গল্পের ঝুলি : ভূতের বেগার : প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

                     



খাড়াবুরু পাহাড় থেকে সবচাইতে কাছের রেলস্টেশন পাহাড়িগঞ্জে আসতে হলে ছ’সাত ঘন্টা লাগে। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে একই পাহাড়ি নদীকে চারবার পার করার পর একটা ঘন জঙ্গল পার হতে হয়। নদী পারাপারের সুবিধে আর জঙ্গলের রাস্তায় শঙ্খচূড়ের কামড় থেকে বাঁচবার জন্য পুরোটাই আসতে হয় ঘোড়ায় চড়ে।

একটিমাত্র প্যাসেঞ্জার ট্রেন, মহানগর থেকে সকালে এসে সন্ধেতে ফেরে। মহানগর যাবার এই ট্রেন ধরতে খাড়াবুরু ক্যাম্প থেকে ভোরবেলায় বেরিয়ে বিকেল নাগাদ পাহাড়িগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছালাম।

ওয়েটিং রুমের চাবি চাইতেই স্টেশন মাস্টার খবর দিলেন যে লাইনে ধস নেমেছে। সন্ধের প্যাসেঞ্জার কাল ভোরের দিকে আসতে পারে। এই লাইনে এটা প্রায় হয়। ওয়েটিং রুমও সেই কারণে বেশ বড়। রাতের শোয়া থাকার বন্দোবস্ত, এমনকি রেলের ওপর মহলে অলিখিত বোঝাপড়ার দরুন ওয়েটিং রুমের আঙিনায় আমাদের কোম্পানি রান্নাঘরের একটা চালাও বানিয়ে নিয়েছে।

মাস্টারমশাই বললেন ওয়েটিং রুমে সেই দুপুর থেকে আর এক বাঙালি প্যাসেঞ্জার শঙ্করবাবু আছে।  লোকটি ঘরে চাবি দিয়ে ওয়েটিং রুমের সহকারী বুধুয়াকে সঙ্গে নিয়ে বোধ করি হাটে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। 
হাটের কথায় মনে পড়ল আজ বুধবার। এই তল্লাটের সবচাইতে বড়ো হাট, এই স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তায় একটু গেলেই শুরু হয়।
সাপ্তাহিক এই হাটে আনাজ আর গ্রাম-গ্রামান্তরের টাটকা সবজিই যে বিক্রি হয় তাই নয়, বেশ কয়েকটা খাবারের দোকানও বসে।

গণেশ হালুইকরের বিখ্যাত চপ জিলিপি খাওয়া শুরু করতে যাব, দেখি বুধুয়ার সাথে একজন লোক দোকানে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কুচকুচে কালো, লম্বা,শীর্ণকায় লোকটির টিপিক্যাল বাঙালি ছাঁদের মুখ দেখে আন্দাজ করলাম এ নিশ্চয় সেই শঙ্কর।
আমার অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করে, শঙ্কর মিনিট পাঁচেক আমার কাছে বসে, রাত্রে ওয়েটিং হলে একসাথে একটু মাংসভাত খাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেল। সে  যাবার পর দেখি পাশের সারির  টেবিলে বসা দু’জন স্থানীয় লোক আমাকে দূর থেকে নমস্কার করছে। আমার কাছে এসে বসতেই চিনলাম ওদের একজনকে। আমি বললাম,
“কী খবর মংলু? বহুদিন পর দেখা হল, কেমন আছ?”

বছরখানেক আগে, পিনাক পাহাড়ে কাজ করবার সময়, এই মংলু সর্দার ছিল আমাদের লোকাল গাইড। চা খেতে-খেতে মংলু আমাদের ক্যাম্পের সবার খবর নিচ্ছিল । হঠাৎ গলার স্বর নামিয়ে বলে,
“সাহেব, একটু আগে রেলের বুধুয়ার সাথে যে বাঙালি বাবু ছিলেন, তার সাথে কতদিনের জান-পহচান?”

আমি অবাক হয়ে বলি,
“এই দোকানেই আলাপ। ওয়েটিং হলে উঠেছেন আমার আগে। তুমি চেনো নাকি ওঁকে?”

“ আলাপ নেই সাহেব। কিন্তু লোকটা সুবিধের নয়। আমার সঙ্গের এই বন্ধুর কাছেই শুনুন ওঁর কীর্তি কাহিনী।”

মংলুর বন্ধু বলে,
"সাহেব, এই লোকটা আজ প্রায় একমাস আগে আমাদের গ্রামে আসে। আমাদের প্যাটেলকে (মোড়ল) পটিয়ে নিয়ে ও আমাদের মারাং থানে (আদিবাসীদের দেবতাদের বেদী) এসে একটা পুতুল বার করে কিসব মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে, বেশ কয়েকদিন ধরে পুজো করতে থাকে।"

আমার দেখা অরণ্যের আদিবাসীরা অত্যন্ত খোলা মনের লোক। গ্রামের মোড়লের অনুমতি থাকলে, ওঁদের দেব-দেবীদের থানে এসে পুজো যে কেউ করতে পারে। সে আদিবাসী না হলেও কিছু যায়-আসে না।
মংলুর কথা শুনে আমি বলি,
“তাতে দোষের কী আছে?”

মংলু বলে,
“সাহেব, আমার এই বন্ধু দেখেছে যে ওই লোকটা  তার পুজোর শেষদিনে অনেকক্ষণ ধরে মন্ত্র পড়ে একটা বড় মানুষ-পুতুল থানে ছেড়ে দিয়ে নিজে পাশের ঝোপে লুকিয়ে ছিল”। 

আমি কিছুটা আন্দাজ করলাম, কিন্তু পুরোটা আগে শুনে নিই। তারপর কিছু না হয় বলা যাবে মংলুকে।
মংলুর বন্ধু  বলে, “সাহেব, এরপর ওই মানুষ-পুতুলটা একবার এগোয়, একবার পিছোয়, শেষটায় মারাংকে (বড় শিলা, যাকে ওরা দেবী বলে মানে) চারপাশ ঘুরে একদম মাটিতে পড়ে শুয়ে থাকল। আর এই লোকটা তখন পুতুলটাকে তুলে নিজের ঝোলায় পুরে ফেলল।”
মারাং-থানে থাকে এক বিশাল শিলা। সেটি একটি বড়ো গাছের তলায় থাকে। শঙ্কর, মনে হচ্ছে, এই গাছে বা মারাং-শিলাতে কোনও পোকামাকড়, বা  কোনও পাখি দেখেছে।
এদের আওয়াজ রেকর্ড করবার জন্য টেপ-রেকর্ডার আর কোনও মেশিন লাগানো রিমোট পুতুল টাইপের রিসিভার লাগিয়ে দিয়ে আড়ালে ছিল। আমি শুনেছি এই রকমের আওয়াজের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে খুব চাহিদা আছে। সেইসব কাজ করছে বোধহয়।

আমি কিছু বলছি না দেখে মংলুর বন্ধু বলে, “মারাং এর সাথে থাকবার আর পুজো পাবার জন্য বেশ কিছু অশরীরীরাও, সেখানকার গাছের ডালে বা মারাং এর চারপাশে থাকেন। সাহেব, এই মারাং-তলায়, প্রতি বুধবার, মারাং চোঁতাই (আদিবাসীদের পুরোহিত)-এর ওপর, এইসব আত্মাদের ভর হয়। এরা গ্রামের লোকদের রোগে-অসুখে, জড়িবুটির নিদান বা নানা বিপদ-আপদের খবর চোঁতাই-এর মুখ দিয়ে বলে দেয়। 
কিন্তু এই লোকটা যাবার পর, মারাং চোঁতাই-এর ওপর, এঁদের ভর হয়নি। জড়িবুটির নিদান আর আপদবিপদের সাবধানবাণী জানতে না পেরে সাধারণ মানু্‌ষ, একটু ভয়ে-ভয়ে আছে।"

মংলু বলে, “ এইরকম কখনো-কখনো যে হয় না তা নয়। তবে সেটা বসন্তকালে। দেবী তখন মহাদেব পাহাড়ে যান, তাঁর ভৈরবের সঙ্গে হোলি খেলতে। সেই সময় এদিক-ওদিক ঘুরে অশরীরীরা নতুন সঙ্গী-সঙ্গিনীর খোঁজ করে । আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এই লোকটার পুতুলে কোনো জাদুর ফাঁদ নেই তো?"

আমি বলি “তার মানে?”

মংলু বলে “ সাহেব এই অপদেবতারা বা অশরীরীরা কিন্তু অনেকটা আমাদের মতো । সেইরকম শক্তিমান কোনো সিদ্ধাই কোনো কিছুর লোভ দেখালে এরা তার বশে এসে তার সঙ্গে চলে যায়। অনেক আগে এইরকম ব্যাপারটা লোহাগাঁওয়ের লোকেরা করেছিল। কিন্তু অপদেবতারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে, ফিরে এসেছিলেন”।

এই জঙ্গলে, সাপ ধরতে অনেক লোক আসেই। এছাড়া, বেশ কিছু লোক এখান থেকে বাঁদর বা পাখি ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে অপদেবতা বা ভূত কি বাঁদর না পাখি যে তাকে ফাঁদে ফেলে ধরে নিয়ে যাবে কেউ?   

আমাদের ওপর খুব কড়া নির্দেশ আছে, কোনো অবস্থাতেই স্থানীয় লোকের বিশ্বাসে ঘা দিয়ে কোনো মন্তব্য যেন না করি। এই কারণে, ওদের মুখে যা শুনলাম তাতে চুপ করে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করলাম।

***********
ওয়েটিং হলের বাথরুমে পাহাড়ি ঝরনা থেকে হিমশীতল ঠান্ডা জল আসে। সেই জলে ভালো করে স্নান করতেই সারাদিনের ক্লান্তি মুছে গেল। হলের বাইরে বাঁধানো গাছতলাটায় যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম শঙ্কর ওয়েটিং হলে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।

ব্যাপারটা বেশ চোখে পড়ার মতো। গভীর রাতেও এই ওয়েটিং হলে ঠাণ্ডা বাতাস পাবার জন্য আমরা কেউ কখনো দরজা লাগাই না। তবে কি সত্যি সত্যি এই শঙ্করের কোনো রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার আছে?
আজ অন্ধকার পক্ষ। আকাশ থেকে এক বোতল কালি চারদিকে ছড়িয়ে, আঁধার নামলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে শঙ্কর রিটায়ারিং রুম থেকে বেরিয়ে  আমার কাছে এসে বসলো। একটু পরে আমাকে ও বলে “রাতের রান্নার কিছুটা এগিয়ে রাখলাম”।

আমি শঙ্করকে বলি,
“চলো, তোমাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করি। অবশ্য আমি বিশেষ কিছু পারি না।”
শঙ্কর বলে “ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। চা এসেছে আপনার জন্য, খেয়ে দেখুন।”

টর্চের আলোয় দেখি, ট্রে-তে, রীতিমত টিকোজি ঢাকা টি-পটে, চা এনেছে। চা জিভে আসতে মনে হল এ তো রংলি-রংলিয়টের বাগানের। অরেঞ্জ পিকো চা-পাতার ভুরভুরে গন্ধওয়ালা চা।
হঠাৎ মনে পড়লো, শঙ্কর বলছিল, চা এসেছে আপনার জন্য। এই চা এইখানে আনলে কে? আমি স্পষ্ট দেখেছি শঙ্কর এখানে এসেছে একদম খালি হাতে। হতে পারে এই গভীর অন্ধকারে আমার দেখায় কিছু ভুল হয়েছে।
চা খেতে-খেতে শঙ্কর অকপটে বলছিল নিজের জীবনের কথা।

অনাথ আশ্রমে কেটেছে ওর শৈশব। তারপর রুজির কারণে একাধিক পেশা। শেষটায় কপাল ঠুকে হাইওয়ের ধারে ধাবা। একসময়ে, ভাতের হোটেলে কাজ, আর লাইন-ট্রাকে খালাসি থেকে ড্রাইভার হবার কর্মজীবনের সূত্রে, কম পুঁজি দিয়ে ছোটো ধাবা শুরু করে। কিন্তু বড়ো ধাবার মালিক হতে তার বেশি দেরি লাগেনি।

এই ধাবাতেই আলাপ হয়ে যায় এককালের জমিদার বংশের সন্তান জিগনেস সিংহের সাথে। এর এখন অনেক প্যাসেঞ্জার গাড়ি আর ট্রাকের বিজনেস আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে জঙ্গলের ভেতর পূর্বপুরুষদের এক শিকারবাড়ি পেয়েছে, জিগনেস শঙ্করকে বলে যে শঙ্কর চাইলে দুজনে যৌথ মালিকানায় সেখানে রিসর্ট খুলতে পারে। শঙ্কর হোটেল আর রেস্তোরাঁ চালাবে।

জিগনেসের গাড়িগুলোতে এয়ারপোর্ট অথবা স্টেশন থেকে পর্যটকদের আনাগোনা চলবে।

জঙ্গলে পাহাড়ের চুড়োর কাছে এই শিকারবাড়ির ছাদ থেকে পুরো জঙ্গল, আর এঁকেবেঁকে যাওয়া এক পাহাড়ি নদী দেখা যায়। এই রকম জায়গায় আসা-যাওয়ার সুযোগ-সুবিধে থাকলে লোকের অভাব হয় না। এছাড়া বিদেশী পর্যটকরাও এই জায়গাটাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করলো।

সমস্যা দাঁড়ালো হোটেলে কর্মীর অভাব নিয়ে। চার-পাঁচগুণ বেশি মাইনে, ভালো থাকা-খাওয়ার সুযোগ সুবিধে দিয়েও এই বন-জঙ্গলে কাজ করতে লোকে আসতেই চায় না, তার ওপর আর এক ভয়।

কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যেতে অন্ধকার আরও চেপে বসেছে। নিজের হাত পা দেখা যাচ্ছে না। শঙ্করের আওয়াজ একবার বাড়ছে, একবার কমছে। এই অন্ধকারে ও কথা বলার সময় চলছে কী করে? তাহলে কি মংলু ঠিকই বলছিল এর ব্যপারে? এই শঙ্কর মনে হয় সিদ্ধাই না হলেও তার আশেপাশে কিছু একটা হবে। নয়তো এইরকম মিশকালো আঁধারে ও দেখতে কী করে পায়?

মনের ভয় মনে চাপলেও আমি একটু কাঁপা গলায় শুধালাম,
“ভয়ের কী ব্যাপার হল? চিতাবাঘ হামলা করেছিল নাকি?"

শঙ্কর বলে, “সে হলে উপায় তো ছিল। কিন্তু এঁদের থেকে কিছু তো করার নেই । তবে বিদেশী গেস্টদের খুব ভালো লাগতো এঁদের উপস্থিতি।”

“ব্যপারটা খোলসা করে বলুন তো।”   

শঙ্কর বলে, “পুরানো আমলের কিছু লোকজন এই শিকারবাড়িতে অশরীরী হয়ে এখনো রয়ে গেছেন। তাঁদের উপস্থিতি আমাদের কাজের লোকজন টের পেতে থাকলো আর পালালো। শেষটায় এমন হল যে, কাজের লোকের অভাবে গেস্টদের সবাইকে সসম্মানে এয়ারপোর্ট বা স্টেশন ছেড়ে আসতে হল। গেলেন না শুধু এক স্কটিশ গেস্ট, ব্লেয়ার সাহেব। শেষ অবধি ওঁর জন্যই হোটেল আবার চলতে লাগলো বেশ রমরমিয়ে।”

ব্লেয়ার সাহেব কী নিদান দিয়েছিলেন, সেটা জানবার আগেই, পুরো জায়গাটা মাটন কাটলেটের সুগন্ধে ভরে উঠল। সেই সময় পাইলট ইঞ্জিনের আলো এসে পড়ায় শঙ্করের মুখ দেখা যাচ্ছিল। শঙ্করের পেছনে কে একজন একটা ঢাকা দেওয়া ট্রে আনছে। শঙ্কর আমার কাছে এসে বসে বলে, 
“তখন শুধু চা খাওয়ালাম। এখন এই কয়েকখানা কাটলেট খান। আপনার প্রিয় কফি আসছে এরপর।”

কিন্তু এ কী! ইঞ্জিনের সার্চ লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ট্রে এগিয়ে আসছে, কিন্তু শূন্যে। এতো জোরালো আলোতেও ট্রে কে আনছে দেখা যাচ্ছে না। লাইট ইঞ্জিন আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় দেখলাম বাঁধানো গাছতলায় যেখানে আমরা দু’জনে বসেছিলাম, খুব নিপুণ ভাবে অদৃশ্য কেউ আমাদের দুজনের মাঝখানে মাটন কাটলেটের ঢাকা দেওয়া ট্রে রাখল। 

আমার পা থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনে হল শরীরটা নিস্পন্দ হয়ে গেছে।  সাড়ে চার বছর অরণ্যবাস করছি। বহুবার বাঘ, পাইথন, জংলি শুয়োরের সাথে সামনাসামনি দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু এইরকম অবস্থা আমার কখনো হয়নি।
কিন্তু শঙ্কর নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি এইরকম ভাবখানা করে সে মাটন কাটলেটের প্লেটের ঢাকনা খুলে কাঁটাচামচ আর ছুরি ধরে একটুকরো মুখে পুরে নিলে।

আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে শঙ্কর বলে,  
“যা দেখলেন তা নিয়ে বেশি ভাববেন না। এসব সেই ব্লেয়ার সাহেবের অবদান। আপনি নির্ভয়ে কাটলেট খান আর খেতে খেতে ব্লেয়ার সাহেব কীভাবে আমার রিসর্ট বাঁচিয়ে দিলেন সেই কাহিনীটা শুনুন।”

আমার মনে পড়ে গেল, একটু আগে শঙ্কর বলছিল বটে, জঙ্গলের মধ্যে তার রিসর্টে অশরীরীর উৎপাতের কথা, যা এই ব্লেয়ার সাহেবের জন্যই মিটে যায় এবং রিসর্ট আবার রমরমিয়ে চলতে থাকে।

আমি কাটলেট শেষ করে দেখি কফি আসছে, ঠিক সেই মাটন কাটলেটের ট্রে নিয়ে আসার  মতো। যে আনছে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। এবার আর ভয় করছিলো না,  হঠাৎ কাপে চামচের আওয়াজে চমকে উঠি।

শঙ্কর বলে, “ওয়েট্রেস জানতে চাইছে কফি আপনি বানিয়ে নেবেন না ও বানিয়ে দেবে?” 
'মিস্টার ইন্ডিয়া' সিনেমার মতো একটা শো দেখা যেত কিন্তু সাহসে কুলালো না। নিজে বানাবো জানালাম।

একটা হাল্কা ফরাসি পারফিউমের গন্ধ মিলিয়ে যেতেই শঙ্কর হেসে বলে, “স্যার, দিতিয়েনের হাতের কফি একবার খেলে সহজে ভুলতে পারতেন না। খাঁটি ফরাসি কায়দায় বানান। উনি ফ্রান্স থেকে এদেশে আসবার সময়, বিমান দুর্ঘটনার পর আমাদের কাছেই রয়ে গেছেন। উনি আমার হোটেলের একজন অন্যতম শেফ এবং ভি. আই. পি. গেস্টদের ওয়েট্রেস।”

নাঃ, এই শঙ্কর দেখছি একথা-সেকথায় ব্লেয়ার সাহেব কী নিদানে ওর রিসর্ট বাঁচিয়েছিলেন সেটা এড়িয়ে যেতে চাইছে । কিন্তু আমিও ছাড়বার লোক নই।
 আমি বলি,
"শঙ্কর, এবার কিন্তু ব্লেয়ার সাহেবের কথাটাই বলো।”

কফিতে চুমুক দিয়ে ও সেই কাহিনী বলতে শুরু করলো।

“পুরো হোটেলে তখন শুধু ব্লেয়ার সাহেব আর আমি। এক রাতে খেতে- খেতে ব্লেয়ার সাহেব আমায় শুধালে, “ স্যাঙ্কি, এই হোটেলে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড সেলার আছে কি?”

সাহেব-গেস্টদের সাথে আলাপের দরুন আমি বুঝে গেলাম ব্লেয়ার সাহেব কী বলছে। আমি মাথা নাড়তেই, ও বলে, “তুমি না জানলেও, টুমরো মর্নিঙে আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব এই বিল্ডিঙের কোথায় আছে সেটা।”

পরদিন ভোরবেলাতে সাহেবের সাথে নেমে পাতালঘরের একদম নিচে পাওয়া গেল অক্ষত অবস্থায় শ্রী শ্যাম-রাইয়ের যুগল অষ্টধাতুর  মূর্তি, নৃত্যরত মুদ্রায়। সেইসাথে আরও আটটি নারী-পুতুল।
সাহেব আমায় বললে যে এই মূর্তিগুলি শিকার বাড়ির পিছনে যে বিগ্রহহীন মন্দির আছে সেখানে রাখতে । ব্লেয়ার সাহেবের কথা অনুযায়ী, হয়তো কোনো লুটেরা দস্যুর হাত থেকে বিগ্রহকে রক্ষা করতে এই বাড়ির মালিকেরা এঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন আর সাথে দিয়েছিলেন এই আটটি সঙ্গী ও সঙ্গিনী।

সাহেব শোনালে, তার গ্রামে এইরকম এক প্রাচীন দুর্গে ভূত আছে বলে শোনা যেত। সেখানে এইরকম পাতালঘরে কিছু মূর্তি পেয়ে উনি সেগুলো দুর্গের  গির্জাতে নিয়ে আসেন। এই মূর্তিগুলি অত্যন্ত পবিত্র এবং এতে অশরীরীরা প্রবেশ করলে তাঁদের মুক্তি হয়।   
শঙ্কর আমার দিকে চেয়ে বলে “সাহেবের কথা আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। কিন্তু ওঁর কথা অনুযায়ী কাজ করে দারুণ সব ব্যাপার ঘটতে লাগলো।”

আমি শুনছিলাম শঙ্করের সব কথা। কফির কাপের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখি, সেটা কখন শেষ করে ফেলেছি নিজেই জানি না।

শঙ্কর বলে “ স্যার, পটে অনেক কফি আছে, আপনাকে আর এক কাপ দিয়ে দিই। কফি খেতে খেতে শুনুন বাকিটা।”

পাতালঘর থেকে ফিরে ব্লেয়ার সাহেবকে দুপুরের লাঞ্চের জন্য কোনোমতে দু’খানি হাতে-গড়া রুটি আর স্যুপ সার্ভ করে ঘুমিয়ে গেছিলাম। ঘুম যখন ভাঙ্গে, দেখি বিকেল পার হয়ে গেছে। সাহেব এই সময় কফি আর স্যান্ডউইচ খায়। দেরি হয়ে গেছে ভেবে নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে কিচেনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। দেখি ব্লেয়ার সাহেব কিচেনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি, লজ্জিতস্বরে কিছু বলবার চেষ্টা করার আগেই সাহেব বলে উঠলো, 
“স্যাঙ্কি, স্ট্রেঞ্জ থিং হয়েছে। আমি বিকেলে বরাবরের মতো, ঝরনার ধারের বাঁধানো গাছতলায় বসে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, এটা তো আমার কফি খাবার সময়। শ্যাঙ্কির তো ভুল হয় না।
চোখ তুলে দেখি, প্রায় মানুষের কোমরের সমান উচ্চতায় একটি কফি আর স্যান্ডউইচ সমেত হোটেলের ট্রে আসছে, কিন্তু কেউ কোথা নেই। ট্রে সাবধানে গাছতলার সিমেন্টের বেদীতে নেমে এলো। কফি এতটুকুও ছলকে পড়লো না। আমার কফি আর স্যান্ডউইচ খাওয়া হতেই ট্রে যেভাবে এসেছিল  সেভাবেই ফিরে গেল কিচেনের দিকে।”
আমি ব্লেয়ার সাহেবের কথা শুনে কিচেনে গিয়ে দেখি, সারা কিচেন স্যান্ডউইচ গ্রিল করার গন্ধে ম-ম করছে। কফিসেট আর গ্রিল মেশিন দেখে বুঝলাম সেগুলো সদ্য ধোওয়া।  তবে আমি বিস্মিত হলেও সাহেব কিন্তু নির্বিকার।

সন্ধে হতেই দেখি, আবার আগের মতো সব ক'টা দেওয়াল-গিরি জ্বলে উঠেছে। ব্লেয়ার সাহেব হোটেলের ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। 
আমায় দেখে বলে, 
“ এক্সেলেন্ট ডিনার স্যাঙ্কি, গো ইনসাইড। দারুণ রান্না করা ডিনার তোমার জন্য অপেক্ষা করছে”।

ভেতরে গিয়ে দেখি, আমার রেস্তোরাঁর পুরানো গোয়ানিজ কুকের মতো সেভেন কোর্স ডিনার তখনো গরম আছে। ভয়ে ভয়ে চেখে দেখি, প্রতিটি পদ কন্টিনেন্টাল, আর পাকা হাতের রান্না।

সাহেব বাইরের বাগানে বসে ছিল। আমাকে ঈশারায় ডেকে বলে, 
“জয়েন মি হিয়ার, স্যাঙ্কস। আমার ইন্টিউশন বলছে সামথিং মোর স্ট্রেঞ্জ উইল হ্যাপেন। একটু অপেক্ষা করে দেখো।”

সাহেব তার স্কটল্যান্ডের গল্প করছিল। সেখানে এইরকম অনেক  হানাবাড়ি আর দুর্গ আছে।  এইরকম পবিত্র পুতুল রেখে দিলে সেখানের অশরীরীরা খুশি হয়ে ঘরবাড়ি, দুর্গ এইসব পরিষ্কার করে রাখে। সাহেবের এইসব কথা শুনে আমি ঢুলছিলাম মাঝেমাঝে।
সাহেব আমার পিঠে হাল্কা চাপড় দিয়ে বলে, 
“স্যাঙ্কর, গেট আপ, শুনতে কিছু পাচ্ছ”?

শিকার বাড়ির পেছনে সেই পুরানো মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে।  মাঝে মাঝে  মৃদঙ্গ-খোল-করতাল-খঞ্জনি বেজে উঠছে।

সাহেব আর আমি এরপর মন্দিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে যাই। দেখি সবক'টা দেওয়ালগিরি জ্বলছে। আটচালাতে ঢাকা দিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা বাদ্যযন্ত্রগুলোর একটাও নেই। যে বিগ্রহ আমি পাতালঘর থেকে এনে নিজে মন্দিরের ভেতরে সিংহাসনে বসিয়েছিলাম,  সেটি এখন নাটমন্দিরে। সেই আটটা পুতুল হাত নামিয়ে-উঠিয়ে, কখনো বা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, বিগ্রহকে গোল করে ঘিরে মেলার কাঠপুতলির নাচের মতো নেচে চলেছে। সুরেলা মধুর বংশীধ্বনি হচ্ছে আর সেইসাথে মৃদঙ্গ, শ্রীখোল আর খঞ্জনি বেজে চলেছে। 

আমরা একদম নিশঃব্দে তাঁদের নাচ কিছুক্ষণ দেখে ফিরে এলাম হোটেলে। আসবার পথে, আমাকে সাহেব একটা দারুণ জিনিস শোনাল, 
“স্যাঙ্কর, জাস্ট ইমাজিন, তুমি গৃহহারা হয়ে গেছ। ঘরে তোমার বেডরুম, লিভিংরুম, কিচেন সবকিছু ছিল। যেটা যেখানে থাকবার, সেগুলো সুন্দর গোছানো ছিল। কিন্তু গৃহহারা হবার পর, সব জিনিস তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন কেউ যদি তোমাকে আবার একটা ছোটোমতোও ঘর দেয়, তুমি খুব আনন্দিত হয়ে তার কোনও দুঃখ বা কষ্ট দূর করতে চাইবে। এইখানেও তাই হয়েছে”।

আমি বোকার মতো সাহেবের দিকে চেয়ে আছি দেখে সাহেব আমায় বললেন, 
“স্যাঙ্কর, আমাদের শরীরের এক-একটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ  ঘরের এক-একটা রুমের মতো। মারা গেলে শরীরের সাথে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো হারিয়ে আমরা ওই গৃহহারা মানুষের মতো তালগোল পাকানো অবস্থায় থাকি। এই হোলি পুতুলগুলো ছোটো ঘরের মতো। এইখানে ঘুরে বেড়ানো অশরীরীরা এই পুতুলগুলোর কাছে আশ্রয় পেয়ে, কিছুটা শরীরী মানুষের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করতে পেরে স্বস্তি পেয়েছে আর সেই আনন্দে এই গডের মূর্তিকে ঘিরে নাচছে। হতে পারে, এখানের অশরীরীরা সবাই বৈষ্ণব ছিল। জীবিত অবস্থায় তারা এইভাবে ওই হোলি গড আর গডেসের চারপাশে ঘিরে নাচত। বহুকাল পরে আবার সেই অবস্থাটা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এই সাথে তোমাকেও ওরা ভোলেনি। ওরা দেখেছে কাজের লোকজনের অভাবে তোমার হোটেল এখন বন্ধ হতে চলেছে। তাই ওরা এগিয়ে এসেছে তোমাকে হেল্প করতে। ওরা এই হোটেলের কুকিং, ক্লিনিং, রুম-সার্ভিসিং এইসব কাজ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।”

আমি বললাম, “ব্লেয়ার সাহেব, গেস্টরা যখন দেখবে এসব, তখন তো তাদের অর্ধেক হার্টফেল করে মারা যাবে, আর আমাকে তো জেলেই পচতে হবে।”

ব্লেয়ার সাহেব বললেন, 
“আজ বিকাল আর পরে সন্ধ্যেবেলাতে যা দেখলাম, তা একটা রেয়ার ওয়ান্ডারফুল একসাইটিং অভিজ্ঞতা। আমি তোমাকে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, পৃথিবীর অন্য কোথাও এইরকম ম্যাচিং আরণ্যক পরিবেশে, যেখানে অদৃশ্য সার্ভাররা তোমাকে তোমার রুমে বা ডাইনিং হলে খাবার পরিবেশন করছে বা পুরো রিসর্ট ক্লিন করছে, এইরকম ভৌতিক শিহরণ পাওয়া দৃশ্য দেখা যাবে না। এই দেখতে, আমাদের দেশ থেকে প্লেন ভর্তি লোকেরা আসবে।  এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিতে তারা আসবেই আসবে।”

আমি বিস্মিত হয়ে বলি, “তার মানে এখানে গেস্টের অভাব কখনো হবে না!”

ব্লেয়ার সাহেব নিজের মোবাইল হাতে নেবার আগে আমায় বললেন, “আগামী একমাসের জন্য আমি তোমার সব ঘর বুক করে নিলাম। ফুল পেমেন্ট অ্যাডভান্স করে দিচ্ছি”।

ব্লেয়ার সাহেব একঘণ্টা পরে আমাকে বললেন, 
“কাল এয়ারপোর্টে সকাল আটটার আগে দশটা স্করপিও পাঠিও। আমার চল্লিশজন বন্ধু, যাঁরা এখন ইন্ডিয়া ট্যুর করছেন, তাঁরা আমার কাছে খবর পেয়ে কালই আসছেন।”

শঙ্কর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, 
“চল্লিশজন গেস্টদের কে বা কারা সামলালো তা আপনি বুঝতেই পারছেন। এঁরা স্বেচ্ছায় লিখিত গ্যারান্টি দিয়েছিলেন যে, এই হোটেলে তাঁদের বসবাসকালে, তাঁদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির কোনোপ্রকার দায়দায়িত্ব হোটেলের ওপর বর্তাবে না। সেই থেকে আমার হোটেলে গেস্টদের মালপত্র রুমে নিয়ে যাওয়া থেকে, তাঁদের রুম সার্ভিস বা ডাইনিং হলে অর্ডার নেওয়া, সার্ভ করা, দেশি- বিদেশি রান্না করা, এইসব কাজ অশরীরীরাই করে থাকে।
মন্দিরের বাইরে গ্যালারি মতো বানিয়ে দিয়েছি। প্রতি সন্ধেবেলায় হোটেলের গেস্টরা বিগ্রহকে ঘিরে কাঠপুতুলের নাচ অবাক হয়ে দেখেন। এছাড়া এখানকার অরণ্যের নয়ন-মনোহর শোভাও তারা তারিয়ে তারিয়ে দেখেন। ফাঁক-ফুরসত আর হানাবাড়ির খবর পেলে আমি কাঠপুতুলদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সেইসব হানাবাড়িতে থাকা অশরীরীদের কেউ যদি এইখানে আসতে চান, তবে আমার সাথে যে পুতুলেরা থাকে তারা তাদেরকে নিজের অঙ্গে মিশিয়ে নেয়।”

আমি শঙ্করকে বলি, “এই অরণ্যের আদিবাসী গ্রামগুলোতে তুমি তাহলে এই পুতুল নিয়ে এইজন্য ঘুরেছ।”

শঙ্কর বলে, “এঁরা অরণ্যের আদিবাসী, অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন। আমি প্রতিটি মারাং-থানে গিয়ে ওঁদেরকে আমার হোটেলের চারপাশে আরণ্যক পরিবেশে ঘুরে বেড়াবার আমন্ত্রণ দিয়েছি। যাঁরা আসতে চেয়েছেন, তাঁরা ওই কাঠপুতুলের মধ্যে চলে এসেছেন। এঁরা এই রিসর্টে এসে থাকবেন আর নতুন আরণ্যক পরিবেশে ঘুরে বেড়াবেন। পরে এরা যদি খুশি হয়ে গাইড হতে চান, তাহলে রিসর্টের গেস্টরা, যাঁরা এইখানের চারপাশের অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে চান, তাঁদের নিরাপদে ঘুরিয়ে আনতে পারবেন।”

আমি আর থাকতে না পেরে বলেই উঠি, “ শঙ্কর তুমি তো দারুণ প্ল্যান এঁটেছ!”

একটু নীরবতার পর শঙ্কর বলে,
“ স্যার, ডি. এফ. ও. সাহেব বলছিলেন, আপনি একজন নামডাকওয়ালা জিওলজিস্ট তো বটেই, সেই সাথে আপনি ঐতিহাসিক এক রাজবংশের বংশধর?”

কিছু তিক্ত স্মৃতি আছে আমার এইসব নিয়ে। আমি এইপ্রসঙ্গে বাইরের কারো সাথে আলোচনা খুব অপছন্দ করি। বিরক্তিভরে বাইরের দিকে  তাকাতে-তাকাতে শঙ্করকে বলি, 
“দেখ ভাই, ওসব অনেক পৌরাণিক যুগের কথা। আমি একজন সাধারণ মানুষ। সেইটাই এখন আমার পরিচয়। ডি. এফ. ও. সাহেব আর কী বলেছেন আমাকে নিয়ে?”

শঙ্কর বলে, “উনি যখন আপনার গ্রামের ও'দিকে ছিলেন, তখন জঙ্গলের মধ্যে পরিখা ঘেরা আপনাদের পূর্বপুরুষের রাজপ্রাসাদ আর দেবী দুর্গার মন্দির দেখেছেন। শুনেছেন সেই সাথে আরও অনেক কথা।”

শঙ্কর বলে, “ পুরোটাই বলব আপনাকে স্যার। আমি শুনেছি সেই জঙ্গলের দুর্গামন্দিরে নাকি একবার...”

আমি ওর মুখের কথা কেড়ে বলি,
“ভোগের রান্নার সব কাঁচা উপকরণ মন্দিরের ভাঁড়ার  ঘরে রাখা ছিল। রাত্রে প্রবল বৃষ্টিতে সেই মন্দিরে যাওয়া যাচ্ছিল না। সকালে বৃষ্টি থামলে লোকে গিয়ে দেখে দেবীর ভোগের রান্না সব তৈরি হয়ে গেছে।"

শঙ্কর বলে, “এই সব নাকি অনেক বছর আগে প্রয়াত এক হরুঠাকুর দেবীর ভোগ রান্না করতো, সে বানিয়েছে!”

আমি বলি, “এই ছাড়াও আমি শুনেছি, কতগুলো বিশেষ তিথিতে জঙ্গল মহালের এই দুর্গাদালানে, কারো যাওয়া নিষেধ। সেই সব রাতে সন্ধ্যারতি করতে যায় একদল লোক।  তারা নাটমন্দিরে সব ঝাড়বাতিগুলো জ্বেলে আসে। গভীর রাতে সেই আমলের প্রয়াত দেবদাসীরা নাচ করে। তবে সেই নাচ কেউ দেখবার চেষ্টা করলে তার সেখানেই মৃত্যু অবধারিত।”

ওই অন্ধকারেও মনে হল শঙ্কর আমার কথাগুলো শুনছে নয়, গিলছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 
“আপনারা এইসব অশরীরীদের মুক্তির কোনও ব্যবস্থা করেন না?”

আমি বলি, “শান্তি-স্বস্ত্যয়নে বা যাগ-যজ্ঞে তেমন কিছু ফল হয়নি। তবে ভোগ রান্না আর হয়নি। যাক, এসব পুরানো কাসুন্দি।” 
শঙ্কর বললে, “ স্যার, আপনাদের ওখানে একবার যাবো”।

বুঝলাম আমার দেশের জঙ্গলমহালের  দুর্গাদালানের  অশরীরী হরুঠাকুর আর দেবদাসীদের ও নিজের রিসর্টে নিয়ে আসবে। হরু ঠাকুরের ভোগ আর দেবদাসীদের নাচ, এই দুইয়ে বিগ্রহ আর হোটেলের কৃষ্ণভক্ত গেস্ট সবাই সন্তুষ্ট থাকবেন। ভূতেরা বেগার খাটবে আর ওর রিসর্টের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে । ভূতদের দিয়ে এইরকম কাজে লাগিয়ে নেওয়ার কাহিনী আমি আগে শুনি নি।

বিরিয়ানির সুগন্ধ টের পাচ্ছি এখানে বসেই। হ্যারিকেনের আলো এগিয়ে আসছে দেখে বুঝলাম মাস্টার সাহেব আর বুধুয়া আসছে রাতের খাবার খেতে। 

আজ সন্ধেয় চা, কফি কে বা কারা দিয়ে গেল আর  বিরিয়ানি রান্না ওর ব্যাগের মধ্যে রাখা কোন্ পুতুলের কীর্তি কে জানে? খাওয়া চুকলে একবার শঙ্করকে জিজ্ঞেস করতে হবে, এখনও পর্যন্ত শঙ্কর কতগুলো এইরকম বেগার খাটা ভূত ধরেছে? 


(সমাপ্ত )

অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস










           

4 comments:

  1. চেটেপুটে খেলাম, ফিসফ্রাই এর স্বাদ জিহ্বে লেগে আছে। বিরিয়ানীও অসাধারণ। রিসর্টটায় যাবো একবার। পেট পুরো ভরে নি যে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. dhnyobad. Kharagpur Station er 2 and 1/2 platform theke Steam engine tana train chare Nisithpur e jabar jonyo. Nisithpur e apnar jonyo resort er Pokhiraj ghora gari apnay uriye niye asbe ei resort e.

      Delete
  2. বেশ অন্যরকম আর ভালো।

    ReplyDelete