পিকচার পোস্টকার্ড



আজ পনেরোই আগস্ট, ভারতের বাহাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই ভারতের চেহারায় বেশ বদল এসেছে এতগুলো বছরে। বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে বলো, বা খেলাধুলোয়, অর্থনীতি কিংবা ব্যবসাজগতে, আমাদের দেশ এগিয়েছে অনেকখানি। আজ তোমরা যারা স্কুলে পড়ছো, অথবা পা বাড়াচ্ছো কলেজের পথে, কিছুদিন পরেই তোমাদের হাতে আসবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব। জানি, খুব যত্নের সঙ্গে তোমরা সে দায়িত্ব পালন করবে, দেশের আর দশের মুখ উজ্জ্বল করবে তোমরাই।

তবে বন্ধুরা, কতগুলো কথা মনে রেখো। "দেশটা কেবল মাটি দিয়েই গড়া নয়, মানুষ দিয়েও গড়া।" আর এই দেশের মানুষের ভালো যাতে হয়, সেকথা চিন্তা করতে হবে আমাদের, প্রতিটি পদক্ষেপে। খুব বড় মাপের কোনও কাজ এক্ষুনি আমরা করে ফেলতে পারব না, জানি, তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়, সময় লাগে। কিন্তু কাজের শুরুটা আমরা আজ থেকেই করতে পারি। বাড়ি থেকে যখন আমরা বেরোচ্ছি কোনও কাজে, তখন এটুকু মনে রাখব যে রাস্তায় কারও যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তবে তাঁকে উপেক্ষা করে নিজের কাজে চলে না গিয়ে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো। স্কুলে মেধার মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়া ক্লাসমেটকে অযথা ব্যঙ্গ বিদ্রূপে অতিষ্ঠ করে না তুলে তাকে পড়া বুঝতে সাহায্য করব। কোনও মানুষকেই তাঁর জন্মপরিচয়, ধর্ম, আর্থিক অবস্থা এসবের নিরিখে বিচার করব না, আশেপাশে থাকা প্রত্যেকে যেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পান, সেদিকে নজর দেবো। বাড়িতে কাজ করতে আসা দিদি, ড্রাইভারদাদা, বাগানের মালীদাদা, রাস্তা পরিষ্কার করা সুইপারদাদা, এঁরা প্রত্যেকে আমাদের রোজকার অনেক কাজ সহজ করে দেন। কাজেই এঁদের প্রতি আমাদের ব্যবহার যাতে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা খুব ভালো বন্ধু হবো, সবার, এমনকি, যার কাছে আমরা দুহাত ভরে শুধু নিয়েই থাকি, সেই প্রকৃতিরও বন্ধু হতে হবে আমাদের। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে দূষণের হাত থেকে, তবেই আমরা ভালো থাকবো, উন্নতি করতে পারবো আমাদের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা সুন্দর দেশটার।

আজ, স্বাধীনতা দিবসের দিনে হইহই করে এসে গেল তোমাদের বন্ধু ক্রমশঃ কিশলয়-এর দ্বিতীয় সংখ্যা। এবারের সংখ্যার থিম 'ভারত'। রকমারি স্বাদের গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদির পাশাপাশি রয়েছে কিছু নতুন চমকও। বলব না, পাতা উল্টে নিজেরা আবিষ্কার করো দেখি কী সেই চমক! এছাড়া রয়েছে মজাদার ধাঁধার পাতা, ক্যুইজ, তোমাদের নিজেদের আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো 'কচিকাঁচাদের পাতা', বই কথা কও ইত্যাদি নিয়মিত বিভাগ। মোটকথা, স্বাধীনতা দিবস স্পেশাল 'ক্রমশঃ কিশলয়' পড়তে পড়তে দিনকয়েক এখন বেজায় আনন্দে কাটবে, কি বলো!


অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল

গল্পের ঝুলি : ক্লাসমেট : অনিমেষ ভট্টাচার্য্য


।।১।।

আমাদের বসিয়ে রেখে কাকু চলে গেল। অসিত কাকু। মুকুলের বাবা। ভর্তির দিন মুকুলের বাবা-মা দুজনেই এসেছিল স্কুলে। বোধহয় সেই কারণেই আমার বাড়ির কেউ যায় নি। আর তাছাড়া, বাবার অফিস ছিল। ঘরে ছোট ভাই তখন চার বছর বয়েস। মা তো ঘরের কাজ মিটিয়ে ভাইকে সামলাতে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যায়।

তবে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আনন্দই আলাদা ছিল। পাড়ার ওই ছোট মাঠের প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে, জিটি রোড পেরিয়ে আরও কিছুটা হাঁটতে হয়। তারপর একটা রেলগেট আসে। সেই রেললাইন পেরোনোর পর স্কুল। সেখানে ফ্যান আছে। বড় মাঠ আছে। আর আছে অনেক স্যার, ম্যাডাম। লাইব্রেরিও ছিল।

প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু বলতে ওই মুকুল। ফাইভের বি সেকশনের সেকেন্ড বেঞ্চে আমি আর মুকুল পাশাপাশি বসলাম। মা আমাকে সেদিন টিফিন দেয়নি। প্রথম দিন তো। আদৌ পুরো স্কুল হবে কি হবে না, কে জানে! অসিত কাকু দেখি দু’টো বাপুজি কেক কিনে আমাদের দিল।

“টিফিন হবে শুনছি। খেয়ে নিস তোরা। আর একদম বদমায়েশি করবি না। ফেরার সময় একসঙ্গে বাড়ি ফিরে যাস।”

আমার ব্যাগের টিফিন বাবদ চার টাকা ছিল। মা দিয়েছিল। দিতে গেলাম কাকুকে। নিল না।

আমাদের বেঞ্চে আরও তিনটে ব্যাগ রাখা ছিল। তারা যে কারা সেটা প্রেয়ার শেষের আগে জানা যায়নি। ওইদিকে দুজন রাকেশ আর সুজয়। আর আমাদের ঠিক পাশেই বসেছিল ভগত’দা। রাজ ভগত। যদিও খাতায় নাম লেখার সময় ও ‘ভকত’ বানান লিখত। কিন্তু আমরা ভগত’দা বলেই ডাকতাম।

“আজ তো টিফিন হবে না রে। এ বাবা তোরা জানিস না। নিচে নোটিশ দিয়েছে।”, কাটা কাটা বাংলা উচ্চারণে ভগত’দা বলল। আমাদের থেকে লম্বা। স্বাস্থ্যবান চেহারা। চোখের নীচ’টা একটু কালো। গায়ের রঙ খুব ফর্সাও নয়, আবার চাপাও নয়। সাদা জামাটা পুরনো। আর আমরা সবাই কালো প্যান্ট পরেছিলাম। ভগত’দার প্যান্টটা নীল ছিল।

সেই শুরু। স্কুলের নোটিশ বোর্ড কোথায়; টিউবওয়েল ছাড়াও আর কোথায় খাওয়ার জল পাওয়া যায়; পরেশবাবু কেন সাইকেলে স্কুল আসেন সব খবর ভগত’দা জানত। মুকুল জিগেস করেছিল, “তুমি এত কিছু কী করে জানো? এই স্কুলে আগে পড়েছ?”

“না, না। আমি তো বিদ্যানিকেতনে পড়তাম। এই দেখছিস না, নীল প্যান্ট।”

“তুমি তো জুতোও পরোনি। স্যাররা বকবে না?”

“জুতো আছে। পরব। আজকে ভুলে গেছি।”

“বিদ্যানিকেতন মানে বৈদ্যবাটি বিদ্যানিকেতন?”, আমি জিগেস করলাম।

“হ্যাঁ, রে।”

“কিন্তু ওটাও তো হাইস্কুল। আমি অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম। তুমি ওখানে কিসে পড়তে?”

“ফাইভেই পড়তাম। দু’বছর। তারপরে তাড়িয়ে দিল। ... হা হা হা...” দু’দুবার ফেল করে স্কুল থেকে রাস্টিকেট হওয়ার পর কেউ এভাবে হাসতে পারে জানতাম না। ভগত’দা পারে। সে হাসিতে দেমাক ছিল না। টালবাহানা ছিল না। হতাশা ছিল। অসফলতার হতাশা। নিজের প্রথম স্কুল ছেড়ে আসার হতাশা।

কদিন পর থেকেই বুঝতে পারলাম ভগতদা কেন ফেল করত। কারণ সে স্কুলেই আসে না। সপ্তাহে একদিন কিংবা দুদিন আসত। তাও শনিবার করে। সেদিন হাফ ছুটি। প্রথম প্রথম আমি আর মুকুল ভগতদার জন্য জায়গা রাখতাম। কিন্তু, সে স্কুলে ঢুকত দেরি করে। সবাই বসে পড়ে। একবার তো স্যার এসে যাওয়ার পরে ঢুকেছিল। বাইরে দশ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।

একদিন টিফিন বেলা আমি আর মুকুল টিফিন বক্স বের করে বেঞ্চে চাউমিন খাচ্ছি। ভগত’দা আলুকাবলি খেতে খেতে ঢুকল। জিগেস করলাম,

“ও, ও ভগত’দা চাউ খাবে? মা বানিয়েছে।”

“... তোর মায়ের বানানো। দে একটু।”

“আচ্ছা, তুমি দেরি করে ইস্কুল আসো কেন? তারপরে এত কামাই করো। এরকম করলে তো তুমি আবার ফেল করবে।”

“কী করব বল দেখি। রোজ ভাবি ইস্কুলে যাব। কিন্তু মালিক ছাড়লে তবে তো!”

“মালিক? কে মালিক? কিসের মালিক?”

“দোকানের মালিক। ছাড় তুই অত বুঝবি না। বড় হলে বুঝবি।”

।।২।।

সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিল। কী এমন কথা যে আমরা বুঝব না! হ্যাঁ, মানছি ভগত'দা বয়েসে একটু বড়। কিন্তু তা বলে এভাবে বলবে! বুঝিয়ে বললেই বুঝতাম। ভগত’দা কেমন যেন আস্তে আস্তে রহস্যময় হয়ে উঠছিল। স্কুলে এলে মুখ গুঁজে লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকত। স্যার নাম ডাকার সময় প্রায়ই মিস করত। বার কয়েক কানমলাও খেয়েছে। তবু শিক্ষা নেই।

আমিও কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিলাম। খানিকটা রাগ করেই।

কিন্তু সেদিন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আর কোন রহস্যই রইল না।

রবিবার। বাবার সঙ্গে গেছিলাম জেঠুর বাড়ি। বৈদ্যবাটি খাল পেরিয়ে শেওড়াফুলির ভিতরে। বেলার দিকে ফিরছিলাম। রাস্তাঘাট মোটের ওপর ফাঁকা। দোকানপাট খোলা। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। সাইকেলের পিছনে দুদিকে পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম। বাবা খুব আস্তে সাইকেল চালায়। ফলে, চারদিকে সব বেশ দেখতে দেখতে আসা যায়। তখনই কানে এল-

“এই ছেলে, দু'টো থালা মাজতে কতক্ষণ লাগে? খদ্দের বসে আছে যে!”

“এই তো দাদা। হয়ে গেছে। আসছি...”

গলাটা চিনতে মোটেই ভুল করিনি। চকিতে ঘাড় ঘোরাতেই চোখাচোখি হল। ‘অন্নপূর্ণা হোটেল’-এর বাইরে কলের জলে এত্তগুলো বাসনের ডাঁই। সেখানে উবু হয়ে বসে বাসন মাজছে ভগত’দা। আমাকে দেখতে পেয়েছিল। চোখ নামিয়ে কাজে মন দিল। যতক্ষণ দেখা গেল, আমি ঠায় তাকিয়ে ছিলাম। একটা পুরনো হাফ প্যান্ট, খালি পা আর স্কুলের সাদা জামাটা। পুরো রোদ্দুরটা মুখে এসে পড়ছে।

বাবাকে কিচ্ছু বলিনি। পরের দিন স্কুলে গিয়ে মুকুলকে বললাম। সব শুনে মুকুলও বেশ অবাক হল।

“ভগতদাকে ভালো করে জিগেস করলে নিশ্চয় বলবে। আমরা বাবা-মা’কে বলে কিছু হেল্পও করতে পারি। পারি না?”, মুকুল বেশ আশা জুগিয়ে বলেছিল। আমার মন বলছিল অন্য কথা। ভগতদা আর আমাদের সঙ্গে কথা বলবে না হয়তো।

ঘটনাটা ঘটল পুরো উল্টো। সেদিনেই বিকেলে টিভিতে সাকালাকাবুমবুম দেখছি এমন সময় সাইকেলে বেল দিতে দিতে মুকুল হাজির।

“তাড়াতাড়ি চল। ভগতদা এসেছে। ক্রিকেট খেলব।”

মা’কে বলে টিভি বন্ধ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মুকুলদের বাড়ির সামনের ছোট মাটির গলিটার সামনে একগাল হাসি নিয়ে ভগত’দা দাঁড়িয়ে। জমিয়ে ক্রিকেট খেলা হল বিকেলে। তারপর সন্ধের আগে আগে আমিই জিগেস করলাম,

“ওই লোকটাই তোমার মালিক? ওই হোটেলের লোকটা?”

“অনেক আছে। ও তো একটা।”

“আর কে আছে?”

“সকালে পেপার দিতে বেরোই। পচার সাইকেল ধার করে। ফেরার পথে সবজি কিনে ফিরি। তারপর মা’কে সেসব দিয়ে বংশীদাদুর দোকানে যাই। জামা কাপড়ের ভালো সেল হয়। যেদিন খদ্দের কম থাকে ওখান থেকেই ইস্কুল চলে যাই, আর দেরি হয়ে গেলে যাই না। বাড়িতে আসি। খেয়ে দেয়ে খানিক পড়তে বসি। না’হলে মায়ের সেলাইয়ের কাজ করে দিই। তারপর বিকেল হতে না হতেই আবার গ্যারেজে। সেই রাতে ফিরে শুয়ে পড়ি। ছুটির দিনে শুধু হোটেলে যেতে হয়।... এবার বুঝলি কেন ইস্কুল যাই না?”

“সব তোমাকেই কেন করতে হবে? তোমার বাবা কী করে?”

“বাবা তো কবেই মরে গেছে! বাবা থাকলে কি আর এসব করতে হত রে?... যাকগে শোন, এখন এমনিতেই শ্রাবণ মাস। তারকেশ্বর যাত্রীদের জন্য বাঁকের দোকান দিচ্ছি। কদিন ইস্কুল আসব না। আমাকে নিয়ে ভাবিস না। নিজেরা পড়াশুনা কর মন দিয়ে। আমি ভালোই থাকব।”

।।৩।।

সেদিনেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ভগতদাকে এবার পাস করাতেই হবে। দুপুরে রোজ পড়তে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু ইস্কুল না আসলে কী পড়া হচ্ছে জানবে কী করে! কাজেই আমাদের একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।

মুকুল আর আমি, দুজনে মিলে ছুটির দিনে চলে যেতাম ভগতদার দোকানে। অন্নপূর্ণা হোটেল। গিয়ে বলে আসতাম সপ্তাহে কী পড়া হয়েছে। বই আনতে বলতাম। সেখানে দাগ দিয়ে দিতাম। কিছু দরকারি নোটস থাকলে বাবা অফিস থেকে জেরক্স করে আনত। প্রথম প্রথম হোটেলের মালিক বিরক্ত হত। কিন্তু যখন বুঝল, আমরা এলে ভগতদার কাজের ফাঁকি হচ্ছে না, তখন আর কিছু বলত না।

ভগতদার মাথা ভালো ছিল। হাফ-ইয়ার্লিতে খুব খারাপ রেজাল্ট করেনি। আমরা বুঝতাম, ও প্রতি রবিবার আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকত। একবার আমাদের মাংস খাইয়েছিল। ভয়ে ভয়ে জিগেস করেছিলাম, “মালিক বকবে না?”

“কেন বকবে? দাম দিয়ে কিনেছে রে তোদের এই ভগতদা! কী ভাবিস আমাকে! খা খা... আমি খেয়েছি।”

পুজোর সময় বংশীমোহন রেডিমেড বস্ত্রালয় থেকে একটা গেঞ্জি আর টুপি কিনতে গেছিলাম। ভগতদা তখন একটা জামা ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছিল। একদম ভাবেনি আমি ওদের দোকান থেকে গেঞ্জি কিনতে আসব। কী খুশিই না হয়েছিল!

আস্তে আস্তে সময় হয়ে আসছিল। আর আমার চিন্তা হচ্ছিল। নিজে কীরকম রেজাল্ট করব সে নিয়ে ভাবনা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভগতদার জন্য সাজেশন তৈরি করতে গিয়ে সবকটা বই আমার বারকয়েক পড়া হয়ে গেছিল। মা পর্যন্ত অবাক হয়ে জিগেস করেছিল,

“হ্যাঁ রে অনি, তোর ওই প্রশ্ন বিচিত্রাটা শেষ?”

“হ্যাঁ। রোববার শেষ করে ফেলেছি।”

আমি শেষ না করলে ভগতদাকে কীকরে দেব!

মজা হয়েছিল অ্যানুয়াল পরীক্ষার দিনগুলোয়। সক্কাল সক্কাল পড়া করে স্নান খাওয়া সেরে আমি আর মুকুল হাজির হতাম কাপড়ের দোকানে। ভগতদা তৈরিই থাকত। আমরা বেল দিলেই ঝপাং করে জামাটা গলিয়ে চলে আসত। বংশীদাদু পরীক্ষার ক’দিন রেহাই দিয়েছিল ওকে।

দেখতে দেখতে ছ’টা পরীক্ষা, ছ’টা দিন শেষ!

।।৪।।

পরীক্ষা শেষ হতেই দাদু এসে আমাকে নিয়ে চলে গেল। আমিও ব্যাগ গুছিয়ে লাফাতে লাফাতে মামাবাড়ি চলে গেলাম। সামনে লম্বা ছুটি। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়িয়ে আর শুকতারা পড়ে দিব্যি ছুটি কাটাচ্ছিলাম। বাড়ির কথা একরকম ভুলেই গেছিলাম।

প্রায় মাসখানেক বাদে বাবা আর মা এল। আমরা সেখান থেকে বোলপুরে পিসির বাড়ি গেলাম। তারপর কাকু, পিসি আর আমরা মিলে দার্জিলিং ঘুরতে চলে গেলাম। খুব মজা হয়েছিল সেবার! উঁচু উঁচু পাহাড়, খরস্রোতা নদী আর পাহাড়ি মানুষগুলো। সব মনে রাখছিলাম। স্কুল খুললেই মুকুলকে আর ভগতদাকে বলতে হবে।

দার্জিলিং ঘুরে-টুরে যখন ফিরলাম ততদিনে রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। বাবা একদিন শনিবার দেখে আমার রেজাল্ট নিয়ে এল। ভালো নম্বর নিয়ে পাস করেছিলাম। হাইস্কুলের প্রথম বড় পরীক্ষা। কিন্তু স্কুলে কোনো লিস্ট বেরত না। ফলে, জানাই গেল না ভগতদা পাস করেছিল কি না। মুকুলকে জিগেস করলাম। সে-ও বলল রেজাল্ট বেরনোর দিন ভগতদাকে দেখেনি। স্কুল খোলা ছাড়া উপায় নেই।

হঠাত খেয়াল হল স্কুল খুলতে তো আরও দিন সাতেক। ভগতদা নিশ্চয় দোকানে থাকবে এই ক'দিন। গিয়ে দেখা করে এলেই হয়। মুকুল আর আমি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম বংশীদাদুর দোকানে। দোকান চলছে। দুটো বড় ছেলে দোকান সামলাচ্ছে। কিন্তু ভগতদা কই?

জিগেস করলাম, “ভগতদা আর কাজ করে না এখানে?”

“করে।”

“আজ আসেনি?”

“না।”

“কেন?”

“আমরা কী জানি!... সে কোথায় মরছে তার খবর কি আমাদের বলে গিয়েছে?”

“জানো না বললেই হয়। এভাবে বলছ কেন!”

আর দাঁড়াইনি সেখানে। ধাঁ করে সাইকেল বাগিয়ে সোজা অন্নপূর্ণা হোটেল। কিন্তু না! ওখানেও কেউ কিছু বলতে পারল না।গ্যারেজের জেঠুর কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানাটুকু পাওয়া গেল। শেওড়াফুলি অভিযান সংঘের কাছে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। তখন ঘড়িতে দুপুর সাড়ে বারোটা। দেরি হয়ে গেছিল বুঝতে পারছিলাম। আর দেরি হলে বাড়িতে মায়ের কাছে বকুনি বাঁধা। তাও আশা ছিল, বাড়িতে গেলে নিশ্চয় দেখা হবে। অনেকটা সাইকেল চালিয়ে ওদের বাড়ির কাছে পৌঁছে কাউকেই বিশেষ দেখা গেল না।

লোকজনও খুব বেশি নেই। মুকুল বলল, “ক্লাবে গিয়ে একবার খোঁজ করবি?”

ক্লাবের ছেলেদের আমার খুব ভয় করত। কেমন বদমেজাজি হয় সবাই। ভয়ে ভয়ে একজনকে জিগেস করলাম,

“এখানে ভগতদা থাকে না? ওর মা আছে। এই ... এই বাড়িটায় ভাড়া থাকে।”

“কে ভগত?”

“রাজ... রাজ ভগত।”

“হ্যাঁ। থাকে। কেন?”

“কই দেখতে পাচ্ছি না তো।”

“ওর মায়ের শরীর খারাপ। মা'কে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।"

“কোন... কোন হাসপাতাল?”

“অত জেনে তোদের কী কাজ! যা বাড়ি যা! এই তোদের বাড়ি কোথায় রে?”

মুকুল দেখি সাইকেলে উঠে হাঁক দিচ্ছে, “পালা ভাই! চল... পালাই!”

বাড়িতে এসে বেশ এক দাগ বকুনি খেলাম। অবেলায় চান, খাওয়া ইত্যাদি নিয়ে খুব বকা দিলো মা। স্কুল খোলা অব্দি আমার বাড়ি থেকে বেরনো নিষেধ হয়ে গেল!



সিক্সে আমার ‘এ’ সেকশনে নাম ছিল। মুকুলের ‘বি’-সেকশন। ততদিনে অবশ্য আমাদের অনেক বন্ধু হয়ে গেছে। সেই নতুন ক্লাস, নতুন লোকজন ভয়টা আর নেই। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল। কারণ, না তো ‘এ’ সেকশনে, না ‘বি’ সেকশন; কোথাও ভগত’দার নাম নেই। আমাদের ক্লাস টিচার শ্যামলবাবুকে জিগেস করলাম, “স্যর, সিক্সে ক’টা সেকশন?”

“তিনটে। এ, বি আর সি।”

“সি সেকশনের ঘরটা কোথায়?”

“দোতলায়। উনিশ নম্বর।”

ব্যাস। ওটুকুই আশা। টিফিন অব্দি চুপচাপ ক্লাস করলাম। সিক্সে প্রথম দিন বলে হাফ ছুটি হত না। পুরো ক্লাসই হবে। মা আমাকে টিফিন বক্স ভরে খাবার দিয়েছিল। মুকুল অবশ্য টাকা এনেছিল। নিতাইদার ঝালমুড়ি খাবে।

টিফিনের ঘন্টা পড়তেই এক ঢোক জল খেয়ে উপরে চলে গেলাম। ওপরে বড়দের ক্লাস। এইট, নাইন, টেন সব দোতলায়। আর একেবারে উপরে তিনতলায় ক্লাস ফাইভের ঘরগুলো। ভয় করছিল। কেউ যদি কিছু বলে। এদিক ওদিক খুঁজে উনিশ নম্বর রুম’টা পেলাম। ভেতরে কয়েকজন বসে টিফিন খাচ্ছে। বাকিরা কেউ টেবিলে পেনফাইট খেলছে, কেউ বেঞ্চ বাজিয়ে গান গাইছে এইসব। মুখচেনা কয়েকজন ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে অত ভালো বন্ধুত্ব ছিল না। চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।

মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে খেয়ালই নেই যে নীচে নামার বদলে আমি অভ্যাসবশত তিনতলায় চলে গেছি। তিনতলায় উঠে ভুলটা ভাঙল। ফাইভের ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে। ওদের অ্যাডমিশন টেস্ট, তারপর লিস্ট বেরিয়ে ছাত্ররা আসতে আসতে আরও দিন পনেরো। কী মনে হল, একবার দেখেই আসি পুরনো ঘরগুলো। ফাইভ সি পেরিয়ে ফাইভ বি-তে ঢুকে দেখি সেকেন্ড বেঞ্চের ধারে চুপচাপ বসে আছে ভগত’দা।

খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম! “ভগতদা!! তুমি এখানে?”

“আরে তুই! আয় আয়... হ্যাঁ, একবার দেখতে এলাম ক্লাসগুলো। এখানেই তো বসেছিলাম প্রথম দিন। চিন্তা করিস না, এবারে আর ফেল করিনি।”

“সত্যি?”

“সত্যি। সি সেকশন। রোল একশ দুই। সকাল থেকে চারটে ক্লাস করলাম। কী ভাবিস আমায়!”

আমার তখন আনন্দে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, “তু-তুমি ছিলে কোথায় এতদিন? জানো, জানো আমরা কত খুঁজেছি? তোমার বাড়ি গেছিলাম! ও তোমাকে তো বলাই হয়নি, ছুটিতে দার্জিলিং গেছিলাম। কত পাহাড়, নদী... তারপরে এবারে শুকতারায় একটা ভয়ের গল্প পড়েছি, খুব ভয়ের, শুনলে তুমিও ভয় পেয়ে যাবে! তুমি টিফিন আনো নি?”

“টিফিন? না খেতে যাব। নিচে।”

“আমাদের ক্লাসে চলো। মা আজকে এত্তটা চাউমিন দিয়েছে। খাবে চলো।”, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে বললাম।

“তুই কী খাবি!”

“আমি অত খেতে পারি নাকি! ভাগ করে খেয়ে নেব চলো।”

“আচ্ছা... চল, চল।”

“এই ভগতদা, তোমার মা কেমন আছে গো? ওরা বলল হাসপাতালে ভর্তি ছিল।”

“আর বলিস না। কলপাড়ে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিল। এখন ঠিক আছে। মায়ের কাছে তোদের কথা বলেছি। একদিন নিয়ে যাব, দাঁড়া।”

“নিশ্চয় যাব। আরে ওই দ্যাখো মুকুল... এই মুকুল, মুকুল, এই দ্যাখ ভগতদা। পাস করে গেছে। বলেছিলাম না পাস করবে!”

"কী রে ভাই, কেমন আছিস?", সিঁড়ি দিয়ে চটি ফটফট করতে করতে ভগতদা মুকুলের দিকে এগিয়ে গেল। ভগতদা আজকেও জুতো পরতে ভুলে গেছে।

(সমাপ্ত )


অলঙ্করণ : অনিমেষ ভট্টাচার্য্য

গল্পের ঝুলি : বিষের কারবারী : দেবদত্তা ব্যানার্জী




-"না, আর কিছু করার নেই। সব শেষ। বাঁচানো গেল না ওঁকে। আসলে ওষুধগুলোই ঠিক নয়।''

আফসোস ঝরে পড়ল ডাঃ হালদারের গলায়।

ধপ করে বসে পড়ল ছেলেটা। খুব চেষ্টা করেছিল, সব কিছু বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছিল। যা যা ওষুধ বলেছিলেন ডাঃ হালদার সব এনেছিল। তবুও...

খুব রাগ হচ্ছিল ছেলেটার। ফেটে পড়তে ইচ্ছা করছিল। হঠাৎ একটা জুনিয়র ডাক্তার এসে ডাঃ হালদারকে কিছু বলল। ভ্রু কুঁচকে ডাঃ হালদার সবটা শুনলেন। এই ছোট্ট নার্সিংহোমটা ওঁর বাড়ির একতলায়। একাই থাকেন, চারজন ডাক্তার আর কয়েকটা নার্সকে নিয়ে গরিবদের চিকিৎসা করছেন আজ দশ বছর। অশোকের মা হার্টের অসুখে ভুগছিল, এক সপ্তাহ ধরে ভর্তি ছিল এখানে। অশোক একটা ট্যাক্সি চালাত।

-" ওষুধগুলো কোথা থেকে এনেছিলে অশোক?''

ডাক্তার হালদারের প্রশ্নে মুখ তোলে অশোক। বলে,

-"আমার এক বন্ধু এনে দিয়েছিল কম দামে। ও একটা ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটারের ওখানে কাজ করে। কেন ?''

-"আমাদের সন্দেহ ঠিক, সব ডেট পার হয়ে যাওয়া ওষুধ। সব নষ্ট হয়ে বিষ হয়ে গেছে। এই সব আবার ঘুরে মার্কেটে চলে আসছে কিছু অসাধু ব‍্যবসায়ীর হাত ধরে। ''

-'কী বলছেন আপনি!''

চমকে ওঠে অশোক। গাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছে মায়ের অসুখের চিকিৎসা করতে গিয়ে, তারপরও বাঁচাতে পারল না মাকে।

-''এখন মাথা ঠাণ্ডা করে বাড়ি যাও। তুমি আমি সাধারণ মানুষ। এরা সব রাঘব বোয়াল। বড় বড় মন্ত্রী জড়িত এ’সবে। কিছুই করতে পারবো না আমরা।''

চোয়াল শক্ত হয় অশোকের। চোখের জল শুকিয়ে আগুন জ্বলে ওঠে, বলে

-"আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।"

-"পনেরো বছর আগে আমার চাকরি গেছিল এদের জন্য। জাল ওষুধের এক কারবারিকে ধরেছিলাম। কিন্তু টাকার জোরে বেরিয়ে এসেছিল মাত্র তিন বছর জেল খেটে। আমাকেই মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে চাকরি কেড়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে আমি গরিবদের চিকিৎসা করি এখানে। ওদের হাত অনেক লম্বা অশোক। ভুলে যাও ওসব।”

ওর কাঁধে হাতটা রাখেন একবার, তারপর চলে যান ডাঃ হালদার।

অশোক সেদিকে চেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে । ওর আর কিছুই হারাবার নেই।


*************************


শীতের ছুটিটা এবার ঘরে বসেই কাটবে ভেবেছিল রুবাই। কিন্তু হঠাৎ বাবার একটা সেমিনার পড়ে গেল কলকাতায়। রুবাইয়ের বাবা রাজেশবাবু মালবাজার হাসপাতালের সুপার আর মা শ্রমণাদেবী মেয়েদের স্কুলের বড়দি। ওঁরও বড়দিনের ছুটি চলছিল। সবাই মিলেই তাই কলকাতা এসেছিল ছুটিতে। কলকাতায় রুবাইয়ের ছোটমামা থাকে। রুবাই কলকাতা আসতে খুব ভালোবাসে তার আরেকটা কারণ ছোটমামার অফিস। ওর ছোটমামার ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ আছে। ক্যানিং স্ট্রিটে ছোটমামার ছোট অফিসটা ওর ভীষণ প্রিয়। আসলে ঐ বাগড়ি মার্কেটের গায়ে অফিস আর গুদামটা, ওখানে পাওয়া যায় না এমন কোনও জিনিস নেই। রুবাই এর আগেও দু’বার এসেছে। এবার ছোটমামা ওদের নিজের নতুন অফিস দেখাতে নিয়ে এসেছিল ক্যানিং স্ট্রিটের মেহতা বিল্ডিং-এ। ওর মামা এখন এক বড় ওষুধ কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর। ক্যানিং স্ট্রিটের গলির ভেতর হাঁটাই যায় না এমনভাবে সব দোকান। চারদিকে খেলনা থেকে ন‍্যাপথলিন, বাড়ির সব রকম প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে দড়ি প্লাস্টিক, কী নেই!! রুবাইয়ের মা ঘরের টুকিটাকি জিনিস কিনতেই ব্যস্ত। তবে এমন ভিড়ে বাজার করতে ওরা কেউ অভ্যস্ত নয়, সব গলিগুলো একই রকম। নানারকম ইমিটেশন গয়না, ঘর সাজাবার জিনিস, ব্যাগ সুটকেস, কী নেই ঐ বাজারে। দোতলায় ছোটমামার বন্ধু কাশিম ভাইয়ের খেলনার দোকানে নিয়ে গেছিল মামা। রুবাই একটা ভিডিও গেম আর দূরবীন পেয়েই খুশি।


উল্টোদিকের মেহতা বিল্ডিং-এ মামার নতুন অফিসে গিয়ে রুবাই আরও অবাক। এমন পুরানো অন্ধকার বাড়ির ভেতর এমন ঝাঁ চকচকে আধুনিক অফিস থাকতে পারে ওর ধারণাই ছিল না। মামার নতুন এয়ার কণ্ডিশনড অফিসে বসে বাবা গল্প করছিল মামার ম‍্যনেজার দত্ত আঙ্কলের সাথে। ছোটমামা আর মা বেরিয়ে গেছিল বাজারে, কেনাকাটায়। রুবাই এক মনে আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত। ডিসেম্বরেও কলকাতায় দিনের বেলায় এসি লাগছে। ওদের মালবাজারে এ সময় সোয়েটার টুপি পরে থাকতে হয়। ছ’শো স্কোয়ার ফিটের সুন্দর সাজানো অফিস হলেও টয়লেট নেই নিজেদের। হাত ধোবে বলে রুবাইকে যেতে হল ঐ উইং এর শেষ প্রান্তের কমন টয়লেটে। অন্ধকার উইং এর দু’ধারে গুদাম আর ছোট ছোট খুপরি অফিস, ঘেমো গায়ে কুলিদের আনাগোনা, ওয়ারিং-এর ঝুলন্ত তার আর পানের পিক ভর্তি নোংরা দেওয়াল, এসব দেখে রুবাইয়ের গা ঘিনঘিন করছিল। এত নোংরা বাথরুম ও আগে কখনও দেখেনি। বিচ্ছিরি গন্ধ আর নোংরা জল চারদিকে। কোনও রকমে হাত ধুয়েই ও বেরিয়ে আসছিল। ঠিক তখনি করিডোরে লোকটার সাথে ধাক্কা লেগেছিল ওর । আসলে কী করে যেন পা-টা পিছলে গেছিল। টাল সামলাতে না পেরে ও পড়েই যাচ্ছিল। লোকটাকে ধরে ও যদিও সামলেছিল কিন্তু লোকটার হাতের দুটো বাক্স ছিটকে পড়েছিল। আর কিছু কাঁচের বোতল ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।

খুব ভয় পেয়ে গেছিল রুবাই। ‘সরি’ বলে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়েছিল লোকটার দিকে। হাল্কা চাপদাড়ি একটা আধময়লা সার্ট পরা লোকটা গুটখার পিক ফেলে, ওকে একটা নোংরা গালাগালি দিয়ে বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল ,

-"ইয়ে নুকসান কৌন ভরেগা অব?"

-"আমার বাবা দিয়ে দেবে। আপনি আসুন আমার সাথে।'' মুখটা কাঁচুমাচু করে বলেছিল রুবাই। ক্লাস সিক্সে পড়া রুবাই এমনিতে ভীষণ স্মার্ট, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কেমন যেন হয়ে গেছিল। লোকটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল। একটা পরিচিত গন্ধ পাচ্ছিল রুবাই ভাঙ্গা শিশিগুলো থেকে। ঠিক ওষুধের নয়, মনেও করতে পারছিল না ঠিক কীসের গন্ধ। ছোট্ট একটা জটলা তৈরি হয়ে গেছিল ওদের ঘিরে। হঠাৎ মামার একটা স্টাফ ওকে দেখে এগিয়ে এসেছিল। ততক্ষণে ঐ লোকটার দুই শাগরেদ বেরিয়ে এসেছিল পাশের একটা ছোট্ট গুদাম থেকে। ওরা কাঁচের টুকরো ও বাক্স পরিষ্কার করে তুলতে লেগেছিল। ঐ লোকটা মামার স্টাফটার সাথে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পরেছিল। রুবাই বারান্দার শেষ মাথায় মামার অফিসে দৌড়ে চলে এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে যাবে ভাবছিল। হঠাৎ একটা সাফারি পরা মাঝবয়সী লোক এসে চিৎকার করে উঠল -"ক‍্যায়া হো রহা হ‍্যয় ইধার ? কই মেলা লাগা হ‍্যায় ক‍্যায়া?"

সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল লোকটার কথায়। ঐ চাপদাড়ি লোকটা রুবাইকে দেখিয়ে বলল কী হয়েছে। রুবাইও বলল যা লোকসান হয়েছে ওর বাবা দিয়ে দেবে। লোকটা রুবাইয়ের বাবার নাম শুনে হাসল, বলল

-"ডাগতার বাবুকা বেটা? সোম-বাবু কা ভাগনা? তুম তো হামারা গেস্ট হো। কোই বাত নেহি। সব যাও আপনে আপনে কাম পর।"

ওর চুলটা ঘেঁটে দিয়ে লোকটা হাসল পান খাওয়া দাঁত বের করে। তারপর চাপদাড়িকে বলল,

-"এক কাম ভি ঢংসে নেহি হোতা তেরে সে!! জলদি সব সাফ কর, এক ভি কাঁচ কা টুকরা নেহি রহনা চাহিয়ে। কাম পে যাও বাকি সব। ''

লোকটার গলায় কিছু ছিল, ভিড়টা নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল। রুবাইও চলে গেল বাবার কাছে। মনটা বড্ড খচখচ করছিল। নিজেই বাবাকে খুলে বলল সবটা। আসলে লোকসান তো হয়েছিল। অতগুলো শিশি ভেঙ্গে ফেলল ও!! রাজেশবাবু শুনেই দত্তকে বললেন -"চলো তো দেখি!! কী কাণ্ড। দামটা না হয় দিয়েই দেবো।''

দত্ত বলল -''মনে হয় গোয়েল ফার্মা, ওদের গুদামটা ওখানে। আসুন দেখছি।''

রুবাইও ওদের পিছু পিছু গেলো। ছোট্ট গুদামটার ভেতর ভর্তি প্যাকিং বাক্স, ঢোকার জায়গা নেই। ভেতরের আরেকটা ঘর থেকে কথা ভেসে আসছিল। দত্তবাবুর ডাকে সেই সাফারি পরা লোকটা বেরিয়ে এলো। রাজেশবাবুকে দেখে বিগলিত। বলে উঠল

-"আরে ডাগতার বাবু হামারে ইধার? আইয়ে আইয়ে, লেকিন কাহা বৈঠায়ে আপকো! ইধার তো জাগা নেহি হ‍্যায়। উপর অফিসমে চলিয়ে সাব।''

রাজেশবাবু ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করছিলেন লোকটাকে চেনেন কিনা। অধিরাজ গোয়েল বলে একজনকে চিনতেন বহু বছর আগে। তবে লোকটা জাল ওষুধচক্রে জড়িয়ে জেল খেটেছিল।

-"গোয়েলজী, বাচ্চে নে কুছ নুকসান কর দিয়া আপকা শুনা...''

দত্ত আঙ্কলের কথার মাঝেই এক হাত জিভ কেটে লোকটা বলল,

-"আরে ও তো বাচ্চা হ‍্যায়, কিষণ ভগবান। ছোড়িয়ে দত্তাজী ও সব। আইয়ে অফিস মে। চায়ে পিজিয়ে আপলোগ। ''

ওঁর জোরাজুরিতে যেতেই হল ওঁর অফিসে, রাজেশবাবু বার বার দাম দিতে চাইলেও নিলো না। ওঁর একটাই কথা ওটা একটা এক্সিডেন্ট। রুবাই ভাবেনি লোকটা এত ভালো হবে। বাবাদের চা খাওয়ালো আর ওর জন্য এলো লস‍্যি। বড় একটা চকলেট বারও দিল ওকে। আবার আসতে বলল ওদের।


দত্ত আঙ্কলের সাথে গাড়িতে ফেরার পথে রাজেশবাবু বললেন -"লোকটা একটু বেশি অমায়িক মনে হল। কেমন যেন গায়ে পড়া... আমাকে চিনল কী করে?"

-''ও এই বাজারের বড় কন্ট্রোলার। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সাপ্লাই দেয় ওরা। তাই হয়তো আপনাকে চেনে। কত বড় মন্ত্রীদের সাথে ওঠাবসা। বড় স্টকিস্ট, তবে ভীষণ চতুর। বাদ দিন ওর কথা। সোম-বাবু সব জানে।''

সোম রুবাইয়ের ছোটমামার নাম।

রুবাই ভাবছিল শিশিগুলোর কথা, কী ওষুধ ছিল ও’গুলো? শিশিগুলো অন্যরকম। গন্ধটা অনেকটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত। এর আগে বেশ কয়েকটা রহস্য সমাধান করেছে রুবাই। চোখ কান ওর সর্বদা খোলা থাকে। এখানেও একটা রহস্যর গন্ধ পাচ্ছিল ও।


***************************


-"ডাক্তার বাবু, আমি কিছু খবর জোগাড় করেছি। প্রমাণ আছে বেশ কিছু। কিন্তু আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি কিছু করতে পারেন!''

ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেন না ডাঃ হালদার। ওকে ভেতরে ডেকে সবটা শুনলেন। ওর কমদামী মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন -''পুলিশে গিয়ে লাভ হবে না। মিডিয়াতে জানিয়ে দেখি কী হয়। অশোক তুমি কাল বিকালে এসো একবার। ''


অশোক চলে যেতেই এক পরিচিত খবর কাগজের এডিটর আর নিউজ চ্যানেলকে ফোনে সবটা জানান উনি। ওঁরাও বড় খবরের আশায় নড়েচড়ে বসেন।


অশোক ওঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বাড়ি আসে। মায়ের ফটোর বাসি ফুলের মালা ফেলে একটা ধূপ জ্বালে। ফোন আর ওষুধের স্যাম্পলগুলো গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। ভোরে উঠে বার হতে হবে কাজে। এক জোড়া চোখ যে ওকে বহুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে ও টের পায় না।


পরদিন সকালে কাজে যেতেই মালিক ওকে ডেকে পাঠায় গুদামে। একটু অবাক হয়েছিল অশোক। দু’মাস এই কাজে ঢুকেছে ও। গুদামে খুব পুরনো আর বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কাউকে ডাকে না মালিক। ওকে কাজটা দিয়েছিল পরাগের সুপারিশে। ওর কাজ ছিল বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি চালিয়ে মাল পৌঁছানো। অবশ্য সাথে লোক থাকে। মায়ের অসুখে ট্যাক্সিটা বেচে দিয়েছিল আগেই। পরাগকে বলে কাজটা পেয়েছিল। সকাল আটটায় বড় বাজার পুরো জেগে ওঠেনি তখনও। একটা দুটো করে দোকানের ঝাঁপ খুলছে। এত ফাঁকা ক্যানিং স্ট্রিট চোখেই পড়ে না। মেহতা বিল্ডিং এর দোতলায় গুদামে অবশ্য রাত দিন কাজ হয়। বসের অফিসে যখন ও ঢুকল আর কোনো অফিস খোলেনি। বস আর দুজন লোক রয়েছে অফিসে।

ওকে একটা বড় ডেলিভারির কাজ দেয় বস। কাজটা একাই করতে হবে বলে দেয়।


************************


রুবাই আজ মামার সাথেই খুব সকালে অফিসে এসেছে, বাবা মা গেছে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে। ও’দিকে নাকি প্রচুর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে স্কাই-ওয়াকের জন্য। অনেক ঘুরে যেতে হয় তাই ওকে সাথে নেয়নি। মামা দুপুরে ওকে সিনেমা দেখাবে আর চাইনিজ খাওয়াবে আজ। বাবা মা চায়না টাউনে চলে যাবে সোজা। মামা এতো সকালে এসেই একটা ভিডিও কনফারেন্সে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। রুবাই বাবার পুরনো একটা ফোন নিয়ে খুটখুট করছিল। বাবা এটা ওকে দিয়েছে ঘুরতে এসে। আজ তাড়াতাড়ি আসায় মেহেতা বিল্ডিং ফাঁকা। দূরবীনটা নিয়ে ও এদিক ওদিক দেখতে থাকে। বাগড়ি মার্কেট খোলেনি তখনও। আসলে ওর মন পড়ে রয়েছে কালকের সেই ঘটনায়। কী মনে করে রুবাই বেরিয়ে আসে করিডরে। দোতলায় গোয়েল আঙ্কলের অফিসটা চুপিচুপি একবার ঘুরে আসবে ভাবছিল । হয়তো খোলেইনি এখনও। কালকের সেই গুদামটা খোলা দেখতে পায়। কাজ চলছে ভেতরে। কালকের চাপদাড়িকে ঢুকতে দেখে রুবাই। কাকে যেন বলছে,

-"অউর থোড়া জলদি জলদি হাথ চালাও। আজ ইয়ে সব ডেলিভারি হোগা।''

কাছে এসে নাকে আবার সেই গন্ধটা পায় রুবাই। হঠাৎ মনে পড়ে সকালে মামাতো দিদির ড্রেসিং টেবিলে দেখেছিল শিশিটা। স্পিরিটের মতো গন্ধ। স্পিরিট লাগতেই পারে ওষুধের কোম্পানিতে। কিন্তু এখানে কী কাজে লাগে কে জানে!! কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না রুবাই। প্রথম ঘরটায় ঢুকে পড়ে, কেউ নেই! ওষুধের বাক্সের পিছনে লুকিয়ে ভেতরের ঘরে উঁকি দেয় রুবাই। কী করছে লোকগুলো বুঝতে পারে না প্রথমে। দুটো লোক তুলো দিয়ে ওষুধের পাতা ঘষছে। আরেকজন স্ট্যাম্প মারছে সে সব পাতায়। চাপদাড়ি আর আরেকজন সব গুছিয়ে রাখছে বাক্সে। কিছু যে একটা ভুল হচ্ছে বুঝতে পারে ও। হাতের মোবাইলটায় ভিডিও করে নেয় চুপচাপ । ওর ছোট্ট শরীরটা বাক্সের আড়ালে কেউ দেখতে পায় না। আবার পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ঠিক দরজায় দেখা হয়ে যায় একটা লোকের সাথে। এক দৌড়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে ও। না, কেউ আসেনি ওর পেছনে।

অশোক অবাক হয় ছেলেটাকে দেখে। বাচ্চাটা এই গুদামে কী করছিল কে জানে। মালিকের ছেলে নাকি! অত ভাবার সময় নেই ওর। পরাগকে ডেকে মাল রেডি করতে বলে ডেলিভারির জন্য। মুটের মাথায় মাল চাপিয়ে ব্রাবোর্ন রোডে ওর গাড়িতে মাল লোড করা শুরু হয়। দশটার ভিড় শুরুর আগেই বেরিয়ে যেতে হবে ওকে।


সাহসটা রুবাইয়ের বরাবরই একটু বেশি। গোয়েল আঙ্কল কী জানে কী হচ্ছে ওর গুদামে!! অফিস থেকে একটা গাড়ির নম্বর বলতে বলতে বার হচ্ছিল গোয়েল আঙ্কল। ওঁর কথা শুনে সিঁড়ির উল্টোদিকে কতকগুলো বস্তার আড়ালে লুকিয়ে যায় রুবাই। গাড়ির নম্বরটা চটপট নোট করে নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে গোয়েল আঙ্কল চাপা গলায় কথা বলছিল -"একদম খালাস কর দো। কোই সবুত না রহে, টিকটিকি কঁহিকা!''

রুবাই বোঝে কিছু একটা হয়েছে। ওকে আটকাতেই হবে ব্যাপারটা। গোয়েলকে নিচের গুদামে ঢুকতে দেখে ও লুকিয়ে একছুটে মামার অফিসে ঢুকে হাঁপাতে থাকে । মামার অফিসের ওয়াই-ফাই কানেক্ট করে ভিডিওটা বাবাকে পাঠিয়ে দেয় তক্ষুনি। কিন্তু মেসেজটা আনসিন হয়েই থাকে। বাবা যে কখন দেখবে!

মামার মিটিং শেষ, ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তক্ষুনি। গাড়ি চলেছে সল্টলেকের দিকে। সিটি-সেন্টার ওয়ানে একটা সিনেমা দেখবে ওরা প্ল্যান করাই ছিল। রুবাই মামাকে ভিডিওটা দেখাবে ভাবে, কিন্তু মামা তো গাড়ি চালাচ্ছে! উত্তেজনায় ঘামতে থাকে ও। সল্ট-লেকে ঢোকার মুখেই একটা বড়সড় দুর্ঘটনায় পুরো ই-এম বাইপাসে গাড়ি আটকে যানজট, ওরাও আটকে যায়। একটু আগেই হয়েছে ঘটনাটা, একটা ছোট ম্যাজিক ভ্যানকে ধাক্কা মেরেছে একটা দশ চাকার বড় ট্রাক। ট্রাকটা বেরিয়ে গেছে, ভ্যানটা পুরো উল্টে গেছে। তখনও চালককে বার করা যায়নি। বড় বড় বাক্স আর ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ওদের গাড়ির আগে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। পুলিশের গাড়ি আসছে সাইরেন বাজিয়ে। অনেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ওরা ফেঁসে গেছে মাঝখানে। ভিড়টা বেড়েই চলেছে। উঁকি দিয়ে কী হয়েছে দেখছিল রুবাই। গাড়ির নাম্বার প্লেটটা দেখে চমকে ওঠে!

ওদিকে ফোনটা বাজছে, বাবার ফোন। ধরতেই বাবার গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ে। ভিডিওটা কাউকে দেখাতে মানা করে বাবা। বাবা মাও সিটি-সেন্টারেই আসছে জানায়। রুবাই বলে দুর্ঘটনার কথা, যানজটের কথা। মামা ততক্ষণে খবর নিয়ে এসেছিল, কোনো চোরাই মালের গাড়ি, পালাচ্ছিল। ড্রাইভার গুরুতর আহত। হাসপাতালে নিয়ে গেছে পুলিশ। রুবাই ফোনে কথা বলতে বলতে এক-ঝলক দেখেছিল স্ট্রেচারে শোয়ানো লোকটার শরীর রক্তে ভাসছে, মুখটা বড্ড চেনা! দেখেছিল কোথাও... আজ সকালে ঐ গুদামে... গাড়ির নাম্বার প্লেটের ফটো তুলে রাখে রুবাই।


সিনেমাটা আর দেখা হল না রুবাইয়ের। যানজটে আটকে চায়না টাউনের বদলে বাইপাসের গ্লোবাল গ্ৰিলে বসেছিল বাবা মায়ের সাথে। ছোট মামা সব শুনে থ’। ওর ভিডিওটা খুঁটিয়ে দেখে মামা তখনই লালবাজারে নিজের বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রুবাই বারবার বলছিল ঐ দুর্ঘটনার গাড়ির নম্বরটাও ও বলতে শুনেছে গোয়েলকে।


ওদিকে খেয়ে বাড়ি ফিরে ওরা দেখে টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে খবরটা, ওষুধ চুরি করে পালাতে গিয়ে যুবক গুরুতর আহত। ছেলেটা নাকি ওষুধ চুরি করত গোয়েল ফার্মার। নতুন কাজে ঢুকেছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ একটা চ্যানেল বলছে ছেলেটাকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। দুর্ঘটনা নয় ওটা।

এক বয়স্ক ডাক্তার বলছিলেন যে ছেলেটা সৎ। ওকে ফাঁসানো হয়েছে চুরির দায়ে। রুবাইয়ের বাবা বললেন,

-"আরে, এ তো ডাঃ হালদার !! আমার স্যার। উনি এই কেসে কেন? ''

রুবাইয়ের সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কে ঠিক কে ভুল! ডাঃ হালদার বলছিলেন ঐ কোম্পানি ডেট পার হয়ে যাওয়া ওষুধের ডেট বদলে বাজারে ছাড়ে। বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দেয়। অন‍্য চ্যানেল বলছে ডাঃ হালদার নিজেই জাল ওষুধ কাণ্ডে সাসপেন্ড ছিলেন বহু বছর। রুবাইয়ের কিছুই ভাল লাগছে না। এবার ও বুঝেছে ওটা ছিল নেইলপালিশ রিমুভার, ওটা দিয়ে ওষুধের গায়ের আসল ডেট তুলে ওরা নতুন ডেট বসাচ্ছিল। এটাই হত ওখানে। ঐ ব্যস্ত এলাকায় কেউ কারোর খবর রাখে না। লালবাজারের নাকের ডগায় বসে ব‍্যবসা করত লোকটা।

হঠাৎ ছোটমামার ফোনে কল এলো একটা, মামা উঠে গিয়েছিল সাইডে। হাসি মুখে রুবাইকে থাম্বস-আপ দেখালো দূর থেকে।

টিভির পর্দায় আবার ব্রেকিং নিউজ। কলকাতার ক্যানিং স্ট্রিটের মত ব্যস্ত জায়গায় চলছিল জাল ওষুধের রমরমা কারবার। সব তারিখ পার হয়ে যাওয়া ওষুধ নতুন করে সেজে উঠত এখানে। আর আসল ওষুধের সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ত সব জায়গায়। প্রমাণসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছে মালিক দেবরাজ গোয়েল।

লাফিয়ে ওঠে রুবাই। ওর তোলা ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেছে। টিভিতে দেখাচ্ছে। মা এসে জড়িয়ে ধরে রুবাইকে। এই প্রথম ওর এই ধরনের কাজে মা এত খুশি হয়েছে।

না, এ বার রুবাইয়ের নাম গোপন রাখা হয়েছিল তদন্তের স্বার্থে। এই সব শয়তানদের হাত প্রচুর লম্বা। যাতে রুবাইয়ের কোনো ক্ষতি না হয় তাই ওকে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তবে রাজেশবাবু দাঁড়িয়েছিলেন ডাঃ হালদারের পাশে। বহু বছর আগে যখন দেবরাজের বাবা অধিরাজ গোয়েল এই ডাঃ হালদারকে ফাঁসিয়েছিল জাল ওষুধ কাণ্ডে তখন রাজেশবাবু স্টুডেন্ট ছিলেন। চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারেননি সেদিন। এতদিন পর সারের পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছিলেন অশোকের জন্য, ন্যায়ের জন্য।


বেকসুর খালাস পেয়েছিল অশোক। ওর সাক্ষ্য প্রমাণকে কেন্দ্র করেই কেস এগিয়েছিল। মা-কে দেওয়া কথা রেখেছিল ছেলেটা। হাসপাতালে রুবাইকে দেখে চিনতে পেরেছিল ও। বহুদিন যুদ্ধ করে অশোক এখন সুস্থ। রাজেশবাবু ওকে মালবাজারে ডেকে নিয়েছেন। বিশ্বাসী ড্রাইভার এখন পাওয়াই যায় না। ছেলেটা খুব কাজের। রুবাইয়ের সাথেও ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে অশোকের।

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল

গল্পের ঝুলি : আমাদের স্বাধীনতা: প্রিতম দাস




মনটা একদম ভালো লাগছে না বিতানের। স্কুল থেকে ফিরে কোনওমতে পিঠের ভারি ঢাউস ব্যাগটা খাটের উপর ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে আছে ও। খেয়েদেয়ে দু’ঘন্টা ঘুমিয়েই আবার পড়তে বসতে হবে ওকে। সাড়ে পাঁচটায় দিদিমণি আসবেন বাড়িতে, বিতানকে পড়াতে। ক্লাস ফোরেই এই পড়ার চাপ, ফাইভে উঠলে যে কী হবে কে জানে! মা বলেছে ক্লাস ফাইভ থেকে আরও ভালো করে মন দিয়ে পড়তে হবে, না হলে ভালো রেজাল্ট হবে না।


রোজ রোজ এই এক রুটিন আর ভালো লাগে না! মানে রোজ বলতে রোজ ঠিক না, সপ্তাহে পাঁচদিন। শনি, রবি ছুটি। স্কুলও থাকে ওই পাঁচদিনই। তবে তোমরা কিন্তু আবার ভেবে বোসো না যে এই ছুটির দু’দিন বিতান মজাসে খেলে, ঘুমিয়ে, কার্টুন দেখে, কমিক্স পড়ে কাটাতে পারে! তার কোন উপায় নেই। শনিবার দিনটা পুরোটাই কেটে যায় উইকেন্ডের টাস্ক করতে। রোববার সকালটা অবশ্য ফাঁকা থাকে, তবে বিকেলেই থাকে আবার আঁকার ক্লাস। তোমরাই বলো এসবের মাঝখানে বেচারা বিতান একটু দম ফেলবে কখন?


যাই হোক, কাল ১৫ই আগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। কালকে স্কুলে কোনও ক্লাস হবে না। স্বাধীনতা দিবস পালন হয়েই ছুটি। এইটা একটা ভাল কথা। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে 'ছোটা ভীম' একটু বেশি সময় নিয়ে দেখা যাবে! তবে খারাপ খবরও যে নেই তা নয়। ওদের ক্লাসটিচার ম্যাম বলেছেন সবাইকে কিছু না কিছু ভাবে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেই হবে। মানে কিছু একটা পারফর্ম করতে হবে আর কী! বিতানের এমনিতে এইসব কালচারাল ফাংশনে অংশগ্রহণ করতে একদম ভালো লাগে না! দর্শকটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু মঞ্চে উঠলেই মনে হয় সবাই যেন হেডদিদিমণির মত রাগী চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে! ওর সব কেমন গুলিয়ে যায়।


বিতান ঠিক করেছে অংশগ্রহণ যখন করতেই হবে, ও একটা কবিতাই আবৃত্তি করবে কাল। মাকে বলাতে মা বললেন কুসুমকুমারী দাশের লেখা 'আদর্শ ছেলে' কবিতাটা আবৃত্তি করতে। ওটাই সবচেয়ে ভালো হবে। কিন্তু আবৃত্তি করবে বললেই তো আর করা হয়ে গেল না, তার জন্য কবিতাটা ভাল করে মুখস্থ করতে হবে। তারপর বেশ কয়েকবার আবৃত্তির মতো করে বলা প্র্যাক্টিস করতে হবে। তাই আজ দিদিমণি চলে যাওয়ার পরও সব সেরে ঘুমাতে ঘুমাতে ঘুমাতে মনে হয় বেশ রাত হয়ে যাবে। কী আর করা, ক্লাসটিচারের নির্দেশ। অমান্য তো আর করা যাবে না।


বিতানের বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার পথে বস্তি পড়ে একটা। বিতান আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে আজকের বস্তির কোনও তফাৎ খুঁজে পেলো না। ও একটু অবাকই হলো। আসার সময় ওদের পাড়াতেই তো দেখলো কী সুন্দর ভারতের পতাকা টাঙানো হয়েছে একটা! ওকে দুটো লজেন্সও দিলো ওদের পাড়ার দীপকাকু। অথচ এখানে তো তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না বিতানের! তবে কি এখানে স্বাধীনতা দিবস আসেনি? না, ওই তো খালি গায়ে ওর বয়সী দুটো ছেলে একটা পুরোনো টায়ার নিয়ে গড়াতে গড়াতে এই দিকেই আসছে। হাতে একটা ছোট লাঠি। ওরা তো বিতানের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন! কী সুন্দর নিজের মনের সুখে ওরা খেলেধুলে বেড়াতে পারছে! তবে কেন ওরা পালন করছে না স্বাধীনতা দিবস, আর বিতান স্বাধীনতা দিবস পালন করতে যাচ্ছে স্কুলে? বিতান ভাবলো মাকে প্রশ্নটা একবার করলে হতো, কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলালো ও। বিতান জানে স্কুল যাওয়ার সময় মাকে এইসব আবোলতাবোল প্রশ্ন করলে, মার ধমক খাওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।


স্কুলে পৌঁছে বিতান দেখলো, ওদের স্কুলের মাঠটায় বড় একটা মঞ্চ বানানো হয়েছে। আর তার সামনেই স্ট্যান্ড বানানো হয়েছে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য। ফুল আর মালা দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে জায়গাটা। আজ স্টুডেন্টদের সঙ্গে সব অভিভাবকরাও উপস্থিত। সমস্ত মাঠ জুড়ে অনেক চেয়ার রাখা হয়েছে সবার বসার জন্য। তবে সামনের সারিগুলো স্টুডেন্টদের জন্য আর পিছনেরগুলো অভিভাবকদের। মানে তেমনি নির্দেশিত আর কী! বিতান দেখলো অনেকেই ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। এমনকি ওর বেস্টফ্রেন্ড রণজয়ও চলে এসেছে ওর আগেই। ওকে দেখেই রণজয় হাত নাড়লো, 'শুভম এইদিকে আয়’। ওহ্, তোমাদের তো বলাই হয়নি আমাদের বিতানের ভালো নাম শুভম সেনগুপ্ত। বিতান গিয়ে বসলো রণজয়ের পাশে। আর ওর মা রণজয়, অর্ণব, মধুরিমা এদের মায়েদের সঙ্গে গিয়ে বসলেন পিছনের সারিতে।


অনুষ্ঠান শুরু হল। সকলে উঠে দাঁড়ালে বড়দিম্যাম এসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন একদম প্রথমেই। এরপর সকলে মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পর শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিতিপ্রিয়া, সৌমিলি, অনুষ্কা সমবেত নৃত্য পরিবেশন করলো। রণজয় খুব সুন্দর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলো। অনুরাগ আবৃত্তি করল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটা। আমাদের বিতানও অবশ্য খারাপ করেনি। বেশ ভালোই হাততালি পেয়েছে ওর আবৃত্তিও।


সবশেষে বক্তব্য রাখতে মঞ্চে উঠলেন বড়দিম্যাম। মাইক হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন মঞ্চের একদম সামনে,


-“স্বাধীনতা। চার অক্ষরের একটা শব্দ। মানেটা কিন্তু অনেক বড়। আমরা স্বাধীনতা বলতে ঠিক কী বুঝি? আচ্ছা স্টুডেন্টস তোমাদের যদি বলা হয় একদিনের জন্য তোমরা স্বাধীন, যা ইচ্ছে তাই করতে পারো, কেউ তোমাদের বকবে না, কেউ তোমাদের মারবে না, তাহলে তোমরা কি করবে? একে একে বলো সকলে।”


বলে বড়দিম্যাম মাইকটা এগিয়ে দিলেন একদম সামনের সারির রৌনকের হাতে। সকলে একে একে বললো তাদের মনের সুপ্ত ইচ্ছের কথা। কেউ বললো আমি সারাদিন ভিডিও গেম খেলতাম। কেউ বললো আমি সারাদিন গল্পের বই পড়তাম। কেউ বললো আমি সারাদিন কার্টুন দেখতাম। বিতান অবাক হয়ে দেখলো কেউই বললো না আমি সারাদিন পড়াশোনা করতাম। এমনকি ক্লাসের ফার্স্টগার্ল সুস্মিতা পর্যন্ত পড়াশোনার কোনো ইচ্ছাই প্রকাশ করলো না! অথচ ওর মোটা চশমার পিছনে গোল গোল চোখ দেখে বিতান ভাবতো পড়াশোনা ছাড়া এ মেয়ে বোধহয় আর কিছুই বোঝে না। পড়াশোনাই বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় সুস্মিতার। কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে সুস্মিতা বলে উঠলো,

-“আমার ঘুরতে খুব ভাল লাগে ম্যাম। সুযোগ পেলে আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম, নতুন নতুন জায়গায়।”

মাইকটা সবার হাত ঘুরে আবার ফেরত গেল বড়দিম্যামের হাতে। মাইকটা নিয়ে তিনি আবার বলা শুরু করলেন,

-“দেখলে তো সুযোগ পেলে আমরা সবাই সব কিছুই করতাম কিন্তু কেউই পড়াশোনা করতাম না! আমরা যদি একটুও পড়াশোনা না করি তবে পরীক্ষার সময় আমরা কী করে পাশ করবো? পাশ না করলে উঁচু ক্লাসে উঠবো কী করে, নতুন জিনিস শিখবো কী করে? সেই কারণেই বাবা মা অভিভাবকরা আমাদের জোর করে পড়তে বসান। তবে একটা কথা আমি অভিভাবকদেরও বলবো, সবসময় অতিরিক্তি চাপ দেবেন না। ওদের একটু খেলাধুলোও করতে দিন, কমিকস পড়তে দিন, গল্পের বই পড়তে দিন। তবেই তো ওদের পড়াশোনাতেও আগ্রহ তৈরি হবে। আমরা তো সকলেই জানি জ্যাকের কথা, 'All work and no play makes Jack a dull boy' , কি, জানি না?
আর স্টুডেন্টস তোমাদেরও বলছি পড়াশোনার সময় পড়াশোনা আর খেলাধুলোর সময় খেলাধুলো, দুটোই যেন সমানভাবে চলে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে স্বাধীনতার যেন কোনও অপপ্রয়োগ আমরা না করি। মনে রাখবে 'with great power comes great responsibility' , আর স্বাধীনতার থেকে বড় শক্তি, বড় power আর কী-ই বা আছে? তাই আমাদের স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার করতে হবে আমাদেরই। আর এটাই প্রকৃত স্বাধীনতার মানে।”


বক্তব্য শেষ করলেন বড়দিম্যাম। হাততালিতে তখন মাঠে কান পাতা দায়! বিতান বুঝলো আজ সকালে স্কুল আসার সময় ওর বয়সী ছেলেদুটোকে দেখে ওর যা মনে হয়েছিল, তা আসলে ভুল ছিলো। সারাদিন খেলে বেড়ানোর স্বাধীনতা মোটেও ভালো কথা নয়। হয়তো ওরাও চায় না এমন স্বাধীনতা! ওরাও হয়তো চায় বিতানের মতোই স্কুলে এসে পড়াশোনা করতে! বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রেয়ার করতে! টিফিন টাইমে সবাই মিলে একসাথে টিফিন ভাগ করে খেতে! হয়তো ওদের কাছে স্বাধীনতা মানে এগুলোই, ইচ্ছেমতো ওই ঘুরে বেড়ানোটা নয়! বিতান ভাবলো আমরা বোধহয় কেউই আমাদের মনের মতো স্বাধীনতা কোনোদিনই পাই না। সুমিত যে স্বাধীনতাটা চেয়েছিলো সেটা হয়তো সুমন পাচ্ছে, আবার সুমনেরটা পাচ্ছে হয়তো অন্য কেউ। কী আর করা যাবে, সুমন না হয় সুমিতের স্বাধীনতাটা নিয়েই খুশি থাকুক। ক্ষতি কী?


(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : আবির

গল্পের ঝুলি : ঋভুর রুটিন : রুমেলা দাস






ধপাস করে দরজার সামনে পড়লো একটা মুখ হাঁ করা বাসা। পিছন থেকে জেঠিমার চিল চিৎকার কানে তালা লাগিয়ে দিলো,

-"ও ছোটো, ডিম পড়েছে ডিম পড়েছে। বারান্দার ওপরের তাকে বজ্জাত পায়রাগুলো বাসা বানিয়েছিলো। ওদের যেন দেখতে দিস না। সর্বনাশ হয়ে যাবে!"

আর সাথে সাথে পাশ থেকে রিমিদিদি চোখ বুজে দিলো চোঁ চাঁ দৌড়। আরেকটু হলে হুমড়ি খেতো আর কী! পায়ের দিকে তাকাতেই ঋভু দেখলো প্লাস্টিক, গাছের শুকনো পাতা, খড়, কোথাকার কোন ইলেক্ট্রিকের তার রাজ্যের এলোমেলো জিনিস দিয়ে তৈরি একটা বাসা! তাতে হলদেটে সাদা গোল পুঁচকে পুঁচকে দুখানা ডিম।

"ওমা!"- বলে ঋভু বাঁ-কাঁধের ব্যাগটাকে হড়কে নিচে ফেলে যেই না ধরতে যাবে, ওমনি

"ধরিস না, ধরিস না, দেখিস না, ছুঁস না..."- গোটা পাঁচ-আট 'না' বিভিন্ন সুরে বিভিন্ন তালে ছুঁড়ে তেড়ে এলো ওর মা। তা সে, যে অস্ত্র যে বেগেই আসুক না কেন! ততক্ষণে বাসা ঋভুর হাতে।

"এ ছেলেটাকে নিয়ে আমি আর পারি না। বিপদ না করে ছাড়বে না দেখছি!"

ঋভুর মা, জেঠিমা দুজনেই তুমুল বিলাপ করতে শুরু করে দিয়েছেন। ওর মন কিন্তু আনন্দে পিলপিল করছে। একলাফে বারান্দা টপকে সোজা সটান তরতর করে উঠে গেছে সিঁড়ি বেয়ে। উপায় নেই! মাথায় প্ল্যানটাও খেলে গেছে! এটাকে চোখের সামনে রাখলে যতক্ষণে ও পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরবে ততক্ষণে নিশ্চয়ই আর বাসারও হদিশ পাবে না। মা ঠিক ফেলে দেবে! কুণ্ডুকাকু আরো বার-চারেক হর্নটা বাজালো। স্কুলের ভ্যান এসে গেছে যে! ঝটপট আরও তাড়াতাড়ি করতে হবে কাজটা। পুরনো খেলনা ভাঙা যে পিচবোর্ড-এর বাক্সটা পিলুর মা ছাদে, টবের পাশে রেখেছে সেটাকে বগলদাবা করে, তাতেই গুঁজে দিলো বাসাটা। এদিক ওদিক থেকে ডানা ঝাপটানো ফড়ফড় আওয়াজটা বাসা পড়ার সাথে সাথে হচ্ছিলো। এখন ও দেখলো, আওয়াজটা থেমে ছাদের কার্নিশে এসে বসেছে। দু’টো পায়রা। এই ক’দিন বকম বকম, ফড়ত ফড়ত, ফটর ফটর, আর গাদা গাদা সাদা, খয়েরি পটি করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখার কর্ম এরাই করে তাহলে! আর গজগজ করতে করতে পরিষ্কার করে যে যখন পারে! পায়রাদু’টো গলাটাকে একবার ছোটো আর একবার বড় করছে। পুঁতির মতো লাল লাল গোল চোখ দিয়ে দেখছে ঋভুকে। ঋভুর আর দেখার সময় নেই। সড়াৎ করে বাক্সটাকে টেনে আলতো করে ঢুকিয়ে রাখে ট্যাংকের তলার ফাঁকা জায়গাটায়। নিচের হল্লা আরও আরও বাড়ছে। কোনওমতে হাত ঝেড়ে খানিকটা প্যান্টে মুছে, এক নিমেষে বোল্টের মত দৌড় দিলো ঋভু। সোজা বাড়ির গেট। রেহাই কি আছে! আঁকশির মত আঙ্গুল ততক্ষণে পাকড়েছে ঋভুর নোটা নোটা ডানকান।

"আঃ লাগছে মা!"

"এবারও তোর কপালে গোল্লা আছে!"

পড়ে থাকা ব্যাগটা হিঁচড়ে ভ্যানে রেখে মায়ের গালে চুমু খেলো ও। ভ্যানে বসে দেখলো, রিমিদিদি তখনও চোখ বুজে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে! একবার হাত কপালে ঠেকাচ্ছে আরেকবার বুকে। 'জয় মা সরস্বতী!'- ঋভুও ভ্যানের জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো। মা, জেঠিমার ব্যাজার মুখ! আর পাখিদুটো? উড়ে উড়ে ঘুরছে দোতলার বারান্দায়।

**************


বারান্দাতে-ই চেয়ার পেতে বসেছেন ঋভুর বাবা। এ হলো পরীক্ষা নম্বর ২! মানে শ্রেণীঘরে লেখা বা বলা উত্তরগুলো মিলিয়ে দেখেন সজল সমাদ্দার, অফিস থেকে ফিরে তবে তাঁর শান্তি। এক এক করে বলে চলেছে ঋভু,

প্রশ্ন- সোজা? উত্তর- সাপ্টা

প্রশ্ন- গাঢ়? উত্তর- খয়েরি

প্রশ্ন- সাদা? উত্তর- পায়রা

-"কী বলছো কী ঋভু তুমি? এগুলো বিপরীত শব্দ হচ্ছে? কে শিখিয়েছে তোমায় এসব! পইপই করে সব মুখস্থ করিয়েছিলাম।"

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। ঋভুর মনে হলো, বাবা এক্ষুণি ওকে জল দিয়ে গিলে ফেলবে!

-"আমি জানতাম এরকমই একটা কিছু করবে ও! সকাল সকাল যা কাণ্ডটা বাধিয়ে স্কুলে গেছিলো! শুভ কাজে গেলে ডিম দেখতে নেই পর্যন্ত! আর ও কিনা ছুঁয়েটুয়ে একাকার। আর পায়রাগুলোও বলিহারি। ডিম ফেলবি তো ফ্যাল পুরো ছেলেমেয়েগুলোর যাওয়ার রাস্তায়! কি অলুক্ষুণে!"

ঋভু বুঝলো বাবা-মা দুজনেই ক্ষেপে গেছে। তবে এটা বুঝলো না ওর ভুলটা কী! বাসাটা পড়ে গেছে। যাতে ডিমগুলো না নষ্ট হয়, ও সরিয়ে রেখেছে! ব্যাস! তার সাথে পরীক্ষা খারাপ হবার কী আছে? পরীক্ষা দেবার সময় মনটা খুঁতখুঁত করছিলো, কেউ যেন বাক্সটা দেখতে না পায়! বাড়ি ফিরে তাই একটা কাপড় দিয়ে আড়ালও করে দিয়েছে। অংশুকে স্কুলে গিয়েই বলেছে। ওর দাদু পায়রা পুষতো আগে শুনেছিলো। ওদের ছাদে নাকি ভর্তি থাকে তিরিশটা পায়রা। অনেক রকমের। পায়রাগুলো ওদের বাড়ির সবাইকে চেনে। আরও বলেছিলো, পায়রারা নাকি অঙ্ক কষতে পারে। সব থেকে বড়, বুড়ো পায়রাটা। সে খুব বিজ্ঞ। অংশু অঙ্ক করতে না পারলেই ওই পায়রাটার কাছে যায়! ঋভু অংশুর কথা ক্যাবলার মত শুনছিলো আর ভাবছিলো তাহলে তো বেশ হয়! অঙ্ক পরীক্ষা এখনও বেশ কিছুটা সময় আছে। ততদিনে নিশ্চয়ই পায়রাদু’টো বন্ধু হয়ে যাবে। তারপর না হয় জিজ্ঞেস করা যাবে, অনুশীলনীর যে অঙ্কগুলো কঠিন লাগবে!

"এত বাজে পরীক্ষা দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছো? বড়দি আবারও ডাকবে আমাকে!"

এই রে! ওকে কি খুব হাসি হাসি দেখতে লাগছে! আসলে কিছু ভাবনা এলেই, আপনা থেকে ওর ঠোঁট দুটো কান পর্যন্ত ঠেকে যায়! ঋভু নিজের গালে হাত বোলালো। আবার ঠোঁটদুটো ঠিক জায়গায় নিয়ে এলো।

-"আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। দু’দিন ছুটি। ইতিহাস পরীক্ষা সামনে। মন দিয়ে সকাল বিকেল পড়া। সারাদিন টোটো কোম্পানি বন্ধ। আমি অফিস থেকে ফিরে রোজ তোমার রিভিশন নেবো!"

-"জানো বাবা, গৌড়কাকু আরো দুটো নতুন টোটো কিনেছে।"

-"স্বপ্না! তোমার ছেলেকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও!"

বাবা তো আরও রেগে গেলো। সত্যিই তো! স্কুল থেকে যখন ফিরছিলো তখনই দেখেছে গৌড়কাকু দু-দুটো ঝকঝকে নতুন টোটো দাঁড় করিয়ে গোল গোল করে ধূপ দেখাচ্ছে। তাহলে কি বাবা, গৌড়কাকু টোটো কিনেছে বলে রাগ করেছে? কে জানে!

-"আবার ঠোঁট ওল্টানো হচ্ছে। দিন দিন তোমার বেয়াদপি বাড়ছে ঋভু! বাবার মুখের উপর তর্ক?"- ওকে মা হাত ধরে নিয়ে এলো খাবার ঘরে।

-"আমি জলখাবার দিচ্ছি। একটু রেস্ট নিয়েই পড়তে বসবে। আর কোনো বাজে কথা নয়!"

আঙুল তুলে শাসিয়ে মা রান্নাঘরে যেতেই সুবর্ণ সুযোগ হাতে পেলো ঋভু। একেবারে ছাদ! সন্ধে হয়েছে। জেঠিমা শাঁখে ফুঁ দিয়েছে। ওদের ছাদে লাইট আছে তাই দেখতে পাবে ঠিকই। পা টিপে টিপে গুটিগুটি এগোলো ট্যাংকের নিচের দিকে। ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। বিকেলে দেওয়া কাপড়টা সরালো। ঝটপট ডানার আওয়াজ! পায়রাদুটো কি ভয় পাচ্ছে ওকে দেখে? তুক তুক তুক আঃ আঃ আঃ মুখ দিয়ে সরু শব্দ করে আরও খানিকটা এগোলো। এইবার একটু স্পষ্ট। একটা পায়রা গোল হয়ে গা ফুলিয়ে বসে। আরেকটা ঝটফট করছে। ডিমদুটো? কোথায় গেলো ওদুটো? এই পায়রাটা গা ফুলিয়ে কী করছে? অংশু বলেছিলো ওরা 'তা' দিয়ে বাচ্চা ফোটায়! তবে কি ও 'তা' দিচ্ছে? বাচ্চা ফুটবে? কী মজা! কী মজা! ঋভু তালি দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে আনন্দে নেচে নিলো কিছুক্ষণ! নিচু হয়ে বসলো। দেখলো পায়রাটা গা ফুলিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে ওকে দেখছে!

**************


দেখছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাতে নিয়ে ডিমদুটো। কিচ্ছুটি বলে না বড় পায়রাদুটো। মানে ওদের বাবা-মা। তাই হবে হয়তো! ঋভু ঠিক জানে না। এদের তো আর দাড়ি গোঁফ নেই যে বুঝবে কোনটা বাবা! খোঁপাও নেই, মা চুলও বাঁধে না। ও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছে একটা একটু ছোটো আরেকটা সামান্য বড়। বড় যে পাখিটা তার গায়ের রংটা খুব গাঢ় শ্লেট আর কালচে মতন। মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছন ধূসর সাদা। পালকগুলো আঁশের মত সাজানো একগুচ্ছ। ছোট পাখিটার গায়ে সাদাটে ভাগই বেশি। অংশু বলেছে, ছোটোটা মেয়ে পাখি মানে মা। আর বড়টা বাবা পাখি। মাঝে মাঝে ওরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ থাকে না। তখন ঋভু ডিম দেখে। একদিন মা পাখিটা চলে এসেছিলো। ঋভু ভেবেছিলো এই হয়তো দিলো ঠুকরে! কিন্তু মা পাখিটা গলায় ঢেউ তুলে তুলে একবার ডানদিক, একবার বাঁ-দিকে দেখে ওর গায়ের কাছে উড়ে এসে বসেছিলো। হয়তো ওর খিদে পেয়েছে! এই ভেবে, ঋভু একটা মেরি বিস্কুটের টুকরো ওর জন্য নিয়ে এসেছিলো। ও খায়নি। ঠক ঠক ঠক করে কয়েকটা ঠোক্কর মেরেছিলো মেঝেতে। তারপর আবার উড়ে গেছিলো। বিস্কুট কেন খেলো না? ও কি মিষ্টি খেতে ভালোবাসে না? পরেরদিন রেখেছিলো মুড়ি ছড়িয়ে। এই দিন বেশ আনন্দ করে ঠুকরে ঠুকরে ছাদময় ঘুরে ঘুরে খেয়েছিলো। তারপর থেকে মুড়িই খায়। ঠাকুরঘর থেকে খুঁজে পেতে একটা মাটির সরা এনে রেখেছিলো বাসার মধ্যে। জল দিয়েছিলো তাতে। ওদের তো জল তেষ্টাও পায়! ঠোঁটে করে খানিকটা জল নিয়ে, মুখ সামান্য উঁচু করে ঠিক জেঠু যেমন করে গার্গল করে অমন করেই মা, বাবা পাখিগুলো জল খায়। এসব দেখতে হয় লুকিয়ে। একবার যদি বাড়ির কারুর নজরে পড়ে তবে আর রক্ষে নেই। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস ঋভু দেখেছে। প্রথম যেদিন ডিমদুটো দেখেছিলো সেদিনের তুলনায় এখন একটু বড় হয়েছে ও দুটো। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান পরীক্ষাও হয়ে গেছে। ইংরেজি, অঙ্ক বাকি। অংশু বলেছে, আঠেরোদিন পর বাচ্চা ফুটবে। গুনে গুনে দেখেছে, দশদিন হয়ে গেছে। উফ কবে যে ওই দিনটা আসবে! ওর আর তর সইছে না। ডিমগুলোর একটার ওপর থেকে কেমন নীল নীল শিরা দেখা যাচ্ছে! ও ডিমগুলোর তলায় ওর গেঞ্জি ছেঁড়া পেতে দিয়েছে, ডিম যাতে ভালো থাকে। সারাদিন ওগুলোই এখন ঋভুর ধ্যান জ্ঞান, ওদের বিছানা ঠিকঠাক না করে, ডিমগুলো কেমন দেখতে হচ্ছে তা না দেখে ওর শান্তি নেই।

ওদিকে মা সারাক্ষণ বকে। ডিম দেখার পর থেকে মা ভাবে, ঋভু খুব বড় বড় গোল্লা পাবে খাতায়। ঋভুর যে সারাক্ষণ জেঠতুতো দিদির মত বই নিয়ে বসতে ভালো লাগে না। রিমিদিদি ওর থেকে দু-বছরের বড়। ক্লাস এইটে পড়ে। ও সিক্সে। ওর পরীক্ষা রিমিদিদির মত অত ভালো হয় না। রিমিদিদি প্রতিবার ক্লাসে ১০-এর মধ্যে থাকে। কী ভালো! ঋভু অতো ভালো না হলেও, সেদিন সহেলি বলে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে ক্লাসে। ওকে বই না দেখে বিজ্ঞানের সব পড়াগুলো বলেছে। তার বেলা? দইয়ের ফোঁটা নিতে ভালো লাগে না। কপালে চ্যাটচ্যাট করে। মা, জেঠিমা বলে ওগুলো শুভ। ঋভু বোঝে না। যেটা পড়বে, সেটা মনে থাকলেই তো পরীক্ষা ভালো হবে। তবেই তো লিখতে পারবে। রিমিদিদি সারাবছর পড়ে বলেই কি ভালো নম্বর পায়? তবে দই ফোঁটা ভালো কেন? আর ডিম বাজে! ওর যেন পরীক্ষার দিনগুলোতে আরো বেশি করে ডিম খেতে ইচ্ছে করে! ধুর ছাই! পরশু অঙ্ক পরীক্ষা। একটু ভয় ভয় লাগছে। কৌশিক স্যার কী প্রশ্ন দেবেন? কে জানে! ক'টা আম কে খেলো? ভগ্নাংশ, সরলীকরণ, মৌলিক সংখ্যা, কোনটা কার দ্বারা বিভাজ্য সব তালগোল পাকিয়ে যায়। তবে একটা খুব পছন্দের। গ্রাফ! এক্কেবারে ঝট করে সমাধান হয়ে যায়। সময় বাড়ার সাথে সাথে ধান উৎপাদন কতটা বেড়েছিলো, আগের পরীক্ষায় এই গ্রাফটাতেই ১০/১০ পেয়েছিলো। প্রশ্নপত্র পেলে আগেই করে নেয় ওটাই। বাকিগুলো পরে। সবুজ চৌকো খোপে গুণে গুণে ফুটকি দিয়ে তারপর মেপে মেপে জুড়ে দাও। বড় একটা লাল রাইট পাবেই পাবে।


************


পাচ্ছে না, কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ঋভু। বোর্ডের তলা, নিজের পায়ের কাছে, রণিতের ব্যাগ পর্যন্ত উঠিয়ে দেখেছে। কিন্তু না! কোত্থাও নেই। অভ্যাস করে এসেছিলো যেটা, সেটাই পেয়েছে পরীক্ষায়। তাই ঝটপট করে সেরে নিয়েছিলো স্যার গ্রাফের কাগজটা দিতেই।

-"আর দশ মিনিট!"

স্যার তাড়া দিলেন। হাত পায়ের তলা ঘেমে উঠলো ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ। কী করবে এবার ও? বোতল চাপা দিয়েই তো রেখেছিলো। কোথায় গেলো তবে? হাওয়ায় উড়ে যায়নি তো? কিছুক্ষণ আগে থেকেই একটা উটকো হাওয়া দিচ্ছে। চারদিক কালো করে, ঢেকে গেছে নীল, সাদা মেঘ। কী করে জমা দেবে অঙ্ক খাতা?

-"ঋভু রায়, রোল নম্বর ২৩! কী করছো ওখানে? বেঞ্চে এসে বসো!"

জানলার কাছে যেতেই গম্ভীর গলায় ডাকলো স্যার।

-"আমার গ্রাফটা উড়ে গেছে স্যার!"

-"সেকি! আর পাঁচ মিনিট বাকি। তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও খাতা সকলে।"

স্যার কিছু বললোই না। কান্না পেলো ওর। গ্রাফটা খুব ভালো হয়েছিলো। ঠাণ্ডা ভেজা হাওয়াটা বোর্ডে আটকে রাখা খাতার পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। ও ভয় পেয়ে এগিয়ে গেলো বেঞ্চের দিকে। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করে ড্রাম পিটতে লাগলো। পাশে বসে রণিত ততক্ষণে খাতার পাতার সাথে গ্রাফ জুড়ে দিয়েছে পিন দিয়ে। তাহলে কি মায়ের কথাই ঠিক? জেঠিমাও ঠিকই বলে? প্রথম দিন ডিম দেখেছে বলেই কি আজ এই বিপদ! ডিম দেখলো বলেই কি আজ শেষ দিন এভাবে খারাপ হলো? অঙ্কে গোল্লা পেলে বাবা আর ট্যুরে নিয়ে যাবে না পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে। সারাবছর ওই বেড়াতে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ঋভু। অঙ্কে কি শূন্যই পাবে ও? কেন ও ডিমগুলো দেখলো? রিমিদিদি দ্যাখেনি। ওর পরীক্ষা নিশ্চয়ই ভালো হবে। কোথায় গেলে পাবে ওর গ্রাফ?

ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রি ইইইইইয়িং - করে বেলের শব্দটা একনাগাড়ে কানের কাছে বেজে উঠলো। আর ঠিক তখনই ঋভু শুনলো খুব চেনা সেই শব্দটা ফট ফট ফট ফটর ফটর, ও চমকে জানলার দিকে তাকাতেই দেখলো সাদা, শ্লেট মেশানো একটা পায়রা বসে। মুখে করে কী একটা নিয়ে টপাঙ করে ঠোঁট থেকে ফেলে দিলো ক্লাসের ভিতরে। আর একটুও বসলো না, উড়ে গেলো। এদিকে সবাই খাতা জমা দেবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। কাগজটা দুলতে দুলতে যেই না মেঝেতে পড়েছে, ঋভুর আনন্দে দম আটকে আসে আর কী! আরে, এটা তো ওর সেই গ্রাফটা! এটা কোথা থেকে পেলো পায়রাটা? হুররে... রেররে বলে সবাইকে ঠেলেঠুলে ছোঁ মেরে তুলে নিলো কাগজটা। ইশ কাগজটার গায়ে ধুলো লেগে গেছে। রুমাল দিয়ে কোনোমতে মুছে কাঁপা কাঁপা হাতে পিন লাগিয়ে জমা দিলো খাতা। মাথার মধ্যে কেমন করছে ওর। এটা কী করে সম্ভব? ততক্ষণে রণিত, সৌরদীপ, কৃষ্ণেন্দু 'কী হলো', ‘কী হলো' করে ভিড় জমিয়েছে চারপাশে। ও আবারও জানলার কাছে গেলো। কই না তো! আশেপাশে কোনও পাখি দেখতে পেলো না। দূরের কোনো বাড়ির তারে একটা কাক বসে হেঁড়ে গলায় ডেকে চলেছে। ওই পায়রাটা কি মা পায়রা? গায়ের রংটা তো অমনি সাদা ছিলো? কিন্তু তা কী হয়? ও তো ঋভুর ক্লাস চেনে না? আর তাছাড়া ওর গ্রাফটাই যে হারিয়ে গেছে সেটাই বা জানবে কি করে! আজব ব্যাপার! জিকে বইতে পড়েছিলো পায়রা ঘরে ফেরার জন্য ব্যবহার করে "ম্যাপ সেন্স" ও "কম্পাস সেন্স"। ম্যাপ সেন্সের ক্ষেত্রে তারা যেখানে বাস করে সেখানকার ভূমির চিহ্ন ও গন্ধ কাজে লাগায়। কম্পাস সেন্সের ক্ষেত্রে সূর্যের অবস্থান ও গতিবিধির ওপর নির্ভর করে। বইয়ের কথাগুলো কি সত্যি হলো? বন্ধুদের কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো জানলার বাইরে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগলো ওর গায়ে। সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্লাস থেকে। ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাসের বাইরে পা দিতেই দেখলো, রিমিদিদি পাশের ক্লাস থেকে বেরিয়ে স্কুলের বারান্দায় নীল দলের আঁকা সরস্বতী ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে কি সব বিড়বিড় করে বলছে, আর চোখ বুজিয়ে আছে। আজ ওরও শেষ দিন পরীক্ষার। ভূগোল ছিলো। ঋভু দিদির কাছে এসে দাঁড়ালো। মুখ তুলে দেখলো, আঁকা ঠাকুরের মুখটা কী সুন্দর হাসি হাসি!


*************


হাসছিলো আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো ঋভু। লাল চামড়ার উপর হলদে হলদে লোমগুলো নেতিয়ে গায়ে লেপ্টে রয়েছে। আর ঠোঁটদুটো শুধু ফাঁক করছে। মনের মধ্যে খুব আনন্দ হচ্ছে। ডিম দু’টো ফুটে আজ বাচ্চা হয়েছে। এদিকে রেজাল্টও বেরিয়েছে। ঋভু পাশ করে গেছে। রিমিদিদির ভালো নম্বর এসেছে কিন্তু ১০-র মধ্যে নেই। কেন কে জানে! ও সবাইকে বলছে, ডিম দেখার জন্যই গোটা পরীক্ষাটা খারাপ হয়েছে। কিন্তু ঋভু নিজের চোখে দেখেছে দিদি চোখ বুজে ছিলো। বাড়ির সবাই দিদির কথা বিশ্বাসও করছে। আর ও? ঋভু বিশ্বাস করছে না, কাউকে বিশ্বাস করাতেও পারছে না যে পায়রাটা গ্রাফের পাতা না দিলে, ও হয়তো পাশ-ই করতে পারতো না। সবাই ভাবছে গল্প কথা। তাই ও এই পায়রার ডিমগুলোর কথা, ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার কথাও কাউকে বলেনি। স্কুল থেকে ফিরেই জানাতে এসেছিলো মা আর বাবা পায়রাকে। সেদিনের পর থেকে মা পায়রাটাকে কতবার দেখেছে আর ভেবেছে তাহলে কি ওই ছিল সেদিন? আজ আর ওসব ভাবতে চায় না। হাতে করে মুড়ি এনেছিলো। তু তু তু করে দিতেই ওরা আজ আর নিজেরা খায়নি। মুখে করে নিয়ে বাচ্চাগুলোর কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো।

-"ঋভু অ্যাই ঋভু কোথায় গেলি? নিচে আয়, ড্রয়িং পরীক্ষা আছে তো!"

মা ডাকছে। তাইতো, আজ শনিবার। আঁকার স্কুলে পরীক্ষা। ভুলেই গেছিলো ও। মা নিশ্চয়ই খেতে ডাকছে। আসলে স্কুল ড্রেস ছেড়েই চলে এসেছিলো।

-"যাই ইইইইই"

বলে আস্তে করে ডিমের খোসাদুটো ময়লার জায়গায় ফেলে দৌড় লাগালো নিচে। খাবার টেবিলের সামনে এসে চক্ষু চড়কগাছ, মা যে ডিম ভেজে দিয়েছে। মাথা চুলকে মায়ের দিকে তাকাতেই দুহাতে জড়িয়ে ধরেন স্বপ্না দেবী। ও মনে মনে হাসে, ভাবে আজ থেকে ঋভুর রুটিনে আর কিচ্ছুটি থাকলো না, শুভ কি অশুভ। আরও আরও মন দিয়ে পড়বে শুধু। আর অনেক অনেক থ্যাংকস জানালো পায়রাটাকে, মা সরস্বতীকে।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

গল্পের ঝুলি : টুবলুকে টক্কর : শেলী ভট্টাচার্য (অন্তহীনা)





"টুবলু এতো কাহিনী জানে কী করে রে?" ভ্যাবলার ক্যাবলা ক্যাবলা প্রশ্নে মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল বিল্টুর। এমনিতেই সে কয় মাস ধরে টুবলুর হাজার রকম মিথ্যে জারিজুরি ভরা প্যাঁচগুলো টের পেয়েও কোনও উত্তর দিতে পারছে না। তার উপর জুটেছে টুবলুর এই শহুরে বীরুদা। সে হল গিয়ে টুবলুর বাবার পিসতুতো দাদার বৌয়ের মাসতুতো বোনের ছেলে। উফফফ, সম্পর্কগুলোর জট যে এতোক্ষণ মনে রাখতে পেরেছে বিল্টু, সেই ভেবেই নিজের উপর কেমন একটা গর্ববোধ হচ্ছে। কেন যে ইতিহাসের সাল তারিখগুলো এভাবে মনে থাকে না তার, কে জানে? তাহলে আর রোজ স্কুলে হরেন মাস্টারের ভয়ে থাকতে হ’ত না। অঙ্ক, বিজ্ঞান সব ঠিকঠাক পড়ে নেয় সে, মাথাতেও সেগুলো চটপট খেলে যায় তার। কিন্তু ওই এক ইতিহাসেই প্রকৃত অর্থে এক্কেবারে পানাপুকুরে চরা পাতিহাঁস সে। আর টুবলু ব্যাটা ওই ইতিহাসেই ক্লাসে বরাবর হায়েস্ট মার্কস পায়। সালতারিখ সব চোখ বন্ধ করে গলগল করে বলে দেয় সে। বিল্টুকে ক্লাসে পেলেই তার কাছে গিয়ে ইচ্ছা করে খোঁচা দিয়ে এই বাবরের জন্ম তো এই আকবরের মৃত্যু সাল জিজ্ঞেস করে মুখ টিপে হাসে টুবলু। একমাত্র অঙ্কটা দিলেই সে জব্দ হয়ে যায় বিল্টুর কাছে। সেই টুবলু কিনা আজ প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আর্যভট্টের জন্ম মৃত্যু সাল বলে দিয়ে অঙ্কের বীরেন স্যারের মন জয় করে নিল। বিল্টুর সবচেয়ে খারাপ লাগে যে, টুবলু যেটুকু জানে, তার চেয়ে দেখায় অনেক বেশি। আর সবাইকে বলে বেড়ায় যে, সে নাকি অনেক বই পড়ে। তাই অনেক জ্ঞানী সে। তবে কেউ বই চাইতে গেলেই বলে, ওদের আলমারির চাবি নাকি ওর বাবা সবসময় সাথে নিয়ে রাখেন। অনেক দামি বই আছে কিনা তাতে! তাই টুবলু ওর বাবা ফিরলেই রাতে আলমারি খুলে পড়তে বসে সে’সব বই। আর সবার মতো কূপমণ্ডুক হয়ে পড়ার বই নিয়ে শুধু বসে থাকার ছেলে সে নয়। 'সবার' শব্দটা উচ্চারণের সময় আড়চোখে তাকায় বিল্টুর দিকে। বিল্টুর এটাই সহ্য হয় না। ওর পরিষ্কার মনে আছে, টুবলু একবার আমের আচার চাটতে চাটতে আমেজে গল্প করে ওকে বলে দিয়েছিল যে ওর শহুরে বীরুদা পড়াশোনায় দারুণ। অনেক কিছু জানে সে। ওদের বাড়িতে টুবলুরা যখনই যায়, অনেক গল্প শোনে তার কাছে। ওই একবারই মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল সেসব কথা। আর এসব জানে বলেই বিল্টুর বড্ড রাগ হয় টুবলুর উপর। সে পারতে মিথ্যা বলে না, বলাটাও পছন্দ করে না, সেখানে বিদ্যা আহরণের বিষয়ে তো নয়ই। তার উপর সব কথাতেই নিজের বংশের সাথে সারা দুনিয়ার বিখ্যাত লোকেদের একটা নয় একটা সূত্রাকার সম্পর্ক বার করে ফেলে টুবলু। আর সবাই হাঁ করে ওর ঢপের কীর্তনগুলো হজম করে।

কিন্তু কোনোভাবেই টুবলুর মিথ্যেটা কেউ টের পায় না। প্রতিদিন স্কুলের পরে বিকালের খেলার মাঠে খেলা সেরে এক ডজন কলা নিয়ে বসে একের পর এক কলা ছুলে খেতে থাকে পেটুক টুবলু। আর কলার খোসাগুলো ছুঁড়ে এদিক ওদিক ছড়াতে থাকে। সাথে চলতে থাকে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রমাণের ঢপবাজি গল্প ... আজ এই বই পড়েছি ... শুধু দেশি বই পড়ে কী হবে ... ইত্যাদি। তারপর শুরু করে এক একটা গল্প। আর তখন ওকে ঘিরে বসে থাকা সব হাঁ করা মুখগুলো দেখে তারিয়ে তারিয়ে মজা নেয় ও। হাবলু, ভ্যাবলা তো গোগ্রাসে গিলতে থাকে সেসব গল্প। তারপর ওরা বিল্টুকে ঘরে ফেরার পথে যেতে যেতে বলতে থাকে, 'টুবলু কত জানে রে, কত বই পড়ে ও'। অথচ বিল্টু আজ অবধি টুবলুর বাড়িতে ইতিহাস ছাড়া অন্য কোনো পাঠ্যবইয়ের টিকিটিও সামনাসামনি দেখতে পায়নি। ওর সব কাহিনীর ঝোলা যে ওই বীরুদা, সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। ইসস, বিল্টুর যদি এমন কোনো শহুরে দাদা বা দিদি থাকতো, তাহলে অন্তত টুবলুকে একটু টক্কর দিতে পারতো ও।

একবার স্বাধীনতা দিবসের জন্য অনুষ্ঠানের রিহার্সাল হচ্ছিলো স্কুলের ব্যায়ামের ঘরে। সেসময় বিল্টুকে স্যার ক্ষুদিরাম বসুর জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করলে, বিল্টুর আগেই টুবলু সব বলে দেয়। তাতেও পুরোপুরি দমে না সে। খেলার মাঠে বসে বলতে থাকে, তার কোন আত্মীয় নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্ল্যানচেট করে নিয়ে আসতো। আর তাদের কাছ থেকে তাজা তাজা গল্প শুনতো সেইসব দিনের। টুবলুর ভাগ্য যে সেসব গল্প সেও জানে। আর বড় হয়ে সেও প্ল্যানচেট করা শিখে নিয়ে যখন তখন বড় বড় মনীষীদের ডেকে আনবে। তার জন্য কিছু বিদেশি বইও পড়বে।

কথাগুলো শোনামাত্র বিল্টুর মাথা গরম হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এতো বড় ঢপবাজ ছেলে টুবলু! বলে কিনা প্ল্যানচেট করে মনীষীদের আনবে। সোজা হনহন করে হেঁটে গিয়ে সে গ্রামের পুরানো হাসপাতালটার পেছনের ছোট্ট মাঠে গিয়ে বসলো। ঠিক তখনই এক বছর কুড়ির ছেলে এসে পা ঝুলিয়ে বসলো ওর পাশের ভাঙাচোরা পাঁচিলটার উপর। সন্ধের কমলা আলো তখন নীল আকাশের গায়ে আলপনা এঁকে চলেছে পশ্চিমাকাশ জুড়ে। বিল্টু কথা বলার আগেই ছেলেটা ওকে 'ভাই' সম্বোধন করে কথা শুরু করলো।

"মন খারাপ নাকি ভাই?"

"হুম" , মনমরা মুখটা উপর-নিচ করে জানালো বিল্টু।

"তা, সমস্যাটা কি বন্ধুকে নিয়ে?"

চমকে বলে উঠলো বিল্টু "কী করে জানলে?"

"দাদারা সব জানে।"

কথাটা বড্ড আপন লাগলো বিলটুর। তারপর টুকটাক কথার মধ্য দিয়েই সহজে আলাপ হয়ে গেল দুজনের। বিল্টু ওর মনের সব কথা খুলে বললো এক দাদা পেয়ে। তারপর সেই দাদা ওকে একটা বুদ্ধি দিল।

পরেরদিন দাদার পরিকল্পনা অনুসারে বিল্টু টুবলুকে উদ্দেশ্য করে সবার সামনে খেলার মাঠে বলতে শুরু করলো,

"জানিস, চৌধুরীদের আমবাগানের পাশে যে পরিত্যক্ত বাড়িটা আছে না, ওতে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার থাকতো।"

যথারীতি টুবলু প্রশ্ন করে বসে "তুই কী করে জানলি?"

"আমি গতকাল ঘরে ফেরার পথে সব জেনেছি।"

"কার কাছে?" প্রায় সমস্বরে।

"এক দাদার কাছে। সে ওই বাড়ির কারোর আত্মীয় ছিল। তবে সেই দাদা বলেছে, যে আমাদের মধ্যে যারা সাহসী, তারা ওই বাড়ির কাছে এলে, দাদা আরও অনেক গল্প শোনাবে। অবশ্য সন্ধের পর আসতে হবে তাদের।"

কথাটা বলতেই ভ্যাবলা ভয়ে বলে উঠলো "বাবারে, চৌধুরীদের আমবাগান! সেখানে তো ভূত আছে।"

বিল্টু কথাটা পাত্তা না দিয়ে টুবলুর পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো,

"আরে আমাদের মধ্যে এমন একজন সাহসী থাকতে ভয় কীসের? কিরে টুবলু ঠিক বলিনি? তুই তো প্ল্যানচেট শিখবি, তো এমন জায়গায় চল, একবার ঘুরে আসি আজ।"

টুবলু ঢোক গিলে একবার সবার দিকে তাকালো। তারপর নিজের কলারটা একটু নাড়িয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বললো,

"হ্যাঁ, হ্যাঁ, চল। কোনও ব্যাপার না।"

কথামতো সন্ধে সাড়ে ছ’টার দিকে খেলার মাঠ থেকে উঠে সবাই এগোতে থাকলো চৌধুরীদের আমবাগানের দিকে। পথে ভ্যাবলার হঠাৎ পেটে মোচড় দেওয়ার অজুহাত খাড়া হল। সে ঘরের পথে হাঁটা দিল। হাবলুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ওর ন’পিসির আসার আজগুবি গল্পকথা। সেও পালালো নিজের ঘরে। পড়ে রইলো বিল্টু আর টুবলু। টুবলুর ইচ্ছা না থাকলেও উপায় নেই। প্রেস্টিজের ব্যাপার। অতঃপর দুজনে যখন চৌধুরীদের আমবাগানে ঢুকলো তখন, রাতের অন্ধকার প্রায় ছুঁইছুঁই। ওরা ধীর পায়ে হেঁটে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছনে যেন কে একটা ডাকলো টুবলুর নাম ধরে। টুবলু ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে বিলটুকে জড়িয়ে ধরলো। বিল্টু তো আগে থেকেই জানতো এ সেই দাদার গলা। তাই স্বাভাবিক স্বরে বললো "কীরে, এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?"

"কে যেন ডাকলো আমায়" কাঁপা গলায় বলে উঠলো টুবলু।

"হবে কেউ, আমাদের মতোই এ বাগানে এসেছে হয়তো।"

"এই ভূতের বাগানে কে আসবে রে এই অন্ধকারে?"

বলতে বলতেই আবার হাতখানেক দূরের আমগাছের ফাঁক গলে সেই গলার স্বর ভেসে এলো। কতকটা প্রতিধ্বনিত হয়ে,

"ভয় পেয়ো না টুবলু, বিল্টু। আমি তোমাদের কিছু কথা বলি শোনো। আমি ওই বাড়িটাতে আজ থেকে সত্তর বছর আগে থাকতাম। অনেক কষ্ট করে সেসময় দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়িয়েছি আমরা।"

বিল্টু কথাগুলো শুনতে শুনতে টুবলুর দিকে চেয়ে দেখলো ওর চোখেমুখে ভির্মি খাওয়ার আগের অবস্থা প্রায়। কথাগুলো হয়ে যাচ্ছে তখনও ....

"এতো বড়ো শক্তিকে আমরা কীকরে পরাজিত করেছিলাম জানো? আমরা সবাই এক হয়ে ছিলাম বলে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা লড়েছি। সত্যপথে চলেছি। মিথ্যার আশ্রয় নিইনি কখনো। আশা করি তোমরাও আজ সেই সত্যপথে চলে আমাদের স্বপ্নের স্বাধীন ভারতকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই তো?"

বিল্টু মুখ টিপে দাঁড়িয়ে দেখলো টুবলু হ্যাঁ কথাটা বলতে চাইলেও, গলা দিয়ে আওয়াজ সরছে না তার। তারপর আবার সেই গলার স্বর বলে উঠলো,

- "এবার তোমরা বাড়ি যাও। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মনে রাখবে মিথ্যাচরণ কখনও নয়। আর হ্যাঁ টুবলু শোনো, মনে রেখো দেশটা আমাদের, তাই সব দিক থেকে তাকে আমরাই পরিষ্কার রাখবো। তাই খেলার মাঠে ওরকম করে কলার খোসা এদিক ওদিক ফেলো না কিন্তু। কেউ পড়ে গেলে বিপদ হতে পারে তো। আমি জানি তোমরা ভালো হবে। ভালো দেশ গড়বে।"

টুবলু কোনোরকমে মাথাটা নত করে সম্মতি জানিয়েই দ্রুত হাঁটা লাগালো ঘরের দিকে।

পরের দিন থেকে তার ধুম জ্বর এলো। বিল্টু সেসময় সকাল সন্ধেয় গিয়ে বন্ধুর খবর নিচ্ছিলো। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল, সে ওই দাদার সাথে মিলে টুবলুকে সঠিক শিক্ষা দিতে গিয়ে, বন্ধুর কোনো ক্ষতি করে বসলো না তো? কিন্তু সেই দাদার দেখা আর পাচ্ছে না সে কিছুতেই।

তারপর স্বাধীনতা দিবসের দিন স্কুলে আসা এক নতুন শিক্ষকের কথায় বিল্টু জানতে পারলো যে, সত্যি ওই আমবাগানের পাশের ভাঙাচোরা বাড়িটাতে এক স্বাধীনতা সংগ্রামী থাকতেন। ক্ষুদিরাম বসুর মতোই খুব অল্প বয়সে তিনিও প্রাণ দিয়েছিলেন সত্যাগ্রহ চলাকালীন। তিনি ছিলেন এ গ্রামের গর্ব। তাই তার একটা মূর্তি গড়া হয়েছে স্কুলের মাঠে। আজ তার উন্মোচন হবে। বিল্টু চমকে উঠলো সেই মূর্তি দেখে, এতো সেই দাদা! তার সারা গায়ে একটা শিহরণ খেলে গেল নীরবে। তাই বোধ হয় সেদিন পরিকল্পনার পর যখন বিল্টু দাদাকে বলেছিল যে, সে মিথ্যা স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প বলে টুবলুকে আমবাগানে নিয়ে যেতে পারবে না। তখন দাদা বলেছিল 'মিথ্যা নয় তো। আর এতো দেশের, দশের ভালো চাওয়া'।

হঠাৎ পেছন থেকে টুবলুর ধাক্কায় সম্বিত ফিরলো বিল্টুর। সে এখন বেশ সুস্থ। বিল্টুর কাঁধে হাত রেখে বললো সে "ধন্যবাদ ভাই। তুই সেদিন ওই আমবাগানে নিয়ে গিয়েছিলি বলে, আমি নিজের অনেক ভুল বুঝতে পেরেছি। মিথ্যা বলা অন্যায়। যে দেশকে স্বাধীন করতে এতো নাম না জানা মানুষের অবদান আছে, সেই দেশকে আমরা আরো উন্নত করবো, সততা দিয়ে।"

দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে। মাইকে বেজে উঠলো গান ... ‘বন্দেমাতরম... '

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : শেলী ভট্টাচার্য

গল্পের ঝুলি : নববর্ষের গল্প : শ্রেয়সী মুখার্জী






আজ সকালেও বেশ দেরি করেই ঘুমটা ভাঙলো মিতুলের। পুজোর ঘর থেকে চেনা ধূপের মিষ্টি গন্ধটা ভেসে আসছে।বিছানায় শুয়ে শুয়েই একপ্রস্থ ভেবে নিল আজ কোন কোন জামা কখন কখন পরবে ও। তারপর একলাফে বিছানা থেকে নেমে ব্রাশ হাতে সোজা বাগানের দিকের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো মিতুল। বাইরে আজ ঝলমলে রোদ্দুর, সকালের নরম বাতাসে মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। বাগানের বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া বুড়ো আমগাছটাকে প্রথম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালো। আজকাল আর কেউ নববর্ষ বলতে চায় না, মিতুলের বন্ধুরা সব বেঙ্গলি নিউ ইয়ার উইশ করে। কিন্তু ওকে বাবা বলে দিয়েছে সবার আগে নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান করতে শিখতে হয়।

বারান্দার কোণে রাঙাদিদু বড়ি শুকোতে দিচ্ছে। ওদিকে বাবা দ্বিতীয়বার চা সহযোগে খবরের কাগজটা আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছে। মা রান্নাঘরে আনন্দীমাসিকে নিয়ে মহা ব্যস্ত, দুপুরে বাড়িতে বিশাল আয়োজন। নানাবিধ বাঙালি পদ সহযোগে নববর্ষের দুপুরের জমিয়ে আড্ডা ও খাওয়াদাওয়ার রেওয়াজটা নাকি সেই ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসছে। ছোটোকাকু, সেজমাসি, মণিদিদা আর বুকুনরা সবাই এলো বলে। পাশের বাড়ির বন্ধু রিকু আর তার বোনকেও আসতে বলেছে মিতুল। এই আড্ডা হইচই বাঙালিয়ানা সবটাই ভালো লাগে মিতুলের, কিন্তু তার থেকেও ভালো লাগে উৎসবের আগের এই প্রস্তুতিটা দেখতে।

হাতে বেশি সময় নেই, স্নান করে গোলাপি জামাটা পরে নিয়ে কোঁকড়া চুলগুলো সামলে দুটো ক্লিপ লাগিয়ে নেয় মিতুল। নিচে এসে মা'র কথামতো ফ্রিজ থেকে দই মিষ্টিগুলো বের করে রাখে।তারপর ফ্রিজের কোণার দিক থেকে বের করে আনে বড়ো লাল প্যাকেটটা। মায়ের ফোনটা নিয়ে কার সাথে যেন কথা বলে নিয়ে আশ্বস্ত হয় মিতুল। তারপর মায়ের সঙ্গে ইশারায় কীসব যেন কথা হয়ে যায়। ছাতা আর লাল প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও।

ঝিলের পাড়েও আজ মহা উৎসব। আজ নাকি পয়লা বৈশাখ। কৌতূহল চাপতে না পেরে মিঠি শেষ অবধি ছেঁড়া জামাটায় কুড়িয়ে পাওয়া সেফ্টিপিনটা লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, "পয়লা বৈশাখ মানে কী রে দিদি?" সারা বছর দিন তারিখের হিসেব না রাখলেও দিদি বেশ করে মিঠিকে বুঝিয়ে দেয় যে পয়লা বৈশাখ মানে নতুন বছরের শুরু। কিন্তু নতুন বছর কীকরে শুরু হয় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না মিঠির। এটাও তো সেই আর পাঁচটা দিনের মতো, কোন ভোরে মা বাবা কাজে বেরিয়ে যায়। মিঠিও সকাল থেকে খিদে চেপে দিদির হাত ধরে স্টেশনে পয়সা চেয়ে বেড়ায়। আর বেলা বাড়লে ক্লান্ত হয়ে একটুকরো বাসি রুটি রেললাইনের ওপারে বসে দু’জনে ভাগ করে খায়। তাই নিজের ছয় বছরের জীবনে 'নতুন' শব্দটা শুনলেও, মানেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি মিঠি।

তবে আজ দিদি কোথায় যেন শুনেছে কারা যেন বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে খাওয়াবে। দিদির কোল থেকে নেমে অনেক খাবারের গন্ধকে পেছনে ফেলে একটা লাল বড়ো প্যাকেটের দিকে চোখ চলে যায় মিঠির। একটা গোলাপি জামা পরা মেয়ের হাত থেকে ঝুলছে। দিদি জোর করে দু’গ্রাস খাইয়ে দেয়। আজ অনেকদিন পর এতো খাবার পেয়েও মিঠির মনটা ওই লাল প্যাকেটে আটকে। বস্তিতে পড়াতে আসা দিদিমণিদের মতো করে বানান করে লাল প্যাকেটের ওপরের লেখাটা পড়ে মিঠি, 'ন-ব-ব-র্-ষে-র শু-ভে-চ্ছা'। মানেটা ঠিক না বুঝলেও কেমন করে যেন 'নতুন' কথাটার মানেটা আজ মিঠি বেশ বুঝতে পারে।


খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটলে শুরু হল গিফ্ট দেওয়ার পালা। জামাকাপড়, খেলনা, সুন্দর ছবি দেওয়া গল্প ও ছড়ার বই আরও কত কিছু!

মিতুল অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করছিল হাঁটু অবধি ধুলোমাখা, অপুষ্টিতে চুল বাদামী হয়ে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটার মন খাওয়ার দিকে নেই। বারবার ঘুরেফিরে ছোট্ট চোখদুটো যেন ওর হাতে ধরা লাল প্যাকেটে এসে আটকে যাচ্ছিল। একবার যেন মনে হল মেয়েটা অস্ফুটে প্যাকেটের গায়ের লেখাটা পড়ার চেষ্টা করছে। তখনই মিতুল মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল ওর আনা গিফ্টটা ওই দুই বোনকেই দেবে।


মিঠি কতদিন ভোরে কত সুন্দর সব স্বপ্ন দেখে, ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন, মায়ের হাত ধরে সুন্দর জামা পরে মেলায় যাওয়ার স্বপ্ন। দিদি বলে ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! কিন্তু কোনোদিন তো বলেনি চোখ খুলে দিনের আলোয় দেখা স্বপ্নও এভাবে সত্যি হতে পারে! ওই গোলাপি জামা পরা দিদিটা যখন ওদের হাতেই ওই লাল প্যাকেটটা তুলে দিল, তখন সারাদিনের সব আলো বুঝি মিঠির মুখে এসেই জমা হয়েছিল।


আজ মিঠিদের বস্তিতে জমজমাট আসর, বিকেলে পড়াতে আসা দিদিমণিদের সবাই কে কী গিফ্ট পেলো দেখাতে ব্যস্ত। মিঠি আর তার দিদি চুপচাপ লাল প্যাকেটটা দিদিমণিদের হাতে দিল। ওদের কথামতো একজন দিদিমণি প্যাকেটটা খুলে দেখলেন ভেতরে একটা বড় কাগজের বাক্স আর তার সাথে একটা চিঠি। কাগজের বাক্সটাই প্রথমে খুললেন দিদিমণি। এবার বুঝি ছিল চমকের বাকি থাকা আসল অংশটার পালা। বাচ্চারা সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখল ভেতরে একটা বিশাল বড় অদ্ভুত আকৃতির হাতে বানানো ক্ষীরের মিষ্টি। 
দিদিমণি সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বললেন, তার বলতে শুরু করলেন,

- “তোমরা যে এই বড় মিষ্টি দেখছো এটা একটি বিশেষ আকৃতি দিয়ে বানানো হয়েছে, সেটা কীসের জানো?”

বাচ্চারা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।

দিদিমণি বলে চললেন,

-“এ হল আমাদের পরম প্রিয় মাতৃভূমি ভারতবর্ষের মানচিত্র। আর এই যে দেখছো মিষ্টির ওপরে কাজু, কিসমিস, পেস্তা, নানারকমের বাদাম আরও কত কী দেওয়া আছে, এগুলো দিয়ে এক একটা রাজ্যের রাজধানীকে চিহ্নিত করা আছে, আর কোনটার কী নাম তা এই কাগজের প্যাকেটের ভেতরের দিকে লেখা আছে।"

বস্তিতে পড়াতে আসা দিদিমণিরা সবাই তখন খাবারের মাধ্যমে বাচ্চাদের নিজের দেশকে চেনানোর এই অভিনব পদ্ধতি দেখে অভিভূত। বাচ্চাদের মনেও তখন নতুন জিনিস শেখার নিজের দেশকে চেনার একরাশ আনন্দ। এবার চিঠিটা পড়ার পালা-

প্রিয় বাচ্চারা,

তোমরা যে আজ নিজের দেশকে চিনলে তার ভবিষ্যৎ কিন্তু তোমাদের হাতেই গড়া হবে। তাই নিজের দেশকে ভালো রাখতে গেলে সবার আগে নিজেকে একজন মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জীবনে বড় মানুষ হয়তো সবাই হতে পারে না, কিন্তু ইচ্ছে থাকলে একজন বড় মনের মানুষ অবশ্যই হওয়া যায়।তোমরা সবাই ভালো থেকো এবং চারপাশের মানুষদের ভালো রাখার চেষ্টা কোরো। আর এই ছোট্ট উপহারটা সবার সাথে ভাগ করে নিও।

ইতি

তোমাদের বন্ধু


-“বড় মনের মানুষ কী রে দিদি?”

দিদির হাত ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে জিজ্ঞেস করেই ফেলে মিঠি।

- “এই যে তুই তোর উপহারে পাওয়া মিষ্টিটা সবার সাথে ভাগ করে খেলি, এটাই বড় মনের পরিচয়।আর যে মানুষের সেটা থাকে সেই তো বড় মনের মানুষ।”

দিদির হাতটা শক্ত করে ধরে মিঠি, মনে মনে ঠিক করে নেয় এবার যদি তাকে কেউ বড় হয়ে কী হতে চাও জিজ্ঞেস করে, তাহলে চোখ বন্ধ করে বলবে 'আমি বড় হয়ে একজন বড় মনের মানুষ হতে চাই'।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : লীনা রায় মল্লিক

গল্পের ঝুলি : ভজামামা ও গন্ধবিচার : হিমাংশু চৌধুরী





"তোদের আজ একটা অমূল্য জিনিস দেখাবো, দাঁড়া।" এই বলে ভজামামা সযত্নে তার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা এবড়োখেবড়ো পাথরের টুকরো বের করে আমাদের হাতে দিলো।

রোজকার মতো সেদিনও আমরা আড্ডা মারছিলাম রেলপুকুরের মাঠে বটতলার নীচে বসে। ভজামামা একটু দেরি করে ঢুকেই ওপরের ঘোষণাটা করলো।

"কী এটা? দেখি দেখি!" বলে টাবলু ভজামামার হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ঘোষণা করলো, "দেখে তো মনে হচ্ছে রেললাইনের ধার থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছো। কী এটা?"

"রেললাইনের ধার থেকে! ব্যাটা অলম্বুষ! তুই জানিস এটার মূল্য?"

গল্পের গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে। ভজামামাকে একটু তাতিয়ে দেবার জন্য বললাম, "একটা পেপারওয়েটের আর কত দাম হবে? দশ-বিশ টাকা ম্যাক্সিমাম। "

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ভজামামা শুরু করলো, "শোন তবে।"


১৯৬৫ সাল, চীন ভারত যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। আমি তখন লিমুলাস কাঁকড়ার খোঁজে বাহামার উত্তরে ছোট ছোট দ্বীপগুলোর সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সঙ্গী বলতে একটা ছোট মোটরবোট আর রিকার্ডো। রিকার্ডো স্প্যানিশ প্রসপেক্টর। মোটরবোটটা আমার, আর আমাকে দ্বীপগুলো চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ওর। আমাদের আলাপ হয়েছে নাসাউতে। ওর সাথে চুক্তি হয়েছে, আমি করবো কাঁকড়ার খোঁজ, আর ও করবে ওই পাথুরে দ্বীপগুলোতে সেমিপ্রেশাস পাথরের খোঁজ। খরচ আধাআধি। সেমিপ্রেশাস পাথর কাকে বলে জানিস তো তোরা?"

"না ভজামামা", আমরা সমস্বরে বললাম।

"শোন, সেমিপ্রেশাস স্টোন হলো প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এরকম কিছু রঙবেরঙ এর পাথর, যা গয়না তৈরিতে ব্যবহার হয় অথবা গ্রহরত্ন হিসেবে ধারণ করা হয়। যেমন, রুবি, নীলা, মুনস্টোন, অ্যামেথিস্ট, গোমেদ, চুনি, পান্না ইত্যাদি। সাধারণত এগুলো আগ্নেয় শিলাতেই বেশি পাওয়া যায়। আর জানিস তো, উত্তর বাহামা দ্বীপপুঞ্জের অধিকাংশ দ্বীপই মগ্ন আগ্নেয়গিরির চূড়া। অবশ্য কিছু কোরাল এটলও আছে। ফলে এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে এই ধরণের দামী পাথর পাওয়া যায়। তা রিকার্ডো বাহামা সরকারের কাছ থেকে এইসব দ্বীপে প্রসপেক্টিং করার লাইসেন্স নিয়েছিলো। আমার লাইসেন্সের ব্যাপার নেই, কারণ আমি খালি ম্যাপিং করবো, লিমুলাস কোথায় কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, ওদের গতিবিধি রেকর্ড করবো শুধু। কেনই বা ওরা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডিম পাড়ার জন্য প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার উজিয়ে কতগুলো নির্দিষ্ট জায়গাতেই যায়, সেই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা চালাচ্ছি তখন আমি।

গোটাকতক দ্বীপ ঘুরে শেষতক অনামা এই দ্বীপে সেদিন নোঙর ফেলেছি। জনমানবশূন্য পাথুরে দ্বীপ, গাছপালাও খুবই কম, দুচারটে ছোট ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝখানে একটা অনতিউচ্চ টিলা, আর তীরভূমি খুবই সংকীর্ণ। সমুদ্রের বিশ ফুট দূর থেকেই শুরু হয়েছে পাথুরে জমি। রিকার্ডো দ্বীপে নেমেই বোঁ করে চলে গেলো উত্তর দিকে টিলাটার ওপারে। আমি খাবারদাবার নামিয়ে নিলাম বোট থেকে, আর তাঁবুটা। তাঁবু খাটাতে গিয়ে দেখি, তাঁবুর খোঁটাগুলো জমিটা ঢোকানো যাচ্ছে না, এত শক্ত পাথুরে জমি। এদিক ওদিক খোঁজার পরে আমি যা খুঁজছি তা দেখতে পেলাম। সমুদ্রের ধারে কয়েকটা বড় বড় ছাইরঙা পাথর পড়ে রয়েছে। সাইজে বড় হলেও আনুপাতিক ওজন বেশ কম। দেখেশুনে ছ'টা বেশ বড়সড় পাথর তুলে নিয়ে এসে তাঁবুর দড়িগুলো তাতে বেঁধে যখন খাড়া হলাম, তখন সূর্য মধ্যগগনে। আমি খাতাপত্র নিয়ে লেগে পড়লাম কাজে। তীরভূমি শেষ হয়ে যেখানে পাথুরে জমি শুরু হচ্ছে, সেখানেই কাঁকড়াগুলো বাসা বেঁধেছে। সারাদিন ধরে ওদের গতিবিধি রেকর্ড করে লিপিবদ্ধ করলাম। সন্ধ্যা নেমে আসলে স্টোভ জ্বালিয়ে টিনের খাবার গরম করতে না করতেই রিকার্ডো এসে হাজির।

_নাঃ, মুকাজ্জি, এখানেও বিশেষ কিছু নেই, গর্ত খোঁড়ার মজুরি পোষাবে না। কাল পরশু চলো আরো ক'টা দ্বীপ ঘুরে নিই। এতক্ষণে রিকার্ডোর চোখ পড়লো তাঁবুর খুঁটো লাগানো পাথরগুলোর উপরে। নেড়েচেড়ে দেখে বললো,

_এগুলো কি পাথর জানো মুকাজ্জি?

_কি জানি, পড়ে তো ছিলো সমুদ্রের ধারে।

_হুম।


রাতে শুয়ে আছি তাঁবুতে, অনেকক্ষণ ধরেই খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে, খুব একটা গ্রাহ্য করছি না। কিন্তু যখন হু হু করে সামুদ্রিক হাওয়া এসে গায়ে লাগলো তখন চোখ না খুলে পারা গেল না। ঠান্ডা লেগে হি হি করে কাঁপছি। চোখ খুলে দেখি, আমার তাঁবু গায়েব, উপরের দিকে আকাশ দেখা যাচ্ছে, ফটফট করছে তারা। রিকার্ডোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার সাথে গায়েব তাঁবু ধরে রাখা পাথরগুলো আর বোটটা। হাওয়ায় তাঁবু উড়ে গিয়ে পড়ে আছে দূরে টিলাটার গায়ে। উঠে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম। জানি একটু পরেই ওকে ফিরতে হবে।

ঊষার প্রথম সূর্যকিরণের সাথেই দেখি দাঁড় টানতে টানতে আসছে রিকার্ডো। বোট কূলে ভিড়িয়েই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ঐ বারো স্টোনের দশাসই চেহারা নিয়ে। বেড়াল যেভাবে ইঁদুর ধরে সেভাবে আমার নড়াটা ধরে চাপ দিতে শুরু করলো। মুখে গালাগালি,

_ব্লাডি নিগার, শিগগির বল গ্যাসোলিনগুলো কী করেছিস? বললে তোর জানটা বকশিস দেবো।

_আর না বললে? কঁকিয়ে কঁকিয়ে প্রশ্ন করি।

_বলবি না মানে? না বললে তোকে সমুদ্রে চুবিয়ে মারবো।


দশফুট দূর থেকে তার শরীরটাকে তুলে এনে বসালাম মাটিতে। তারপরে বোতল থেকে জল ঢেলে ওর মুখে ছিটিয়ে দিলাম। যুযুৎসুর কঠিন প্যাঁচে ধরাশায়ী হয়েছিলো ও। জ্ঞান ফিরলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

_এবারে বলো তো দেখি বাছা, রিকার্ডো তোমার কে হয়?

ক্ষণপূর্বের যুযুৎসুর প্যাঁচের কথা মনে করেই বোধ হয় বললো,

_ভাই, আমার থেকে দু'মিনিটের ছোট। আমার আসল নাম রিচার্ড।

_হুম, যমজ ভাই। অবশ্য হতেই হবে, না হলে ভিসা আর পাসপোর্ট অফিসে ছাড়বে কেন? তা রিকার্ডো এখন কোথায়?

_গত বছর প্রসপেক্টিং করতে গিয়ে ও আমাজনের গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেছে, আর ফেরেনি। ওর লাইসেন্সটা পড়েই ছিলো, ফি-ও দেওয়াই ছিলো। আমি ওর নাম ভাঁড়িয়ে এসেছি, শুধু এটুকুই আমার দোষ।

_আমি যদি বলি রিচার্ড, তুমি তোমার ভাইকে গুমখুন করেছো, তোমার আসল ব্যবসা অ্যাম্বারগ্রীস এর।

বাহামা সরকার তাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করার অনুমতি দেয় না, অথচ দুনিয়ার সেরা অ্যাম্বারগ্রীস পাওয়া যায় এখানেই। তাই দুনিয়া জুড়ে সব চোরাচালানকারীদের নজর এখানেই পড়ে থাকে। গত কয়েকবছর ধরেই এই অ্যাম্বারগ্রীস বাহামা থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছিলো, তাই বাহামা সরকার আমাকে নিযুক্ত করেছে এই চোরাচালান বন্ধ করার জন্য।

যাই হোক, আমি কাজে নেমে দেখলাম, এই ছোট ছোট দ্বীপগুলো থেকে অ্যাম্বারগ্রীস নিয়ে জলপথে তিনশো থেকে চারশো কিমি গেলেই ইউ এস, যেখানকার সুগন্ধি কোম্পানিগুলি বসে আছে অ্যাম্বারগ্রীস কেনার জন্য। এ ছাড়াও ক্যারিবিয়ান হয়ে ফ্রান্সে পাচারের একটা রুটও তৈরি হয়েছে। জগদ্বিদিত সুগন্ধিগুলি সবই ফরাসী কোম্পানির তৈরি। তবে সম্প্রতি বাহামা সরকার অ্যাম্বারগ্রীস পাওয়া যায় জানা আছে, এরকম দ্বীপগুলিতে নজরদারি বাড়ানোয় জোগান কম পড়ে যাচ্ছে। চোরাচালানকারীদের দরকার নতুন সোর্স। আমি জানতাম সমস্ত রসদ নিয়ে বোট ভাড়া কর‍তে হলে তা রাজধানী নাসাউ থেকেই করতে হবে, আর ওখানকার বোট ভাড়া দেবার এজেন্সিগুলো ভালো করে পরিচয়পত্র যাচাই করে পাসপোর্ট জমা রেখে তবেই বোট ভাড়া দেয়, যেটা কিনা স্মাগলাররা করতে পারবে না।

তাই আমি রিসার্চারের ছদ্মবেশে নাসাউতে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। একা বোট ভাড়া নেওয়ার সঙ্গতি নেই, তাই সেথো খুঁজতে লাগলাম। তুমিও এরকমই একটা সুযোগ খুঁজছিলে, তাই লুফে নিলে অফারটা। আসলে আমার পাতা ফাঁদে পা দিলে। তুমি যে রিকার্ডো নও সেটা আমি প্রথম দিনই আন্দাজ করেছিলাম। রিকার্ডো গার্সিয়া সেলভাজ, বিখ্যাত প্রসপেক্টার, আমার পূর্বপরিচিত। আমরা দু'জনে একসাথে ধনদেবতা কুবেরের রত্নভান্ডার খুঁজতে গিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে তিব্বতে। তুমি যখন আমায় চিনতে পারলে না, অথচ নাম বলছো রিকার্ডো গার্সিয়া - তখনই বুঝেছি, তুমি আসলে রিকার্ডো নও, অন্য কেউ নাম ভাঁড়িয়ে রিকার্ডো সেজে ঘুরছো।

তুমি যে প্রসপেক্টিং-এর অছিলায় আসলে অ্যাম্বারগ্রীস কোথায় কোথায় পাওয়া যায় তার ম্যাপিং করছো, সেটাও আমি গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছি। যতই সাংকেতিক স্প্যানিশে নোট নাও না কেন, ও সংকেত আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ব্রেক করতে পারি। তুমি নিজেই যখন ম্যাপিং করতে শুরু করলে, তখন আমি বুঝলাম তুমিই পান্ডা। এই মহামূল্যবান সম্পদের সন্ধান যাতে অন্য কেউ না পায়, তাই তুমি এ কাজের ভার আর কাউকে দাওনি। আহা, আহা, আবার তেড়ে আসার চেষ্টা করছো কেন? 
একটা থাবড়া মেরে ফের ওকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা কর‍তে হবে না, ওই দেখো বাহামা নেভির জাহাজ আসছে, তোমাকে নেবার জন্য। দূর থেকে তখন জাহাজের ভোঁ শোনা যাচ্ছে।

বাই দা ওয়ে, তোরা কি অ্যাম্বারগ্রীস কাকে বলে জানিস?"

"না ভজামামা!" আমরা সমস্বরে বললাম।

"অ্যাম্বারগ্রীস হলো এক ধরনের তিমি মাছের, সাধারণত স্পার্ম তিমির, অন্ত্রে ক্ষরিত রস ঘনীভূত হয়ে তৈরি হওয়া পাথরের মতো একটা জিনিস। এইসব তিমিমাছগুলো অনেক বড়বড় খাবার গিলে ফেলে, যেগুলো তারা পুরো হজম করতে পারে না। এই বর্জ্য পদার্থগুলো তাদের পেটের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় যাতে আটকে না যায়, তাই এদের পিত্তথলি থেকে একধরণের লুব্রিক্যাণ্ট ক্ষরিত হয়। বেশ কিছুদিন পরে এই রসটাই ঘনীভূত হয়ে সলিড হয়- এটাই অ্যাম্বারগ্রীস। সাঙ্ঘাতিক দামী এই অ্যাম্বারগ্রীস কিন্তু সাধারণত তিমির মলের সাথে বা বমির সাথে বেরিয়ে আসে। একদম পাথরের মতো দেখতে হলেও জলের থেকে আপেক্ষিক ঘনত্ব কম হওয়ায় এটা জলে ভাসে।

অ্যাম্বারগ্রীস এত দামী কেন জানিস? কারণ এটা একটা জৈব সুগন্ধি। এমনিতে ফ্রেশ অ্যাম্বারগ্রীস নাকের কাছে নিয়ে শুঁকলে মলের গন্ধ পাওয়া যাবে। কিন্তু মজার কথা হলো, এই অ্যাম্বারগ্রীসই আবার স্বল্প পরিমাণে সবরকম সুগন্ধির বেস হিসেবে কাজ করে।"

"তারপরে কী হলো?"

"তারপরে আর কি! রিচার্ড ধরা পড়লো, আর ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে পুরো টিমটাই। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাহামা সরকার আমাকে একটুকরো অ্যাম্বারগ্রীস দিয়েছিলো। এই পাথরটাই হলো সেই অ্যাম্বারগ্রীস, যেটা তোরা পেপারওয়েট ভাবছিলিস, বুঝলি?" 

এই বলে ভজামামা উঠে গটগটিয়ে হাঁটা লাগালো।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

ধারাবাহিক গল্প : বনস্থলীর নব্য পুরাণ (প্রথম পর্ব) : টিম কিশলয়




।।১।।

-“জানো মা, বাবুইটা না ভারী বোকা! বলে নাকি মানুষরা একদম ভালো নয়, খুব দুষ্টু। সবসময় ঝগড়া করে। ও তো উড়ে উড়ে জঙ্গলের বাইরে মানুষদের আস্তানায় যায়, তখন নাকি দেখেছে সব মানুষগুলো মোট্টে মিলেমিশে থাকে না। আচ্ছা তুমিই বলো এর থেকে আর হাসির কথা কিছু হয়? সেই যেবার পুশকুন গর্তে পড়ে গেল সেবার ইরু আর শীলু, মানুষদের দু’টো ছানাই তো ওকে বাঁচাল বলো? আমি যেই এই কথা বললুম ওমনি বাবুই বললে, ‘গর্তটাও তো মানুষরাই খুঁড়েছিল’। দুষ্টু মানুষরা নাকি আমাদের ধরে আমাদের এই সাদা সাদা দাঁতগুলো কেটে নেয়! হ্যাঁ মা, এমনটা কি সত্যি হয় গো? ও মা বলো না, চুপ করে রইলে কেন?”

মা-কে ডাকতে গিয়ে পেছন ফিরে মিশকুন দেখে কেউ নেই আশেপাশে, বড় বড় গাছগুলো ছাড়া। ঝুপ করে আঁধার নেমে এসেছে। অথচ এই মাত্র তো এত্ত আলো ছিল চারদিকে। পাতার ফাঁক গলে নেমে আসা সূর্যের আলোর গোল গোল চাকতিগুলোর সাথে ধরাধরি খেলছিল মিশকুন। গাবদুগুবদু পা দিয়ে যেই না রোদ্দুরের গোল্লাগুলোকে চেপে ধরছে ওমনি দুষ্টু হাওয়াতে গাছের পাতা নড়ে উঠছে আর ওর পায়ের তলা দিয়ে পিছলে রোদ্দুরের গোল্লাটা বেরিয়ে পড়ছে। আবার যেই শুঁড় বাড়িয়ে ধরতে গেছে ঝোপের ওপরে ঘাপটি মেরে থাকা হলুদ গোল্লাটাকে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁচ্চো!’, ব্যস! ঝোপটা প্রবল বেগে নড়ে গিয়ে রোদ্দুর ভ্যানিশ।

এই খেলা খেলতে খেলতে মিশকুন লক্ষ্যই করেনি যে কখন দলছুট হয়ে পড়েছে। মা এইজন্যই সবসময় বলে শুঁড় দিয়ে মায়ের লেজটাকে শক্ত করে পাকিয়ে ধরে থাকতে। কিন্তু সে কথা মিশকুনের মাথায় থাকলে তো! একটা প্রজাপতি কিংবা ফড়িং দেখতে পেলেই হয়েছে! তার পেছন পেছন যে কোন দিকে চলে যাবে মিশকুন তার নেই ঠিক। তবে প্রতিবারই একটু পরে টের পেয়ে মা ওর লম্বা লম্বা কুলোর মত কানদুটো শুঁড়ে করে পেঁচিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যায় দলের সবার কাছে, অথবা মিশকুন নিজেই ফিরে চলে আসে। কিন্তু এবার মায়ের কাছছাড়া হয়ে অনেকটা দূরেই চলে এসেছে। একটু গা ছমছম করে ওঠে মিশকুনের। দেখতে মিশকুন অনেক বড়সড় হলে কী হবে, আসলে তো ও কয়েকমাসের বাচ্চা। তাই মা আশেপাশে না থাকলে একটু ভয় পায় বৈকি।

সূয্যিমামা পাটে গেলেই জঙ্গলে বড্ড ঝুপ করে আঁধার ঘনিয়ে আসে। নিমেষের মধ্যে চারিদিক কালো হয়ে যায়। বটগাছ আশুথগাছ শালগাছগুলোকে মনে হয় যেন বিশাল বিশাল দৈত্য কাঁধে গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস যখন বয়ে যায় পাতার ফাঁক গলে শনশন আওয়াজ ওঠে, গা শিরিশিরিয়ে ওঠে কেমন। আর দূরে সব হায়না ফেউ শেয়াল ডাকলে তো আর কথাই নেই। মিশকুন সোজা গিয়ে মায়ের পেটের তলাটিতে ঠাঁই নেয়। তখন অবশ্য সব ভয় চলে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে মিশকুন কী করবে? মা-কে কোথায় পাবে? ভয়ের চোটে মাথার বুদ্ধিগুলো সব গুবলেট হয়ে যায়। মা কতবার মিশকুনকে বলে রেখেছিল যে যদি কখনও দলছুট হয়ে যায় তাহলে চুপটি করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। দলের বড়রা ঠিক খুঁজে বার করে নেবে। কিন্তু যদি মিশকুনও এদিকে মাকে খুঁজতে যায় আর মা ওদিকে মিশকুনকে খুঁজতে যায় তাহলে তো কেউই কাউকে খুঁজে পাবেনা।

আর জোরে জোরে ডেকে খোঁজ করাটাও বিপদ, কারণ যদি বনের হিংস্র পশুরা টের পায় একটা বাচ্চা হাতি এক্কেবারে একা রয়েছে তাহলে আর মোটেই নিরাপদ ব্যাপার হবে না। যদিও এই বনে বাঘ সিংহ নেই তবে হায়না, নেকড়ে আছে কতকগুলো। কালো ছোপছোপ হলদে চিতাবাঘও আছে একটা। এমনিতে এরা সব হাতিদের এড়িয়ে চলে, কিন্তু সেটা তখনই যখন হাতিরা দলবেঁধে থাকে। এদিকে মিশকুন আচমকা ভয় পেয়ে এইসব ভুলে ইতিউতি মায়ের খোঁজে দৌড়তে থাকে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ছুটোছুটি করার পর ক্লান্ত হয়ে মিশকুন একটা বড় গাছের তলায় এসে বসে। কপাল ভালো যে এখনও কোনও হিংস্র পশুর নজরে পড়েনি ও। অন্ধকারে তারাও যে যার জায়গায় ঘুমোতে চলে গেছে মনে হয়।

মিশকুনের এবার খুব কান্না পায়। কী হবে! আর যদি কোনওদিন ফিরতে না পারে মায়ের কাছে। শুঁড় দিয়ে চোখের উপচে আসা জল মোছার চেষ্টা করে। এমন সময় কানে একটা আওয়াজ আসে, ‘পিঁপ পিঁপ পিঁপিপ পিঁইইইইপ’। বড় বড় কানগুলো একবার ঝাপটে নেয় মিশকুন। ভুল শুনল না তো? ফের কান খাড়া করে থাকে। একটু পরে কানে আসে, ‘প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ’!

আওয়াজ লক্ষ্য করে মিশকুন হাঁটা দেয়। একটু এগোতেই জঙ্গলটা পাতলা হয়ে আসে ধীরে ধীরে। তার মানে মিশকুন কি পথ ভুলে ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গলের শেষপ্রান্তে মানুষদের বসতির কাছে চলে এসেছে?

এর আগে কক্ষনো মানুষদের এলাকায় আসেনি মিশকুনের মত ছোট্ট হাতিরা। তবে মানুষদের সাথে মোলাকাত হয়েছে বেশ কয়েকবার। গাছ থেকে মৌচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করতে আসে অনেক মানুষ, তাদের দেখেছে। কেউ কাঠ কাটতে আসে, কেউ শালপাতা কুড়োতে আসে। কী করে কে জানে মানুষরা এসব? বাবুই বলছিল ইদানীং তো আবার কিছু বদমাইশ মানুষ নাকি জঙ্গলে আসে পশুদের মারতে। তাদের মেরে তাদের চামড়া হাড় এসব নাকি নিয়ে যায়। মিশকুনের তো শুনেই গা শিউরে উঠেছিল। এমনও হয়? অথচ ঐ দু’টো মানুষের ছানা ইরু আর শীলু, ওরা তো অমন নয়, ওরা কত্ত ভালো।

মা-কে জিজ্ঞেস করলে মা বলে, সব মানুষ তো সমান হয় না। কেউ ভালো কেউ বা মন্দ। হিংস্র পশুরা খিদে পেলে তবেই প্রাণীহত্যা করে, কিন্তু যে মানুষরা খারাপ হয় তারা নাকি লোভের জন্য এমন করে।

এইসব নানা কথা মনের মধ্যে বুজকুড়ি কাটতে থাকে মিশকুনের। যাবে কি যাবে না, এই ভাবতে ভাবতেই দেখে কখন জঙ্গলের ধারের বড় রাস্তাটার পাশে চলে এসেছে। রাস্তা টপকালেই ওপারে মানুষদের বসতি। অনেকটা দূরে একটা বাক্সর মত চাকা লাগানো জিনিস যেটাকে নাকি ‘বাস’ বলে, ভ্যাঁ পোঁ ভ্যাঁ পোঁ জগঝম্প শব্দ করতে করতে চলে যাচ্ছে। এই শব্দই তবে কানে এসেছিলো মিশকুনের। কিন্তু সামনের বড় রাস্তাটা দেখে বুক ঢিপঢিপ করে ওর। মা বলেছিল এইসব রাস্তা দিয়ে মানুষ ‘বাস’ চালিয়ে অনেক দূরে দূরে যায়। আর তখন পশুপাখিরা রাস্তা পেরোতে গেলে তাদের দুম করে চাপা দিয়ে দেয়। মিশকুন ভয়ে ভয়ে ডাইনে বাঁয়ে চায়। নাহ্! কোথাও কেউ নেই, কোনও ‘বাস’ও নেই আর।

কিন্তু রাস্তা টপকে মানুষদের এলাকায় যাওয়া কি ঠিক হবে? জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে গেলে মায়েরা তো আর খুঁজেই পাবে না। এদিকে ভারী কৌতূহলও হচ্ছে কিনা। যদি একবার ইরু আর শীলুর সাথে ফের দেখা হয়। মিশকুনের নাকটা সুড়সুড় করে ‘হ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁচ্চো’ হয় একটা ইয়াব্বড়। মিশকুন দেখেছে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলেই ওর লম্বা নাকটা সুড়সুড় করে। আর বেশি ভাবনাচিন্তা না করে চোঁওও করে এক ছুটে রাস্তাটা টপকে যায় মিশকুন।

জঙ্গলের বাইরে এখনও অন্ধকার ঘনায়নি তেমন। সূয্যিমামা আকাশে না থাকলেও, বেশ একটা নরম আলো চারদিকে বিছিয়ে আছে। একটু দূরে সারি সারি বাড়ি। ছোটো, বড়, বেঁটে, লম্বা, রোগা, মোটা, নানা আকারের। একটা ইয়াব্বড় মাঠ। তার চারদিকে জালের মত ঘেরা। ভেতরে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে খেলা করছে। ইরু আর শীলু ওখানে নেই তো? ওদিকপানে গুটিগুটি এগোয় মিশকুন। মাঠটা থেকে একটু দূরের একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে থাকে। ইরু আর শীলুকে দেখতে পেলেই শুঁড় দুলিয়ে ডাকবে। ওরা নিশ্চয়ই মিশকুনকে চিনতে পারবে, তারপর ঠিক ওকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

হঠাৎই মিশকুনের লেজে একটা জোরসে টান পড়ে।

‘ইইইক্কিক্কিইয়াওঁ!!!’ বলে লাফিয়ে ওঠে মিশকুন। পেছন ফিরে দেখে একটা ছোট্টমতন কালোমতন কপালে সাদা বাঁকা চাঁদওয়ালা একটা ছাগলছানার মুখে ওর লেজটা।

-“অ্যাই অ্যাই! তুই কে রে! আমার লেজ চিবোচ্চিস কেন?”

ছাগলছানাটা এর আগে মনে হয় হাতি দেখেনি। ড্যাবড্যাব করে মিশকুনের দিকে চেয়ে বলে,

-“ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা! আমি পুঁটিলাল, বোমকাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড! তুমি কে গা? তোমার নাকটা কত লম্বা! তোমার কানদুটো কত বড়! তোমার পা’গুলো কত মোটা মোটা! তোমার গায়ে খুব শক্তি না গো? তোমার নাম কী গো? তুমি কোথায় থাকো!”

মিশকুন খানিকটা হতভম্ব হয়ে বলে,

-“আমি মিশকুন! আমি ওই রাস্তার ওপারে জঙ্গলে থাকি। এখানে আমার বন্ধু ইরা আর শীলু থাকে। আমি ওদের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

মিশকুন যে হারিয়ে গেছে সে কথা আর এই পুঁচকে পুঁটিলালের সামনে বলল না, পাছে ওকে ভীতু ভাবে ছাগলছানাটা।

পুঁটিলাল বলে,

-“তুমি যদি ওই বদমাইশ ভুলো কুকুরটাকে একটু দাবড়ে দাও যেন আমায় দেখলে আর ঘেউ ঘেউ না করে, তাহলে আমি বোমকাইকে বলব তোমার বন্ধুদের, ওই কী যেন নাম ইলু আর শীলু, ওদের খুঁজে দিতে। বোমকাই সক্কলকে চেনে, আতিফদাদা, ঈশানদাদা, আলেক্সদাদা! সব্বাই ওর বন্ধু।”

মিশকুন মহানন্দে বলে,

-“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ভুলোকে দাবড়ে দেব। তুমি আমাকে নিয়ে চলো শিগগির ওর কাছে।”

পুঁটিলাল বিজ্ঞের মত ঘাড় নেড়ে বলে,

-“দাঁড়াও দাঁড়াও! সে তো এখন সন্ধেবেলায় বিশুপাগলের কুঁড়েতে ঢুকে নাক ডাকাচ্ছে। সকালের আগে তাকে পাবো কই!”

-“অ্যাঁ! সকাল! ততক্ষণ আমি কী করব? কোথায় থাকব?”

ডুকরে ওঠে মিশকুন।

পুঁটিলালও চিন্তায় পড়ে,

-“তাই তো! এ তো ভারী মুশকিল। দাঁড়াও আমি বোমকাইকে ডেকে আনি তবে। তুমি চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকো মিশকুনদাদা, কোত্থাও যেও না। আমি আসছি এক্ষুনি!”

মিশকুনকে এই বলে, তিড়িং বিড়িং করে পুঁটিলাল ছুট লাগাল।

(কলমে : সুস্মিতা)


।।২।।

ছুট ছুট ছুট, ছুটে তো গেল পুঁটিলাল। তবে কিনা বোমকাইকে ডেকে আনাটা হল না। সন্ধে হলেই বোমকাইয়ের জীবন কমপ্ল্যান আর নামতাময়। পড়ার ঘরে তখন মা ছাড়া কারোর প্রবেশ নিষেধ। বাবা পর্যন্ত ঘরের বাইরে থেকেই চায়ের চাহিদা জানান দিয়ে পালিয়ে যান। পুঁটিলাল তো তুশ্চু একখানা ছাগল মাত্তর!

ব্যা ব্যা করে বাড়ির আশেপাশে খানিক পায়চারি করে পুঁটি। কাঁঠাল গাছের গায়ে গা মাথা খানিক ঘষে তারপর তার বুদ্ধি খোলে। হ্যাঁ, বটুকদাদাকে গিয়ে বললে হয় তো। ছাগলছানা জানালার গ্রিল গলে ঘরে ঢুকতে পারে না বটে, কিন্তু বেড়াল তো পারে। আনন্দে ‘ব্যা-অ্যা-অ্যা' ডেকে উঠে টিনের ঘরের দিকে দৌড়ে যায় পুঁটিলাল।

কিন্তু এ কি! বটুকদাদার জায়গায় ওটা কে বসে? ও তো বটুক নয়, অন্য বেড়াল। সাদা ঝুমরো লোমশ, কেমন উলোঝুলো ল্যাজ! অচেনা লোক দেখে কথা বলতে আমতা আমতা করে পুঁটিলাল। কেমন উদাস মুখে বসে থাবা চাটছে বেড়ালটা। কেমন একটা রাজাগজা টাইপ ভাব। তাকাচ্ছেই না পুঁটিলালের দিকে! প্রেস্টিজে লাগে না বুঝি পুঁটির! ছাগল বলে হ্যাটা করে লোকে, সে বুঝি বোঝে না!

জোরসে ব্যা করে পুঁটিলাল। বলে, “কে গা তুমি? বটুকদাদার বস্তার ওপর বসেছ কেন?” ঠান্ডা চোখে এদিক তাকিয়ে দেখে বেড়ালটা। তারপর বলে, “তোমার তাতে কি শুনি? বটুক তোমার দাদা বুঝি? তাই বলি, ওর মাথায় ছাগলের মত বুদ্ধি কেন!”

অপমানজনক কথা শুনে রাগে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় পুঁটির। খেপে গিয়ে বলে, “আমার বাড়িতে ঢুকে আবার আমারই পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করা, অ্যাঁ? রোসো ঘন্টাদুই, বোমকাই বেরোক। একটা হেস্তনেস্ত না করি তো দেখে নিও তখন!”

বোমকাইয়ের নাম শুনে গা ঝেড়েঝুড়ে সোজা হয়ে বসে বেড়ালটা। বলে, “অ, তুমি বোমকাইয়ের বন্ধু হও? তাহলে তোমার সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়া নেই। বোমকাই ভালো ছেলে। জীবজন্তুদের প্রতি খুব মায়া ওর প্রাণে। আমি ফেলিসিয়া। তোমার নাম কি?”

ফেলি-সি-য়া!! বেড়ালের আবার এরকম নাম হয় নাকি! মাথা চুলকোতে থাকে পুঁটিলালের৷ মাথাটাকে ঘরের কাঠের খুঁটিতে ঘষতে ঘষতে সে বলে, “আমি পুঁটিলাল। তুমি কি সায়েব বেড়াল?”

ফেলিসিয়া মাথা নাড়ায়। বলে, “না না। আমি কাবলি।”

কি কাবলি? আলুকাবলি? জিজ্ঞেস করতে না করতে ফেলিসিয়া বলে, “বটুক কোথায়? ওর সঙ্গে কিছু আলোচনা করার ছিল যে!”

বেড়ালরা আবার আলোচনা করে নাকি? বোমকাইয়ের বাবা-কাকারা, তাঁদের বন্ধুরা করেন সেটা দেখেছে পুঁটিলাল। বেড়ালদের ঝগড়া আর ম্যাঁওম্যাঁও ছাড়া তো কিছু করতে দেখেনি। সে বুদ্ধি খাটিয়ে বলে, “বটুকদাদা মনে হয় লালু বেড়ালের সঙ্গে ডুয়েল লড়তে গেছে। লালু কিনা সেদিন ভোলা মাছের মাথাখানা বটুকদাদার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে গেছিল!”

ফেলিসিয়া বিরক্তিভরে ফ্যাঁস করে। বলে, “দূর! এগুলো সব মানুষদের মতো। খালি ঝগড়া আর মারামারি! এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না সত্যি!”

ব্যা ব্যা করে প্রতিবাদ জানায় পুঁটিলাল। বলে, “না না, মানুষরা সবাই খারাপ হয় নাকি! বললেই হল!”

ফেলিসিয়া উঠে দাঁড়ায়, দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, “তবে আর বলছি কি! ওপাড়ার ঈশান, আতিফদের চেনো তো? জানো ওদের বাড়ির বড়রা সব এইসান ঝগড়া করেছে? করে এখন বাড়ির বাচ্চাগুলোর এক সঙ্গে খেলাধুলো বন্ধ করে দিয়েছে? কি করে মিটমাট করানো যায় সেই নিয়েই তো আলোচনা করতে এলুম বটুকের সঙ্গে! সে কিনা নিজেই মারামারি করতে গেছে পাড়া উজিয়ে! দূর! যাই এখন বিশুপাগলার ওখানে, সে যদি কিছু বুদ্ধি দিতে পারে।”

তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে ওঠে পুঁটিলাল। বলে, “আমায় সঙ্গে নেবে কাবলিদিদি, স্যরি, ফেলিদিদি? আমিও একটা মুশকিলে পড়েছি গো। একটা হাতির ছানা কেমন করে জঙ্গল থেকে এখানে এসে ঢুকে পড়েছে। মা যাবে, বাড়ি যাবে বলে কাঁদছে। কোন দু’টো বন্ধুকে খুঁজছে, আমি তাদের চিনি না যে! বোমকাই ও পড়তে বসেছে। কার কাছে সাহায্য চাইব বলো তো! আমায় নিয়ে চলো বিশুপাগলের কাছে। আমি ভেতরে যাব না কিন্তু। ভুলো কুকুর শুয়ে থাকে না ওখানে? আমাকে খ্যাঁকায় খালি।”

ফেলিসিয়া ল্যাজ নাড়িয়ে ভরসা দেয় পুঁটিকে, “ভুলোকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয় পেলেই লোকে আরো বেশি বেশি করে ভয় দেখায়। আমি আছি তো। ভুলোর নাকে যে আঁচড়খানা দিয়েছিলাম না, সেই ইস্তক আমাকে ইস্কুলের দিদিমণির মত সমীহ করে চলে। চলো, যাবে তো চলো। বিশু ঠিক কিছু না কিছু উপায় করতে পারবে।”

(কলমে : দেবলীনা)

(পরের পর্ব আগামী সংখ্যায়)

অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু

ছড়ার ছন্দে : মনের সাধ : জয়শ্রী দাস



টাপুর টুপুর বৃষ্টি দুপুর
মিষ্টি হাওয়ার সনে,
গুনগুনিয়ে মনের কথা
বলছে কানে কানে।

ছুটির দুপুর ভারী মজা
এক মনে চেয়ে রই,
মা বলল, "এই ফাঁকিবাজ
হচ্ছে পড়া কই?"

বেজার মুখে যেই না আবার
করছি শুরু পড়া
গাছের ডালে পাখির ডাক
মনকে দিল নাড়া।

কী সুন্দর দেখতে ওদের!
চলছে মেলে ডানা,
আমিও যদি হতাম পাখি
করতো না কেউ মানা।

যখন তখন ইচ্ছে মতন
হেথাহোথা পাড়ি,
বদ্ধ খাঁচায় না আটকে
মন সুদূর প্রসারী।


অলঙ্করণ : আবির

ছড়ার ছন্দে : ভূতুমের পড়াশোনা : দেবলীনা দাস




এক যে ছিল ছোট্ট ভূতু, বটগাছে তার বাসা।
ঝাঁকড়া চুলে ভর্তি মাথা, দুষ্টুমিতে ঠাসা।

নাড়িয়ে ঝুঁটি, দুলিয়ে মাথা, বটের ঝুরি ধরে
খায় সে দোলা, মনখানা তার কোন আকাশে ওড়ে।

শেলেট পুঁথি বাক্সে ভরে গাঁয়ের ছেলেমেয়ে
ইশকুলে যায়, ভূতুমছানা তাকিয়ে দেখে চেয়ে।

মায়ের কাছে বায়না ধরে, আমিও যাব স্কুলে,
ধারাপাতের বই কিনে দাও, পড়ব দুলে দুলে।

বইও আসে খাতাও আসে, আসে কলম কালি;
নাচেন ভূতু আনন্দে আর বাজান হাতে তালি।

বাবার আঙুল ধরে ভূতুম পৌঁছল পাঠশালা -
পড়তে বসে ঘুম পেয়ে যায় - এইটে বড় জ্বালা।

সারাটি রাত ধরে ভূতের নাচনকোঁদন চলে,
সকাল কাটে হাই তুলে তার রাতে জাগার ফলে।

অ আ ক খ’র পাঠের মাঝে যেই পড়েছে ঢুলে,
গুরুমশাই বিশাল হেঁকে টান দিয়েছেন চুলে।

যোগবিয়োগে মন বসে না, সদাই উড়ু উড়ু,
অঙ্ক খাতায় ভুল বেড়ে যায়, চক্ষু পাকান গুরু।

সটান শুয়ে ঘুমোন ভূতু বেঞ্চিখানার 'পরে।
এই খেয়েছে, গুরুমশাই মারতে আসেন ধ'রে!

“দুত্তেরিকা” - বলে ভূতুম ঘরপানে দেয় হাঁটা -
“নয়কো সহজ পড়াশুনো। গুরুমশাই, টা টা।”

ভূতুর বাবার নানান রকম ফন্দি ছিল জানা -
নাইট স্কুলে ভর্তি হল ভূতের যত ছানা।

“ইচ্ছে হলেই উপায় থাকে”, বলেন হেসে গুরু,
সে রাত থেকেই ভূতুমছানার পড়াশুনোর শুরু।



অলংকরণ : দেবলীনা দাস

ছড়ার ছন্দে : মেঘের দেশে : লীনা রায় মল্লিক





মেঘের দেশে পাড়ি দেবো
স্বপ্ন দেখি রোজ,
জানবো আমি নতুন জগৎ
করব নতুন খোঁজ।

সূয্যিমামা কেমনে লুকোয়
মেঘের অন্তরালে,
দৌড়ে গিয়ে দেখবো সেথা
আমি খেলার ছলে।

টাপুর টুপুর বৃষ্টি কেমন
আসে ও দেশ থেকে,
আকাশভেদী আলোর রেখা
ভয় পেয়ে যাই দেখে।

দূর আকাশে মেঘের পাহাড়
দেয় যে হাতছানি,
মাগো আমি যাবো সেথা
দেখব জগৎখানি।


অলঙ্করণ : লীনা রায় মল্লিক