গল্পের ঝুলি : পাপাইয়ের দাদু : দেবপ্রিয়া দাস


॥১॥

তোমরা দাদুকে দেখেছ গো, আমার দাদু, ক'দিন হল বাড়িতে ফেরেনি। তোমরা জানো দাদু কোথায়? বলো না, দাদুকে ছেড়ে আমি যে একদম থাকতে পারি না। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দাদুর সাথে আছি। সেই দাদু কোথায় চলে গেল আমায় ফেলে?

দাদু জানো, বিষ্টুদা আমায় কাল ডেটলের ভয় দেখাচ্ছিল। সেই যেবার রাস্তার ধারে পড়ে থাকা টিনটায় আমার গায়ে কতখানি কেটে গেল, তুমি ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে, সেই থেকেই আমার ডেটলে কি ভয়! বড্ড জ্বালা করত যে।

তোমার মতো যত্ন করে তো কেউ রাখে না আমায়। গত সপ্তাহে বিষ্টুদা আবার আমায় লাথি মেরে সিঁড়ি থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিল । তুমি নেই বলেই ও আমায় এত শাস্তি দিচ্ছে। তুমি ফিরে এসো দাদু, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

রাতে তোমার কম্বলের মধ্যে তোমার পায়ের কাছে এই সেদিনও শুয়েছি, কী যে আরাম হত! কিন্তু এই শীতের রাতে ওরা তো আমায় একটা চটের বস্তা অব্দি দেয় না। বাইরের গেটে একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে সারাদিন। যদি চলেই গেলে আমায় কেন তোমার সাথে নিয়ে গেলে না দাদু?

কতখানি খিদে আমার পেটে জমা থাকতে পারে তুমি থাকতে জানতেই পারিনি। রোজ চারবেলা মাছটা, মাংসটা ভাতে মেখে নিজের হাতে ডেকে খাওয়াতে, বাটি ভরে দুধ-জল কোনো অভাব রাখোনি। আজ দেখো আমায় খেতে দেওয়ার কথা কারোর মনেও থাকে না। তোমার ঘরের সুখের বাসা ছেড়ে আমার কোথায় ঠাঁই হয়েছে জানো, দারোয়ানদাদার ঘরের পাশের এই লোহালক্কড়ের গুদোমে। কালকে তোমার ঘর থেকে আমায় টানতে টানতে বের করে এনে এখানে রেখে গেছে হারুদাদা।

আজ শুনছি বাড়ি ভর্তি লোক আসবে, কী নাকি একটা সভা আছে। কাজের মধ্যে হুড়োহুড়িতে বিষ্টুদা ভুলেই গেছে বোধ হয় আমায় বাঁধতে। দাদুর ঘরে একবার এই সুযোগে ঘুরে আসি।



॥২॥


নিখিলেশবাবু লোকটি ছিলেন আদ্যোপান্ত পশুপ্রেমী। অবিবাহিত, অধ্যাপক মানুষটির বাড়ির লোক বলতে বিষ্টু আর হারু। বিষ্টু চব্বিশঘন্টা তাঁর যাবতীয় ফাইফরমাস সামলানো আর হারু বাগানের মালী আর দারোয়ানির কাজটা করে। তাঁর বাড়ির একতলার একটা ঘরে মাঝেমধ্যেই নিত্যনতুন অতিথির আনাগোনা লেগেই থাকত। কখনও রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পা ভাঙা বেড়াল, কখনও বা ডানাভাঙা বাজপাখি, কখনও আবার গাছের ডাল থেকে পড়ে আঘাত পাওয়া ছোট্ট ছানা বাঁদর, কাউকে না কাউকে পাওয়াই যেত ওঁর ঐ ঘরখানায়। শুশ্রূষা করে ঠিক সারিয়ে তুলতেন ওদের। ফিরিয়ে দিতেন প্রকৃতির কোলে।

একবার ওঁর পাশের বাড়ির বাগানে আমগাছের মগডালে লাফালাফি করতে গিয়ে একটা বাঁদরছানা পা পিছলে মাটিতে পড়ে। সারাদিন তার মা আর দলবল সেই বাগানে একদম হুলুস্থুল কাণ্ড জুড়েছিল। কেউ সাহস করে সেদিকে পা পর্যন্ত বাড়াতে পারেনি। কলেজ থেকে ফিরে বিষ্টুর মুখে সেই কথা শুনে নিখিলেশবাবু একখানা লাঠি হাতে বাগানে গিয়ে ছানাটাকে তুলে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন। গোটা একটা সপ্তাহ লেগেছিল সেটাকে চাঙ্গা করে তুলতে। মা বাঁদরটা নাকি নিখিলেশবাবুর বাড়ির ছাদে সেই এক সপ্তাহ ঘাঁটি গেড়েছিল। তারপর ছানাকে সুস্থ ফিরে পেয়ে তার কী আনন্দ! নিখিলেশবাবুর পায়ের কাছে চারটে পাকা আমড়া রেখে তখনকার মতো বিদায় নেয় সেই মা আর ছানা। তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই দেখা যেত ওদের দুটোকে নিখিলেশবাবুর বাড়ির ছাদে, বাগানে। কী একটা অদৃশ্য বন্ধন যেন ওদের টানত নিখিলেশবাবুর প্রতি। উনিও ওদের দেখলে এটা ওটা দিতেন খাওয়ার জন্য, ছানাটাকে নিয়ে খেলা করতেন।

এহেন মানুষটা পাপাইকে নিয়ে আসার পর অন্য কোনো জীবজন্তুকেই আর বাড়িতে আনেননি। যতক্ষণ থাকতেন পাপাইকে নিয়েই মেতে থাকতেন। তাকে চান করানো, খাওয়ানো, দুবেলা নিয়ে বেড়ানো, তার সঙ্গে খেলা করা, একসাথে শোওয়া সবটুকু করতেন নিজে হাতে।

এক শীতের রাতে হঠাৎ করেই শ্বাসের কষ্ট শুরু হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে, আর সেখানেই সব শেষ। তিনি গত হয়েছেন তেরোদিন হয়ে গেল। আজ তাঁর উদ্দেশে একটি শোকসভার আয়োজন করেছেন তাঁর কলেজের সহকর্মীরা। বিষ্টু আর হারুকে তাঁরাই সমস্ত নির্দেশ দিয়ে বাড়ি গোছগাছ থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়ন সব দায়িত্বও দিয়ে রেখেছেন।

লোকজন প্রায় এসেই পড়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সভা শুরু হবে। বাবুর ঘরে হঠাৎ পাপাইকে দেখে বিষ্টুর মনে পড়ল আজ ওকে বাঁধতে ভুলে গেছে। কখন আবার ঘরদোর নোংরা করে দেয়, ব্যাটা আবার দেওয়াল আলমারির দরজায় আঁচড় কাটছে! কী করে যেন একটা পাল্লা খুলেও ফেলেছে। 'হেই হেই' করে বিষ্টু তাড়া লাগাল পাপাইকে। কী যেন একটা মুখে নিয়ে পাপাই ছুট লাগাল মনে হল না? যাকগে, বিষ্টুর এখন অনেক কাজ। পরে ওসব দেখা যাবে'খন। ব্যাটা আজ ছাড়াই থাক। এত্ত বছর এবাড়িতে আছে, কোনোদিন কাউকে একটা আঁচড় পর্যন্ত কাটেনি। সেদিক দিয়ে ব্যাটাকে ভালই বলতে হবে।



॥৩॥


ছাইরঙা একটা হাতমোজা মুখ থেকে নামিয়ে রাখল পাপাই গোডাউনের মেঝেতে। বেশ কিছুক্ষণ ওটায় নাক লাগিয়ে শুঁকল। এটা ওর দাদুর জিনিস। এখনো এটাতে যেন দাদুর গন্ধ লেগে আছে। ওর চোখের কোণা বেয়ে কি এক-দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল? কে জানে, হবে হয়তো।

বেশ কয়েক বছর আগে শীতের এক সন্ধ্যায়, বাড়ির সামনের সরু গলিটায় দাঁড়ানো একটা বাইকের পিছনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা দিনকয়েকের ছানাটাকে দেখে সেটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন নিখিলেশ সান্যাল। তারপর থেকে পাপাইয়ের ঠিকানা এই বাড়িটাই। দাদুকে ছেড়ে গোটা একটা দিনও থাকেনি সে। আর আজ, এত্তোগুলো দিন চলে গেল, কই দাদু তো ফিরে এলো না!

এইমাত্র পাপাই দেখে এসেছে, সাদা চাদর মোড়ানো দাদুর বসার চেয়ারে রাখা দাদুর ছবিখানাতে সাদা মালা পরানো। সেই থেকেই ওর মনে যেন কেমন একটা ভয় ভয় কষ্ট হচ্ছে।

গোডাউন থেকে বেরিয়ে গেট দিয়ে সোজা বেরিয়ে এল পাপাই। বাড়ির সামনেই যে ঝাঁকড়া কদমগাছটা, তার তলায় এসে বসল। এইখানেই সেদিন নীল আলো লাগানো সাদা বড় গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছিল। দুজন লোক একটা সরু, লম্বাটে বিছানায় শুইয়ে দাদুকে ঘর থেকে বের করে এনে তাতে তুলে দিতে ভোঁ বাজিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গাড়িটা।

বাড়ির ভিতরের স্মরণসভায় যখন অতগুলো লোক নিখিলেশবাবুর সারা জীবন করে আসা ভালো কাজগুলোর স্মৃতি মনে করে তাঁর অাত্মার শান্তি কামনা করছে, তখন বাইরে গাছতলায় তাঁর সাদাকালো ছোপছোপ চারপেয়ে পোষ্যটা বসে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে, তাঁর বাড়ি ফেরার আশায়॥



॥৪॥


তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। নিখিলেশবাবুর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর বাড়িখানা এখন লাইব্রেরী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিষ্টু, হরি সেই লাইব্রেরী দেখাশোনা করে। পাপাইও আছে। ওর প্রতি ওদের দুজনেরও এখন বেশ মায়া পড়ে গেছে। ছোটো থেকেই পাপাই দেখত দুটো বাঁদর এসে ওদের বাড়ির ছাদে বারান্দায় বসে আছে। দাদু ওদেরকে ডেকে ডেকে খেতে দেয়। ছোট বাঁদরটা দাদুর কোলে, পিঠে চড়ে দাদুর সাথে খেলে। পাপাই ভাবত দাদুর সাথে ও ছাড়াও আরও একজন আছে তবে খেলা করার! তারপর একদিন দাদুর সাথে ওই দুই বাঁদর বন্ধুর একটা ছবি পাপাই-এর চোখে পড়ে। ছোট্ট ছানাবাঁদরটি দাদুর কোলে, তার একটা পায়ে সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ। পাপাই তার নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছিল দাদুর সাথে ওদের সম্পর্কটা।

দাদু চলে যাবার পরেও ওরা দুজনে এসেছিল একদিন। দুপুর বেলা ছাদে ঘুরে বিকেলে নেমেছিল বারান্দায় দাদুর দোলনাটার কাছে। এতক্ষণেও একবারও দাদুকে দেখতে না পেয়ে নিজেদের মধ্যে কিচকিচ মিচমিচ করে কী যেন বলাবলি করছিল। পাপাই ওদের দিকে তাকিয়ে যখন বসার ঘরের দিকে হাঁটা দিল, ওর পিছন পিছন গিয়েছিল ওরা দুজনে। দেওয়ালে টাঙানো ফুলের মালা পরানো দাদুর ছবির দিকে কেমন যেন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়েছিল মা'টা; আর তার ছানাটা ছুট্টে গিয়ে বারান্দায় কেমন যেন ছটফট করতে শুরু করল। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ডিগবাজি খেয়ে নিজের মাথায় চাপড় মারতে লাগল। পাপাই দেখেছিল ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।



॥৫॥


পাপাই মাঝেমধ্যে বাগানের ডালপালা মেলা আমগাছটার নিচে গিয়ে বসে, উপরে তাকিয়ে দেখে ওর দুই বাঁদর বন্ধু এসেছে কিনা। আজও এসেছে, ওর মনে হচ্ছে আজ ওর সেই দুই বন্ধু আসবে। তাই পাপাই দাদুর হাতমোজাটা নিয়ে এসেছে, ওটা থেকে তারা একসাথে শুষে নেবে দাদুর গন্ধ, বুকে আগলে রাখবে দাদুর সাথে কাটানো ওদের পুরোনো সময়গুলোকে।

সেই কোন সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । থামার কোনো লক্ষণই নেই। সাথে দুমদাম কড়াক্কড় বাজ আর বিদ্যুতের চোখরাঙানি। পাপাই এরকম বৃষ্টির দিনে ভয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়ত। যেকোনো আওয়াজেই বড্ড ভয় ওর। আর দাদু তখন ওকে খাটের তলা থেকে বের করে নিজের কোলে নিয়ে বসত। হাত বুলিয়ে দিত মাথায়, গায়ে। আজও ও ভয় পাচ্ছে, খুব খুব ভয় পাচ্ছে, তাই বাকি বন্ধুদের চাইছে ওর পাশে। ওর ভিতর থেকে একটা দমবন্ধ করা কষ্টের আওয়াজ বেরিয়ে আসতে চাইছে। দুটো কান ভয়ে মাথার সাথে লেপ্টে গেছে, লেজটা গুটিয়ে পা-দুটোর মধ্যে গিয়ে সেঁধিয়েছে। ওরা কখন আসবে, ওরা আসবে তো? বৃষ্টিটা একটু যেন কমল। ওই তো, কিচমিচ আওয়াজ করে কারা যেন আসছে, ওই তো সেই মা আর ছানা! ওরা তিনজনে একটা গাছের তলায় হাতমোজাখানা ঘিরে বসল। পাপাই ওদের ভাষা বোঝে না, ওরাও বোঝে না পাপাই কী বলতে চায়। শুধু হাতমোজাখানাই যেন ওদের যোগাযোগের সেতু। হঠাৎ খুব জোর কোথাও একটা বাজ পড়ল, সাথে ভীষণ আলোর ঝলকানি।



॥৬॥


দাদু তুমি এসেছ? এই মাত্র আমরা তোমার কথাই বলছিলাম। তোমার হাতে পরার মোজাটা নিয়েছি, আমায় বকবে না তো? তোমায় কী সুন্দর দেখাচ্ছে এই সাদা ধপধপে জামাটা পরে! আর কিন্তু তোমায় আমরা ছাড়ব না। এখন থেকে আমরা আবার একসাথেই থাকব তো দাদু? দেখেছ দাদু, তুমিও এলে, আর বৃষ্টিটাও থেমে গেল। অত জোরে বাজ পড়ছিল, আমাদের খুব ভয় করছিল জানো! এক্ষুনি কত্ত আলো বেরিয়ে চারপাশ কী সুন্দর ঝকমকে হয়ে গেছে! খুব আনন্দ হচ্ছে দাদু, আমাদের খুব ভাল লাগছে। দাদু আমাদের ওই সুন্দর বাগানটায় নিয়ে চলো না, চলো না আমরা ওই রংবেরং সাঁকোটা পেরিয়ে চলে যাই।


বৃষ্টি থেমেছে। বাগানটায় যেন প্রলয় ঘটে গেছে। বিষ্টু আর হরি দেখেছিল খুব জোরে বাজ পড়েছিল একটা গাছের ওপর। ওরা সেখানে গিয়ে দেখল পাপাই সেই গাছের তলায় পড়ে আছে, আর তার পাশে পড়ে আছে মা আর ছানা বাঁদরটা। বাজ পড়ে ওদের তিনটে প্রাণকেই শেষ করে দিয়েছে। আর ওদের মাঝখানে জলকাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে নিখিলেশবাবুর হাতমোজাখানা॥

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস

2 comments:

  1. খুব সুন্দর। এভাবে মনুষ্যতর জীবেদের জবানি তে লেখা গল্পটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। শেষটা পড়ে একটু খারাপ লাগলেও মনে হল শেষ অব্দি কোথাও না কোথাও পুনর্মিলন তো হল.
    .

    ReplyDelete
  2. কি অসাধারণ। মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete