পিকচার পোস্টকার্ড



ক্রমশঃ কিশলয় 
কচিকাঁচাদের মনের সবুজ সাথী
পঞ্চম সংখ্যা
জুন, ২০১৯

কেমন আছ সবাই? স্কুলে স্কুলে গরমের ছুটি ফুরোতে চলল তো? আমার ছানার দু' মাসের ছুটি কবেই ফুড়ুৎ - ব্যাগ কাঁধে তার স্কুল যাতায়াত চালু হয়ে গেছে আবার। দীর্ঘদিনের ছুটিতে বাড়িতে সময় কাটানোও বেচারার কাছে দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

স্বাভাবিক ভাবেই নিজের ছেলেবেলা মনে পড়ে যায়। আমাদের ছুটি কাটত কেমন করে? নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা - তখন তো ফোন-ট্যাবলেট দূরস্থান, টিভিও ছিল না বেশির ভাগ বাড়িতে। থাকলেও তাতে গাদাগুচ্ছের কার্টুন সহজলভ্য ছিল না।দুপুরে 'ছুটি ছুটি’ হত, কিন্তু সে তো দৈনিক এক না দেড় ঘন্টা। টিভি দেখে ছুটি কাটানো যায়, সে সম্ভাবনা মাথাতেই আসেনি কখনো।

পুজোর ছুটির ব্যাপার আলাদা ছিল কিন্তু। পুজোর জামা আর ঠাকুর গুনে, বার্ষিক বরাদ্দ এগ রোলের আর বিলাসিতার নীল গ্যাস বেলুনের সুখস্বপ্নে অর্ধেক কেটে যেত। তারপর লক্ষ্মী পুজো কালী পুজো। তখন দিওয়ালি  কেউ বলত না। 'শুভ দীপাবলী’ উইশ করার চলও ছিল না বোধ হয়। মামার বাড়ি থাকলে লক্ষ্মীপুজোর আলাদারকম হুল্লোড় হত। ময়দা দিয়ে আঠা বানিয়ে চিনে কাগজের শিকলি তৈরি করা, কলার ভেলা বানানো। উচ্চশিক্ষিত আত্মীয়স্বজন মুখ বাঁকিয়ে বলতেন, "শিকলি আবার কী কথা! শিকল বলতে পারিস না!” আমি আজও পারি না। সেই শিকলির সঙ্গে রং মেলানো কটকটে গোলাপী, ফটফটে সাদা, ক্যাটক্যাটে হলুদ চিনির মঠ আসত, কদমা আসত। দেখতে দিব্যি লাগত, খেতে ভাল্লাগত না একেবারেই। গুচ্ছের নাড়ু হত, আর ছাঁচে গড়া নারকেলের সন্দেশ। তারপর তো রংমশাল-চরকি-ফুলঝুরির দিন। বাজিতে ভয় পেতাম চিরকালই, তাই মন খুলে আনন্দ করতে পারতাম না ভাইবোনদের সাথে পাল্লা দিয়ে। তারপর ভাইফোঁটা। কত কিছু।

গরমের ছুটিতে এই এত কিছুর কিছুই থাকত না আবার। রুখাশুখা ছুটি। পূজাবার্ষিকী বইপত্তরের মত গ্রীষ্মবার্ষিকী বেরোলে তাও বুঝি সময় কাটত কিছু। হলিডে হোমটাস্কের সমুদ্দুর অতিক্রম করে নিলে অগতির গতি মামাবাড়ির দিকে পাড়ি জমাতাম আবার৷ মামাতো পিসতুতো ভাইবোন মিলে পাঁচজন ছিলাম, সঙ্গীসাথীর অভাব ছিল না। বাবা পৌঁছে দিয়ে এক রাত কাটিয়ে চলে আসতেন, আসার সময় হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসতেন। বলতেন, “ ভাইবোনেরা মিলে কিছু কিনে খেও।” তবে এই ‘কিছু’র মধ্যে যথেষ্ট গন্ডগোল ছিল। গরমের দিনে আইসক্রিম আর প্লাস্টিকের পাইপে জমানো রঙিন জলের ‘পেপসি'র আকর্ষণই তো সব থেকে বেশি ছিল। ঠিক বানানের ‘কোয়ালিটি’ আইসক্রিম খাওয়া বারণ ছিল। ভুল বানানেরটা বাদে সবই নাকি নর্দমার জল দিয়ে বানানো হত। পয়সা বেশি থাকাকালীন ভাল জিনিসই খেতাম, তারপর আস্তে আস্তে কমদামী জিনিসের দিকে যেতে হত। মনে পড়ে একবার বাবা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার নিরিখে পঞ্চাশ টাকা অনেক অনেক টাকা। তার সবটাই আমরা আইসক্রিম খেয়ে উড়িয়ে ফেলেছিলাম। তারপর দিদার কাছ থেকে কেঁদেকেটে আরো নিতে হয়েছিল।

মামাবাড়ির বাগানে আমগাছ ছিল না। কাঁঠালের আবার কমতি ছিল না। মন ভরে খাওয়া হত। এখন আর ভাল লাগে না। সকালে ধোঁয়া ওঠা পাতলা ডাল দিয়ে ভাত আর কুলের আচার। বছরভর বয়ামে কুল, আমড়া, আমের আচার বানানো থাকত। শৌখিন জিনিসের তালামারা আলমারিতে ডালডার কৌটোর মধ্যে করে তিন চার রকম চানাচুর। দিদার আঁচলে বাঁধা চাবির থেলো থেকে বেছে বেছে চাবি নিয়ে খুলে দিতেন। চেয়ে চেয়ে তিন চার বার খাওয়ার পরে মা দিদাকে বলতেন, “ও মা কত দিচ্ছ? পেট খারাপ করবে তো!” দিদা মা কে উলটো বকা দিতেন, “যাও তো! তুমি খেতে না নাকি ছোটবেলায়?” মায়ের বকা খাওয়াতে কী যে আনন্দ পেতাম!

নারকেলগাছ ছিল অনেক। ডাবের শাঁস, সকালে কখনো নারকেল কোরা, চিনি দিয়ে মুড়ি। বিকেলে আম দুধ দিয়ে মুড়ি মাখা। দিদা ফ্রিজের জিনিস খেতেন না। ফ্রিজ কিনেও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, ব্যবহার হত না বলে। কিন্তু ঠান্ডা জলের অভাবে কষ্ট পেতাম বলে মনে পড়ে না। ডিপ টিউবওয়েলের জলের যেমন মিষ্টি স্বাদ ছিল, তেমন ছিল ঠান্ডা। বাতাবি লেবু মাখা হত। কালোজিরে কাঁচা লঙ্কা কুচি নুন চিনি, আহা সে কী স্বাদ!

আমি বই পড়তে ভালবাসি চিরকালই। আমি গেলেই বড়মামার বাড়ি থেকে দাদা বইয়ের ডাঁই দিয়ে যেত গুড্ডি পড়বে বলে। দাদা বোনেরা যে দুয়েক দিন আসত না তার মধ্যে গোগ্রাসে গিলতাম সে সব। শেষ হয়ে গেলে পুরনো জিনিসের স্তূপ ঘেঁটে বের করতাম হলদে পাতার বই সব। পুরনো পূজাবার্ষিকী, বিদেশী গল্পের অনুবাদ, দস্যু মোহন। অ্যাডভেঞ্চার গল্প, যাতে পেড্রো আর গঞ্জালেস নামের বিচ্ছিরি সব লোকজন থাকত। একবার আর কিছু হাতে না পেয়ে পড়ে ফেলেছিলাম ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’।

ভাইবোনরা থাকলে লেখাপড়া টড়া হত না। খালি পায়ে বাগান, মুরগীর ঘর দাপিয়ে বেড়াতাম যতক্ষণ পারা যেত। দাদু ঘরের জানালা থেকে নিষ্ফল হাঁক পাড়তেন, “দিদা, স্যান্ডেল পায়ে দাও!” মেরেধরে স্নান করাতে নিয়ে যেতে হত। দুপুরটুকু ঘরে থাকতাম বোধ হয়। কী করতাম মনে পড়ে না। দুপুরে ঘুমের অভ্যেস ছিল না। তবে দুপুরবেলার বাগানটাকে অচেনা লাগত। নিঝুম নিঃশব্দ, ভূতুড়ে কেমন। মা ছড়া কেটে বলতেন, “ঠিক দুক্কুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।” ভূতের ভয়ে ভেতরেই থাকতাম নিশ্চয়ই।

রাতে আবার ভূত না হলে চলত না। বড় তিন ভাইবোন দিদার বড় খাটে শুয়ে ভূতের গল্পের আবদার করতাম। বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেলে দিদার ভূতদের তিন চারটে করে মাথা, দশ বারোটা করে হাত, পনেরো কুড়িটা করে পা গজিয়ে যেত। তখন আর শুনতে ভাল লাগত না।

মামাবাড়িতে কুকুর বেড়াল প্রচুর ছিল। কালো হলে কালু, লাল হলে লালু, অন্য যে কোনো রঙের কুকুর ভুলু হয়ে যেত। বেড়াল ছিল বুড়ি, সে আর কোনো বেড়ালকে বাড়িতে থাকতে দিত না। সে আর তার ছানাপোনারা মিলে রাজত্ব করত। মোটের ওপর মাতৃতান্ত্রিক ব্যাপার ছিল - হুলোগুলো কেমন মিনমিনে ছিল, বুড়ির ব্যক্তিত্বের কাছে সুবিধে করতে পারত না। বেড়ালছানা হলে কয়েকদিন দারুণ মজা হত। একবার সেজমামা এক কুকুরের ছানাকে নিয়ে এসেছিলেন, তার ল্যাজখানা টিকটিকির ল্যাজের মত সোজা ছিল। সে সবাইকে অকারণে দাঁত খিঁচুনি দিত, আর খবরের কাগজ থেকে বিছানার চাদর অবধি সব খেত। তার ভয়ে দিন কয়েক চটি কোলে উঁচু খাটে বসে কাটিয়েছিলাম। শেষটায় অতিষ্ঠ হয়ে তাকে মাঠে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে সে বহুদিন বহাল তবিয়তে থেকে পথচারীদের তাড়া করে বেড়াত।

মায়ের কাছে টাইগার বলে এক কুকুরের গল্প শুনেছিলাম। বাগানে গরু ঢুকেছিল, কুকুর সমেত মা মামারা ছিলেন ছাদে। “টাইগার ছুঃ” বলায় টাইগার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল। মনিবের কথা শুনতে হবে সেটাই মনে ছিল, ছাদ থেকে পড়লে পা ভাঙবে সেটা খেয়াল থাকেনি।

শেষদিকের কালবৈশাখী ঝড় মনে পড়ে। লোডশেডিং হয়ে যেত। অন্ধকারে ঝুপঝাপ নারকেল পড়ত গাছ থেকে। মামারা অস্থির হতেন, সকাল হতেই তুলে না নিতে পারলে পাড়ার ছেলেরা নিয়ে যাবে। বাজ পড়লে শাঁখ বাজানো হত।

আমার ছোটবেলার ছুটি বোধহয় মামাবাড়ির সমার্থক ছিল। এখনো রেললাইন দেখলেই, উঁচু পাঁচিলের পাশে নারকেল গাছ দেখলেই মনে হয়, মামাবাড়ি। কুবো পাখির লাল চোখ দেখিনি কতদিন। লোহার গেটে দোল খেতাম, তার মাথার ওপর মাধবীলতা জড়িয়ে থাকত। আর নেই। কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝের বারান্দা নেই। সেই ডিপ টিউবওয়েল নেই। বাঁধানো কলপাড়ে খোদাই করে কে লিখে রেখেছিল বাড়ির কর্তা গিন্নি পাঁচ ছেলেমেয়ের নাম। নেই।

এখন ছুটির রকমসকম পালটে গেছে। ছেলের বন্ধুদের অনেককেই সামার ক্যাম্পে ভর্তি করা হচ্ছে। সময় কাটে না যে। আমার ছুটি কেটে যেত বড্ড তাড়াতাড়ি। ফেরার দিন মাকে বার বার বলতাম, “বাবাকে বোলো না দুষ্টুমি করেছি। আর করব না, পরের বার আর করব না।” পরের বারের অপেক্ষাটুকু অনন্ত মনে হত।

ছুটি আমার কাছে নস্টালজিয়া। তোমাদের মা বাবাদের, দাদু-ঠাম্মা-দিম্মাদের জিজ্ঞেস কোরো তো, তাঁদের ও কি তাই? ছুটি স্পেশাল কিশলয় পড়তে ভুলো না যেন। তোমাদের ছুটির গল্প জানিও আমাদের।

প্রচ্ছদ : সুকান্ত মণ্ডল
কলমে : দেবলীনা দাস 

গল্পের ঝুলি : রিম্পির ছুটি : অনন্যা দাশ



রিম্পি আর রনি গরমের ছুটিতে মা-বাবা, দাদু-দিদার সঙ্গে সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে এসে ভারি খুশি। ওরা যে হোটেলটায় রয়েছে সেটা লোকালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এদিকটায় ভিড়ভাড় দোকানপাট একেবারে নেই, শুধু কয়েকটা খড়ের চাল দেওয়া ছোট চায়ের দোকানটোকান ছাড়া। জোয়ারের সময় সমুদ্রটা এগিয়ে একেবারে হোটেলের গেট পর্যন্ত চলে আসে আর ভাটার সময় নেমে গিয়ে অনেকটা বালির এলাকা বেরিয়ে পড়ে। বালিগুলো ভেজা বলে হাঁটতেও খুব সুবিধা হয়, অন্য জায়গার মতন জুতো চটিতে ঢুকে যায় না। এছাড়া বালিতে কত ছোট ছোট লাল কাঁকড়া। তাদের কাছে যেতে গেলেই অবশ্য তারা তরতর করে পালিয়ে যে যার গর্তে ঢুকে পড়ে, আর তাদের টিকিও দেখা যায় না। আগের দিনই ওরা এসে পৌঁছেছে কিন্তু এরমধ্যেই বিকেলে ওদের সূর্যাস্ত দেখা হয়ে গেছে। কী সুন্দর রঙ! ওরা দুজনেই জলে নামবে বলে লাফাচ্ছিল কিন্তু মা বললেন, “না, আজকে না, এখুনি অন্ধকার হয়ে যাবে। কাল সকালে জলে নেমো।”

খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল ওরা দু’জন। দাদু ছাড়া আর কেউ তখন ওঠেনি। দাদু ওদের চুপি চুপি বললেন, “চলো সবাই ওঠার আগেই আমরা চট করে একবার সমুদ্রটাকে দেখে আসি। পরে সবাই উঠলে ব্রেকফাস্টের পর আবার গিয়ে স্নান করা যাবে।”

রিম্পি আর রনি তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আর সমুদ্র দেখতে যাওয়া তো কঠিন কিছু না, হোটেলের গেট থেকে বেরলেই সমুদ্র। গেট থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটতেই একটা ছোট চায়ের দোকান।

দোকানের লোকটা দাদুকে বলল, “চা খাবেন নাকি বাবু?”

দাদু তখন রিম্পি আর রনিকে বললেন, “আমার তো খুব চা তেষ্টা পেয়েছে তাই আমি একটু চা খেয়ে নিই। তোমরা এখানেই খেলো, দূরে যেও না। চা খাওয়া হয়ে গেলে আবার একটু হাঁটতে যাব না হয়।”

দাদু দোকানের সামনে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লেন। রিম্পি আর রনি ছুটে গেল সমুদ্রের ঢেউ ছুঁতে। রিম্পি বলল, “আমি কয়েকটা ঝিনুক কুড়োবো। ফিরে গিয়ে সবাইকে একটা একটা করে দেবো নাম লিখে লিখে, তাহলে সবাই খুব খুশি হবে।” বলে সে ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রনিও ছুটে ছুটে ওর সাহায্য করতে লাগল। তবে রিম্পির কত রকম নিয়ম! ভাঙ্গা হলে চলবে না, গোটা হতে হবে, দেখতে সুন্দর হতে হবে! রনি একটু বিরক্তই হচ্ছিল অত বাছাবাছিতে। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল বোতলটা। একটু বড়ো সাইজের বোতল কিন্তু মুখটা সরু। বোতলটার ভিতরে আবার কী যেন একটা রয়েছে! জলের সঙ্গে ভেসে এসেছে মনে হয়। একটু কাছে থেকে দেখতে গিয়ে ঢেউ এসে পা ভিজয়ে দিল রনির কিন্তু ততক্ষণে সে বোতলটাকে তুলে ফেলেছে। বোতলটার ভিতরে বন্দি হয়ে রয়েছে একটা সুন্দর মাছ। কী সুন্দর রঙ মাছটার গায়ে কিন্তু খাবি খাচ্ছে মাছটা।


“দিদি দেখ!” বলে চেঁচিয়ে উঠল রনি। রিম্পি ওর কথা শুনে গিয়ে দেখল। ওমা সত্যিই তো!


“আহারে ওই সরু মুখ দিয়ে ঢুকে গেছে ভিতরে কিন্তু আর বেরতে পারছে না। বোতলে বেশি জলও নেই সব বেরিয়ে গেছে!”


ওরা দুজনে চট করে বোতলটাকে সমুদ্রর জল দিয়ে ভরে ফেলল তারপর সাগরের জনের মধ্যে গিয়ে ধরতেই মাছটা বেরোবার জন্যে ছটফট করতে লাগল কিন্তু সরু মুখ দিয়ে বেরতেই পারছিল না। শেষে রিম্পি একবার খপ করে লেজটা ধরে এক টান দিতেই অমনি সুড়ুৎ করে পুরো মাছটা বোতল থেকে বেরিয়ে গেল। সমুদ্রের জলে পড়েই সাঁতরে চলে গেল মাছটা। তাই না দেখে দুজনের সে কী আনন্দ!

রনি বলল, “বাবার ক্যামেরাটা সঙ্গে থাকলে দারুণ ছবি হত। সবাইকে দেখাতে পারতাম।”

রিম্পি মাথা নাড়ল, “না, ক্যামেরা আনতে গেলে খুব দেরি হয়ে যেত, ততক্ষণে হয়তো মাছটা মরেই যেত! যাই হোক বোতলটা সঙ্গে করে নিয়ে চল, ওটা ওই চায়ের দোকানের ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে। সমুদ্রের জলে ভেসে গেলে আবার কোন বেচারা মাছ আটকে যাবে ওটাতে।”

দাদুর চা খাওয়া হয়ে গেছে। দাদুকে মাছের কথাটা বলল ওরা। দাদু তো শুনে খুব খুশি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে ওরা দেখল একটা লোক আর তার বউ মিলে বালিতে চৌকো একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে সমুদ্র থেকে জল এনে ভরেছে। সেই জলে কিলবিল করছে অসংখ্য ছোট বড়ো মাছ। ওরা দুজনে জলে কী সব খুঁজছে।

ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। দাদু ওদের জিজ্ঞেস করলেন, “কী করছ গো তোমরা?”

লোকটা বলল, “বাবু আমরা গরিব মানুষ। সমুদ্র থেকে জল এনে তার মধ্যে চিংড়ির চারা খুঁজি। তারপর যারা মাছ চাষ করে তাদের বিক্রি করে কিছু পয়সা পাই।”

দাদু বললেন, “পেয়েছ নাকি চিংড়ির চারা?”

লোকটা পাশে রাখা একটা হাঁড়ির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। সেটার মধ্যে একদম সরু পিনপিনে কী সব সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখা গেল। রনি তো হেসেই খুন, বলে, “এগুলো বুঝি চিংড়ি!”

রিম্পির মাথায়ে অন্য চিন্তা, সে বলল, “আর বাকি মাছগুলো? ওদের ওই বালির মধ্যে ছোট চৌবাচ্চায় বেশ কয়েকটা সুন্দর মাছ রয়েছে ওরা দেখতে পাচ্ছিল তার মধ্যে একটা মাছ বেশ কিছুটা বড়ো, খুব সুন্দর দেখতে, গা'টা অর্ধেকটা রূপালি আর অর্ধেকটা হলুদ। এ ছাড়াও অনেক মাছ।

“ওগুলো তো আর কেউ খায় না। ওগুলো এখানেই থেকে মরে যাবে।”

“মানে? ওরা এখানেই মরে যাবে? দাদু প্লিজ ওদের বাঁচাতে হবে! তুমি কিছু একটা করো!” রিম্পি আর রনি পীড়াপীড়ি শুরু করে দিল।

দাদু লোকটাকে মাছগুলোর জন্যে কিছু টাকা দিতে ওরা রাজি হল। ওদের কাছ থেকেই একটা খালি পাত্র নিয়ে তাতে জলের মাছগুলোকে তুলে আবার সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এল ওরা।

দেরি হয়ে যাচ্ছে, জলখাবারের সময় হয়ে গেল দেখে ওরা তিনজন হোটেলে ফিরে গেল। এর পর সারাদিন হই হই করে সমুদ্রে স্নান করে, খেয়ে দেয়ে মজা করেই কাটল।

ঘুমিয়ে পড়েছিল রিম্পি, হঠাৎ মাঝরাতে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ও আর রনি একটা খাটে শুয়েছিল। পাশের আরেকটা খাটে দাদু দিদা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। রিম্পি দেখল ওদের খাটের পাশে একটা ওর বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভীষণ চমকে ভয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিল সে তখনই মেয়েটা বলে উঠল, “ভয় পেও না, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে আসিনি। তোমরা আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছো আজকে, আমার আর আমার ভাইয়ের, আমি কী তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারি?”

রিম্পি তো অবাক, বলল, “প্রাণ বাঁচিয়েছি? কোথায়? কখন?”

“ওই যে সকালে আমি বোতলে আটকে গিয়েছিলাম তখন, আবার কখন! আর আমার ভাই ওই চিংড়িচারা খোঁজা লোকেদের খপ্পরে পড়ে মরতে বসেছিল, তাকেও বাঁচিয়েছ তোমরা!”

রিম্পির মুখ হাঁ হয়ে গেল। মেয়েটা বলে কী! সে নাকি মাছ!

মেয়েটা এবার বলল, “চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে যাই। এসো আমার সঙ্গে!”

“রনিকে ডাকব?”

“না থাক! ও ছোট, ঘুম থেকে তুললে যদি কান্নাকাটি জুড়ে দেয় তাহলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে! তুমি চলো আমার সঙ্গে। সকাল হওয়ার আগেই আমরা ফিরে আসব।”

রিম্পি আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটার সঙ্গে ওর পিছন পিছন চলল। সমুদ্রের ধারে এসে মেয়েটা ‘এই নাও’ বলে ওর নাকে কী একটা এঁটে দিয়ে বলল, “এটা দিয়ে তুমি জলের মধ্যে নিশ্বাস নিতে পারবে!”

রিম্পি বলল, “কিন্তু আমি জলে নামব কীভাবে? আমি তো সাঁতার জানি না! মানে সবে ভাসতে শিখেছি এখন!”

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে বলল, “কিছু হবে না। চলো না আমার সঙ্গে!” বলে রিম্পির হাত ধরে একেবারে জলের মধ্যে নিয়ে গেল ওকে।

ওমা রিম্পি অবাক হয়ে দেখল সে দিব্যি সাঁ সাঁ করে জলের মধ্যে দিয়ে চলেছে মেয়েটার হাত ধরে, কোন অসুবিধা হচ্ছে না ওর! জলের নীচের জগৎটা কী সুন্দর! ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন মাছ আর রঙিন গাছ গাছালি সব। সব কিছু অদ্ভুত একটা মায়াবী আলোতে ঝলমল করছে যেন। মেয়েটার দিকে তাকাতে আরো চমকে উঠতে হল রিম্পিকে। মেয়েটার শরীরের অর্ধেকটা মাছ হয়ে গেছে! ও তার মানে মৎস্যকন্যা!

বেশ জোরেই যাচ্ছিল ওরা। হঠাৎ একটা কিম্ভুত দেখতে মাছ মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে ওর কাছে এসে বলল, “দেখ না আমার গলায় কী ব্যথা, কিছুই খেতে পারছি না! কী যে হয়েছে!”

মেয়েটা বলল, “দেখি মুখটা হাঁ করো তো।”

মাছটা মুখটা হাঁ করতে রিম্পি দেখল ওর মুখে সাদা মতন কী একটা আটকে রয়েছে।

মেয়েটা এবার হাত ঢুলিয়ে সেটা বার করে দিল। রিম্পি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল সেটা একটা বোতলের ছিপি!

মেয়েটার হাত থেকে সেটা নিয়ে রিম্পি বলল, “ওটা আমাকে দাও, আমি পকেটে রেখে দিদি। হোটেলে ফিরে গিয়ে ঠিক জায়গায়ে ফেলে দেব। এখানে থাকলে আবার অন্য কারো গলায় আটকে যাবে!”

মেয়েটা দুঃখী মুখে বলল, “সেটাই দেখাতে এনেছি তোমাকে! তোমরা যে সব নোংরা আবর্জনাগুলো ফেলো সেগুলো আমরা তো আর বুঝতে পারি না। আমরা বোকার মতন সেগুলো খেতে যাই আর সেগুলো আমাদের গলায় মুখে আটকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয় আমাদের!”

রিম্পির খুব খারাপ লাগল কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারল না সে। সত্যি তো লোকে কত কিছু ফেলে সমুদ্রে বা সমুদ্রের সৈকতে।

কিছু দূর গিয়ে বেশ কয়েকটা মাছ নেতিয়ে পড়েছিল। তাদের গায়ে কালচে ছোপ।

“ওদের আবার কী হয়েছে?”

“কী আবার হবে? তোমাদের ওখানকার কোন এক জাহাজের থেকে তেল বেরিয়েছে। সেই তেল ওদের গায়ে লেগে ওদের প্রাণ যাওয়ার জোগাড়! এত চিটচিটে আর ভারী যে বেচারারা ঠিক মতন সাঁতারও কাটতে পারছে না। আমরা রোজ ঘষে ঘষে একটু একটু করে তোলার চেষ্টা করি, কিন্তু অনেক সময় লেগে যায়। যাই হোক তোমাকে যা দেখাতে আনলাম সেটা দেখো!”

রিম্পি তাকিয়ে দেখল। ওমা প্লাস্টিকের বোতল আর প্লাস্টিকের জিনিসের একটা পাহাড়! চারিদিক থেকে মাছেরা ওই সব নিয়ে এসে এসে ওখানে জড়ো করছে।

“যারা একটু চালাক তারা বুঝতে পারে ওগুলো খাবার জিনিস নয় তাই তুলে নিয়ে এসে এখানে ফেলে। তুমি তোমার চেনা লোকজনদের একটু বলবে সমুদ্রের জলে আর তীরে ওই সব না ফেলতে? আমরা শুধুশুধু মরে যাচ্ছি!”

“আরো দেখো!”

রিম্পি দেখল এক জায়গায় রাশি রাশি লাল কাঁকড়াদের মৃতদেহ।

“ওমা এদের আবার কী হয়েছিল?” রিম্পি জিজ্ঞেস করল।

“কী আবার হবে! সমুদ্রসৈকতের ওপর দিয়ে হুশ হাশ করে গাড়ি চালিয়ে ওদের পিষে মেরে ফেলেছে লোকেরা! ওরা তো সব বালিতেই থাকে তাই চাপে মরে যায়!”

আরও অনেক কিছু দেখাল মেয়েটা রিম্পিকে। জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কত অসংখ্য মাছ আহত, তাদের কারো ডানা কেটে গেছে, কারো গায়ে চোট। খুব কষ্ট হচ্ছিল রিম্পির ওদের দেখে।

তারপর এক সময় মেয়েটা বলল, “চল এবার তোমাকে জলের ওপরে দিয়ে আসি। একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে।”

মেয়েটার পিছন পিছন রিম্পি হোটেলের ঘরে গিয়ে পৌঁছল।

এর পর যখন ওর ঘুম ভাঙ্গল তখন অনেক বাজে। মা ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার জন্যে ডাকছেন।

রাতের ঘটনাটা কাউকে বলেনি রিম্পি, এমনকি মা-বাবা বা রনিকেও না। সে জানে কেউ বিশ্বাস করবে না। স্বপ্ন দেখছিল বলে হাসবে। কিন্তু রিম্পি জানে সে যা দেখেছিল সব সত্যি কারণ মাছের মুখে আটকে যাওয়া বোতলের ছিপিটা ওর পকেটেই ছিল। ওরা হোটেলে যে সব বোতল থেকে জল খাচ্ছে সেগুলোর ছিপিগুলো নীল বা সবুজ আর এই ছিপিটা সাদা তাই ভুল করে জল খেয়ে সেই ছিপি পকেটে ঢুকিয়েছে তাও নয়, তবে বাকি যে ক'দিন ওরা সমুদ্রের ধারে ছিল সবাইকে বলে বলে প্লাস্টিক বোতল আর আবর্জনা পরিষ্কার করিয়েছে সে। হোটেলের লোকজনকেও বলেছে অনেক বার করে। হোটেলের ম্যানেজার কথা দিয়েছেন যে তিনি খেয়াল রাখবেন।

স্কুল শুরু হতে স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে ওর ছুটির ওই ক'দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা লেখা দিয়েছে রিম্পি। লেখাটা খুব ভাল লেগেছে সবার। সবাই মনে করেছে রিম্পি তার অদ্ভুত কল্পনাশক্তি দিয়ে লেখাটা লিখেছে কিন্তু সত্যিটা কী সেটা শুধু রিম্পি জানে, আর জানে সেই মৎস্যকন্যা!


(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : আবির


গল্পের ঝুলি : বরেনবাবুর হাঁচি : দিব্যেন্দু গড়াই



অসময়ে ঘুম ভাঙলে কারই বা ভালো লাগে? বরেন গোস্বামীর শুধু ঘুম ভেঙেছে তাই নয়, ঘুম ভাঙা থেকে এখনও অব্দি সাড়ে ষোলোটা হাঁচি গুনেছেন। ষোলো নাম্বারের পরের হাঁচিটা শুরু হয়েছিল, শেষ হয়নি। তাই সাড়ে ষোলো। ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে দশ। অসময়ে এলার্ম কেন বাজল? গত পাঁচ বছর ধরে যার একটিও হাঁচি হয়নি, তার হঠাৎ এই রাতদুপুরে হাঁচি হবে কেন? অনেক ভেবেও কোনও কারণ খুঁজে পেলেন না। ঘরে নাকে দেবার কোনও ড্রপট্রপ আছে কিনা তা খোঁজার তোড়জোড় করতে করতে আরও আটটা হাঁচি হল। এবারে ঘাবড়ে গেলেন বরেনবাবু। হচ্ছেটা কী? প্রতিবছর নিয়ম করে এককাঁড়ি টাকা খরচ করে ফ্লু-এর টীকা নেওয়াটা কি তাহলে বৃথা? বাপিডাক্তারকে কালকেই পাকড়াও করতে হবে। বলে কিনা, ‘ষাট তো পার করে দিয়েছেন, এবার থেকে প্রতিবছর ফ্লু-ভ্যাকসিন না নিলে কপালে দুঃখ আছে। ছোটোখাটো সর্দি-কাশি-হাঁচি থেকে শুরু হবে, তাপ্পর জ্বর হয়ে সোজা নিউমোনিয়া। তা সেই ভয়েই প্রতিবছর টীকা নেন বরেনবাবু। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নেন। গতকালই নিয়েছেন একটা। আর সত্যি বলতে কি, তারপর থেকে এক-দু বার জ্বর হলেও হাঁচি-কাশি-সর্দি নৈব নৈব চ। গত পাঁচবছরে একদিনও হয়নি। অম্বল, বুকজ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর, লোমফোঁড়া, পেট খারাপের মত মামুলি অসুখ হয়েছে, কিন্তু হাঁচি-কাশি নয়। হাঁচি হলে নাকের ভেতরটা একটু সড়সড় করে, ভেজা-ভেজা মনে হয়, কিন্তু সেরকম লাগছে না। বুক ভরে লম্বা একটা শ্বাস টানলেন,কই অন্যরকম কিছু মনে হল না তো! তাহলে? স্পষ্ট হাঁচির শব্দ শুনেছেন, হাঁচি গুনেছেন অথচ হেঁচেছেন বলে মনে পড়ছে না। তাহলে হাঁচল কে? এইবার যেন একটু ভয়ভয় লাগছে। অঙ্কের মাস্টারমশাই হলে হবে কী, ভূতে বরেনবাবুর বড়ই ভয়। ভূতের ভয়ে জীবনে বিয়ে পর্যন্ত করেননি। পঁচিশ বছর আগে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পাত্রীকে ভূতে ধরেছিল, ওঝা ডেকে ঝাড়ানো হয়েছিল সে মেয়েকে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ওসব কুসংস্কার মেনে নিয়ে বাতিল করে দিয়েছিলেন বিয়েটাই। আর কোনওদিন ছাদনাতলায় দাঁড়াননি। আর এখন ছাদের তলায় নিজের ঘরে বসে হাঁচির উৎস খুঁজছেন। খুঁজে পেলে যে মোটেই ভালো হবে না, সেটা বুঝতে পেরে অন্ধকারে আগাপাশতলা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন বরেনবাবু।


অসময়ে ঘুম ভাঙলে কারই বা ভালো লাগে? তপুর শুধু ঘুম ভেঙেছে তাই নয়, ঘুম ভাঙা থেকে এখনও অব্দি সাড়ে ষোলোটা হাঁচি হয়ে গেছে। ঘড়িতে রাত ৩টে বেজে ১০। এই অসময়ে এলার্ম? নিঝুম রাতে ওর হাঁচি আর কুকুরের ভৌ-ভৌ ছাড়া আর কিচ্ছুটি শোনা যাচ্ছে না। ঢুলতে ঢুলতে হাঁচছে, হাঁচতে হাঁচতে ঢুলছে। ষোলো নম্বর হাঁচির পরেরটা শুরু হয়েছিল কিন্তু শেষ হয়নি, তাই সাড়ে ষোলো। হাঁচির আওয়াজে মা-বাবা জেগে গেছে। ছোট বোনটা অবশ্য ঘুমুচ্ছে। উঠোনের আলো জ্বলে উঠল। মানে, বাড়িসুদ্ধ সবাই উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। বাকি রাতটুকু জেগে কাটাতে হবে বলে দুঃখ নেই তপুর, দুঃখ হল সাঁতার শেখার নামে পুকুরের জলে দাপাদাপির সুযোগ হাতছাড়া হওয়াতে। এদিকে কাল ভুলুদার কাছে সাঁতার শিক্ষার দ্বিতীয় পাঠ। ভুলুদা বলেছে কালকের দিনটা ঠিকঠাক উতরে গেলে তপুর পক্ষে পুকুরটা এপার-ওপার করা কোনও ব্যাপারই না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আরও আটবার হেঁচে ফেলল তপু।


এটা কী হল? রাত তিনটে বেজে দশ মিনিটে হাঁচল তপু। গুণে গুণে সাড়ে চব্বিশখানা। আর ওদিকে বরেন গোস্বামী সেই হাঁচি শুনতে পেল। এটা তো শুধু অদ্ভুতুড়ে নয়, কিম্ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার। অচিন্ত্যপুরে এর আগেও অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটেছে। জনাবাবুর ছাগল মুক্তিপিসির গোয়ালে পাওয়া গেছে। ফুলির ভূগোলের বই হরিদের কুয়োতলায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সেগুলোর পেছনে পকাই চোরের হাতযশ আছে বলে কানাঘুষোয় শোনা যায়। কিন্তু রাতদুপুরে তপুর হাঁচি অঙ্কের স্যর বরেনবাবুর কানে যাওয়াটার পেছনে তো আর পকাইয়ের হাত থাকতে পারে না। তাহলে?


অচিন্ত্যপুরের মত ছোট জায়গায় যেখানে হাওয়ার থেকেও জোরে খবর ছোটে, সেখানে বরেনবাবুর হাঁচির মত মুচমুচে খবর চাউর হতে বেশী সময় লাগার কথা নয়। তাই হাটে-বাজারে, মন্দিরে, পুকুরপাড়ে সর্বত্র একটাই আলোচনা হতে লাগল।


বামাচরণ জ্যোতিষী বলল, "বরেন গোস্বামীর রাহু কেতুর ঘাড়ে চেপে বসে শনিকে ধাক্কা মারছে, তাই এসব হচ্ছে। সাড়ে চোদ্দ রতির পান্না ধারণ করতে হবে। মাদুলি বানিয়ে ঝোলাতে হবে গলায়। তবেই কাটবে বিপদ।"


শ্যামা দারোগা তো নিশ্চিত এ আর কারুর কান্ড নয়, পকাই চোর ছাড়া। সেদিন নিশ্চয় রাতে চুরির মতলবে গিয়েছিলো বরেনবাবুর বাড়ি। হাঁচির শব্দে ওঁর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চুরি না করেই সরে পড়েছে।


স্কুলের ফিজিক্সের ভবানী স্যর তো বলেই দিলেন এর পেছনে পিওর ফিজিক্স আছে। ফোর্থ ডাইমেনশন। দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা এই থ্রি ডাইমেনশন ছাড়া জগতে আরেকটা ডাইমেনশন রয়েছে, সেটা হল সময়। একটু জটিল বিষয় হলেও এই ফোর্থ ডাইমেনশনে এক স্থানের ঘটনা অন্য স্থানে টাইম-ট্রাভেল করতেই পারে। বিষয়টা নিয়ে ভবানীবাবু নিজেও বেশ বিভ্রান্ত। তাই ইচ্ছে থাকলেও সহশিক্ষকদের জলবৎ তরলং করে বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না।


ভূতবিশারদ ষষ্ঠীবরণের মতে এ কাণ্ড  লম্বোদরের ছাড়া আর কারুর হতে পারে না। গত বৈশাখে ট্রেনে কাটা পড়েছিল লম্বোদর। নাকটা পুরো থেঁতলে গিয়েছিল। তাই বেশিরভাগ সময়েই হেঁচে বেড়ায় সে। ভূতসমাজে তার নামই হয়ে গেছে হেঁচোভূত। আর এসব গুপ্তকথা ষষ্ঠীবরণ জানতে পেরেছে ভূতসিদ্ধ যজ্ঞের সাহায্যে। এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় একটাই। মহাভূতবিতাড়ন যজ্ঞ।


ওদিকে বাপি ডাক্তার সব শুনেটুনে বললেন, "দুটো কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এক হল অডিটরি হ্যালুসিনেশন। ভুল শোনা। আর দু নাম্বার হল অ্যালঝেইমার্স। নিজে হেঁচে ভুলে যাওয়া।"


সব থেকে বেশি বিপদে পড়েছে তপু। কারণ অঙ্কের স্যর বরেনবাবুর স্কুলই তপুর স্কুল। সে ঐ স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্যরের ভয়ে ওর হাত-পা পেটের ভেতর সিঁধিয়ে যাচ্ছে। শাস্তিস্বরূপ পাটিগণিতের কঠিন কঠিন অঙ্ক যে ঘাড়ে নাচছে, এ বিষয়ে তপু নিশ্চিত।


তবে না, তপুকে এযাত্রা আর পাটিগণিতের ধাক্কা সইতে হয়নি। হাঁচির ঘটনার পর বরেনবাবু কেমন মিইয়ে গেলেন। নানান মতামতের মধ্যে ষষ্ঠীবরণের ব্যাখ্যাই মনে ধরল ওঁর। ভূত তাড়ানোর জন্য যজ্ঞ করালেন। একা একা না থেকে বাড়িতে ছাত্রদের ডেকে অঙ্ক শেখাতে লাগলেন। না, এর জন্য কোন পারিশ্রমিক নিতেন না উনি। কয়েক দিনের মধ্যে ছেলেপুলেদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠল। রাগী মাস্টার নয়, ছাত্রদের সাথে বন্ধুর মত সহজভাবে মিশে দেখলেন, আরে এ তো দারুণ ব্যাপার। ছেলেরা পটাপট অঙ্ক করে ফেলছে। পরীক্ষাতে আট-নয়ের ঘরে মার্কস। বরেনবাবুর এমন ব্যবহারে ছেলেরাও বেজায় খুশি। অঙ্ক ওদের কাছে এখন আর আতঙ্ক নয়, বরং একদিন সন্ধেবেলা বরেনবাবুর বাড়ি না যেতে পারলে ওরা ছটফট করে, কিচ্ছু ভালো লাগে না। দেখতে দেখতে অচিন্ত্যপুরের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা অঙ্কে এক্সপার্ট হয়ে উঠল। তবে এর পেছনের কারণ যে অঙ্কে ফেল হওয়ার মত ঘটনা ছিল, সেটা কেবল জানত ভোলা, শান্তনু, হর, সজল, তপু আর বাপ্পা।


হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে ক্লাসের সবকটা ছেলে ফেল করেছিল। অন্য সব বিষয়ে সবাই পাশ করলেও অঙ্কে একজনও পাশ করতে পারেনি। এই ব্যাপারটা রাণী ভবানী স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর কারুরই ভালো লাগেনি। সবাই না করলেও ছ’জন মিলে প্ল্যান করল স্যরকে এর উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। ভেবেচিন্তে ঠিক করা হল স্যর নিজের সম্পর্কে যে দুটো জিনিস সব্বাইকে বলে বেড়ায়, সেই ভূতের ভয় আর হাঁচি-প্রতিরোধক ভ্যাকসিনকেই কাজে লাগাতে হবে স্যরকে জব্দ করার জন্য। প্ল্যানমাফিক তপুর হাঁচি রেকর্ড করা হল ফোনে। এলার্ম দিয়ে ঠিক রাত তিনটে বেজে দশ মিনিটে উঠে হাঁচতে শুরু করেছিল তপু, নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে। সবাইকে বলেছিল প্রথমে সাড়ে ষোলো আর পরে আট, মোট সাড়ে চব্বিশটা হাঁচি হেঁচেছে। ওদিকে বরেনবাবুর বাড়িতে চুপিচুপি ঢুকে প্রথমে এলার্ম বাজিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিল ভোলা আর বাপ্পা। তারপর সাড়ে চব্বিশটা হাঁচি বাজানো হয়েছিল ফোন থেকে। আর তাতেই কেল্লাফতে।


(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : দিব্যেন্দু গড়াই

গল্পের ঝুলি : অচেনা সাথী : দেবদত্তা ব‍্যানার্জী




ছোট্ট বাংলোটা একটা টিলার ওপর, ঢালু জমিতে প্রচুর ফুল গাছ, একটা দোলনাও আছে। ঠিক পেছনেই ঝাউ বন। আর একটু দূরেই সবুজ চা বাগান। নীল রঙের টয়ট্রেন চা বাগানের ভেতর দিয়ে কু ঝিক ঝিক করতে করতে চলে যায় মেঘের দেশে। ঢেউখেলানো পাহাড়ের গায়ে মেঘের দল লুকোচুরি খেলে। পিছনে সাদা তুষার শৃঙ্গ অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসে ভেসে আসে তুষারের গন্ধ, নাম না জানা ফুলের দল পাহাড়ের গায়ে গায়ে পসরা সাজিয়ে রাখে কার অপেক্ষায়।


তিতিরের বাবা এখানকার এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে এসেছেন দু'মাস আগে। তিতির ওর মায়ের সাথে কলকাতায় থেকেই পড়াশোনা করে। কারণ বাবা তো আবার বদলি হবেই। কত বার ও স্কুল বদলাবে! দু'দিন হল গরমের ছুটি কাটাতে কার্শিয়াং-এ এসেছে ও মায়ের সাথে। স্কুলে বলে ওর ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছে মা। তাই ওর এখন ভীষণ মজা। এই মেঘ আর চা-বাগানের দেশে সব কিছুই খুব সুন্দর। হঠাৎ বৃষ্টি নামে, মেঘ এসে ভিজিয়ে দেয়, আবার রোদ লুকোচুরি খেলে পাহাড়ের পিছন থেকে। কিন্তু একা একা ঘুরতে কার ভাল লাগে! তাই গল্পের বই হাতেই সময় কাটে তিতিরের। বাবা বিকেলে ফিরে ওদের মার্কেটে নিয়ে যায়।

সেদিন দুপুরে দোলনার ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজটা কানে যেতেই ও উঠে পড়েছিল গল্পের বই ফেলে। ওধারের বড় কাচের জানালাটা দিয়ে দেখে একটা ছোট্ট মেয়ে ওদের বাগানের দোলনাটায় দুলছে একা একা। তিতির পা টিপে টিপে দোলনার সামনে যেতেই মেয়েটা এক লাফে নেমে পড়ে। ও ধরতে যেতেই এক ছুট। ঢালু জমিটা যেখানে গিয়ে পাইন-বনের সাথে মিশেছে ঠিক সেখানে কাঁটাতারের বেড়া গলে পালিয়ে যায় মেয়েটা। তিতির ছুটে গিয়েও ধরতে পারে না আর। আরও দুদিন চেষ্টা করেও ধরতে পারে না মেয়েটাকে ও। রোজ দুপুরেই মেয়েটা আসে ওদের বাগানে।

এর পরদিন দুপুরে তিতির লক্ষ্য রেখেছিল। মেয়েটা আসতেই একটা ঝোপের আড়াল থেকে পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে ও। মেয়েটা কিন্তু ওকে দেখে ভয় পায়নি। ভাঙ্গা বাংলায় ওকে বলে -''তুমি কে গো ? আমি তো রোজ এখানে খেলতে আসি, তোমায় তো আগে দেখিনি?''

-''আমার বাবার বাংলো এটা। আমি কলকাতা থেকে ঘুরতে এসেছি এখানে। এটা আমার দোলনা।'' গম্ভীর গলায় বলে তিতির ।

-''তোমার দোলনা? ঘুরতে এসেছ মানে আমাদের অতিথি তুমি। কিন্তু দোলনাটা তো তোমার নয়। '' কোমরে হাত দিয়ে রুখে দাঁড়ায় মেয়েটা।

ওর সহজ সরল কথায় হেসে ফেলে তিতির। মেয়েটার বয়স পাঁচ ছয় বছর হবে। ফরসা একমাথা কোঁকড়া চুল, ছোট চোখ, চ্যাপটা নাক, নেপালিদের মত বেশ মিষ্টি দেখতে। তিতিরের বয়স এগারো বছর, বেশ একটা বড় বড় ভাব এসেছে ওর মধ্যে। ঐ টুকুন একটা পুঁচকে বাচ্চার মুখে এমন সব কথায় রাগ করতে পারে না তিতির।

হেসে ফেলে বলে -''আসলে বাংলোটা এখন আমাদের, তাই দোলনাটাও আমাদের। তোমায় আসতে বাধা দেবো না যদি তুমি আমার বন্ধু হও।''

-''ঈশ, তোমাদের না ছাতা। কদিন পরেই তো চলে যাবে তোমরা। আমিই থাকব এই বাগান আর দোলনা ঘিরে।''

-''তোমায় তো এখনো আসতে বললাম রোজ। একা একা আমার আর ভালো লাগে না। তুমি আর আমি খেলব রোজ। তুমি আমায় ঘুরিয়ে দেখাবে তোমাদের এই ছোট্ট পাহাড়ি শহর?''

মেয়েটা একটু গম্ভীর হয়ে বলে -'' ঠিক আছে, আগে তোমার নাম বলো?''

-''তৃষাণ, তবে তুমি আমায় তিতির দাদা বলে ডেকো। তোমার নাম কী?''

-''রুমেলা, তুমি যদি আমায় বৈনি বল তবেই দাদা ডাকবো। ''

এরপরের দুপুর গুলো দুই ভাইবোনে দুষ্টুমি আর খুনসুটি করেই কাটাত। কখনো পাইন বনের ভেতর হাঁটা পথ ধরে ওরা পৌঁছে যেত পাহাড়ি ঝর্ণার ধারে। পাহাড়ি ঝর্ণাতে রুমাল দিয়ে মাছ ধরেছে দুজনে। কখনো চা-বাগানের অলিগলিতে হারিয়ে যেত ওরা।চা গাছের ফাঁকে লুকোচুরি খেলত দুজন। তিতির কুকিজ বিস্কুট জমিয়ে রাখত এক সাথে খাবে বলে। বৈনি বলেছিল বাড়িতে কাউকে ওর কথা বলতে না। কারণ ও তো লুকিয়ে আসে। পাইন বনের ফাঁক দিয়ে যে নিচের বস্তিটা দেখা যায়, সেখানে খাদের ধারে সিডার আর রডডেনড্রন গাছ আছে দুটো। তার ফাঁকে গোলাপি বাড়িটায় ও আর ওর মা থাকে। বাবা নেই ওখানে। কোথায় যেন চলে গেছে বাবা। ওর মা বাগানে কাজ করে। দুপুরে থাকে না কখনও। তখন আসে চুপিচুপি।

তিতির যে সারা দুপুর না ঘুমিয়ে দস্যিপনা করে তা তো আর মাকে বলা যায় না। মা সারা দুপুর টিভি সিরিয়াল দেখে। ঐ সময় মা এক অন্য জগতে চলে যায়। তাই তিতির বলেনি কিছুই। এই স্বাধীনতার স্বাদ ও একাই উপভোগ করছিল।

বৈনির সাথে গিয়ে ও দু দিন টয়-ট্রেনেও চেপে এসেছে। টয়-ট্রেন জিগজ‍্যাগ করে পাহাড়ে ওঠে। কিছুটা উঠে আবার পিছিয়ে আসে, আবার ওঠে।সে সময় অনেক বাচ্চা উঠে পড়ে ট্রেনে। আবার নেমে যায় একটু ওপরে। বৈনি ওকে কমলা বাগান ঘুরিয়ে এনেছে একদিন। গাছ গুলোতে সবুজ সবুজ কচি কমলা এসেছিল সবে। টক আর তিতকুটে স্বাদের কমলা চেখেও দেখেছে তিতির।

বৈনি ওকে অনেক গল্প বলত পাহাড়ের, জঙ্গলের। কখনো লটকা বলে একটা টক মিষ্টি ফল আনত ওর জন্য। কখনো আনত তিতোরা, এক ধরনের টক শুকনো আচার, যা নুন দিয়ে শুকানো হয়। তিতির ওকে গল্প পড়ে শোনাতো, কলকাতার গল্প বলত। ও অবাক হয়ে শুনত। এভাবেই আস্তে আস্তে তিতিরের ছুটি ফুরিয়ে আসেছিল।

সেদিন দোলনায় বসে তিতির বৈনিকে বলেছিল সে পরদিন চলে যাচ্ছে। বৈনি যেন সকাল সকাল একবার এসে দেখা করে যায়। রুমেলার চোখে বড় বড় মুক্তোবিন্দু এসে জমেছিল। তিতির বুঝিয়ে বলে ও আবার আসবে পূজার ছুটিতে। অভিমানী মেয়েটা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।

একটু পরে বলে -'' আর চারদিন থাকতে পারো না? চারদিন পর যে রাখি । আমি কখনো কাউকে রাখি  বাঁধিনি।''

-''না, টিকিট যে কাটা হয়ে গেছে। স্কুল খুলে গেছে অনেক আগেই। আমি স্পেশাল পারমিশন নিয়ে এসেছিলাম। এখন ফিরতেই হবে বৈনি। আবার আসব পরের ছুটিতে।''

তিতির বলে আস্তে আস্তে। ওর গলাটাও ভারি হয়ে আসে।

ছলছল চোখে মেয়েটা ফিরে যায়।সেদিকে তাকিয়ে চোখ মোছে তিতির।


পরদিন সকাল থেকেই বার বার বাগানের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল তিতিরের। ওরা একটায় বেরিয়ে যাবে বাবা বলেছে। বৈনি সবসময় দুপুরে আসে। ওর মা কাজে যায় তখন। সাড়ে এগারোটার পর তিতির আর থাকতে পারে না। এক ছুটে নেমে যায় পাইন বনের ভেতর দিয়ে ঐ বস্তিতে। গোলাপি বাড়িটা দূর থেকে দেখেছিল ও। সামনে একটা রডডেনড্রন আর সিডার গাছ । কিন্তু বাড়িটার সামনে গিয়ে মনে হয় কেমন যেন পরিত্যক্ত। ফাঁকা, বাগানে আগাছা ভর্তি। দরজা জানালা দেখলেই মনে হয় বহুদিন খোলা হয় না। বৈনি বলে দুবার ডেকেও সাড়া পায় না তিতির। এবার ও রুমেলা বলে কয়েকবার ডাকতেই পাশের বাড়ি থেকে একটা লোক বেরিয়ে আসে। ও এগিয়ে গিয়ে রুমেলার কথা জিজ্ঞেস করতেই আরও কিছু লোক জুটে যায়। ওর বাবার পরিচিত একজন এগিয়ে এসে বলে -''তুম তো ম্যানেজার সাব কা লেড়কা হো? ইধার ক‍্যাসে আয়ে?''

-''এখানে একটা মেয়ে থাকত। রুমেলা....'' ও ভয়ে ভয়ে বলে।

-''তুম উসে ক‍্যাসে জানতে হো বেটা?'' আরেকজন প্রশ্ন করে।

এর মধ্যে কেউ ওর বাবাকে ফোন করে দিয়েছিল। ভিড়ের মধ্যে বাবা মা কে দেখে আরও ভয় পেয়ে যায় তিতির।


সামনের একটা চায়ের দোকানে ওদের নিয়ে বসায় সবাই। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেন -'' এই বাড়িতে আজ দশ বছর কেউ থাকে না। তার আগে একটা পরিবার থাকত। বাবা মা আর ছোট্ট রুমেলা। একবার একটা দুর্ঘটনায় মা আর মেয়ে মারা যায়। বাবাটা এর পর মনের দুঃখে কোথাও চলে যায়। বাড়িটা সেই থেকে বন্ধ পড়ে রয়েছে। ''

-''কিন্তু গত এক মাস রোজ মেয়েটা আমাদের বাগানে খেলতে আসত। ও আমায় দাদা ডাকত।'' তিতির বলে।

-''ও বেঁচে থাকতে ঐ বাংলোয় খেলতে যেত ঠিকই, তোমার বয়সী একটা ছেলে থাকত ওখানে। পরে তারাও বদলি হয়ে চলে গেছিল। তবে অনেকেই বলে রুমেলাকে ঐ বাংলোর বাগানে দেখেছে। ''


এরপর নানারকম আলোচনা শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ বলছিল বাংলোয় পূজা করাতে। কেউ বলছিল এই বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলতে। দেরি হচ্ছে বলে বাবা মায়ের সাথে ফিরে এসেছিল তিতির। গাড়িতে সব জিনিস তোলা হয়ে গেছিল। শেষবারের মত বাগানটা ঘুরে দেখছিল ও। হঠাৎ ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে ও ঘুরে তাকায়। ওর মনে হল দোলনাটা অল্প দুলছে। ছুটে গিয়ে দেখে দোলনায় একটা রাখি  আর এক থোকা লটকা রাখা রয়েছে।

তিতির ওগুলো হাতে নিয়ে বলে -''থ‍্যাংকিউ বৈনি, আমি জানি তুই আছিস। আমি আবার আসবো তোর জন্য। খুব তাড়াতাড়ি আসব।'' 

ওর চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। 

অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু 

গল্পের ঝুলি : টেনশন : প্রতীক কুমার মুখার্জি







ক্যাম্পাসের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল বুবলারা। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার বিশাল ক্যাম্পাসে কুড়িজনের দলটা মশগুল হয়ে ছিল খেলায়। হঠাৎ জিকো বলটা সপাটে তুলে মারতেই পিছনে ছুটল বুবলা - এটা ধরতেই হবে তাকে, নইলে এই বিচ্ছুদের টিমের ডাকাবুকো ক্যাপ্টেন হিসেবে মান থাকবে না।


বলটা মাঠ পেরিয়ে সোজা উড়ে গেলো এস বি আই গেস্টহাউসের দিকে। ক্যাচ হবার সম্ভাবনা নেই, কারণ সেটা আগেই ওভার বাউন্ডারির গন্ডি পেরিয়ে গেছে। অগত্যা কেয়ারি করা পাতাবাহারের ঝোপের তলা থেকে বলটা খুঁজে মাঠের দিকে ছুড়তেই, গেস্ট হাউসের দরজা খোলার আওয়াজে বুবলা পিছন ফিরে তাকালো - এবং স্ট্যাচু হয়ে গেল সাথে সাথেই!


এ চেহারা যে ভোলার নয়। গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে আসছেন আর কেউ না, স্বয়ং ভীষ্মদেব সামন্ত - সেই ছ'ফুট লম্বা, টকটকে ফরসা, মুগুরভাঁজা বিশাল বপু! সেই কাঁধ অব্দি লম্বা কাঁচাপাকা চুল (এখন পনিটেলে সজ্জিত) বিশাল গোঁফের সাথে মানানসই গালপাট্টা, প্রশস্ত কপালে সেই লাল টিপ ধকধক করে জ্বলছে! পরনে শুধু ঘিয়ে গরদের ধুতি আর উত্তরীয়র জায়গায় লিনেনের শার্ট ট্রাউজার্স, আর হাতে ভাঁজ করা ব্লেজার।


দরজায় তালা দিয়ে ঘুরেই তার দিকে তাকিয়ে একটা জিঘাংসালোলুপ হাসি, তারপর নারকীয় একখানা থাম্বস ডাউনের পর সেই বুড়ো আঙ্গুল নিজের গলায় আড়াআড়ি চালিয়ে দেওয়া ! অতএব তিনিই স্বয়ং! একসাথে মাথাটা ঘুরে উঠে পেটে মোচড় দিল বুবলার। শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে নেমে যাওয়া শীতল স্রোতটা জানান দিল তার সামনে ভীষণ বিপদ।


ভদ্রলোক অবিশ্যি ইশারা করার পর বুবলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তর্জনীতে চাবি ঘুরিয়ে শিস দিতে দিতে মেনগেটের দিকে হাঁটা দিলেন। সম্বিত ফিরে পেতে বুবলা পায়ে পায়ে মাঠে ফিরে এসে ফিল্ডিং করতে শুরু করল। সে যে মোটেই শান্তিতে ছিল না, সেটা বোঝা গেলো দু'ওভার পরেই।


বিশ্বদুরন্ত ও নামকরা দুষ্টু, ক্যাম্পাসের দস্যিদলের অন্যতম মাথা বুবলা, ওরফে অন্তরীক্ষ সেন জীবনে প্রথমবার, মাঠে অসুস্থ বোধ করায়, বন্ধুদের কাঁধে ভর দিয়ে সি উইং এর লিফটে চড়ে অসময়ে ফ্ল্যাট অভিমুখে রওনা দিল। বাড়িতে ফিরতে বুবলার মা পড়ে গেলেন ফাঁপরে, কারণ তার তেরো বছরের ক্ষুদে দানবটির এ হেন করুণ অবস্থা দেখে ওঁরা একেবারেই অভ্যস্ত নন।


সন্ধ্যেবেলায় বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখেন ছেলে নেতিয়ে পড়েছে। তার মায়ের তো কাঁদোকাঁদো অবস্থা। হাজার প্রশ্নে জর্জরিত করে চলেছেন ছেলেকে, 'কেউ কিছু বলেছে?' 'কারু সাথে ঝগড়া হয়েছে?' 'বাইরে কিছু খেয়েছিস?' 'হঠাৎ পড়ে গেছিলি?' ‘মাথায় লেগেছে নাকি বলবি আমায়?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বুবলা চুপ - তার মুখ গম্ভীর, ভুরু দুখানি কুঞ্চিত, আর চোখদুটি চিন্তাক্লিষ্ট। স্ত্রীর ঝোলাঝুলিতে অগত্যা ডাক্তারবাবুর শরণাপন্ন হতে হলো সেনবাবুকে।


তিনি এসে পরীক্ষা করে স্মার্ট হাসিতে বললেন, "এ এখন সবার হচ্ছে, হিট স্ট্রোক," দিয়ে ছাপমারা কাগজের উপর একগাদা ফরমায়েশ লিখে দিয়ে করকরে পাঁচশো টাকা পকেটস্থ করে লিফটে ওঠার আগে সেনবাবুকে আলাদা করে ডেকে বললেন, "একটু শক তো পেয়েছে, তবে চিন্তার কিছু নেই, বাকি কথা রাতে হোয়াটস্যাপে হবে!"


সেনবাবু ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে স্টেয়ারকেসের বিশাল জানলা দিয়ে নিজের অজান্তেই একবার বাইরে তাকালেন। এখান থেকে গেস্টহাউসের সামনেকার দিকটা পরিষ্কার দেখা যায়। তার মুখে বিরল এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল - আশেপাশে কেউ কোথাও আছে কিনা এক ঝলক দেখে নিয়েই তড়িঘড়ি তিনি ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লেন।


।।২।।


আলাদা করে বলি। কে এই ভীষ্মদেব সামন্ত, কেনই বা আমাদের দাপুটে বুবলার তাকে দেখে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম? তিনিই বা কেন প্রতিহিংসার হাসি আর খবরদারিতে বুবলাকে টেনশনে রোস্ট করে চলেছেন? বুবলার বাবা কেন এতো কিছুর পরও বেশ নির্লিপ্ত? ডাক্তারের সাথে তার হোয়াটস্যাপে কীসের কথা? কেনই বা তিনি গেস্টহাউসের দিকে তাকিয়েই নিজেকে সামলে নেন? কিছু বোঝা যাচ্ছে না, তাই তো?


ঠিক আছে, এখন আগস্টের মাঝামাঝি। সব জানতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে - এই ধরো এপ্রিলের শেষের দিকটায়, গরমের ছুটির সময়টাতে। তার আগে বুবলাদের গ্রামের বাড়ির সম্বন্ধে বলে নিই একটু।


বুবলাদের আদি বাড়ি বর্ধমানের মেমারি গ্রামে। ওখানে এখনো তিনমহলা একখানা বাড়ি আছে ওদের। সেনবাবুরা তিন ভাইবোন, পালা করে নিজের নিজের সময়মতো দেখাশোনা করেন সেই বাড়ির। পুজো, গরমের ছুটি আর শীতের সংক্ষিপ্ত ছুটিতে সবাই জমায়েত হয় ওইখানে। এমন কোনো ছুটি যায় না যখন বুবলারা গ্রামের বাড়ি যায় না ছুটি কাটাতে। এবং প্রতিবার সে কোনো না কোনো দুর্ধর্ষ কীর্তি রেখে আসে তাদের আদি গ্রামের বাড়িতে।


বুবলার ভাইবোন নেই, সে একা। কাকার এক মেয়ে, এক ছেলে, আর পিসির এক মেয়ে। তাদের এই দলে চারজনের ভিতর খুড়তুতো ভাইবোন এমনিতে শান্ত। কিন্তু পিসির মেয়ে আর বুবলা হল দুষ্টুমির ক্যাটালিস্ট। এই দুজনের উস্কানিতে বাকি দুজনও নিমেষে নিজেদের ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে পিছপা হয় না – হলেই যে প্রেস্টিজ ইস্যু। এদের ধুন্ধুমার কান্ডে গ্রামের মানুষ ত্রস্ত হয়ে থাকলেও, গ্রামতুতো স্নেহমায়ার বশে, সেভাবে কেউ মুখ খোলে না। অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে করতে নিজেদের প্রবোধ দেয়, "আহা, মিষ্টি বাচ্চাগুলো। কদিন বই তো নয় - ফিরে গেলেই সব ঠিকঠাক আবার!"


সুতরাং অত্যাচার চলতে থাকে, উত্তরোত্তর বেড়ে চলে এই বোম্বেটে বাহিনীর বোমাবর্ষণ। বাবা মায়েরা প্রমাদ গণতে থাকেন, গ্রামের লোকেদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে হাতজোড় করতে থাকেন চুপিচুপি। কিন্তু দিনদিন তাদের চিন্তাও বাড়তে থাকে। বলা বাহুল্য, মুখ্য চিন্তাটা বুবলা আর তার পিসীর মেয়েকে নিয়ে - সব কিছুর মাস্টারমাইন্ড ওরা দুজন। এদের কিছু কাজের নমুনা দিলেই বুঝতে পারবে তোমরা, বানরবাহিনী বা পংগপালের চেয়ে কিছুমাত্র কম যায় না এদের হাতযশ।


গ্রামের প্রতিটা বাগানে একটি ফলও আস্ত থাকে না - ঠিক আছে, ফল খাচ্ছ খাও, সমস্ত কাঁচা ফলগুলি পেড়ে ফেলে নষ্ট করার মানে কী? রয়েছে গুলতির কেরামতি, তা দিয়ে কখনো কারো ছাগল ভেড়া, নয়তো ছিপের ফাতনা লক্ষ্য করে টিপ করে মাছধরার বারোটা বাজানো, এগুলো সাধারণ। শান্তভাবে চলেফিরে বেড়ানো গরুমোষের ল্যাজ মুচড়ে দিয়ে সেগুলোর সাথে সাথে গ্রামের শান্তি নষ্ট করা, এ কোনদেশী ভদ্রতা বলতে পারো?


কাকতাড়ুয়ার মাথার হাঁড়ি, কলসি কুঁজো, কুকুর বিড়ালের ল্যাজে কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যান বেঁধে দিয়ে সেগুলোকে টিপ করা, কিচ্ছু বাদ যায় না এই বিচ্ছুদের হাত, থুড়ি, গুলতি থেকে। পাড়াগাঁ অঞ্চল, অনেকে ভূতে অপদেবতায় ভয় পায়। ভর সন্ধ্যায় ফাঁকা জায়গা দেখে দল বেঁধে আপাদমস্তক সাদা থান জড়িয়ে হঠাৎ কাউকে ভয় পাওয়ানো, এসবেও পিছপা নয় এরা। কাকপাখিতে টেনে আনা আধখাওয়া ইঁদুর ইত্যাদি ফেলে রেখে আসে কারো তুলসীতলায়, কি নিকোনো উঠোনের মাঝবরাবর।


এর দাওয়ায় শুকোতে দেওয়া আচার, বড়ি বা আমসত্ত্ব চুরি করে অন্য বাড়িতে রেখে আসা, তারপর নিষ্পাপ মুখে জমিয়ে দুইবাড়ির ঝগড়া দেখতে যাওয়া, এসব ওদের কাছে নস্যি। আগের বছর কলকাতা থেকে একটা রবারের লাউডগা সাপ নিয়ে গিয়ে ভয় দেখাতে গিয়ে সে এক সাংঘাতিক কান্ড। আরেকটু হলে বিচ্ছিরি একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতো শীতলজেঠুর।


দুষ্টুমি ছোটবেলায় সকলে একটু আধটু করেই থাকে, কিন্তু এদের দুষ্টুমির ধরনটা ভালো নয়। ক্ষতিসাধনের একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা আছে এতে। এই নিয়ে সবাই বড়ই উদ্বিগ্ন - সবাই ভাবতে থাকে কী করে এদের থামানো যায়, কারণ এরপর লোকে আর বাচ্চা বলে ছেড়ে কথা বলবে না।


।।৩।।


এতদিন ছুটিতে গ্রাম জুড়ে লুঠতরাজ চালালেও, অজানা কারণবশত কিছু লোকের থেকে দূরে থাকত এই বিচ্ছুবাহিনী। যেমন কবিরাজ শ্যামাপদ পাকড়াশী মশাই-এর ধারেকাছে ঘেঁষতো না এরা। এই তালিকায় পড়তেন পঞ্চায়েত প্রধান পরিতোষ কর্মকার, পুরোহিত শিবতোষ গাঙ্গুলি আর অবশ্যই ভীষণদেহী ভীষ্মদেব সামন্তমশাই।


সামন্তরা ছিলেন এ গ্রামের জমিদার। জমিদারি গেছে, কিন্তু ঠাটবাট, দানধ্যান, আর আলগা চাকচিক্যের সাথে বিশাল চকমিলানো বাড়িটা, হরেকরকম গাছপালার বিশাল উদ্যানের সাথে তিনটে বিশাল বিশাল দিঘি সেই জমিদারির প্রমাণ। বিশালদেহী ভীষ্মদেব আসলে সেনবাবুর বন্ধু, একইসাথে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু রাজাপ্রজায় একটা ব্যবধান রয়েই গেছে। বাড়ির মন্দিরে নিজে যখন পুজো করেন গরদের ধুতি উত্তরীয় গায়ে, কপালের লাল টিপ আর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে বুক কেঁপে ওঠে না এমন মানুষ খুব কমই আছে গ্রামে।


ভীষ্মদেব এদের কাণ্ডকারখানা সম্পর্কিত সব খবর রাখতেন, কিন্তু সেভাবে কিছু বলতেন না - হয়তো আত্মপ্রসাদ অনুভব করতেন এরা তাকে কোনোদিন আক্রমণ না করায়। এক দুবার সেনবাবুকে ডেকে বন্ধুর মতই বুঝিয়েছিলেন বাড়ির ছেলেদের বাগে আনার ব্যবস্থা করতে। আর সেটা কোনোভাবে শুনে ফেলে বুবলা। ব্যস, আর যাবে কোথায় – চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফেলল বুবলা। ওঁর তো কোনোদিন কোনো ক্ষতি করিনি আমরা? তাহলে আমাদের শাসন করতে বলবেন কেন উনি?


তাই এইবার গরমের ছুটিতে গিয়ে অন্যান্য দুষ্টুমির সাথে একটা জিনিস করার দুঃসাহস করেছিল বুবলা। ছোটখাটো অপারেশন অনেক হয়েছে, এবার সে টার্গেট করেছিল ওই দশাসই ভীষ্মদেবকেই। এবং ঠান্ডামাথায় প্ল্যান করে করেছিল কাজটা।


ওরা ওঁর পুকুরে, বাগানে, বাড়িতে কোথাও হাত দেয়নি, কারণ জানতো ওসব জায়গার নাগাল পাওয়া কঠিন। তাই, চুপচাপ নিজের মোবাইল ঘেঁটে এমন কাজ করেছিল, যাতে ছোটাছুটি না করেও সে দুষ্টুমির ফল হল বিচ্ছিরি রকমের। আর ঠিক কলকাতায় ফিরে আসার দিনে কায়দা করে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিল বুবলা এন্ড কোম্পানি, যাতে গ্রামে অশান্তি হলেও কেউ তার টিকি ছুঁতে না পারে।


ঘটনার দিন সকাল ন'টায় বিরাট একটা ট্রাক গ্রামে ঢোকার প্রধান রাস্তায় এসে থামল। এরপর ছোট রাস্তা, অতবড় গাড়ি আর ঢুকতে পারবে না। ইউনিফর্ম পরা লোকজন নেমে এসে ভীষ্মদেবের ঠিকানা খুঁজতে, সবাই বাড়ি দেখিয়ে দিলো। লোক দুজন বাড়িতে এসে সামন্তমশাইকে বলল, "আপনার অর্ডারি মালপত্র এসে গেছে স্যার, রিক্সা ভ্যান বা গরুর গাড়ি পাঠাতে হবে, নিদেনপক্ষে ছোট গাড়ি, নইলে অত জিনিস আসবে কী করে? আর এই আপনার বিল, তিন লক্ষ একুশ হাজার। এটা সিওডি আছে, কার্ডে করবেন না ক্যাশে, স্যার?"


দেখেশুনে সামন্তমশাই-এর গালে মাছি, শিবনেত্র অবস্থা!! বিলের শোভা বাড়াচ্ছে বেয়াল্লিশ ইঞ্চির টিভি, কম্বো মাল্টিপ্রসেসর ফ্রিজ, গাদাখানেক ব্র্যান্ডেড ফার্নিচার, দামী দু'টনের চারটি এসি ইত্যাদি। ফরসা রঙ আস্তে আস্তে দুধে-আলতা হতে শুরু করতেই ফোনটা বেজে উঠল ওঁর - "মিস্টার ভি ডি সামন্ত? আপনার বাড়ি যাবার একটা ঠিকঠাক ল্যান্ডমার্ক বলুন তো! আমি এশিয়ান পেন্টস ইজিপেন্ট থেকে বলছি, আপনার বাড়িতে আজ থেকে কাজ শুরু। জব কার্ডে লেখা আছে আমরা এগারোটায় শুরু করবো।" ধপ করে শ্বেতপাথরের রোয়াকে বসে পড়লেন ভীষ্মদেব, চোখমুখ বিস্ফারিত। আর ঠিক সেই সময়েই সেনবাবুরা কলকাতা ফেরার জন্য বাড়ি থেকে বেরোলেন।


যখন সামন্তবাড়ি পেরোচ্ছে বুবলারা, তখন সেখানে ধুন্ধুমার কান্ড! আপাদমস্তক সিঁদুর-রাঙ্গা ভীষ্মদেব, বাজখাঁই গলায় প্রশ্নবাণ দেগে চলেছেন, "কীসের অর্ডার? কীসের বুকিং? কে করেছে? কলকাতা থেকে বুকিং হয়েছে? আমার কাছে স্মার্টফোনই নেই! এই অর্ডার কীভাবে আপনাদের কাছে গেছে তার আমি কী জানি?" ঘটনাটা ঘটছিল ঠিক সামন্তবাড়ীর সামনে রাস্তার উপর, আর সেটাই গ্রাম থেকে বেরোনোর একমাত্র প্রধান সড়ক। বুবলাদের গাড়ি ওখান দিয়ে পার হবার সময়েই তার মিচকে হাসিমুখটা তাঁর চোখে পড়ে গেলো – আর যায় কোথায়? পিছনে দেখা গেলো ছুটে আসছেন ভীষ্মদেব,"তুই করেছিস?এত সাহস তোর?আমি শেষ দেখে ছাড়বো। রোককে, রোককে!! জেলে গিয়ে পচবি তুই, আমি আসছি কলকাতায়। এর প্রতিশোধ আমি নেবো। গ্রামছাড়া করবো তোকে।"


গাড়ি চলার সাথে সাথে কথাগুলো মিলিয়ে যেতে বুবলা দেখলো মায়ের চোখে জল, আর বাবা কপাল টিপে ধরে বসে আছেন চুপ করে। সেই সময়েই উল্টোদিক থেকে আসা আরেকটা ট্রাক তাদের থামালো, "ভীষ্মদেব সামন্তের ঠিকানা বলতে পারবেন? ট্রাক ভরতি জামাকাপড়, ওঁরই সমস্ত অর্ডার। একবার বাড়ি খুঁজে পেলেই ট্রাক খালি।" বুবলা গম্ভীরভাবে পিছনদিকে ফেলে আসা গ্রামটা দেখিয়ে দিতেই বাবার হাতের একটা বিরাশি সিক্কার চড় আছড়ে পড়ল তার গালে - প্রথমবার!!


।।৪।।


এসব কথাই শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বুবলা। সেই এপ্রিলমাসের ঘটনা, আর এটা আগস্ট - তিনমাস কেটে গেছে, সে ভেবেছিল ফাঁকা আওয়াজ। কিন্তু তিনমাস পরে লোকটা এসেছে, তাকে এক দেখাতেই চিনেছে, নিঃশব্দে শাসিয়েছেও। তাহলে এবার কী হবে - সত্যি সত্যিই কি তাকে জেলের ঘানি টানতে যেতে হবে? সে শুনেছে, অল্পবয়সী অপরাধীদের আলাদা জেল আছে। আবার গা পাক দিয়ে উঠল বুবলার।


সেদিন অনেক রাতে ঘুম এলো বুবলার, মাঝে মাঝেই চমকে উঠে বসছিল সে। পরদিন সকালে উঠেই বারান্দায় ছুটে গেলো, সম্ভবত কালকের ব্যাপারটার সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য। গেস্টহাউসে তালা দেখে সে যারপরনাই খুশি হয়ে রেলিঙে ভর দিয়েই আঁতকে উঠে পিছিয়ে এলো। ব্যালকনির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে ভীষ্মদেব সামন্ত, তার দিকে আঙ্গুল তাক করে হাতের মুদ্রায় বন্দুক চালিয়েই তাদের লিফটের দিকে এগোতে লাগলেন তিনি। বুবলা শিউরে উঠে ছুটে গিয়ে বাথরুমে দরজা দিলো।


কিন্তু পনেরো মিনিট কেটে গেলো, তাদের বাড়িতে কেউ বেল বাজালো না দেখে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল ডানপিটে বুবলা। কিছুক্ষণ পরে তার মা গিয়ে দেখলেন তার রীতিমতো কম্প দিয়ে জ্বর এসেছে। সেদিন স্কুল যাওয়া বন্ধ হল ছেলের। কিছুক্ষণ পর পরই বুবলা জানলার ফাঁক দিয়ে, কখনো পর্দা সরিয়ে, বা ব্যালকনি থেকে উঁকি দিতে লাগলো – লক্ষ্য গেস্টহাউস। কিন্তু ‘নো সাইন অফ সামন্ত!’ লোকটা গেলো কই? পুলিশের কাছে তার নামে নালিশ করতে নয়তো?


বিকেলে খেলতে নামছিল না বুবলা, কিন্তু বন্ধুরা ডাকাডাকি করতে বুকে বল পেলো সে। মা লক্ষ্য করলেন প্রথমবার, ছেলেকে একটু অন্যরকম লাগছে ! অন্যদিনের মতো ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাবটা যেন জলে ভেজানো মুড়ির মতোই নরমের দিকে! "আমার একমাত্র ছেলেটার মাথাটা ঠান্ডা করে দাও ঠাকুর, আমি কামাখ্যার মন্দিরে তোমায় গয়না..." এই অব্দি ভাবতে ভাবতেই দরজায় প্রবল ধাক্কার সাথে ডোরবেলের আওয়াজে ছুটে গেলেন তিনি।


দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে বুবলা – দরদরিয়ে ঘামছে সে। "কী হয়েছে বাবা, ফিরে এলি কেন?? শরীর খারাপ করছে? কী হয়েছে বল আমায়?" দুরন্ত বুবলা আর কিছু না বলে মায়ের হাতে একটা লাল গোলাপ গুঁজে দিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের বুকে মুখ ঢাকল। পরে সন্ধ্যেবেলায় বাবা বাড়ি ফেরার পর সে জানালো বিকেলে মাঠে যেতেই গেস্টহাউসের লোকটা হন-হনিয়ে এসে বুবলার হাতে ফুলটা ধরিয়ে দিয়ে একটা ‘থাম্বস আপ’ দেখিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে গেস্টহাউসের দিকে ফিরে যায়।


বাবা সব শুনে যেন আমলই দিলেন না, বললেন, "তোর মত দানবকে যদি কোনো ভদ্রলোক ফুল দিয়ে থাকেন তিনি নিশ্চয় ভুল করেছেন, তারই উচিত ডাক ছেড়ে কাঁদা।"

তখন বুবলা আসল কথাটা বলল, "বাবা, লোকটা আর কেউ না, আমাদের গ্রামের সামন্তকাকু!" বাবা বললেন, "হতেই পারে না, ভীষ্মদেব গ্রাম ছেড়ে এভাবে বেরোতেই পারে না, দাঁড়া, তাও আমি গ্রামে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি।" 

কিন্তু গ্রামে ফোন করে দেখা গেলো সত্যিই ভীষ্মদেব গ্রামে নেই, বাইরে কোথাও গেছেন। অবশ্য কোথায় গেছেন সে ব্যাপারে কেউ বলতে পারলো না।


পরের তিনটে দিন বুবলার তেরো বছরের জীবনে সবচেয়ে অন্ধকার দিন হিসেবে গণ্য হয়ে থাকলো। বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে ক্যাম্পাস সংলগ্ন সমস্ত জায়গা থেকে নানাভাবে নিঃশব্দে আমাদের তুখোড় বুবলাকে টেনশনে জর্জরিত করে তুললেন ভদ্রলোক। কিন্তু ওই পর্যন্তই, তার বেশি কিছু ঘটলো না – একটা কথাও উনি বলেননি। কিন্তু তার নিজের করে আসা অনাসৃষ্টি ও তার ফলে অগ্নিশর্মা সামন্তকাকুর মুখ থেকে বেরোনো প্রতিটা শব্দ মনে পড়তে লাগলো বুবলার, মনে করালেন গেস্টহাউসের অতিথি। বাবা মা দু তিনবার গেস্টহাউসে গেলেন বটে দায়সারা, কিন্তু দেখা হলো না ভীষ্মদেবের সাথে।


শেষে মরিয়া বুবলা পুলিশকে ফোন করার কথা ভেবেও হাত গুটিয়ে নিলো। সে ভাবলো, পুলিশ যদি আসে, তাহলে সব শুনে তাকেই ধরবে, কারণ সত্যি কথা, আজ অব্দি সামন্তকাকু তার এতটুকু অনিষ্ট করেননি। এতদিন যা অনিষ্ট করার সে করেছে। ভিতরে ভিতরে কোথায় যেন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। সে নিজের অবস্থা দেখে আগে তার করা সমস্ত দুষ্টুমির জন্য আক্ষেপ করতে শুরু করেছে!


।।৫।।


চারদিন চলার পর আর পারলো না বুবলা। বাবা মায়ের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সমস্ত দোষ স্বীকার করে তাঁদের পা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করলো যে আর কখনো সে দুষ্টুমি করবে না। মায়েরা নরম মনের মানুষ, সেই বিধি মেনেই যেন মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা বললেন, "নে, এবার নিজে ফোন করে সামন্তকাকুর কাছে ক্ষমা চাইবি, আমি ডায়াল করছি…"

কথা শেষ হতে না হতেই বুবলা লাফ দিয়ে উঠে বলল, "ফোনের কী দরকার, আমি এক্ষুনি গিয়ে কাকুর সাথে সব সেটল করে ফেলছি!" বলে তিন লাফে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে।


এবার সেনবাবু হতভম্ব ভাবে স্ত্রীর দিকে চেয়ে হাত উল্টে, "যাচ্চলে, এবার সামলাবো কী করে?" বলেই দেখেন, তাঁর স্ত্রী তাঁর দিকে চোখ পাকিয়ে বসে আছেন। ঝামেলা হবার আগেই সেনবাবু বললেন, "শোনো, যা করেছি তাতে হয়তো তোমার গোপালের একটু কষ্ট হয়েছে, না করলে ও বজরংবলী হয়ে দেশবিদেশে ল্যাজের আগুন ছড়িয়ে বেড়াতো। তোমার ছেলে আর কোনওদিন দুষ্টুমি করলেও, বদমায়েসি করবে না, আমার গ্যারান্টী রইল। এবার তাড়াতাড়ি গেস্টহাউসে চলো। এই অবস্থায় তাকে কী করতে হবে, সহদেব মোটেই জানে না।"


গেস্টহাউসের অবস্থা তখন মারাত্মক! ওই বিশাল চেহারায় কালো একটা জিম ভেস্ট আর লিওটারড পরে নাকিসুরে বিশুদ্ধ মার্কিনীতে পরিত্রাহি চিৎকার করে চলেছেন ভীষ্মদেব, থুড়ি সহদেব সামন্ত, "হে বয়, প্লীজ লিভ মি। হোয়াট অন আর্থ! লেট মি গো! লেট গো মাই লেগস – আই গন্না ফল!!" কিন্তু কে শোনে কার কথা? অতবড় চেহারার লোকটির পা ধরে ঝুলে আছে বুবলা – দেখে মনে হচ্ছে যেন গোল্ডেন বীকড কিং ঈগল পায়ে করে ছোট্ট একটা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে !!


অনেক কষ্টে দুজনকে ছাড়ানো গেলে, গেস্টহাউসে তালা দিয়ে সবাই ফিরে এলো বুবলাদের ফ্ল্যাটে। সেখানে বসেই জানা গেলো যে গেস্টহাউসের অতিথি মোটেই ভীষ্মদেব সামন্ত নন, ইনি তার যমজ ভাই সহদেব সামন্ত, আমেরিকাবাসী কুড়ি বছর যাবৎ। প্রতিবছর দেশের বাড়িতে এসে পনেরো বিশদিন থেকে যান। আর এই পুরো প্ল্যানটা বেরিয়েছে সেনবাবু আর ভীষ্মদেবের মাথা থেকে। ঠিক করেছিলেন, বুবলার বুদ্ধিমত্তার কাঁটা ওঁরা বুদ্ধিমত্তার দ্বারাই তুলবেন – ছুটিতে পাকানো অশান্তির শোধ নেবেন ছেলেটাকে টেনশনে ছুটোছুটি করিয়ে! বুবলা এবং তার মায়ের এই যমজের ব্যাপারটা জানা না থাকায় প্ল্যান করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি!


সব জানার পর প্রবল হাসাহাসির ভিতর একটা ফোঁপানোর আওয়াজে সবাই দেখলো বুবলা হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। আজ কেউ তাকে বাধা দিলো না, শুধু সহদেব তার পকেট থেকে একটা দামী ডিজিটাল ক্যামেরা বাড়িয়ে ধরে বলল, "ফ্রম টুডে দিস ইস ইওরস, জাস্ট ডিলিট দ্য স্ন্যাপস আই টুক টু কিপ অ্যান আই অন ইউ, মিস্টার ডেনিস!" মার্কিনী মানুষ তো, ওদের কাছে ডেনিস হলো দুষ্টুমির ইউনিট!


বুবলাই ঠিক করল পরেরদিন সবাই মিলে গ্রামে যাবে, প্রথমে ভীষ্মদেবকাকু, তারপর সমগ্র গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবে সে। তার বাবা এটা জানিয়ে সামন্তকাকুকে ফোন করার কথা বলতে গেলে বুবলা বারণ করে, "সারপ্রাইজ দিয়ে শুরু হয়েছিল, সারপ্রাইজ দিয়েই শেষ হোক!"


পরদিন গাড়িতে সামনের সীটে বসা সহদেবকাকুকে জিগ্যেস করলো বুবলা, "আই ডিড দ্য মিসচীফ ইন এপ্রিল, হোয়াট টুক ইউ সো লং?’ এক গাল হেসে চকচকে সদ্য কামানো গালে হাত বুলিয়ে জবাব দিলেন ছোট সামন্ত, ‘ইট টুক লং টু গ্রো সাচ ম্যামথ হুইস্কারস টু লুক লাইক ভীষ্মা !!"


মা পিছনের সীট থেকে অবাক হয়ে তাকাতে বাবা বুঝিয়ে দিলেন, "আরে আমেরিকার অফিসে তো ওরকম বুনো রাক্ষসের মত গোঁফদাড়ি রাখতে দেয় না!"


"আরেকটা প্রশ্ন বাবাকে," গম্ভীর মুখ বুবলার, "ডাক্তারবাবুর সাথে হোয়াটস্যাপে কী কথা হতো তোমার?" 
সেনবাবু বললেন, "সে অনেক কথা বাবা, যতটা শক তুমি লোককে দিতে, তার কতটা তোমার শরীর নিতে পারে তার হিসেবপত্র করতাম আমরা। বড় হয়ে বাবা হও, সব হাড়ে হাড়ে বুঝবে!"


হাসির রোল উঠিলো, গাড়ী সবেগে ‘ছুটির ডেস্টিনেশন’ এর দিকে ‘ছুটিতে’ লাগিলো।।

(সমাপ্ত )


অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু

গল্পের ঝুলি : লুকোচুরি : প্রদীপ কুমার বিশ্বাস



সোমবার যে হঠাৎ করে ছুটি হয়ে যাবে আর সারাদিন ধরে এইরকম অদ্ভুত আর মজার ঘটনাগুলো যে ঘটবে, তার আগাম খবর আমার কাছে ছিল, কিন্তু বিশ্বাস হয়নি। রবিবার সন্ধ্যেয় মধুদাদা এরকমই একটা আভাস আমাকে দিয়েছিল। তখন অঙ্কের বিশাল হোমটাস্ক শেষ করতে এত ব্যস্ত ছিলাম, বুঝতেই পারিনি। তবে শেষ রাতের দিকে রাত-জাগা পাখিগুলো বোধ হয় এরকমই কথাগুলোই টুই- টুই করে গান গেয়ে বলছিল। আমার ওদের গানের কথাগুলো বিশ্বাসই হয়নি।

আমাদের টাউনশিপের বাইরেই চওড়া হাইওয়ে। সেটা ধরে কিছুটা গেলেই একটা বড় ব্রিজ পড়ে। স্কুল-বাস যখন রোজ এই ব্রিজে ওঠে, আমরা সবাই দুঃখের দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এরপরেই আমাদের স্কুল।শুরু হবে, আবার একটা বিরক্তিকর লম্বা সময়।

আজ আমাদের স্কুল বাস সেই রাস্তায় ব্রিজ পার হবার ঠিক আগে গতি ধীর করল । কিন্তু ব্রিজ পার না হয়ে দেখি ইউ-টার্ন নিচ্ছে। আমরা কয়েকজন দু’কান-কাটা ছাত্র ছাড়া 
বাকি সবাই হোমটাস্কের খাতাগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিতে ব্যস্ত। তাই ভাল ছেলেরা কিছু বুঝতে না পারলেও ব্যাপারটা আমাদের নজর এড়ালো না। কিন্তু ততক্ষণে আমরা একে অন্যকে ইশারা করছি চুপ থাকতে। মনে হয় আজ হঠাৎ কোনও কারণে স্কুল ছুটি। সে খবরটা আমাদের বাসের কন্ডাক্টর নিলুদা হয়ত এইমাত্র পেয়েছে স্কুল থেকে। মনে হচ্ছে সেই জন্যই বাস ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু ফিরে তো যাচ্ছে সেই টাউনশিপেই আর তারপর বাড়িতে। আজ হোমটাস্ক নেই, কিন্তু নিস্তারও নেই। পুরানো পড়া রিভাইজ করো, লেখো আর যে টিফিনটা দিয়েছিলাম সেইটা দুপুরে খেয়ে নিয়ে আবার অঙ্ক করতে বসে যাও। কিন্তু যদি বলি আগে একটু ছবি আঁকি কিম্বা পেয়ারা গাছে আসা সবুজ টিয়াদের সাথে কথা বলি তারপর না হয় করবো সে গুড়ে বালি।

কিন্তু এ কী! বাস তো টাউনশিপের রাস্তা না ধরে বাঁদিকে ঘুরে জঙ্গলে যাবার এবড়ো- খেবড়ো রাস্তাটা ধরে একটু হেলে-দুলে কিন্তু বেশ ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে। এতক্ষণে ব্যাপারটা বাকি সবার নজরে পড়েছে। আমরা সবাই চেঁচিয়ে উঠলাম,
“ ড্রাইভার-দাদা, পাগল হলে নাকি?” 

ততক্ষণে নিলুদা ড্রাইভার-দাদার কেবিনে ঢুকে পড়েছে। এক মুহূর্তের মধ্যে দুজনেই কেবিন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে ভয় পাওয়া ফ্যাসফেঁসে গলায় যতটা সম্ভব উঁচু আওয়াজে বলে,
“বাসের স্টিয়ারিং, ব্রেক সব এক সাথে ফেল করেছে”।

গেটের কাছে এসে আমাদের উদ্দেশ্যে দু’জনে এবারে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আরে ননীগোপালের দল, কুঁড়ের বাদশা সব, বুঝতে পারছ না কী হতে চলেছে? বাসটা এখন খুব ধীরে চলছে, এই সময় লাফিয়ে নেমে পড়ো সব। ভয়ের কিছু নেই। এই দেখ, আমরাও নামছি”।

ড্রাইভারদাদা আর নিলুদা ঝাঁপিয়ে নেমে তো পড়ল, কিন্তু সেই সঙ্গে দারুণ একটা মজার ব্যাপার হল। মোটা চেহারার ভুঁড়িওয়ালা ড্রাইভারদাদা ঝাঁপিয়ে নামতে গিয়ে জঙ্গলের কাঁকর-মাটিতে টাল সামলাতে না পেরে দু’বার গড়াগড়ি খেয়ে, চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। তখন তার ভুঁড়িটা হাপরের মত ওঠানামা করছিল। সেই দেখে জঙ্গলের দু’পাশের লম্বা গাছগুলো থেকে বাঁদরের দল খিক-খিক করে একসাথে হেসে উঠলো। বাসে বসে থাকা আমরাও বাদ গেলাম না।

না, আমরা কেউ ঝাঁপিয়ে নামিনি। তার মানে এই নয় যে আমরা ভয় পেয়ে নামিনি, বরং উল্টোটাই । বনের এই রাস্তাতে আমরা আগে তো আসিনি, বেশ মজা লাগছিল যেতে। বাসটার তেমন কিছু হয়নি মনে হয়। আর তেমন হলে বাস কি অন্তত আমাকে বলতো না? একটু আগেই তো আমাদের সাথে-সাথে ড্রাইভার দাদার দুর্গতি দেখে বাস তো হাসছিল। বিশ্বাস হল না তো? আমাদের যেমন ভাষা আছে, তেমনি বাকি সব জীব আর যন্ত্রপাতি এদেরও আছে। একটু চেষ্টা করলেই আমরা সকলেই আমাদের চারপাশের সবার ভাষা বলতে হয়ত পারব না, কিন্তু বুঝতে পারব। মজার কথা হল, আমরা ওদের ভাষা না বুঝলেও ওরা আমাদের প্রতিটি কথা বোঝে। আমি অবশ্য ওদের ভাষা তাড়াতাড়ি শিখেছি, সেটা মধুদাদার শেখানোর গুণে। পরে আমিও, আমাদের স্কুলের দু’চারজন বন্ধুদের শিখিয়েছি।

প্রায় প্রতিদিনই বাসে ঢুকতেই বাস আমাকে কিছু-না-কিছু বলে। ওর ওপর ড্রাইভার আর গ্যারাজের মেকানিক প্রায় প্রতিদিনই খুব অত্যাচার করে। একটু বেশি তেল খেলে বা ঠিকঠাক দৌড়াতে না পারলে বেশ মারধর করে । ও প্রায়ই এখন বলে, রোজ-রোজ একই রাস্তা ধরে স্কুল আর গ্যারাজ যেতে তার আর ভাল লাগছে না। আমাদেরও অবশ্য তাই, কিন্তু কী আর করা যায়?

আজকাল ও প্রায়ই বলে, খুব জলদিই একটা স্কুলে যাওয়ার দিনে হঠাৎ করে ছুটি হবে আর ও সবার জন্যে কিছু একটা মজার ব্যাপার করবে। আমরা ওকে বারণ করি বটে, তবে এমন একটা কিছু হলে কিন্তু হয় বেশ। আজ এই বাস জঙ্গলের রাস্তায় আসার আগে একটাও কথা বলেনি।জঙ্গলের পথে এতটা চলবার পর বলে উঠল,
“বন্ধুরা ভয় পাওনি তো কেউ?” 
এটুকু কথা, দু’একজন ছাড়া, বাকি সবাই বোঝে। সবাই একসাথে বলে উঠলাম,
“একটুও না। কিন্তু এইবার তুমি একটু জিরিয়ে নাও । এই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় চলতে তোমার কষ্ট হচ্ছে তো?” 
বাস বললে,
“আর একটু কাছেই একটা বড় মাঠ, তারপরেও রাস্তা আছে, কিন্তু আমি সেখানে তোমাদের নিয়ে যেতে পারবো না”। 
আমরা সমস্বরে বলে উঠি, “ কিন্তু কেন?”
বাস বলে,“সেটা ঢালু রাস্তা, সিধা নেমে গেছে নদীর দিকে। আমি হয়ত টাল সামলাতে পারব না। তাছাড়া সেখানে গিয়েই বা কাজ কী? তার চেয়ে আর একটা জায়গা অবধি পৌঁছাতে পারলে ভালো। আমার কাছে একটা দারুণ খবর আছে যে সেইখানে আজ জঙ্গলের সবাইকে নিয়ে বেশ দারুণ মজার কিছু হবে, আর সেই জন্যেই তো আসা এইখানে”।

পিলু আমাদের সবার ছোটো, রোজ বসে কেবিনের একদম কাছে। সে তার পাতলা রিনরিনে গলায় বললে,
“তা এতক্ষণ চেপে রেখেছিলে কেন?”
বাস বললে 
“ সে অনেক কথা, একটু জিরিয়ে নিয়ে বলছি”।

 এই বলতে-বলতে, বাস থেমে গেল।

দুপাশে গভীর জঙ্গল আর ঝোপ-ঝাড়। আমরা সবাই এখানে নামতে ইতস্তত করছিলাম। কয়েকজন এই সময় দেখতে পেল, ঝোপের আড়ালে বেশ কতকগুলো কালো-কালো মুখ। কেউ-কেউ আবার নাকি ভালুক দেখেছে!

হঠাৎ দেখি, এক বড় ভালুক ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল। তার দু'হাতে, বড়-বড় করনেটো আইসক্রিমের মত দেখতে দুটো সবুজ পাতার ঠোঙ্গা ।

বড় ভালুক আমাদের দিকে একগাল হেসে বললে,
“নেমে এস বন্ধুরা । তোমাদের ক্লান্তি দূর করবার জন্যে, মৌমাছিরা তাদের চাক থেকে টাটকা মধু পাঠিয়েছে।”

ভালুকের জড়ানো শব্দ, আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারেনি । বাস থেকে নেমে আসতেই বড় ভালুক আমাকে জড়িয়ে ধরে 
“কী ভাগ্নে? কেমন আছো?” এই বলে আমার হাতে মধুর ঠোঙ্গাগুলো ধরিয়ে দিল । সেই দেখে বাকি সব ছেলেমেয়েরা দুদ্দাড় করে নেমে পড়ে আমার হাত থেকে ঠোঙ্গা দুটো কেড়ে নিল । ততক্ষণে ভালুকমামি ভাই-বোনদের সাথে নিয়ে আমাদের কাছে আরো অনেক ছোটো ছোটো মধু ভরতি ঠোঙা নিয়ে হাজির। টাটকা মধু দেখে সবাই খুব হ্যাংলামি শুরু করে দিল । তবে দোষ নেই কারো। খাঁটি টাটকা মধু, আমরা এর আগে তো খাইনি কখনো। 

কী আশ্চর্য! ভালুক ভাইবোনগুলো কী সুন্দর পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে । আমাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই এবার ওদের কথা বুঝতে পারল । আচ্ছা কোন মিথ্যেবাদী বলে এরা নাকি মানুষ দেখলেই, দাঁত-নখ দিয়ে আঁচড়ে-কামড়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি বার করে দেয়?

সামনেই একটা বিশাল বট গাছ। আমরা ক্লান্ত দেখে মামা, মামি আর ভাইবোনেরা সবাইকে সেই গাছতলায় বসিয়ে নিজেরাও বসলো সেখানে।ভালুক মামা বললে,
“তোমরা কিন্তু বেশ ভাল দিনে এসেছ। এই বনে আজ সারাদিন ধরে উৎসব হবে। অবশ্য এমনিতেই আমাদের মধ্যে প্রায়ই ছোটখাটো উৎসব হয়ে থাকে। কিন্তু আজকের উৎসবটা মহোৎসব। আজ এইদিনে আমাদের সবাইয়ের প্রিয় রাজা শ্রী মধুসূদন আসবেন উদ্বোধন করতে।”

উৎসবের নাম শুনে সবার ছোটো পিলুর মুখে হাসি আর ধরে না । উৎসুক হয়ে সে শুধায়,
“কী কী হয় এই মহোৎসবে ?”
ভালুকমামা তার দিকে তাকিয়ে বললে,
“মেলা বসবে, আর নানারকম খেলা আর নাচ হবে।”
আমাদের মধ্যে ভীতু কেউ একজন কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, 
“ভালুকমামা, জঙ্গলের সব জন্তু-জানোয়াররা কি আসবে নাকি ? মানে যারা খুব হিংস্র তারাও কি আসবে?”

ভালুকমামা কপাল নাক কুঁচকে রাগতস্বরে বললে “কথাটা কে বললে তোমাদের মধ্যে?”
আমরা তো সবাই চুপ হয়ে আছি। সেই দেখে মামা বললে, 
“জন্তু-জানোয়ার বলছ কেন? এখনি বন্ধু না বললেও, বনবাসী তো বলা উচিত ছিল। আর এরকম বোলো না তোমরা কেউ । ভয় পেও না, এই বনে রাজা মধুসূদন থাকেন। তাঁর রাজ্যে সবাই হিংসা ভুলে যায়। শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের সব বনবাসীদের আর তোমাদেরও ভাষা বুঝতে-বলতে পারি। এসবই সেটা তাঁরই জন্য” ।

মামি বললে, 
“ তিনি থাকেন সবসময় আমাদের সাথে। কিন্তু তিনি আমাদের সব সময় দেখতে পেলেও, যারা তাঁকে মন দিয়ে ডাকে, তারাই শুধু দেখতে পায়। কিন্তু আজ এই বছরকার মেলার দিন তিনি সবাইকে দেখা দেন। তাঁর সেই হাসিমাখা মুখে কী যে জাদু থাকে কে জানে? বড় বিড়ালের পরিবারও হিংসা ভুলে গেছে।”

আমরা সমস্বরে বলি,
 “তাহলে তারা খায় কী?”
মামা বললে,
“আমাদের এখানে, পাঁচশোর বেশি মহিষ- মহিষীর বিশাল পরিবার । জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গাতে তারা খুর দিয়ে খুঁড়ে-খুঁড়ে এক বড় ডোবা মতো বানিয়ে রেখেছে। মহিষীরা সেই ডোবার পাড়ে এসে বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়। তারপর বাঁট দিয়ে যা উপচে পড়ে, সেইটাতেই ডোবাটা বিকেল-তক দুধে ভরে টইটম্বুর হয়ে যায়। বড়-বিড়ালের পরিবার সন্ধের পর তাতে সাঁতারও দেয় আর পেটও ভরায়।”
টুম্পা হাঁ করে শুনছিল। বোকার মত, দুম করে বলে বসলো,
“বড়-বিড়ালের পরিবার মানে কি অনেকগুলো বা-আ-ঘ?”
এই মরেছে! ভালুক মামা আবার না ধমক দেয়।আমরা সকলে সমস্বরে টুম্পাকে চুপ করতে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে উঠি,
“শ:!শ:!”
ভালুক মামা যখন রাজা মধুসূদনের কথা বলছিল, তখন মধুসূদন নাম শুনেই আমার গায়ে কীরকম কাঁটা দিয়ে উঠলো। অরণ্যের এই রাজার মতো আমার মধুদাদাকেও সবাই দেখতে পায় না।

মাঘের কড়া শীতের এক সন্ধ্যেতে হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। নির্জন রাস্তা ধরে, টিউশন সেরে ফেরার পথে ভয় পেয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তা ভুল করেছিলাম। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো সে উপায় না দেখে আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। সেই সময়ে আকাশের বিদ্যুৎ-চমকের আলোতে দেখলাম, আমার চাইতে সামান্য বয়েসে বড়ো একটি ছেলে হাতে একটি বাঁশি নিয়ে আমার আগে আগে চলেছে । আর একবার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখি, মধুর মতো তার গায়ের রঙ, মাথাভর্তি কালো কোঁকড়ানো চুল সুন্দর চুড়ো করে বাঁধা। তার মুখে, দারুণ এক ভুবন-ভোলানো, মিষ্টি হাসি। সে, তার সঙ্গের বাঁশির মতো মিষ্টিস্বরে, আমায় বলে, “ভয় পেয়ো না । আমি তোমায় বাড়ির পথে এগিয়ে দিচ্ছি।”

বাড়ির পথে যেতে যেতে, তার সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি তাকে মধুদাদা বলে ডাকবার অনুমতি নিয়ে নিলাম। বাড়ির  সামনে এসে সে বিদায় নেবার সময় বললে, 
“আমি তোমার সখা। যখনই কোনো বিপদে পড়বে, আমায় ডাক দিলেই আমি আসবো তোমার কাছে।”
সেই থেকে স্কুলের হোমটাস্ক না করতে পারলে, ক্লাসে পড়া ভুলে গিয়ে বলতে না পারলে, এমনকি রাত্রে ঘুমাবার সময় গল্পের বা গান শোনবার দরকার হলেও মধুদাদাকে ডাকলেই, সে সঙ্গে-সঙ্গে হাজির হয়ে মিষ্টি হেসে,যা চাই তাইই দিয়ে দেয়।

মধুদাদার সাথে সবচাইতে বড়ো সুবিধে হল, যে ডাকে সে ছাড়া আর কেউ তাকে দেখতে বা শুনতে পায় না। এইজন্য সব জায়গাতেই ওকে ডাকা যায়।

উৎসবের এইবারের স্বেচ্ছাসেবী ভালুকমামা সপরিবারে আর হনুমান বাহিনীর ছেলেবুড়ো সবাই। বাঁদরের দল, যারা একটু আগে ড্রাইভারদাদার দুর্দশা দেখে খিক খিক করে হাসছিল, তারা গাছে-গাছে লাফাতে-লাফাতে আমাদের পৌঁছে দিলে চারপাশে গাছে ঘেরা একটা ফুটবল খেলার মতো বিরাট মাঠে।


মনে হচ্ছে বাসটা আমাদের নামিয়ে দেবার পর এই মাঠটার কথাই বলেছিল বোধ হয়। থেকে-থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে যে দিক থেকে, সেই দিকে একটু উঁকি দিতেই একটা নদী দেখা যাচ্ছিল । বুঝলাম এর কাছেই সেই ঢালু রাস্তাটা, যেটা সামলাতে পারবে না বলে বাসটা বলছিল বটে।

বড়ো হনুমানেরা একটা বড়ো গাছের তলায় আমাদেরকে বসতে ইশারা করে একঝাঁক সবুজরঙের তোতাপাখিদের আমাদের সঙ্গী হতে বলে গেল। সব গাছেই দেখি নানারকম পাখিতে-পাখিতে ছয়লাপ। অনেকদিন পরে সব দেখা হয়েছে, কিচিরমিচির করলেও আমরা অনেকেই তাদের কথা বুঝতে পারি। ওদের আলাপ শুনে আমাদের অনেকেরই বেশ মজা লাগছিল। এরা আকাশপথে এসেছে বলে সবার আগে পৌঁছে গেছে।

এদের কিচির-মিচির বাড়লে দেখি গাছে-গাছে দোল খেয়ে অন্য অরণ্যের বড় বড় হনুমানেরা আসছে। তাদের সাথে সাথে রয়েছে কাঠবিড়ালির দল। এরা আসতে না আসতেই দেখি জঙ্গলের পূর্ব আর দক্ষিণকোণে ধুলোর ঝড় উঠেছে। তবে কি এখন ঝড়-বাদল শুরু হবে নাকি? আমাদের আশ্বস্ত করে সবুজ তোতাদের একজন আমাদের বলে, বাইসন আর হরিণের পাল আসছে ওই পথে। খুশির সময় ওরা ওইরকমই দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। আমাদের অবাক করে দিয়ে জঙ্গলের জলার ধার থেকে আসে অনেকগুলো শেয়ালের দল। সারারাত জেগেও এদের উৎসাহ কম কিছু নয়।

এইভাবেই সব অরণ্যবাসীরা তাদের নিজের-নিজের এলাকা থেকে দলবেঁধে এসে পৌঁছচ্ছে মেলার জায়গায়। জঙ্গলের একমাত্র বাঘের পরিবারও এলো, তবে সবার শেষে, হাই তুলতে-তুলতে। তাদের ঠোঁটে আর গোঁফে টাটকা দুধের সর লেগে রয়েছে। ভালুক মামার পরিবার আর হনুমানেরা, সবাই লেগে পড়েছে অংশগ্রহণকারীদের জমায়েত হবার জায়গা আর দর্শকদের বসবার জায়গা দেখাতে। কোন দলের লোকেরা কোথায় বসবে সেই নিয়ম আমাদের সাথে থাকা তোতাপাখিরা বুঝিয়ে বলছিল।

জঙ্গলের সবাই এলো, কিন্তু হাতিরা কেন এল না এখনো? এই অরণ্যে তাহলে কি হাতিরা থাকে না? সর্দার-তোতা হাসতে-হাসতে আমাদের বলে, “ওরা এখন আসে কী করে? এইবার ওরা হয়েছে রাজা মধুসূদনের বাহন। ওরা সবাই এইসময়ে নদীর জলে স্নান করে পরিষ্কার হবার কাজে ব্যস্ত।”


সর্দার-তোতার বউ রানি-তোতা খুব মিষ্টি দেখতে, আর তেমনি তার গলার সুর। আজকের এই খেলার সব নিয়মকানুন আমাদেরকে বুঝিয়ে বলছিল, কথায় আর গানে মিলিয়ে- মিশিয়ে। রানী-তোতা বলছিল,
“রাজা বলেছেন, আমরা এই মেলায় আসবো মজা আর আনন্দ করতে, জিততে বা হারতে নয়। সেজন্য যে যাতে ভালো নয় সে তাই করে দেখাবে। আমরা সব পাখিরা এবং নদীর কাছিমেরা দৌড়াবো। সেই দৌড়ে এতটুকুও লাফানো বা ওড়া চলবে না। হাতি আর হরিণ সাঁতার কেটে দেখাবে নদীতে।”

টুম্পা শুনে বলে,
“বেশ মজা হবে তো!"
লিকলিকে কঞ্চিবাঁশের মতো অরিন্দম তুখোড় সাঁতারু। মোটা দেবুকে দেখিয়ে নিরীহ গলায় বললে, 
“সেই দলে দেবু থাকলে বেশ হতো”। 
আমাদের সমবেত হাসির রোলকে থামবার ইশারা করে সর্দার-তোতা বলে, “হলুদ পাখির দল দাঁতালো হাতি এবং তার পুরো দলকে দেখতে পেয়ে গেছে। তারা দেখেছে, দাঁতালো হাতির পিঠে চড়ে রাজা মধুসূদন এইমাত্র জংগলের পদ্মদিঘি পার করে, এই মেলার মাঠে আসছেন।”

দু’মিনিট যেতে না যেতেই, উড়ন্ত হলুদ পাখিদের দেখা গেল মাঠের সীমানাতে। তারা প্রায় আমাদের মাথার সমান-সমান উঁচুতে আসতেই দেখা গেল মাঠের ঠিক পূর্বদিকে একটি বড়ো কালো বিন্দু। সামান্য পরেই দেখা গেল একটি দাঁতালের কিছুটা আভাস আর তার সাথে ভেসে এলো বাঁশির সুমধুর আওয়াজ। এইবার পরিষ্কার দেখা গেল পুরো হাতি পরিবারকে। সামনে দাঁতাল হাতি, তার পেছনে রানি হাতি, আর রানি হাতির দু'পাশে সার করে তাদের শাবকেরা। দাঁতালের পিঠে যে চড়ে আছে, তাকে এতদূর থেকে পরিষ্কার দেখা না গেলেও তার বাঁশির মিঠে সুর ভেসে আসছিল আর সবাই শিহরিত হয়ে উঠছিলাম।

রানি-তোতা একটু চড়ায় উঠে ধরলে, 
“ তুমি স্বাগত, তুমি স্বাগত/ হে রাজা এসো প্রিয়বান্ধব শ্রী মধুসূদন”।

আর সেই সুরে তাল মিলিয়ে জঙ্গলের সব প্রাণীরা একসাথে বলে উঠলো,
“এসো রাজা মধুসূদন, আজ সবাই দেখি তোমায় প্রাণভরে”। 

হাতি পরিবার মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে।সবাই তাঁকে দেখবার জন্য অস্থির হয়ে পড়ছে। এই দেখে রাজা নিজেই দাঁড়ালেন দাঁতালের পিঠে। তাঁর পরনে সোনার জরির পাড়ের পীতবর্ণের রেশমি ধুতি, গায়ে হাল্কা সোনালি-হলুদ রঙের উড়নি, চুড়ো করে বাঁধা কালো কোঁকড়ানো চুলে গোঁজা আছে ময়ূরের পালক। এই রাজবেশ দেখতে-দেখতে তাঁর মুখপানে চেয়ে থমকে গেলাম, আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল । মধুর মতো রঙের সেই মিষ্টি ভুবন-ভোলানো হাসিমাখা মুখ আর চোখে সেই মায়াবী দৃষ্টি, এ তো আমার মধুদাদা! সে আবার শ্রীমধুসূদন হয়ে এই জঙ্গলের রাজা হল কবে?

দাঁতাল হাতি রাজাকে নামাবার জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু উনি আমাদের দেখতে পেয়ে ঠিক আমাদের সামনেই হাতির শুঁড় বেয়ে নেমে পড়লেন। হনুমান বাহিনী আর ভালুক মামা সপরিবারে এগিয়ে এলেন, রাজাকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে। রাজা, আমাদের দিকে চেয়ে ওদেরকে বললেন, 
“এবার আমি আমার নতুন বন্ধুদের সাথে বসব”।

আমরা যে বটগাছের নিচে বসেছিলাম, তার ঝুরিগুলোকে স্বেচ্ছাসেবীরা চটপট বেঁধে দিয়ে, ওঁর জন্যে একটা দোলনা বানিয়ে দিলেন। দোলনার দিকে যেতে-যেতে, আমার কাছে এসে বললেন, 
“বন্ধু শমীক, তোমার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও”। 

আমি তাহলে ঠিকই ধরেছি, জংগলের রাজাই আমার মধুদাদা। আমার স্কুলের বন্ধুদের সাথে যখন আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, দেখি ভালুক মামা, সর্দার-তোতা আর রানিতোতা,জংগলের আর সবাই, অবাক হয়ে আমায় দেখছে। আমি যে সে লোক নই, জঙ্গলের রাজা শ্রীমধুসূদনের বন্ধু। আলাপ পরিচয়ের পর মধুদাদা আমার কাছে এসে বললে, 
“বন্ধু, আমাকে যে যেমনভাবে চায়, আমি তার কাছে সেইভাবে আসি। সেই রাত্রে তুমি যখন বাড়ীর পথ হারিয়েছিলে, তোমার দরকার ছিল এক বন্ধুর। তাই আমি এসেছিলাম তোমার বন্ধু হয়ে, সাধারণ বেশে । আর এই জঙ্গলের প্রাণীরা আমাকে রাজা হিসেবে পেতে চায়, তাই আমি তাদের কাছে এই রাজবেশে এসেছি”।

 স্বেচ্ছাসেবীরা এইবারে মধুদাদাকে খেলাধুলো এবং আনন্দমেলার উদ্বোধন করতে অনুরোধ করলে।

মধুদাদা বললে, “ আমার মনে হচ্ছে আমরা এইবার সমবেত নৃত্য দিয়ে শুরু করি । একসাথে দুটো জিনিসেরই উদ্বোধন হয়ে যাবে।”
মাদের দিকে চেয়ে মধুদাদা বললে,
“নাচের সময় আমি বাঁশি বাজাবো । তোমাদের মধ্যে, কারা আমার সাথে সঙ্গত করতে চাও?”

নীতিশ বললে, 
“আমরা ক’জনা চেষ্টা করবো সঙ্গত করতে। কিন্তু এইখানে কি আর বাজনার সেইসব জিনিষগুলো পাওয়া যাবে?”
মধুদাদা বললে, “তোমাদের কী কী চাই, তা একবার আমায় বলে তো দ্যাখো? তারপর আমি দেখছি কিছু করা যায় কি না?”

নীতিশের এক বন্ধু বলে উঠলো, “ আমাদের চাই, ঢোলক, বড়ো ড্রাম, বঙ্গো, গীটার আর অ্যাকর্ডিয়ান” ।

আমার খুব রাগ হচ্ছিল ওদের কথা শুনে। কতো তো তোরা বাজাতে পারিস, সে আমাদের সব জানা আছে। এই জংগলের মধ্যে এইসব জিনিষ চেয়ে, মধুদাদাকে বিব্রত করবার কোনো মানে হয়? 
মধুদাদা হেসে বলে, 
“দেখ তো ওই গাছের কোনায়, কী কী সব রাখা আছে । মনে হচ্ছে, তোমরা যা চাইছিলে, তার সবগুলোই ওইখানে আছে। আমি একটু বাজাচ্ছি, তোমরা তাহলে সেই অনুযায়ী যন্ত্রগুলো বেঁধে নাও”।

মধুদাদা একটা সুর বাজাতেই, যারা বাজাবে, তারা তাদের যন্ত্রগুলোতে বেশ চটপট সুর বেঁধে ফেললো। মধুদাদা আর ওরা বাজানো শুরু করতেই ময়ূরের দল তাদের নাচ শুরু করলো। তাদের নাচ দেখে মনে হচ্ছিল যেন হুবহু ছৌ নাচ দেখছি। সেই নাচ দেখে জংগলের সব প্রাণীদের নিজ-নিজ আওয়াজে কী উল্লাস!

গাছের ডালে-ডালে লাফিয়ে-লাফিয়ে ওঠানামা করা কাঠবিড়ালির দল সেই নাচ দেখে আর থাকতে পারলো না। তারা দলে-দলে নেমে আসতেই মধুদাদার ইশারায় ময়ূরের দল থেকে একটু তফাতে থেকে বাজনার তালে-তালে মাটি থেকে উঁচুতে লাফিয়ে আর নেমে এক নতুন ধরনের নাচ দেখাতে শুরু করলে।

সেই দেখে হরিণের দলও এলো নাচতে, আর তারপর বাইসনের পুরো পরিবার। দেখতে-দেখতে মাঠে জমায়েত হয়ে থাকা সব প্রাণীরা নাচে অংশ নিলে। কিন্তু সবাই নিজ- নিজ দলে আর সুশৃঙ্খলভাবে। এমনকি যখন হাতির দলও নাচে অংশ নিলে তখন মাটি কেঁপে উঠছিল ভূমিকম্পের মতো কিন্তু কোনো দলের কিছু অসুবিধে হয়নি। এমনকি এই শৃঙ্খলায় আমরা যারা অনভ্যস্ত তাদেরও না। একটু পরেই সবাই নাচের তালে-তালে নিজেদের অঙ্গ দোলাতে-দোলাতে নিজ-নিজ আওয়াজে বলে উঠছিল,
“মধুসূদন, হে মধুসূদন”।

মধুদাদা এই নাচের দলে একদম কেন্দ্রে থেকে, একের পর এক সুর বাঁশিতে বাজিয়ে চলেছিল আর দারুণ সঙ্গত করছিল আমাদের স্কুলের বাজিয়ের দল।

আমরা নিজেরাও জানি না, কখন আমরাও বাইসন, হরিণ, হাতি, হনুমানদের দলে মিশে গেছি আর দু’হাত তুলে মধুদাদার বাঁশির তালে নেচে চলেছি।

এই সমবেত আনন্দে ডুবে গিয়ে আমাদের মনে জমে থাকা দুঃখ, বেদনা, স্কুলের নির্দয় আর বিরক্তিকর স্মৃতিগুলো কোথায় যেন ধুয়ে-মুছে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আনন্দে শিহরিত হতে-হতে আমরা সবাই বাকিদের সাথে নাচের মাঝে-মাঝেই বলে উঠছিলাম
 “জয় মধুসূদন, হে মধুসূদন”।


হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো আমাদের বাবা,মা, আর স্কুলের স্যারদের, ম্যামদের, আর সবাইকে ছাপিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের চিৎকার। আমাদের নাম ধরে তারা ডেকেই চলেছে। এত মানুষের চিৎকার শুনে জংগলের সব প্রাণীরা ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু মধু দাদা সবাইকে আশ্বস্ত করলে।আমাদের দিকে তিনি হাত তুলে বললেন, “তোমরা, তোমাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরে যাও, আর বাকি সবাই, তোমরা এসো আমার কাছে”।

আমাদের স্কুলবাস যে ঢালু রাস্তায় নিজেকে কোনোমতে সামলে, এই মাঠের এককোণে এসে দাঁড়িয়ে এই আনন্দমেলা দেখছিল, সে এবার টালমাটাল চালে মধুদার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, 
“ হে রাজা শ্রীমধুসূদন, তুমি আমায় রক্ষা কর।আমি যা করেছি, তা আমার বন্ধুদের আনন্দের জন্য। কিন্তু এখন আমাকে দেখতে পেলেই, এই ড্রাইভার আর মেকানিক, খুব নির্দয় ভাবে, আমাকে মারতে-মারতে, মেরেই ফেলবে”।

মধুদাদা তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, 
“তবে তুমিও এসো আমার সাথে। কেউ তোমার কিছু ক্ষতি করতে পারবে না।”

এইকথা শেষ হতে না হতেই, এক লহমায়, আমরা ছাড়া সবাই কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেদিন, বা তার পরেও, আমাদের মা বাবা স্কুলের ম্যাম আর স্যারেরা আমাদেরকে অক্ষত ফিরে পেয়ে এতটাই আনন্দে ডুবে গেছিলেন যে কেউ ভুলেও জিজ্ঞেস করেননি এতটা সময় জংগলে আমরা কী করলাম? আমরাও কেউ কিচ্ছুটি বলিনি আর বললে বিশ্বাসই বা কে করতো? এমনকি পেট-আলগা টুম্পাও একটি কথা বলেনি।

নতুন-বাসটা ঝকঝকে সুন্দর হলে কি হবে, সে একদম বোবা। আমাদের পুরানো স্কুলবাসকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার দুঃখে আমরা সবাই বেশ কয়েকদিন চুপসে গেছিলাম। আমাদের মনঃকষ্ট আর দুঃখ দেখে, মধুদাদা একদিন তার হদিস আমাদের দিল।

এক রবিবারের ছুটির সকালে, আমরা ক'জন সেই জংগলের নদীর ধারে একটা ঝোপে ঢাকা জায়গাতে গিয়ে আমাদের সেই পুরানো বাস বন্ধুর খবর জানতে আর সে কেমন আছে দেখতে গিয়েছিলাম ।সেখানে সে তার নতুন বন্ধুদের নিয়ে খুব ব্যস্ত। নতুন বন্ধুরা মানে বাঁদরেরা, শেয়ালের বাচ্চারা, এমনকি বাঘমামার বাচ্চারা।এরা জংগলে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে বাসের মধ্যে এসে এমন- এমন সব জায়গায় লুকিয়ে পড়ে যে বাকিদের তাদের খুঁজতে খুব নাকাল হতে হয়। এদের সবার এমনকি মাঝে-মধ্যে আমাদেরও লুকোচুরি খেলবার জন্য দারুণ সুন্দর একটা নতুন জায়গা হয়েছে।


(সমাপ্ত)


 অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু

গল্পের ঝুলি : ছুটির ঘন্টা : বিভাবসু দে




টং, টং, টং, টংটংটংটংটং...

ইয়ে, ছুটি ছুটি ! কী মজা !

হইহই করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাগুলো। পিঠে স্কুলব্যাগ। ছুটির ঘন্টা বাজলে আর এদের ধরে রাখে সাধ্যি কার ! সারাটা সকাল যেন এই ঘন্টা বাজার টানা টং-টং শব্দটা শোনার জন্যেই মুখিয়ে থাকে ওরা।

তবে বাকিদের মতো মিলির অত তাড়া নেই। ছুটি হলেও ও ধীরেসুস্থেই বেরোয়, সবার শেষে; আস্তে আস্তে নিজের ব্যাগট্যাগ সব গুছিয়ে নিয়ে। বারদুয়েক আবার দেখেও নেয় কিছু ফেলে-টেলে যাচ্ছে না তো। আসলে শুধু শুধু ওই হুড়োহুড়ি ওর একদম ভাল্লাগে না।

মিলি এবার ক্লাস ফাইভে। নেতাজী সুভাষ বিদ্যানিকেতনের মর্নিং সেকশন। পরের বছর থেকে ও দুপুরের স্কুলে চলে যাবে। ক্লাস টু-তে ভর্তি হয়েছিল এই স্কুলে, তারপর কখন যে হুশ করে তিনটে বছর পেরিয়ে গেল--- এখনও ভাবলে মনে হয় মাত্র যেন এই সেদিনের কথা।

ওদের স্কুলটা ভারী সুন্দর, অনেক পুরোনোও। ১৯৪৮-এ তৈরি। দু-দুটো মাঠ আছে। একটা ভেতরে, একটা বাইরে। বাইরের মেন-গেট দিয়ে ঢুকলে হাতের ডানপাশে পড়ে বড় মাঠটা। মাঠের গায়ে গায়ে পাকা রাস্তা, সোজা এগিয়ে গেছে স্কুলের দালানের দিকে। মিলিদের স্কুলটা দেখতে অনেকটা ওপর-খোলা চৌকো বাক্সের মতো। প্রথমেই একটা বড় লোহার গেট; ঢুকলেই ডানদিকে স্যার-দিদিমণিদের স্টাফরুম, হেড-স্যারের ঘর, অফিসঘর, লাইব্রেরি আর মিড-ডে মিলের রান্নাঘর। বাঁদিকে একটা দোতলা দালান, ওখানেই সব ক্লাস-টাস হয়। মাঝখানে চারকোণা ছোট মাঠটা। সেটা পেরিয়ে সোজা এগোলেই চোখে পড়বে নেতাজীর একটা আবক্ষ মূর্তি আর সেই মূর্তির ঠিক পেছনে সংস্কৃতি ভবন--- সকালবেলা ওখানেই প্রেয়ার-মিট হয় মিলিদের। তাছাড়া পঁচিশে বৈশাখ থেকে স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস, আগমনী, পুরস্কার বিতরণ সব অনুষ্ঠান ওই সংস্কৃতি ভবনেই। এককথায় সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট ওদের স্কুলটা।

কিন্তু এসবের মধ্যেও একজনকে বড্ড আলাদা লাগে মিলির। স্কুলের প্রথমদিন থেকে রোজ দেখে, আর রোজই অবাক হয় ও। ঘন্টা-কাকু ! হ্যাঁ, স্কুলের গ্রুপ-ডি স্টাফ প্রাণতোষবাবুকে বাচ্চারা সবাই ওই নামেই ডাকে। মিলিও।

রোগ-ছিপছিপে, লম্বাটে গড়ন, মাথায় প্রায় সব চুলই সাদা। তামাটে গায়ের রঙ, ঘিয়া শার্ট আর টেরিকটের প্যাণ্ট। শীতের দিনে তার ওপরে সোয়েটার আর কানঢাকা টুপি। খুব বেশি কথা না বললেও, মুখে সবসময় যেন একটুকরো হাসি লেগেই আছে।

মিলিদের স্কুল গরমদিনে শুরু ভোর ছ'টায় আর শীতের দিনে সাড়ে ছ'টায়, কিন্তু শীত গ্রীষ্ম নির্বিশেষে ঘন্টা-কাকু কিন্তু সবসময় সবার আগে এসে হাজির। এই তিনবছরে একদিনও ওঁকে ছুটি নিতে দেখেনি মিলি। ঘন্টা-কাকুর কি জ্বর-সর্দি কিছুই হয় না ?

রোজ নিয়ম করে সবার আগে এসে স্কুলের গেট খোলে, তারপর এক এক করে সবগুলো ক্লাসরুম, স্টাফরুম, সংস্কৃতি ভবন, সব। কিছুক্ষণ পর, যখন প্রায় সবাই এসে পড়ে, ঘন্টা-কাকু ওয়ার্নিং-এর ঘন্টা বাজায়। টং...টং...টং ! সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারা প্রতিটা ক্লাসরুম থেকে আস্তে আস্তে সার বেঁধে বেরিয়ে চলে যায় সংস্কৃতি ভবনে, প্রেয়ারের লাইনে। স্যার-দিদিমণিরাও। সবার সামনে দাঁড়ান হেড স্যার। ওয়ার্নিং-এর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ে। টং ! সবাই একসঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গায়। গান শেষ হলে আবার লাইন করে যে যার ক্লাসে। শুরু হয় পড়াশুনো। কোনওদিন একচুলও নড়চড় হয় না ঘন্টা-কাকুর ঘন্টা বাজানোয়।

মিলিদের প্রথম ক্লাসটাই হেড স্যারের, ইংরেজি পড়ান। বেজায় কড়া লোক। লম্বা, পেটানো গড়ন, টিকালো নাকের তলায় সরু গোঁফ। হেড স্যারের মুখে আজ অব্দি হাসি দেখেনি মিলি। এই ক্লাসে যেন সময় কাটতেই চায় না ওর। দু'চোখ বারবার চলে যায় ওপাশের স্টাফরুমের দিকে, যেখানে কাঠের বর্গার গায়ে ঝুলে আছে কালচে হয়ে আসা পেতলের গোল ঘন্টাটা। আর দরজার পাশে কাঠের হাতুড়ি। কখন যে ঘন্টা-কাকু আসবে, আর টং করে ঘা দেবে ওটার গায়ে ! মিলি মাঝে মাঝে ভাবে ঘন্টা-কাকুকে একদিন গিয়ে বলবে, প্রথম ক্লাসটা একটু ছোট করে দিতে। আগেভাগে ঘন্টা বাজিয়ে দিলেই তো তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ !

প্রথম ক্লাসের পর একটা ঘন্টা বাজে--- টং ! হেড স্যার বেরিয়ে যান। আসেন অঙ্কের গৌতম স্যার। এই স্যার খুব ভালো, একফোঁটা রাগ নেই। বকেন না, মারেন না, কান ধরে বেঞ্চের ওপর খাড়া করান না। কী সুন্দর করে প্রতিটা অঙ্ক ধরে ধরে বুঝিয়ে দেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসটা যে কখন ফুরিয়ে যায় টেরই পায় না মিলি। ইংরেজিটা একটু কমিয়ে বরং এই ক্লাসটা আরও লম্বা করে দিলে কী ক্ষতিটা হয় ? ঘন্টা-কাকু কেন যে বোঝে না ! ঠিক সেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরেই ঘন্টা বাজিয়ে দেয়--- টং-টং !


মিলি একটা জিনিস খেয়াল করেছে, ঘন্টা-কাকুর হাতে ঘড়ি নেই তবু কক্ষনও সময় ভুল হয় না ! এমনকী কোন ক্লাসের পর ক'বার ঘন্টায় ঘা পড়বে, সেটাও গুলিয়ে ফেলে না কোনওদিন। আর ছুটির ঘন্টা--- রোজ ঠিক সেই একই আওয়াজ, ঠিক একইভাবে টংটংটংটংটং ! কখনও এতটুকু এদিক-ওদিক হয় না ঘন্টা বাজানোর এই তাল। ভীষণ অবাক লাগে ওর।

মিলির মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয়, ঘন্টা-কাকু যদি কোনওদিন স্কুলে না আসে তবে কী বিপদটাই না হবে ! ইংরেজির রাগী রাগী হেড স্যার হয়তো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বদলে এক কি দেড়ঘন্টা কিংবা হয়তো গোটা দিনই ইংরেজি পড়িয়ে ফেললেন ! পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই মিলির মনে হয় ক্লাস ছেড়ে পালায়, আর আস্ত দিন ! উফ, ভাবলেও যেন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে ওর !

ঘন্টা-কাকু না থাকলে স্কুলের স্যার-দিদিমণিরাও তো বুঝবে না কার কখন ক্লাস। হয়তো অনিতা দিদিমণি সমাজবিদ্যা পড়াচ্ছেন, আর তাঁর ক্লাসের মাঝখানেই এসে ঢুকে পড়লেন বিজ্ঞানের অম্লান স্যার ! তারপরে দুজনে রীতিমত তর্কাতর্কি বেঁধে গেল যে এখন ক্লাসটা আসলে কার !

আর পরীক্ষার সময় ? কতবার এমন হয়েছে মিলি একটা প্রশ্নের উত্তর লিখছে তো লিখছেই, সময়ের হুঁশই নেই ! তখনই হঠাৎ, টং ! মানে একঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এদিকে মিলির এখনও বিস্তর বাকি--- কিন্তু হাতে আর মাত্র দুইঘন্টা। তাড়াতাড়ি যেমন-তেমন করে হাতের প্রশ্নটা শেষ করেই পরের প্রশ্নে ছুটেছে মিলি। ঘন্টা-কাকু ঘন্টা না বাজালে হয়তো ওই এক প্রশ্ন নিয়েই আড়াই ঘন্টা কাটিয়ে দিত ও !

কিন্তু ঘন্টা-কাকু না এলে সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার যেটা হবে তা হল, টংটংটংটং করে ছুটির ঘন্টাটাই তো বাজবে না ! ছুটি নেই, শুধু পড়া আর পড়া ! উফ, কী দুঃস্বপ্ন !


কিন্তু মিলি ভাবতেই পারেনি, একদিন আসলেই এই দুঃস্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাবে। সেদিন ছিল সোমবার। নভেম্বরের শেষদিক, তাই স্কুল শুরু হয় সাড়ে ছ'টায়। তবে ক্লাস আর বেশি দিন নেই, কারণ ক'দিন পর থেকেই পরীক্ষার ছুটি পড়ে যাবে। সামনেই অ্যান্যুয়াল পরীক্ষা।

তা সেদিনও স্কুলে ঢুকবার সময় ঘন্টা-কাকুকে দেখল মিলি, স্টাফরুমের দরজা খুলছে। ঘন্টা-কাকু হাসলও ওকে দেখে, সামনাসামনি পড়লে প্রায়ই যেমনটা হাসে। তারপর মিলি ব্যাগ কাঁধে রোজকার মতোই চলে গেল ওর ক্লাসে। কিছুক্ষণ পর ওয়ার্নিং, তারপর প্রেয়ারের ঘন্টা। প্রেয়ারও হল, যেমনটা হয় রোজ।

হেড স্যার এলেন, টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট একটা ইংরেজি কবিতা বোঝালেন। মিলি চার আনা বুঝল আর বাকি বারো আনা ওর মাথার ওপর দিয়ে কাগজের এরোপ্লেনের মতো হুঁই করে উড়ে চলে গেল ! ঘন্টা বাজল, টং। আহ, শান্তি ! গৌতম স্যার এলেন। স্যারের সিলেবাস শেষ, এখন শুধু রিভিশন চলছে। এসে অঙ্ক করতে দেন, আর যার যেখানে সমস্যা, বুঝিয়ে দেন। মজায় মজায় কেটে গেল আরও পঁয়তাল্লিশটা মিনিট। টংটং !

টিফিন ব্রেকের পর আরও দুটো ক্লাস। বাংলা আর বিজ্ঞান। কিন্তু আজব ব্যাপারটা ঘটল শেষ ক্লাসেই। বেশ কিছুক্ষণ পড়াবার পর অম্লান স্যার একবার ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, "সময় হয়ে গেছে, ছুটি।"

সবাই অবাক। মিলিও। ঘন্টা বাজল না যে এখনও ! স্যার বোধহয় ওদের মনের কথা বুঝেই বললেন, "আজ আসলে প্রাণতোষবাবুর চাকরির শেষ দিন। আজ থেকে ওঁর অবসর। তাই ছুটির ঘন্টা বাজানো হবে না আজকে। তোরা সবাই যাবার সময় লাইন করে স্টাফরুমের সামনে দিয়ে যাবি, প্রাণতোষবাবুকে প্রণাম করে।"

কিছুক্ষণ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেই পারল না মিলি। চাকরির শেষ দিন ! অবসর ! তবে কি ঘন্টা-কাকু আর ঘন্টা বাজাতে আসবে না ? তাহলে ক্লাস শেষ হবে কীভাবে ? প্রেয়ার, ওয়ার্নিং, ছুটি ? ঘন্টা-কাকুকে নিয়ে এতদিনের সব চিন্তাগুলো যেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একসঙ্গে ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল মিলির মাথায়। আর ক'দিন পরেই তো পরীক্ষা, তখন সময়মতো কাকু ঘন্টা না বাজালে কী করবে ও ?

"এই মিলি, চল।" তৃণার ডাকে হঠাৎ হুঁশ ফিরল মিলির, সবাই প্রায় বেরিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বই-খাতা ব্যাগে ভরে সেও উঠে পড়ল। ছোট ক্লাসের বাচ্চারা চলে গেছে, এবার ওদের ক্লাস থেকে লাইন করে সবাই হেঁটে যাচ্ছে ওপাশের স্টাফরুমের দিকে। মিলি গলা বাড়িয়ে দেখল, ঘন্টা-কাকু অফিসঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে হেড স্যার। সবাই ঘন্টা-কাকুকে প্রণাম করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘন্টা-কাকুর মুখে রোজকার মতোই সেই ঝলমলে হাসি। কিন্তু একটু যেন অন্যরকম। ঠিক বুঝতে পারল না মিলি।

আজ থেকে ঘন্টা-কাকুর ছুটি ! ছুটি হলে সবাই যেমন খুশি হয়, কাকুও বোধহয় আজ তেমনি খুব খুশি। কিন্তু ঘন্টা-কাকুর কি একবারও এই স্কুল, ওই গোল ঘন্টা, কাঠের হাতুড়ির কথা মনে পড়বে না বাড়ি গিয়ে ?

মিলি এগিয়ে গেল। তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল ঘন্টা-কাকুকে, যেমনটা সবাই করছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের লাইন। কিন্তু গেটের পাশে গিয়ে হঠাৎ কেমন যেন থমকে গেল মিলি। চকচক করে উঠল ওর চোখদুটো।


সবার প্রণাম করা শেষ। প্রাণতোষবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তখন আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছেন হেড স্যার।

টং, টং, টং, টংটংটংটংটং...

চমকে পেছন ফিরলেন প্রাণতোষবাবু। সঙ্গে হেড স্যারও। বাচ্চা মেয়েটা দুইহাতে কাঠের ভারী হাতুড়িটা উঁচিয়ে ধরে ঘন্টা বাজাচ্ছে। ছুটির ঘন্টা।

প্রাণতোষবাবু এসে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালেন মিলির পাশে। মুখে হালকা হাসির রেখা। "কী গো, হঠাৎ ঘন্টা বাজাচ্ছ কেন ?"

"আজ থেকে যে তোমার ছুটি, তাই। তুমি তো সবার জন্যে বাজাও, তাই আমিও..."

কথাটা আর শেষ করতে পারল না মিলি। ওকে বুকে চেপে ধরলেন প্রাণতোষবাবু। ওর ঘন্টা-কাকু। মিলি অবাক হয়ে দেখল ঘন্টা-কাকুর সেই ঝলমলে হাসিটা একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : আবির

গল্পের ঝুলি : অন্য রকম ছুটি : মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস




"সবাই বেড়াতে যাচ্ছে মা, আমরা যাব না?" ঝিনুক আর শঙ্খ দুই যমজ ভাইবোন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে৷ 

মা বলেন, "ছাড়, ছাড়, পড়তে বস৷" 

"উফ্ মা, সবে তো ছুটি পড়লো, চলো না মা, কোথাও যাই আমরা৷ এই পাড়ার গুবলু রনি শিনা ওরা কেউ আত্মীয় বাড়ি, কেউ ঠান্ডা টুরিস্ট স্পটে গেছে৷ যারা এখনও যায় নি, তারাও যাবে যাবে করছে এক দু'দিনের মধ্যে৷ আর আমরা যাবো না, মা?"

মা সবই জানেন কিন্তু মায়ের হাত পা বাঁধা৷ ঝিনুক আর শঙ্খর বাবা অফিসের কাজে দিন দশেকের জন্য বাইরে৷ ওদের ঠাম্মি গত কয়েক মাস যাবৎ শয্যাশায়ী৷ না হলে বাবা দু'দিন ছুটি নিয়ে হয়ত মাকে বলতেন ওদের নিয়ে আশেপাশে কোথাও দু একবেলার জন্য ঘুরে আসতে৷ কিন্তু তার কোনোও উপায় নেই৷

মা বলেন, "ছুটি মানে কি শুধু বাইরে বেড়াতে যাওয়া না কি? ছুটির মজা বাড়িতেও হয়৷"

মুখ গোঁজ হয়ে যায় শঙ্খের৷ ঝিনুক রাগ করে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে বসে জোরে জোরে পা নাড়াতে নাড়াতে দূরে রাস্তার বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ 

ঐ বাঁকের পাশে একটা ছোট্ট খোলা জায়গা আছে৷ পাশে একটা বড় পুকুর৷ পানায় ঢাকা৷ ঐখানেই ওদের বিকেলটা কাটে৷ মানে যাদের টিউশনি বা অন্য কিছু করার থাকে না বিকেলে তারা এসে জোটে ইস্কুলের পর৷ বার বার বল পড়ে যায় পানার দঙ্গলে আর ভাবতে হাসি পায় লম্বা বাঁশটাঁশ এনে বল খুঁজে বার করতে করতেই হঠাৎ টুপ করে সূর্যমামা পুকুরের পশ্চিম পাড়ের নির্মীয়মান বহুতলটার পেছনে টুপ করে হারিয়ে যায়৷ ঐ বহুতলটা কয়েক বছর ধরে আধখাপচা হয়ে পড়ে আছে কেন কে জানে! ঝিনুকের বাবা বলেন, "যতদিন না হয় ততদিনই ভাল৷ শেষ হলেই তো পাড়াতে লোকজন আর হৈ হল্লা আরও বেড়ে যাবে৷"

সন্ধের মুখে ঠাম্মির ঘরের আয়াপিসি এল৷ মা ফ্রেশ হয়ে এসে সন্ধ্যা জ্বেলে ডাক দিল ওদের৷ গরম গরম পেঁয়াজি আর মুড়ি ওদের ভীষণ ভাল লাগে৷ মা বাইরের খাবার খুব বেশি কিনে দিতে পছন্দ করেন না৷ মাথা ঠান্ডা হয়েছে দেখে মা বললেন, "শোন, তোরা যদি ইচ্ছে করিস ছুটিটা শুয়ে বসে কাটাবি না তবে তোদেরই ভাবতে হবে তোরা কী করবি৷ এমন কিছু কর এ ক'দিনে যাতে তোদের বন্ধুরা ছুটির শেষে ফিরে তোদের গল্প শুনে বোঝে তোদের ছুটিটা সব থেকে ভাল কেটেছে৷ তার জন্য ঠিকঠাক প্ল্যান করে যদি আমাকে শোনাতে পারিস তবে প্রয়োজনে আমার পূর্ণ সহযোগিতা পাবি৷"

ছুটি চলছে ঠিকই কিন্তু ছোট থেকে বাবার নির্দেশ, অন্ততঃ হাতের লেখা, অল্পস্বল্প অঙ্ক আর ইস্কুলের ছুটির পড়া করতেই হবে৷ আজ কিন্তু পড়তে বসে দুইজনে আলোচনায় মেতে গেল কিভাবে নতুন কিছু মজা এবার ছুটিতে করা যায়৷
কত রকম প্ল্যান আসে মাথাতে৷ 

শঙ্খ বললো, "আচ্ছা, আমরা যদি কার্ড ডিজাইন করি, তারপর পুজোর আগে স্কুলের বন্ধুদের কাছে বিক্রি করব বিজয়ার গ্রিটিংস হিসাবে৷ আর যা টাকা পাবো তা দিয়ে বাগদীপাড়ার ছোটদের নতুন জামা কিনে দেব পুজোর জন্য৷" 
বাগদীপাড়া থেকে ঝর্ণামাসি ওদের বাড়ি আসে ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করার জন্য৷ ওঁর মুখেই শোনে ও পাড়াতে অনেকেরই খুব দারিদ্র্য
ঝিনুক বলে, "তাহলে তাই করি৷ কালই আমাদের ভাঁড় ভেঙে টাকা বার করব৷ অনেক আর্ট পেপার আর রঙ লাগবে৷ মায়ের কাছেও কিছু চাইতে হবে৷"
"আচ্ছা, যদি আমাদের কার্ড বিক্রি না হয় ? তবে কী হবে?"
"কেন হবে না? সবাই আমাদের আঁকার কত তারিফ করে৷"

তারপর রাতের খাওয়া থেকে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আরও কত রকম আইডিয়া ওদের মাথায় এল তার ঠিক নেই৷ মা এখন ঠাম্মির ঘরের সামনেটাতেই সোফাতে৷ আয়ামাসি থাকলেও মায়ের দরকার থাকে৷ দুই ভাইবোন আলোচনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল কখন৷

ভোর ভোর কাউকে না বলেই ওরা দরজা খুলে চলে এল খেলার জায়গায়৷ সঙ্গে এনেছে মাটি-খুপড়ি আর ভাঙা বালতি একটা৷ গরমকাল যদিও এখন, মাঝে মধ্যে কালবৈশাখীর দাপটে ভেজে মাটি৷ তাই বড় বড় ঘাসে, আকন্দ বনতুলসির ঝোপে জায়গাটা বড় অপরিচ্ছন্ন৷ আর হয়ে আছে গোছা গোছা পার্থেনিয়াম৷ খোলা জায়গায় পুকুর ধারে হয়ে থাকা এই গাছগুলো নাকি দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা ছিল৷ কোনোভাবে ভারতে এসে পড়া সহজে বেড়ে ওঠা এই গাছগুলো বিষাক্ত৷ 

ওরা ঠিক করে ফেলেছে এগুলো রাখা চলবে না৷ তাই সাফ করতে লেগে পড়ল৷ ওরা কাজ করছে এমন সময় একজন পথচারী এসে দাঁড়ালেন৷ 

"কী করছ তোমরা?"

"আমরা এসব আবর্জনা সাফ করছি৷ আমরা বন্ধুরা এখানে খেলি তো৷ শুনেছি এসব গাছপালা ক্ষতিকারক৷"
"তোমরা একা পারবে?"
"একদিনে তো পারব না৷ আস্তে আস্তে করে ফেলব৷"

ওরা যতটা পারল সাফ করে বাড়ি চলে গেল৷ এবার ব্রেকফাস্ট না করলে মা বকবে৷
মাকে ওরা প্ল্যানটা জানালো মোটামুটি৷ মা উৎসাহ দিলেন৷ যদিও নিজেও ভাবছিলেন ওরা এত ভারী কাজ করে উঠতে পারবে কি না৷
বাইরে প্রচন্ড রোদ এখন৷ তাই আর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ সামান্য পড়া করে নিয়ে ওরা বাড়িতেই কাজে লেগে পড়ে৷ অব্যবহৃত গোয়ালঘরটাতে নানা যন্ত্রপাতি ও টুকটাক জিনিসপত্র রাখে বাবা৷ ওরা একটা শক্তপোক্ত কাঠের তক্তা খুঁজে নিয়ে করাত চালিয়ে মাপমত কেটে নাইলন দড়ি দিয়ে দুই ধার বাঁধল৷
পরের দু এক দিনও ওরা সকাল সকাল কিছুটা সাফাই করতে পারল জমিটা৷ একদিন দুপুরে খাওয়ার পর প্রচন্ড ঝড় উঠল৷ ঝড় থামলেও বৃষ্টি আর থামেই না৷ ওরা খুশিই হল৷ মাটিও আলগা হল আর গরম কমল৷ কাজের সুবিধা হবে৷
পরদিন সকালে মাঠে গিয়ে অবাক৷ বাকি আগাছা ঘাসটাস সব কে যেন সাফ করে দিয়েছে৷ বেশ ঝকঝকে লাগছে জায়গাটা৷ ওরা একটু অবাক হয়ে পরবর্তী কাজ নিয়ে আলোচনা করছে এমন সময় গতদিনের আগন্তুক এসে হাজির৷
"কেমন? পছন্দ হয়েছে?"
"মানে?" ওদের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে কথাটা৷
"তোমাদের দেখে আমার মনে হল ভদ্রঘরের ছেলেপুলে, এসব কাজে অভ্যাস নেই৷ অথচ একটা কাজের মত কাজ করছো৷ কাল আমার তাঁতের কাজ বন্ধ ছিল৷ আমি দুপুরবেলা এসে সব সাফ করে গেছি৷ কাজে যাওয়ার পথে তোমাদের সাথে দেখা হয়ে ভালই হল৷ বাড়ি তো চিনি না যে কথাটা বলে যাব৷"

প্রচন্ড খুশি আর কৃতজ্ঞতা কিভাবে প্রকাশ করবে বুঝতে না পেরে শঙ্খ তো মানুষটাকে জড়িয়ে ধরল৷ ওদের বাড়ির দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে ঝিনুক বলল উনি যেন ওদের বাড়ি গিয়ে বাবা মার সাথে আলাপ করে যান৷ জানা গেল মানুষটির নাম সিদ্ধেশ্বর সাধু৷

সিদ্ধেশ্বর কাকু চলে যাবার পর ঝিনুক খেয়াল করল পুকুরের একদম গা ঘেঁষে কচুপাতারা যেখানে পিটুলি গাছের নিচে মাথা তুলেছে সেখানে পড়ে আছে ইতস্তত প্ল্যাস্টিক পলিথিন৷

"দেখছিস ঐ লাল বাড়ির ফিঙে ঠাকমা আবার জানালা থেকে এঁটো কাটা আবর্জনা প্ল্যাস্টিকে মুড়ে ফেলছে৷"
"ধুর, বুড়িটা কারোর কথা শোনে না৷ ওকে দীনেশ জেঠু সেদিন বারণ করেছিল৷ কী সব যাচ্ছেতাই গালাগালি দিল জানিস? ওগুলো তো দেখতেও খারাপ লাগে৷ আর তারপর পুকুরে ভেসে গিয়ে আরও যাচ্ছেতাই হচ্ছে৷"

ততক্ষণে ঝিনুক গলি ধরে হাঁটা দিয়েছে লালবাড়িটার প্রবেশ পথের দিকে৷ বাধ্য হয়েই পিছু নেয় শঙ্খ৷
"ঠাকমা, ঠাকমা...." ডাক দেয় দরজা থেকে৷
বুড়ির সাত কূলে কেউ নেই মনে হয় কারণ বাড়িতে আর কাউকে ঢুকতে বার হতে দেখে না৷ বুড়ি অবশ্য মাঝেমধ্যে দোকান বাজার করে৷ একা একা থেকেই কি না কে জানে খুব খিটখিটে৷ কিছু বলতে গেলেই গালাগাল দেয়৷ সবাই যেন ওর শত্রু৷
ডাকাডাকিতে বুড়ি দরজা খুলে অবাক চোখে তাকায়৷
"সেন বৌদির নাতি নাতনি না?"
চেনে তবে! শঙ্খ মুখে বলে, "হ্যাঁ৷"
"তা, কী মনে করে?"
আমতা আমতা করে বলেই ফেলে ঝিনুক যা মাথায় আসে, " না, বলছি, ভাল আছেন?"

এবার সুর চড়ে বুড়ির, " এ পাড়ায় কে আর আমার খবর নেয়? আমি যে আছি একথাটাই কারো মনে থাকে?"

শঙ্খ সামাল দেয়, " আসলে আমাদের ছুটি তো৷ ভাবলাম আপনার খবর নিই৷ আমাদের ঠাম্মি তো খুবই অসুস্হ৷ উনিই আমাদের গল্প বলতেন৷ বাবা মায়ের তো এসব সময় নেই৷ আপনি আমাদের গল্প শোনাবেন?"

বুড়ির মুখের অবাক ভাব কাটেই না৷ বলে, "বলি কী যে বলছো, মাথাতেই ঢুকছে না৷ ওই মোড়াটায় বসে বল দেখি৷"

দুই ভাই বোন ভাঙাচোরা মোড়া আর মেঝেতে বসেই পড়ল৷ ঘন্টাখানেক পর যখন ওরা বাতাসা চিবোতে চিবোতে বাইরে এল তখন মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি৷ ফিঙে ঠাকমা কথা দিয়েছেন আর পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন করবেন না৷ তাছাড়া বিকেল বেলায় খেলার জায়গায় এসে ওদের সাথে সময় কাটাবেন৷ গল্প করবেন৷"

বাড়ি ফিরে এসে এসব কথা মাকে বিস্তারিত বলল৷ মা তো হেসে বাঁচেন না৷ তোরা ঐ পাগলি ফিঙে পিসিমাকেও শায়েস্তা করে এলি?"
"হ্যাঁ, তবে বড়দেরও বলে দেবে কিন্তু যেন অকারণে ওঁর পেছনে না লাগে", ঝিনুক বলল৷

মা সময় করে একবার ওদের কান্ড কারখানা পর্যবেক্ষণ করে আসেন৷ মা পাড়ার লোকের কথায় বুঝতে পারেন ছেলেমেয়ের উদ্যোগ অনেকেরই চোখে পড়েছে৷ মা খুশি হয়ে কিছু টাকা দিয়ে ওদের ঝর্ণামাসির সাথে পাঠালেন নার্সারিতে৷

দেখে শুনে মালিকাকুর সাথে পরামর্শ করে ওরা কিনে আনল কিছু গাছের চারা৷ আর আসার সময় পাশের পাড়ার লাল্টুদাকে বলে এল কতগুলো কঞ্চির ঘেরাটোপ বানিয়ে পরেরদিন সকাল বেলা যেন মাঠে পৌঁছে দেয়৷ 

পরদিন ওরা খেলার জায়গার সীমানায় ও পুকুরের ধারে বেশ কিছু বকুল, গন্ধরাজ, কৃষ্ণচূড়ার ছোট গাছ লাগিয়ে দিল ঘেরাটোপের সুরক্ষা দিয়ে৷ পাশের বাড়ির রকিদাদা দেখে নিজের থেকেই এসে ওদের সাথে হাত লাগাল৷ ওদের ভালই হল৷ এরপর দু'বেলা জল দিতে দিতে গাছগুলো বেশ ধরে গেল৷

ইতিমধ্যে বাবাও ফিরে এসেছেন৷ বাবা সব শুনে খুব খুশি৷ মাকে বললেন "তোমারও বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না৷"

মা হেসে বললেন, " আমি সব থেকে বেশি খুশি হব যেদিন ওরা ওদের ঠাম্মির হাত ধরে ওদের সাজানো মাঠটা দেখাতে নিয়ে যেতে পারবে৷"

পরে বাবা ওদের অপটু হাতে বানিয়ে রাখা দোলনা দেখে হেসে গড়াগড়ি৷ কিন্তু নিজেই দোলনাখানা উপযুক্ত করে ওদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে টাঙিয়ে দিলেন পুকুরের ধারে একটা জামগাছের নীচু ডালে৷ 
বললেন, "পুকুরের হাওয়া খেতে খেতে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে যাস না৷ জলে পড়ে যাবি৷"

প্রায় সকলেই ছুটির শেষে ফিরে এসেছে৷ খেলার জায়গাটার এমন ভোল বদলে কী যে অবাক ওরা! অন্যবার সবাই এক জায়গায় হয়ে বেড়ানোর গল্প করে৷ এবার সবাই শঙ্খ আর ঝিনুকের তারিফে অস্হির৷ 

তবে ওরাও বলে দিয়েছে, ভাল বললেই হবে না৷ জায়গাটা যাতে এরকমই ছিমছাম থাকে তার জন্য সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে৷ টুনি গুবলু ঝুমা নন্টে সকলে একসাথে বলছে "নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই৷"


আর টুবাইএর হাত থেকে অতি উত্তেজনায় ছুড়ে দেওয়া চকোলেটের মোড়কটা সযত্নে কুড়িয়ে হাতে রেখে ডাব্বু বলল, 
"যেখানে সেখানে এসব আর ফেলা একদমই চলবে না—আনন্দে রাগে দুঃখে কোনো কোনো অবস্হাতেই নয়৷ সকলে একথা শুনেহো হো করে হাসতে হাসতে পরিষ্কার মাঠে গড়াগড়ি খেতে লাগল৷

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

লোককাহিনী : রক্তচোষা দেবতা : রাজীবকুমার সাহা




​রাজন্য ত্রিপুরার এক্কেবারে গোড়ার দিককার কথা।

​রাজমহিষী হীরাবতী ছিলেন অন্যসব রাজ-অন্তঃপুরবাসিনীদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু অন্দরমহলে শুয়ে বসে দিন কাটাতেন না তিনি। রাজসংসারের নিত্য কাজকর্ম নিজের হাতে করতে পছন্দ করতেন। সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাপন।

​এক আষাঢ়ের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে বর্ষাঘন সন্ধের মুখে তিনি রাজবাড়ি-সংলগ্ন নদীতে নামলেন সান্ধ্যস্নান সারতে। স্নান-শেষে কাঁখের রুপোর কলসি ভরে নেওয়ার উপক্রম করতেই কানে এল মিলিত গলায় এক আর্ত চিৎকার, “রক্ষা করুন, রাজমাতা! রক্ষা করুন আমাদের!”

​তারপর আবার, বারংবার। অথচ চতুর্দিকে কেউ কোথাও নেই। হীরাবতী প্রথমে খানিক হতভম্ব হয়ে গেলেও অচিরেই বুঝে গেলেন, নির্ঘাত বিপদে পড়েই ডাকছে কেউ। রাজমহিষীর সঙ্গে রসিকতা করার মতো প্রজা তাঁর রাজ্যে নেই।

​ঘাট বেয়ে ওঠে তিনি রওনা হলেন সে আর্ত চিৎকারের উৎস সন্ধানে। কিছুদূর এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। দেখেন, একদল প্রজা এক শিমুলগাছকে ঘিরে বেজায় শোরগোল বাধিয়েছে। সে গাছের গুঁড়িতে প্রকাণ্ড দুই শিং বাগিয়ে আঘাতের পর আঘাত হেনে যাচ্ছে কোথাকার এক দৈত্যাকার ষাঁড়। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে সে। শিংয়ের সজোর প্রহারে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে গাছ। আর শিমুলের সুউচ্চ শাখায় শাখায় পরিত্রাহি রব। চৌদ্দ শাখায় বসে থরথর কেঁপে চলেছেন চৌদ্দজনায়।

​রানিমা চোখ তুলে শুধান, “কারা তোমরা? কী তোমাদের পরিচয়?”

​শিমুলের উচ্চতম শাখা থেকে উত্তর আসে, “আমরা চতুর্দশ দেবতা - হর (শঙ্কর), উমা (শঙ্করী), হরি (বিষ্ণু), মা (লক্ষ্মী), বাণী (সরস্বতী), কুমার (কার্তিকেয়), গণপা (গণেশ), বিধি (ব্রহ্মা), ক্ষ্না (পৃথিবী), অব্ধি (সমুদ্র), ভাগীরথী (গঙ্গা), শিখি (অগ্নি), কামদেব (প্রদ্যুম্ন) ও হিমাদ্রি (হিমালয়)।”

​“বেশ। কী চাও?”

​“মুক্তি চাই, রাজমহিষী। এই পাষণ্ড ষাঁড়ের কবল থেকে। তাড়া খেয়ে এই শিমুলগাছে আশ্রয় নিয়েছি। আজ সাতদিন অভুক্ত বসে আছি গাছে।”

​রানিমা ভাবলেন, তাই তো। গত সাতদিন তো ঘোর বর্ষার কারণে নদীঘাটে আসতে পারিনি। নইলে অনেক আগেই চোখে পড়ত এ অঘটন। কিন্তু এই সাতদিনে এ-সংবাদ রাজদরবার অবধি পৌঁছল না, সেও এক আশ্চর্য বটে। মুখে বললেন, “সে কী! তোমরা তো নিজেদের দেবতা বলে পরিচয় দিলে। তবে নিজেরাই এর বিহিত করলে না যে বড়ো! কোথায় তোমাদের দৈববল?”

​দেবতাদের গলায় আক্ষেপ। জবাব আসে, “আমরা বর্তমানে অভিশাপগ্রস্ত রয়েছি, রাজরানি। এক্ষেত্রে আমাদের কোনও দৈববলই কাজে আসবে না। আপনি সাধ্বী নারী। এক আপনিই পারেন আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে।”

​হীরাবতী মুহূর্তকাল ভাবলেন। বললেন, “বেশ। তবে তাই হোক। বলো, কী উপায়ে আমি রক্ষা করতে পারি তোমাদের। যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি।”

​দেবতাগণ সমস্বরে বলে ওঠেন, “আপনি আপনার রিয়া (বক্ষবন্ধনী) ষাঁড়ের চোখে বুলিয়ে তার পিঠে ফেলে দিন। তবেই সে শান্ত হবে; আমরাও গাছ থেকে নেমে আসতে পারব।”

​হীরাবতী উপায় শুনে তৎক্ষণাৎ রাজবাড়ি খবর পাঠিয়ে নিজের একখানা রিয়া, একদল সেপাই-সান্ত্রী আর জনাকতক রাজভৃত্য আনালেন। কিন্তু এই দৈত্যাকার ষাঁড়ের বিকট চেহারা দেখেই সেপাইরা পিছিয়ে এল সাত পা। কেউই ওই যমদূতের কাছে রিয়া হাতে এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

​শেষপর্যন্ত এগিয়ে এল বৃদ্ধ এক রাজভৃত্য। বলে, 


“রানিমা, আমার দিন তো এমনিতেই ফুরিয়ে এল। আমিই চেষ্টা করে দেখি বরং, ষাঁড়ের গুঁতোয় প্রাণ গেলেও ক্ষতিবৃদ্ধি বিশেষ কিছু নেই।”

​এই বলে সে ষাঁড়ের সম্মুখে অবতীর্ণ হল। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ও মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে তেড়ে এল শিং বাগিয়ে। বৃদ্ধ বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে রানিমার রিয়াখানা বুলিয়ে দেয় ষাঁড়ের চোখে। মুহূর্তের অপেক্ষা। অচিরেই ষাঁড়ের কেমন এক ভাবান্তর উপস্থিত হল। সেই সুযোগে বৃদ্ধ তড়িৎগতিতে বাকি কাজটুকু সেরে ফেলে। রিয়াখানা ফেলে দেয় ষাঁড়ের পিঠে। নিমেষে শান্ত হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে ষাঁড়। সৈনিকেরা তৈরিই ছিল। অমনি দড়িদড়া জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তাকে। দেবতাদের নির্দেশে গাছের সঙ্গে শিংদুটো বেঁধে বলি দেওয়া হয় তাকে। চৌদ্দ দেবতারা নির্বিঘ্নে নেমে এলেন গাছ থেকে। তারপর বলিদত্ত ষাঁড়ের রক্ত পান করে শান্ত ও তৃপ্ত হলেন প্রত্যেকে।

​রাজমহিষী হীরাবতী চৌদ্দ দেবতাকে রাজযোগ্য আড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করলেন। রাজমহিষী নির্মিত মন্দিরে নিত্য পূজা পেতে লাগলেন চৌদ্দ দেবতা।

​রাজকুমার ত্রিলোচন তখন সদ্য কিশোর। নতুন দেবতাদের নিয়ে তার কৌতূহলের অন্ত নেই। মায়ের চোখের আড়াল হলেই সে চলে যায় নতুন মন্দিরে। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে। রানি হীরাবতী একসময় লক্ষ করেন যে তাঁর নয়নের মণি রাজকুমারের শরীরগতিক দিন দিন যেন কেমন হয়ে আসছে। নতুন মন্দির থেকে বেরোলে তার চোখমুখ অত্যন্ত পাংশু দেখায়।

​হীরাবতীর সন্দেহ হল। কোনও অঘটন ঘটে চলছে না তো তাঁর অলক্ষ্যে? তক্কে তক্কে রইলেন। রাজকুমার মন্দিরে ঢোকার সামান্য পরেই তিনি একদিন মন্দিরের দরজার ফাঁকে চোখ রাখলেন। যা দেখলেন, এর চেয়ে ভয়ংকর বুঝি দুঃস্বপ্নও হয় না। দেখেন, দেবতাদের সিংহাসনের সামনে পড়ে এক মুণ্ডুকাটা পাঁঠা। তার ধড় থেকে একে একে রক্ত পান করছেন চৌদ্দ দেবতা। তৃপ্ত হতেই পাঁঠার কাটা মুণ্ডু পুনরায় জোড়া লেগে গেল আর প্রাণ ফিরে পেয়ে সে ধীরে ধীরে কিশোর ত্রিলোচনের অবয়ব ধারণ করল। রানিমার বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। তিনি সজোরে দরজা খুলে দেবতাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর তেজোদীপ্ত দৃষ্টির সামনে চতুর্দশ দেবতা অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলেন। রানিমা হুঙ্কার দিলেন, “কৃতঘ্ন দেবতা সব! এই তোদের প্রাণরক্ষার প্রতিদান? শেষে কিনা আমারই বুকের ধনের রক্তে লোভ জেগেছে তোদের!”

​দেবতারা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন। বললেন, “শান্ত হন, রাজমহিষী। অকৃতজ্ঞ আমরা কেউই নই। এ ভবিতব্য। আমরা অভিশাপগ্রস্ত ছিলাম এতদিন। আজ আমাদের শাপমুক্তি ঘটল। শিমুলতলে আপনি স্বয়ং, আর এই মন্দিরে রাজকুমার আমাদের সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা আপনাদের কাছে চিরঋণী রইলাম। তবে একটা কথা, রাজরানি। আমাদের নিত্য ভোগে পঞ্চব্যঞ্জন ব্যতীতও বলিদত্ত রক্তের অবশ্য প্রয়োজন। আমরা আপনার নিকট সে রক্তের স্থায়ী ব্যবস্থার আশা করছি।”

​দিনটা ছিল আষাঢ় মাসের শুক্লাষ্টমী। সেদিন থেকে প্রচলিত হল চতুর্দশ দেবতার পূজনবিধিতে নিয়মিত ছাগবলির রীতি। সে থেকে আজ অবধি চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে সে-প্রথা প্রচলিত।

​আর প্রতিবছর আষাঢ়ের শুক্লাষ্টমী তিথিতে শুরু হয়ে সাতদিন ধরে চলে খারচি পূজা নামে চতুর্দশ দেবতার এক বিশেষ পূজনরীতি। এই সাতদিন চলে পুণ্যার্থীদের এক মহামিলন মেলা।

_____

(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)



অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী