।।১।।
আমাদের বসিয়ে রেখে কাকু চলে গেল। অসিত কাকু। মুকুলের বাবা। ভর্তির দিন মুকুলের বাবা-মা দুজনেই এসেছিল স্কুলে। বোধহয় সেই কারণেই আমার বাড়ির কেউ যায় নি। আর তাছাড়া, বাবার অফিস ছিল। ঘরে ছোট ভাই তখন চার বছর বয়েস। মা তো ঘরের কাজ মিটিয়ে ভাইকে সামলাতে সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যায়।
তবে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আনন্দই আলাদা ছিল। পাড়ার ওই ছোট মাঠের প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে, জিটি রোড পেরিয়ে আরও কিছুটা হাঁটতে হয়। তারপর একটা রেলগেট আসে। সেই রেললাইন পেরোনোর পর স্কুল। সেখানে ফ্যান আছে। বড় মাঠ আছে। আর আছে অনেক স্যার, ম্যাডাম। লাইব্রেরিও ছিল।
প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু বলতে ওই মুকুল। ফাইভের বি সেকশনের সেকেন্ড বেঞ্চে আমি আর মুকুল পাশাপাশি বসলাম। মা আমাকে সেদিন টিফিন দেয়নি। প্রথম দিন তো। আদৌ পুরো স্কুল হবে কি হবে না, কে জানে! অসিত কাকু দেখি দু’টো বাপুজি কেক কিনে আমাদের দিল।
“টিফিন হবে শুনছি। খেয়ে নিস তোরা। আর একদম বদমায়েশি করবি না। ফেরার সময় একসঙ্গে বাড়ি ফিরে যাস।”
আমার ব্যাগের টিফিন বাবদ চার টাকা ছিল। মা দিয়েছিল। দিতে গেলাম কাকুকে। নিল না।
আমাদের বেঞ্চে আরও তিনটে ব্যাগ রাখা ছিল। তারা যে কারা সেটা প্রেয়ার শেষের আগে জানা যায়নি। ওইদিকে দুজন রাকেশ আর সুজয়। আর আমাদের ঠিক পাশেই বসেছিল ভগত’দা। রাজ ভগত। যদিও খাতায় নাম লেখার সময় ও ‘ভকত’ বানান লিখত। কিন্তু আমরা ভগত’দা বলেই ডাকতাম।
“আজ তো টিফিন হবে না রে। এ বাবা তোরা জানিস না। নিচে নোটিশ দিয়েছে।”, কাটা কাটা বাংলা উচ্চারণে ভগত’দা বলল। আমাদের থেকে লম্বা। স্বাস্থ্যবান চেহারা। চোখের নীচ’টা একটু কালো। গায়ের রঙ খুব ফর্সাও নয়, আবার চাপাও নয়। সাদা জামাটা পুরনো। আর আমরা সবাই কালো প্যান্ট পরেছিলাম। ভগত’দার প্যান্টটা নীল ছিল।
সেই শুরু। স্কুলের নোটিশ বোর্ড কোথায়; টিউবওয়েল ছাড়াও আর কোথায় খাওয়ার জল পাওয়া যায়; পরেশবাবু কেন সাইকেলে স্কুল আসেন সব খবর ভগত’দা জানত। মুকুল জিগেস করেছিল, “তুমি এত কিছু কী করে জানো? এই স্কুলে আগে পড়েছ?”
“না, না। আমি তো বিদ্যানিকেতনে পড়তাম। এই দেখছিস না, নীল প্যান্ট।”
“তুমি তো জুতোও পরোনি। স্যাররা বকবে না?”
“জুতো আছে। পরব। আজকে ভুলে গেছি।”
“বিদ্যানিকেতন মানে বৈদ্যবাটি বিদ্যানিকেতন?”, আমি জিগেস করলাম।
“হ্যাঁ, রে।”
“কিন্তু ওটাও তো হাইস্কুল। আমি অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম। তুমি ওখানে কিসে পড়তে?”
“ফাইভেই পড়তাম। দু’বছর। তারপরে তাড়িয়ে দিল। ... হা হা হা...” দু’দুবার ফেল করে স্কুল থেকে রাস্টিকেট হওয়ার পর কেউ এভাবে হাসতে পারে জানতাম না। ভগত’দা পারে। সে হাসিতে দেমাক ছিল না। টালবাহানা ছিল না। হতাশা ছিল। অসফলতার হতাশা। নিজের প্রথম স্কুল ছেড়ে আসার হতাশা।
কদিন পর থেকেই বুঝতে পারলাম ভগতদা কেন ফেল করত। কারণ সে স্কুলেই আসে না। সপ্তাহে একদিন কিংবা দুদিন আসত। তাও শনিবার করে। সেদিন হাফ ছুটি। প্রথম প্রথম আমি আর মুকুল ভগতদার জন্য জায়গা রাখতাম। কিন্তু, সে স্কুলে ঢুকত দেরি করে। সবাই বসে পড়ে। একবার তো স্যার এসে যাওয়ার পরে ঢুকেছিল। বাইরে দশ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।
একদিন টিফিন বেলা আমি আর মুকুল টিফিন বক্স বের করে বেঞ্চে চাউমিন খাচ্ছি। ভগত’দা আলুকাবলি খেতে খেতে ঢুকল। জিগেস করলাম,
“ও, ও ভগত’দা চাউ খাবে? মা বানিয়েছে।”
“... তোর মায়ের বানানো। দে একটু।”
“আচ্ছা, তুমি দেরি করে ইস্কুল আসো কেন? তারপরে এত কামাই করো। এরকম করলে তো তুমি আবার ফেল করবে।”
“কী করব বল দেখি। রোজ ভাবি ইস্কুলে যাব। কিন্তু মালিক ছাড়লে তবে তো!”
“মালিক? কে মালিক? কিসের মালিক?”
“দোকানের মালিক। ছাড় তুই অত বুঝবি না। বড় হলে বুঝবি।”
।।২।।
সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিল। কী এমন কথা যে আমরা বুঝব না! হ্যাঁ, মানছি ভগত'দা বয়েসে একটু বড়। কিন্তু তা বলে এভাবে বলবে! বুঝিয়ে বললেই বুঝতাম। ভগত’দা কেমন যেন আস্তে আস্তে রহস্যময় হয়ে উঠছিল। স্কুলে এলে মুখ গুঁজে লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকত। স্যার নাম ডাকার সময় প্রায়ই মিস করত। বার কয়েক কানমলাও খেয়েছে। তবু শিক্ষা নেই।
আমিও কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিলাম। খানিকটা রাগ করেই।
কিন্তু সেদিন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আর কোন রহস্যই রইল না।
রবিবার। বাবার সঙ্গে গেছিলাম জেঠুর বাড়ি। বৈদ্যবাটি খাল পেরিয়ে শেওড়াফুলির ভিতরে। বেলার দিকে ফিরছিলাম। রাস্তাঘাট মোটের ওপর ফাঁকা। দোকানপাট খোলা। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। সাইকেলের পিছনে দুদিকে পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম। বাবা খুব আস্তে সাইকেল চালায়। ফলে, চারদিকে সব বেশ দেখতে দেখতে আসা যায়। তখনই কানে এল-
“এই ছেলে, দু'টো থালা মাজতে কতক্ষণ লাগে? খদ্দের বসে আছে যে!”
“এই তো দাদা। হয়ে গেছে। আসছি...”
গলাটা চিনতে মোটেই ভুল করিনি। চকিতে ঘাড় ঘোরাতেই চোখাচোখি হল। ‘অন্নপূর্ণা হোটেল’-এর বাইরে কলের জলে এত্তগুলো বাসনের ডাঁই। সেখানে উবু হয়ে বসে বাসন মাজছে ভগত’দা। আমাকে দেখতে পেয়েছিল। চোখ নামিয়ে কাজে মন দিল। যতক্ষণ দেখা গেল, আমি ঠায় তাকিয়ে ছিলাম। একটা পুরনো হাফ প্যান্ট, খালি পা আর স্কুলের সাদা জামাটা। পুরো রোদ্দুরটা মুখে এসে পড়ছে।
বাবাকে কিচ্ছু বলিনি। পরের দিন স্কুলে গিয়ে মুকুলকে বললাম। সব শুনে মুকুলও বেশ অবাক হল।
“ভগতদাকে ভালো করে জিগেস করলে নিশ্চয় বলবে। আমরা বাবা-মা’কে বলে কিছু হেল্পও করতে পারি। পারি না?”, মুকুল বেশ আশা জুগিয়ে বলেছিল। আমার মন বলছিল অন্য কথা। ভগতদা আর আমাদের সঙ্গে কথা বলবে না হয়তো।
ঘটনাটা ঘটল পুরো উল্টো। সেদিনেই বিকেলে টিভিতে সাকালাকাবুমবুম দেখছি এমন সময় সাইকেলে বেল দিতে দিতে মুকুল হাজির।
“তাড়াতাড়ি চল। ভগতদা এসেছে। ক্রিকেট খেলব।”
মা’কে বলে টিভি বন্ধ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মুকুলদের বাড়ির সামনের ছোট মাটির গলিটার সামনে একগাল হাসি নিয়ে ভগত’দা দাঁড়িয়ে। জমিয়ে ক্রিকেট খেলা হল বিকেলে। তারপর সন্ধের আগে আগে আমিই জিগেস করলাম,
“ওই লোকটাই তোমার মালিক? ওই হোটেলের লোকটা?”
“অনেক আছে। ও তো একটা।”
“আর কে আছে?”
“সকালে পেপার দিতে বেরোই। পচার সাইকেল ধার করে। ফেরার পথে সবজি কিনে ফিরি। তারপর মা’কে সেসব দিয়ে বংশীদাদুর দোকানে যাই। জামা কাপড়ের ভালো সেল হয়। যেদিন খদ্দের কম থাকে ওখান থেকেই ইস্কুল চলে যাই, আর দেরি হয়ে গেলে যাই না। বাড়িতে আসি। খেয়ে দেয়ে খানিক পড়তে বসি। না’হলে মায়ের সেলাইয়ের কাজ করে দিই। তারপর বিকেল হতে না হতেই আবার গ্যারেজে। সেই রাতে ফিরে শুয়ে পড়ি। ছুটির দিনে শুধু হোটেলে যেতে হয়।... এবার বুঝলি কেন ইস্কুল যাই না?”
“সব তোমাকেই কেন করতে হবে? তোমার বাবা কী করে?”
“বাবা তো কবেই মরে গেছে! বাবা থাকলে কি আর এসব করতে হত রে?... যাকগে শোন, এখন এমনিতেই শ্রাবণ মাস। তারকেশ্বর যাত্রীদের জন্য বাঁকের দোকান দিচ্ছি। কদিন ইস্কুল আসব না। আমাকে নিয়ে ভাবিস না। নিজেরা পড়াশুনা কর মন দিয়ে। আমি ভালোই থাকব।”
।।৩।।
সেদিনেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ভগতদাকে এবার পাস করাতেই হবে। দুপুরে রোজ পড়তে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু ইস্কুল না আসলে কী পড়া হচ্ছে জানবে কী করে! কাজেই আমাদের একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
মুকুল আর আমি, দুজনে মিলে ছুটির দিনে চলে যেতাম ভগতদার দোকানে। অন্নপূর্ণা হোটেল। গিয়ে বলে আসতাম সপ্তাহে কী পড়া হয়েছে। বই আনতে বলতাম। সেখানে দাগ দিয়ে দিতাম। কিছু দরকারি নোটস থাকলে বাবা অফিস থেকে জেরক্স করে আনত। প্রথম প্রথম হোটেলের মালিক বিরক্ত হত। কিন্তু যখন বুঝল, আমরা এলে ভগতদার কাজের ফাঁকি হচ্ছে না, তখন আর কিছু বলত না।
ভগতদার মাথা ভালো ছিল। হাফ-ইয়ার্লিতে খুব খারাপ রেজাল্ট করেনি। আমরা বুঝতাম, ও প্রতি রবিবার আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকত। একবার আমাদের মাংস খাইয়েছিল। ভয়ে ভয়ে জিগেস করেছিলাম, “মালিক বকবে না?”
“কেন বকবে? দাম দিয়ে কিনেছে রে তোদের এই ভগতদা! কী ভাবিস আমাকে! খা খা... আমি খেয়েছি।”
পুজোর সময় বংশীমোহন রেডিমেড বস্ত্রালয় থেকে একটা গেঞ্জি আর টুপি কিনতে গেছিলাম। ভগতদা তখন একটা জামা ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছিল। একদম ভাবেনি আমি ওদের দোকান থেকে গেঞ্জি কিনতে আসব। কী খুশিই না হয়েছিল!
আস্তে আস্তে সময় হয়ে আসছিল। আর আমার চিন্তা হচ্ছিল। নিজে কীরকম রেজাল্ট করব সে নিয়ে ভাবনা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভগতদার জন্য সাজেশন তৈরি করতে গিয়ে সবকটা বই আমার বারকয়েক পড়া হয়ে গেছিল। মা পর্যন্ত অবাক হয়ে জিগেস করেছিল,
“হ্যাঁ রে অনি, তোর ওই প্রশ্ন বিচিত্রাটা শেষ?”
“হ্যাঁ। রোববার শেষ করে ফেলেছি।”
আমি শেষ না করলে ভগতদাকে কীকরে দেব!
মজা হয়েছিল অ্যানুয়াল পরীক্ষার দিনগুলোয়। সক্কাল সক্কাল পড়া করে স্নান খাওয়া সেরে আমি আর মুকুল হাজির হতাম কাপড়ের দোকানে। ভগতদা তৈরিই থাকত। আমরা বেল দিলেই ঝপাং করে জামাটা গলিয়ে চলে আসত। বংশীদাদু পরীক্ষার ক’দিন রেহাই দিয়েছিল ওকে।
দেখতে দেখতে ছ’টা পরীক্ষা, ছ’টা দিন শেষ!
।।৪।।
পরীক্ষা শেষ হতেই দাদু এসে আমাকে নিয়ে চলে গেল। আমিও ব্যাগ গুছিয়ে লাফাতে লাফাতে মামাবাড়ি চলে গেলাম। সামনে লম্বা ছুটি। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়িয়ে আর শুকতারা পড়ে দিব্যি ছুটি কাটাচ্ছিলাম। বাড়ির কথা একরকম ভুলেই গেছিলাম।
প্রায় মাসখানেক বাদে বাবা আর মা এল। আমরা সেখান থেকে বোলপুরে পিসির বাড়ি গেলাম। তারপর কাকু, পিসি আর আমরা মিলে দার্জিলিং ঘুরতে চলে গেলাম। খুব মজা হয়েছিল সেবার! উঁচু উঁচু পাহাড়, খরস্রোতা নদী আর পাহাড়ি মানুষগুলো। সব মনে রাখছিলাম। স্কুল খুললেই মুকুলকে আর ভগতদাকে বলতে হবে।
দার্জিলিং ঘুরে-টুরে যখন ফিরলাম ততদিনে রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। বাবা একদিন শনিবার দেখে আমার রেজাল্ট নিয়ে এল। ভালো নম্বর নিয়ে পাস করেছিলাম। হাইস্কুলের প্রথম বড় পরীক্ষা। কিন্তু স্কুলে কোনো লিস্ট বেরত না। ফলে, জানাই গেল না ভগতদা পাস করেছিল কি না। মুকুলকে জিগেস করলাম। সে-ও বলল রেজাল্ট বেরনোর দিন ভগতদাকে দেখেনি। স্কুল খোলা ছাড়া উপায় নেই।
হঠাত খেয়াল হল স্কুল খুলতে তো আরও দিন সাতেক। ভগতদা নিশ্চয় দোকানে থাকবে এই ক'দিন। গিয়ে দেখা করে এলেই হয়। মুকুল আর আমি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম বংশীদাদুর দোকানে। দোকান চলছে। দুটো বড় ছেলে দোকান সামলাচ্ছে। কিন্তু ভগতদা কই?
জিগেস করলাম, “ভগতদা আর কাজ করে না এখানে?”
“করে।”
“আজ আসেনি?”
“না।”
“কেন?”
“আমরা কী জানি!... সে কোথায় মরছে তার খবর কি আমাদের বলে গিয়েছে?”
“জানো না বললেই হয়। এভাবে বলছ কেন!”
আর দাঁড়াইনি সেখানে। ধাঁ করে সাইকেল বাগিয়ে সোজা অন্নপূর্ণা হোটেল। কিন্তু না! ওখানেও কেউ কিছু বলতে পারল না।গ্যারেজের জেঠুর কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানাটুকু পাওয়া গেল। শেওড়াফুলি অভিযান সংঘের কাছে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। তখন ঘড়িতে দুপুর সাড়ে বারোটা। দেরি হয়ে গেছিল বুঝতে পারছিলাম। আর দেরি হলে বাড়িতে মায়ের কাছে বকুনি বাঁধা। তাও আশা ছিল, বাড়িতে গেলে নিশ্চয় দেখা হবে। অনেকটা সাইকেল চালিয়ে ওদের বাড়ির কাছে পৌঁছে কাউকেই বিশেষ দেখা গেল না।
লোকজনও খুব বেশি নেই। মুকুল বলল, “ক্লাবে গিয়ে একবার খোঁজ করবি?”
ক্লাবের ছেলেদের আমার খুব ভয় করত। কেমন বদমেজাজি হয় সবাই। ভয়ে ভয়ে একজনকে জিগেস করলাম,
“এখানে ভগতদা থাকে না? ওর মা আছে। এই ... এই বাড়িটায় ভাড়া থাকে।”
“কে ভগত?”
“রাজ... রাজ ভগত।”
“হ্যাঁ। থাকে। কেন?”
“কই দেখতে পাচ্ছি না তো।”
“ওর মায়ের শরীর খারাপ। মা'কে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।"
“কোন... কোন হাসপাতাল?”
“অত জেনে তোদের কী কাজ! যা বাড়ি যা! এই তোদের বাড়ি কোথায় রে?”
মুকুল দেখি সাইকেলে উঠে হাঁক দিচ্ছে, “পালা ভাই! চল... পালাই!”
বাড়িতে এসে বেশ এক দাগ বকুনি খেলাম। অবেলায় চান, খাওয়া ইত্যাদি নিয়ে খুব বকা দিলো মা। স্কুল খোলা অব্দি আমার বাড়ি থেকে বেরনো নিষেধ হয়ে গেল!
৫
সিক্সে আমার ‘এ’ সেকশনে নাম ছিল। মুকুলের ‘বি’-সেকশন। ততদিনে অবশ্য আমাদের অনেক বন্ধু হয়ে গেছে। সেই নতুন ক্লাস, নতুন লোকজন ভয়টা আর নেই। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল। কারণ, না তো ‘এ’ সেকশনে, না ‘বি’ সেকশন; কোথাও ভগত’দার নাম নেই। আমাদের ক্লাস টিচার শ্যামলবাবুকে জিগেস করলাম, “স্যর, সিক্সে ক’টা সেকশন?”
“তিনটে। এ, বি আর সি।”
“সি সেকশনের ঘরটা কোথায়?”
“দোতলায়। উনিশ নম্বর।”
ব্যাস। ওটুকুই আশা। টিফিন অব্দি চুপচাপ ক্লাস করলাম। সিক্সে প্রথম দিন বলে হাফ ছুটি হত না। পুরো ক্লাসই হবে। মা আমাকে টিফিন বক্স ভরে খাবার দিয়েছিল। মুকুল অবশ্য টাকা এনেছিল। নিতাইদার ঝালমুড়ি খাবে।
টিফিনের ঘন্টা পড়তেই এক ঢোক জল খেয়ে উপরে চলে গেলাম। ওপরে বড়দের ক্লাস। এইট, নাইন, টেন সব দোতলায়। আর একেবারে উপরে তিনতলায় ক্লাস ফাইভের ঘরগুলো। ভয় করছিল। কেউ যদি কিছু বলে। এদিক ওদিক খুঁজে উনিশ নম্বর রুম’টা পেলাম। ভেতরে কয়েকজন বসে টিফিন খাচ্ছে। বাকিরা কেউ টেবিলে পেনফাইট খেলছে, কেউ বেঞ্চ বাজিয়ে গান গাইছে এইসব। মুখচেনা কয়েকজন ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে অত ভালো বন্ধুত্ব ছিল না। চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।
মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে খেয়ালই নেই যে নীচে নামার বদলে আমি অভ্যাসবশত তিনতলায় চলে গেছি। তিনতলায় উঠে ভুলটা ভাঙল। ফাইভের ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে। ওদের অ্যাডমিশন টেস্ট, তারপর লিস্ট বেরিয়ে ছাত্ররা আসতে আসতে আরও দিন পনেরো। কী মনে হল, একবার দেখেই আসি পুরনো ঘরগুলো। ফাইভ সি পেরিয়ে ফাইভ বি-তে ঢুকে দেখি সেকেন্ড বেঞ্চের ধারে চুপচাপ বসে আছে ভগত’দা।
খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম! “ভগতদা!! তুমি এখানে?”
“আরে তুই! আয় আয়... হ্যাঁ, একবার দেখতে এলাম ক্লাসগুলো। এখানেই তো বসেছিলাম প্রথম দিন। চিন্তা করিস না, এবারে আর ফেল করিনি।”
“সত্যি?”
“সত্যি। সি সেকশন। রোল একশ দুই। সকাল থেকে চারটে ক্লাস করলাম। কী ভাবিস আমায়!”
আমার তখন আনন্দে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, “তু-তুমি ছিলে কোথায় এতদিন? জানো, জানো আমরা কত খুঁজেছি? তোমার বাড়ি গেছিলাম! ও তোমাকে তো বলাই হয়নি, ছুটিতে দার্জিলিং গেছিলাম। কত পাহাড়, নদী... তারপরে এবারে শুকতারায় একটা ভয়ের গল্প পড়েছি, খুব ভয়ের, শুনলে তুমিও ভয় পেয়ে যাবে! তুমি টিফিন আনো নি?”
“টিফিন? না খেতে যাব। নিচে।”
“আমাদের ক্লাসে চলো। মা আজকে এত্তটা চাউমিন দিয়েছে। খাবে চলো।”, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে বললাম।
“তুই কী খাবি!”
“আমি অত খেতে পারি নাকি! ভাগ করে খেয়ে নেব চলো।”
“আচ্ছা... চল, চল।”
“এই ভগতদা, তোমার মা কেমন আছে গো? ওরা বলল হাসপাতালে ভর্তি ছিল।”
“আর বলিস না। কলপাড়ে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিল। এখন ঠিক আছে। মায়ের কাছে তোদের কথা বলেছি। একদিন নিয়ে যাব, দাঁড়া।”
“নিশ্চয় যাব। আরে ওই দ্যাখো মুকুল... এই মুকুল, মুকুল, এই দ্যাখ ভগতদা। পাস করে গেছে। বলেছিলাম না পাস করবে!”
"কী রে ভাই, কেমন আছিস?", সিঁড়ি দিয়ে চটি ফটফট করতে করতে ভগতদা মুকুলের দিকে এগিয়ে গেল। ভগতদা আজকেও জুতো পরতে ভুলে গেছে।
(সমাপ্ত )
অলঙ্করণ : অনিমেষ ভট্টাচার্য্য