গল্পের ঝুলি : অপরিচিত : মুনমুন মুখার্জী



“এতো রাতে এখানে কী করছিস তুই?”


অপরিচিত কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে দেখার আগেই ডান হাতের কনুইয়ে একটা হ্যাঁচকা টান; তারপরেই টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে পড়বি তো পড় একেবারে লোকটারই ঘাড়ের উপর। অপরিচিত কেউ ‘তুই' সম্বোধন করলে ভীষণই রাগ হয় রিয়ার। তার ওপর বলা নেই কওয়া নেই অমনি কনুই ধরে টানবে কেন? নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটাকে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই শুকনো পাতার উপর একটা সরসর আওয়াজ।

“কাল কেউটে। তুই যেখানে দাঁড়িয়েছিলি সেখানেই ওর গর্ত।” 

কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল লোকটা, 

“এতো রাতে আর কখনও আসিস না এখানে।”


“থ্যাংকস।” লোকটা ওর কনুই ধরে না টানলে কী হত সেটি ভেবেই রিয়ার গলা শুকিয়ে আসে।


“চুপ কর।” 

ধমকে বলল লোকটা,

“ওসব শহুরে কেতা শহরে গিয়েই করিস। এখন বাড়ি যা, বাবা-মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।”
কণ্ঠটা কি আগে কোথাও শুনেছে রিয়া? উঁহু, মনে পড়ছে না।

“মা বকেছে? মায়েরা অমন একটু আধটু বকেই থাকেন, খুব ভালোবাসেন তো তাই বকেন।” লোকটা বলল।


রিয়া এবার দুদিকে মাথা নাড়ল। কী মনে হতে পেছনে ফিরে আরেকবার লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল রিয়া। তারপর নিজের মনেই হাসলো একবার। ও কি তবে ভয় পেয়েছে?


“কি রে কী ভাবছিস?” লোকটা প্রশ্ন করে।

“আমি বাড়ি নেই, সেটা বোধ হয় মা-বাবা এখনও টের পান নি। আরও কিছুক্ষণ থাকবো আমি এখানে। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার বাড়ি চলে যান।” 
রিয়ার কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়।

“আমি তো এখানেই থাকি। তুই শহুরে মেয়ে। এই অন্ধকারে একা থাকা ঠিক নয় তোর।”

“আপনি এখানে কোথায় থাকেন? আমি শহুরে মেয়ে তা-ই বা জানলেন কীভাবে?"

“আমি বেশ ক’দিন ধরে ঠিক এই জায়গাতেই থাকি রাতে। সকালে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই লোকচক্ষুর আড়ালে।” 

মুখ দেখা না গেলেও লোকটির কথায় একটা হাহাকার টের পায় যেন রিয়া। হাহাকারের এই অনুভূতি বোধ হয় ছোঁয়াচে। রিয়ার মনটাও কেমন হু হু করে ওঠে।


*********


এটা রিয়ার মামার বাড়ি। এখানে আসতে রিয়ার ভীষণই ভালো লাগে। অথচ এবার কিচ্ছু ভালো লাগছে না ওর। আসলে এবারের আসাটা তো অন্য বারের মতো নয়। এবার রিয়া এসে, “গল্পটা কিন্তু শেষ করতে হবে” বলে বায়না করেনি। দাদুও উঠোনের এক ধারে হ্যারিকেনের আলোয় এক কাপ লাল চা আর এক বাটি মুড়ি মাখা নিয়ে আগের ছুটিতে বলা গল্পটি ঠিক যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু করেননি। আর কখনওই দাদুর শেষ না করা গল্পটা শেষ হবে না। মাত্র বারোদিন আগেই রিয়ার দাদু সেই চির গল্প বলার দেশে চলে গেছেন সবাইকে ছেড়ে।


সেদিন সকালে স্কুলে বেরুবার মুখে রিয়ার বড় মামার ফোনে দাদুর অসুস্থতার খবর পেয়ে রিয়া বাবামায়ের সাথে এখানে যখন পৌঁছায় ততক্ষণে সব শেষ।


কাল ছিল দাদুর শ্রাদ্ধ। মামা বাড়ি এখন সব তুতো ভাই বোন আর আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে ঠাসা। দুই মামা আর মামীমারা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। আত্মীয়রা সব গ্রুপে গ্রুপে বসে গল্প করছে আর এক-একবারে হাসির রোল উঠছে বাড়ির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। মাঝে মাঝে মা আর দিদার ফোঁস ফোঁস কান্নার শব্দ ছাড়া এবাড়ির কোথাও কোন শোকের চিহ্নও নেই। সব তুতো ভাই বোনরা মিলে কখনও অন্তাক্ষরী খেলছে, কখনও বা লুডো। কখনও পুকুরঘাটে কখনও বা দোতলার ছাদে আবার কখনও বা উঠোনের এক পাশে বসে গল্প করছে। বড় মামীমার দিদির ছেলে; মিঠু, রিয়ার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ই হবে; ফটোগ্রাফি কোর্স করছে, সে তাই মাঝে মাঝে নিজের ক্যামেরায় বিভিন্ন ভঙ্গীতে সবার ছবি তুলছে।


দাদুর অনুপস্থিতিটা কত সহজে মেনে নিয়েছে সবাই। কিন্তু রিয়া মানতে পারছে কোথায়? সবার মাঝে থেকেও ও যেন কিছুটা গুটিয়ে আছে। একটা মন খারাপের মেঘ ওকে আষ্টেেপৃষ্ঠ বেঁধে রেখেছে যেন। তাই দেখে মিঠুদা আজ সন্ধেয় ওকে বলল, “এই যে রিয়া রানি, স্বাভাবিক ঘটনাকে মেনে নিতে না পারলে জীবনে এগিয়ে যাবি কীভাবে?”

“এগিয়ে যাওয়াটা কি খুব জরুরী দাদা?” স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে পাল্টা প্রশ্ন করে রিয়া।

“আলবৎ! কেউ চলে গেছে বলে কি দিনরাত্রি- হাসি আনন্দ বন্ধ হয়ে যাবে? জীবন স্থবির হয়ে যাবে? যদি তাই হতো তাহলে মানুষ তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্মই দিতো না। সে যেখানটায় শেষ করে গেছে ঠিক সেখান থেকেই যাতে তার উত্তরসূরীদের যাত্রা শুরু হয় তাই তো চায় মানুষ।”


এত কঠিন কথা পনেরো বছরের রিয়ার মাথায় ঢুকল না। শুধু অপ্রতিরোধ্য অশ্রুতে ভেসে গেল ওর বাকি কথা।

“এই সন্ধ্যে বেলায় মৃত মানুষের জন্য কান্না করলে তাঁর আত্মা ভূত হয়ে এসে ঘাড় মটকে দেয়, জানিস?” রিয়ার কান্না দেখে বলে মিঠুদা।

“মোটেই না! ভূত বলে কিচ্ছু হয় না। অযথা আমাকে ভয় দেখাতে এসো না। আমি ওসবে বিশ্বাসও করি না, ভয়ও পাই না।” কাঁদতে কাঁদতেই বলে রিয়া।

“খুব সাহসী বুঝি তুই?” ফোড়ন কাটে মিঠুদা, “তবে যা দেখি দাদুর শ্মশানে। এই তো উঠোন পেরিয়ে মাঠ। তার পরেই বড় পুকুর। পুকুরের ধার ঘেঁষে পায়ে চলা পথের ওপাশেই তোর দাদুর শ্মশান। এতই যদি অবিশ্বাস ভূত প্রেতে, যা দেখি এখন।”

“বেশ, যাচ্ছি।” 
বলেই চপ্পল জোড়া পায়ে গলিয়ে হাঁটতে শুরু করে রিয়া। মিঠুদা ভেবেছিল কয়েক পা গিয়েই ফিরে আসবে রিয়া। কিন্তু ওকে বাগান পেরিয়ে পুকুর ধারে পৌঁছুতে দেখেই মিঠুদা সহ অন্য ভাইবোনরা সব ছুটে যায়, “অনেক হয়েছে, এবার ফিরে চল।” অনুনয় ফুটে ওঠে মিঠুদার কণ্ঠে।

“কিছুতেই না। আজ আমি প্রমাণ করে দেব, ভূত বলে কিছু হয় না।” 
রিয়া এত সহজে হার মানার পাত্রী নয়।

******

একটা ক্ষীণ আলোর রেখা যেন ক্রমশঃই এগিয়ে আসছে শ্মশানের দিকে, সাথে বেশ কিছু লোকজনের উত্তেজিত কণ্ঠ।


“ঐ যে, বাড়ি থেকে তোকে খুঁজতে আসছে। আর জেদ করিস না, ওদের সাথে ফিরে যাস। এসব জায়গায় সাপ খোপের বিচরণ বেশি।”

“আপনি তাহলে এখানে থাকেন কীভাবে?” রিয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।

“ওরা হয়তো আমায় সমঝে চলে।” হাসতে হাসতে বলে লোকটা।


রিয়ার মুখেও হাসি ফোটে। এই কয়েক ঘণ্টায় লোকটার ওপর কেমন মায়া পড়ে গেছে ওর।


“এভাবে হুজুগে মেতে বাবা-মা-কে আর চিন্তায় ফেলিস না। সন্তানের অনিষ্ট আশংকায় মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, বড় কোনও দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।” 

লোকটার কণ্ঠে যেন বিন্দু বিন্দু স্নেহ গলে পড়ছে।

“আর এখানে আসার প্রয়োজন হবে না আমার,” রিয়া জানায়, 
“আমি তো প্রমাণ করেছি মিঠুদার কাছে যে, আমি ভূতে ভয় পাই না। ভূত বলে কিচ্ছু হয় না।”

“ভূত হল মানুষের ভ্রম। তাছাড়া ইহকালে যে তোকে ভালোবাসতো, মরে গিয়ে সে তোর কোনও ক্ষতি করতে চাইবে কেন? তুই যেমন তোর দাদুকে মিস করছিস; তোর দাদুও তো তোকে মিস করছে, তাই না?” 

লোকটার কণ্ঠ এবার বাষ্পীভূত হয়।


এদিকে সেই ক্ষীণ আলোর রেখা স্পষ্ট হতে হতে টর্চের আলোয় পরিণত হয়ে রিয়ার চোখে এসে পড়ে। রিয়া দু হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে নেয়। ওকে দেখে মিঠুদা এগিয়ে আসে। পেছনে দাঁড়ানো রিয়ার বাবা আর বড় মামাকে দেখিয়ে বলে, 
“তুই ফিরছিস না দেখে ওঁদের সব খুলে বলে এখানে নিয়ে এলাম। ধন্যি মেয়ে তুই যে একা একা...”

“একা থাকবো কেন? এই যে ইনি তো...” কথা শেষ করার আগেই পেছনের লোকটার দিকে হাসি মুখে ফিরে তাকায় রিয়া।


এ কী! কেউ তো কোথাও নেই! তবে এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিল রিয়া? আর সেই সাপটা? মিঠুদার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে মাটির দিকে তাক করে রিয়া, হ্যাঁ সাপের গর্তটা আছে তো! তাহলে লোকটা!!!!


কেউ কিছু বলার আগেই রিয়া বাবাকে জড়িয়ে ধরল, 
“খুব ক্ষিধে পেয়েছে বাবা। বাড়ি নিয়ে চলো।”


কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে তাকায় রিয়া শ্মশানের দিকে। এতক্ষণে রিয়ার চোখে অন্ধকার সয়ে এসেছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রিয়া লোকটা ঠিক সেখানেই বসে... তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। লোকটার মুখের সাথে দাদুর মুখের কি অদ্ভুত মিল! ভাবতেই শিহরিত হয় রিয়া।


“কি দেখছিস রিয়া?” 
ফিসফিস করে বলে মিঠুদা।


উত্তর না দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে রিয়া। ওর কানে বাজতে থাকে, 
“তুই যেমন তোর দাদুকে মিস করছিস; তোর দাদুও তো তোকে মিস করছে, তাই না?” 

নীরব চোখের জলে ভেসে যেতে থাকে রিয়ার চিবুক।


(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

1 comment:

  1. সত্যিই তাই, যারা আমাদের ভালোবাসেন তাঁরা কখনো আমাদের ছেড়ে যান না। আমাদের পাশেই থাকেন।

    ReplyDelete