বিবিধ নিবন্ধ : পুজো আসছে : অভিনন্দন চক্রবর্তী



"বাবু, এই বাবু ওঠ ওঠ! আরে আমি রেডিও চালিয়ে দিয়েছি তো, শুনবি না? এক্ষুণি শুরু হবে কিন্তু শঙ্খের আওয়াজ, মহালয়া যে আজ! পুজো এসে গেল বাবু, উঠে পড়। তোর দিদিভাইও কিন্তু উঠে গেছে ঘুম থেকে"।
আকাশবাণী কলকাতায় চ্যানেল সেট করে আট বছরের ছেলেকে ডাকতে ডাকতে বিছানার দিকে এগিয়ে যান শর্বরী দেবী। ঘড়ির কাঁটা তখন চারের ঘর ছুঁই ছুঁই।

মায়ের ডাকে চোখ কচলে মায়ের দিকে তাকালো জয়। আরে আজই তো মহালয়া। আজ কিছু শোনাবে মা রেডিওতে, কাল রাতেই ভাত খেতে খেতে বলছিলো। কিন্তু খুব ঘুমও যে পাচ্ছে!

"ওওও মা আরেকটু শুই না! ঘুম পাচ্ছে তো খুউউউব"।

"আরে আজ কি ঘুমালে চলবে? দুপুরে ঘুমোস আবার। এখন শোন মন দিয়ে লক্ষ্মীসোনা আমার। মহালয়া না শুনলে বুঝবি কী করে যে পুজো আসছে? শুনতে হয় বুঝলি? দেখবি, বড় হয়ে একদিন বুঝবি এর জাদু। হয়তো থাকবি দূরে কোথাও, আমেরিকা বা লন্ডন বা দিল্লী, কিন্তু আজকের দিনে ঠিক ফিরে আসবি বারবার। সবসময় মনে পড়বে এই আজকের দিনটা। বলবি যে হ্যাঁ, মা ঠিকই বলেছিল ওইদিন। এই মহালয়ার গল্প তুইও একদিন শোনাবি কাউকে"।
ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন শর্বরী দেবী। তাঁর মনে পড়ে যায় নিজের ছোটবেলার কথা। এইভাবেই তাঁকেও মহালয়ার ভোরের এই অনুষ্ঠানের মাহাত্ম্য বুঝিয়েছিলেন তাঁর মা।

মায়ের কথা এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল জয়। যদিও ঘুম এখনও লেগে চোখে কিন্তু ভালোই লাগছিলো বেশ শুনতে। এখন হঠাৎ মায়ের মুখে এই দূরে থাকার কথা শুনেই দিদিভাইয়ের বালিশের পাশ কাটিয়ে ও এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। 
"ধ্যাৎ মা কী যে বলো! আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবোই না। আমি তো এখানেই থাকব তোমার কাছে। কোথাও গেলে তো তুমি, বাবা আর দিদিভাইও যাবে সাথে। কই তোমার আঁচল কই? দাও ওটায় মুখ গুঁজে শুনবো। আচ্ছা মা সত্যিই কি পুজো এসে গেল ? আর এখন রেডিওতে কী হবে গো বলো না!"

ছেলের কথা শুনে হেসে ওঠেন শর্বরী দেবী। পায়ের কাছে গোটানো চাদরটা টেনে নিতে নিতে বলেন, 
"হ্যাঁ বাবু, আর সাতদিন পরেই পুজো। দুর্গাপুজোর ঠিক সাতদিন আগে, মহালয়ার ভোরে প্রতি বছর নিয়ম করে এই অনুষ্ঠান হয় রেডিওতে। আর তুই কি জানিস এটা কবে থেকে হচ্ছে? সেই ১৯৩১ সাল থেকে। শ্লোকপাঠ, স্তোত্রপাঠ আর অনেক গান সবই হবে এখন। 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামের এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, আর গেয়েছেন আরও অনেকে। যখন গানগুলো হবে আমি বলবো সবার নাম এক এক করে। সব মনে রাখতে হবে কিন্তু, নাহলে ......"
মায়ের কথার মাঝেই জয় জিজ্ঞাসা করে,
"আচ্ছা মা এটা কি ওই বড় বাড়িটাতেই হচ্ছে যেটা এবার শীতকালে ইডেন গার্ডেন্স যাওয়ার সময় বাবা দেখিয়েছিল আর বলেছিল এটা আকাশবাণী কলকাতার অফিস?"
ছেলের কথা শুনে তার বুদ্ধির তারিফ করে শর্বরী দেবী বলেন,
"হ্যাঁ ওখান থেকেই সম্প্রচার করা হচ্ছে এটা রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কিন্তু সরাসরি সম্প্রচার হত জানিস? এখন রেকর্ডিং বাজানো হয়। নে এবার শোন চুপটি করে। বাবাও শুনছে দ্যাখ নিচে শুয়ে। ওই যে শুরু হচ্ছে শঙ্খের আওয়াজ।"


শঙ্খের আওয়াজের মাধ্যমে মহালয়া শুরু হয়ে যায় ছোট্ট ঘরটিতে তথা গোটা ভারতবর্ষে। মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে থাকা ছোট্ট জয়ের শরীরে অজান্তেই খেলে যায় শিহরণ। তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় রোজ সন্ধ্যেবেলা মা'ও তো এভাবেই শঙ্খ বাজায়। শুরু হয় মহালয়ার প্রথম গান-


'যা চণ্ডী .....
মধুকৈটভাদি দৈত্য দলনী ......'


শুরুতেই এইরকম একটি গানে অল্প ঘাবড়ে যায় জয়। চণ্ডী শব্দটি ছাড়া আর কোনো শব্দই চেনা লাগে না তার।
"মা এই গানটার মানে কিছুই বুঝতে পারছি না। যা চণ্ডী মানে কি মা"?

"এখনই তো বুঝবি না বাবু, আরেকটু বড় হ। তবে হ্যাঁ এই গানটা মা দুর্গাকে নিয়ে। তাঁর প্রতি স্তুতি। তিনি আসছেন আর ক'দিন পর সব ভালো হবার বার্তা নিয়ে। তিনি দৈত্যদলনী অর্থাৎ ওই যেসব বড় বড় ভয়ঙ্কর দৈত্যরা যারা সবকিছু বিনাশ করে দেয়, মা দুর্গা তাদের শাস্তি দেন। তাদের দমন করেন।"

এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় জয়ের কাছে। কিন্তু মা বললো না তো এটা কার গাওয়া! সে জিজ্ঞাসা করে "এই গানটা কার গাওয়া মা"?

"এই গানটা? এটা অনেকে মিলে একসাথে গেয়েছেন বাবু। কেউ একা গাননি। এইবার শোন এই গানটা শেষ হবার পরেই শোনা যাবে ওঁর কণ্ঠস্বর। যা শোনার জন্য আপামর বাঙালি অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। ওঁর নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বুঝলি? ওঁর গলায় জাদু আছে। এবার শুরু হবে ওঁর স্তোত্রপাঠ। অনেক কিছু বলবেন উনি মন দিয়ে শুনিস। আর ফাঁকে ফাঁকে খুব ভালো ভালো গানও হবে। ওই যে শোন শুরু হচ্ছে।"

মায়ের কথা শুনে ভালো করে গুছিয়ে শোয় জয়। আড়চোখে একবার দেখে পাশে শুয়ে থাকা দিদিভাইকে আর নিচে বাবাকে। দুজনেরই চোখ বন্ধ। বুঝতে পারে না সে ওঁরা শুনছে কিনা। তখনই রেডিও থেকে ভেসে আসে এক কণ্ঠস্বর-


"আশ্বিনের শারদপ্রাতে
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির ,
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা ....."


কিছু কিছু বুঝতে পারলেও পুরোটা বোঝে না জয়। "কীরকম রাগী রাগী কণ্ঠস্বর গো মা! আচ্ছা উনিও কি এটাই বলছেন যে পুজো আসছে?"

"হ্যাঁ রে বাবু। মা দুর্গাকে নিয়েই বলছেন উনি। এই আশ্বিন মাসেই তো পুজো হয়। তাই উনি শুরুতে বললেন আশ্বিনের শারদপ্রাতে। ওই যে শোন উনি বলছেন ধরণীর অন্তরাকাশে জাগরিত মায়ের আগমন বার্তা। এই যে দেখিস না বাইরে কী সুন্দর পুজো পুজো ভাব, আকাশে সাদা মেঘের সারি, মাঠে কাশফুল দুলছে! কেমন আনন্দ হয় তাই না? বুঝে যাই আমরা যে পুজো আসছে। এটাই বলা হচ্ছে এখানে। আগামী কয়েকদিন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে সবাই আনন্দ করবে। কারোর কোনো কষ্ট থাকবে না।"

মনের মত একটা ব্যাখ্যা পেয়ে খুব খুশি হয় জয় আর সাথে সাথে মনে পড়ে পিছনের মাঠে কাশফুলের কথা। "ওওওও এইবার বুঝেছি মা। জানো মা ওই পিছনের মাঠেও অনেক কাশফুল হয়েছে। খুব সুন্দর লাগে দেখতে। সেদিন তো আমি স্কুলে এঁকেও ছিলাম কাশফুল। আচ্ছা মা আর গান হবে না এরপর?"

ছেলের আগ্রহ দেখে হেসে ওঠেন শর্বরী দেবী। তাকে আশ্বস্ত করে বলেন "হবে তো বাবু। এরপর আরও একটা ছোট্ট গান হবে সবাই একসাথে গাইবে। আর তারপর আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর কন্ঠস্বর। উনি তখন মা দুর্গার বিভিন্ন রূপের কথা বলবেন। শোন মন দিয়ে।"



মন দিয়ে এরপরের কথা শুনতে থাকে জয়। কাল সকালে উঠেই দিদিভাইকে ধরতে হবে যে ও মা দুর্গার কতগুলো রূপের নাম জানে।
"মা আমি কিন্তু অনেকগুলো নাম মনে করে নিয়েছি। মহামায়া, সনাতনী , শক্তিরূপা, গুণময়ী আর তারপর ওই যে কী যেন, নাহ্ আর মনে পড়ছে না মা!"
মুখ ব্যাজার করে বলে ওঠে জয়। ধ্যুৎ এইতো মনে করল পাঁচটা নাম, কী করে যে ভুলে গেল শেষেরটা!


"থাক থাক আর মনে করতে হবে না, আজ এগুলোই যথেষ্ট। এগুলো সবই মা দুর্গার নাম। এই নামগুলোই বললেন উনি আর বললেন মা দুর্গার বিভিন্ন রূপের কথা। কখনও তিনি দুষ্টের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন, আবার কখনও তিনি পরম স্নেহময়ী। এবার কিন্তু খুব মন দিয়ে শোন। এবারই হবে সেই গানটা যে গান একদিন তুইও শোনার জন্য পাগলের মত সারা বছর অপেক্ষায় থাকবি বড় হয়ে। ওই দ্যাখ তোর বাবাও উঠে বসল গানটা শোনার জন্য। মহালয়ার সব গানের মধ্যে এই গানটা সব থেকে বেশি জনপ্রিয়"।


'বাজল তোমার আলোর বেণু ,
মাতল যে ভুবন ....
বাজল তোমার আলোর বেণু'



"শুনলাম গো মা। আর এবার কিন্তু আমি অল্প অল্প বুঝেছি মা। এটাও মা দুর্গাকে নিয়ে। মা দুর্গা যে আসছেন, সবাই মেতে উঠেছে সেই নিয়েই তো বলল তাই না?" একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে জয় দেখে মায়ের চোখে জল।
"আরে আরে! একি মা, তোমার চোখে জল কেন? ধুৎ, আমি বন্ধ করে দিচ্ছি রেডিও। শুনব না মহালয়া। তুমি কাঁদছ যে!"

ছেলের কথা শুনে চোখ মুছে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শর্বরী দেবী বলেন,
"ওরে না রে পাগল, কাঁদছি না রে। এ তুই এখন বুঝবি না। বড় হ', তারপর আস্তে আস্তে দেখবি এই গানটা শুনলেই কেমন অনুভূতি হয় ভিতরে। শরীরে কাঁটা দেয়। চোখে জল আসে যেটা কান্না নয়। এইটাই মজা এই গানের। আর এই গানটি কে গেয়েছেন বল তো ? ওঁর নাম সুপ্রীতি ঘোষ। খুব সুন্দর গলা ওঁর। নে এবার শোন খুব ভালো করে। আসল কথা কিন্তু এবারই শুরু হবে। কীভাবে ওই মহিষাসুরের জন্ম হল আর কীভাবে মা দুর্গা ওই দুষ্টু অসুরকে বধ করেছিলেন সেটাই এখন বলা হবে পুরো। মন দিয়ে শোন। আর শুধু শুনলেই কিন্তু হবে না, মা দুর্গার মত আমাদের সবাইকে এইভাবেই দুষ্টু অসুরদের হারাতে হবে"।

মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন আনমনা হয়ে গিয়েছিল জয়। সে বলে ওঠে,
"ওই যেরকম ওইদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল ওই লোকটা কেমন মারছিল সেই গুন্ডাটাকে, ওইভাবেই মা?"

"সবসময়ই যে মারপিট করে তা নয়। ভুল শুধরে দিয়ে তারপরই শাস্তি দিতে হবে। নে এবার শোন পরের গানটা। দেখি তো এই গানটা শুনে তোর কিছু মনে পড়ে কিনা!"
কথাগুলো বলে ছেলের দিকে তাকান শর্বরী দেবী। রেডিওতে শুরু হয় পরবর্তী গান।

'জাগো তুমি জাগো
জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী ,
অভয়া শক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো।
জাগো তুমি জাগো ....'



গানটা শেষ হতেই লাফিয়ে উঠে জয়।
"মনে পড়েছে মনে পড়েছে মা, এই জাগো জাগো গানটা সেই ওই পাড়ার ক্লাবের ফাংশনে গেয়েছিল না বাবা একবার?"

ছেলের কথা শুনে হাততালি দিয়ে ওঠেন শর্বরী দেবী। ছেলেকে আদর করে বলেন,
"আরে তোর মনে আছে ? ঠিক বলেছিস বাবু। তখন খুব ভালো গান গাইত তোর বাবা। এখানে এই গানটা গেয়েছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। এখানে আহ্বান জানানো হচ্ছে মা দুর্গাকে। ওই দ্যাখ শুনতে শুনতে ঘুমিয়েই পড়েছে তোর বাবা। তোর বাবার সবথেকে প্রিয় গানটা তো শুনলই না। একটু পরেই হবে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা'। তোর বাবার খুব প্রিয় ওই গানটা। জানিস তোর বাবা অনেক রাতে ফিরেছিল কাল। ফিরে তোকে কত আদর করল।  নতুন জামাও এনেছে তোদের জন্য জানিস ? কাল সকালে উঠেই তোরাও অনেক অনেক আদর করে দিস বাবাকে আর বলিস যে জামা খুব পছন্দ হয়েছে"।

নতুন জামার কথা শুনে মনটা নেচে ওঠে জয়ের। গতবার মোট সাতটা জামা হয়েছিল তার। সে বলে ওঠে "এখনই যাব মা বাবার পাশে?"

"না বাবু এখন না। এখন বাবা একটু ঘুমাক। সারাদিন তোর আর তোর দিদিভাইয়ের জন্যই এত পরিশ্রম করে। বলে যে আমার বাবু আর মামণি একদিন অনেক বড় হবে। আচ্ছা, এই জাগো গানটা ভালো করে বুঝতে পারলি তো? জানিস, বড় হয়ে চারিদিকে অনেক কিছু দেখবি। কোনোটা ভালো বা কোনোটা খারাপ। খারাপ কিছু দেখলেই কিন্তু মা দুর্গার মত আমাদের ভিতরে ভিতরে জেগে উঠে সেই খারাপকে ভালো করার জন্য এগিয়ে যেতে হবে বুঝলি? এই গানটাতে দ্যাখ কী বলছে। জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণী , অভয়া শক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো। মা দুর্গাই আমাদের শক্তি বুঝলি বাবু ? আমাদের বল দেন ,শক্তি দেন। তবে আমাদের সকলের মধ্যেই কিন্তু মা দুর্গা আছে। আমাদেরও মা দুর্গার মত বিনাশ করতে হবে যত্তসব বাজে পচা জিনিসকে।"



মায়ের কথাগুলো মন দিয়ে শুনে জয় বলে,
"জানো মা কাল স্কুলের ওই বদমাশ বিল্টুটা না খুব মারছিল পাপাইকে। আমি দেখতে পেয়েই গিয়ে থামিয়েছি ওকে। সরিয়ে দিয়েছি ঠেলে আর বলেও দিয়েছি স্যারকে।"

"এইতো লক্ষ্মীসোনা আমার! একদম ঠিক করেছিস বাবু। তবে পরশু স্কুলে গিয়ে কিন্তু ভাব করে নিস বিল্টুর সাথে। ওকে বলিস যে এরকম করতে নেই, আর হ্যাঁ, ওকেও বলতে ভুলিস না যে পুজো আসছে। খুব ভালো করে যেন ও কাটায় পুজো।"
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন শর্বরী দেবী।

"বলে দেব মা। ও মা এবারই কি অসুর বধ হবে"?

"হ্যাঁ রে, শোন বাকিটা মন দিয়ে"।

মা দুর্গার বিভিন্ন রূপের মতো এবার তাঁকে দেওয়া অস্ত্রগুলির কথাও মনে রাখা শুরু করে দেয় জয়। পাশাপাশি মনে রাখে সকলের নামও।
"এইতো এবার সবাই কী কী অস্ত্র দিল মা দুর্গাকে সেটাই তো বলছে, তাই না মা? এবারই কি যাবে মা দুর্গা অসুরকে মারতে?"

"হ্যাঁ বাবু। এবারই যাবে মা দুর্গা অসুরকে মারতে। আচ্ছা কে কী কী অস্ত্র দিল সব মনে করে নিয়েছিস তো? কাল সকালে উঠেই দিদিভাই আর বাবাকে বলে দিস। ওরা তো ঘুমিয়েই পড়ল, জানতেও পারল না কে কিী অস্ত্র দিল।"

মনের মতো একটা হোমটাস্ক পেয়ে খুব খুশি হয় জয়। "হ্যাঁ মা বলে দেবো। জানো মা আমি গতবার দেখেছিলাম ওই মন্দিরের প্যান্ডেলের মা দুর্গার দশটা হাতে দশটা অস্ত্র। মা এবারও যাব তো আমরা ঠাকুর দেখতে? জামাগুলো কই মা?"

"আরে আছে রে আছে, সব বাক্সে তোলা আছে।" ছেলেকে আশ্বস্ত করেন শর্বরী দেবী।
"কাল সকালে উঠে আমরা দুজন মিলে একবার রোদে মেলে দেব জামাগুলো বুঝলি বাবু? আর তোর গত বছরের যে ছোট হয়ে যাওয়া জামাগুলো আছে ওগুলো তোর হাতে দেব, তুই ওই পাশের বস্তিতে পিলু, মানিক, লাল্টুদের দিয়ে আসিস বুঝলি? ওরা এবার জামা কিনতে পারেনি। খুব মন খারাপ ওদের, এই পুজো কিন্তু ওদেরও। ওরাও চায় মজা করতে। নতুন জামা তো আর দিতে পারব না, তোদের বাবা আর একা কত পারবে! ওগুলোই দেব তোকে। তুই ওদের হাতে দিস, আর হ্যাঁ, বলে দিস যে পুজো আসছে, এই জামাগুলো যেন ওরা পরে পুজোয় আর খুব আনন্দ করে। দেখবি খুব খুশি হবে ওরা। এটাও কিন্তু মা দুর্গাই শেখান আমাদের, জানিস? সব সময় সবার পাশে থাকতে হয়। একসাথে থাকতে হয়, বুঝলি?"


"বুঝেছি মা। তুমি দিও, আমি দিয়ে আসব ওদের। খুব মজা হবে। আচ্ছা মা অঞ্জনাপিসিকেও একটা শাড়ি দিলে হয় না? রোজ কত কষ্ট করে আসে আমাদের বাড়ি। আমার খেলনাগুলোও গুছিয়ে দেয়। অঞ্জনাপিসিকেও একটা শাড়ি দাও না মা! দিয়ে বোলো যে পুজো আসছে। খুব যেন মজা করে"।

ছেলের মুখে এই কথা শুনে ভীষণ খুশি হন শর্বরী দেবী। "আরে আমার বাবুটা তো হঠাৎ করে বড় হয়ে গেল দেখছি! আয় আয় আদর করে দিই একটু। আমি কাল সকালেই বের করে দেব তোর অঞ্জনাপিসির জন্য শাড়ি।"
কথাগুলো বলে ভীষণ আনন্দিত হন শর্বরী দেবী।

"মা মা, ওই শোনো মা দুর্গা হারিয়ে দিল দুষ্টু অসুরকে। কি মজা।"
বিছানায় শুয়েই হাততালি দিয়ে ওঠে জয়।

"হ্যাঁ বাবু। অসুর পরাস্ত হল এবার। দুষ্টের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করলেন মা দুর্গা। এবার আমাদের দায়িত্ব এই পৃথিবীকে রক্ষা করার। মা দুর্গা সব সময় আসবেন না। আমাদের ভিতরের মা দুর্গাকেই এবার করতে হবে যা করার। আর আমি জানি আমার বাবুসোনা ঠিক তাই করবে বড় হয়ে। কী তাই তো? এ কি রে, চোখ বন্ধ কেন? ঘুম পাচ্ছে বাবা? আহারে ছোট্ট সোনা আমার সেই কত সকালে উঠে মহালয়া শুনেছে আমার সাথে। নে, এবার ঘুমো। পুরোটাই তো শুনেছিস প্রায়। বাকি আছে শুধু শেষ গান 'রূপং দেহি রণং দেহি'। ওটার মানে আমি কাল বুঝিয়ে দেব।"
ছেলেকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে কোলবালিশটা এগিয়ে দেন শর্বরী দেবী।

"আচ্ছা মা ওই নমো চণ্ডী গানটাও খুব ভালো লাগলো। ওটা কে গেয়েছে বললে না?" ঘুমচোখে প্রশ্ন করে জয়।

ঘুম পাওয়া সত্ত্বেও ছেলের এই আগ্রহ দেখে হেসে ওঠেন শর্বরী দেবী।
"ওই গানটা? ওটা গেয়েছেন বিমলভূষণ, আর ওই যে আরও একটা গান হল 'হে চিন্ময়ী' ওটা গেয়েছেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ওঁর গানও খুব পছন্দ করে তোর বাবা।"

"মা দুর্গা রাগ করবে না তো মা পুরোটা শোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়লে?"

"না না  মা দুর্গা কখনো আমার বাবুর মত লক্ষ্মী ছেলের ওপর রাগ করতে পারেন? মা দুর্গা তো আরও খুশিই হয়েছেন তুই এত সকালে উঠে প্রায় পুরোটা শুনেছিস বলে। নে ঘুমিয়ে পড় এবার। সকালে উঠে জামাগুলো রোদে দিতে হবে তো, নাহলে পুজোয় পরবি কী করে ? কাল সকালে লুচি বানাবো তোদের জন্য। পুজোর ক'টা দিন রোজ তোর আর তোর দিদিভাইয়ের প্রিয় খাবারগুলি বানাবো। এবার পুজোয় খুব মজা করব আমি, তুই, দিদিভাই আর তোর বাবা। খুব ভালো কাটবে এবার আমাদের পুজো। আমাদের মত আর যারা যারা আছে তাদের সবার পুজো। চাদরটা টেনে নে ভালো করে। ঠান্ডা লেগে যেন জ্বর না হয় দেখিস। জ্বর হলেই সব মাটি কারণ পুজো আসছে।"

(সমাপ্ত)


ছবি : সুকান্ত, স্বর্ণদ্বীপ, অনিন্দ্য, উইকিপিডিয়া

8 comments:

  1. ভাষাহারা আমি। অনেক কিছু আবার করে মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ, অনবদ্য, অপূর্ব ������

    ReplyDelete
  3. অনেক ধন্যবাদ 😊

    ReplyDelete
  4. অনেক অনেক ধন্যবাদ 😊

    ReplyDelete
  5. Too good vai ai gulo koto age chere asechi

    ReplyDelete
  6. নন্দিতা আর দেব, অনেক ধন্যবাদ 😊

    ReplyDelete