গল্পের ঝুলি : তিলতিল আর মিতিল আর চড়াইপাখিরা : মহাশ্বেতা রায়





ঘুম থেকে উঠে, চোখ কচলাতে কচলাতে, টয়লেটের দিকে না গিয়ে প্রথমেই বারান্দার দিকে পা বাড়ালো মিতিল। দরজার পর্দাটা  সাবধানে সরিয়ে উঁকি দিল। শীত শেষের দিকে। তাই সকালের আলো দিব্যি ফুটেছে। সূয্যিমামা এখনো পুরো তেজে সেজেগুজে অফিস খুলে বসেননি। বেশ একটা নরম নরম আলো চারিদিকে। কোণের দিকের গ্রিলের গায়ে বাঁধা রয়েছে দুটো মাটির হাঁড়ি। মিতিল সেই হাঁড়ি দুটোর দিকে ভালো করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নাহ! আজকেও আসেনি। মনমরা হয়ে ফের বিছানামুখো হল মিতিল। ধুস... ভাল্লাগে না।


কিন্তু বিছানায় একটা পা ওঠানোর আগেই ঘরে ঢুকলেন মা।

-" গু-উ-উ-ড মর্নিং মিলুসোনা। তুমি নিজেই উঠে পড়েছ ঘুম থেকে? কী দারুণ ব্যাপার। আর দাদা এখনো ঘুমাচ্ছে? স্কুলে যেতে হবে না নাকি..."

-"ও মোটেও দাদা নয়। ও তো মোটে  দুই মিনিটের বড়..."  খাটে উঠে পড়ে বলল মিতিল।

-"আচ্ছা, ঠিক ঠিক, ও দাদা নয়...তিলুবাবু, ও তিলুবাবু, ওঠ এবার, স্কুলে যাবে না নাকি? ওঠ, ওঠ, এবার দেরি হয়ে যাবে- আজকে একটা দারুণ টিফিন দিয়েছি , চলো চলো, স্কুলে না গেলে টিফিনটার কী হবে..."- মা  বিছানা থেকে টেনে তুলে বসালেন তিলতিলকে। তিলতিল দু-হাত বাড়িয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমে তলিয়ে যেতে  লাগল। মা, ছেলের আগোছালো চুলে বিলি কাটতে কাটতে  বললেন- “আর ঘুমায় না বাবা, চলো- অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে...” । মিতিল সেই  দৃশ্য দেখে  পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে  উল্টোদিকে ফিরে শুতে শুতে মাকে বলল- "আগে আমাকেও ও'রকম করে আদর করো, না হলে আমি স্কুলে যাব না..."


তিলতিল আর মিতিল সাত পেরিয়ে আটে পা দিল। মাত্র দুই মিনিটের বড় বলে তিলতিল যদিও মাঝে মাঝেই নিজেকে বড় দাদা বলে দাবী করে, এবং সেই সুবাদে বোনকে ধমক-ধামক দেওয়ার চেষ্টা করে, মিতিল সে সবকে মোটেও পাত্তা দেয় না। তিলতিলের তুলনায় মিতিলেরই বরং মারপিট করার স্বভাবটা বেশি, বেশি ছটফটে, সব সময়ে বেশি বেশি বকবক করছে। তিলতিলের তুলনায় তার সাহসও অনেক বেশি। যখন কালবৈশাখির সময়ে খুব জোরে বাজ পড়ে , তিলতিল তখন খুব ভয় পেয়ে যায়। মা- বাবা- বীণাপিসি, যাকেই সামনে পায়, জাপ্‌টে ধরে বসে থাকে; মিতিলের সে সব বালাই নেই। কিংবা গরমকালে সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে গেলেই তিলতিল একেবারে চিল চিৎকার জুড়বে, "আলো কই, আলো কই" করে। কিন্তু মিতিল তখন ছুটবে ব্যালকনিতে। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, শুধু লোকজনের কথাবার্তা হইচই শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না, অনেক দূরে  লম্বা লম্বা বাড়িগুলোর জানলায় সাদা, হলুদ আলো জ্বলছে - এসব দেখতে তার দারুণ লাগে। একটু একটু ভয় করে ঠিকই। বীণাপিসি একবার বলেছিল অন্ধকারে ভূত বেরোয়। কিন্তু মা সেদিন বীণাপিসিকে বকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভূত -টুত কিছু হয় না। ওসব মানুষের কল্পনা শুধু। তাছাড়া গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখেছে  মিতিল। সেখানে তো কত্ত ভূত। কই, তারা তো কেউ খারাপ না, বা ভয় দেখায় না। বরং ভূতের রাজা কেমন দিব্যি সব বর-টর দিলো গুপী বাঘাকে। তাছাড়া মা বলেছেন, আরেকটু বড় হলে, একটা বই পড়তে দেবেন। সেই বইটা ভর্তি শুধু ভালো ভূতেদের গল্প। মা যখন তিলতিল-মিতিলের মত ছোট্ট ছিলেন, তখন দাদুন বইমেলা থেকে কিনে দিয়েছিলেন বইটা। সেটা পড়েই তো মায়ের ভূত-টুত নিয়ে একদম ভয় নেই।

ভূতের ভয় অবশ্য তিলতিলেরও নেই। কিন্তু অন্ধকার হলে, বা বাজ পড়লে কীরকম মনে হয়, এই বুঝি আর মা'কে দেখতে পাবে না, বাবাকে দেখতে পাবে না, মিতিলকে দেখতে পাবে না। তাই সেরকম কিছু হলেই তিলতিল নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে, ততক্ষণ যতক্ষণ না মা এমারজেন্সি লাইট জ্বালাচ্ছেন। আলো এসে গেলে, সবাইকে দেখতে পেলেই সে আবার একদম সাহসী তিলতিল। বাবা মাঝে মাঝে বলেন- “তোর মা তোর নাম তিলতিল শুধু শুধুই রাখলেন। তুই তো মোটেও সেই তিলতিলের মতো নোস। তার কত সাহস ছিল! আর তুই কিনা লোডশেডিং হলে ভয় পাস।”

এই কথা শুনে তিলতিল মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। একে তো তিলতিল নামটা তার মোটেও পছন্দ নয়। কীরকম মেয়েদের মত নাম। ঋজু, অর্ক, বাবাই, দীপ- সবার কিরকম বেশ ছেলে ছেলে নাম। আর তার নামটা দেখ একবার- তিলতিল! মা যে কী না! নতুন কেউ তাকে আজকাল তার ডাকনাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে “তিলু”- অন্তত এটা একটু ছেলে ছেলে নাম। কী দরকার ছিল সেই 'নীল পাখি' গল্পের তিলতিল আর মিতিলের নামে তাদের দুজনের নাম রাখার? মা অবশ্য কারণটা বলেছেন অনেকবার। সেই মা যখন অনেক ছোট ছিলেন, তখন মা 'নীল পাখি' নাটক দেখেছিলেন। সে হল দুই সাহসী ভাই-বোনের গল্প, যাদের নাম তিলতিল আর মিতিল। তারা দুজনে এক ছদ্মবেশী পরীর আদেশে তার অসুস্থ মেয়েটাকে সুস্থ করার জন্য নীল পাখি খুঁজতে যায়। তাদের সাথে সঙ্গী হয় ঘরের আলো, ফায়ারপ্লেসের আগুন, রুটি, দুধ, পোষা কুকুর, বেড়াল সবাই। গল্পটা মা বলেছিলেন একবার। আসল গল্পটা ফরাসী, লেখকের নামটা বেশ খটোমটো, সে আর এখন তিলতিলের মনে নেই। মা বলেন, সেই গল্পটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই যেদিন তিলতিল আর মিতিলের জন্ম হল, ভাই-বোন দুজনকে একসাথে দেখে মা তখনি তাদের নাম দিয়ে দেন তিলতিল আর মিতিল। তিলতিল যখন মাঝে মাঝে মায়ের বুকের কাছে শুয়ে অনুযোগ করে- “তুমি আমার এ'রকম নাম রাখলে কেন?" মা তখন তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে বলেন- “তোরা যে আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট্টবেলা রে - তাই তো তোদের নাম রেখেছি ছোট্টবেলার ভালোলাগা স্মৃতির সাথে মিলিয়ে...তোর পছন্দ নয়?"- বলতে বলতে মায়ের চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে, তখন তিলতিলের বুকের ভেতরটা কেমন শুকনো-শুকনো কষ্ট কষ্ট হয়, আর সে মা'কে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে- “না, না, আমার খুব পছন্দ এই নাম, আর বদলাতে হবে না।”

(২)

শীতের ছুটিতে দাদুন-দিদুন এসেছিলেন। দাদু্ন-দিদুনের কাছে তিলতিল-মিতিলের যাওয়া একটু কমই হয়। বাবা-মায়ের কাজ, স্কুলের পরীক্ষা এইসবের ফাঁকে ছুটি আর কতটুকুই বা পাওয়া যায়? তাই  দাদুন-দিদুনই সুযোগ পেলে চলে আসেন তাদের কাছে। তখন কিন্তু খুব মজা হয়। বাড়িটা সবসময় বেশ ভরা ভরা। দাদু্নের  কাছে বসে অঙ্ক করা, সায়েন্স পড়া; আর দিদুনের কাছে বসে বাংলা আর ইংলিশ। দাদুন তো স্কুলে পড়াতেন, সব ছেলেমেয়েরা নাকি খুব ভয় পেত। দাদু্ন যে খুব কড়া টিচার ছিলেন সেটা বলেছেন মায়ের বন্ধু সোনালি মাসি। সোনালি মাসি দাদুনের কাছে পড়েছেন। কিন্তু তিলতিল আর মিতিলের দাদুনের কাছে পড়তে কিন্তু একটুও ভয় করে না। কারণ দাদুন তো ওদের বকেনই না। শুধু যখন খুব মাথা ধরে, তখন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকেন। তখন বেশি কথা বলেন না, পড়াতেও চান না। তখন মায়ের কথামতো মাঝে মাঝে তিলতিল, মাঝে মাঝে মিতিল দাদু্নের  মাথা টিপে দেয়।





দাদুনের কাছে কত্ত গল্প শোনে দুই ভাই -বোন। গাছপালার গল্প, চাঁদ-সূর্যের গল্প; সোলার সিস্টেমের গল্প; দাদুনের ছোট্টবেলার গল্প; আর দিদুন নানারকমের সব খাবার বানিয়ে দেন – নাড়ু, গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া; যেবার দিদুন প্রথম মোয়া বানালেন বাড়িতে, তিলতিল আর মিতিলের সে কী উৎসাহ; গুড়ে পাক দেওয়া গরম গরম মুড়িকে কিরকম দিদুন হাতে অল্প তেল লাগিয়ে ফটাফট বলের মতো পাকিয়ে দিচ্ছেন। আর সেটা গরম গরম আর পরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা খেতেও মন্দ লাগেনি।  তারপরে সেই যে, রবিবারের সকালবেলা লুচি আর বেগুনভাজা খেতে খেতে দিদুন সেই ছড়াটা শিখিয়েছিলেন-


ফুলকো লুচি ফুলকো লুচি পেট্‌টা ফুলে ঢাক

ফুলকো লুচি ফুলকো লুচি পেটের  ভিতর ফাঁক...


এইটুকু বলেই প্লেটের ফুলকো লুচি গুলোর পেট ফাটিয়ে দিতে হবে! সেই নিয়ে তো সেদিন দুই ভাই বোনে ছোটখাটো একটা যুদ্ধই হয়ে গেল; নিজেদের থালার লুচিগুলোর পেট ফাটিয়ে শুরু হল যুদ্ধ- কে ক'টা লুচির পেট ফাটাতে পারে। দাদুনের থালা, দিদুনের থালা, মায়ের থালা সবের ওপরে ঘোরতর আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল; জলখাবার খাওয়া প্রায় মাথায় ওঠে আর কী! মিতিল আবার তার মধ্যে বীণাপিসিকে গিয়ে একটু ধমকেও এল- সবগুলো লুচির যেন পেট্‌টা ফুলে ঢাক হয়, নাহলে কিন্তু...নেহাত রবিবার ছিল, আর বাড়িতে বাবা ছিলেন, তাই বাবা যখন পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে- “কী হচ্ছে এসব-" বলে একবার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তখন দুই ভাই বোন থামলো। বাবা অবশ্য সেদিন বেশি বকেননি। দাদুন-দিদুন থাকলে বাবা বা মা, কেউই বেশি বকাবকি করেন না।

ফ্ল্যাটের ছোট্ট বারান্দায় মায়ের শখের ছোট্ট বাগান। মা বলেন “আমার কুঞ্জ”। নানারকমের পাতাবাহার। কোনোটার পাতা ঝিরিঝিরি, কোনোটা কলাপাতার মতো, একটার গায়ে আবার সবুজের মধ্যে সাদা আর গোলাপির ছিটছিট। সঙ্গে একটা নয়নতারা, একটা জবা। দাদুন এলে সেইসব গাছগুলোর পেছনে সময় দেন মাঝে মধ্যে। একটু টবের মাটি খুঁচিয়ে দেন, কোনোটার শুকনো পাতা আলাদা করে দেন। সেই করতে করতেই দাদুনের চোখে পড়ে যায় চড়াইপাখি দু'টোর দিকে। ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে বারান্দার আশেপাশে। মাঝে মধ্যে ঢুকে আসছে ভেতরে, মাঝে মাঝে গ্রিলের ওপর বসছে কয়েক মুহূর্ত, আবার উড়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তার উল্টোদিকে কাঠবাদামগাছের ডালে, আবার ফিরে আসছে তাদের বারান্দার দিকে।

চড়াই পাখি দুটোকে দেখতে দেখতে দাদুন বলেছিলেন- "ওরা বাসা বানাবার জায়গা খুঁজছে। এখন ওদের ডিম পাড়ার সময়..."

তাই শুনে তো তিলতিল আর মিতিলের চক্ষু চড়কগাছ। অ্যাঁ, তাই নাকি? কিন্তু গাছের ডালে বাসা না বেঁধে ওরা ব্যালকনির কাছে জায়গা খুঁজছে কেন?

"চড়াই পাখিরা গাছের ডালে বাসা বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে এইরকম পাকা বাড়ির আনাচে-কানাচেও বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। সেই যে তোমাদেরকে গল্প বলেছিলাম, মনে নেই?"

"সেই চড়াই আর চড়নীর গল্প?" মিতিল বলে;

"হ্যাঁ হ্যাঁ... চড়াই আর বাঘের গল্প... কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো  ওইরকম মাটির ইয়ে ঝোলানো নেই; তাহলে ওরা বাসা বাঁধবে কী করে?" তিলতিল প্রশ্ন করে।

"ইয়ে আবার কী?" দাদুন হা হা করে হেসে উঠেছিলেন।

"ভুলে গেছি...ইয়ে...কলসী” লাজুক লাজুক মুখে হেসে উত্তর দিয়েছিল তিলতিল।

"কলসী না, হাঁড়ি, সেই গল্পে যেটার কথা লেখা ছিল সেটা হাঁড়ি। কিন্তু তোমাদের এই ফ্ল্যাটের দেওয়ালে তো ঘুলঘুলি নেই, ওরা বাসা বাঁধবে কী করে? ওদের জন্য আমাদের আলাদা বাসার ব্যবস্থা করতে হবে। যেটা জোগাড় করতে হবে, সেটা যদি পাওয়া যায়, তাহলে দেখবে সেটাকে অনেকটা কলসীর মতই দেখতে। কিন্তু সেসব হওয়ার আগে তো তোমাদের মা-বাবার থেকে পারমিশন নিতে হবে।”

এইসব কথাবার্তা হওয়ার পরে পরেই, এক রবিবার সকালে বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক 'হাটে' গিয়ে পাখিদের জন্য আলাদা করে এক দিকে গর্ত করা হাঁড়ি কিনে আনা হল। এই ' হাঁড়ি-বাড়ি' কিনে আনার অভিযানে বাবা আর দাদুনের সঙ্গে গেল তিলতিল আর মিতিলও। 'হাট বসেছে শুক্রবারে, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপাড়ে'  - সেই হাট যে সত্যি সত্যি হয় সেটাই তো জানা ছিল না। ওদের বাড়িতে তো বেশিরভাগ বাজার বীণাপিসি করে, না হলে বিগ বাজার। মাঝে মাঝে হোম ডেলিভারিও হয়। সেই 'হাট' অভিযানে সেদিন মা আর দিদুনও সঙ্গে গেছিলেন, কী সব নানারকমের শাকসবজি কেনা হয়েছিল, যেগুলি নাকি এমনিতে পাড়ার দোকানে পাওয়া যায় না। তবে গরুর গাড়ি দেখতে পাওয়া যায়নি একটাও, যে দোকান থেকে পাখিদের বাড়ি কেনা হলো তাঁরা নাকি ম্যাটাডোর গাড়িতে সব জিনিস নিয়ে আসেন।


সেইসব কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে আসতে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল বলে সেদিন আর চড়াই পাখিদের জন্য বারান্দার গ্রিলে হাঁড়ি-বাড়ি বাঁধা হয়নি। সেই নিয়ে খানিক কান্নাকাটি -মান অভিমান হলেও কিছুই করার ছিল না। কিন্তু পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে এসেই দুই ভাই-বোনের আর আনন্দ ধরে না। বারান্দার গ্রিলে শক্তপোক্ত করে বাঁধা দুটো 'হাঁড়ি-বাড়ি'; তাদের খোলা মুখগুলো অবশ্য বাইরের দিকে যাতে মিস্টার চড়াই আর মিসেস চড়নী সহজেই যাতায়াত করতে পারেন। হাঁড়ি-বাড়ির ওপরে একটা করে মাটির ছোট থালার মত ঢাকা দেওয়া, সেগুলিকে 'সরা' বলে। দাদুন-দিদুনের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে হাঁড়ি-বাড়ির একটু নিচে জল রাখার আর খাবার রাখার পাত্রেরও ব্যবস্থা করা হল। জলের পাত্রে জল আর খাবারের পাত্রে কিছু ছোলা রেখে দিল তিলতিল আর মিতিল।


সেই থেকে চলছে অপেক্ষা। কবে চড়াই আর চড়াইয়ের বউ এসে বাসা বাঁধবে তিলতিল আর  মিতিলের দেওয়া হাঁড়ি-বাড়িতে। পাত্রের জল শুকিয়ে গেল কয়েকদিন পরে, ছোলা খেয়ে গেল পিঁপড়ে আর কাকে, কিন্তু যাদের জন্য এত আয়োজন, তাদের দেখা নেই। ঘুম থেকে উঠে আর স্কুল থেকে ফিরে রোজ খেয়াল রাখে মিতিল, কিন্তু হাঁড়ি-বাড়িতে কেউ ঢোকেও না, কেউ বেরোয়ও না। তিলতিল তো দুঃখের চোটে আর ফিরেও দেখে না। মনমরা হয়ে দাদুনকে ফোন করে মিতিল,

"ও দাদুন, এলো না তো..."

"কে এলো না ?"

"ওই যে, ওরা..."

"ও আচ্ছা, মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস চড়াই? সত্যি, কী হল বলতো? ওদের হয়ত ঘরগুলো পছন্দ হয়নি..."

"কিন্তু জল দিয়েছি তো, আর ছোলাও দিয়েছি তো..." কাঁদোকাঁদো গলায় জানায় মিতিল।

ফোনের ওপাশ থেকে দাদুন বলেন, "আচ্ছা, শোনো শোনো, কেঁদো না, চড়াই পাখিদের নিয়ে একটা অন্য কথা আছে..."  মিতিলের মন খারাপ দূর করার জন্য চড়াইদের নিয়ে নতুন গল্প বলতে থাকেন দাদুন, ফোনের ও'পাশ থেকে।


(৩)


এক রবিবার সকালবেলা  যখন তিলতিল আর মিতিল  খুব মন দিয়ে হোমটাস্ক করছিল, তখন বাবা এসে চুপিচুপি ডেকে বললেন, "আয়, দেখে যা, তোদের চড়াই আর চড়নী কেমন বাসা বাঁধছে। চুপিচুপি কিন্তু, আওয়াজ করলে ওরা ভয় পাবে। বাসা বাঁধার আগেই আবার পালিয়ে যাবে।” প্রায় একবছর ধরে বারান্দার গ্রিলে বাঁধা হাঁড়িদুটোকে খুলতে দেয়নি তিলতিল আর মিতিল। তবে রোজ সকালে উঠে হাঁড়িগুলোর হাল-হকিকত জানার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিল। এতদিন পরে তাহলে আশা পূর্ণ হল! বইখাতা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠল দুজনে।


বাবার সঙ্গে দরজার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয় তিলতিল আর মিতিল। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে, এমনকী কে সামনে দাঁড়াবে সে নিয়ে ঝগড়াও করে না। কিঁচ-কিঁচ, কিঁচ-কিঁচ – শোনা যাচ্ছে চড়াইদের কথাবার্তা, অবশ্যই একটা হাঁড়ির ভেতর থেকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কিছুই। কী করে দেখা যাবে? হাঁড়ি-বাড়ির দরজা তো খোলা আকাশের দিকে মুখ করে রয়েছে। পেছন দিক থেকে দেখা যায় নাকি? বেশ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তিলতিল আর মিতিল যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন দেখতে পেলো, একটা চড়াই হুশ করে হাঁড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল। ফিরে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তারপরে আবার উড়ে গেল, আবার ফিরে এলো।


"ওটা কি বাবা চড়াই? মা চড়াই কি নেস্টের ভেতরে আছে?" প্রশ্ন করে তিলতিল।

" হ্যাঁ , হতে পারে সেটা। মিসেস চড়াই হয়ত ভেতরে ডিমে তা দিচ্ছেন।” বাবা হেসে উত্তর দেন।

" কিন্তু তুমি জানলে কী করে ওরা বাসা বেঁধেছে? আমি তো বুঝিনি..." মিতিল জানতে চায়।

" আমি গত কয়েকদিন ধরেই ওদের কথাবার্তা শুনছি তো সকাল বেলায়। তোরা সকাল উঠেই  স্কুলের জন্য রেডি হতে শুরু করিস, তাই খেয়াল করিসনি।”

"কিন্তু আমরা দেখব কি করে, ওদের ডিম... তারপরে যখন ডিম ফুটে ছানা বেরোবে... হাঁড়িগুলো তো উঁচুতে আর খোলা গর্তটাও বাইরের দিকে..."

"ঠিক, আমরা ওদের দেখতে পাবো না। চাইলে পারি, কিন্তু সেটা করলে ওরা ভয় পেয়ে যেতে পারে। এমনিতেই এতদিন ধরে দেখে দেখে, ভরসা করে ওরা এখানে বাসা বাঁধতে এসেছে। ওদের এখন একদম বিরক্ত করা উচিত নয়। বরং আমরা ওদের জন্য আবার জল আর খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।”

"বাবা, ও বাবা, চড়াইপাখিদের বাচ্চা হলে আমরা ওদের খাঁচায় পুষবো?"  মনের ইচ্ছেটা জানায় তিলতিল।

"হ্যাঁ হ্যাঁ, খাঁচায় পুষবো-" উৎসাহে হাততালি দেয় মিতিল।

"একদম না," বলতে বলতে ঘরে ঢোকেন মা। “ছানাদের কষ্ট হবে না মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে? আর চড়াই  মা আর বাবা, তাদের কষ্ট হবে না? ধর যদি কেউ তোদেরকে আমাদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে গিয়ে একটা খাঁচায় পুরে রাখে - কেমন লাগবে ভাবতে পারছিস?"

"এ মা, আমাদের কে ধরে রাখবে খাঁচায়? আমরা কি পাখি নাকি?"  অবাক হয়ে প্রশ্ন করে  মিতিল।

"পৃথিবীর সব মানুষের জীবন একরকম হয় না মিতিল। এই দুনিয়ায় তোমাদের মতো বয়সী কত ছেলেমেয়ে আছে জানো, যাদেরকে নানারকমের কারণ দেখিয়ে জোর করে তাদের বাবা-মায়েদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে? বা তারা বিপদে পড়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে? কান্নাকাটিও করেও কোনও লাভ হচ্ছে না ... তোমাদের কী আর এমনি এমনি বলি তোমরা যেটুকু  পাচ্ছো, অনেক পাচ্ছো... " মা গম্ভীর গলায় বলেন।

"আহা, ঠিক আছে , " বলে বাবা মা'কে ইশারা করেন আর না বকতে ," তিলু, মিলু, ঝটপট  হোমওয়ার্ক শেষ করে ফেলো। এইসব কথা পরে হবে।”


একে তো মায়ের হঠাৎ বকুনি, তারপরে মা-বাবার থেকে আলাদা হয়ে অনেক দূরে একা একটা খাঁচার ভেতর আটকে থাকার কথা ভেবেই ভয় আর দুঃখ আর মন খারাপ- সব একসঙ্গে হল! দুই ভাইবোনে আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে গেল হোমটাস্ক শেষ করতে। মা আর বাবা অবশ্য লক্ষ্য করলেন, তিলতিল ঘন ঘন চোখের জল মুছছে; মিতিল অবশ্য খুব গম্ভীর মুখে সব টাস্ক শেষ করল। দুপুরের খাওয়ার সময়ে নিজের পাতের ডিমটা বড় না তিলতিলের পাতেরটা, সে নিয়েও কোনও ঝামেলা করল না।


(৪)

খাওয়াদাওয়ার পরে বাবা দুই ভাইবোনকে বিছানায় ডেকে নিলেন। অন্য রবিবার হলে বাবা এই সময়ে গল্পের বই পড়েন, কিন্তু আজ বাবার কোলে ল্যাপটপ। তিলতিল আর মিতিলকে নিজের দুই পাশে বসিয়ে বাবা পরপর অনেকগুলো ছোট ছোট ফিল্ম দেখালেন। সেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কথা, যারা বেশিরভাগই যুদ্ধের কারণে, নিজেদের পরিবার এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অনেকেরই বাবা-মা হারিয়ে গেছেন চিরকালের মতো। অনেককে নতুন দেশের আইন জোর করে বাবা-মায়ের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। কবে আবার তারা একসঙ্গে হতে পারবে জানে না। অজানা দেশের অচেনা শরণার্থী শিবিরে, তাঁবুর মধ্যে, বা সত্যি সত্যি জেলখানার মত ঘরের মধ্যে মনমরা হয়ে বসে আছে কত ছেলেমেয়েরা, তারা অনেকেই অসুস্থ, কারোর কারোর যুদ্ধে গুলি কিংবা বোমের টুকরো গায়ে লেগে রক্ত ঝরছে। ফিল্ম দেখার মাঝে মাঝে বাবা বলে দিলেন, কোন্ কোন্ দেশে যুদ্ধ হচ্ছে, কোন্ কোন্ দেশের ছেলেমেয়েরা কত কত দূর দেশে একা একা থাকতে বাধ্য হচ্ছে।  দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলল তিলতিল, মিতিলের চোখ জলে ভরে এলেও ডলে ডলে মুছে ফেলল ।

"এই চড়াই বাবা-মায়ের কাছ থেকে ওদের ছানাদের আলাদা করে জোর করে খাঁচায় বন্দী করে রাখলে ওদেরও খুব কষ্ট হবে, ঠিক এই বাচ্চাগুলোর মতো, তাই না বাবা?”

" আমরা কোনওদিন পাখির ছানাদের ওদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে এনে পুষব না। হ্যাঁ বাবা?”

"আমি ওপরের ঢাকনি সরিয়ে ওদের বাসা দেখতে চাইব না,  খালি ওদের জল আর খাবার দেব, তাই না বাবা?"

"একদম ঠিক," বলতে বলতে পাশে এসে বসলেন মা।” আমরা যেমন সবাই মিলে এক সঙ্গে আনন্দ করে, নিশ্চিন্তে থাকতে চাই, পৃথিবীর সব মানুষ, সব পশু-পাখি সেভাবেই থাকতে চায়। আমরা তো সবাইকে সবসময়ে সাহায্য করতে পারব না, কিন্তু এই চড়াইপাখিদের পরিবারটাকে এখন সাহায্য করব। আজ বিকেলে আমরা পুরনো বাজারে যাব, আর সেখানে থেকে পাখিদের খাওয়ার জন্য ঘাসের বীজ কিনে আনব, কেমন?"

এই কথা শোনার পরে  মায়ের কোলে একসঙ্গে গুটিসুটি হয়ে, কাঁদতে কাঁদতে আর হাসতে হাসতে আদর না খেয়ে তিলতিল আর মিতিল কীই বা করে!


(সমাপ্ত )

অলঙ্করণঃ সুস্মিতা কুণ্ডু

10 comments:

  1. গল্পের ম‍্যাসেজ টা খুব সুন্দর। কিন্তু গল্পটা আমার কআজ বাড়িয়ে দিলো। এখন হাড়ি কিনে এনে বারান্দায় বাঁধার হুকুম হয়েছে। কারন বারান্দার লাইটের সেডের ভেতর দুটো চড়াই মাঝে মাঝেই ঘর বাঁধে। কিন্তু প্রতিবার ওদের ডিম লাইটসেডের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। আপাতত ছেলে বলেছে ওদের বাড়ি বানিয়ে দিতে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ :) তিলতিল আর মিতিলের গল্প আপনার কাজ বাড়িয়ে দিল, এটা জেনে সত্যিই আমি খুব খুশি হলাম।

      Delete
  2. আমার খুব মিষ্টি লাগলো।ছোট দের উপযুক্ত লেখা

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর গল্প। দারুণ!!

    ReplyDelete
  4. খুব সুন্দর গল্প। দারুণ!!

    ReplyDelete
  5. ভীষণ ভালো লাগলো দিদি। মন ছুঁয়ে গেল। আর সুস্মিতা দিদির আঁকা টাও খুব ভালো।

    ReplyDelete