পিকচার পোস্টকার্ড




ছুটি, শব্দটা শুনলেই মনে হয় এবার ভালো হওয়ার শুরু, নিয়মমতো ঘুম থেকে না উঠে একটু দেরি করলেও মনে হয় বাড়ির বড়রা বকবে না, নাহয় বিকেলে বা সকালে মাঠে আরো এক-আধঘন্টা বেশি সময় কাটানো যাবে নির্দ্বিধায়, পড়াশুনো ছাড়াও অন্য কোনো কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা বড়দের সঙ্গে সমানতালে আলোচনা করা যাবে, আসলে কোথাও যেন নিয়মের দড়ি একটু আলগা হয়ে যায়, সবার মনেই একটা প্রশ্রয় আসে, কোথাও সবাই একটু বেশি খুশি থাকে।

আর ছুটির মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো পুজোর ছুটি, এক্কেবারে মেগা ইভেন্ট! দুর্গাপুজো আসছে এই ভাবনা কসবা থেকে কানসাস সিটি অব্দি কোটি কোটি মানুষের মনকে উদ্বেল করে রাখে। আর যখন পুজো একদম দোরগোড়ায়, ঘরে ফিরে মাকে দেখার জন্য প্রতিটি অপেক্ষারত মন দূর দূর থেকে যাত্রা শুরু করে, তখন সবাই চেষ্টা করে এই ক'টা দিন বছরের বাকি দিনগুলোর থেকে একদম আলাদাভাবে কাটানোর। আর তার আয়োজনও তৈরিই থাকে। তাই পুজোর ছুটি মানেই নতুন জামা, ঘোরার প্ল্যান, ভালো খাওয়াদাওয়া, দেদার মজা, আলোর রোশনাই, স্বপ্নের রোদ্দুর।

তবে সবচেয়ে আগে পুজোর আমেজ পাওয়া যায় পুজোবার্ষিকীর হাত ধরে। বর্ষাকালের মাঝেই টুক করে মনখারাপের মেঘ সরিয়ে গোধূলির রামধনুর মতো এসে যায় একরাশ গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। সারা বছর ধরে পুজোবার্ষিকীর অপেক্ষা পুজোর ছুটির মতোই, আসছে আসছে, আর এলেই গোগ্রাসে পড়ে মনের আশ মেটানো। পাতে দিলে শেষ না করা অব্দি তৃপ্তি পাওয়া যায় না। তা তোমরা কোন্ কোন্ পুজোবার্ষিকী পড়েছ এখনো অব্দি এই বছর?

ছুটি, পুজো, পুজোবার্ষিকী আসলে সবই যেন আরেকটু ভালো থাকার, আরেকটু বেশি আনন্দ করে নেওয়ার, মন থেকে খুশির আমেজ আত্মস্থ করার চেষ্টা। আমরা স্বাধীন, তবু নিয়মের গন্ডিতে সময় কাটিয়ে সবাই কোথাও একটু যেন হাঁপিয়ে উঠি, এই পুজো আমাদের সেইসব থেকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীনতার আশ্বাস দেয়, নিজেরা অনুভব করি এই দিনগুলো আমরা নিজের মতো করে কাটাবো। তবে পুজোর মতো না হলেও নিজের মতো করে আনন্দ, মন ভালো আমরা সারা বছরই রাখতেই পারি। আর তার সবচেয়ে ভালো আবেশ পাওয়া যায় যখন আমরা নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের ভালো রাখার চেষ্টা করি, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য নিজেদের ছোট ছোট অভ্যাস পাল্টানোর চেষ্টা করি।

যেমন ধরো, সকালে উঠে নিজে জল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বড় বাটিতে জল ভ'রে বাড়ির উঠোনে কোনো উঁচু জায়গায় বা ব্যালকনিতে রেখে দিলে, যাতে পাখিরা যখন তখন এসে জল খেতে পারে। কিংবা, মায়ের জন্য নিজের হাতে গ্রিটিংস কার্ড বানিয়ে, মায়ের সবচেয়ে পছন্দের ফুল এনে একদিন মা ঘুম থেকে ওঠার আগে মায়ের বিছানার পাশে রেখে দিয়ে লুকিয়ে দেখো মা জেগে উঠে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে কী অপার্থিব অনুভূতির মিশ্রণ দেখা যায়! বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো নিরীহ বিড়াল কুকুরদের দিনকয়েক খাবার দিয়ে দেখো কেমন ওরা তোমার ন্যাওটা হয়ে যায় আর তোমার মন নির্মল আনন্দে ভরে ওঠে! আবার ধরো, রাস্তায় বেরিয়ে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে রাস্তা পার করতে সাহায্য করতে পারো, বা হঠাৎই তোমার কোনো বন্ধুকে কোনো গিফট দিয়ে চমকে দাও, বা একদিন পাড়ার বন্ধুদের জড়ো করে বই, জামা বিতরণ করতে বেরিও। মজার ব্যাপার কী জানো, এই কাজগুলো প্রায়ই করতে করতে টের পাবে অজান্তেই কখন তোমার মনটা আনন্দে ভরে আছে, তোমার মুখে হাসি ফুটে আছে, দেখবে পৃথিবীটা আরো একটু সুন্দর, আরো একটু বেশি ভালোবাসার হয়ে রয়েছে।

আর কী, এবার না হয় পুজোর ছুটিতে মাঝে মাঝেই নিজেকে আর এইভাবে বাকি সবাইকে সারপ্রাইজ দিয়ে দেখো সারা পরিবেশ কীভাবে আরো খুশির, আরো পজিটিভ হয়ে গেছে, পুজোর ছুটি শুধু ছুটির আনন্দে নয়, সবার ভালো থাকার পরিপূর্ণতায় কাটছে।


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

গল্পের ঝুলি : নটে গাছটি মুড়োলো : অনন্যা দাশ



নটের খুব শখ সে গোয়েন্দা হবে। সারাদিন ধরে শুধু নানারকমের গোয়েন্দা গল্প পড়ে সে। পড়ে বললে ভুল হবে। একেবারে গোগ্রাসে গেলে! অত গোয়েন্দা গল্প পড়ে, জ্ঞানে একেবারে টইটুম্বুর হয়ে যাওয়ার পরই সে ঘোষণা করল যে সে গোয়েন্দা হবে।
ওর ওই ‘নটে’ নামটার পিছনেও অবশ্য একটা গল্প আছে। সে যখন বেশ ছোট তখন খাতার ওপর NOTE লেখাটা দেখে বলেছিল, “এটার ওপর নটে লেখা আছে কেন? নটে শাকটি মুড়োলো বলে?” 
তাই শুনে তো সবার সে কী হাসি! আর ওর নামটাই নটে হয়ে গেল। ভালো নাম একটা আছে বটে কিন্তু কেউ আর ওকে সেই নামে ডাকে না। 

ওর দিদি রিম্পা তো ওর গোয়েন্দা হওয়ার কথা শুনে হেসেই খুন হয়, বলে, “ওরে নটে, গোয়েন্দা হওয়ার জন্যে শুধু বই পড়লে হয় না! উপস্থিত বুদ্ধিও থাকতে হয়, মানে কমন সেন্স আর কি! তোর আছে?”

নটে অমনি বলে, “হ্যাঁ! আছে তো!”

“তাহলে আজ সকালে যখন ব্রেকফাস্ট করছিলি তখন তো টিভিটা গাঁ গাঁ করে চলছিল। লোকটা বারবার বলল আজ বৃষ্টি হবে তাও তুই মনে করে ছাতা বা রেনকোট নিলি না! ভিজে ভিজে স্কুল থেকে ফিরলি! তোর দ্বারা ওই সব গোয়েন্দাগিরি হবে বলে মনে করছিস?” 

নটে রেগে গিয়ে বলল, “হুঁ! ওই সব বৃষ্টি ছাতাটাতার সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির কোন সম্পর্ক নেই! পিটার তো ওই সব কিছু নিয়ে ভাবে না!”

‘পিটার, দা প্রাইভেট আই’ হচ্ছে নটের সবচেয়ে প্রিয় গোয়েন্দা। পিটার সিরিজের সব বই নটের পড়া হয়ে গেছে। এখন সে ‘সিড, দা সিক্রেট স্পাই’ সিরিজটা ধরেছে। 

ওরা যেখানে থাকে সেই জায়গাটা বেশ ছোট। মার্কিন মুলুকের একটা গ্রামই বলা যেতে পারে। খুব সবুজ খোলামেলা জায়গা। ওদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই থাকেন মিস্টার ও মিসেস স্মিথ। আর তাঁদের বাড়িতে থাকে অনেক রকমের জন্তু জানোয়ার। তাঁরা ভয়ঙ্কর পশুপ্রেমী, তাই দুটো কুকুর, তিনটে বেড়াল, গোটাচারেক খরগোশ, দুটো চিঞ্চিলা (বড়সড় ইঁদুরের মতন দেখতে একটা জন্তু) এই সব নিয়ে থাকেন। সবাই স্মিথদের বাড়িটাকে চিড়িয়াখানা বাড়ি বলে ডাকে। ওই সব জন্তু ছাড়াও স্মিথদের বাড়িতে নতুন এসে জুটেছে একজোড়া অ্যালবিনো পায়রা। একেবারে ধবধবে সাদা রঙ তাদের। চোখ আর পা-গুলো গোলাপি। ভারি সুন্দর দেখতে। স্মিথরা তাদের নাম দিয়েছেন কিং আর কুইন। মিসেস স্মিথ কিং আর কুইনকে প্রচন্ড ভালোবাসেন সেটা সবাই জানে। অত জন্তু আছে বলে বাড়িতে কাজ খুব বেশি। তাই ওদের বাড়িতে একজন বয়স্ক কাজের মহিলা আছে মেরি আর আছে মিস্টার স্মিথের ভাগ্নে হ্যারি আর ভাইঝি জ্যানেট। পাড়ার সব বাচ্ছারা প্রায়ই ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় জন্তুদের সঙ্গে খেলবে বলে। নটে তো একবার ওদের বাড়ি থেকে ফিরে খুব বায়না ধরেছিল একটা কুকুর পুষবে বলে। মা তো কিছুতেই রাজি হবেন না। বললেন, “এখানে এমনিতেই কাজ করে করে হাড়মাস কালি হয়ে যাচ্ছে আর ওই সব কুকুরটুকুর আমি রাখতে পারব না! তাছাড়া খুব যখন বরফ পড়বে তখন কে তাকে বাইরে নিয়ে যাবে শুনি? তোমরা সবাই লেপের তলায় ঢুকে বসে থাকবে আর আমার ঘাড়ে সব কাজ এসে পড়বে! ও সব হবে না। ওই স্মিথদের সঙ্গে ভাব জমাও। ওদের পোষা অনেক জন্তুদের সঙ্গে খেলা করে এসো বাপু!” 

অগত্যা নটে আর রিম্পা তাই করেছে। রোজ বিকেলে স্মিথদের বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ ওঁদের পোষ্যদের সঙ্গে খেলা করে আসে। তাতে স্মিথরাও খুশি, মা-ও খুশি। 

এমনি করে বেশ চলছিল। হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে ওরা স্মিথদের বাড়িতে গিয়ে দেখে সেখানে কান্নাকাটি চলছে। নটে আর রিম্পা তো বেশ ঘাবড়েই গেল। এমনটা তো দেখেনি তারা কখনও। কুকুর দুটো, মানে চকোলেট আর ব্রাউনি, ওদের চেনে তাই এসে পা চেটে দিয়ে গেল। এদিকে মিসেস স্মিথ সমানে কেঁদে চলেছেন। মিস্টার স্মিথ ওদের ইশারায় অন্য ঘরে ডাকলেন। ওরা যেতে উনি বললেন, “রোজির মনটা খুব খারাপ তাই ও কাঁদছে। তোমরা কিছু মনে কোরো না।”

রিম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে মিসেস স্মিথের?”

“আর বোলো না। কিং আর কুইনকে পাওয়া যাচ্ছে না আজকে দুপুরের পর থেকে!”

“ওমা সে কি!”

“হ্যাঁ, শুধু তাই নয়। আজ বিকেলে পোস্টবক্সে একটা চিঠিও এসেছে মুক্তিপণ চেয়ে। পাঁচ হাজার ডলার চাইছে ওই দুটো পায়রার জন্যে! ওদের দাম অত নয় মোটেই। আমি বলেছিলাম নতুন পায়রা কিনে নিতে কিন্তু রোজি তো শুনবে না, ওর কিং আর কুইনকেই চাই। কী যে করব আমি বুঝতে পারছি না।” 

“পুলিশে খবর দিয়েছেন আপনারা?”

মিস্টার স্মিথ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, “আমি তো খবর দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওই চিঠিতে লেখা রয়েছে যে পুলিশে খবর দিলে কিং আর কুইনকে ওরা মেরে ফেলবে তাই রোজি তো পুলিশে যেতে দেয়নি আমাকে।”

সেই শুনে নটের তো গোয়েন্দাগিরি করার ইচ্ছে চাড়া দিয়ে উঠল। সে বলল, “ওই চিঠিটা একবার দেখতে পারি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!” বলে মিস্টার স্মিথ চিঠিটা এনে ওদের দেখালেন। 

“আমি সাবধানেই রেখেছি ওটাকে। যদিও পুলিশের কাছে যখন যাচ্ছি না তখন হাতের ছাপ পড়ার তো আর সুযোগ নেই।”

একটা সাদা কাগজে খবরের কাগজ থেকে শব্দ কেটে কেটে আঠা দিয়ে জুড়ে চিঠিটা তৈরি করা হয়েছে। 

নটে সেটা দেখে বলল, “এটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এমন কেউ এটা লিখেছে যার হাতের লেখা আপনারা চেনেন।”

রিম্পা ফিসফিস করে বলল, “তোর মাথা আর মুন্ডু! যে কেউ ওই রকম করতে পারে।” 

নটে আরো বলল, “আপনারা কি কাউকে সন্দেহ করেন?” 

“না, কাকে সন্দেহ করব? আমরা এই পাড়াতে বহুদিন ধরে আছি। সব বাচ্চারা এসে আমাদের বাড়িতে খেলা করে যায়। তাদের মধ্যে থেকে কেউ একাজ করেছে বলে আমি মনে করি না। মেরি তিরিশ বছর ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। তাকে আমরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করি। সে হতেই পারে না! এ ছাড়া রয়েছে হ্যারি আর জ্যানেট। তারা তো আমাদের আত্মীয়। তাদের ওপরই বা দোষ দিই কী করে? কিন্তু কেউ একটা তো কাজটা করেছে।” 

নটে বলল, “আমি একটু আধটু গোয়েন্দাগিরি করি। আমি চেষ্টা করে দেখব?” 

মিস্টার স্মিথ তো তাই শুনে ভীষণ খুশি হয়ে বললেন, “তাহলে তো খুব ভালো হয়! পুলিশের কাছেও যেতে হবে না অথচ চোরও ধরা পড়বে।তুমি প্লিজ চোরটাকে খুঁজে বার করে দাও। তোমার উপকার তাহলে আমরা কোনওদিন ভুলব না। রোজি বেচারার দশা তো তোমরা দেখছই!” 

বাড়ি ফেরার পথে রিম্পা নটেকে বলল, “খুব তো বললি চোর ধরে দিবি! এবার কী করবি শুনি? মা শুনলে না বেদম পেটাবে!”

নটে বলল, “ওসব ছাড়, কাউকে সন্দেহ করিস তো বল।” 

রিম্পা বলল, “সন্দেহ করি না একেবারে জানি কে করেছে কাজটা!”

“অ্যাঁ! বলিস কী রে! কে করেছে?”

“হ্যারি, আবার কে! মনে নেই সেদিন গজর গজর করছিল যে মানুষের ছেলেমেয়েরা খেতে পায় না আর এদের পশুপাখি নিয়ে আদিখ্যেতা!” 

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস! তা বলছিল বটে। কিন্তু কোথায় রেখছে সেটা কী করে বোঝা যাবে বল তো?” 

“হ্যারির ওপর নজর রাখতে হবে। কোথায় যাচ্ছে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।”

নটে বলল, “ঠিক আছে, সেটা করা যাবে।”

বলে বাড়ি ফিরে কাদের জানি সব ফোন করল। 

রাত ন'টার সময় হঠাৎ সে রিম্পার কাছে এসে বলল, “দিদি চট করে একবার যেতে হবে। আমার যে বন্ধুকে হ্যারির ওপর নজর রাখতে বলেছিলাম সে ফোন করেছে। হ্যারি বেরিয়েছে, তাই আমাদের ওর পিছু নিতে হবে।”

“এখন এই রাতের বেলা?” রিম্পা অবাক। 

“হ্যাঁ, তোকে কোনও একটা উপায় করতেই হবে!” নটে কাকুতি মিনতি করে বলল। 

রিম্পা চট করে নিজের কানের একটা দুল পকেটে পুরে মাকে গিয়ে বলল, “মা, আমার কানের একটা দুল মিস্টার স্মিথদের বাড়িতে খুলে পড়ে গেছে মনে হয়। নিয়ে আসব?” 

সোনার দুল তাই মা শুনে বললেন, “ঠিক আছে যাও। চট করে চলে এসো। নটেও যাচ্ছে তো সঙ্গে?”

“হ্যাঁ, এই যাবো আর এই আসব।” 

দুই ভাইবোন পড়ি কি মরি ছুটতে ছুটতে বের হল। কিছু দূর গিয়েই হ্যারিকে দেখা গেল। সে কিছুটা দূর হেঁটে গিয়ে একটা খামার পর্যন্ত গিয়ে চট করে একটা খামারঘরের ভিতরে ঢুকে একটু পরেই আবার বেরিয়ে এসে বাড়ি ফিরে গেল। 

রিম্পা বলল, “কাল শনিবার। স্কুল নেই। সকালে আমরা ওই খামার ঘরে গিয়ে দেখে আসব কী আছে, কেমন?” এর পর ওরা দুজন বাড়ি ফিরে এল। 


(২)

পরদিন সকালে জলখাবারের পর ওরা দুজন খামারবাড়িতে গিয়ে হাজির। যে ঘরে হ্যারি ঢুকেছিল সেখানে ঢুকে ওরা তো অবাক! প্রায় পঞ্চাশটা পায়রা রয়েছে সেখানে। সব বকবকুম করে চলেছে। কিন্তু সবকটাই সাধারণ পায়রা। সাদা পায়রা একটাও নেই। 

নটে বলল, “এ বাবা এখানে তো নেই! ও গতকাল তাহলে এখানে কী করছিল?” 

রিম্পা হঠাৎ বলল, “যেদিন বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন তুই স্কুলে কী নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলি?”

“ছাতা! কেন ছাতা দিয়ে কী হবে?”

“পায়রাদের কি ছাতা থাকে?”

“কী আজেবাজে বলছিস তুই!” নটে বিরক্ত হয়ে বলল। 

“বাইরে একটা জলের পাইপ ছিল না?” রিম্পা বলল। 

“হ্যাঁ, ছিল তো!”

“চল তাহলে পায়রাদের একটু বৃষ্টিতে স্নান করিয়ে দিই।” 

“কেন?” 

“দেখ না মজা!” বলে রিম্পা বাইরের পাইপটাকে গিয়ে দেখল। একটা কলের সঙ্গেই লাগানো ছিল সেটা কিন্তু কলটা বন্ধ। কল খুলতেই জল বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। রিম্পা পাইপটাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ঝাঁঝরিটা এমন ভাবে লাগালো যে বৃষ্টির মতন জল পড়তে লাগল। পায়রাদের মধ্যে হুটোপাটি লেগে গেল! কিছু পায়রা অবশ্য খুব মজা করে স্নান করল।

স্নান শেষ হতে দেখা গেল সব সাধারণ পায়রার মধ্যে দুটো পায়রার গায়ে কেমন একটু সাদা নীল ছোপ ছোপ! রিম্পা এবার নটেকে বলল, “সাদা পায়রা দুটোকে সাধারণ করার জন্যে ওদের গায়ে রঙ মাখানো হয়েছিল। ওই দুটো পায়রাই কিং আর কুইন। যা এবার ছুটে গিয়ে মিস্টার আর মিসেস স্মিথকে ডেকে নিয়ে আয়। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।”

নটে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। 

রিম্পা অপেক্ষা করছিল হঠাৎ ওর চুলে ভয়ঙ্কর একটা টান পড়ল আর মাথায় কে যেন দুম করে কী একটা মারল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল রিম্পা আর তখুনি পিছন থেকে কড়া গলায় একজন বলল, “একটুও নড়বে না! নড়লেই গুলি করব!” 

রিম্পা কোনওরকমে উঠে বসে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখল নটে একজন পুলিশ অফিসারকে সঙ্গে করে এনেছে, যে খুব রাগী রাগী মুখ করে জ্যানেটের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিচ্ছে। 

(৩)

এখন রিম্পা আর নটে স্মিথদের হিরো হয়ে গেছে। আসলে কাজটা ছিল জ্যানেটের। হ্যারিও ওদের মতন পায়রাগুলোকে খোঁজার চেষ্টাতেই খামারে গিয়েছিল। সে মনে হয় জ্যানটেকে ওই ঘরে ঢুকতে দেখে আন্দাজ করেছিল যে জ্যানেট অন্য পায়রাদের সঙ্গেই কিং আর কুইনকে রেখেছে কিন্তু সব সাধারণ পায়রা দেখে সে ফিরে যায়। তারপর রিম্পা জল দিয়ে ভেজাতে কিছুটা রঙ ধুয়ে যেতে কিং আর কুইনকে বোঝা যাচ্ছিল। নটে স্মিথদের বাড়ি যাওয়ার পথে একজন পুলিশকে দেখতে পায় আর ওর কী মনে হয়েছিল তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। নাহলে জ্যানেট রিম্পাকে মেরে অজ্ঞান করে পায়রাগুলোকে নিয়ে পালাবার চক্করে ছিল। ওর স্মিথদের বাড়িতে আর ভাল লাগছিল না তাই ভাবছিল কিছু অর্থ জোগাড় করে নিউ ইয়র্ক পালিয়ে যাবে।

মিসেস স্মিথ তাই শুনে হেসে বলেছিলেন, “কী বোকা মেয়ে রে বাবা! ওই অর্থ দিয়ে নিউ ইয়র্কে কিছুই তো হবে না, যা দামি শহর!” উনি জ্যানেটকে ক্ষমা করে দিয়েছেন কিন্তু ওঁদের বাড়িতে আর তার ঠাঁই হয়নি। 

যাই হোক নটে আর রিম্পার গোয়েন্দাগিরিতে কিং আর কুইনকে ফিরে পেয়ে স্মিথরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই খুব খুশি। সেই খুশির উপহার হয়ে একটা বড়ো খাঁচাতে করে ওদের বাড়িতে এসেছে পোস্ত আর পান্তুয়া, স্মিথদের চিঞ্চিলা দম্পতির সদ্য হওয়া দুটি ছানা! 


অলঙ্করণ : আবির

গল্পের ঝুলি : পশুরাজ সিংহবর্মা : ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়



রাজ্যটা নেহাত ছোট নয়। সারা পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে বিশাল পর্বতমালা। আর উত্তর থেকে দক্ষিণ ঘিরে রয়েছে বিশাল সমুদ্র। সমুদ্র পেরিয়ে কাউকে যদি পাহাড়ের দিকে যেতে হয় তবে পেরোতে হবে অনেক কিছু। যেমন বিশাল এক দুর্ভেদ্য গহন অরণ্য। পেরোতে হবে সবুজ মাঠ আর ফাঁকা জমি। অনেক নদীনালা যেগুলো পাহাড় থেকে তৈরি হয়ে সাগরের দিকে চলে গেছে পেরোতে হবে সেগুলোও। আবার নদী তো শুধু একদিকেই যায়নি। উত্তর থেকে পূর্ব অর্ধ-চন্দ্রাকার পথে সরু সরু কেঁচোর মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে সমুদ্রের দিকে।

চারিদিক শুধু সবুজ আর সবুজে মোড়া এক রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা প্রবল প্রতাপান্বিত সিংহবর্মা। যার এক হুংকারে সাগরে ঢেউ উঠে যায় চল্লিশ থেকে চারশোটা। পাহাড়ের ক’টা পাথর ধ্বসে পড়ে যায় তা অবশ্য গুনে দেখেনি কেউ। তবে জঙ্গলে ঝড় ওঠে বেশ বড়সড়। সমস্ত পশুরা থরথর করে কাঁপতে থাকে।

সিংহবর্মার নিজের সংসারে আছে তার বৌ সিংহী আর দুটো ছোট ছোট বাচ্চা। বাচ্চাদুটোকে দেখে একদিন তো এক বনবিড়ালের মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। আগে সেই গল্পই বলি তবে।

বনবিড়ালরা বেশ বড়সড় হয়। অনেকটা সিংহছানার মত দেখতে। একদিন বনবিড়ালের দুটো বাচ্চা হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল মানে দুপুরে খেয়েদেয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। সারাদিন কেটে গিয়ে সন্ধের মুখে পশুরাজের গুহার কাছে গিয়ে বনবিড়াল তো অবাক! দেখে গুহার কাছে তার চার চারটে বাচ্চা দিব্বি খেলা করছে। তার দুটো বাচ্চা কী করে চারটে হয়ে গেল বুঝতে পারে না।

অনেক সময় চোখের পাতা একটু এদিক সেদিক হলে সব কিছু দুটো দুটো মনে হয়। নিজের চোখের পাতা একটু একটা গাছে ঘষে নিয়ে দেখল, না, দুজন তো নয়, চারজনই তো বটে! একটু কাছে যেতে ভুল ভাঙল। দুটো তার নিজের বাচ্চা বটে, তবে আর দুটো তো পশুরাজের। ওরা একসঙ্গে খেলা করছে। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের মা সিংহী মিটিমিটি হাসছে।

বেশ একটু দূর থেকেই নিজের বাচ্চাদের ডাকল বনবিড়াল। সিংহী বলল, "দূর থেকে কেন গো বনবিড়াল? কাছে এস না! দেখে যাও তোমার দুই বাচ্চা আমার দুই বাচ্চার সঙ্গে কেমন খেলা করছে।"

বনবিড়ালের একটু ভয় ভয় করছিল। এসব রাজা-রানিদের বেশি কাছে যাওয়া ঠিক নয়। কখন কী ভুল করে ফেলবে আর গর্দান চলে যাবে। মহারানি ঘ্যাঁক করে তেড়ে এসে তার ঘাড় কামড়ে ধরবে। গলার নলি চিরে দিয়ে খেয়ে ফেলবে। তবে সিংহরা রাজার জাত তাই এরা এত ছোট পশু খেতে ভালবাসে না। তাই সচরাচর বিড়াল বনবিড়াল বা ছোটখাট আর জন্তুদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তবে তাদের এই রানিমা বেশ ভালমানুষ। সকলের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা কয়। দরকার না হলে কাউকে শিকার করে না।

বনবিড়াল বলল, "পেন্নাম হই রানিমা। না রানিমা। এখন আর খেলা দেখার সময় নেই। আর বাচ্চাদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। নদী থেকে বড় বড় দুটো মাছ ওদের জন্যে ধরে এনেছি। ওরা জ্যান্ত মাছ খেতে খুব ভালবাসে। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করে তারপর খায়। আমারও দেখতে খুব ভাল লাগে সেই খাওয়া।"

সেই থেকে মাঝে মাঝেই অবশ্য বনবিড়ালের বাচ্চারা সিংহছানাদের সঙ্গে খেলা করে। বাচ্চাদের অবশ্য বেশ সাবধান করে দিয়েছে সে, "এখন ছোট আছ খেলাধুলো করতে পারো। কিন্তু বড় হলে খবরদার। ওদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াবে না বলে দিলুম।"

পশুরাজ সিংহবর্মার রাজত্বে অনেক প্রজা। আছে মহামন্ত্রী বাঘ, সেনাপতি হাতি, কোটাল ভালুক, গুপ্তচর শিয়াল। এছাড়াও আছে হরিণ, গন্ডার, বানর, কচ্ছপ, বেজি, বেড়াল, বুনো মোষ, খরগোশ, হায়না, নেকড়ে, সব পাখির দল, নদী পুকুর আর খালবিলের মাছ আর অন্য জলচরের দল।

সিংহবর্মা খুব সাহসী আর বীর রাজা। তার এমনই প্রতাপ যে বাঘে-হরিণে একঘাটে জল খায়। অপ্রয়োজনে কাউকে শিকার করা যাবে না। অকারণে কারোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করা চলবে না।

এই রাজ্যের পশ্চিমে বিরাট পাহাড় তা আগেই বলেছি। সেই পাহাড়ের এক গুহায় বেশ রাজকীয় মর্যাদায় বাস করে পশুরাজ সিংহবর্মা। এই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ওপারে কী আছে বা সাগর পেরিয়ে কোথায় যাওয়া যায় সেটা কিন্তু জানে না সে। একবার লাফ দিয়ে পাহাড় পেরোবার চেষ্টা করতে গিয়ে তার হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো হয়েছিল। তারপর থেকে সে আর চেষ্টা করেনি।

আর একবার সাগর পেরোনোর কথা মাথায় এসেছিল বটে। কিন্তু একটা লাফে যতদূর গেল তাতে তার মনে হয়েছিল এরকম হাজার হাজার লাফ দিয়েও সাগর পেরোনো যাবে না। বিরাট বড় বড় ঢেউ তাকে নিয়ে যেন ভলিবল খেলতে লাগল। ভাগ্যি ভাটা এসে পড়ল এ সময়। জল কমে গিয়ে বালিতে গাঁথা হয়ে গেল সে। অনেক কষ্টে উঠতে হল। পরে সে সিদ্ধান্ত নিল এই সাগরের কোনও শেষ নেই। সাগরের পারে কোনও দেশ নেই।

পাখিদের মধ্যে চিল, বাজপাখি আর ঈগল আকাশের সবচেয়ে উঁচু দিয়ে ওড়ে। কিন্তু অনেক উঁচু দিয়ে উড়লেও অনেক নিচুতে তারা দেখতে পায়। গুহার সামনে বিরাট বড় গাছের মাথায় এরা তিনজন মাঝে মাঝে বিশ্রাম করে। ওদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় সিংহবর্মার। বাজ বলল, "পশুরাজ, এই পাহাড়ের ওপারে আছে সব মানুষের দেশ। তারা সব ভয়ংকর। ওদের অনেক বড় বড় অস্ত্র আছে। ওরা আমাদের মত পশুদের সব ধরে ধরে একটা খোঁয়াড়ে পুরে পয়সা নিয়ে অন্য মানুষদের দেখায়। তারা আমাদের বন্দি অবস্থায় দেখে খুব মজা পায়।"

চিল বলল, "হ্যাঁ পশুরাজ, বাজ যা বলছে সব এক্কেবারে ঠিক। এই খোঁয়াড়টাকে ওরা নাকি চিড়িয়াখানা বলে।"

ঈগল বলল, "ওরা দুজন ঠিক কথা বলছে পশুরাজ। ওদের চিড়িয়াখানায় কে নেই বলুন? সিংহ, বাঘ, হাতি, গন্ডার, হরিণ, জিরাফ, জেব্রা আবার জলচরদের মধ্যে আছে কচ্ছপ, কুমির, সাপ এইসব।"

বেশ সুখে-শান্তিতেই চলছিল রাজ্যটা। এমন সময় সিংহবর্মার মাথায় একটা চিন্তা এল। মহামন্ত্রী বাঘকে ডেকে বলল, "আচ্ছা মহামন্ত্রী, এই সাগরটা কার? মানে এর রাজা কে? কাউকে তো দেখতে পাই না।"

বাঘ তো এত কিছু জানে না। গাঁইগুঁই করে বলল, "মনে হয় এই সমুদ্রের কোনও রাজা নেই পশুরাজ।"

"কিন্তু প্রজা তো আছে?"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু সব আছে জলের ভেতর। ছোট প্রাণীর সঙ্গে বড় প্রাণীরাও আছে মহারাজ।"

"যেমন?"

"এই যেমন ধরুন শুশুক, হাঙ্গর, তিমি এইসব। আর কুমিরও আছে তবে সে তো আমাদের সঙ্গেও বাস করে। মানে এই রাজত্বে।"

"হ্যাঁ জল থেকে তো প্রায়ই উঠে আসে ডাঙ্গায় রোদ পোয়াতে।"

একটু ভেবে পশুরাজ বলল, "আচ্ছা মন্ত্রী এই সাগরের রাজত্ব কি দখল করা যায় না?"

"এতবড় জায়গা নিয়ে কী করবেন রাজামশাই? আর তাছাড়া জলের ভেতরে তো আমরা কানা মহারাজ। কিছুই তো দেখতে পাব না।"

সিংহবর্মা ভেবে ঘাড় নেড়ে বলল, "তা ঠিক। কিন্তু কিছুটাও যদি দখল করা যেত তো রাজ্যটা বেশ একটু বড় হত।"

মহামন্ত্রী বাঘও একটু ভাবল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, "তা ঠিক। চেষ্টা করে দেখাই যেতে পারে। সেনাপতির সঙ্গে কথা বলে দেখুন সে কী বলে।"

সেনাপতি হাতি কিন্তু বেঁকে বসল, "আমার এত বড় আর ভারী দেহটা আমি সাগরে ফেলতে পারব না মহারাজ। একবার বালিতে আটকে গেলে আর পা তুলতে পারব না। আমাকে কি ডুবিয়ে মারবেন মহারাজ?"

সে তো ঠিক। সিংহবর্মা খুব চিন্তায় পড়লেন। তবে কি সাগর দখল হবে না ছিটেফোঁটাও?

সমাধান করে দিল হাতিই। বলল, "একমাত্র কুমির পারে সাগরে ডুব গালতে। উভচর প্রাণী সে। জলেও থাকে আবার ডাঙ্গাতেও। জলে ওর ক্ষমতাও প্রচুর। হাঙ্গর আর তিমির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও আছে ভাল। সাগর দখল সে-ই করতে পারবে।"

সিংহবর্মা দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলল, "না না এ ঠিক নয়। এমনভাবে করলে তো সে-ই সাগরের রাজা হয়ে যাবে। আমাকে যদি প্রজারাই না দেখতে পেল তো আমাকে মানবে কেন রাজা বলে?"

"কেন মহারাজ? আপনি সাগরেও যেতে পারেন।"

"যেতে পারি? কেমন করে? ওই বড় বড় ঢেউয়ে আমি তো সাঁতার কাটতে পারব না!"

"আহা আপনাকে সাগরে সাঁতার কাটতে কে বলল? আপনি থাকবেন কুমিরের পিঠে। সাগরের সেনাপতি বানিয়ে দিন কুমিরকে। তারপর তার পিঠে চেপে সাগর পরিদর্শন করবেন।"

শুনে খুব খুশি হল পশুরাজ সিংহবর্মা। কুমিরকে সাগর বিভাগের সেনাপতি করে দেওয়া হল। পরের দিন থেকে শুরু সাগর দখল অভিযান। একটা কুমিরের পিঠে পশুরাজ সিংহবর্মা। আর একটা কুমিরের পিঠে বাঘ। দুই কুমির মাঝখানে পাশাপাশি। তাছাড়াও সঙ্গে চলল আরও অনেক কুমিরের একটা দল। তারা সব রইল এই দুজনকে ঘিরে। যেমন রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতির পেছনে পেছনে অন্য সেনারা যায়।

সাগরের মজা হচ্ছে এই যে যত বড় বড় ঢেউ সব কিন্তু পাড়ের দিকে। একটু মাঝ বরাবর গেলে ঢেউ অনেক কমে যায়। একটু কষ্ট করে পাড়ের দিকটা কাটিয়ে মাঝামাঝি চলে গেল সবাই। কুমিরের পিঠে বসে সিংহের সে কী হাঁকডাক! জলের প্রাণীরা কখনও সিংহ দেখেনি। তারা তো খুব ভয় পেয়ে গেল। কুমির এই সুযোগে কচাকচ করে কিছু সমুদ্রের প্রাণী মুখে করে ধরে পিঠের সিংহকে ভেট দিতে লাগল। জলের প্রাণীরা তাতে আরও ভয় পেয়ে গেল।

সাগরের সেনাপতি কুমির তখন সব জলের প্রাণীদের বলল, "আমার পিঠে যিনি আছেন তিনি হলেন সমগ্র পশুসমাজের রাজা। উনি পশুরাজ সিংহবর্মা। আর আজ থেকে সাগরের সব প্রাণীদের রাজা হলেন। কী, তোমরা সব মানবে তো?"

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, "রাজি রাজি। এতদিন তিমি ছিল আমাদের রাজা। কিন্তু আমরা তার কাছ ঘেঁষতেই পারতুম না। এবার থেকে পশুরাজ সিংহবর্মাকেই আমাদের রাজা বলে মানব। সব অভাব অভিযোগ জানাব।"

এদিকে বেশ কিছুদূর দিয়ে আসছিল একটা জাহাজ। তারা নানা দেশ থেকে পশু ধরে ধরে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। তারা এই দৃশ্যে অবাক হয়ে গেল। সাগরে কুমিরের পিঠে সিংহ, বাঘ। ভারি মজার তো।

ঘটনা মজার হলেও জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এল। এই দ্বীপে মনে হচ্ছে আরও অনেক জন্তু জানোয়ার আছে। তারা জাহাজটাকে সেখানে রেখে পেছন পেছন একটা বোট পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে অস্ত্র থাকলেও সে বলে দিল খুব দরকার না হলে যেন সেগুলো ব্যবহার না করা হয়। চুপি চুপি এক একটা করে জন্তু শিকার করে জাহাজে তুলতে হবে।

পরের দিন ভোরে উঠে গুহার বাইরে এসেছে সিংহবর্মা। বৌ সিংহী সাতসকালে একটা বুনো মোষ শিকার করে এনেছে। এবার চারজন মিলে খাওয়া হবে। তারপর পশুরাজ তার রাজ্য পরিদর্শনে বেরোবে।

এমন সময় গাছ থেকে কী একটা সড়সড় করে নেমে এল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সেটা জড়িয়ে নিল পশুরাজকে। আর জড়িয়ে নিয়ে একেবারে গাছের টঙে উঠে গেল। পশুরাজ একটা জালের খাঁচায় বন্দি হয়ে ঝুলতে লাগল গাছের ডালে।

এ তো ভারি বিপদ। এমন ঘটনা আজ পর্যন্ত কখনও দেখেনি কখনও। পশুরাজ সিংহবর্মার কাছে এ শুধু বিপদই নয়, চরম লজ্জা আর অপমানও বটে। বনের পশুরা আর মানতে চাইবে তাকে? তারা ভাববে এই জঙ্গলে তাদের রাজার চেয়েও শক্তিশালী আর একজন রয়েছে যে সিংহবর্মাকে এমন ভাবে বন্দি করার সাহস দেখাতে পারে।

তার গাঁক গাঁক আওয়াজে ভেতর থেকে তার বৌ আর ছেলেরা বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আশপাশ থেকে বেরিয়ে এল সব পশুর দল। আকাশ পথে উড়ে এল চিল, ঈগল আর বাজ। তারা সমস্বরে বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ এ জিনিস আমরা চিনি। এ তো একটা ফাঁদ। একে জাল বলে। কোনও দুষ্টু মানুষ নিশ্চয় এসেছে এখানে লুকিয়ে থেকে এই ফাঁদ পেতেছে আমাদের জন্যে।"

বাঘের হঠাৎ মনে পড়ল মাঝসমুদ্রে সেই জাহাজটার কথা। হালুম হুলুম করে বলল, "এ নিশ্চয় সেই শয়তানগুলোর কাজ।"

কার কাজ সে তো নাহয় আন্দাজ করা গেল। কিন্তু পশুরাজকে এখন মুক্তি দেওয়ার কী হবে? ইঁদুর দলপতি বলল, "মাটিতে থাকলে আমার বাহিনী এক্ষুনি সব কেটেকুটে রাজাকে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু এত উঁচু গাছে আমরা উঠব কী করে? তাছাড়া এ ফাঁদ আবার আকাশে ঝুলছে। আকাশে যারা ওড়ে এ তাদেরই কম্ম।"

চিল, বাজ, ঈগল সব জড়ো হল সেই গাছের ডালে। কিন্তু তাদের শত চেষ্টাতেও কাটা গেল না জাল। এত মোটা জাল কাটা তাদের পক্ষে খুব অসুবিধে।

রাজ্যের সব পশুপাখি এসে জড়ো হয়েছে। পশুরাজ স্বয়ং এতবড় এক বিপদে! তারা কি কেউ আর ঘরে বসে থাকতে পারে? কিন্তু তারাই বা আর কী করে? কয়েকটা বানর অনেক চেষ্টা করল দাঁত দিয়ে সেই জাল কাটতে, কিন্তু পারল না। দিনের শেষে তারা সব ফিরে গেল নিজের নিজের বাসায়। আর পশুরাজ সেই জালের মধ্যে কোনওমতে কুঁকড়ে সারাদিন কাটালো। দানা নেই, পানি নেই, নেই কোনও খাবার। সিংহীরও কিছু করার নেই। সে শুধু কেঁদেই গেল। গুহার ভেতরে আওয়াজ উঠল গম গম করে।

সেদিন তো গেলই, সে রাতও গেল। ভোরের দিকে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় পশুরাজের একটু তন্দ্রা আসবে বোধহয়। এমন সময় সে শুনল গাছের ওপর থেকে কিছু যেন আওয়াজ হচ্ছে। কী যেন খসখস করে আওয়াজ। একটু ভয় পেল। কাল সারা রাত খুব কষ্ট গেছে তার। মনে কষ্ট। পশুদের রাজা হয়ে এ কী বেইজ্জতি। ভাবা যায়?

একটা ডালে পাতার আড়ালে চকচকে একটা ছুরি নিয়ে একজন বসে। একে ঠিক চিনেছে সিংহবর্মা। এটা একটা মানুষ। এই লোকটাই মনে হয় তাকে ফাঁদ পেতে ধরেছে। চুপি চুপি গাছের আড়ালে লুকিয়েছে অন্য পশুদের ভয়ে। কিন্তু লোকটার হাতে ছুরি কেন? নেহাতই আত্মরক্ষার জন্যে নাকি তাকে কেটে কেটে খাবে? মানুষ অনেক পশু মেরে খায় শুনেছে বটে সিংহবর্মা। তবে বাঘ সিংহ বা হাতি গন্ডার খায় বলে তো শোনেনি। তেমন হলে চিল, বাজপাখিরা তো বলত।

লোকটা কিন্তু একমনে কাজ করে চলেছে। খুব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে ঝুলে এগিয়ে এসেছে সিংহের ঝুলন্ত জালের খাঁচাটার দিকে। আর তারপর কচাকচ করে কেটে যাচ্ছে জালের দড়ি। তার মুখ জালের ভেতরে থাকা সিংহবর্মার কানের খুব কাছে। পশুরাজকে সে যেন কী বলে চলেছে। একহাত দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে জাল কাটা খুব শক্ত কাজ। পশুরাজ পশু হলেও রাজা কিনা! তাই ভাল বোঝে।

আধঘন্টার অনেক বেশি পরিশ্রম। একটু পরেই ধপাস ধাঁই! জাল ছিঁড়ে পড়ল সে মাটিতে। বেশ একটু লাগল বটে তবে সিংহের শরীর তো একটু শক্তপোক্ত হবেই। অমনি সব পশুর দল ছুটে এল। সকলেরই কৌতূহল, কী করে মুক্ত হল পশুরাজ?

সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেই মানুষটা আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারল না। ধরা পড়ে গেল সকলের চোখে। অমনি চেঁচামেচি হৈ-চৈ। বাঘ তো লাফ মেরে মেরে তার নাগাল পেতে চাইল। হাতি শুঁড় উঁচিয়ে, জিরাফ গলা বাড়িয়ে চেষ্টা করতে লাগল মানুষটার নাগাল পেতে। কিন্তু অত উঁচু ডালে পাওয়া কি অত সহজ?

চিল বলল, "পশুরাজ বলুন ওর মাথাটা ঠুকরে দিয়ে আসব?"

বাজপাখি আর ঈগল তাতে সায় দিল। এই তিন শিকারি পাখির সম্মিলিত আক্রমণে মাথা বাঁচাতে নিচে পড়বেই। তখন হয় মাথা ফেটে মরবে আর নয়তো পশুদের আক্রমণে। যাবে কোথায় বাছাধন? আমাদের রাজাকে বন্দি করার চেষ্টা? আমরা ছেড়ে দেব?

চিল ঈগলের প্ল্যান সফল হল। মাথা বাঁচাতে মাটিতেই লাফাল লোকটা। সব পশুরা তেড়ে এল। পশুরাজ সিংহবর্মা আদেশ দিলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে লোকটার ওপর। পশুরাজের মুখ থেকে তার আদেশটা একবার খসলেই শুধু হল।

কিন্তু পশুরাজের মুখ থেকে আদেশ এখনও না আসায় তারা সবাই উসখুস করছে। এদিকে লোকটা তাকিয়ে আছে সিংহবর্মার দিকে। তার তো আর পালাবার কোনও উপায় নেই। চারিদিক ঘিরে তাকিয়ে হিংস্র পশুর দল।

পশুরাজও কিন্তু করুণ চোখে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। সবাই তো অবাক। এই কি সেই সিংহবর্মা যার এক হুংকারে সাগরে ঢেউ ওঠে চল্লিশ থেকে চারশো? এই কি সেই সিংহবর্মা যার এক হুংকারে পাহাড়ে কতগুলো পাথর খসে পড়ে তা কেউ কখনও গুনে দেখেনি? পরিবর্তে একটা নরম দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। প্রবল প্রতাপান্বিত পশুরাজ কি তবে ভয় পেয়ে গেল তাকে দেখে? এত ক্ষমতা লোকটার?

পশুরাজ অতি ধীর পায়ে এগিয়ে এল লোকটির দিকে। লোকটা তো ভয়ে মরে। কিন্তু পশুরাজ এসে মানুষটার পায়ের নিচে বসে পড়ল থাবা গেড়ে। যেন প্রণাম করছে। যেন বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছে তার।

দাঁড়িয়ে উঠল পশুরাজ। একটু পরেই সিংহবর্মার এক বিরাট হুংকার। হুংকার করে বলল, "সবাই ভাল করে কান খুলে শুনে রাখস। এই মানুষটি আজ থেকে আমার বন্ধু। আমাদের বন্ধু। কারণ এ সমগ্র পশুসমাজের বন্ধু।"

আসলে হয়েছে কি গাছের ডালে জালের মধ্যে ঝুলতে থাকা অবস্থায় লোকটি যা বলেছিল তা এইঃ লোকটা বলছে সে-ও ওই জাহাজে এসেছে। জাহাজের বদ স্বভাবের লোকেরা আস্তে আস্তে এই জঙ্গলের সব পশুদের ফাঁদ পেতে ধরে নিয়ে যাবার অপেক্ষায় আছে। ফাঁদ পেতে রোজ একটা করে পশু বন্দি করে জাহাজে তুলে নিয়ে যাবে।

সিংহবর্মা প্রশ্ন করেছিল, "কেন? আমাদের নিয়ে কী করবে তারা?"

লোকটা বলছে মানুষ পশুগুলোকে চিড়িয়াখানায় বিক্রি করবে। বন্দি করে রাখবে। অন্য মানুষেরা আটকে থাকা পশুদের দেখে খুব মজা পাবে। আর কিছু লোক পশুদের মেরে ফেলবে।

"কেন?"

"মেরে ফেলে তাঁদের নখ, দাঁত, চামড়া, চোখ, লোম, নাড়িভুঁড়ি এইসব বার করে বিক্রি করবে। এসব জিনিস মানুষের কাছে খুব দামি। এসব জিনিস দিয়ে তারা নানা রকম জিনিস তৈরি করে। আবার ওষুধ তৈরিও হয়।"

সব পশুরা শুনছে আর রাগে তাদের সারা গা জ্বলছে। পারলে এক্ষুনি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে মানুষটাকে। কিন্তু এখনও তারা পশুরাজ সিংহবর্মার কাছ থেকে কোনও আদেশ পায় নি। তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।

বাঘ বলল, "মহারাজ আমাদের আদেশ দিন এক্ষুনি লোকটার নাড়িভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিই।"

পশুরাজ সিংহবর্মা রাজকীয় ভাবে হুংকার করে বলল, "আমি রাজা। আমি বীর। আমার কর্তব্য যেমন প্রজাদের রক্ষা করা তেমনি রক্ষা করা বন্ধুকেও। এই মানুষটির মতো কিছু মানুষ অবশ্য নিজেদের স্বার্থে আমাদের ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু সব মানুষ খারাপ হয় না। এ গোড়া থেকে আমাদের রক্ষা করতে চেয়েছে। অত ঝুঁকি নিয়ে আমাকে জাল কেটে উদ্ধার করেছে। সিংহের
ধর্ম উপকারীকে প্রতিদান দেওয়া। আমিও আমার সেই কর্তব্য করতে চাই। যাও বন্ধু তুমি মুক্ত। আমাদের কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করবে না।"

লোকটি বলল, "আমি পশুদের ভালবাসি আর তাই সে পশুদের এমন কষ্ট দিতে চাই না বলেই আমার সঙ্গে জাহাজের লোকগুলোর মতবিরোধ হয়েছে। ঝগড়া করে তারা আমাকে ফেলে পালিয়েছে। আবার একটা এই রকম লোক নিয়ে এসে পশুদের এক এক করে বন্দি করে নিজের দেশে নিয়ে যাবে।"

সব শুনে পশুরাজ বলল, "দাঁড়াও তোমার দেশে ফেরার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।"


চিল, ঈগল আর বাজপাখির ওপর ভার পড়ল। তারা একটা ঝোলায় পুরে লোকটাকে ঠোঁটে করে আকাশপথে পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছে দেবে পাহাড়ের ওপাশে মানুষের দেশে।

মানুষটি তো ভেবেই পাচ্ছিল না কী করে দেশে ফিরবে। কৃতজ্ঞতায় কেঁদে উঠল। 

সিংহবর্মা দুই থাবা জোড় করে কেশর নেড়ে বলল, "তোমার মত উপকারীর কথা কখনও ভুলবে না পশুরাজ সিংহবর্মা। আর ভুলবে না আমার প্রজারাও। যাও বন্ধু নির্ভয়ে আর নিশ্চিন্তে নিজের দেশে ফিরে যাও। আজ থেকে সব পশুরা সাগরের দিকের সীমানা পাহারা দেবে খুব ভাল করে। জাহাজে আসা সেই বিদেশী মানুষের দল কিছুই করতে পারবে না।"

সব পশুর দল চিৎকার করে বলে উঠল, "জয় পশুরাজ সিংহবর্মার জয়। জয় পশুপ্রেমী মানুষের জয়।"

 (সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : সুদীপ্ত দত্ত

গল্পের ঝুলি : সিংহের দন্তচিকিৎসা : অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়





গভীর জঙ্গলে সিংহটার সেদিন বড় মন খারাপ। তিনদিন তার পেটে কিছু পড়েনি। পেটের মধ্যে থেকে থেকে গুরুম গারাম ডাক শোনা যাচ্ছে। খালি পেট হলে যা হয় আর কি! আহা, নধর মাখন চিক্কন গায়ের চিতল হরিণগুলো এইসময়ে সামনের ঝিলটাতে জল খেতে এসেছে দল বেঁধে। সিংহের বড় সাধ হল, এক ছুটে চকিতে একটা হরিণের টুঁটি টিপে ধরে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো আর সব সময়ে উপায় থাকে না! সিংহটার গায়ে একরত্তি জোর নেই, যে সে দৌড়ে গিয়ে একটা হরিণের ঘাড় কামড়ে ধরবে।

এখন জঙ্গলে ঘোর অন্ধকার নেমে আসছে। মুখ তুলে সিংহ দেখে, মাথার উপর গরানগাছগুলোর উঁচু উঁচু শাখায় শেষবেলার আলো পড়েছে। যতটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে, তাতে দৃশ্যমান হচ্ছে পাখিদের দল বেঁধে ঘরে ফেরার দৃশ্য। আহা, যদি একটা পাখিও কোনও কারণে টুপ করে খসে পড়ত, তবে অন্তত আজকের জন্য তার পেট খানিকটা শান্ত হতো। শরীরের ভিতর থেকে একটা অসম্ভব রাগ আসছে। কিন্তু দুর্বল সিংহ তার গলা দিয়ে জলদগম্ভীর আওয়াজ করতে আজ অক্ষম। যদিও সে তেমন কিছু বুড়ো হয়েও যায়নি এখনো।

আসলে হয়েছে কী, হপ্তাখানেক আগে একটা নীলগাইয়ের বাচ্চাকে বাগে পেয়ে, তার ঘাড়ে আচমকা লাফিয়ে পড়ে সিংহ তাকে শিকার বানিয়েছিল। কিন্তু যেই না সে নীলগাইয়ের একটা হাড় বেশ কায়দা করে চিবোতে গেছে, অমনি তার কষের দাঁত একেবারে ঝনঝন করে উঠল। তড়িঘড়ি হাড়টা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বিশাল এক হুংকারে জঙ্গল কাঁপিয়েছিল সে। সেই আওয়াজ শুনে বাঁদরের দল দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছিল। জল খেতে আসা হরিণেরা পড়িমরি করে ছুটেছিল ডেরার দিকে। গাছের মাথায় ঘরফিরতি পাখিরা কিচির মিচির শব্দ করে উড়ে গিয়েছিল।

সিংহের কষ দাঁত গিয়েছিল ভেঙে। যন্ত্রণা তারপর থেকে বেড়েই চলেছে, কমার লক্ষণ পর্যন্ত নেই। সে তারপর থেকে শিকার করা জিরাফের মাংস বেশ বুঝেশুনে হাড়টাড় বাদ দিয়ে খেয়ে খিদে মিটিয়েছে। না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে গিয়ে সিংহ আজ ভয় পেয়েছে। এমনভাবে শিকার না করে না খেয়ে থাকলে নির্ঘাত মৃত্যু, সেটা সে বেশ ভাল করেই জানে।

যখন দাঁতের যন্ত্রণায় সিংহ ধুঁকছে, ঠিক তখুনি সামনের বট গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে, দোল খেতে খেতে, একটা উটকো বাঁদর দাঁত বার করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বলে উঠল, “কেমন মজা, কেমন মজা? দাঁতের ব্যাথায় পাচ্ছ সাজা!”

খালি পেটে কারই বা রসিকতা সহ্য হয়? কিন্তু দাঁতের ব্যথায় কাতর সিংহ খুব রেগে গেলেও মুখে কিছু বলতে পারে না। এবার ফক্কড় বাঁদরটা বলে, “কী খুড়ো, তোমার তর্জন গর্জন কোথায় গেল? এখন এই দুর্বল শরীরে লেজ নাড়ানোর ক্ষমতা পর্যন্ত নেই তোমার। সাধে কি বলে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝাটা খুব প্রয়োজন! কিছু মনে কোরো না খুড়ো, অকারণে প্রাণিহত্যা জঙ্গলের নিয়মবিরুদ্ধ, তুমি জানতে। তা সত্ত্বেও নিরীহ প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতে। সেই কারণে খুড়িও তোমাকে ছেড়ে গেছে। জঙ্গলের নিয়ম না মেনে বড় পাপ করেছ হে। তাই তোমাকে বনবিবি শাস্তি দিয়েছে।”

বাঁদরের কথা শুনে বড় আফসোস হয় সিংহের। সে মাথা নাড়িয়ে দুর্বল শরীরে হাঁফাতে থাকে আর ভাবে — কী কুক্ষণেই না অকারণে প্রাণী হত্যা করার নেশা ধরিয়েছিল। পেটে খিদে না থাকলেও হরিণ আর জিরাফের দলের পিছনে ছুটে গিয়ে শিকার করেছে। সিংহী কত বার বারণ করেছে। তার একটা কথাও কোনোদিন শোনেনি সে। তাই একদিন ছানাপোনাদের সাথে নিয়ে সিংহী চলে গেল দূরের জঙ্গলে। সেই থেকে সিংহ একেবারে একা।

সিংহকে বেচাল দেখে বাঁদর বলল, “উপায় আছে খুড়ো। দাঁত যদি ভালো করতে চাও, আমার কথা শুনে চলতে হবে।”

সিংহ ক্ষীণ গলায় বলল, “যা বলবে তাই শুনব। আর কোনোদিন জঙ্গলের নিয়ম ভাঙব না। আমায় বলো কী করণীয়।”

“ওই যে দূরে উঁচু পাহাড় দেখতে পাচ্ছ, ওই পাহাড়ের মাথায় আছে একটা গুহা। কষ্ট করে যদি ওই পর্যন্ত পৌছতে পারো, তবে তোমার দাঁত ভালো হয়ে যাবে।”

দাঁত ভালো হয়ে যাওয়ার কথা শুনে বেচারা সিংহ নড়ে বসে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি তার নেই। কেশর ভর্তি মাথাটা বোঁ বোঁ করে পাক খায়।

“আচ্ছা, বুঝেছি। না খেয়ে তোমার গায়ে আজ একরত্তি শক্তি নেই। দেখছি কী করা যায়।”

এই না বলে, বাঁদর এক লাফে তিনটে গাছ পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো একছড়া কলা নিয়ে। কলার ছড়া সিংহের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “ভাঙা দাঁত নিয়ে এখন তোমায় কলা খেয়েই কাটাতে হবে। মাংস টাংস খাওয়া চলবে না বাপু।”

সিংহ বেজার মুখ করে কলা দিয়েই পেট ভরায়। নইলে উঠে দাঁড়াতেও পারবে না আর গুহায় গিয়ে তার দাঁতের চিকিৎসা করাও হবে না। সিংহে কলা খায়, এমন ঘটনা বাঁদর তার জীবনে কোনোদিন দেখেনি। তাই সে বিশাল এক গাছের গুঁড়ির আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগল।

পাহাড়ের মাথায় গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে সিংহের পুরো তিনটে দিন কেটে গেল। দুর্বল শরীরে একটানা পথ চলা তার পক্ষে বেশ কষ্টের ছিল। বাইরে থেকে গুহার মুখটা দেখা যায় না। ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা পড়ে আছে। সূর্যের আলো বিশাল পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এখানে খুব একটা সহজে ঢুকতে পারে না। সারা রাস্তা সিংহ বাঁদরের সাথে একটা কথাও বলেনি। সে হচ্ছে জঙ্গলের রাজা। ইতর তুচ্ছ বাঁদরের সাথে কথা বলে নিজের সম্মান নষ্ট করা যায় নাকি? এদিকে কৌতূহল কিছু কম হচ্ছে না। কী এমন আছে এই গুহায়, যা তার দাঁত ভালো করে দিতে পারবে?

গুহামুখের কাছে পৌঁছে বাঁদর সিংহের থেকে কিছুটা তফাতে বসে বলল, “ভালো করে শোন খুড়ো। এখানে তোমার গায়ের জোর দেখাতে যেয়ো না কিন্তু। যদি দাঁত ভালো করতে চাও, যা বলব সব শুনবে। আমি গুহার ভিতর থেকে যতক্ষণ না বাইরে আসছি, তুমি চুপ করে ওই পাথরটার উপরে বসে বিশ্রাম করো। কলা-টলা খেয়ে একটু জোর এসেছে গায়ে। কিন্তু সামনে যদি কোনও শিকার পাও, ভুলেও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যেয়ো না কিন্তু! আসছি এখুনি।”

বাঁদরটা চলে যেতে গুহার পাশের পাটকিলে রঙের পাথরের উপর লেজ গুটিয়ে বসে থাকল সিংহ। চোখ বুজে একটু ঘুমিয়ে নিল। হঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে, কুচকুচে কালো শরীরের এক বুড়ো মানুষ তার কিছুদূরে দাঁড়িয়ে। হাতে তার ঢাল আর বল্লম। বাঁদর এক লাফে সিংহের মাথার উপরে গাছের ডালে দোল খেতে খেতে বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দাদু, এই সেই সিঙ্গি! নাও এর দাঁতটা একটু দেখো দেখি। বেচারা না খেতে পেয়ে মরতে বসেছে।"

এদিকে হাতের সামনে আস্ত একটা মানুষ পেয়ে সিংহের তো মুখ দিয়ে লালা ঝরতে শুরু করেছে। কিন্তু বাঁদরের কথা না শুনলে দাঁত ভালো হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তাও সে ভালো করেই জানে। মানুষটা স্থির দৃষ্টিতে সিংহের দিকে তাকিয়ে ভেবে নিচ্ছে তার উপর সিংহের ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও সম্ভাবনা আছে কি না। যদি ঝাঁপায়, তাহলে তার বল্লম সোজা গেঁথে যাবে সিংহের বুকে। মানুষ খাওয়ার লোভ সম্বরণ করতে সিংহ অন্যদিকে মুখ ফেরায়।

বুড়ো মানুষটা এবার কাছে আসে। সে জঙ্গলের ভাষা জানে। কাছে এগিয়ে এসে বলে, “বড় করে হাঁ করো দেখি বাপু। খবরদার একদম চালাকি করবে না। আমার কোনও ক্ষতি হলে বাঁচবে না তুমিও।”

বাধ্য ছেলের মতো সিংহ তার মুখ হাঁ করতে ভালো করে সিংহের মুখের ভিতর নজর চালিয়ে বুড়ো বলে, “হুম, একেবারে ঠিক হয়ে যাবে। শুধু দাঁতের ভিতর একটু ফুটো করতে হবে।”

এই কথা বলে বাঁদরকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সেই বুড়ো ফিসফিস করে কিছু নির্দেশ দিতে বাঁদর একছুটে গুহার ভিতর ঢুকে নিয়ে এলো লোহার তৈরি তীক্ষ্ণ ফলা আর একগাছা দড়ি। বুড়োর পায়ের কাছে সেসব নামিয়ে দিয়ে এক লাফে গাছে উঠে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। বুড়ো সেই লোহার ফলা পাথরে ঘসে ঘসে মসৃণ আর ছুঁচলো করে তুলল। বাঁদর কিছু সময় পর ফিরে এল একগুচ্ছ লতাপাতা নিয়ে। তারপর লতাপাতা পাথরের উপর আর একটা পাথরের টুকরো দিয়ে ঘসে ঘসে বুড়ো বানাল পাতার রস।

বাঁদর বলল, “দেখো খুড়ো, ঝপ করে আবার তোমার চোয়ালটা বন্ধ কোরো না বাপু। তাহলে কিন্তু আমাদের সব্বোনাশ।”

সিংহ হাঁ মুখ করেই, ‘ঘু ঘু’ , ‘ঘরর, ঘরর’ শব্দ করে জানালো যে সে সব কথাই মেনে নেবে। দাঁতের ব্যথা বড় বালাই। তারপর বুড়ো এক হাতে লোহার তীক্ষ্ণ ফলা সিংহের হাঁ মুখে ঢুকিয়ে ভাঙা দাঁতের উপর বসিয়ে দিতেই সিংহ “উঁ হুঁ হুঁ ঘ্রিয়াও ঘ্রিয়াও” বলে ভয়ংকর আওয়াজ করে উঠল, কিন্তু ভুলেও মুখ বন্ধ করল না। এবার লোহার ফলায় দড়ি জড়িয়ে, একদিকে বুড়ো আর এক দিকে বাঁদর, দড়ির প্রান্ত ধরে টেনে টেনে লোহার ফলা ঘোরাতে থাকল। আস্তে আস্তে ফুটো হল সিংহের দাঁত। তারপর সেই দাঁতের ফুটোয় পাতার রস ঢেলে দিল বুড়ো। কিছুক্ষণ এমন ভাবে চিকিৎসা চলতে লাগল। ধীরে ধীরে দাঁতের ব্যথা কমে যেতে সিংহের চোখ আরামে বুজে এল।

“কী গো কত্তা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”

বাঁদরের ডাকে সিংহ চমকে তাকায়। এবার মৌচাক থেকে ভেঙে আনা মোম সিংহের দাঁতের ফুটোয় জোরে জোরে চেপে দেয় বুড়ো। তারপর বলে, “সাতদিন শুধু কলা খেয়ে থাকতে হবে। তারপর শিকার টিকার করতে পার। তবে, একটু বুঝে শুনে। প্রয়োজনের বেশি যদি প্রাণিহত্যা করো, বনবিবি তোমাকে ছাড়বে না। খেতে না পেয়ে মরবে তখন।”

“কোনোদিন আর ওই কাজ করব না, এই প্রতিজ্ঞা করলাম। আমি তোমার কী উপকারে আসতে পারি বলো?” সিংহ আজ বড় খুশি।

সিংহের কথা শুনে বুড়ো বলল, “আমি আমার চিকিৎসার বিনিময়ে কিচ্ছু নিই না। সেবা করাই আমার কাজ। অসুস্থ আর বাচ্চা কোনও প্রাণী কোনোদিন মারবে না, শুধু এই কথাটা মনে রেখো। তোমার জীবন। স্বচ্ছন্দে কাটবে। এখন যাও, আমার রান্না বসানোর সময় হল।”

পাহাড়ি পথে সিংহের শরীর মিলিয়ে যেতেই বাঁদর বুড়োকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই বিদ্যে কোথায় শিখলে দাদু?”

বুড়ো গুহার দিকে পা চালিয়ে চলতে চলতে বলল, “সে অনেক হাজার হাজার বছর আগের কথা। আমাদের পিতৃপুরুষ এই বিদ্যে আবিষ্কার করে। তবে মানুষ ছাড়া কারো উপর এই বিদ্যে আমি কখনো প্রয়োগ করিনি। কিন্তু তুই আমার কথা জানলি কী করে?”

বাঁদর দাঁত খিঁচিয়ে হাসতে হাসতে এক লাফে গাছের ডালে লাফিয়ে উঠে বলল, “বাঁদরদের সবার হাঁড়ির খবর রাখতে হয় দাদু। সব কথা ফাঁস করতে নেই। ওই যে বললে সেবা, সেটা আমরাও মাঝে মধ্যে করে থাকি!”

বুড়ো তার হাতের লোহার ফলকটা তুলে, ছুঁড়ে মারার অভিনয় করে হাসতে হাসতে বলে, “সাধে কি আর তোদের বাঁদর বলে? যত্তসব বাঁদরামো!”

অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস

গল্পের ঝুলি : কুতুয়া : আবেশ কুমার দাস




তুলসীমঞ্চের পাশে মোটরসাইকেলখানাকে রাখতে রাখতেই চোখে পড়েছিল আশিসের। ছোট্ট ছোট্ট চপ্পলগুলো ছাড়া রয়েছে সিঁড়িতে। মাসিমণি এসেছে তাহলে। ঘরে ঢুকলেই এখন চেপে ধরবে বুঁচি-পেঁচি। ওদিকে আবার বরা থেকেই ফিরছে এখন আশিস। তেল ভরতেই হত আজ গাড়িতে।

রাস্তার এপারে বরা পেট্রোল পাম্প। ওপারেই সেই ঝুপড়ি দোকানটা। মিটারের কাঁটা তখন বাড়ছে চড়চড়িয়ে। আর তার উৎসুক চোখজোড়া ঘুরপাক খাচ্ছিল রাস্তার ওপারে। হুশ করে আওয়ালসিদ্ধির দিকে চলে গেল একটা লরি। দোকানঘরের সামনেটা শুনশান। তিনটে একশোর নোট বের করে দিতে দিতে ভাবছিল আশিস— আর আসবে না এই পাম্পে। জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে বড্ড। মাঝেমাঝেই বলে মাম্মাম, সবকিছুরই একটা শূন্যতা আছে...

মাসিমণির মোবাইল থেকে ফোন করেছিল একদিন বুঁচি, "এসেছে গো?"

"না রে, এখনও আসেনি।"

"ইস, কোথায় চলে গেল! রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে হয়তো। কোথায় বসে বসে কাঁদছে। আর কেউ কি ওকে খেতে দিচ্ছে তোমার মতো!"

মাম্মাম কিন্তু বলেছিল, "রাস্তা ওরা হারায় না..."

পাম্প থেকে বেরোতে যাবে, বউদির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। পাম্পের পেছনের চাপকলটা থেকেই দোকানের জল নেয় বউদি। ওই জলেই চা হয়। তাকে দেখে হেসে বলল, "যাও, গিয়ে বসো। যাচ্ছি জল নিয়ে।"

এরপর যেতেই হয়। নইলে তেল ভরে চুপচাপ চলেই আসত আশিস। মনে হয় আজকাল, ইস, যদি একখানা ছবিও তুলে রাখত মোবাইলে!

চায়ের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসবে। বউদি বলল, "আবার এসো। আগে তো রোজই আসতে। বোনদুটোকেও আর দেখি না।"

"একটু কাজে ফেঁসে গেছি আসলে ক’টাদিন। আসব।"

বউদিও খেয়াল করেছে তবে! খেয়াল করার কথাই অবশ্য। সকাল-বিকেল দু’বেলাও এসেছে এই সেদিনও। আচমকা এভাবে আসা বন্ধ করলে চোখে লাগবেই।

শীতের গোড়ার দিকে আচমকাই শরীরটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল মাম্মামের। বিছানা থেকেই উঠতে পারছিল না ক’দিন। বুঁচি-পেঁচিকে নিয়ে এসে কিছুদিন ছিল মাসিমণি। ওদেরও ইস্কুল আছে আবার। পেঁচি টু আর বুঁচিটা পড়ে থ্রিতে। আশিসই বাইকে চাপিয়ে ক’দিন স্কুলে ছেড়ে আসছিল দুটোকে। সেই থেকে গাড়ি চড়ার মজাটা ভালই পেয়ে নিল দুটোয়। বিকেলের দিকে বায়না ধরত প্রায়দিনই— দাদাভাইয়ের বাইকে চেপে ঘুরে আসবে দু’ চক্কর।

সেদিন বিকেলেও অমনই বেরিয়েছিল আশিস। শীতের ছোট বেলা। বিকেল গড়াতে না গড়াতে লেগে যায় অন্ধকার। কল্যাণী রোডটা পার হলেই শহরের চিহ্ন শেষ। তাপমাত্রার আচমকা হেরফেরটা বোঝা যায় স্পষ্ট। পশ্চিম থেকে পুবে নৈহাটি-হাবড়া পাকা সড়কের দু’পাশে মাইলের পর মাইল খালি ধানিজমি, ফাঁকা মাঠ, গাছগাছালি আর পুকুর-ডোবা। মাঝেমধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব রেখে দেবক বা হামিদপুরের মতো এক-আধখানা গঞ্জ বা গঞ্জঘেঁষা গ্রাম্য এলাকা। অন্ধকার নামল কি নামল না— চারপাশ তেপান্তরের মাঠ। বরার পেট্রোল পাম্পে গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাস্তার ওপারে ঝুপড়ি দোকানটার দিকে চোখ পড়ে গিয়েছিল আশিসের। চা ফুটছিল হয়তো উনুনে। গনগনে না হলেও আঁচের আভাটুকু টের পাওয়া যাচ্ছিল দূর থেকে। হাতের আঙুলগুলো তখন ঠান্ডায় প্রায় অকেজো।

ঝুপড়ি ধাঁচের হলেও বেশ খানিকটা জায়গা দোকানের ভেতর। একটা তক্তপোশে অল্প বিছানা। হয়তো একেবারে ফাঁকা রাখা ঠিক নয় বলে রাতে কেউ শোয় দোকানে। সন্ধ্যার মুখে একধার থেকে বিছানার অনেকটা গোল করে গুটিয়ে টুকিটাকি জিনিসগুলো তুলে রাখা ছিল। বিছানার লাগোয়া দরমার গায়ে একটা জানলা দিয়ে দেখা যায় পিছনের কলাবনখানা। গরমের দিনে দক্ষিণখোলা জানলাটা রাতে খুলে শুলে হয়তো একেবারে মন্দ হয় না। দরমার ঘরের এককোনায় জলের বড় একটা জালা। উত্তরের দরজার লাগোয়া কোমরসমান ইটের গাঁথনির উপর রাখা আছে কেক-বিস্কুটের বয়ামগুলো। পাশেই গাঁথনি করে বানানো উনুনে জ্বলছিল আঁচ। রাতে ঝাঁপ ফেলে দিলেই বেশ ছিমছাম গেরস্থালি টালির চালের দোকানটার ভেতরে।

চায়ের ভাঁড়ে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছে আঙুলগুলোকে আঁচে সেঁকে নিয়ে। তখনই মনে হল ছোট্ট ছোট্ট হাতে কেউ যেন পেছন থেকে ডাকছে পায়ে খোঁচা দিয়ে। পরক্ষণেই চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল পেঁচি আর বুঁচি।

"ও দাদাভাই, ও দাদাভাই গো!"

"ওটা তোমার পেছনে গো!"

"পালিয়ে এসো। পালিয়ে এসো।"

উনুনের ওপাশ থেকে একটা চ্যালাকাঠ ততক্ষণে তুলে নিয়েছে বউদি, "যা ভাগ। এমন শয়তান হয়েছে লালুটা! সবার কাছে চাইতে শুরু করেছে। ভয় নেই, কিছু করবে না তোমাদের।"

কিন্তু চ্যালাকাঠের ভয়ে নড়ার বান্দাই নয় লালুও। আশিস পেছন ঘুরে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। একবার আশিসের মুখের দিকে তো পরক্ষণেই বিস্কুটের বয়ামগুলোর দিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল লালুর চোখজোড়া। বুঁচি আর পেঁচি তখন গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে আশিসের।

ফেরার পথে দু’জনের মাঝখানে বসে বলছিল পেঁচি, "তোমার তো খুব সাহস দাদাভাই। আবার হাতে করে নিয়ে বিস্কুট খাওয়ালে ওকে।"

"ভয়ের কী আছে? দেখলি না, বিস্কুট খাবে বলে ডাকছিল কেমন!"

"একদম মানুষের মতো। না?"

"মাটিতে বসে সামনের একটা পা দিয়ে ডাকছিল। যেন হাত দিয়ে ডাকছে!"

আশিস বলল, "বউদি কী বলল শুনলি না? আসলে দোকানেই থাকে কুকুরটা। ভয়ের কিছু নেই। যে দোকানে আসে সবাইকেই নাকি ওভাবে ডেকে বিস্কুট চায়।"

"ওকে তো খেতে দেয় দোকান থেকে?"

"তাতে কী হয়েছে? খদ্দেরদের কাছেও যদি পায়। উপরি লাভ।"

মাম্মাম শুনে বলেছিল, "লাল কুকুর? দিস, ওদিকে গেলে মাঝেমধ্যে বিস্কুট দিস। লাল কুকুরকে খেতে দিলে রাহুর দশা কেটে যায়।"

মাসিমণিও বলেছিল, "হ্যাঁ, কে কোন ছলে এসে খেয়ে যায়!"

এমনিতেই কুকুরটাকে ভাল লেগেছিল আশিসের। মুখে সাড়াশব্দ নেই। নতুন কেউ দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেই চুপিসাড়ে পেছনে গিয়ে বসবে। আর সামনের একটা পা তুলে খোঁচা দিয়ে ডাকবে। চোখাচোখি হলে নিঃশব্দে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিস্কুটের বয়ামগুলোর দিকে একবার আবার পরক্ষণেই খরিদ্দারের মুখের দিকে একবার তাকাতেই থাকবে। প্রথমে ভয় পেলেও পরে লালুকে দেখে মজা পেত বুঁচি-পেঁচিও। যে ক’দিন তারপর মাসিমণি ছিল তাদের বাড়িতে রোজই একবার করে অন্তত বউদির চায়ের দোকানে নিয়ে যেতেই হত দুটোকে। ইতিমধ্যে আশিসের মোটর সাইকেলের আওয়াজও চেনা হয়ে গিয়েছিল লালুর। এমনিতে হয়তো গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকত দোকানের পাশে এককোণে। কিন্তু চেনা শব্দটা কানে গেলেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে নিত খানিক। তারপরই জিভ বের করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এসে দাঁড়াত আশিসের সামনে। প্রত্যেকদিনই তিন-চারটে করে বিস্কুট যেন বরাদ্দই হয়ে গিয়েছিল লালুর।

একদিন দোকান থেকে ফেরার পথে বলল বুঁচি, "আচ্ছা দাদাভাই, আমরা তো এই কুকুরটার একটা নাম দিতে পারি।"

"ওর নাম তো আছেই। লালু।"

"আহা, সে তো আমাদেরও ইস্কুলের নাম শ্রেয়সী আর মানসী। আবার তুমি বলো বুঁচি-পেঁচি।"

গিয়ার বদলাতে বদলাতে হেসে ফেলে আশিস, "আসলে তোর নাক বোঁচা ছিল ছোটবেলায়। তাই বুঁচি বলা হত। এটা কি ভাল একটা নাম হল?"

"হ্যাঁ, খুব ভাল নাম। তুমি বেশ ভাল ভাল নাম দিতে পারো। দাও না দাদাভাই ওরও একটা ভাল দেখে নাম!"

টালিখোলা পেরোতে পেরোতে বলেছিল আশিস, "বেশ, ওকে তাহলে আমরা বলব কুতুয়া।"

"ঠিক ঠিক। কুতুয়া।"

বাড়ি ফিরে মাম্মাম আর মাসিমণির কাছে গল্প করত দু’জনে, "কুতুয়াটা না একদম পোষ মেনে গেছে গো দাদাভাইয়ের। দাদাভাই গেলেই বিস্কুট খাবে বলে কী লাফালাফি করতে থাকে!"

মাম্মাম সেরে উঠলে বাড়ি ফিরে গেল মাসিমণিরা। যাওয়ার দিন বলেছিল পেঁচি, "কুতুয়াটাকে আর দেখতে যাওয়া হবে না আমাদের।"

"কেন হবে না? তোদের আমি রবিবার করে নিয়ে যাব। দেখিয়ে আনব।"

"হ্যাঁ, নিয়ে যেও তো। আর তুমি কিন্তু রোজ ওকে বিস্কুট খাইয়ে আসবে দাদাভাই। আশা করে বসে থাকবে বেচারা।"

রোজ না হলেও সপ্তায় তিন-চারদিন করে যেতই আশিস। রবিবার বা ছুটির দিনে মাসিমণির বাড়ি থেকে নিয়ে যেত বুঁচি-পেঁচিদেরও।

মাসদেড়েক আগে এক রবিবার সকালের কথা। বুঁচি-পেঁচিকে নিয়ে বউদির দোকানে গিয়েছিল আশিস। সচরাচর দোকানের সামনেই কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকত কুতুয়া। সেদিন ছিল না। উনুন থেকে কেটলি নামাতে নামাতে চিন্তিত মুখে বলল বউদি, "লালুকে কাল সকাল থেকে পাচ্ছি না জানো! কোথায় যে গেল! এমন তো করে না কখনও।"

"সে আবার কী! এই ধারেকাছেই তো বসে থাকে দেখি।"

"হ্যাঁ, বড়জোর উঠে পাম্পের দিক থেকে ঘুরে আসত এক চক্কর। কাল সকালেও ছিল এখানেই। সওয়া দশটা নাগাদও দেখেছি। একটু ভিড় ছিল দোকানে তখন। ব্যস্ত ছিলাম। সেই ফাঁকে উঠে যে কোনদিকে গেছে খেয়ালই করিনি।"

"এরকম গেছে নাকি আগে কখনও?"

"না যায়নি তো। তার জন্যই তো চিন্তা করছি আরও। রাস্তাঘাট তো বিশেষ চেনেও না ও। অন্য কুকুরের সঙ্গে দলে পড়ে বেশিদূরে চলে গেলে..."

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না আর সেদিন বউদির দোকানে।

মাম্মাম শুনে বলেছিল, "কুকুর তো কখনও ছেড়ে যায় না মনিবকে। আর সব্বাই বেইমানি করে। করে না একমাত্র কুকুরই।"

কিন্তু দিন গেল, সপ্তা গেল, মাস পেরিয়ে গিয়েও ফিরে এল না কুতুয়া। মাঝে একটা ইন্টারভিউ নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আশিসও। দু’-একদিন তারই ফাঁকে যেতে হয়েছে বরার পেট্রোল পাম্পে। গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেয়াল করেছে কেমন খাঁ খাঁ করছে বউদির দোকানের সামনেটা। হাতে সময় থাকলেও ঢুকতে ইচ্ছে করত না দোকানে।

ইন্টারভিউয়ের পর্বও মিটল একদিন। গরম কেটে বর্ষা এসে পড়ল ইতিমধ্যে। একদিন পাম্প থেকে বেরোনোর মুখেই ঝেঁপে বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গিয়ে বাধ্য হয়েই ঢুকে দাঁড়াতে হয়েছিল দোকানে। নিজে থেকেই বলল সেদিন বউদি, "লালু বোধহয় ফিরবে না গো আর।"

"কেন ফিরবে না? ঠিক গন্ধ চিনে চিনে ফিরে আসে কুকুর।"

বলে ফেলেও মনে হল আশিসের— যেন বউদিকে নয়, নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতেই বলল এই মুহূর্তে কথাটা।

যাতায়াতের পথে সাইকেল থামিয়ে এই দোকানে দু’দণ্ড বসে চা খায় দেবক বা রামচন্দ্রপুরের দিক থেকে আসা অনেক হাটুরে ধরনের লোকই। জরুরি কাজে নৈহাটির দিকে যাওয়ার পথে যেহেতু পড়ে দোকানটা। আর বৃষ্টি-বাদলায় হঠাৎ আটকে পড়তে হলে তো কথাই নেই। টালিখোলা থেকে সেই আওয়ালসিদ্ধি অবধি পাকা সড়কের লাগোয়া ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝুপড়ি দোকানগুলোই সেই মুহূর্তে পথিক বা সাইকেল-মোটর সাইকেলের আরোহীদের ভরসা। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটটা, কেকটা, পাউরুটি-অমলেটটাও বিকোতে থাকে তখন হু হু করে।

বাইরে যখন তেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে, দোকানের ভেতর বেঞ্চিতে বসে সেই মুহূর্তে বিড়ি টানছিল এই ধরনেরই একটা গ্রামের লোক। আশিসের কথায় সায় দিল লোকটাও, "ঠিকই। কিছুদূর ছেড়ে ছেড়েই পেচ্ছাপ করতে করতে যায় কুকুর। আবার ফিরে আসে সেই গন্ধ চিনে চিনেই।"

"কী জানি! এতদিন হয়ে গেল। আসার হলে এর মধ্যে কি আর আসত না?" 

চিন্তিত মুখে বলতে থাকে বউদি, গাড়ি-টাড়ি চাপা পড়ল নাকি কোথাও তা-ই বা কে জানে! যা স্পিডে যায় গাড়িগুলো সব। দেখি তো দোকানে বসে!"

ভাঁড়ে চুমুক দিতে গিয়ে আশিসের জিভটা পুড়ল হঠাৎ।

মাসিমণির বাড়িতে গেলেই রোজ ধরত বুঁচি-পেঁচিও। একদিন প্রায় আর্তনাদের সুরেই বলে ফেলল পেঁচি, "কুতুয়াটা কোথায় চলে গেল!"

হঠাৎ মনে হল আশিসের। ইস, যদি একখানা ছবি তুলে রাখত মোবাইলে!

কাল রাতে হঠাৎই ভেঙে গিয়েছিল ঘুমটা। শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিল একপাল কুকুরের চেঁচামেচি। রাতবিরেতে এমন শোনা যায় সব পাড়াতেই। বিশেষ করে দলছুট হয়ে এক গলির কুকুর যদি ঢুকে পড়ে অন্য গলিতে আর রক্ষে থাকে না। কিন্তু চারদিক থেকে সেই উন্মত্ত চেল্লামেল্লির মধ্যেই যেন আবছা হয়ে কানে আসছিল একটুকরো করুণ কান্নার আওয়াজ। কুকুরের কান্না। আশপাশের একটানা চিৎকারের মধ্যে ওই একটুকরো কান্নাটুকুই যেন ছিল বেমানান। দলছুট।

সকালে মুখ ধোওয়ার সময়ও মনে পড়ে গিয়েছিল রাতের কথাটা।

কিন্তু বাবা ব্যাঙ্কে যাওয়ার কথাটা তোলায় তখন চাপা পড়ে গিয়েছিল চিন্তাটা।

ব্যাঙ্ক থেকে ফিরতে ফিরতে বেজে গেল সাড়ে বারোটা। অল্প একটু বিশ্রাম নিয়ে স্নানে ঢুকবে ভাবছে। বাঁশ-কাগজের খামে তখনই এল সেই চিঠিটা। ব্যস, নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল তারপর। মাসিমণির বাড়ি, জেঠুমণির বাড়ি ফোন করতে শুরু করল মাম্মাম।


"দাদাভাই, আর গিয়েছিলে গো কুতুয়ার কাছে? ফিরেছে গো ও?"

আজকের দিনেও যে তাকে দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরে এই প্রশ্নটাই করবে বুঁচি জানতই আশিস।

চুপ করে থাকে সে।

মাসিমণি বলে, "ছাড়ো এখন দাদাভাইকে। সবে বাড়ি ফিরল। হাতমুখ ধুতে দাও। রাস্তার কুকুর। ওদের কি ঠিক আছে কিছুর? আজ এখানে কাল ওখানে। আবার দেখো কোথায় গিয়ে আস্তানা গেড়েছে।"

মাম্মাম হঠাৎ বলে ওঠে, "লাল কুকুর বলেছিলি না? আর দেখতে পাবি না ওকে।"

অবাক চোখে তাকায় আশিস।

মাম্মাম বলতে থাকে, "মানতে চাস না তো কিছু, তাই তোকে বলিনি এতদিন। তোর ঠিকুজিটা নিয়ে মাঝে একদিন গিয়েছিলাম সুজিতের কাছে। দেখেশুনে বলল, ছক তো খুবই ভাল এ ছেলের। কিন্তু রাহুর একটা খারাপ ফেজ চলছে এখন। তবে কেটে যাবে খুব শিগগিরি। দ্যাখ, তোর মতো ছেলে পাশ করে বসে আছিস বাড়িতে। এত জায়গায় ইন্টারভিউ দিচ্ছিস। ভালই হয় বলিস। অথচ ডাকে না কেউই। তোকে বলেছিলাম না, লাল কুকুরকে খেতে দিলে রাহুর দশা কেটে যায়। তোর হাতে যেটুকু সেবা পাওনা ছিল নিয়ে চলে গেছে।"

মাসিমণি বলে, "হ্যাঁ, হতেও পারে। বলেছিলাম না, কে কোন ছলে এসে খেয়ে যায়!"

কুতুয়াটাকে এই কয়েক মাস বিস্কুট খাওয়ানোর দরুনই আজ দুপুরের ডাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা এল কিনা জানে না আশিস। বিশ্বাস করা মুশকিল এসব কথায়। শুধু মনে পড়তে থাকে সেই কুতকুতে দুটো চোখের চাহনি। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে বসে সামনের একটা পা হাতের মতো করে তুলে মানুষের কায়দায় ডাকা।

সত্যিই আর দেখা হবে না কোনওদিন কুতুয়াটার সঙ্গে?

এত আনন্দের দিনেও খালি এটুকু মনে করেই চোখের কোনা ভিজে ওঠে আশিসের।


অলঙ্করণ : আবির

গল্পের ঝুলি : একেই বলে বরাত : তরুণকুমার সরখেল



হারাধনবাবুর ভীষণ ভুলোমন। এই ভুলোমন হওয়ার কারণে তিনি আজ পর্যন্ত একশো আটচল্লিশটি ছাতা, দু'শো ছাপান্নটি কলম, বাষট্টিটি চাবি ইত্যাদি হারিয়েছেন। হারানোর তালিকায় হারাধন বাবুর আরো কত কী রয়েছে তা তার মনে নেই। কেননা তাঁর ভীষণ ভুলোমন!

বাইরে বেরোনোর আগে হারাধনবাবু তাঁর 'দেওয়াল-কাম-মনে করানো বোর্ডে'র দিকে তাকান। দেওয়াল-কাম-মনে করানো বোর্ড জিনিসটা হল তাঁর সারাদিনের কাজকর্মের সঙ্গী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোথায় যেতে হবে, সঙ্গে কী নিয়ে যেতে হবে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে সবই তিনি ঐ দেওয়াল নামক বোর্ডে চক দিয়ে লিখে রাখেন। কিছু কিছু জিনিস চক দিয়ে না লিখে কালি দিয়েও লেখেন। অফিসে বেরোনোর আগে তিনি বড় করে লেখা তিনটি 'চ' অক্ষর ভালো করে দেখে নেন। প্রথম চ-এর অর্থ হল 'চিরুনি'। হারাধন বাবু স্নান সেরে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে খাবার টেবিলে চলে আসেন। খেয়েদেয়ে অফিস বেরিয়ে গেলে তাঁর মনে পড়ে, আরে চুলে যে চিরুনি চালানো হয়নি! উস্কো-খুস্কো চুল নিয়ে কি অফিসে যাওয়া চলে! বাধ্য হয়ে তিনি ফুটপাথ থেকে একটা চিরুনি কিনে চুল আঁচড়ে তবে অফিসে ঢোকেন। দ্বিতীয় চ-হল 'চশমা'। চশমা ছাড়া অফিসে যাওয়া মানেই ঘোর বিপত্তি। আর তৃতীয় চ হল 'চাবি'। যেটা হারাধনবাবু প্রায়দিনই অফিসে নিয়ে যেতে ভুল করেন। চাবি জিনিসটা তাঁকে বেশ ভোগায়। সকাল থেকে অফিসে যাবার তোড়জোড় করে নাকে-মুখে ভাত গুঁজে গলদঘর্ম হয়ে অফিসে পৌঁছে পকেটে হাত দিতেই দেখেন, চাবি আনতে ভুলে গেছেন। হারাধনবাবু অবশ্য বর্তমানে অফিসের একটা চাবি মানিব্যগের মধ্যে সবসময় ভরে রাখেন।এই মানিব্যাগের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত ঘটনাটাও এখানে বলে ফেলি।

বিয়ের কিছুদিন পরেই হারাধনবাবু গিন্নিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। নতুন জামাই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে বলে পোষাকটাও জমকালো হওয়া চাই। সকাল থেকে অনেক ভাবনাচিন্তা করে তিনি তসরের পাঞ্জাবিটি পরেই শ্বশুরবাড়িতে যাবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু গাড়ি যখন ছাড়ছে সে সময় হারাধনবাবুর মনে হল, না, এতটা রাস্তা তসরের পাঞ্জাবি পরে গেলে পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি ঘরে এসে একখানা মিহি সুতোর পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন। গাড়িও ছেড়ে দিল। শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে ড্রাইভারকে গাড়িভাড়া মেটাতে গিয়ে দেখলেন পকেটে মানিব্যাগ নেই। থাকবে কোথা থেকে? গাড়ি ছাড়বার আগেই তো মানিব্যাগসুদ্ধু পাঞ্জাবিটা ঘরে খুলে রেখে এসেছেন। তারপর মানিব্যাগ ছাড়া সেখানে কী কী ঘটনা ঘটল তা আর না বলাই ভাল। সেই থেকে হারাধনবাবু তাঁর ঘরের দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে রেখেছেন 'বাইরে বেরোনোর আগে মানিব্যাগ সঙ্গে থাকা চাই।'

তবে দেওয়াল লিখন লিখেও যে নিস্তার নেই এটা তিনি একবার বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। অভ্যেসমতো হারাধনবাবু একদিন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলেন 'আঠারোই মার্চ' লেখাটি লাল কালিতে লিখে তিনি সেটার উপর একটা বৃত্ত এঁকে রেখেছেন। লেখাটি তাঁর নিজেরই কিন্তু ঠিক কী কারণে আঠারোই মার্চ লিখলেন তা আর মনে করতে পারলেন না। কারো জন্মদিন? বিয়েবাড়ি? না তো। কিছুতেই মনে আসে না। শেষমেশ অভয়কে ফোন করলেন। অভয় তাঁর অনেকদিনের বন্ধু। নিশ্চয়ই ঐদিন তাঁর ছেলের উপনয়ন। কিন্তু ফোন করে জানতে পারলেন উপনয়নের এখন দেরি আছে। তাহলে? এদিকে পনেরোই মার্চ এসে গেল। অথচ আঠারোই মার্চ ঠিক কীসের অনুষ্ঠান তা হারাধনবাবুর কিছুতেই মনে পড়ল না। শেষে সতেরোই মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় বিষ্ণুপুর থেকে তাঁর বন্ধু ঋষির ফোন পেলেন। আর তখনই তিনি বুঝতে পারলেন ঘুম থেকে উঠেই তাঁকে ট্রেন ধরতে হবে। পুরী যাবার প্রোগ্রাম আঠারোই মার্চ নিজেরাই ঠিক করছিলেন। বলাই বাহুল্য, হারাধনবাবু সেবার বন্ধুদের সঙ্গে পুরী বেড়াতে যেতে পারেননি।

নিজের ভুলোমনের জন্য তাঁকে অনেকরকম অসুবিধের মধ্যে পড়তে হলেও একবার কিন্তু ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছিল। অন্যের ভুলোমন তাঁর কীভাবে কাজে এসেছিল সেটাই বলি।

জামাইষষ্ঠীর আগের দিন হারাধনবাবু শ্বশুরবাড়িতে যাবেন বলে সকাল আটটা কুড়ির চক্রধরপুর-গোমো ট্রেনে চেপে বসেছেন। গাড়িতে খুব বেশি ভিড় ছিল না। কিন্তু বাগালিয়া স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই পুরো একটা বড়সড় প্যাসেঞ্জার টিম হৈ-হৈ করে বগিতে চেপে পড়ল। 


হারাধনবাবুর মনটা অনেকক্ষণ ধরেই খচ্‌ খচ্‌ করছিল। তিনি কি কিছু ভুলেছেন? পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন মানিব্যাগ আছে। ব্যাগের মধ্যে জলের বোতল, রুমাল সব ঠিকঠাক আছে। তাহলে? না তাঁর কিছু ভুল হয়নি। অফিসে কাজের চাপে অনেকদিন ট্রেনে করে বাইরে যাওয়া হয়নি। হারাধনবাবু জানালার ধারে একখানা সিট পেয়েছেন। জৈষ্ঠ্যমাসের প্যাচপেচে গরমে জানালার ঠান্ডা বাতাস তাঁর চোখে ঘুম এনে দিচ্ছে। তিনি মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে ফেলছেন, কিন্তু সহযাত্রীদের হৈ-হট্টগোলে তাঁর সে ঘুম উড়ে যাচ্ছে। তিনি তো আর ডেলিপ্যসেঞ্জার নন যে এভাবে হৈ-হট্টগোলের মধ্যে একখনা তোফা ঘুম দিয়ে দেবেন। বাইরে কড়া রোদের তেজ আজ অনেকটা কম আছে। মাঝে মাঝে আকাশ মেঘলাও হয়ে যাচ্ছে। জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হারাধনবাবুর হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে 'তিনি কি কিছু ভুল গেছেন?"

মহুদা স্টেশন আসতেই কামরার সব প্যাসেঞ্জার লাইন দিয়ে ঝটপট করে নেমে গেল। কামরায় অনেকগুলো বাচ্চাও ছিল। সবাই একসঙ্গে নেমে যেতেই বগিটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ট্রেনও চলতে শুরু করল। পরের স্টেশনে তিনি নামবেন বলে তৈরি হাতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ চলে গেল বাঁ-দিকের বাঙ্কের উপর। দুটো মাটির হাঁড়ি কাঁচা শালপাতা দিয়ে ঢাকা। হারাধনবাবু হাঁড়ি দুটোর কাছে এসে শালপাতা আলতো করে খুলে দেখলেন ভেতরে বেশ বড় বড় রসগোল্লায় ঠাসা। বাগালিয়া ষ্টেশনে লোকগুলো যখন ট্রেনে উঠল তখন তিনি তাদের হাতে ঐ হাঁড়িদুটো দেখেছিলেন। এখন তিনি কী করবেন? লোকগুলো নিশ্চয়ই কোনও অনুষ্ঠানবাড়িতে যোগ দিতে চলে গেল। তারা রসগোল্লার হাঁড়ি দুটো না পেয়ে বিপদে পড়বে। কিন্তু হারাধনবাবু তো আর তাদের উপকার করতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ট্রেন থেকে নামার সময় হাঁড়ি দুটো তিনি সাথে নিয়েই নামবেন। হাতের নাগালে দু' হাঁড়ি রসগোল্লা গোল্লায় যেতে দিতে পারেন না। তিনি হাঁড়িগুলো না নামালে অন্য কেউ নামিয়ে নেবে। অন্যের জিনিস সাথে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক কি বেঠিক সে সব ভাববার আর তিনি সময় পেলেন না। গাড়ি ষ্টেশনে এসে থেমে গেল।

আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। এক পশলা বৃষ্টিও নেমে যেতে পারে। হারাধনবাবুর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ননষ্টপ ঝুলে আছে। তিনি কাঁধে ব্যাগ রেখে দুটো হাঁড়ি দু'হাতে ঝুলিয়ে মাঠ ভেঙ্গে হেঁটে চলেছেন। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে ঝাপটা মারতেই সহসা তাঁর মনে পড়ে গেল, আরে এতক্ষণ তিনি 'কী ভুলে গেছেন' ভাবতে ভাবতে আসছিলেন, কিন্তু তিনি মিষ্টি কিনতেই তো ভুলে গিয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন ট্রেনে ওঠার আগে গদাই-এর মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে নেবেন। অথচ মিষ্টি কেনার কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন।

যাইহোক, এখন তো আর কোনও চিন্তা রইল না। পরের ধনে পোদ্দারি করে তিনি দু-দুটো রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে সসম্মানে ঢুকতে পারবেন। হারাধনবাবু ভুলোমনের অনেক খেসারত দিয়েছেন। আজ অন্যের ভুলোমনের হাওয়া নিজের পালে লাগিয়ে তাঁর মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে।

আনন্দে ডগমগ হয়ে হারাধনবাবু লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন।


অলঙ্করণ : সুদীপ্ত দত্ত

গল্পের ঝুলি : তেরোর গেরোয় : দেবদত্তা ব‍্যানার্জী




তেরো সংখ‍্যাটাকে সবাই কেন অপয়া বলে অনয়া বোঝে না। একটা নির্দোষ সংখ‍্যার উপর সকলের এই রাগের কারণ ওর ছোট্ট মাথায় ঢোকে না। কিন্তু এই তেরো সংখ‍্যাটা যেন অনয়ার জীবনে একটা অভিশাপ। ছোটকাকুর বৌভাতের দিন পড়েছিল তেরো তারিখ। তাই ঠাম্মা সেদিন অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। চোদ্দ তারিখ হয়েছিল বৌভাতের অনুষ্ঠান। তাতে অবশ‍্য একটা দিন বাড়তি পাওনা হয়ে বেশ আনন্দ হয়েছিল অনয়ার। 

তবে সেবার পূজার ছুটিতে ওদের দার্জিলিং ঘুরতে যাওয়া বানচাল হয়ে গিয়েছিল এই তেরোর গেরোয়। চারমাস আগে ভোরবেলা লাইনে দাঁড়িয়ে বাবাই যখন টিকিট কেটেছিল, ওটা যে তেরো তারিখের টিকিট, আর ঠাম্মা যে কাউকে ঐ দিন যেতে দেবে না বাবাই বুঝতেই পারেনি। আসলে ছুটিটা তো ঐ দিন থেকেই পড়েছিল। ঠাম্মা ঘুরতে যাওয়ার পনেরো দিন আগে যেই শুনল টিকিট তেরো তারিখের, বলে দিলো যাওয়া হবে না। দাদু, মা, ছোট কাকু নতুন কাকি সবাই চুপ। ঠাম্মার এই তেরো সংখ‍্যার প্রতি বিরক্তির কারণ সবাই জানে। অনয়ার খুব রাগ হয়েছিল সেবার। 

আজ আবার ক্লাস টেস্টে অঙ্কে তেরো পেয়েছে ও। বাড়ি ফিরলেই কপালে মায়ের বকা নাচছে। অনয়ার জন্মদিনও তেরো তারিখ, তার উপর শনিবার অমাবস‍্যায় জন্ম বলে ঠাম্মা মুখ কালো করে হাসপাতালে দাঁঁড়িয়েই নাকি অপয়া বলেছিল ওকে। বাবাই তখন আদর করে সেটা বদলে ওর নাম রেখেছিল অনয়া।একমাত্র বাবাই ওকে ভালোবাসে। কিন্তু বাবাই তো শহরে থাকে, মাসে মাত্র একবার আসে।
পরশু বাবাই আসবে আর অনয়ার জন‍্য কত কী নিয়ে আসবে!


বাড়ি ফেরার পথে কালো বেড়ালটাকে আদর করে বাঁঁচিয়ে রাখা টিফিনটা খাইয়ে দেয় অনয়া। বেচারা বেড়ালটা কালো বলে ওকেও সবাই অপয়া বলে দূর দূর করে সবসময়। অথচ মিতিনদের লেজ মোটা হলদে হুলোটা সবার বাড়ি চুরি করে খেয়েও কত আদর পায়। তাই তো এই মেনিটাকে ওর নিজের সমব‍্যথী মনে হয়। রোজ বিকেলের দুধটা মায়ের চোখ বাঁচিয়ে মেনিকে খাওয়ায় ও। ওর ঐ বিড়ালপ্রীতিও ঠাম্মার চক্ষুশূল। কালো বিড়াল নাকি অলক্ষ্মী। এসব কথা সারাক্ষণ বলে চলেছে ঠাম্মা। বিড়ালটা মাঝে মাঝে ওর পড়ার ঘরের জানালায় এসে মিয়াও মিয়াও বলে ডাকে। ঠাম্মার কানে গেলেই শুরু হয় কীর্তন। 

''বেড়াল কাঁঁদা ভালো নয়, অলুক্ষুণে কালো বেড়াল...'' আরো কত কী বলতে থাকে।

গত মাসে ওর পড়ার ঘরে ইঁঁদুর হয়েছিল খুব। বইপত্র কেটে দিয়েছে দু'বার। মেনি কয়েকটা ইঁদুর মেরেছিল বলে ঠাম্মার কী চিৎকার! গনেশের বাহন হল ইঁঁদুর। এরাও নাকি ঘরের লক্ষ্মী। দাদুর ব‍্যবসার লক্ষ্মী। অথচ স্কুলের মিস বলে ইঁদুর খুব নোংরা, প্লেগের জীবাণু বহন করে।কিন্তু এদের কে বোঝাবে!


সেদিন বাড়ি ফিরেই অনয়া দেখে হুলুস্থুলু ব‍্যাপার, ওদের গৃহদেবতা লক্ষ্মীদেবীর গলার সোনার হার চুরি গেছে। সারা বাড়ি তোলপাড় হচ্ছে। ছোটকাকু আর নতুন কাম্মা এক সপ্তাহ আগেই ফিরে গেছে কলকাতায়, কাজের জায়গায়। ওরাও থেকে থেকে ফোন করছে। মিনুদিদি আর কণিকামাসি এ বাড়িতে কাজ করে। বাইরের লোক বলতে ওরাই একমাত্র তিনতলায় ছাদের ঘরে যায়। আর তো বাইরের কেউ ঢোকে না।ওদের বারবার করে জিজ্ঞেস করছে ঠাম্মা আর মা। মিনুদিদি পা ছড়িয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁঁদছে আর বলছে, ''শেষে চুরির অপবাদ! ও মা লক্ষ্মী, দেখো গো মা! এই বাড়িতে এত খাটি, কুটোটি নিই নি গো মা, তাতে এখন এরা এসব বলছে!"
কণিকামাসি গম্ভীর হয়ে বলছে, ''শেষ বয়সে শেষে তোমরা আমাদের চুরির দায়ে জেলে দেবে? এ-ও ছিল কপালে!''


দাদু গম্ভীর হয়ে পায়চারী করছে আর বলছে, ''বাসি ফুলের সঙ্গে ফেলে দাওনি তো? খুঁজে দেখো আবার।''
মা বলছে, ''সব ফুল নেড়ে দেখে এসেছি বাবা। কোথাও নেই। প্রায় দু'ভরির ভারি হার। গতকালও মায়ের গলায় ছিল।''


অনয়ার অঙ্ক খাতার কথা আর বলা হয় না। তাড়াতাড়ি খেয়ে ও নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সন্ধ‍্যায়ও থমথমে পরিবেশ। দাদু বাধ‍্য হয়ে থানায় জানিয়েছে। দুজন মোটা গোঁফওয়ালা পুলিশ এসে মিনুদিদি আর কণিকামাসির সঙ্গে কী সব কথা বলছে থেকে থেকেই। রাতে আজ একাই পড়াশোনা করল অনয়া। শুয়ে শুয়ে ভাবে আজ তো তেরো তারিখ নয়। তবে কেন এমন হলো!
পরদিন স্কুল যেতে হল ম‍্যাগি খেয়ে। কণিকামাসি কাজে আসেনি। হয়তো আর আসবে না। মিনুদিদি এ বাড়িতেই থাকে। সে রাঁধতে জানে না। আজ টিফিনেও জ‍্যাম ব্রেড। 


বিকেলে বাড়ি ফিরেই অনয়া বোঝে এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ঠাম্মা থেকে থেকেই ''মা গো , পাপ নিও না। এ কী অমঙ্গল হল গো!'' বলে সুর তুলছে। 

কখনো বলছে, ''সোনা হারানো খুব বাজে। হবে না! এক অপয়া রয়েছে ঘরে, এ ঘরে কি লক্ষ্মী থাকবে?'' 

অনয়া বোঝে না এতে তার দোষ কোথায়! দাদু আজ দোকান খোলেনি। মায়ের মুখ গম্ভীর, বাবাই নাকি দুপুরের পর আর ফোন তুলছে না। ফোন লাগছেই না।

মিনুদিদি বিকেলের দুধটা ওর টেবিলে রেখে বলে যায়, ''আমার হয়েছে যত জ্বালা, মাস পুরলে চলে যাবো আমিও কাজ ছেড়ে।''


বাটিটায় দুধটা ঢেলে পা টিপে টিপে অনয়া বাগানে বেরিয়ে আসে। পিছনের ভাঙাচোরা আবর্জনা রাখার ঘরটার পাশেই মেনি থাকে এসময়। কিন্তু আজ নেই। দুধটা ফেলে রাখলে হুলো খেয়ে যাবে। তাই বাটি হাতেই ও বাগানে খুঁজতে বার হয়। মৃদু স্বরে মেনিকে ডাকতেই সে মিয়াও করে সাড়া দেয় গোলাপগাছের ঝোপের নিচ থেকে। বাটি নামিয়ে চুকচুক আওয়াজ করে অনয়া। কিন্তু মেনি কী যেন করতে ব‍্যস্ত! মাটি খুঁড়ে কী করছে ও? 


অনয়া এগিয়ে যায়। গোলাপঝাড়ের নিচের নরম মাটি দু পায়ে খুঁড়ছে মেনি। ওর কি শরীর খারাপ? শরীর খারাপ হলে কচি দুব্বো খায় ওরা, মা বলেছিল। গোলাপঝাড়ের নিচে দুব্বোঘাস আছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে অনয়া দেখে মেনিটা একটা কী যেন টেনে বার করতে চাইছে, চকচক করছে জিনিসটা। 

আরে, এই তো সেই হারটা! তাড়াতাড়ি মেনির সঙ্গে দু'হাতে মাটি খুঁড়ে হারটা খুঁজে পায় অনয়া। লাফাতে লাফাতে দুধের বাটি ভুলে ঘরে ছোটে ও।


আর তখনি একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাড়ির সামনে। অনয়া দেখে বাবাইও চলে এসেছে। ওর আর খুশির সীমা নেই। ওর চিৎকারে মা ঠাম্মা সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মা তো কেঁদেই ফেলেছে বাবাইকে দেখে।


''আজই চলে এলাম, বুঝলে! কী সব চুরি হয়েছে বললে। তাই আর কি!'' বাবাই অনয়াকে কোলে তুলে নেয়।
''এই দেখো, চোরাই মাল। আর কে খুঁজে দিয়েছে জানো? আমার মেনি, ঐ কালো বেড়ালটা।'' 


অনয়ার হাতে মাটি মাখা হারটা দেখে সবাই অবাক। 

মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ বদলে যায়। 


আপাতত মেনিকে ড্রইং রুমের মেঝেতে বসিয়ে আদর করে দুধ খাওয়াচ্ছে ঠাম্মা। আর বাবাইয়ের কোলে বসে মেনির হার খুঁজে দেওয়ার গল্প করছে অনয়া। দরজার পাশে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে মিনুদিদি। ঠাকুরের বাসন নামিয়ে রোজ বাগানে দুব্বো আনতে যায় ও বাসন মাজার জন‍্য। সে সময় হারটা বাগানে পুঁতে এসেছিল, কাজ ছেড়ে দেবে বলে গান গাইছিল। সময় সুযোগ বুঝে তুলে নিত। খবর পেয়ে কণিকামাসিও এসেছে ফিরে। এত বছরের পুরানো কাজ, ভালো মাইনে, কেউ কি ছাড়তে চায়? ছোটকাকুদের ফোনে জানানো হয়েছে সব।

হঠাৎ বাবাই বলে ওঠে, ''যে মেনিকে অপয়া বলতে সে-ই কিন্তু আজ হিরো। ওর জন‍্যই হারটা পাওয়া গেলো। আর আজকের বাংলা তারিখটাও কিন্তু তেরো। আজ কিন্তু খুব ভালো দিন। আর আমার মেয়েকে তোমরা তেরোর খোঁটা দেবে না বলে দিলাম।ওর আর মেনির জন‍্য আজ লক্ষ্মীর হার ফেরৎ এলো।''


ঠাম্মা আজ প্রথমবার অনয়াকে আদর করে বলে, ''ও তো এবাড়ির জ‍্যান্ত মা লক্ষ্মী।'' 


মিনু হঠাৎ কেঁদে এসে বাবাইয়ের পা জড়িয়ে বলে, ''বড়দা, লোভের বশে করে ফেলেছি গো। আমার কাজটা খেয়োনি গো। আমি আর এসব করবোনি গো। ও বড়মা তোমার লক্ষ্মীর দিব‍্যি বলছি গো। ''

দাদু বলে, ''ঠিক আছে, ঠিক আছে। আবার দিব‍্যি! কুসংস্কারগুলো আজ থেকে বাতিল। সেই আনন্দে একটু মিষ্টি নিয়ে আয় তো মিনু।ডায়বেটিস আজ আর মানছি না।'' 


সবাই হেসে ওঠে। আর তখনি অনয়ার মনে পড়ে অঙ্কখাতার নম্বরটা বাড়িতে বলাই হয়নি। তবে বাবাই যখন আছে চিন্তা নেই। মাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে চুপি চুপি কানে কানে বাবাইকে বলতেই বাবাই বলে, 

''কুড়িতে তেরো তো অনেক নম্বর রে। আমিও এত নম্বর পেতাম না ছোটবেলায়। আজ তো মিষ্টি আসবেই সবার জন‍্য।''

আনন্দে ঝলমল করে ওঠে অনয়ার মুখ। আর তেরোকে কেউ খারাপ বলতে পারবে না। মেনিও ওদের ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়ে গেলো আজ থেকে। কী মজা!! কালো মেনিটা কী বুঝল কে জানে, দুধ শেষ করে ঠোঁটটা চেটেই ডেকে উঠল "মিয়াও মিয়াও"।



অলঙ্করণ : আবির

গল্পের ঝুলি : স্কুল থেকে ফেরবার পথে : প্রদীপ কুমার বিশ্বাস



স্কুল বাসটা লজঝড়ে । প্রায়ই ঠিক বাড়ি ফেরবার সময়ই তার কিছু না কিছু বিগড়ায়। ড্রাইভার, মেকানিক তার মেরামতিতে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে শ্যাম, নিত্য, দেবা আর কার্ত্তিক এই চার বন্ধু চুপিসাড়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। শর্টকাটের রাস্তায় তারা অনেক আগেই বাড়ির কাছে পৌঁছে যায়।

গরমের ছুটির পর আজ প্রথমদিন স্কুল খুললো আর তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। কিন্তু সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ঠিক শঙ্খনালার সাঁকোর কাছে বাসটা বেশ বাজেভাবে বিগড়ে গেল। শঙ্খনালার পাড় ধরে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যায় তাদের পছন্দের বাগান-বাড়িটা। সেখানে নানারকম ফলের গাছের ছড়াছড়ি। অন্য বাগান-বাড়িগুলোর মতো এর পাঁচিল তালগাছের মতো লম্বা নয়। গেটটাও তার সাথে মানানসই সাইজের। বেশ বেঁটে-খাটো । বাগানের মালী এবং পাহারাদার লখন দিনদুপুরেই সিদ্ধি খেয়ে চোখ লাল করে থাকে। লখনের এই গুণের জন্যই এই বাগান বাড়িটা ওদের আরও পছন্দ।

গরমের ছুটির পর এই পথে আজ এই প্রথম আসা। বাগান-বাড়ির গেটের সামনে এসে ওরা সবাই থমকে দাঁড়ালো। এই ক'টা দিনে এই বাগানবাড়ির দেওয়ালে নতুন ইটের সারি চাপিয়ে সেটা বেশ অনেকটাই উঁচু করা হয়েছে। নতুন দেওয়ালের সঙ্গে মানানসই উঁচু নতুন গেট। সেটা আবার ভেতর থেকে বড় তালা দিয়ে বন্ধ করা। গেটের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে যতোটুকু দেখা যায়, তাতে ওরা হতাশ হয়ে দেখল যে প্রায় সব গাছই ফাঁকা। কার্তিক ফিসফিসিয়ে বলে,“ভাং-খেকো ফোকলা মালী পেয়ারা, আম, সবেদা সব বাজারে বেচে দিয়েছে”। 

নেত্য ভেংচে ওঠে,“একটা পাকা সবেদাও তো কামড়াবার উপায় নেই ওর”।

কার্তিক আর দেবার নজরে এলো, দূরে এক গাছের তলায় ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা মই। নিত্য দেখে যে গেটের সামনের দেওয়ালে একটা কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটানো আছে । তাতে কেউ কাঁচা হাতে কালো কালিতে লিখে রেখেছে,“TO LET HERE”। বেশ মোটা করে লেখা আর শব্দগুলোর মধ্যে অনেক ফাঁক। শ্যাম বলে “নেতাই, তোর কালো ফেল্ট পেনটা দে তো!”

নিত্য বলে “ সেটা দিয়ে এখন কী করবি?”

শ্যাম চাপা হাসি মুখে এনে বলে, “ দে এখন, দেখতেই পাবি একটু পরে।”

কালো কালির TO LET এর মাঝে খালি জায়গাতে কালো ফেল্ট পেন দিয়ে মানানসই এমন একটা ইংরেজি অক্ষর শ্যাম লিখল যে বিজ্ঞাপনটার মানে পালটে গেল। ছিল “TO LET HERE”, কিন্তু হয়ে গেল “TOILET HERE” .

শ্যামের কাণ্ড দেখে বাকি তিন বন্ধু কোনওরকমে হাসি চেপে বাগানের পেছন দিকের দেওয়ালে মইটা নিয়ে গেল। পেছনের দিকের গাছগুলো নিরাশ করেনি। মই বেয়ে নামতে-নামতে দেবা একটা আধ-খাওয়া পেয়ারা ছুঁড়ে মারল বাগানের ভেতরে। সেই দেখে বাকিরাও শুরু করল। পর-পর বেশ কিছু পেয়ারা গিয়ে পড়ল, মালীর টিনের ছাদের আস্তানায় । কিন্তু দুপুরের ভাঙের নেশায় মালীর ঘুম না ভাঙলেও একটা ঘেউ-ঘেউ আওয়াজ শুনে ওরা চারজন কোনওমতে নেমে বাড়ির রাস্তার দিকে দৌড়ালো ।

মালী তাহলে এখন একটা দেশী কুকুর পুষেছে । লম্বা গরমের ছুটির পর আজই ওরা প্রথম আসছে। এই খবর তো না জানবারই কথা । ওদের মধ্যে সব চাইতে ঠাণ্ডা মাথা শ্যামুর। ও সবাইকে দৌড়াতে বারণ করতে-করতে বলল, “ওরে তোরা থাম, আমার কথা শোন । অত উঁচু গেটটা, অ্যালসেসিয়ান কুকুরেও কোনোমতেই পার হতে পারবে না” ।

ততক্ষণে ওরা নালার পাশে ঢিপির কাছে এসে গেছে । ঢিপিটার চারপাশ ঝোপে ঢাকা থাকায় একটা সুবিধে হল। বাগানবাড়ির গেটের আশপাশ ওরা দেখতে পেলেও ওখান থেকে ওদেরকে দেখা কুকুরটার পক্ষেই বেশ মুস্কিল আর মালী বেচারার তো কথাই নেই। কুকুরটার চিৎকারে সে বেচারা কোনোরকমে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে টলতে-টলতে দৌড়োবার চেষ্টা করতে গিয়ে, গেটের সামনে এসে চিৎপাত হয়ে উলটে গেল। তার ভুঁড়ির হাপরের মতো ওঠা-নামা দেখে কুকুরটাও বিরক্ত হয়ে গরর-গরর করতে-করতে সরে গেল।

ঢিবির ঢালে বসে পেড়ে আনা ফলসা আর পেয়ারায় কামড় দিতে-দিতে ওরা তাই দেখছিল আর খুব কষ্টের সঙ্গে চাপা হাসি হাসছিল । পকেট ভরতি পেয়ারা আর গাছ-পাকা আমগুলো। তার থেকে ভালো ভালোগুলো দেখে ভাই-বোনদের দেবার জন্য স্কুলব্যাগে চালান করছিল দেবা আর নেতাই। শ্যামু আর কার্তিকের ভাই বোন নেই। তবে ওদের বিল্ডিং-সোসাইটির দারোয়ানদের বাচ্চাগুলোকে কিছু দেবে । ওদের মধ্যে এই সব কথাই হচ্ছিল। কিন্তু কার্তিকের রাডারের মতো চোখে ধরা পড়ে এক দারুণ দৃশ্য ।

ও বলে,
“সবাই সামনের দেয়ালের শেষটায় দেখ। শ্যামুর কারসাজিটা ধরতে না পেরে ওরা কিন্তু দেওয়ালে সাঁটানো নোটিসগুলোকে সিরিয়াসলি নিয়েছে”। 

স্কুল-বাসের ঠিক হয়ে যাবার আশা ছেড়ে দিয়ে দলে- দলে ওদের স্কুলের ছেলেরা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরেছে। তারা এখন বাগানবাড়ির সামনের দেওয়ালের শেষ থেকে শুরু করে গেটের প্রায় কাছে পর্যন্ত জায়গায় সমবেত টয়লেট করা শুরু করে দিয়েছে।এইসব দেখে মালীর কুকুর সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে । ভাঙের নেশায় ডুবে থাকা মালী মাথা তোলবার চেষ্টা করেও পারছে না। দেবা, কার্ত্তিক, শ্যামু আর নেতাই এতক্ষণ ধরে হাসি চেপে ছিল। এবার এই সব দেখে আর পেরে উঠলো না হাসি চাপতে।

নিজেদের টাউনশিপে ঢুকে শ্যামু আর নেতাই একটু জোরে পা চালিয়ে তাদের বাড়ির দিকে চলে গেল। কার্ত্তিক আর দেবা বাসস্ট্যান্ডের কংক্রিট বেঞ্চিতে বসে গেল। কেউ দেখলে ভাববে, এইমাত্র স্কুল-বাস থেকে নেমে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আসলে ওদের এখনই ঘরে ফেরার তেমন তাড়া নেই। ওদের মায়েরা এখন কোনও এক আন্টির বাড়িতে তাস খেলায় ব্যস্ত।

কার্ত্তিক বলে “দেবা আজ দিনটা বেশ গেল কিন্তু!”

কার্ত্তিক বলে “ দেবা, শ্রী বাস্তব আঙ্কল আর আন্টি বেড়াতে বেরোল।”

“তাতে আমাদের কী?”

“তুই ভুলে গেলি? এই তো সেদিন, সেই হরতালের দিন আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম এখানে । একটা বল গেট পেরিয়ে, ওদের বাগানে চলে গেছিল” ।

“বল তো আঙ্কল দিলই না, তার ওপর আন্টি কত গাল-মন্দ করল!”

কার্ত্তিক বলে, “আঙ্কলদের ফিরতে আধাঘণ্টারও বেশি হবে। সেবারে আন্টি যখন ধমকাচ্ছিল, তখন ভুট্টাগাছগুলোতে সবে মাত্র থোড় এসেছে।”

দেবা, কার্তিকের মতলবটা তখনো বুঝতে পারেনি। কার্ত্তিক সেটা বুঝে, নিজের স্কুলব্যাগ থেকে একটা লাল বল বের করে আশ্বাস দেয়,“আমরা মিনিট-খানেক ওদের বাংলোর পেছনে এই বল নিয়ে লোফালুফি খেলবো। কয়েকবার খেলার পর বলটা গেট পেরিয়ে ঢুকতেই পারে । আমি গেট টপকে ঢুকে যাব আর তুই চলে যাবি সামনের গেট থেকে একটু তফাতে। কেউ যদি দেখে থাকে, তবে সে এইটুকুই দেখবে। এইবারে বুঝলি হাঁদারাম?”

কার্ত্তিক এবার দেবার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,“আমি একটা-একটা করে ভুট্টা ছুঁড়বো আর তুই আমাদের দু’জনের ব্যাগে ঢোকাতে থাকবি। আর যদি দেখিস আঙ্কল-আন্টি ফিরে আসছে, তবে আমাকে ইশারা করেই তুই স্মার্টলি সটকে পড়বি। আমি বাংলোর পেছনের গেট টপকে পালাব।”


দেবা নিজের বুড়ো আঙুল তুলে ইশারা করতেই কার্ত্তিক পি-টি স্যারের গলা নকল করে বলে, “এনি ডাউট বয়েজ? তব আগে বাঢ়, ডরকে আগে জিত হ্যায়।”

শ্রীবাস্তবদের বাংলো পেরিয়ে সামান্য এগিয়ে গেলেই পার্ক। পার্কের আগাছা কেটে সাফ করা, শুকনো ঘাস-জঙ্গল। ঝোপে আগুন লাগিয়ে মালী গেছে কোথাও হাত-মুখ ধুতে। সেই ধিকিধিকি আগুনে সেঁকে নেওয়া কচি ভুট্টাগুলো খেতে-খেতে ওরা দু’জনেই বলাবলি করছিল,

"একটু নুন আর লেবু হলে মন্দ হতো না।” 

একটা “হায়-হায়” ধ্বনি ভেসে আসতেই দু’জনে মুখ বাড়িয়ে দেখে, শ্রীবাস্তব আঙ্কলদের বাড়ির সামনে বেশ ভিড় ।

দেবা আর কার্ত্তিক শ্রীবাস্তবদের বাংলো থেকে ফেরবার সময় বেশ কিছু ভুট্টার সবুজ খোসা ওখানেই ছাড়িয়ে গেটের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল। আন্টি একবার গেটের দিকে দু’হাত দেখিয়ে, আর একবার কপালে চাপড়ে সমানে 'হায়- হায়’ করে যাচ্ছে। 


হঠাৎ দেবাও বলে ওঠে,“ হায় রে! শেষবারে, বলটা তোকে ছোঁড়বার জায়গায়, আর একটা কচি ভুট্টা ছুঁড়েছি।”

নতুন বল, তবুও সেই শোক সামলে কেতো দেবার পিঠ চাপড়ে দিতে গিয়ে দেখে ওদের পিছু-পিছু ভোলু আসছে। ভোলু এই পাড়ার দেশী কুকুর। কেতো ওর পকেটে রাখা একটা বিস্কুট ভোলুর দিকে এগিয়ে দিতেই সে লেজ নাড়ার সাথে-সাথে কেতো’র পায়ে মুখ ঘষতে থাকে। কেতোর পায়ে আর একবার মুখ ঘষে আর গর-গর আওয়াজ করতে-করতে শ্রীবাস্তবদের বাড়ির বাগানের পেছনের গেট লাফ দিয়ে পেরিয়ে ভুট্টা গাছগুলোর দিকে দৌড়ে চলে যায় । বিস্কুটদুটো পড়েই থাকে। মিনিট-খানেকের কম সময়ে বাগান থেকে সে ফিরে আসে। তার মুখে কেতোর সেই ফেলে আসা বল। বলটা কেতোর পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে, একবার ভৌ করেই এবারে বিস্কুট কামড়ানোয় মন দেয় ভোলু ।

বিস্মিত ওরা দুজন “সাবাস ভোলু” বলা ছাড়া আর কিছু বলতে পারেনি। এতদিন, ভোলুকে ওরা আসলে একটা অবোধ পশু ভেবেছে। সত্যি-সত্যি বন্ধু ভাবেনি। এই সত্যটা তাদের সামনে আসতেই কিছুটা লজ্জা আর আর অনেকটা অনুশোচনা এই দুটোই তাদের দুজনকে বাড়ির রাস্তার শেষ-অবধি সাময়িক বোবা করে রেখেছিল ।


অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু

গল্পের ঝুলি : মায়ের গল্প : বনশ্রী মিত্র



                     এক

রোজ দুপুরে ইকির মিকিরকে গল্প না শোনালে ওরা কিছুতেই ঘুমোয় না। ইকির, মিকির আমার দুই মেয়ে।পিঠোপিঠি দুই বোন। ইকির এক বছরের বড় মিকিরের থেকে। এই তো ইকির তিনে পা দিল। মিকির দুইয়ে।রোজ-রোজ এত গল্প পাই কোথায়? ওদের আবার বই খুলে গল্প শোনালে হবে না। তাই আপন মনে ভেবে-ভেবেই গল্প শোনাই ওদের। আজ যেমন রান্না করতে করতে বাইরের বট গাছটার দিকে তাকিয়ে এই গল্পটা মাথায় এল! চটপট রুইমাছের ঝোল কড়া থেকে বাটিতে ঢেলেই গল্পের প্লটটা মোবাইলে লিখে রাখলাম।আসলে অনেক প্লট মাথায় এসেই আবার কেমন হাওয়ায় ভেসে চলে যায়। তাই আজকাল লিখে রাখি আমার ফোনে।

দুপুরবেলা বিছানায় যেই একটু গা এলিয়েছি, অমনি শুরু হল ইকির-মিকিরের ফন্দিফিকির। “গল্প বলো,গল্প বলো।” 
তাহলে ঐ রাক্ষসের গল্পটাই এখন বলি। ঐ যে ঐ বট-রাক্ষস!


নন্দীপুর গ্রামের বাইরের দিকটায় ছিল একটা টিলা।সেখানেই ছিল বটরাক্ষসের বাস। তার ভয়ে কেউ ঐ টিলার ধারেকাছে ঘেঁষত না। প্রায়ই গ্রামের বাছুর, ছাগলছানা খেয়ে নিত সে।

বটরাক্ষসের হাত থেকে মুক্তি পেতে গ্রামের লোকেরা শরণাপন্ন হল গ্রামের ইস্কুলমাস্টার মনোজ দত্তের।

“শরণাপন্ন মানে কী মা?” ইকির অমনি প্রশ্ন করে উঠল।মিকিরও বড়-বড় চোখ করে তাকাল আমার দিকে। হ্যাঁ, তাই তো, এত শক্ত শব্দ ব্যবহার করা আমার মোটেও উচিত হয়নি।

তাই সহজ করে ওদের বোঝালাম - বটরাক্ষসের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের লোকেরা সকলে মিলে গ্রামের ইস্কুলমাস্টারের কাছে বুদ্ধি নিতে গেল। মনোজ দত্ত মানুষটা খুব বুদ্ধিমান।তাই গ্রামের লোক কখনো কোনও সমস্যায় পড়লে বুদ্ধি নিতে মাস্টারমশাইয়ের কাছে যায়।

ছুটির দুপুরে খাওয়া শেষ করে মনোজ দত্ত তখন খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন, দল বেঁধে হাজির হল রমেশ, কানাই, রহিম, জগু এবং আরো কয়েকজন।

বটরাক্ষসের কথা মনোজ দত্ত জানতেন। সবার সাথে কথা বলে তাদের চিন্তার কারণটা বুঝলেন।

আমাকে থামিয়ে মিকির প্রশ্ন করল, "আচ্ছা মা, বটরাক্ষস কি মানুষও খায়?"

ও হ্যাঁ, এই কথাটা তো আগে বলাই হয়নি।আজ থেকে অনেক বছর আগে এক সন্ন্যাসী যখন বনের মধ্যে তপস্যা করছিলেন তখন বটরাক্ষস সেই সন্ন্যাসীকে আক্রমণ করে। তপস্যা ভেঙে যাওয়ায় সেই সন্ন্যাসী বটরাক্ষসকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে সে আর কোনদিনও কোনও মানুষ খেতে পারবে না। আর কোনও মানুষকে কখনো যদি সে আক্রমণ করে তবে সে আর রাক্ষস থাকবে না।

"সে আর রাক্ষস থাকবে না? তাহলে সে কী হবে মা?" ইকির অমনি প্রশ্ন করল।

সে কথা তো সন্ন্যাসী বলে যাননি। শুধু বলেছিলেন,  কোনও মানুষকে আক্রমণ করলে বটরাক্ষস আর রাক্ষস থাকবে না। আর সেই ভয়েই তো বটরাক্ষস তারপর থেকে শুধু বাছুরছানা, ছাগলছানা খেয়ে দিন কাটায়।

মিকির আমার আরো কাছে ঘেঁষে বলল , “তাহলে মাস্টারমশাই কী বুদ্ধি দিলেন?”

মনোজ দত্ত, মানে মাস্টারমশাই বেশ বুদ্ধিমান লোক আর নানান বিষয়ে খোঁজখবরও রাখতেন। বটরাক্ষসকে সন্ন্যাসীর দেওয়া অভিশাপের কথাটা তিনি বেশ ভালোই জানতেন। খানিক ভেবে তিনি গ্রামের লোকেদের বললেন, বটরাক্ষসকে লোভ দেখাতে হবে।মানুষ খাওয়ার লোভ! যদি সেই ফাঁদে সে পা দেয়, তাহলে হয়তো তার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

মনোজ দত্তের এমন প্রস্তাব শুনে গ্রামের লোক প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। তারা মাস্টারমশাইকে বলল, সন্ন্যাসীর অভিশাপের ফল কী হতে পারে তা তো কেউ জানে না।যদি মানুষ আক্রমণ করার পর সে মানুষ মরে যায় আর বটরাক্ষস আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন তো আরও বিপদ! আর তাছাড়া সবারই প্রাণের মায়া আছে। গ্রামের কে-ই বা এমন কাজ করতে রাজি হবে?

ইকির আমায় জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা মা,তাহলে গ্রামের সবাই কি ভীতু?কারুর সাহস নেই!”

তা নয়,তা নয়। সবাই ভীতু নয়।আমি ইকিরকে বোঝালাম।

মনোজ দত্ত গ্রামের সবাইকে থামিয়ে বললেন, “দেখো, কাউকে তো এগোতেই হবে। আর কেউ না পারো,আমি যাবো বটরাক্ষসের টিলায়”।

মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে তো সবাই অবাক। 
“তা কী করে হয়? আপনি একা কেন এই বিপদের মধ্যে্ যাবেন? আমরা তা হতে দেব না।"
সবাই হৈ-হৈ করে উঠল।

মাস্টারমশাই গ্রামের সবাইকে আশ্বস্ত করলেন।তিনি সামনে এগিয়ে যাবেন আর গ্রামের কিছু লোক কাছেই লুকিয়ে থাকবে।দরকার মতো তারা মাস্টারমশাইকে সাহায্য করবে।

মিকির অমনি চোখ গোলগোল করে বলে উঠল – “আচ্ছত্ত! কী?"

মিকিরকে বললাম, “আশ্বস্ত” মানে গ্রামের লোকেদের মাস্টারমশাই ভালো করে বোঝালেন।

“গ্রামের লোক রাজি হল মা?” ইকির আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

গ্রামের সবাই মিলে পরেরদিন সকালে সভা করল।সেই সভায় ঠিক হল, দশ দিন বটরাক্ষসের টিলার কাছে গরু-ছাগলদের যেতে দেওয়া হবে না। সবাই নিজের পালিত পশুদের চোখে-চোখে রাখবে। দশ দিন পরে পূর্ণিমার রাতে মাস্টারমশাই মনোজ দত্ত যাবেন টিলার সামনে। আর পেছনে গ্রামের কয়েকজন লুকিয়ে থাকবে। তারপর লক্ষ্য রাখতে হবে কী হয়।

মাস্টারমশাইয়ের জন্য চট দিয়ে মোটা পোশাক বানাতে শুরু করল কানাই দরজি। চটের পোশাকের তলায় থাকবে লোহার মোটা পাতের বর্ম। গ্রামের কবিরাজমশাই একরকম ওষুধ তৈরি করলেন। সে ওষুধ সারা গায়ে মেখে নেবেন মাস্টারমশাই। বটরাক্ষস আক্রমণ করলে সহজে মাস্টারমশাইয়ের শরীরে বিষ ছড়াবে না।

ইকির, মিকির আমার আরো কাছে এসে বসল। দুজনের চোখে-মুখে কৌতূহল ফুটে উঠেছে।

এর পর দশদিন গ্রামের কোন জন্তুকে বটরাক্ষসের টিলার কাছে যেতে দেওয়া হল না। বটরাক্ষস খিদেতে অস্থির হয়ে উঠল। কয়েকবার গ্রামের আশে-পাশেও ঘুরে এল সে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা একসাথে দল বেঁধে গ্রাম পাহারা দেয়। রাতে মশাল জ্বালিয়ে রাখে। সন্ন্যাসীর অভিশাপের কথা মনে করে আর বটরাক্ষস তাই গ্রামের ভেতর যায় না।


                  দুই

দশদিন পরে পূর্ণিমার রাত। আজ গ্রামের চেহারা অন্যরকম। সবাই একজোট হয়েছে। সবার মনেই চিন্তা আজ রাতে কী হয়! মনোজ মাস্টারমশাই টিলায় যাওয়ার জন্য তৈরি। কবিরাজের ওষুধ সারা গায়ে মেখে নিলেন। লোহার বর্মের ওপর চটের পোশাক পরে নিলেন। রাত তখন প্রায় আটটা। টিলার ওপর জ্যোৎস্নার আলো। সেদিকে চললেন মনোজ মাস্টার আর বাকি গ্রামের লোকেরা একজন-দুজন করে টিলার কাছেই লুকিয়ে থাকল। বটরাক্ষসের এই ক'দিন কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি। সে টিলার ওপর শুয়ে-শুয়ে রাগে ফুঁসছিল। পায়ের আওয়াজে টিলার ওপর থেকে সে দেখল একজন মানুষ টিলার দিকে ধুঁকতে-ধুঁকতে এগিয়ে আসছে। তার হাঁটা দেখে তাকে অসুস্থ মনে হল।খানিক পরেই লোকটা টিলার সামনে হাত-পা ছুঁড়ে শুয়ে পড়ল।

কী ব্যাপার বোঝার জন্য বটরাক্ষস লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই মানুষের শরীরের গন্ধে তার খিদে যেন আরো জেগে উঠল। কিন্তু সন্ন্যাসীর অভিশাপের কথা ভেবে বটরাক্ষস লোকটার দিকে চার পা এগোয় তো দু পা পিছোয়। খানিক পরে আর থাকতে না পেরে বটরাক্ষস মনোজ মাস্টারকে ধরে কাঁধের ওপর তুলতে যেতেই তার হাত-পা অবশ হয়ে গেল। সে উল্টে পড়ল।

মনোজ মাস্টার উঠে গ্রামের লোকেদের তার কাছে আসার জন্য ইশারা করলেন। একটা কাগজের টুকরো মাস্টারমশাইয়ের পায়ের সামনে কোথা থেকে যেন উড়ে এল।

তাতে লেখা ছিল, “সন্ন্যাসীর কথা না শোনার শাস্তি বটরাক্ষসকে পেতে হবে। আজ সারা রাত বটরাক্ষস এভাবেই শুয়ে থাকবে। কাল ভোরবেলা সূর্যোদয়ের পর বটরাক্ষস উঠতে পারবে। তারপর শুরু হবে কঠিন পরিশ্রম। দিনরাত শুয়ে-বসে জন্তু-জানোয়ার মেরে আর দিন কাটবে না তার। কাল থেকে তাকে গ্রামের সব জমিতে লাঙল দিতে হবে। কুয়ো থেকে জল তুলে গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে হবে। এইভাবে একশো বছর তার জীবন কাটবে। গ্রামের লোকেরা তাকে যা খেতে দেবে, তাকে তাই খেতে হবে। রাত্রিবেলায় গ্রাম পাহারা দিতে হবে। একশো বছর এইভাবে পরিশ্রম করে তাকে বাঁচতে হবে। একশো বছর পর বটরাক্ষসের মৃত্যু হবে। তারপর সে মানুষ হিসেবে জন্ম পাবে!”

ইকির, মিকিরের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“মানুষ হওয়ার জন্য বটরাক্ষসকে এত্ত কাজ করতে হবে মা!” ইকির আমাকে বলল।

আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ,হবেই তো। অনেক কাজ করতে হবে। তবেই না মানুষ! পরিশ্রম করতে হবে।ভালো-ভালো কাজ করতে হবে। তবেই না মানুষের মতো বাঁচা যাবে।”

ইকির-মিকির আমার কথায় গোল-গোল চোখ করে তাকাল।

“গল্পের নাম কী রাখলে মা?” মিকির আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

“মায়ের গল্প।” ইকির-মিকিরকে কাছে টেনে বললাম।

“কাজ করলে মানুষ হবে!” এই নামটা কেমন মা? ইকির আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

আমি বললাম,হ্যাঁ! তাও হতে পারে।

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস

গল্পের ঝুলি : এলিয়েন বন্ধু : শেলী ভট্টাচার্য




একে তো ঘন জঙ্গল, তার উপরে সন্ধে নেমে আসছে .... অন্ধকারের চাদরটা যেন তাড়াহুড়ো করে ঝুপ করে নেমে আসছে পুটুর চারপাশে। এদিকে বাবা অফিস থেকে এসে যদি জানতে পারে যে দামি হেলিকপ্টারটা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে বেশ কড়া বকুনি দেবে। মায়ের কানে উঠলে তো পুটুর পিঠে অসময়ে দুর্গাপূজার ঢাকও বেজে যেতে পারে। ভেবেই কান্না পেয়ে গেল পুটুর। এই তো কদিন আগে এখানে আসার পথে বায়না করায় শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে বাবা এই সুন্দর দেখতে হেলিকাপ্টারটা কিনে দিয়েছিল। বনবন করে সেটা ঘুরছিল সারা ঘর জুড়ে। কেন যে পুটু ওটাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা করতে গেল, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। এখন অন্ধকারটা আরও ঘন হলে, কী করে খেলনাটাকে পাবে পুটু? যদিও ল্যান্ড করার পর ওটার বুকে একটা ছোট্ট কিন্তু সূক্ষ্ম লাল আলো দপদপ করে অনেকক্ষণ। সেটাকেই এখন গোরুখোঁজা করছে পুটু। 

বাড়িটার পেছনে যে এতো বড় জঙ্গল আর ঘাসের জড়াজড়ি কাণ্ড, তা বাড়ির জানলা দিয়ে দেখেও আগে বুঝে উঠতে পারেনি সে। বরং কলকাতা থেকে ওর বাবার উত্তরবঙ্গের এই চা-বাগান ঘেঁষা জায়গায় বদলি হয়ে আসায় খুশিই ছিল। সবুজে সবুজে ছয়লাপ করা চারিধারটা দেখে ওর চোখ ও মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। তাই তো ছুটিতে দাদানকে এখানে এনে রাখার ব্যবস্থা করল বাবা। কিন্তু এখানে এসে পুটু ওর নিজের বুদ্ধিভ্রমে নিজের বিপদ যেচে ডেকে নিয়ে এলো। ভাবতে ভাবতে মাথাটা নিচু করে আরও মনোযোগ দিয়ে খেলনাটাকে খুঁজতে লাগল ও।


এমন সময় একটা লাল আলোর রশ্মি যেন দ্রুত ওর ডান চোখের কোণের দিক দিয়ে ডান কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। আশায় আর আনন্দে পুটুর দুটো চোখ মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল। ও ডানদিকে এগিয়ে ওই লাল আলোর রেখাটাকে আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল।

খোঁজার নেশায় খেয়াল হয়নি, ইতিমধ্যে ও বেশ গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে। এমন সময় হঠাৎই একটা বড় গাছের গুঁড়ির ওপাশ থেকে কিছু একটা নড়ল বলে মনে হল পুটুর। চলতে চলতে ভয়ে থমকে দাঁড়াল ও। এত ভারী জঙ্গল, যদি কোনো হিংস্র জানোয়ার থাকে, যদি পুটুকে একা পেয়ে একটা থাবা উঁচিয়ে .... ভয়ে দু'চোখ বন্ধ করে দেয় পুটু। আর ভাবতে পারছে না, কী মারাত্মক বিপদের সামনে এসে পড়েছে সে। এর চেয়ে তো মায়ের হাতে মার খাওয়ার বিপদও কম ছিল। তাও কৌতূহলে ধীরে ধীরে চোখের উপরে রাখা দুটো হাতের আঙুল একটু ফাঁক করল পুটু। আর ছিটকে কয়েক পা পিছনে সরে এলো। এটা কী দেখছে ও? এ আবার কী প্রাণী? দুর্গামায়ের মতো বড় বড় টানা টানা দুটো চোখ তার। নাক বলতে গেলে নেই। ঠোঁটের খাঁজ না থাকলেও মুখে একটা বাকা চাঁদের ফালির মতো রেখা আছে। তবে কি হাসছে ও? প্রাণীটা জঙ্গলের বড় বড় ঘাসের মধ্যের অন্ধকারে ডুবে থাকায় হাত পা ঠিক করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু একটা বেশ মিষ্টি আলোর রেখা ওর গা থেকেই যে ঠিকরে বেরচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছে পুটু।


এভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর প্রাণীটাই একটু যেন পুটুর দিকে সামনে এগিয়ে এলো। ভয় আর কৌতূহল তখনও দামামা বাজাচ্ছে পুটুর মনে। কে এই নতুন প্রাণীটা? চিড়িয়াখানায় এতরকম প্রাণী দেখেছে পুটু, এরকম কিছু তো দেখেনি! তাছাড়া এমন আলো জ্বলা প্রাণী কি আদৌ হতে পারে?


"জোনাকিপোকা দেখনি বুঝি?" 

এবার চমকে চিৎপটাং হওয়ার জোগাড় হল পুটুর। এই প্রাণী তো ওর মনের প্রশ্ন পড়ে ফেলছে। সে কী করে সম্ভব? ভেবে ভয়ে ডিসেম্বরের ঠাণ্ডাতেও ঘেমেনেয়ে অস্থির হয়ে উঠল পুটু।

"এটা কি তোমার খেলনা?" 

বলে প্রাণীটা এবার আরও কয়েক পা এগিয়ে এলো পুটুর দিকে। এতক্ষণে পুটুর চোখে মুখে হাসির ঝলক খিলখিল করে উঠল। 

হেলিকপ্টারটাকে সামনে পেয়ে পুটুর আনন্দটা ভয় আর কৌতূহলকে ছাপিয়ে গেছে। ও বেশ কয়েক পা সাগ্রহে এগিয়ে গেল এবার প্রাণীটার দিকে। আর প্রাণীটার হাত থেকে নির্ভয়ে নিয়ে নিলো ওর খেলনা হেলিকপ্টারটা। হেলিকপ্টারটা নিতে গিয়েই প্রাণীটা আর পুটুর মধ্যে দূরত্ব কম হওয়ায় প্রাণীটার আলোতে পুটু স্পষ্ট দেখতে পায় ওকে। কেমন যেন একটা থলথলে বাজারের ব্যাগের মতো সবুজ আবরণে ঢাকা আছে ওর দেহ। আর ছোটো ছোটো দুটো হাত সেই পোষাকের দু'পাশের বড় বড় ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। বেঁটেখাটো বেশ হাড্ডাগাড্ডা চেহারা প্রাণীটার। পুটু ওর আলোর উৎসটা একবার গলা উঁচিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা কর‍তেই প্রাণীটা নিজের ডান হাতটাকে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে এগিয়ে বলে উঠল "হাই, আমার নাম গ্রিনি। আমি জড়িবুটি গ্রহের প্রাণী।"

কথাগুলো শুনে চমকে উঠল পুটু। জড়িবুটি গ্রহ মানে? সেটা আবার কী গ্রহ? তবে কি ভিনগ্রহের কথা বলছে নাকি? মানে এই প্রাণীটা এলিয়েন?চিন্তাগুলোয় পুটুর সারা শরীরে আহ্লাদী শিহরণ জাগতে লাগল। ও উত্তেজনায় প্রশ্ন করল "তুমি এলিয়েন?"

প্রাণীটা ওর খাম্বার মতো মাথাটা উপরনিচ করে 'হ্যাঁ' জানাল। আর তাতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল পুটু।

অমনি গ্রিনি ওর ডানহাতের আঙুলটাকে মুখের কাছে এনে, ফিসফিসিয়ে বলল "শ-শ-শ! এখন এত লাফালাফি কোরো না। অনেকে জেনে যাবে। আমি এখানে একটা জিনিস নিতে এসেছি। নিয়েই চলে যাব। আমার বডিতে যে সেন্সর আছে, তাতেই তোমার খেলনার লাইটটা ধরা পড়েছিল। তাই চোখে পড়ল এটা। তখন তোমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম।
আচ্ছা, তোমার নাম বললে না তো?"

"সে কী! তোমার তো দিব্যদৃষ্টি আছে, তাহলে নাম জিজ্ঞেস করছ কেন?" অবাক প্রশ্ন পুটুর।

"সেটা আবার কী?" ততোধিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল গ্রিনি।

"আরে তুমি যে আমার মনের প্রশ্ন পড়ে বলে দিলে জোনাকির গায়েতেও আলো জ্বলে।"

"ওহহো, সেটা তো আমি জানি যে, যেকোনো মানুষ আমায় দেখলে আমার চেয়েও আমার শরীরের আলোক উৎস দেখে অবাক হয় প্রথমে। আগে একবার এক বিজ্ঞানী আমায় সিমলার জিখু পাহাড়ে দেখে এমন অবাক হয়েছিলেন! সেবার এক সঞ্জীবনী গাছের খোঁজে গিয়েছিলাম।
কিন্তু তার সাথে তোমার ওই দিব্য না কী বললে যেন ... তার কী সম্পর্ক?" গ্রিনির অবুঝ প্রশ্ন।


এবার নিজের মধ্যে একটু বিজ্ঞভাব এনে পুটু বলল "ওসব তুমি বুঝবে না। এগুলো পৃথিবীর ভাষা। তবে তুমি বাংলা ভাষা জানো দেখে অবাক হচ্ছি।"

"আরে তা জানব না কেন? আমাদের পূর্বপুরুষ যে এই পৃথিবীতেই ছিল একসময়। তারপর বিভিন্ন ভাষাভাষী এক হয়ে ওই গ্রহে গিয়ে উঠেছে। সে অনেক কাহিনি। তবে এটুকু জেনে রাখো, তোমার মতো আমার মা বাবাও বাঙালি।"


মা বাবার কথা বলতেই পুটুর মুখ আমসির মতো চুপসে গেল ভয়ে। সে সেই বিকালে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আর এখন সন্ধে পেরিয়ে রাত হতে চলল। ও বাড়িতে ফেরেনি। নির্ঘাৎ সবাই ওকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। মা বেজায় রেগেও গেছে বোধ হয়। কী হবে এখন? ফেরার পথটাও তো মনে নেই ওর। ভেবে চোখের কোনায় জল টলটল করে উঠল পুটুর। ওকে এমন দেখে গ্রিনি জিজ্ঞাসা করল "তুমি কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?"

"আমি বাড়ি যাব। রাস্তা জানি না। মাত্র ক'দিন হল এখানে এসেছি আমরা। বাবা এখানের অফিসে দু'মাস হল বদলি হয়ে এসেছে। আমরা এখন শীতের ছুটিতে দাদানকে নিয়ে এসেছি। দাদানের যে বড্ড মন খারাপ। তাই ডাক্তারবাবু প্রকৃতির কোলে গিয়ে থাকতে বলেছিলেন।

আমি যে কিছুই চিনি না এখানকার। এখন ফিরব কী করে?" বলে কেঁদে ফেলল পুটু।


"আরে কেঁদো না। আমার সাথে এসো। আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আমি এখানকার পথঘাট জঙ্গল সব চিনি। তোমরা তো চারকুঠির বাড়িটাতে থাকো? এছাড়া আশেপাশে তো আর তেমন বাড়ি ... ।"


কথাটা শেষ না হতেই হুড়মুড় করে বলল পুটু "হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই চারকুঠিবাড়িতেই থাকি আমরা।"

"বেশ, বেশ। এখন আমার পিছন পিছন তাড়াতাড়ি এসো।"


গল্প করতে করতে পায়ে পায়ে কখন যে পথ ফুরিয়ে গেল, টেরই পেল না দুজনে। পুটু সামনে চেয়ে দেখল বাড়ির বারান্দার আলোটা দেখা যাচ্ছে। ঠিক তখনই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্রিনি। আর পুটুকে বলল "এবার বাকি পথটা তুমি একা যাও। আমি আর গেলাম না। আর আপাতত আমার কথা কাউকে বোলো না।"


এলিয়েন ব্যাপারটা যে কতটা ভাগ্য হলে দেখে কেউ, আর সেটাও সবার থেকে লুকিয়ে রাখতে হয়, এটা বোঝার মতো বয়স আট বছরের পুটুর হয়েছে। ও হেসে ঘাড় নাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই গ্রিনি বলে উঠল "তোমার নামটা বললে না তো?"

এমন সময় পুটু মাকে দেখল বারান্দা দিয়ে সজোরে ডাক পাড়ছে "পুটু-উ-উ"।

পুটু হেসে বলল "ওই যে মা ডাকছে।"


তারপর পকেট থেকে একটা জুসের ছোটো প্যাক বের করে এগিয়ে দিল ওর নতুন বন্ধুর দিকে। সেটা দেখেই গ্রিনি রীতিমতো চমকে গেল।

অত:পর হাত নাড়িয়ে "বাই পুটু" বলে গ্রিনি বিদায় জানাল বন্ধুকে।


পুটু বাড়িতে এসে শুনল দাদানের হঠাৎ করে মন ও শরীর .... দুইখারাপ হয়েছিল। মা সেই নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, ওর খোঁজাখুঁজি বেশিক্ষণ ধরে হয়নি। এই কিছু সময় ধরেই খোঁজ চলছিল ওর। আর পুটুও সুযোগ বুঝে বলে দিল তখন মাকে, হেলিকপ্টারটা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গিয়েছিল বলে, ও ওটা নিতেই ওদিকে গিয়েছিল।


মায়ের মাথায় দাদানের চিন্তা থাকায় বকুনি কম খেল পুটু। কিন্তু ওর মনখারাপ হয়ে গেছে দাদানকে দেখে। এখানে এসে মনমরা দাদান হেসে টুকটুক করে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, চারপাশের প্রকৃতিকে দু'চোখ ভরে দেখছিল। বাবা বলেছিল, দাদান নাকি উড়িষ্যার পুরোনো বাড়িতে থাকাকালীন সামুদ্রিক পরিবেশ নিয়ে রিসার্চ করত। সামুদ্রিক জীবদের যেন অসুবিধা না হয় তাই সমুদ্রের পাড় বরাবর একটা প্লাস্টিকের কারখানা গড়তে দেয়নি। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষে হয়নি। প্রভাবশালীরা পরে কারখানা গড়েছে সেখানে। আর তার থেকে আসা বর্জ্যের মধ্যের কীসব দূষিত পদার্থ সমুদ্রে মিশে যাওয়ায় কত কচ্ছপ, মাছ, সামুদ্রিক পাখিরা মরে গেছে। এদের পেটে নাকি মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরোও পাওয়া গিয়েছিল। তারপরেও পুটুর দাদান সমুদ্রপাড়ে প্লাস্টিক বর্জনের জন্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু সচেতনতা সেভাবে গড়ে তুলতে পারেনি। তাতেই পুটুর প্রকৃতিপ্রেমী দাদান মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মা পুটুকে বলেছে, আজ নাকি দাদান টিভিতে একটা নিউজ রিপোর্টে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবে কারসিনোজেনের পরিমাণ বেড়ে ক্যান্সার বাড়ছে দেখে আবার মনমরা হয়ে গেছে।


রাতের খাবার সময়েও পুটু খেয়াল করল মা বাবার মুখ ভার। বাবা বলছিল

"আমরা আধুনিক হয়েছি, অথচ এখনও পরিবেশ সচেতনতা বোধ আসেনি। এতদিন এই প্লাস্টিক থেকে কত পরিবেশ দূষণ হয়েছে। তাতেও টনক নড়েনি আমাদের। এখন এর থেকে এমন মারণ রোগের কারণ গজাচ্ছে।"


"সত্যিই কী ভয়াবহ পরিস্থিতি!" মায়ের গলায় বিষণ্ণতা।


পুটু রাতে বালিশে মাথা দিয়ে শুতেই মনে পড়তে লাগল ওর এলিয়েন বন্ধুকে। পুটু কি একবার ওকে দাদানের অসুখের কথা বলবে? ও যদি তেমন কোনো ওষুধ জেনে থাকে। ওকে আজ ফেরার সময় পকেট থেকে জুসের প্যাকেটটা দিচ্ছিল যখন, প্যাকেটটার গায়ের স্ট্রটা দেখে ও চমকে উঠে বলছিল 'ড্রপ দা স্ট্র'। আরও বলছিল এসব হাবিজাবি প্রসেসড ফুড খায় না ওরা। কেন এমন বলেছিল, জানা হয়নি তো!


পরেরদিন ভোরে কী একটা আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল পুটুর। শব্দটার খোঁজ করতে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখল, গ্রিনি দূরে একটা গাছকে শিকড়সমেত ওঠাতে চাইছে। গাছটা একটা বড় গাছে পরজীবীর মতো আটকে আছে। ভোরের নরম আলোতে স্পষ্ট না হলেও পুটু বেশ দেখতে পেল গ্রিনিকে। আর ভাবল, এই সুযোগ। গ্রিনিকে গিয়ে দাদানের অসুখটার কথা বলবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুটু পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দ্রুত পায়ে পৌঁছে গেল গ্রিনির কাছে। গ্রিনি ওকে দেখেই হেসে 'গুড মর্ণিং ' বলল। আর জানাল যে, ওকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কাল সারারাত ও অনেক ভেষজ উদ্ভিদ জোগাড় করেছে। কয়েকটা মাত্র বাকি ছিল। তা করেই ফিরে যাবে নিজের গ্রহে।

তখন পুটু ওকে জিজ্ঞেস করল গতকালের স্ট্রয়ের ব্যাপারটা। তার উত্তরে গ্রিনি ওদের গ্রহের কথা গল্প করে বলল, এই পৃথিবীতে মানুষ আধুনিক হতে গিয়ে যেভাবে উদ্ভিদ ধ্বংস করছে, পরিবেশ দূষণ করছে, তার বিরুদ্ধে যেতেই ওদের পূর্বপুরুষরা রিসার্চ করছিল। আর এভাবেই নাকি একদিন ওদের দুই প্রজন্ম আগের ব্যক্তিরা এই জড়িবুটি গ্রহকে আবিষ্কার করেছিল। ছোট্ট সে গ্রহে প্রকৃতিই প্রাণীর আশ্রয়দাতা, খাদ্যদাতা, বস্ত্রদাতা, এমনকি অসুখের ওষুধের জোগানদারও। প্রধানত প্রকৃতিকে নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসক সেখানে রিসার্চ করে আর ভেষজ ওষুধ বানায়। তার জন্য এই পৃথিবীর কিছু স্থানে এসে ওরা সেসব উদ্ভিদ সংগ্রহ করে। তারপর গরীবদের কাছে অলৌকিক উপায়ে সেসব ওষুধ পৌঁছে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে আসে গ্রিনি। তাই মানুষ বা প্রাণীর ক্ষতি হতে পারে, এমন যেকোনো জিনিস দেখলেই ও সেটা বর্জন করতে বলে।

পুটু তখন গ্রিনিকে ওর দাদানের কথা বলাতে, ও বলে "তোমার দাদান খুব ভালো মানুষ। তাই এমন গভীর সচেতনতাবোধ তার।" বলে ওর সবুজ পোষাকের পকেট থেকে একটা গাছ বের করে পুটুর হাতে দিয়ে বলে, 

"এই গাছ নিয়ে তোমার দাদানের কাছে দিয়ে বলো তোমায় পাহাড়ের এক ভিনদেশী বন্ধু এটা দিয়েছে। সেই বন্ধুর বাবা জড়িবুটির রাজা। এই গাছের শেকড় বেটে ওষুধ করে ওই প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত মানুষ সেবন করলে, সেরে যাবে। দেখো, তাতে তোমার দাদুর প্রতি সবার বিশ্বাস বাড়বে। তার এমন মূল্যবান সচেতনতামূলক লড়াইয়ে অনেকে সঙ্গী হবে। আমার বাবা বলেন, আমরা দূষণমুক্ত গ্রহে থাকলেও, যেভাবেই হোক দূষণের বিরুদ্ধে লড়ে যাব আমরা। তাই আজ তোমায় এটা দিয়ে গেলাম। এই গাছ আরও লাগলে ওই নীল পাহাড়ের পেছনের বেগুনি রঙের ফুল ফোটা ক্যাকটাসের বাগানে চলে যেও। পেয়ে যাবে।"


বলেই নিজের পিঠের ব্যাগটা চটপট ঠিক করে নিল গ্রিনি। ওর ঘাড় বরাবর পিঠের লাল আলোটা তখন সবুজাভ হয়ে উঠেছে। গ্রিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকল, 

"আমার স্পেসশিপ এসে গেছে। সিগনালিং তাই বলছে।" 
বলে এগিয়ে যেতেই একবার পেছনে ফিরে দেখল পুটু মনমরা হয়ে গাছগুলো হাতে নিয়ে বন্ধুর বিদায়ী পথের দিকে চেয়ে রয়েছে। গ্রিনি তখন পুটুর দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতে একটা গ্রিন ছোটো গোলক দিয়ে বলল "এটা আমাদের জড়িবুটি গ্রহের মডেল। সাথে রাখো। কালকের মতোই আবার কোথাও কখনো আমরা অজান্তে কাছাকাছি এলে, এর সিগনালিং চিনে আমি তোমার সাথে দেখা করে নেব। তবে দেখা হোক বা না হোক এই বন্ধুর কথা মনে রেখো, তোমার দাদানের মতো তুমিও মন থেকে পরিবেশ রক্ষা করার শপথ নিও।"

বলে গ্রিনি চলে যেতেই পুটু হাতের গোলকটাকে সযত্নে মুষ্ঠিবদ্ধ করে ধরল।


কিছুক্ষণের মধ্যে পুটু দেখল অদূরের আকাশে ঠিক গোলকটার মতোই একটা ছোট্ট স্পেসশিপ উড়ে যাচ্ছে। পুটু মনে মনে ওর এলিয়েন বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলো ঘরে।

(সমাপ্ত)



অলঙ্করণ : শেলী ভট্টাচার্য্য