বিবিধ নিবন্ধ : জাবিভাকা অ্যাণ্ড কোং : দেবলীনা দাস





খেলাধুলোর সঙ্গে আমার তেমন সম্পক্ক নেই কোনো কালেই। স্কুল জীবনে ফি বছর নিয়ম করে একশো মিটার দৌড়ে নামতুম আর সেকেন্ড লাস্ট হতুম, ব্যস! পরের দিকে সেটাও কৌশলে এড়িয়ে যেতুম। তবে ফুটবল বিশ্বকাপ এমন একটা জিনিস যার উন্মাদনা আমার মত খেলাবিমুখ লোককেও ছুঁয়ে গেছে বার বার। সেই ভালো লাগা থেকেই তোমাদের জন্য লিখতে বসলাম ওয়ার্ল্ড কাপ ম্যাসকটদের গল্প।

ম্যাসকট বলতে কোনো সংস্থা বা সংগঠনের প্রতীক কোনো ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুকে বোঝানো হয়। ম্যাসকটদের সৌভাগ্যের প্রতীক বলেও মনে করা হয়। ১৯৬৬ থেকে ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাসকট ডিজাইন করার দায়িত্বে থাকেন আয়োজক দেশ। এর পর থেকে চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন আয়োজক দেশরা। ম্যাসকট ম্যাজিক, না কি নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার - সেটা বলতে পারব না, কিন্তু ফুটবল দুনিয়ার এই মজাদার চরিত্রগুলির সঙ্গে তোমাদের টুক করে আলাপ করিয়ে দিতে পারব। এসো, চোখ রাখি ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাসকট তালিকায়। মানুষ, জীবজন্তু, ফল, সবজি - কে নেই সেই লিস্টিতে!

১. প্রথম ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ম্যাসকট - ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৬৬ বিশ্বকাপের প্রতীক সিংহ, উইলি



উইলির স্রষ্টা রেগ হোয়ে ছিলেন একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। বিশ্ববিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ইনিড ব্লাইটনের কিছু বইয়ের অলঙ্করণ করেছিলেন তিনি। তাঁর পুত্র লিওর কথা মনে করে আরো তিনটি ডিজাইনের সঙ্গে তিনি জমা দিয়েছিলেন লায়ন উইলির ছবিও। জানো তো, লিও শব্দের মানে সিংহ! তবে সিংহকে ইংল্যান্ডের রাজকীয় চরিত্রের প্রতীক হিসেবেও ভাবা হয়েছিল। ছবিতে উইলির পরনে দেখতে পাই ব্রিটিশ ফুটবলারদের জার্সি। জানিয়ে রাখি, ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের এমন উদ্বুদ্ধ করেছিল উইলি, যে স্যার বব চার্লটনের অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ড সেবারে প্রথম এবং এখনো অব্দি তাদের একমাত্র বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল। প্রেরণা দিতে পারার এই সাফল্যই ম্যাসকটদের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তোলে।

২. প্রথম মানুষ ম্যাসকট, মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ১৯৭০ বিশ্বকাপের প্রতীক হুয়ানিতো


১৯৭০ বিশ্বকাপে মেক্সিকো প্রতীক হিসেবে বেছে নেয় হুয়ানিতো বা লিটল হুয়ানকে। মানুষ হওয়ার কারণে হয়তো সে সবার কাছে হয়ে উঠেছিল আরো গ্রহণযোগ্য।

হুয়ানিতো আর কেউ নয়, জনতার প্রতিভূ, গড়পড়তা মেক্সিকান ফুটবল ফ্যান। শিশুসুলভ দেখতে তাকে, মুখে দুষ্টুমিষ্টি হাসি। মাথায় সম্ব্রেরো টুপি, পরনে মেক্সিকোর লাল বর্ডারওয়ালা সবজে জার্সি। জার্সিটি মাপে একটুস ছোট, তার নিচ থেকে তাই উঁকি মারে ছোট্ট ভুঁড়ি। মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল হুয়ানিতো, বলাই বাহুল্য!

৩. জোড়া ম্যাসকট, জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪ ওয়ার্ল্ড কাপের প্রতীক টিপ ও ট্যাপ


আগের বিশ্বকাপে মানুষ ম্যাসকটের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে জার্মানি ‘৭৪ এর বিশ্বকাপে ম্যাসকট হিসেবে নিয়ে আসে খাটো টিপ আর লম্বা ট্যাপকে। দুষ্টু ছেলেদের মত দেখতে এই জুড়ি প্রতীক পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একতা ও বন্ধুত্বের। এদের গায়ে তাই রঙিন জার্সি নেই। এরা পরে রয়েছে সাদা জার্সি, কালো প্যান্ট। টিপের হাতে একটি সাদা ফুটবল। টিপের গায়ে লেখা দু’টি অক্ষর, ‘ডাব্লিউ এম’, আর ট্যাপের গায়ে লেখা ইংরেজিতে ৭৪। ৭৪ তো বোঝাই গেল - ১৯৭৪ এর চুয়াত্তর আর কি! ডাব্লিউ এম হল ওয়ার্ল্ড কাপের জার্মান প্রতিশব্দ ‘ওয়েল্টমাইস্টারশাফট’ এর কাটছাঁট করা চেহারা।

৪. আর্জেন্টিনার হুয়ানিতো, ১৯৭৮ বিশ্বকাপের প্রতীক গাউচিতো



মেক্সিকোর থেকে টুকলির দোষে দুষ্ট আর্জেন্টিনার গাউচিতো। ‘গাউচো’ কথার অর্থ ‘গ্রামের ছোট ছেলে’। আর্জেন্টিনার নীল সাদা জার্সি পরিহিত বলের ওপর পা দিয়ে দাঁড়ানো কিশোর মনে পড়িয়ে দেয় ছোট্ট হুয়ানকে। এ ছাড়াও আরো একটি কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল গাউচিতোকে। তার হাতে ধরা আছে ঘোড়া চালানোর একটি চাবুক বা ছপটি। আর্জেন্টিনার গ্রামেগঞ্জে ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ভারি জনপ্রিয় খেলা হলেও বিশ্বকাপের ম্যাসকটের হাতে চাবুক অত্যন্ত বেমানান বলেই সবাই মনে করেছিলেন।

৫. না মানুষ, না অন্য কোনো প্রাণী, স্পেনে আয়োজিত ১৯৮২ বিশ্বকাপের প্রতীক নারানহিতো


নারানহিতো শব্দটি তৈরি হয়েছে ‘নারানহা’ থেকে। স্প্যানিশ ভাষায় ‘নারানহা’ হল কমলালেবুর নাম। স্পেনের প্রিয়তম ফলটি লাল জার্সি, নীল পেন্টুল, লাল হলুদ মোজা আর সবুজ কালো জুতো পরে নিজের চেহারাখানার মতই সুগোল একখানা ফুটবল হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

৬. ফলের পরে সবজি, ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মেক্সিকো ম্যাসকট হিসেবে নিয়ে এল পিককে



‘পিক’ (Pique) নামের উৎস হল ‘পিকান্টে’ শব্দটি, যার মানে ঝাল। হ্যাঁ, সবজে-রঙা পিক একটি হ্যালাপিনিও লঙ্কা। মেক্সিকান রান্নাবান্নায় প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয় বলে একে মেক্সিকোর প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। মাথায় তার হুয়ানিতোর মতই সম্ব্রেরো টুপি, নাকের নিচে সরু পেন্সিল গোঁফ, আর হাতে রয়েছে ফুটবল।

৭. ম্যাসকট ডিজাইনিংয়ে অভিনবত্ব নিয়ে এল ১৯৯০ বিশ্বকাপে ইতালির তৈরি প্রতীক, চাও

ব্যতিক্রমী ডিজাইনের ‘চাও’ (Ciao) কোনো মানুষ, জন্তু বা ফল-সবজির কার্টুন নয়। ঘনকের সমষ্টিতে তৈরি এই ম্যাসকট একটি স্টিক ফুটবল খেলোয়াড়ের ফিগার। ড্রিবল করার পোজে দাঁড়ানো চাওয়ের মুন্ডুখানাই আস্ত একটা ফুটবল। শরীরের কিউবগুলিতে ইতালির সবুজ, সাদা ও লাল রং। তার নামখানা এসেছে জনপ্রিয় ইতালীয় অভিবাদন ‘ciao’ থেকে, যার দ্বারা হ্যালো ও গুডবাই দু’টোই বোঝানো যেতে পারে।

৮. ১৯৯৪ বিশ্বকাপে আমেরিকার তৈরি স্ট্রাইকার, দর্শকদের বন্ধু হয়ে উঠতে পারল কি?



পোষ্য প্রাণী হিসেবে সবার প্রিয় কুকুরকে তাদের ম্যাসকট করল আয়োজক দেশ আমেরিকা। আমেরিকান জাতীয় পতাকার লাল নীল সাদা রঙে সজ্জিত কুকুরটির নাম আবার ফুটবলের মাঠের একটি পোজিশনের নামে রাখা হল। মজার কথা জানো - স্ট্রাইকারকে ডিজাইন করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত ওয়ার্নার ব্রাদার্সের অ্যানিমেশন টিম। আশা করা হয়েছিল তাঁদের সৃষ্ট সর্বকালের জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র বাগস বানি বা ড্যাফি ডাকের মত স্ট্রাইকারও বাচ্চাদের পছন্দের হয়ে উঠবে অচিরেই। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, শিশুমনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি স্ট্রাইকার।

৯. ফ্রান্সের ফুটিক্স, ১৯৯৮ বিশ্বকাপের প্রতীকী মোরগ



ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক মোরগকে এবার সাজিয়ে তোলা হল ম্যাসকট হিসেবে। ফুটিক্স নামখানি এসেছে ফুটবলের ‘ফুট’ আর বহুলব্যবহৃত ফ্রেঞ্চ প্রত্যয় ‘ইক্স’ থেকে। নাম শুনে আমাদের প্রিয় গলযোদ্ধা অ্যাসটেরিক্স আর ওবেলিক্সকে যাতে মনে পড়ে যায় তাই হয়তো এমন নামকরণ। বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ফুটিক্স সেজেছিল ফ্রান্সের পতাকার রঙে, এমনকি তার হাতের ফুটবলখানাতেও লাল নীল রেখা আঁকা ছিল। ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ এ কোয়ালিফাই না করতে পারা ফ্রান্স এইবারে জিতে নিয়েছিল বিশ্বকাপ।

১০. দ্য স্ফেরিকস - ২০০২ বিশ্বকাপে যুগ্ম আয়োজক দেশ সাউথ কোরিয়া ও জাপানের তৈরি তাক লাগানো ম্যাসকট-ত্রয়ী



কম্পিউটার গ্রাফিক্স ডিজাইনিং-এর দুনিয়ায় বিখ্যাত জাপান ও সাউথ কোরিয়া যুগ্ম ভাবে ২০০২ বিশ্বকাপ হোস্ট করেছিল। কম্পিউটার জেনারেটেড তিনটি চরিত্র ‘দ্য স্ফেরিকস’ - অ্যাটো, ক্যাজ ও নিককে তারা ম্যাসকট হিসেবে নিয়ে এল দর্শকদের কাছে। ফুটবলের মত একটি কাল্পনিক খেলা ‘অ্যাটমোবল’ এর খেলোয়াড় ক্যাজ ও নিক, এবং অ্যাটো তাদের প্রশিক্ষক অর্থাৎ কোচ। এখানে উল্লেখযোগ্য, যে বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই প্রথমবার ম্যাসকট চরিত্রের গায়ের রঙ আয়োজক দেশের জার্সির রঙের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত ছিল না।

১১. ২০০৬ বিশ্বকাপে জার্মানির গোলিও VI ও পিল

গোলিও নামের ৬ নম্বর সাদা জার্সি পরিহিত সিংহ আর তার পার্শ্বচরিত্র, কথা বলা ফুটবল পিল একেবারেই জনপ্রিয় হয়নি। অনেকেই মনে করেছিলেন যে জার্মানির প্রতীক হিসেবে সিংহকে বেছে নেওয়া যথাযথ হয়নি। এছাড়া ছিল আরেকটি সমস্যা। চুপি চুপি বলে ফেলি, জার্সির নিচে কার্টুন সিংহ গোলিওকে পেন্টুল পরানো হয়নি বলে অনেকে এই ম্যাসকটকে দৃষ্টিকটু মনে করেছেন।

১২. ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যাসকট জাকুমি, হলদে-সবুজ - না না, ওরাংওটাং নয়, চিতাবাঘের ছানা



‘জা’ (ZA) শব্দটি ২০১০ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ সাউথ আফ্রিকাকে বোঝায়। আর ‘কুমি’ শব্দটির দ্বারা অনেক আফ্রিকান ভাষাতেই ‘দশ’ সংখ্যাটি বোঝানো হয়। প্রাণোচ্ছল জাকুমির হলুদ গায়ে খয়েরী বুটি, পরনে সাদা জার্সি ও সবুজ প্যান্ট, মাথায় আবার ঝাঁকড়া সবুজ চুল। হলুদ আর সবুজ যে সাউথ আফ্রিকার জাতীয় দলের রঙ সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই।

১৩. ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ফুলেকো - একাধারে খেলার প্রতীক ও পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তাবহ



ব্রাজিলের তৈরি ফুলেকো একটি অসুরক্ষিত প্রাণী - থ্রি ব্যান্ডেড আর্মাডিলো। বিপন্ন না হলেও তার বেশ কাছাকাছি অবস্থার বলা চলে। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে যারা, ফুলেকোকে ম্যাসকট হিসেবে নির্বাচন করে ব্রাজিল বিশ্ববাসীকে তাদেরই কথা মনে করিয়ে দিল। পর্তুগীজ শব্দ ‘futebol’ (ফুটবল) ও ‘ecologia’ (ইকোলজি) কে মিলিয়েমিশিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ফুলেকো’ নামটি।

১৪. ২০১৮ বিশ্বকাপে এইবারের ম্যাসকট রাশিয়ার জাবিভাকা


রাশিয়ান ভাষায় ‘জাবিভাকা’ কথাটির মানে ‘যে স্কোর করে/ গোল করে’। রাশিয়ার জাবিভাকা একটি মজাদার দেখতে নেকড়ে। রাশিয়ার জাতীয় দলের রঙে রাঙানো সাদা নীল জার্সি ও লাল প্যান্ট পরা জাবিভাকার চোখে লাগানো কমলা রঙের স্পোর্টস চশমা। ফিফার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ভোটিং-এর মাধ্যমে জাবিভাকাকে ম্যাসকট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।


এই ম্যাসকটদের দেখতে পাওয়া যায় প্রায় প্রতি ম্যাচেই। গ্যালারিতে দর্শকদের মধ্যে এসে হাজির হয় তারা, কখনো বা বিরতির সময়ে সাইডলাইনের পাশ দিয়ে মজাদার অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। দর্শকরা, বিশেষ করে তোমাদের মত কচিকাঁচারা মুখিয়ে থাকে ম্যাসকটের সঙ্গে ছবি তোলানোর জন্য।

আচ্ছা, ২০২২ এর বিশ্বকাপে যদি ম্যাসকট ডিজাইনিং-এর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তোমাদের হাতে? কেমন হবে তোমাদের কল্পনায় ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের ম্যাসকট? ঝটপট তুলে নাও তুলি কলম, এঁকে ফেলো, আর পাঠিয়ে দাও আমাদের পরের সংখ্যার জন্য। পছন্দসই নাম দিতে ভুলো না যেন! অগাস্ট মাসের ক্রমশ কিশলয়ের পাতা জুড়ে থাকুক তোমাদের তৈরি ম্যাসকট!



তথ্যসূত্র :
www.espn.com
www.hongkiat.com
www.sportskeeda.com

ছবি : Wikipedia

3 comments:

  1. অনবদ্য! সবগুলো নিবন্ধই খুব উপভোগ্য ও তথ্যসম্পন্ন। পড়ে আনন্দ পেলাম।

    ReplyDelete
  2. এটা পড়ে খুবই আনন্দ হল :)

    ReplyDelete
  3. দারুণ দিদি। খুব ভালো লাগলো পড়ে। অনেক কিছু জানতেও পারলাম।

    ReplyDelete