গল্পের ঝুলি : কাঠঠোকরা : অনন্যা দাশ





“ওটা কাঠঠোকরা!!” 

বলে ফেলেই হকচকিয়ে গেল দর্শিতা। ক্লাসের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে দেখছে! পরক্ষণেই সবাই হো হো হি হি করে হাসতে শুরু করে দিল। লজ্জায় লাল হয়ে গেল দর্শিতার ফর্সা গাল দুটো। মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে সে, বাংলায় কথা বলে ফেলেছে ক্লাসে!

দু’সপ্তাহ হল দর্শিতা মায়ের সঙ্গে আমেরিকার হ্যারিসবার্গ শহরে এসেছে। বাবার কাজের সূত্রেই ওদের এখানে আসা। বাবা আগেই এসেছিলেন, তারপর বাড়িঘর সব ঠিক হতে ওরা এসেছে। দর্শিতা এখানকার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সে ইংরাজিটা বুঝতে পারে কিন্তু এখানকার ঢঙে কথা বলতে তার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সেইজন্যেই সে বেশির ভাগ সময় ক্লাসে চুপ করেই থাকছে, অথবা হ্যাঁ না বলে কম কথায় মাথা নেড়ে ইশারায় কাজ চালাচ্ছে। মুশকিলটা হল ক্লাসের জানালার বাইরে একটা সুন্দর কাঠঠোকরা পাখি এসে বসার পর। সে তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে এদিক ওদিক ঠুকঠাক করে ঠুকে দেখছিল! মাথা লাল, গা-টা সাদা কালো মেশানো, ভারি সুন্দর দেখতে পাখিটাকে! দর্শিতা পাখিটাকে চেনে তাই উৎসাহে আনন্দে ওর মুখ থেকে বাংলা কথাটাই বেরিয়ে গেল! ব্যস আর যাবে কোথায়! ক্লাসের সবাই ওকে ‘কাঠঠোকরা কাঠঠোকরা’ বলে খেপাতে লাগল।

ইসাবেল বলে একটা মেয়ে তো চেয়ারের উপর উঠে তারস্বরে ‘কাঠঠোকরা কাঠঠোকরা’ বলে নেচে নেচে চেঁচাচ্ছিল আর অন্যরা সবাই হাততালি দিচ্ছিল, এমন সময় টিচার এসে ক্লাসে ঢুকলেন।


“ইসাবেল? এ সব কী হচ্ছে? কী করছ তুমি? কী বলছ?”


টিচারকে দেখে অবশ্য ইসাবেল চুপ! তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে নেমে পড়ল। আর তার মুখ থেকে কোনও কথা বেরলো না। টিচার তখন অ্যালিস, নর্মা আর পিটারকে জিজ্ঞেস করলেন। ওরা তিনজনে মিলে টিচারকে বলে দিল ঘটনাটা সত্যি কী হয়েছিল।


সব শুনে টিচার বললেন, “তোমাদের ব্যবহারে আমি মর্মাহত হয়েছি। তোমরা সবাই দর্শিতাকে সরি বলবে। আর ইসাবেল তুমি ভয়ানক বাজে কাজ করেছো। ও একটা অন্য দেশ থেকে এসেছে। আমাদের ভাষাটা ঠিক মতন জানে না এখনও, তবে ঠিক শিখে নেবে। ভেবে দেখো যদি উল্টোটা হত, যদি তোমাকে ওর দেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে হত, তাহলে? আমার ক্লাসে আমি এইরকম আচরণ মোটেই বরদাস্ত করব না। আমি তোমাকে দু’দিন সময় দিচ্ছি। সোমবারের মধ্যে তুমি ও যেখান থেকে এসেছে সেই দেশ সম্পর্কে জেনে, পড়ে একটা প্রোজেক্ট করে আমাকে দেখাবে। না হলে আমি আরও কঠিন শাস্তি দেবো তোমাকে। আমি বলব না ও কোথা থেকে এসেছে আর ক্লাসের অন্য কেউও যেন কিছু না বলে। তুমি ওকেই জিজ্ঞেস করে জানবে।”

ক্লাসের সবাই দর্শিতাকে সরি বলল। দর্শিতা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে রইল। টিচার তার পড়ানো শেষ করে চলে গেলেন। ইসাবেল দর্শিতার কাছে এসে বলল, “নাও এবার তুমি খুশি তো? আমাকে এখন ফালতু ফালতু একটা বাড়তি প্রোজেক্ট করতে হবে হোমওয়ার্ক ছাড়াও। তাও দু’দিনে! উইকেন্ডটা মাটি হয়ে গেল। নাও এবার দয়া করে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ!”


দর্শিতা মুখ খুলল না। ইতিমধ্যে অন্য টিচার এসে গেলেন আর তার পরেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ইসাবেল আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে পারার আগেই দর্শিতা চটপট বাসে গিয়ে উঠে পড়ল। ইসাবেল ওদের পাড়াতেই থাকে ওদের দুটো বাড়ি পরে, সেটা দর্শিতা জানে। একটু ভুগুক সে তারপর না হয় তাকে বলা যাবে! ভেবে দর্শিতা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল।

বিকেলবেলা যেই না দর্শিতা বাড়ির বাইরে বেরিয়েছে অমনি ইসাবেল সেটা দেখতে পেয়ে ওর কাছে এসে হাজির!

বলল, “ঠিক আছে, অনেক ড্রামা করেছ। এবার বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ। প্রথমদিন টিচার বলেছিলেন মনে হয় কিন্তু আমি ভুলে গেছি। এখন তো স্কুলের লাইব্রেরিও বন্ধ হয়ে গেছে, আর তো বইও পাব না। কম্পিউটারেই দেখতে হবে। আমার দাদা আবার আমাকে কম্পিউটারটা ছুঁতে দেয় না আমি নাকি বাচ্চাদের খেলা খেলি ওটাতে বলে!”

মা মনে হয় জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন ওদের। দর্শিতা কিছু বলার আগেই বেরিয়ে এসে বললেন, “ওমা তোমার বন্ধু এসেছে বুঝি? যাও বন্ধুকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসাও।”

“না ও আসবে না। ও একটা দরকারে এসেছে।”

মা রেগে গেলেন, “এ কীরকম ব্যবহার হচ্ছে? নাও ওকে ডাকো।”

দর্শিতা ভেবেছিল ইসাবেলকে ডাকলে সে আসবে না কিন্তু তাকে বলতে সে দিব্যি ভিতরে চলে এল। সেদিন বাবার জন্মদিন ছিল বলে মা কেক বানিয়েছিলেন। সেই কেক আর সাবুর পাঁপড় ভেজে ইসাবেলকে দিতে সে দিব্যি খেয়ে নিলো। তারপর সে দর্শিতাকে আর না জিজ্ঞেস করে সোজা ওর মাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কোথা থেকে এসেছ?”

“ইন্ডিয়া।”

“ও আচ্ছা, তা ভালো।”

দর্শিতা যখন দেখল ওকে আর আটকানো যাবে না তখন বলল, “এসো, দেখাচ্ছি।”


এই বলে বাবার নতুন কম্পিউটারে ইন্ডিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু দেখাল ইসাবেলকে। তাজমহল দেখে ওর তো চোখ ছানাবড়া! পোশাকের ছবিগুলো দেখে বলল, “তোমার কাছে এইরকম ইন্ডিয়ান ড্রেস আছে?”

“হ্যাঁ।” বলে দর্শিতা তার সুন্দর লেহেঙ্গা চোলিটা বার করে এনে ওকে দেখাল। ওটা দর্শিতার মামা ওকে রাজস্থান থেকে এনে দিয়েছিলেন। ওর মামা ইদানীং জয়পুরে থাকেন। মাসখানেক আগে নিজের জন্মদিনে ওটা পরেছিল দর্শিতা। ইসাবেল মনে হয় অত জমকালো জামা কোনওদিন দেখেনি, ওর মুখ হাঁ হয়ে গেল।

বলল, “আমাকে পরতে দেবে একবার?”

দর্শিতা আর কী বলবে, বল, “ঠিক আছে, পরো।”

ইসাবেল বলল, “দাঁড়াও, আমি আমাদের ক্যামেরাটা নিয়ে আসি!”

একটু পরেই সে ক্যামেরা আর নিজের মাকে নিয়ে হাজির হল। ওর মা-ও জামাটা দেখে মোহিত! ইসাবেল জামাটা পরে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। ওদের জামাটা এত ভাল লেগেছে দেখে মা বললেন, “ইসাবেল, ওটা যদি তোমার অত পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তুমি ওটা নাও! আমরা তো আবার আনিয়ে নিতে পারব!”

তাই শুনে ইসাবেল সে কী খুশি! ও আর ওর মা দুজনেই খুব ‘থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ’ করল।


তারপর শনিবার আর রবিবার দু’দিনই ইসাবেল এল ওদের বাড়িতে। তখন অবশ্য শুধু ইন্ডিয়া নিয়ে পড়াশোনা হলো না অনেক খেলাও হলো। দর্শিতার আর ওর সামনে ইংরাজিতে কথা বলতে লজ্জা করছিল না, ইসাবেলের সঙ্গে দিব্যি কথা বলতে পারছিল সে। ওদের সঙ্গে দুপুরের খাবার পর্যন্ত খেল ইসাবেল। মা ভেবেছিলেন ও খেতে পারবে না কিন্তু সে দিব্যি ভাত, ডাল, চিকেন কারি খেল! খেয়ে বলল, “খুব ভাল খেতে!”

ইসাবেলকে প্রোজেক্টটা অনেকটাই বানাতে সাহায্য করল দর্শিতাই।


সোমবার দিন চার্ট পেপারে তৈরি প্রোজেক্টটা ক্লাসের সবাইকে দেখিয়ে পিছনের নোটিস বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দিলেন টিচার। সেখানে ইন্ডিয়া নিয়ে অনেক কিছু লিখেছে ইসাবেল। তার সঙ্গে নিজের একটা লেহেঙ্গা পরা ছবি আটকেছে, একটা কাঠঠোকরা এঁকেছে আর তলায় লিখেছে ‘কাঠঠোকরা ইন বেঙ্গলি’! সব শেষে লিখেছে ‘ইন্ডিয়ার লোকেরা খুব ভাল। আমার একজন ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে তার নাম দর্শিতা।’

টিচার সেটা পড়ে মুচকি মুচকি হাসলেন, এইটাই তো তিনি চেয়েছিলেন।


এখন কাঠঠোকরাটা ওদের ক্লাসের জানালায় এসে বসলে দর্শিতাদের ক্লাসের সবাই বলে, “দ্যাট বার্ড ইজ আ উডপেকার, বাট ইউ ক্যান অলসো কল ইট আ কাঠঠোকরা!” অর্থাৎ ওই পাখিটা উডপেকার কিন্তু ওটাকে কাঠঠোকরা বলেও ডাকতে পারো!


(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : আবির

3 comments:

  1. খুব সুন্দর গল্প আর খুব সুন্দর ছবি। 😊

    ReplyDelete
  2. কি মিষ্টি গল্প, আমার মেয়ে শুনে খুব খুশি। এখন বাইরে কাঠঠোকরা খুঁজছে।

    ReplyDelete
  3. মিষ্টি গল্প। ছবির সাথে গল্প একদম মিশে গেছে। খুব সুন্দর।

    ReplyDelete