গল্পের ঝুলি : মিমোর কৈলাস অভিযান : সায়ন্তনী পলমল ঘোষ



জানালা দিয়ে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল মিমো। বাগানের পেয়ারা গাছে বসে একটা পাখি মহানন্দে পাকা পেয়ারা খাচ্ছে। অন্যদিন হলে এতক্ষণে বাগানে যাওয়ার জন্য চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত কিন্তু আজ আশ্চর্যজনকভাবে সে চুপচাপ আছে। আসলে মনটা ভারী খারাপ তার। আজ দু'দিন হলো মায়ের কোল ছাড়া সে। সেই যে আজ থেকে চার বছর আগে এক হাড় কাঁপানো শীতের সকালে নার্সিংহোমের কেবিনে ছোট্ট তুলোর বলের মত মিমোকে সিস্টার আন্টি মায়ের কোলে তুলে দিয়েছিলেন আর মিমো ওর গোল গোল কুচো কুচো চোখ দিয়ে মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের মধ্যেও চাঁদের জোৎস্নার মত আলো ছড়ানো হাসি দেখেছিল সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত মিমো কোনওদিন মাকে ছেড়ে থাকেনি। মা বলে সেদিন নাকি মিমো মায়ের ওম নিতে নিতে মাকে দেখে ফিক করে হেসেছিল, যদিও সবাই মায়ের কথা শুনে হাসে, বলে সদ্যোজাত বাচ্চা আবার হাসতে পারে নাকি! কিন্তু মিমো জানে সে নিশ্চয়ই হেসেছিল। এখনও তো মাকে স্কুল থেকে ফিরতে দেখলেই মিমোর ঠোঁটে হাসির জলতরঙ্গ খেলে যায়। চার বছরের ছোট্ট একটি মানুষ কি মাকে ছাড়া থাকতে পারে বলো? কিন্তু উপায় নেই, মিমোর মায়ের পেটের মধ্যে নাকি স্টোন হয়েছে। অপারেশন করে ডাক্তার বাবু সেগুলো বের করবেন। মিমো এখন তো স্কুলে যায়। রীতিমতো শিক্ষিত মানুষ, তাই স্টোন মানে যে পাথর জানে সে, কিন্তু অনেক ভেবেও সে বুঝতে পারেনি মায়ের পেটের মধ্যে পাথর ঢুকলো কী করে! যাই হোক এই দু'দিন কিন্তু সে ভারী ভালো ছেলে হয়ে আছে। যে ছেলের দুরন্তপনায় সারা বাড়ি কাঁপে সে লক্ষ্মী ছেলের মত একজায়গায় বসে থাকছে। ভাত খেতে যার একঘন্টার বেশি সময় লাগে সে পনের-কুড়ি মিনিটে খেয়ে নিচ্ছে। মা যে তাকে বলে গেছে সোনা বেটা হয়ে থাকতে!


“আমার সোনা ভাইটার কি মন খারাপ?”

দিদুনের কথা শুনে মিমোর আরও কান্না পেয়ে গেল। সে দিদুনের কোলে মুখ গুঁজল। রাত্রিবেলা বাবার কাছে ঘুমানোর সময় সে মায়ের বালিশটা কাছে টেনে নেয়। বালিশটার মধ্যে যে তার মায়ের গন্ধ লেগে আছে!
মিমো জন্ম থেকেই এবাড়িতে দিদুন, দাদাই, মাসি বিহু, মা পিহু আর বাবা অর্কর সাথে থাকে। ওদের গ্রামের বাড়িতে ওর ঠাম্মি, দাদু, জেঠু, জেম্মা আর দাদাভাই আছে। ছুটির সময়গুলোতে মিমো সেখানে যায়। ঠাম্মি-দাদুর যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাই শহরের বুকে সারাদিন ছেলে-বৌমার অনুপস্থিতিতে মিমোর মত সুপারম্যানকে সামলানোর চেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকাই শ্রেয় তাঁদের পক্ষে। পিহুর অসুস্থতার কারণে তাঁরা এসেছেন এখানে। 

দিদুন ঠাম্মি-দাদুর ঘরে মিমোকে দিয়ে কাজ সারতে লাগলেন। দাদু গল্প বলছিলেন কিন্তু তাও মিমোর ভালো লাগছে না। মা কী সুন্দর সেই কুকুরছানা আর বিড়ালছানার গল্প বলে! আস্তে আস্তে সূয্যিমামা বাড়ির পথ ধরলেন। বিকেল হয়ে আসছে দেখে দিদুন এসে জিগ্যেস করল, “দিদিভাইদের সাথে খেলতে যাবি?” 
মিমো মাথা নাড়লো। মিমোর মায়ের মাসিবাড়ি এ পাড়াতেই। সেখানে ওর দুই দিদিভাই আছে। রোজ একবার দিদিভাইদের সাথে হুটোপুটি করতে না পারলে তার নাকি ভারী কষ্ট হয়। দিদুন তাকে দিদিভাইদের বাড়িতে দিয়ে এল। আজ পাড়ার মিঠু দিদি আর চিনু দাদাও খেলতে এসেছে। 
খেলাটা ভালোই জমেছিল, এমন সময় এপাড়ার সবচেয়ে বিজ্ঞ মানুষ মিঠু বলল, 
“এই মিমো, তোর মা নাকি নারসিংহোমে গেছে?” 
মিমো কিছু বলার আগেই তার ছোড়দিভাই নিশু বলল, 
“হ্যাঁ তো, ডাক্তারবাবু তো ছুরি দিয়ে পিসিমণির পেটটা কেটে স্টোনগুলো বার করবে। খুব ভারী হবে নিশ্চয় সেগুলো।” 

মিঠু ভারিক্কী চলে মাথা নেড়ে বলল, 
“বুঝলি মিমো, তোর মা এবার মরে যাবে। যারাই নার্সিংহোমে যায় তারাই মরে যায়। আমার ঠাম্মি গেল, মরে গেল। আমার বড়মা গেল, মরে গেল। তোর মাও মরে যাবে। তোর খুব কষ্ট হবে রে। আমি টিভিতে দেখেছি যাদের মা থাকে না তাদের কেউ খেতে দেয় না, মারে, খুব কষ্ট দেয়।”


মিমো আস্তে আস্তে শিব মন্দিরের সামনে চলে এল। মিঠুদিদির কথা শুনে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল কিন্তু সে সবার সামনে একটুও কাঁদেনি। আর খেলতে ইচ্ছে করছিল না বলে চুপচাপ বসে ছিল। তারপর দিদিভাইরা সবাই যখন ফুটবলটা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তখন গেটের ফাঁক দিয়ে টুক করে গলে বেরিয়ে পড়েছে। দিদুন বলে মন দিয়ে ডাকলে ঠাকুর সবার কথা শোনেন, তাই সে তাদের পাড়ায় যে ছোট্ট শিবমন্দিরটা আছে সেখানে চলে এসেছে।

শিবঠাকুরের সাথে একবার দেখা হলে ভালো হতো। শিবঠাকুরের বাড়ি তো সেই একটা বরফ বরফ পাহাড়ে। দিদুন বলেছে কৈলাস পর্বত। মিমো চোখ বন্ধ করে বলল, 
“ঠাকুর আমার মাকে ভালো করে দাও। আমি মাকে ছাড়া থাকতে পারি না। খুব মন খারাপ আমার।” 
মন্দিরের চাতালের একপাশে থামের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মিমো।


“হ্যাললো, ইয়ং বয়। চোখে জল কেন?” 
মিমো চোখ তুলে অবাক হয়ে দেখল লাল জামা, লাল, টুপি, কাঁধে থলি, সাদা দাড়ি, ঘনঘন নাড়ি সান্তা দাদু দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মুচকি মুচকি হাসি নিয়ে দাদু বলল, 
“মনটা খারাপ কেন শুনি?”

“ আমার মায়ের শরীর খারাপ তাই আমি শিবঠাকুরের বাড়ি যাব ভাবছি কিন্তু আমি তো রাস্তাই জানি না।” কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল মিমো।

“ওহ, এই কথা। সে রাস্তার সন্ধান তো আমি জানি।” 
সান্তাদাদুর কথা শুনে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মিমোর।

“ তুমি জানো? নিয়ে যাবে আমায়?”

“ পুরো রাস্তা তো যেতে পারবো না। বয়স কি আমার কম হলো। এত ধকল সইবে না । তবে তোমায় আমি একটু এগিয়ে দিতে পারি। বাকি রাস্তা একলা যেতে পারবে কি তুমি?” 
মাথা নেড়ে জিগ্যেস করল সান্তা দাদু।

“ কেন যেতে পারবো না? আমি পারব।” 
দৃঢ় কণ্ঠে বলল ছোট্ট মিমো।

“ ভয় করবে না?”

“ ভয় কীসের? মা বলে আমি মায়ের বীর পালোয়ান বেটু।” বুক চিতিয়ে বলল মিমো।

“ বাহ, তাহলে তো খুব ভালো। চল তাহলে।” 
এই বলে সান্তা দাদু দিল এক হাঁক, 
“এই যে সিমবু, তিমবু কোথায় গেলি রে গাড়িটা নিয়ে?” 
যেই ডেকেছে অমনি দু'খানা রেনডিয়ার কোত্থেকে হাজির হয়ে গেল একখানা স্লেজ গাড়ি নিয়ে।

“উঠে পড় বীর পালোয়ান।”


ভারী মজা লাগছে মিমোর। স্লেজ গাড়িটা মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে আর হাত দিয়ে মেঘের ছানাগুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে মিমো। কী ঠান্ডা! একদম আইসক্রিমের মত। একটা জায়গায় এসে স্লেজ গাড়িটা মাটিতে নেমে এলো। ভারী অদ্ভুত জায়গা সেটা। চারিদিকে অনেক গাছ কিন্তু তাদের পাতাগুলো রং বেরঙের। একটা বিশাল মোটা গাছের কাছে নিয়ে এলো সান্তাদাদু। সেই গাছের পাতাগুলো আবার সোনালী রঙের আর তার ওপর রুপোলি জলবিন্দু টলটল করছে। সান্তাদাদু মিমোর দিকে তাকিয়ে বলল, 
“বুঝলে বীর পালোয়ান, এটা হলো ইচ্ছেগাছ। ওই দ্যাখ ওর পাতায় পাতায় ইচ্ছেরা জলবিন্দুর মত খেলা করছে।” 
মিমো হাঁ করে দেখতে লাগলো। সান্তা দাদু ইচ্ছে গাছের কাছে গিয়ে বলল, 
“ওহে, গাছ ভাই! এই ছোট্ট ছেলেটাকে শিবঠাকুরের বাড়ির পথটা একটু দেখিয়ে দাও তো। ওর বড় ইচ্ছে শিবঠাকুরের সাথে দেখা করার।” 
যেমনি বলা অমনি গাছের গায়ে একটা দরজা খুলে গেল। 
সান্তা দাদু বলল, “তাহলে মিমো বাবু এবার তুমি ওই পথ ধরে চলে যাও। আমি এবার আসি।” 

সান্তা দাদুর জন্য মনটা একটু খারাপ লাগলেও তাকে থ্যাঙ্কু বলে টা টা করে মিমো সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরে দুষ্টু দুষ্টু চাপ চাপ অন্ধকার। মিমোর ভারী ভয় করতে লাগলো। 
এমন সময় হঠাৎ দেখলো চারিদিকে বিন্দু বিন্দু আলো। আলোগুলো ক্রমশ বাড়তে লাগলো। একঝাঁক জোনাকি এসে মিমোর পুরো রাস্তাটা আলোকিত করে দিল। তার আর একটুও ভয় লাগছে না। জোনাকিরা তার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা ছোট্ট জোনাকি তো তার নাকেই বসে গেল। মিমো এগিয়ে চলল। কিছুটা পথ পার হবার পর আরেকটা দরজা খুলে গেল। সেই দরজা দিয়ে মিমো বাইরে বেরিয়ে এল। 
ওমা! এ যে এক ঘন জঙ্গল। কী বিশাল সব গাছ! লম্বা লম্বা পাতার ঝোপ, তাতে নাম না জানা হলুদ রঙের লম্বাটে ফুল। বাতাসে একটা মৃদু গুঞ্জন। জঙ্গলটা যেন কথা বলছে ফিসফিস করে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একটু একটু সূর্যের আলো লাফ দিচ্ছে। মিমো আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে চলল। 
সরু একখানা পথ চলে গিয়েছে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। কাঁটা গাছে লেগে মিমোর জামাটা ছিঁড়ে গেল। তার গায়েও কাঁটা ফুটে রক্ত বেরোচ্ছে। দু'চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে মিমোর, এমন সময়
“হালুম!” 
তার সামনে একটা বাঘ! জুলজুল করে তাকে দেখছে। বাঘমামা এক্ষুনি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন বোধহয়! ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে, কিন্তু হঠাৎ শূন্যে উঠে বাতাস কেটে এগিয়ে যেতে লাগলো মিমো।

“ও ছেলে চোখটা খোলো! বাঘের বাচ্চা দেখে কেউ এমন করে ভিরমি খায়!” 
মিমো চোখ খুলে উঠে বসে দেখে সে একটা গাছবাড়ির বারান্দায় শুয়ে রয়েছে। তার সামনে একটা অদ্ভুত মানুষ। লম্বা লম্বা চুল, খালি গা, নিচে খালি গাছের পাতা দিয়ে তৈরি গামছার মত একটা জিনিস পরে আছে। লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে মিমোর, 
"টারজান!" 
চেঁচিয়ে উঠলো মিমো।

“ও বাবা, তুমি তো দেখছি আমার নামও জানো! তুমি কে গো? এই জঙ্গলে এত ছোটো ছেলে কী করছো?” 
কোমরে হাত দিয়ে টারজান শুধোলো মিমোকে।

“আমি মিমো। শিব ঠাকুরের বাড়ি যাব।”

“ও, নির্ঘাৎ তোমার মায়ের শরীর খারাপ, তাই না?”

“ তুমি বুঝলে কী করে?” অবাক হয় মিমো।

“ তোমার দুঃখী দুঃখী মুখটা দেখে।”

“ তুমি কি শিব ঠাকুরের বাড়ির রাস্তাটা বলে দেবে আমাকে?”

“ অবশ্যই। আমি তোমাকে জঙ্গলটাও পার করে দেব।”

“ থ্যাঙ্কু বন্ধু।” মিষ্টি হেসে বলল মিমো।


টারজানের পিঠে চড়ে গাছের ঝুরিতে, বুনো লতায় দোল খেতে খেতে যেতে ভারী মজা লাগছিল মিমোর। একসময় তারা জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এল। মিমো দেখে পায়ের তলায় শুধু বালি আর সামনে নীল সমুদ্র। বালির ওপর লাল লাল ছোট্ট ছোট্ট কাঁকড়া ছুটে বেড়াচ্ছে।

“ বন্ধু টা টা। আমি এবার আসি, আজ আবার হনুমানদের সাথে আমার কলা খাওয়ার কম্পিটিশন আছে।”
এই বলে টারজান সুড়ুৎ করে জঙ্গলে ঢুকে গেল। 

মিমো পড়লো ভারী মুশকিলে। টারজান বলেছে এই সমুদ্র পার হতে হবে তাকে, কিন্তু সে তো সুইমিং ক্লাসে ভর্তিই হয়নি এখনও। কী করে পার হবে সে?

“এই ছেলেটা তাড়াতাড়ি এসো।” মিমো ঘাড় ফিরিয়ে অবাক। এ যে একটা জিনি দাঁড়িয়ে!

“এই ছেলেটা তাড়াতাড়ি ওঠো আমার পিঠে। দিব্বি আরাম করে চিকেন চাঁপ আর বিরিয়ানি খাচ্ছিলাম। আলাদিন গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে পাঠিয়ে দিল। তুমি নাকি ভারী মুশকিলে পড়েছ?” গজগজ করতে করতে বলল জিনি।

“হ্যাঁ তো। আমার মায়ের শরীর খারাপ তাই শিব ঠাকুরের বাড়ি যেতে হবে আমাকে।” 
মিমো বলল।

জিনি একটু নরম হয়ে বলল, 
“ও তাহলে তো তোমার ভারী কষ্ট। চলো তোমাকে সবুজ দ্বীপের নীল পাহাড়ের নীচে পৌঁছে দিই।”

জিনির পিঠে চেপে মহানন্দে নিমেষের মধ্যে সমুদ্র পার হয়ে নীল পাহাড়ের নীচে পৌঁছে গেল মিমো।

“এবার তুমি নিজে পাহাড়ে ওঠো বাপু। আমি আর পারবো না। ভারী দুর্বল হয়ে গেছি। আমার খাবারগুলো আবার অন্য কেউ খেয়ে নিল নাকি কে জানে! চললুম আমি।” 
জিনি চলে গেল। 

পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট ধাপ। মিমো উঠতে লাগলো। পাহাড়ের মাথায় রামধনুর কাছে পৌঁছতে হবে তাকে। কিছুটা ওঠার পর পায়ে ভীষণ ব্যথা করতে লাগলো মিমোর। পা-টা কেটেও গেছে অনেকটা। খুব কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু তাকে তো পৌঁছতেই হবে ওপরে। মায়ের মুখটা মনে আসতেই সে ঠিক করল যত কষ্টই হোক সে উঠবেই।

“হাই, মিমো কোথায় যাবে তুমি?” মিমো চমকে তাকিয়ে দেখে একটা ফানুসের মধ্যে টম আর জেরি। তার প্রিয় দুজনকে দেখেই মিমোর মুখে হাসির ঢেউ খেলে যায়।

“আমি পাহাড়ের ওপরে উঠব।” উত্তর দেয় সে।

“তাহলে চলে এস আমাদের সাথে। নামিয়ে দেব তোমাকে।” তারা বলে। 

মিমো তো মহা খুশি। টম আর জেরির সাথে গল্প করতে করতে চলল মিমো। সবসময় খুনসুটি করলেও আসলে ওরা ভারী বন্ধু ।

টম আর জেরি পাহাড়ের মাথায় মিমোকে নামিয়ে টা টা করে চলে গেল।


মিমো মুগ্ধ হয়ে দেখছে সাত রঙা রামধনুর পথটাকে। সূর্যের আলোয় সে পথ যেন স্বপ্ন স্বপ্ন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

“এই ছেলেটা! হাঁ করে দেখলেই হবে? যেতে হবে না বুঝি?” 
পা পর্যন্ত ঝুলের ফ্রিল দেওয়া সাদা জামা পরা একটা মেয়ে ধমকে উঠলো মিমোকে। মিমোর বড়দিভাইয়ের মত বয়স হবে মেয়েটার।

“তুমি কে গো?” জিগ্যেস করে মিমো।

“আমি তো স্বপ্ন। আমাকে তুমি স্বপ্নদিদি বলে ডেকো। তোমাকে কৈলাসের দরজায় পৌঁছে দেব বলে আমাকে আসতে হলো, নইলে আমার মেলা কাজ। যাই হোক চল তাড়াতাড়ি।” 

 স্বপ্ন দিদি ভারী সুন্দর লাল টুকটুকে একখানা ট্রাই সাইকেল এনেছে মিমোর জন্য আর নিজে টিয়া দিদির মত ফুল ফুল ছাপ বাস্কেট লাগানো একখান সাইকেলে বসে আছে। রামধনুর সেই লাল, নীল, সবুজ….পথ বেয়ে স্বপ্ন দিদির সঙ্গে চলল মিমো।

“এই যে এসে গেছি আমরা। এইখান থেকে কৈলাস শুরু। ওই মালতীলতার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যাও তুমি।” 
এই বলে স্বপ্নদিদি মিমোকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে মস্ত একটা চকাই হামি দিয়ে চলে গেল। 

ভেতরে ঢুকতেই একটা নীল প্রজাপতি তিরতির করে পাখা নাড়িয়ে জিগ্যেস করল, 
“এই ছেলেটা, লাল জামাটা কি চাই রে তোর?” মিমো বলল, 
“আমি শিব ঠাকুরের বাড়ি যাব।”

“ ও এই কথা। ওইদিকে গণেশদাদা বসে আছে। দেখা কর গিয়ে।” 
ডানা মেলে উড়ে গিয়ে একটা ফুলের ওপর বসল প্রজাপতিটা। 

জায়গাটা একটা বাগান। কত রঙের নাম না জানা ফুল ফুটে আছে, পাখিরা গান গাইছে, প্রজাপতিরা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে, পরী বসানো ফোয়ারায় রঙিন জল ছুটছে। মিমো সব দেখতে লাগলো ঘুরে ঘুরে। ভারী ভালো লাগছে তার। এমন সময় দেখে একটা কদম গাছে মস্ত একটা দোলনা ঝুলছে আর তাতে বিশাল একটা লাড্ডুর থালা নিয়ে গণেশ বসে আছে। মিমো পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।

“ গণেশ দাদা, ও গণেশ দাদা।” আস্তে করে ডাকলো মিমো।

“ হুঁ, কে রে তুই? এখানে কী করছিস? আর হাঁ করে আমাকে দেখছিস কেন? লাড্ডু খাবি? খিদে পেয়েছে?” 
মুখ ভর্তি লাড্ডু নিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল গণেশ।

“ না, আমি নুডলস খেয়ে এসেছি।”

“ সেটা আবার কী রে? কেমন খেতে? ভালোই হবে নিশ্চয়ই তুই খেয়েছিস যখন। তা তুই এখানে কী করছিস বললি না তো?”

মিমো ছলছল চোখে তার আসার উদ্দেশ্য বলল। 

শুনে গণেশ গম্ভীর হয়ে বলল, 
“হুম, মায়ের শরীর খারাপ মানে তো খুব সিরিয়াস ব্যাপার। আমার মা তো ঠাকুর, তাই আমার মায়ের শরীর খারাপ হয় না, কিন্তু তাও আমি জানি রে মায়ের শরীর খারাপ হলে খুব কষ্ট হয়। আমি দুষ্টুমি করলে মা যখন আমার সাথে কথা বলে না আমার ভীষণ কান্না পায় তখন। তুই তো দু'দিন মাকে ছেড়ে আছিস! দাঁড়া তোকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমি লাড্ডুগুলো শেষ করে যাবো।” 

এই বলে গণেশ দিল এক হাঁক, 
“মুষকু, কোথায় গেলি রে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয় দিকিনি। লাড্ডু দিইনি বলে আবার অভিমান হলো নাকি তোর? তোর ভালোর জন্যই তো দিইনি। দিন দিন তোর ভুঁড়িটা কি রকম বাড়ছে দেখেছিস? এখন থেকে একটু খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করা উচিত তোর।”

“আমার ভুঁড়ি বাড়ছে আর তোমার বুঝি কমছে? কী বলছ বলো?” 
গজগজ করতে করতে একটা মস্ত বড় ইঁদুর বেরিয়ে এল পাতাবাহারের ঝাড় থেকে।

“তুই যে থালা থেকে দুটো লাড্ডু নিয়ে গিয়ে ওখানে চুপিচুপি পেটে চালান করলি আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছিস? যাই হোক লাড্ডু চুরির ব্যাপারটা পরে ফয়সালা করব তোর সাথে, এখন একে বাড়িতে দিয়ে আয়। পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যা, বাচ্চা মানুষ পায়ে ব্যথা করবে নাহলে।”

“ লাড্ডু দেওয়ার বেলায় নেই, যতসব কাজের অর্ডার! কই গো ছেলে ওঠো আমার পিঠে।”

মিমোকে পিঠে নিয়ে হেলেদুলে চলল মুষকু।


“মা, কাতু আমার হাঁসের গায়ে বাঁদুরে রং দিয়ে কী করেছে দ্যাখো!”

“মা, কাতু আমার লক্ষ্মীর ঝাঁপি উল্টে কী অবস্থা করেছে দেখে যাও তুমি!”

“কাতু, তুই কি একদণ্ড তিষ্ঠোতে দিবি না আমাকে?” 
একটা রুটি বেলার বেলন নিয়ে মা দুর্গা কার্তিকের পেছনে ছুটে চলেছেন কিন্তু ছেলের গতির সাথে কবে আর মায়েরা পাল্লা দিতে পেরেছে? দুর্গা হাঁফিয়ে উঠেছেন, এমন সময় একটা থামের গায়ে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়লো কার্তিক।

“ মা, মা।” করে কেঁদে উঠলো সে। হাঁটুতে বেজায় লেগেছে তার। 
বেলন ফেলে ছুটে গেলেন দুর্গা। ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমো দিয়ে ভোলাতে লাগলেন। মিমোর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তার মা-ও তো এমনি করে। সে দুষ্টুমি করলে তাকে মেরে নিজেই কাঁদতে থাকে। তাকে কোলে তুলে কত্ত আদর করে। মা যদি না থাকে তাহলে কে তাকে...। ফুঁপিয়ে উঠলো মিমো।

“ কে কে ওখানে?” 
মা দুর্গার চোখ পড়েছে মিমোর দিকে। মিমো কেঁদেই চলেছে। কিচ্ছুটি বলতে পারছে না। কার্তিককে নামিয়ে দুর্গা এগিয়ে এলেন মিমোর কাছে।

“মা, ও হলো মিমো।” লাড্ডু শেষ করে গণেশ এসে হাজির।

“তুই আবার লাড্ডু খেয়েছিস গনু? মিছে কথা বলবি না, তোর মুখে গুঁড়ো লেগে আছে।” 
দুর্গা গম্ভীর হয়ে বললেন।

“মা, লাড্ডুর কথা ছাড়ো না। ওর কথা শোনো। ওর খুব দুঃখ।” গণেশ আদুরে গলায় বলল।

“ ওমা, এই টুকুস ছেলের আবার কীসের দুঃখ!” অবাক হন দুর্গা। 

গণেশ বেশ গুছিয়ে মিমোর দুঃখের কারণ জানায় তার মাকে। বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করে সে, মিমোকে নিয়ে মা ব্যস্ত হয়ে গেলে তার লুকিয়ে লুকিয়ে লাড্ডু খাওয়ার ব্যাপারটা চাপা পড়ে যাবে।

“তুমি যখন এখানে এসে গেছ আর চিন্তা নেই তোমার। আমি তোমাকে মহাদেবের কাছে নিয়ে যাবো।” 
মিমোকে আদর করে চোখ মুছিয়ে বললেন দুর্গা। এতক্ষণে মিমোর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

সে দুর্গাকে বলল, 
“আচ্ছা, টিভিতে দেখেছি কৈলাসে শুধুই বরফ কিন্তু এখানে তো একটুও বরফ নেই।” 

দুর্গা হেসে বললেন, 
“আগে তো ছিল বরফ, কিন্তু ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি জুড়লো যে সারাবছর শুধু বরফ ভালো লাগে না। পৃথিবীতে কী সুন্দর ছটা ঋতু! আমাদেরও ওরকম চাই, তাই এখন এখানেও ছয়টা ঋতু।”

“আর তোমার শুধু দুটো হাত কেন?” মিমোর প্রশ্ন।

“বাকি হাতগুলো খুলে রেখেছি। দশটা হাত নিয়ে সব সময় ঘোরা যায় নাকি? ওই পুজোর সময় আবার পরে নেব।”

“মা, বলছি কি এবার পুজোয় মামাবাড়ি গিয়ে নুডলস খাবো কিন্তু। মিমো নুডলস খেয়ে এসেছে।” 
গণেশ মায়ের কাছে আবদার করল।

“ খাওয়া ছাড়া তোর কি আর কোনও চিন্তা নেই গনু? দ্যাখ দিকি ছেলেটা মায়ের জন্য কত দূর থেকে ছুটে এসেছে।” দুর্গা ধমকে উঠলেন।

“ আমিও তো তোমাকে কতো ভালোবাসি।” 
ঠোঁট ফুলিয়ে বলল গণেশ।

ফিক করে হেসে ফেললেন দুর্গা, 
“জানি রে জানি!”



“শুনছ, বলি শুনছ!” 
দুর্গার ডাকে ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলেন মহাদেব, 
“কী, কী হয়েছে?” 
মহাদেবের গলার সাপটাও মস্ত বড় এক হাই তুললো।

“এই ছোট্ট ছেলেটা অনেক দূর থেকে এসেছে। ভারী বিপদ ওর।”

ভ্রূ কুঁচকে মিমোকে দেখে মহাদেব বললেন, 
“কী বিপদ হয়েছে তোমার?”

“আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ। ঠাকুর তুমি আমার মাকে ভালো করে দাও।” 
কান্না কান্না গলায় বলল মিমো।

“এই এই, কান্নাকাটি একদম নয়! বাচ্চাদের কাঁদতে দেখলে আমারও কান্না পেয়ে যায়। দুর্গা ওকে কাঁদতে নিষেধ করো।”

“তুমি ওর মাকে ভালো করে দাও তাহলেই ও আর কাঁদবে না। সোজাসাপ্টা ব্যাপার।” 
মুচকি হেসে বললেন দুর্গা।

“হুম, কথাটা বলেছ ভালোই। ওর মাকে সুস্থ করে দিলেই ওর কান্নাকাটি বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক আছে পুঁচকে ছেলে, তোমার মাকে আমি ভালো করে দিলুম।” 
আড়মোড়া ভেঙ্গে বললেন শিব ঠাকুর।

মিমোর মুখে ভুবন আলো করা হাসি, “সত্যি বলছ ঠাকুর?”

“এই, আমি হলুম গিয়ে মহাদেব। সত্যি কথা ছাড়া বলি না আমি।” 
চোখ পাকিয়ে বললেন মহাদেব।

“থ্যাঙ্কু, ঠাকুর।” মিষ্টি হেসে বলল মিমো।

“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মিমো!” 
বেশ কায়দা করে বললেন মহাদেব।

“ আচ্ছা, মা ও তো অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছে। অমনি করেই কি ফিরে যাবে?” 
চিন্তিত মুখে বলল গণেশ।

“ তা কেন? আমি ম্যাজিক করে ওকে এক্ষুনি বাড়ি পৌঁছে দেব।” 
মিমোর চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বললেন মা দুর্গা।

“মিমো তুমি আমার হাতটা ধরো।” মা দুর্গা মিমোর হাতটা ধরলেন।

******************

“মা, মিমো মাসিমণিদের বাড়িতে নেই। আশেপাশেও নেই।” 
প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকে উত্তেজিতভাবে বলল বিহু। কলেজ থেকে ফিরে মিমোকে আনতে গিয়েছিল সে।

“কী বলছিস তুই!” আঁতকে উঠলেন বিভাদেবী।

“ওরা সবাই খেলছিল। মিমোর মন খারাপ বলে ও বসে ছিল চুপচাপ। খেলতে খেলতে ওরা কেউ খেয়াল করেনি মিমো কখন ওখান থেকে বেরিয়ে গেছে। মেসোর একজন সহকর্মী এসেছেন বলে মাসিমণিরা সবাই বাড়ির ভেতরে ছিল। সবাই মিমোকে খুঁজছে। আমি তোমাকে বলতে এলাম। মা, বাবা ফিরেছে অফিস থেকে? নাকি ফোন করব?” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল বিহু।

“আমি কিছু ভাবতে পারছি না। তোর দিদিকে নার্সিংহোম থেকে রিলিজ করে দিয়েছে। অর্ক ফোন করে বলল একটু পরেই ফিরে আসবে ওরা। পিহুর কাছে দাঁড়াবো কী করে আমি! কী ভাববে মেয়েটা! যাওয়ার সময় ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কত কেঁদেছিল। কোথায় গেল যে ছেলেটা!” 
কাঁদতে কাঁদতে বললেন বিভাদেবী।

***************

“শুনছ, শিবমন্দিরের সামনে গাড়িটা একটু দাঁড় করাবে।” ক্লান্ত গলায় বলে পিহু।

“এখন এই অবস্থায় কেন? সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবার পর পুজো দিয়ে যেও।”

“ না গো, একবার নামতেই হবে। যাওয়ার সময় আমি বলে গিয়েছিলাম বাড়ি ঢোকার আগে মন্দিরে প্রণাম করে তবে বাড়ি যাবো। প্লিজ একটু থামাও।” 

পিহুর কাতর অনুরোধে অর্ক গাড়ি দাঁড় করিয়ে আস্তে আস্তে পিহুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মন্দির চত্বরে ঢোকে। 
ঠাকুর প্রণাম সেরে ফিরতে যাবে এমন সময় পিহুর চোখ পড়ে বামদিকে, 
“বেটু! তুই এখানে এভাবে শুয়ে আছিস কেন!” ততক্ষণে অর্কও চোখ চলে গিয়েছে মিমোর দিকে।

“বেটা, তুই এখানে কী করছিস?” 

অর্ক এগিয়ে যায় মিমোর দিকে। মিমো চোখ মেলে দেখে সে কৈলাস থেকে আবার মন্দিরে পৌঁছে গেছে, শুধু তাই নয় শিবঠাকুর তাঁর কথা রেখেছেন তার মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“মা!” বলে ছুটে যায় সে।

“আস্তে মিমো, মায়ের পেটে ব্যথা আছে।”

অর্ক সাবধান করে কিন্তু ততক্ষণে মন্দির প্রাঙ্গণে চিরন্তন এক ছবির ফ্রেম তৈরি হয়েছে।



সবাই অনেক বকাবকি করল তাকে, না বলে বেরিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু মিমোর কোনও ভাবান্তর নেই। সে শুধু অপেক্ষা করে আছে কখন রাত্রি হবে আর মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে সে মাকে তার কৈলাস অভিযানের গল্প বলবে।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু


1 comment:

  1. কি মিষ্টি গল্প আর দিদির আঁকাটাও কি দারুণ 😊

    ReplyDelete