গল্পের ঝুলি : মিনুর বুদ্ধি : সুকন্যা দত্ত



মিনু খুব লক্ষ্মী। মা যখন দুধের বাটিটা এনে মিনুর সামনে রাখে, মিনু চোঁ চোঁ করে খেয়ে নেয়। তারপর কুহুদিদির সাথে একটু খেলেই মিনু বাগানে চলে যায়। মা তখন একটা চেয়ারে বসে উল বোনে। ঐ উলের গোলাটা মিনুর ভারী পছন্দ। সে উলের গোলাটা নিয়ে দৌড়ে চলে যেতে চায় বাগানের ঐ দিকটায়। আর তখনই মা চেঁচায় –"মিনু, ছাড় বলছি। চুপ করে বোস।"


তখন মিনু চুপ করে বসে মায়ের উল বোনা দেখে। কতরকমের উল মায়ের কাছে। আর কী সুন্দর সুন্দর সোয়েটার, মাফলার বানায় মা! এই তো সেদিন মিনুর জন্মদিনে মা একটা সুন্দর সোয়েটার বানিয়ে দিয়েছে মিনুর জন্য। মিনু খুব খুশী। সোয়েটারটা পরেই ও মায়ের খাটের ওপর উঠে ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে নিজেকে একবার দেখে নেয়। তারপর এ ঘর, ও ঘর দৌড়ে যখন দুষ্টুমি করছে, তখনই শুনতে পেল মায়ের গলা। মা মিনুকে ডাকছে।


ক’দিন ধরেই মিনুর সন্দেহ রান্নাঘরে কোনো চোর ঢুকছে। মায়ের রান্নাঘর থেকে ভাজা মাছের টুকরো এমনকি মিনুর জন্য রাখা এক বাটি দুধও একদিন চুরি হয়েছে। প্রথমে মা ভেবেছিল, মিনুর হয়ত খিদে পেয়েছে - তাই মিনু খেয়েছে। কিন্তু মিনু ঘাড় নেড়ে সটান বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে খায়নি। তাহলে খেলোটা কে? মাও খুব চিন্তিত। তাই মিনু আজ ঠিক করেছে যে, সে চোরকে ধরবে।


পাশের বাড়ীর হুলোটার ওপর মিনুর খুব সন্দেহ। হুলোটা মাঝে মাঝেই পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে বাগানে ঢোকে। মিনু তো ছোট, হম্বিতম্বি করেও হুলোকে তাড়াতে পারে না। তাই গিয়ে মা-কে বলে। মা এসে হুলোকে বাগানের বাইরে বের করে দেয়। আসলে হুলোটা মিনুর মত অত ভালো খেতে পায় না। মিনুদের বাড়ীতে যে ভালো ভালো খাবার হয়, সেটা সে বিলক্ষণ জানে। তাই খালি তক্কে তক্কে থাকে যদি একটু ভাগ পায়।


মিনু এখন বাগানে জবা ফুলের গাছের পাশে লুকিয়ে আছে। হুলোদাদা যদি বাগান দিয়ে এসে রান্নাঘরে ঢোকে, তাহলে মা-কে দৌড়ে গিয়ে খবর দেবে। কিন্তু হুলোদাদা তো এল না।


"যাই তো একবার রান্নাঘরে।" এই বলে মিনু ছুটল রান্নাঘরের দিকে।

"ও মা, রান্নাঘরে তো কুহুদিদি।"

একটা প্যাকেটে ভাজা মাছগুলো ভরে নিয়েছে।

"ব্যাপারটা কী? দেখি তো একবার।"

এই বলে মিনু কুহুদিদির পিছু নিল।

কুহুদিদি আস্তে আস্তে বাগানের পিছন দিকটায় চলে গেল।

সেইখানে একটা ছোট গেট আছে।

সেই গেটটার পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে। চুলগুলো উস্কো-খুস্কো। মুখটা খুব শুকনো।

'আহা রে, মেয়েটার মনে হয় খুব খিদে পেয়েছে।' দেখেই মিনুর মনে খুব দুঃখ হল।

সে আস্তে আস্তে গেটের কাছে চলে গেল।


মেয়েটা মিনুকে-"ও মা কী সুন্দর!" বলে কাছে ডাকল আর আদর করে দিল।

‘কিন্তু, কুহুদিদি এখানে কী করছে?’

মিনু বুঝতে পারছিল না।

"এই মিনু, তুই এখানে কী করছিস? যা ভেতরে যা।" কুহুদিদি ধমকে দিল।

কিন্তু মিনু সব ব্যাপারটা না জেনে কোথাও যাবে না।

তাই সে একটু দূরে গিয়ে এদিকে তাকিয়ে থাকল।।

আর আড়চোখে দেখল – কুহুদিদি মাছভাজার প্যাকেটটা মেয়েটার হাতে দিল।

‘ও’, এইবার মিনুর মনে পড়েছে। এটা তো সেই মেয়েটা যে কাছেই একটা বস্তিতে থাকে। ওরা খুব গরীব।

একদিন মিনু যখন কুহুদিদির সাথে বল কিনতে গিয়েছিল, মেয়েটা দোকানের কাছেই দাঁড়িয়েছিল।


মেয়েটা কুহুদিদিকে বলল- ‘দিদি, আমাকে একটা বিস্কুট কিনে দেবে?’

কুহুদিদি তো নরম মনের। মেয়েটাকে বিস্কুট আর চকোলেট কিনে দিল।

‘কী যেন নাম মেয়েটার?’

হ্যাঁ, মিঠি।

সেইদিন থেকে কুহুদিদি মিঠিকে বোন বলে।

তার মানে কুহুদিদি মিঠিদিদির জন্য মাছভাজাগুলো এনেছে।

"বোঝো কাণ্ড!"

আর মিনু কিনা এতদিন ধরে ভাবছিল এ সব হুলোর কীর্তি।

মিনুর কুহুদিদির জন্য খুব গর্ব হল।

কিন্তু যাই বলো, কুহুদিদি মা-কে জানিয়ে মাছভাজাগুলো নিতে পারত। মা তো কত ভালো। মা কিছু বলত না। বরং মিঠিদিদির জন্য আরো অনেক খাবার দিয়ে দিত।


মিনু মনে মনে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর দৌড়ে গিয়ে মা-কে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে এল।

মায়ের তো খুব বুদ্ধি। মা দেখেই বুঝে গেল কুহুদিদির কীর্তি। কিন্তু মা খুশী হল কারণ কুহুদিদি তো একটা ভালো কাজ করেছে।


কিন্তু তার সাথে মা এও বলল-"কুহু, তোর কিন্তু আমাকে জানানো উচিত ছিল। শুধু শুধু আমি মিনুকে সন্দেহ করছিলাম, তুই সেটা জানিস। এবার থেকে যা কিছু করবি, আমাকে জানিয়ে করবি।"


কুহুদিদি মাথা নেড়ে সায় দিল।


মা এবার মিঠিদিদিকে বাড়ীর ভিতরে ডাকল। ওদের বাড়ীর কথা জানল, অনেক খাবার দিল আর বলল যে মিঠিদিদিকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে।


মিঠিদিদি তো মহা খুশি! মা ওকে বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেও বলল। সে এসে কুহুদিদি আর মিনুর সাথে খেলবে।


মিনুরও জানো স্কুলে ভর্তি হবার খুব ইচ্ছে। কিন্তু ওদের তো আলাদা কোনো স্কুল নেই। তবে মা-এর কাছে মিনু রোজই কত কী শেখে। তাই মিনুর আর দুঃখ হয় না।


মা এবার এসে মিনুকে কোলে তুলে নিল। মিনুর জন্যই তো আজ সবকিছু বোঝা গেল। তাই সে মহানন্দে ছোট্ট করে ডাক দিল – "ম্যাঁও"।


(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : সুকান্ত মণ্ডল

5 comments: