই পর্যন্ত শুনে বড়দা এক গ্লাস রসনার শরবত বানিয়ে খেয়ে ফেলে ঢক ঢক করে। আমাদের একটুও দেয় না।
ছোড়দা সেদিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থেকে  বলল,  "আমি ভাবলাম রসনা আমার আর মেজদার জন্য বানাচ্ছ! ওর বড্ড পরিশ্রম গেছে কদিন।"

"চুপ কর তো। আগে নিজের মাথাটা ঠান্ডা করি। উফ। ফেলুদা আন্দামানে গেল গণেশ উদ্ধার করতে! এরপর একটা এনার্জি ড্রিঙ্ক না হলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।"

"তা যায়নি বুঝি? তবে কে গেল? বুঝেছি ব্যোমকেশ বক্সী ছাড়া কেউ নয়। আর কারই বা অত সাহস আছে!"

ছোড়দা বলল, "ঠিক বলেছ। তবে ঘুমিয়ে পড় এবার। খুব গরম এখন।"
মেজদা বলল, "এক গ্লাস রসনা না দিলে আমি ঘুমাবো না।"
"আমি করে দিচ্ছি।"

তারপর দেখা দিল এক নতুন সমস্যা। মেজদা ভাবতে শুরু করল তার রহস্য উপন্যাস সে কোন্ পত্রিকায় পাঠাবে। ছোটদের ধ্রুবতারা নাকি আনন্দের দেশে? মেজদা অনেক ভেবেও ঠিক করতে পারল না।

ছোড়দা বলল আনন্দের দেশে-তে পাঠাও। আমি তোমার লেখা মেল করেছিলাম। এডিটরকে চিনি। তোমার লেখা ওর খুব ভাল লেগেছে। তুমি একবার ফাইনাল মেল করে দিও। লেখা যা এডিট করার করে নিও।

মেজদার রহস্য উপন্যাস খুব ভাল হয়েছে। কোনও গোলমাল নেই। বেশ টান টান। আনন্দের দেশে লেখাটা যাবে। খুব মজা হবে আমাদের। আমি একবার মেজদার থেকে চেয়ে পড়ে নিয়েছি। দিতে চাইছিল না। একটা বড় ডেয়ারি মিল্ক কিনে দিতে হল। তারপর পড়তে দিল।
আমার গল্পটা ভালই লাগল। বেশ জটিল রহস্য বানিয়েছে। সব ভাই বোনদের খুব আনন্দ হচ্ছিল।

ছোড়দা একদিন এসে বলল, "মেজদা তুমি এটা কী করলে! আনন্দের দেশে তোমার গল্প অমনোনীত করে দিয়েছে শুধু মাত্র তোমারই দোষে।"
"সে কি! আমার লেখা তো ভালই হয়েছে। তুই তো বললি এডিটরের খুব পছন্দ হয়েছে।"
"বলেছিলাম। কারণ তোমার মেল তখনও উনি পড়েননি।"
 বলতে বলতে পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে এগিয়ে দেয় ছোড়দা। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই প্রিন্ট আউট চিঠি পড়ে ফেললাম। এডিটরকে লেখা মেজদার চিঠি।



মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, 
আপনার পত্রিকা ছোটদের ধ্রুবতারা আমার খুব প্রিয় পত্রিকা। ছোটবেলা থেকে আমি এই পত্রিকা পড়ি। এত বড় হয়ে গেছি এখনও এই নেশা ছাড়তে পারিনি।
......


সারা চিঠি জুড়েই মেজদা ছোটদের ধ্রুবতারার প্রচুর প্রশংসা করেছে। আর কে না জানে আনন্দের দেশের সঙ্গে ধ্রুবতারার ভীষণ রেষারেষি! তাই মেজদার এই উল্টো চিঠি দেখে সম্পাদকমশাই রেগে টং।

মেজদা বলল, "ইস! পুরো ভুল চিঠি লিখে ফেলেছি। আমি ভেবেছি যে ধ্রুবতারায় লেখা মেল করছি। এই ভুলের ক্ষমা নেই।"
"একবার চেক করতে হয় চিঠিখানা।  আর যা হবার হয়ে গেছে।"
 বড়দা শান্ত করার চেষ্টা করে।

তারপর কী হল জিজ্ঞাসা করছ? তোমরা রহস্য উপন্যাসের নাম মেজদার সামনে কেউ করবে না।


(সমাপ্ত)

(ঋণ- তন্ময় বিশ্বাস) 
     

অলঙ্করণঃ সুকান্ত মণ্ডল


   




13 comments:

  1. বেশ লেগেছে--অনেকটা অন্য রকম।

    ReplyDelete
  2. দারুণ। এই ভুল অনেকেই করে থাকে। নতুন স্বাদের।

    ReplyDelete
  3. অন্যরকম রসনাতৃপ্তি পেলাম আর কি।

    ReplyDelete
  4. তবে এই ভুলটা আমিও করি, বেশ লাগলো গল্পটা

    ReplyDelete
  5. হাহাহা, বেশ মজাদার। খুব ভালো হয়েছে দিদি।

    ReplyDelete