অনুবাদ সাহিত্য : জিম করবেট (The Law of Jungles) : অর্পণ শেঠ





এডওয়ার্ড জেমস করবেট বা জিম করবেটের জন্ম ১৮৭৫ সালের ২৫শে জুলাই, বর্তমান উত্তরাখণ্ড রাজ্যের নৈনিতাল শহরে। করবেটের বাবা ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেট মিলিটারি সার্ভিস থেকে অবসর নেওয়ার পর শহরের পোস্টমাস্টারের পদে নিযুক্ত হন। জিমের মা মেরি জেন ছিলেন ইউরোপীয়দের রিয়েল এস্টেট এজেন্ট। তখনকার দিনে গোটা নৈনিতাল আর কালাধুঙ্গি জুড়ে ছিল অতি ভীষণ ঘন বন-জঙ্গল এবং গোটা বন্য এলাকায় বাঘ, চিতা, ময়াল, অজগর, অন্যান্য বিষধর সাপ, ভালুক, হায়েনা, শেয়াল প্রভৃতি হিংস্র জীবজন্তুর রাজত্ব। গাড়োয়াল হিমালয়ান রেঞ্জের বিরাট বিরাট পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই অঞ্চলে আজ থেকে সেই দেড়শো বছর আগে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল ডাক-রানার আর টেলিগ্রাম। বহু দুর্গম বিপদসঙ্কুল বন্য এলাকায় পায়ে হেঁটে ঘোরা ছাড়া আর কোনই উপায় ছিল না। এই বন্য প্রকৃতি, বিপদসঙ্কুল পথ, নানান বন্য পশু পাখি আর ভারতের অগুনতি গরীব সাধারণ মানুষের সারল্যভরা সহজ জীবনধারণ ছোটবেলা থেকেই জিমকে ভীষণ আকৃষ্ট করে। কিশোর বয়স থেকে ক্রমাগত জঙ্গল ভ্রমণের ফলে এই এলাকার সমস্ত বন-জঙ্গল ছিল তার নখদর্পণে, বেশিরভাগ বন্য পশুপাখিকে একবার ডাক শুনেই চিনে ফেলতে পারতেন সহজে। বন্য প্রকৃতি, গাছপালা, পশুপাখি এবং সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও মমত্ববোধের গুণে অচিরেই একজন নামকরা দুঁদে শিকারি হয়ে ওঠেন করবেটসাহেব।

ভারতের এই জঙ্গলে ঘেরা বন্যবিপদসঙ্কুল গ্রামগুলির অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল বন্যজন্তুর উৎপাত এবং বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘ ও চিতাবাঘের দৌরাত্ম্য। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে করবেট এই অঞ্চলের প্রায় ৩৩টি মানুষখেকো বাঘ মারেন। একত্রিশ বছর ধরে এই সবক'টি মানুষখেকো বাঘের হাতে মারা যায় প্রায় ১২০০ জন নিরপরাধ, গরীব গ্রামবাসী। জিমের শিকার করা প্রথম বাঘটি ছিল চম্পাবতের মানুষখেকো যার নথিভুক্ত শিকারের সংখ্যা ৪৩৬! এছাড়াও কুমায়ুন, রুদ্রপ্রয়াগ, পানার, চুকা, মুক্তেশ্বর প্রভৃতি একের পর এক নরখাদক চিতা ও বাঘ শিকার করে জিম হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তী। চমৎকার দৃষ্টিশক্তি, তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি, প্রখর স্মরণশক্তি, অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস ও মনোবলের গুণে তিনি ছিলেন এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা।

তবে শুধু শিকারি হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও জিম করবেট ছিলেন এক বড় মনের উদার হৃদয় মানুষ। তখন ভারতবর্ষে ঘোরতর ব্রিটিশ শাসন চলছে, ভারতবাসীদের প্রতি বেশিরভাগ ব্রিটিশদের যেমন হীন মনোভাব ছিল তেমনই ভারতের সাধারণ জনগণও সাহেবদের সমান ঘৃণার চোখে দেখত। কিন্তু জিম করবেট ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির মানুষ। ভারত, তার প্রকৃতি, তার বন্য জীবন এবং সহজ সরল গ্রামবাসীদের তিনি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। কোথাও কোনও শিকারের খবর পেলেই সব কাজ ফেলে বন্দুক হাতে সেইসব দুর্দশাগ্রস্ত আম ভারতবাসীর কষ্টলাঘব করতে ছুটে যেতেন। তারাও তাদের 'সাহিব'কে সমান শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কী অমানুষিক ধৈর্য্য, অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর সহযোগিতার গুণে তিনি এতটা সফল হতে পেরেছেন তা তাঁর শিকারকাহিনিগুলি পড়লে সহজেই অনুমেয়। লেখক হিসেবেও জিম করবেট ঈর্ষণীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সহজ সরল ভাষায় অনাবিল লেখনীর গুণে তাঁর প্রতিটি কাহিনিই যেমন রোমহর্ষক তেমনি সুখপাঠ্য। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলির মধ্যে 'জাঙ্গল লোর', 'ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন', বিখ্যাত 'দ্য ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ', 'দা টেম্পল টাইগার অ্যাণ্ড মোর ম্যানইটার্স অফ কুমায়ুন' এবং 'মাই ইণ্ডিয়া' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ এ ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি তাঁর বোন ম্যাগির সাথে কেনিয়া চলে যান এবং সেখানেই ১৯৫৫'র ১৯শে এপ্রিল ৭৯ বছর বয়সে এই কিংবদন্তী শিকারী, ভারতপ্রেমিক অসাধারণ মানুষটি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

জিম করবেটের অসংখ্য জনপ্রিয় কাহিনির মধ্যে থেকে তাঁর 'মাই ইণ্ডিয়া' গ্রন্থের 'দ্য ল অফ দা জাঙ্গলস্' এর অনুবাদ আজ তোমাদের জন্য.........






The Law of the Jungles

Jim Corbett



হরকোয়ার আর কুন্তীর যখন বিয়ে হয় তখনও দুজনের বয়সের মিলিত যোগফল দুই অঙ্কে পৌঁছয়নি। সে আমলে গোটা ভারতেই এমন ঘটনা খুব সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। হয়ত আজও এমনটাই চলত যদি না মহাত্মা গান্ধী ও মিস মেয়ো এখানে জন্মগ্রহণ করতেন।

বিরাট দুনাগিরি পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত হরকোয়ার ও কুন্তীর গ্রামদুটির মাঝে মাত্র কয়েক মাইলের ব্যবধান। তবুও বিয়ের আগে তারা কেউ কাউকে দেখেনি। সেই বিশেষ দিনটিতে ওরা দুজনেই নতুন জমকালো পোশাকে সেজেগুজে, খুব অল্প সময়ের জন্য আত্মীয় বন্ধুদের বিরাট ভিড়ের মাঝে যাবতীয় আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। সেদিন, বহুদিন পরে, হয়ত জীবনে প্রথমবার, তারা পেট ভরে হালুয়া আর পুরি খেতে পেয়েছিল। আর তাই-ই এই বিশেষ দিনটির স্মৃতি বহুদিন পর্যন্ত তাদের মনকে এক অনুপম ভালোলাগায় ভরিয়ে রেখেছিল।

এই দিনটির কথা হরকোয়ার ও কুন্তীর দুই বাবাও বহুদিন মনে রেখেছিলেন, বা বলা ভালো রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ কন্যা ও পুত্র দায়গ্রস্ত দুই বাবাকেই তাদের নিজ নিজ গ্রামের পিতা-মাতা-স্থানীয় বানিয়া বা মহাজনের কাছে বিয়ের খরচ বাবদ সামান্য ক'টা টাকার জন্যও হাত পাততে হয়। বানিয়ার ধার দেওয়া সেই অল্পকিছু টাকা দিয়েই তাদের ছেলে-মেয়েদের যে বয়সে বিয়ে হওয়া উচিত সে বয়সেই পুরোহিত মশাইয়ের ঠিক করে দেওয়া শুভদিনে বিয়ে দিয়ে সমাজে নিজেদের মানসম্মান রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। বিয়ের পর পুরোহিতের খাতায় বাচ্চা ছেলে-মেয়েদুটির নাম স্বামী-স্ত্রী রূপে নথিভুক্ত করা হয়।

একথা ঠিকই, এই সামান্য অনুগ্রহটুকুর জন্য বানিয়া যে শতকরা পঞ্চাশ টাকা হারে সুদ দাবি করেছিলেন তা যথেষ্ট বেশি। তবে ভগবান সহায় হলে এই ধারের কিছুটা হয়ত কখনও শোধ হবে। তাছাড়া দুপক্ষেরই বেশ কিছু ছেলে-মেয়ের এখনও বিয়ে হওয়া বাকি। আর তখনও এই দয়ালু বানিয়া ছাড়া আর কে'ই বা তাদের উদ্ধার করবে?

বিয়ের পর কুন্তী তার বাপের বাড়িতেই ফিরে এল। তারপর কয়েকবছর ধরে, খুব গরীব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ প্রতিনিয়ত করে যেতে হয়, সেসব কাজ করেই তার দিন কাটতে লাগল। বিয়ের পর কুন্তীর জীবনে একমাত্র যে পরিবর্তনটুকু এল তা হল কুমারী মেয়েদের মতো একহারা পোশাক সে আর পরতে পারল না। তার বর্তমান পরিচ্ছদে তিনটি জিনিস সংযুক্ত হল, একটা ছোট্ট হাতকাটা খাটো জামা, কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটা ঘাগরা আর দেড় গজ মতো লম্বা একটা চাদর। চাদরের একটা কোণা ঘাগরায় গুঁজে অন্যদিকটা ঘোমটার মতো মাথায় জড়িয়ে রাখতে হত।

এভাবে নিশ্চিন্ত, নির্লিপ্ত, ঘটনাবিহীন কয়েকটা বছর কাটানোর পর কুন্তী তার স্বামীর কাছে যাওয়ার মতো উপযুক্ত বয়সে উপনীত হয়েছে বলে বিবেচিত হল। আবার সেই সহৃদয় বানিয়া এসে তাদের উদ্ধার করলেন। তাঁর কিনে দেওয়া নতুন জামাকাপড়ে সজ্জিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেই ছোট্ট বউ তার বাচ্চা বরের সাথে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

কুন্তীর জীবনে এই বাড়িবদলের ফলে এটুকুই পরিবর্তন এল যে, সে আগে নিজের বাড়িতে নিজের মায়ের জন্য যেসব কাজ করত, সেগুলোই এখন সে তার শাশুড়ির জন্য করবে। ভারতের গরীব গ্রামবাসীদের জীবনে অলসভাবে দিন কাটানোর কোন উপায় নেই। ছোট-বড় সবাইকেই নির্দিষ্ট কিছু না কিছু কাজ করতেই হয়, আর তা তারা খুশি হয়েই করে। কুন্তীও তখন রান্নাবান্নার যাবতীয় দায়িত্ব সামলানোর মতো বড় হয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলেই বাড়ির যেসকল সদস্য মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে সক্ষম, তারা নিজেদের কাজে বেরিয়ে যেত। সেসকল কাজ যত তুচ্ছই হোক না কেন দিনের শেষে সেই মজুরির টাকা পরিবারের মোট তহবিলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। হরকোয়ারের বাবা ছিল একজন রাজমিস্ত্রি। সে তখন অ্যামেরিকান মিশন স্কুলে একটা গির্জা বানাচ্ছিল। হরকোয়ারেরও বাবার মতো রাজমিস্ত্রি হওয়ারই ইচ্ছে। যতদিন না তার এই কাজ করবার মতো শারীরিক শক্তি হয়, ততদিন সে তার বাবা ও অন্য রাজমিস্ত্রিদের জোগাড়ের কাজ করবে। দৈনিক দশঘন্টা পরিশ্রম করে সে যে দু আনা মজুরি পেত তা তার পারিবারিক আয় বাড়াতে সাহায্য করত।

ওদিকে সেচের সাহায্যে চাষ করা নিচু জমিগুলিতে ফসল পেকে উঠেছিল। সকালের খাওয়া দাওয়ার পর এঁটো বাসনপত্র মেজে পরিস্কার করে কুন্তী তার শাশুড়ি ও অনেকগুলো জা-ননদের সাথে গ্রামের মোড়লের জমিতে ফসল কাটতে চলে যেত। সেখানে গ্রামের বাকি মেয়ে বউদের সাথে সমানতালে দশঘন্টা পরিশ্রম করে কুন্তী তার স্বামীর অর্ধেক মজুরি রোজগার করত।

দিনের পরিশ্রম শেষে গোটা পরিবার নিজেদের কুঁড়েঘরে ফিরে আসত। হরকোয়ারের বাবা গ্রামের মোড়লের জমিতে এই ঘরটুকু বানাবার অনুমতি পেয়েছিল। বাড়ির বড়রা যখন বাইরে কাজে গেছে তখন বাড়ির খুদে সদস্যরা শুকনো কাঠ, ডালপালা ইত্যাদি জোগাড় করে এনেছিল। সেসব দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাতের রান্না আর খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হল। এই বাড়িতে শুকনো ডালপালার এই আগুন ছাড়া আর কোনরকম আলো জ্বলেনি কখনো। বাসনকোসন পরিষ্কার করার পর এবার গোটা পরিবারের প্রত্যেকের নিজেদের নির্ধারিত জায়গায় শুয়ে ঘুমনোর পালা। হরকোয়ার তার বাবা আর ভাইদের সাথে শুয়ে পড়ত, কুন্তীর জায়গা হত বাড়ির মহিলা সদস্যদের মাঝে।

হরকোয়ারের বয়স যখন আঠারো আর কুন্তীর ষোলো, তখন তারা তাদের সামান্য কিছু মালপত্র নিয়ে রাণীক্ষেত ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিন মাইল দূরের এক গ্রামে হরকোয়ারের কাকার বাড়িতে নিজেদের নতুন সংসার পাতল। তখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর অনেকগুলি ব্যারাক তৈরি হচ্ছে। কাজেই সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ পেতে হরকোয়ারের কোন অসুবিধাই হল না। আর কুন্তীও কাছের পাথর খাদান থেকে বাড়ি তৈরির পাথর ব্যারাক বানানোর জায়গা পর্যন্ত বয়ে আনার মজদুরি কাজ পেয়ে গেল সহজেই। চার বছর ধরে এই নবীন দম্পতি রাণীক্ষেতের ব্যারাক নির্মাণকার্যেই নিযুক্ত রইল আর এই চার বছরে কুন্তীর দুটি সন্তান হল। চতুর্থ বছরের নভেম্বরে বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেল। এবার হরকোয়ার আর কুন্তীকে নতুন কাজ খুঁজতে হবে। এ ক'বছরে তারা যা সামান্য টাকাপয়সা জমাতে পেরেছে তাতে তাদের দিনকয়েক মাত্র খাওয়া-পরা চলতে পারে। সে বছর শীত পড়ল বেশ তাড়াতাড়ি আর অন্যান্য বছরের তুলনায় এই শীতের প্রকোপ যে কতকটা বেশিই হবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। হরকোয়ারের পরিবারের কারোর কোনোরকম গরম জামা বা শীতপোশাক ছিল না। সপ্তাহখানেক ধরে নতুন কাজ খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে হরকোয়ার পাহাড়ের পাদদেশের দিকে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ওখানে সেচ-খাল কাটার কাজ চলছে বলে সে শুনেছে। অতঃপর ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে পুরো পরিবার মহা উৎসাহে পাহাড়ের পাদদেশের দিকে নেমে যাওয়ার জন্য পায়ে হেটে তাদের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শুরু করল।

যে গ্রামে তারা এই চারবছর ছিল আর কাজের আশায় কালাধুঙ্গির যে সেচ-খালের সন্ধানে তারা এখন চলেছে তার মধ্যে দূরত্ব মোটামুটি পঞ্চাশ মাইল। রাতেরবেলা গাছের তলায় ঘুমিয়ে, দিনেরবেলা খাড়া-রুক্ষ্ণ-বন্ধুর প্রাণান্তকর চড়াই-উতরাই ভেঙে, নিজেদের যাবতীয় মালপত্র আর দুই সন্তানকে পালা করে বয়ে এনে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও ক্ষতবিক্ষত পায়ে হরকোয়ার ও কুন্তী ছ'দিনের মাথায় কালাধুঙ্গি এসে পৌঁছল। অনুন্নত শ্রেণির আরও বেশকিছু ভূমিহীন মানুষজন শীতের গোড়ারদিকেই উঁচু পাহাড় থেকে এই পাদদেশের সমতলে নেমে এসে দলবেঁধে থাকার জন্য কুঁড়েঘর বানিয়ে নিয়েছিল। এইসব কুঁড়েঘরে তখনই তিরিশটির মতো পরিবার বাস করতে শুরু করে দিয়েছে। হরকোয়ার আর কুন্তী সেখানে ঠাঁই না পাওয়ায় নিজেদের জন্য একটা কুটির বাঁধতে শুরু করল। বনের ধারেই তারা এজন্য একটা জায়গা পছন্দ করল, সেখানে জ্বালানী কাঠ পাওয়া যায় সহজে আর বাজারও বেশ কাছে। বনের কাঠ ও লতা-পাতা দিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি বানাতে হবে। তাদের নগদ পুঁজি মাত্র ক'টা টাকায় এসে ঠেকেছে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাথা গোঁজার একটা আস্তানা বানিয়ে কাজের খোঁজে বেরতে হবে। তাদের পুরনো গ্রামের মতো কোন সহৃদয় বানিয়াও এখানে নেই যে তার কাছে গিয়ে প্রয়োজনে সাহায্য চাইবে.......

যে বনের ধারে হরকোয়ার ও কুন্তী নিজেদের কুঁড়েঘর বানিয়েছিল, সেই বনটি ছিল আমার অন্যতম প্রিয় একটি শিকারক্ষেত্র। আমি আমার পুরনো গাদাবন্দুকটা নিয়ে বাড়ির জন্য লাল বনমোরগ আর ময়ুর মারতে প্রথম এই জঙ্গলে ঢুকি। তারপর অসংখ্যবার আধুনিক রাইফেল হাতে এই বনের প্রতিটা কোণায় বড় বড় জানোয়ারের খোঁজে ঘুরেছি। যখন হরকোয়ার ও কুন্তী তাদের তিনবছরের ছেলে পুনোয়া ও দুবছরের মেয়ে পুতালিকে নিয়ে এই বনের ধারে কুঁড়ে বানিয়ে বসবাস করা শুরু করল, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে তখন পাঁচটা বড় বাঘ, আটটা চিতাবাঘ, চারটি স্লথ ভালুকের একটি পরিবার, বুনো কুল আর মধু খাওয়ার লোভে ওপরের পাহাড় থেকে নেমে আসা দুটি কালো হিমালয়ান ভালুক, রাতেরবেলায় বাঘ ও চিতার ফেলে যাওয়া মড়ি খাওয়ার লোভে আসা পাঁচমাইল দূরের ঘাসজমিতে গর্ত করে থাকা একপাল হায়েনা, একজোড়া বুনো কুকুর, অসংখ্য শেয়াল, খ্যাঁকশেয়াল ও পাইন-মার্টেন, বেশকিছু সিভেট ও অন্যান্য বনবিড়াল, দুটো ময়াল ও অসংখ্য বিষধর সাপ, ঝুঁটিওয়ালা ঈগল, ধূসর ঈগল এবং অগুণতি শকুন সে জঙ্গলে থাকত। আমার তালিকা থেকে মানুষের পক্ষে নিরাপদ জন্তু জানোয়ার যেমন হরিণ, কৃষ্ণসার, শুয়োর, বাঁদর ইত্যাদিদের বাদ দিয়েছি। কারণ এই কাহিনিতে তাদের কোন ভূমিকা নেই।

যেদিন তাদের ঐ পলকা কুঁড়েঘরটি বানানো শেষ হল তার পরদিনই হরকােয়ার দৈনিক আটআনা মজুরিতে সেচ-খালের ঠিকাদারের কাছে রাজমিস্ত্রির কাজ পেয়ে গেল। কুন্তী বনবিভাগ থেকে দু টাকা দিয়ে পারমিট কিনে পাহাড়ের পাদদেশের ঘাসজমিতে ঘাস কাটার অনুমতি পেল। সেই ঘাস কেটে সে বাজারের দোকানদারদের কাছে গরু-মোষের খাদ্য হিসেবে বিক্রি করবে। দিনভর প্রায় বারো-চোদ্দ মাইল এলাকায় উঁচু-নিচু বন্ধুর পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে সে যে আশি-নব্বই পাউণ্ড ঘাস কেটে বয়ে আনত তার জন্য কুন্তী পেত চার আনা। এর মধ্যে এক আনা দিতে হত বাজারে ঘাস বিক্রির জন্য নিযুক্ত সরকারী ঠিকাদারকে। হরকোয়ারের আট আনা আর কুন্তীর তিন আনা মিলিয়ে এই চারজনের ছোট্ট পরিবারটি বেশ আরামেই থাকতে শুরু করল, কেননা এখানে খাবার ছিল প্রচুর ও তুলনায় সস্তা। আর ওদের জীবনে সেই প্রথম মাসে একবার মাংস কিনে খাবার মতো সঙ্গতিও জুটে গেল।

হরকোয়ার ও কুন্তী যে তিনমাস কালাধুঙ্গিতে কাটাবে ভেবে এসেছিল, তার মধ্যে প্রথম দুমাস বেশ নিশ্চিন্তেই কাটল। প্রতিদিনের কাজের সময় যথেষ্ট দীর্ঘ, অবসর বিনোদনেরও তেমন একটা সুযোগ ছিল না বটে কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এমন পরিস্থিতিতে তারা অভ্যস্ত। মনোরম জল হাওয়ার গুণে শিশুদুটির স্বাস্থ্যও হয়ে উঠেছে চমৎকার। প্রথম এসে বাড়ি বানানোর ক'টা দিন বাদ দিলে তাদের কখনও না খেয়ে কাটাতে হয়নি।

এখানে আসার পর বাচ্চাদুটিকে নিয়ে ওরা দুজনে গোড়ায় বেশ চিন্তায় পড়েছিল। ছেলে-মেয়েদুটি এতই ছোট যে হরকোয়ার তাদের তার কাজের জায়গায় নিয়ে যেতে পারত না আবার কুন্তীর সাথে ঘাস কাটার কাজে ঐ অতটা চড়াই উতরাই ভাঙাও ছোট্ট শিশুদুটির পক্ষে রোজ রোজ সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? পাশের বারোয়ারি কুটিরের এক পঙ্গু বৃদ্ধা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হরকোয়ারদের কুঁড়ে থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরেই সেই বৃদ্ধার চালাঘর। ওরা দুজনে কাজে বেরিয়ে গেলে সেই বৃদ্ধা বাচ্চাদুটিকে চোখে চোখে আগলে রাখার দায়িত্ব নিল। দু'মাস এই ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই চলল। প্রতিদিন সন্ধেবেলা যখন হরকোয়ার চার মাইল দূর থেকে সেচ-খালের কাজ শেষ করে ফিরে আসত আর তার কিছুক্ষণ পরে কুন্তী যখন বাজার থেকে ঘাস বিক্রি করে ফিরত তখন তারা দেখত যে পুনোয়া ও পুতালি বাবা-মায়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

শুক্রবার হল কালাধুঙ্গির হাটবার। আশেপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ ঐদিন বাজারে জড়ো হত। সস্তার ফলমূল, খাবার, তরকারি ইত্যাদি বিক্রির জন্য ঐ একটা দিন বাজারে প্রচুর অস্থায়ী চালাঘর তৈরি করা হত। সেই হাটবারে হরকোয়ার আর কুন্তীও অন্যান্যদিনের চাইতে আধঘন্টা আগেই কাজ থেকে ফিরে আসত কারণ হাটে তখনও বিক্রি না হওয়া কিছু শাকসবজি পড়ে থাকলে রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার আগে সেগুলো অল্প দামে কিনতে পারা যাবে।

এমনই এক শুক্রবারে হরকোয়ার আর কুন্তী যখন অল্প কিছু শাকসবজি আর এক পাউণ্ড মতো পাঁঠার মাংস কিনে হাট থেকে বাড়ি ফিরল তখন তারা অবাক হয়ে দেখে পুনোয়া ও পুতালি অন্যান্যদিনের মতো তাদের জন্য অপেক্ষা করে বাড়িতে বসে নেই। সেই পঙ্গু বৃদ্ধা জানাল দুপুরের পর থেকে সেও বাচ্চাদুটিকে আর দেখতে পায়নি। তার মনে হয়েছিল গ্রামের বাকি বাচ্চাদের সাথে পুনোয়া আর পুতালিও হয়ত হাটে নাগরদোলা চড়তে চলে গেছে। কথাটা বেশ যুক্তিসঙ্গত, কাজেই হরকোয়ার বাচ্চাদের খোঁজে আবার হাটে চলল এবং কুন্তী বাড়ি ফিরে রাতের রান্না চড়াতে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে হরকোয়ার একদঙ্গল লোকজনকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। এদের সঙ্গে নিয়েই সে গোটা হাট জুড়ে ছেলে-মেয়েদুটির সন্ধান করেছে। কিন্তু তাদের কোনো চিহ্নই সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাটে যেখানে যাকে পাওয়া গেছে তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হয়নি।

সেই সময়টাতে গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই এমন একটা গুজব ভীষণ রটেছিল যে মুসলমান ফকিরেরা ছোট ছোট হিন্দু ছেলে-মেয়েদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানোর জন্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই গুজবের মধ্যে সত্য কতটুকু তা আমার পক্ষে বলা আদৌ সম্ভব নয় কিন্তু খবরের কাগজের পাতায় প্রায়ই পড়তাম যে কখনও এই ফকিরেরা লোকজনের হাতে বেশ মারধোর খাচ্ছে আবার কখনও পুলিস সেই মারমুখী জনতার হাত থেকে কোনক্রমে তাদের উদ্ধার করছে। সব বাবা-মা'ই এই গুজবের কথা জানত। হরকোয়ার ও তার দলবল বাড়ি ফিরে এসে কুন্তীকে তাদের আশঙ্কার কথা জানাল, পুনোয়া আর পুতালিকে হয়ত এই ফকিররাই চুরি করেছে! তারা হয়ত এই উদ্দেশ্যেই হাটে ওঁত পেতে ছিল!!

গ্রামের নিচের দিকে একটি ছোট্ট পুলিস স্টেশন রয়েছে। একজন হেড কনস্টেবল দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে সেই থানা চালাতেন। হরকোয়ার ও কুন্তী প্রায় গোটা গ্রামের লোককে সাথে নিয়ে সেই থানায় অভিযোগ জানাতে চলল। হেড কনস্টেবলটি বৃদ্ধ মানুষ, সহৃদয়, তাঁর নিজেরও বেশক'টি ছেলেপুলে আছে। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সেই উদভ্রান্ত বাবা-মায়ের সমস্ত বিবরণটুকু শুনলেন, তারপর তাঁর ডায়রিতে তাদের অভিযোগ নথিভুক্ত করে নিয়ে বললেন যে সেই রাতে তো আর কিছুই করা যাবে না, কিন্তু পরদিন সকাল হলেই তিনি লোক পাঠিয়ে কালাধুঙ্গির পনেরোটি গ্রামের সবক'টিতেই বাচ্চাদুটির হারিয়ে যাওয়ার খবর প্রচার করার ব্যবস্থা করবেন। তারপর তিনি প্রস্তাব দিলেন যে, এর সাথেই যদি পঞ্চাশ টাকা পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করা যায় তাহলে হয়ত ছেলে-মেয়েদুটিকে সহজে এবং নিরাপদে খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হবে। পঞ্চাশ টাকা!!! হরকোয়ার ও কুন্তী বিস্ময়ে হতবাক! দুনিয়ায় এত টাকাও আছে তাহলে! আর এত টাকা তারা পাবেই বা কোথায়? যাই হোক, পরদিন সকালে ঘোষক যখন গোটা এলাকায় এই বিষয়টি প্রচার করতে বেরল তখন সে এই পুরস্কারের কথাটিও ঘোষণা করে দিল, কারণ হেড কনস্টেবলের প্রস্তাব শুনে কালাধুঙ্গিরই এক সহৃদয় ব্যক্তি বাচ্চাদুটোর মুখ চেয়ে পুরস্কারের টাকাটা দিতে রাজি হয়েছিলেন।

রাতের খাওয়াদাওয়া সারতে স্বভাবতই বেশ দেরী হল, বাচ্চাদুটোর ভাগের খাবার আলাদা করে সরিয়ে রাখল ওরা। ভয়ানক ঠাণ্ডার কারণে আগুনের একটা ছোট্ট কুণ্ড মতো জ্বেলে রেখে দুজনে শুয়ে পড়ল। হরকোয়ার আর কুন্তীর চোখে সে রাতে আর ঘুম এলো না, সাড়া পাবার কোনো আশা নেই জেনেও দুজনে পালা করে রাতের অন্ধকারের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে বারবার ছেলে-মেয়েদুটোর নাম ধরে ডেকে যেতে লাগল।

দূর থেকে দুটো রাস্তা কালাধুঙ্গির কাছে এসে সমকোণে পরস্পরকে ছেদ করেছে। একটা রাস্তা পাহাড়ের পাদদেশ বরাবর হলদোয়ানি থেকে রামনগর পর্যন্ত বিস্তৃত আর অন্য রাস্তাটির বিস্তার নৈনিতাল থেকে বাজপুর পর্যন্ত। সেই শুক্রবার রাতে, ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য ছোট্ট অগ্নিকুণ্ডটার পাশে বসে হরকোয়ার ও কুন্তী ঠিক করল যে, যদি ভোর হওয়ার পরও ছেলে-মেয়েদুটোর কোনো খোঁজ পাওয়া না যায় তাহলে তারা প্রথম রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গিয়ে খোঁজখবর করা শুরু করবে। তাদের ধারণা ছেলেধরাদের পক্ষে ঐ পথে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

শনিবার ভোর হতেই তারা থানায় গিয়ে তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানাল। হেড কনস্টেবল তাদের হলদোয়ানি ও রামনগর দুটো থানাতেই মিসিং রিপোর্ট লিখিয়ে আসার পরামর্শ দিলেন। তিনি ইতিমধ্যে খোদ হলদোয়ানির পুলিস ইন্সপেক্টরের কাছে বাচ্চাদুটির বিবরণ সমেত একটি চিঠি ডাক-রানারের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। হেড কনস্টেবল তাঁর চিঠিতে ইন্সপেক্টর সাহেবকে অনুরোধ করেছেন যে, সাহেব যেন সবক'টি রেলওয়ে জংশনকে ছেলে-মেয়েদুটির ব্যাপারে সতর্ক করে টেলিগ্রাম করে দেন।

সেইদিন সন্ধেয়, সূর্যাস্তের একটু আগে, দীর্ঘ আঠাশ মাইল রাস্তা হেঁটে কুন্তী হলদোয়ানি থেকে ফিরে এল। তারপর সোজা থানায় গিয়ে ছেলে-মেয়েদের খোঁজ করল। হেড কনস্টেবলকে জানাল যে, হলদোয়ানিতে বাচ্চাদুটির কোনো খোঁজই সে পায়নি কিন্তু ওঁর নির্দেশ মতো মিসিং রিপোর্ট লিখিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই হরকোয়ার ছত্রিশ মাইল রাস্তা অতিক্রম করে রামনগর থেকে ফিরেই সোজা থানায় চলে এল। সেও জানাল যে ছেলে-মেয়েদের কোনো হদিস না পেলেও সে হেড কনস্টেবলের আদেশ পালন করে এসেছে।

ক্লান্ত অবসন্ন শরীর ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় গ্রামে ফিরে তারা দেখে প্রায় গোটা গ্রাম ওদের জন্য বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে। এই দলটির বড় অংশই ছিল গ্রামের মায়েরা, নিজেদের ছেলে-মেয়েগুলোর আশু বিপদের আশঙ্কায় তারা যথেষ্ট ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। হরকোয়ার ও 'পুনোয়ার মা'-কে প্রত্যেকেই সহানুভূতি ও সমবেদনা জানিয়ে তাদের মানসিক কষ্ট কিছুটা লাঘব করার আপ্রাণ চেষ্টা করল। ভারতবর্ষের তখনকার প্রথা অনুযায়ী বিয়ের পর কুন্তী তার জন্মের পরে পাওয়া নিজস্ব নামটুকু হারিয়ে ফেলেছিল। পুনোয়া যতদিন হয়নি ততদিন তাকে ডাকা হত 'হরকোয়ারের বউ' বলে, আর পুনোয়ার জন্মের পর সে হয়ে গেল 'পুনোয়ার মা'।

রবিবারেও ঠিক শনিবারের ঘটনাক্রমেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। তফাত শুধু এটুকুই যে, পুব-পশ্চিম মুখো না গিয়ে কুন্তী উত্তরদিকে নৈনিতালের পথ ধরল আর হরকোয়ার দক্ষিণে বাজপুরের দিকে গেল। কুন্তীকে যেতে হল ত্রিশ মাইল, হরকোয়ারের ভাগে পড়ল বত্রিশ মাইল পথ। ভোরে বেরিয়ে, গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত এই উদভ্রান্ত বাবা-মাকে এমন সব গহীন অরণ্য ঘেরা দুর্গম পথ ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছিল যে রাস্তায় সাধারণত বড় দল ছাড়া কেউ কখনো চলাফেরা করার সাহস পেত না। ছেলে-মেয়ের জন্য বাবা-মায়ের সহজাত এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাটুকু না থাকলে ডাকাত আর হিংস্র বন্য পশুর ভয়ে ভরা ও-পথে একা চলাফেরা করার কথা হরকোয়ার ও কুন্তী দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না।

রবিবারের সন্ধেয় ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও অবসন্ন দেহে নৈনিতাল আর বাজপুর থেকে ব্যর্থ-মনোরথে ফিরে এসে দুজনে শুনল, গ্রামে গ্রামে ঘোষণা করিয়ে এবং পুলিসি তদন্তের পরও ছেলে-মেয়েদুটির নূন্যতম হদিস পাওয়া যায়নি। দুই নবীন বাবা-মায়ের মন একদম ভেঙে গেল, তাদের আদরের পুনোয়া ও পুতালিকে কখনও আবার নিজেদের কাছে ফিরে পাবার আশা ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে।

দেবতাদের কোন রোষে প্রকাশ্য দিবালোকে ভিড়ে-ঠাসা হাট-বাজারের মাঝখান থেকে তাদের বাচ্চাদুটো কী করে ফকিরদের ফাঁদে পড়ল, এ রহস্যের সমাধান কোথায়?? পাহাড়ের ওপরে নিজেদের গ্রাম থেকে এতদূরের পথ পেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে নেমে আসার আগে দুজনেই গ্রামের পুরোহিতের মতামত নিয়ে, তাঁর ঠিক করে দেওয়া শুভদিনেই তো যাত্রা শুরু করেছিল! দীর্ঘ যাত্রাপথের যেখানে যত দেবতার থান পড়েছে, প্রত্যেক জায়গায় যথাবিহিত অর্ঘ নিবেদন করতে করতেই এগিয়েছে। কোথাও এক টুকরো শুকনো কাঠ, কোথাও কুন্তীর গায়ের চাদরের আঁচল থেকে ছিঁড়ে নেওয়া এক টুকরো কাপড়, কোথাও আবার পুরো এক পয়সা....... দেবতার মান রাখতে নিজেদের সাধ্যাতীত নৈবেদ্য তুলে ধরতে পিছপা হয়নি কখনোই। এখানে, এই কালাধুঙ্গিতে এসে অবধি, দুজনে যখনই কোন মন্দিরের পাশ দিয়ে গেছে, নিচু জাতের হওয়ায় হয়ত মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেনি, কিন্তু প্রত্যেকবার দূর থেকে হাতজোড় করে প্রণাম করতে, ছেলে-মেয়েদের সুস্থ-সবল-নিরাপদ রাখার মিনতিটুকু জানাতে একবারের জন্যও ভুল হয়নি। তারা তো দেবতারা যা চান তাই-ই পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে এসেছে বরাবর, জ্ঞানত কখনও কারোর কোনো ক্ষতিই করেনি, তবে এই আকস্মিক বিপর্যয়, এতবড় দৈবদুর্বিপাকের কারণ কী?

শ্রান্ত, অবসন্ন দেহে নৈরাশ্য এমন গ্রাস করল যে সোমবার তারা আর কুঁড়েঘর ছেড়ে একচুলও নড়তে পারল না। ঘরে খাবার নেই, কাজে না বেরনো পর্যন্ত তা জুটবেও না আর। যে সন্তানদের মুখ চেয়ে উদয়াস্ত হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেছে দুজনে, তারাই যখন আর নেই তখন কাজ করে হবে কী? তাই, যখন বন্ধু-পরিজনেরা যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিতে আসল, তখন দেখে হরকোয়ার কুটিরের দরজার কাছে বসে তার আশাহীন, নিস্পন্দ শূন্য ভব্যিষতের পানে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। আর কুন্তী ঘরের এক কোণে বসে বিলাপের তাড়নায় সমানে দুলে চলেছে, তার চোখের জল গাল বেয়ে নেমে শুকিয়ে গিয়েছে।

সেই সোমবারই, বন্য জন্তু আর পাখপাখালি ভরা যে জঙ্গলের কথা আমি আগে বলেছি, আমার চেনা একটি লোক সেই জঙ্গলে মোষ চরাচ্ছিল। লোকটি অতি সরল, সাদাসিধে; জীবনের বেশীরভাগ সময় পতাবপুর গ্রামের মোড়লের গরু-মোষ জঙ্গলে জঙ্গলে চরিয়ে কাটিয়েছে। বাঘের ভয়ের কথা সে জানত। তাই সূর্যাস্তের কিছু আগেই সে মোষগুলোকে একত্রিত করে নিয়ে গহন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া একটা গবাদি পশু চলা পথ ধরে তাদের গ্রামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। কিছুদূর এগোনোর পর সে লক্ষ্য করল যে, একটু এগিয়ে, পথের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে প্রত্যেকটা মোষ ডানদিক মাথা ঘোরাচ্ছে আর থেমে দাঁড়িয়ে পড়ছে, পেছনের মোষটার শিঙের ঠেলা না খাওয়া অবধি কিছুতেই নড়ছে না। লোকটি যখন সেই জায়গায় পৌঁছল, তখন সেও মোষগুলোর মতো ডানদিকে তাকাল। সে দেখল পথের কয়েক ফুট তফাতে একটা অপেক্ষাকৃত নিচু জমির ওপর দুটি শিশু শুয়ে রয়েছে।

শনিবার যখন গ্রামে গ্রামে বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা হচ্ছিল, এই লোকটি জঙ্গলের গভীরে মোষ চরাতে ব্যস্ত। কিন্তু সেই রাত্রে বা তার পরের রাতেও হরকোয়ারের ছেলে-মেয়ে চুরির খবর সে গ্রামের আগুনের ধারে বসে শুনেছে। শুধু তার গ্রাম বলে নয়, কালাধুঙ্গির প্রতিটা গ্রামে রাতের আড্ডায় এখন এই একটাই খবর লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। তাহলে এই তো সেই হারানো ছেলে-মেয়ে যাদের জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কারও নাকি ঘোষণা হয়েছে! কিন্তু তাদের মেরে এই এত দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখে গেছে কেন? বাচ্চাদুটির পরনে তো একটা কাপড়ও নেই, কেমন যেন জড়াজড়ি করে পড়ে আছে!

রাখালটি ঢাল বেয়ে নিচু জায়গাটায় নেমে গিয়ে বাচ্চাদুটোর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর শিশুদুটির মৃত্যুর কারণ বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। বাচ্চাদুটো যে আর বেঁচে নেই, এবিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। তাদের কাছে বসে ভালো করে পরীক্ষা করতে গিয়ে সে হঠাৎ দেখল যে তাদের নিঃশ্বাস পড়ছে। তারা মোটেও মরেনি, বরং অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সে নিজেও একজন স্নেহশীল পিতা, খুব সন্তপর্ণে, ধীরে ধীরে স্পর্শ করে সে বাচ্চাদুটোর ঘুম ভাঙাল। যদিও ব্রাহ্মণ হয়ে নিচু জাতের ছেলে-মেয়েদুটোকে ছুঁলে ওর পাপ হবে, তবু এমন বিপদের সময় জাতের চিন্তা করলে চলবে কেন? কাজেই, মোষগুলোকে নিজে নিজে পথ খুঁজে গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য বাঘ-ভাল্লুকে ভরা ঘন বনের মাঝে ছেড়ে দিয়ে সে শিশুদুটিকে তুলে নিল। ও দুটো এত দুর্বল যে নিজের পায়ে হাঁটার ক্ষমতা ওদের নেই, সুতরাং দু-কাঁধে দুজনকে বসিয়ে রাখালটি কালাধুঙ্গি বাজারের পথ ধরল।

রাখালটি নিজেও বেশ দুর্বল, এ অঞ্চলের আর পাঁচজনের মতো সেও বেজায় ম্যালেরিয়ায় ভুগেছে। শিশুদুটিকে এতটা পথ বয়ে নিয়ে যাওয়া বেশ ঝঞ্ঝাটের কাজ, তাদের আবার ঠিক জায়গা-মতো ধরেও রাখা চাই। তাছাড়া এ জঙ্গলের সব গোরু-চলা পথ আর গেম-ট্র্যাকগুলো গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, অথচ তাকে যেতে হবে পুব থেকে পশ্চিমে। তাই, দুর্ভেদ্য বুনো ঝোপ ও গভীর গিরিখাত এড়ানোর জন্য তাকে বারবার ঘুরে-ঘুরে, পথ খুঁজে নিয়ে এগোতে হল। ছ'মাইল হেঁটে আসতে বারবার বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামতে হলেও সে কিছুতেই হাল ছাড়ল না।

পুতালি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। তবে পুনোয়া অল্প অল্প কথা বলছিল। তারা জঙ্গলের এত গভীরে কী করে চলে এল, এর উত্তরে সে শুধু এটুকুই বলতে পারল যে, তারা সেদিন খেলতে খেলতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল।

রাত গভীর হয়ে আসছে। কুঁড়ের দরজায় বসে হরকোয়ার সেদিকে নিশ্চলভাবে তাকিয়ে আছে। নিকষ কালো অন্ধকারের চাদর ফুঁড়ে যখন লণ্ঠন আর রান্নার আগুনের টুকরো টুকরো আলোকবিন্দু ইতিউতি জ্বলে উঠছে একটা দুটো করে তখন হঠাৎ সে একদল লোককে বাজারের দিক থেকে আসতে দেখল। দলের শুরুতে যে লোকটা হেঁটে আসছে তার কাঁধে কী যেন একটা রয়েওছে। মিছিল যত এগোচ্ছে চারদিক থেকে লোকজন এসে ভিড়ও ততই বাড়ছে। হঠাৎ একটা উত্তেজিত গুঞ্জন তার কানে এল, 'হরকোয়ারের ছেলে-মেয়ে!' 'হরকোয়ারের ছেলে-মেয়ে!' সে যেন তার কানদুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না! কিন্তু না, না, কোনো ভুল নেই। ঐ তো, ওরা সবাই তো সোজা তার বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে!

কুন্তী দুঃখ, হতাশা, দুর্ভাবনায় নিস্পেষিত হতে হতে শারীরিক ও মানসিক সহনশীলতার শেষ সীমায় পৌঁছে ঘরের এক কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হরকোয়ার ভেতরে এসে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দরজার কাছে নিয়ে আসতে আসতে সেই রাখালটিও পুনোয়া আর পুতালিকে কাঁধে বসিয়ে সেখানে এসে পৌঁছল।

হারানো ছেলে-মেয়ের সাথে বাপ-মায়ের পুনর্মিলন, কান্নাকাটি, আদর, ধন্যবাদ আর অভিনন্দনের বন্যা স্তিমিত হওয়ার পর রাখালটিকে পুরস্কৃত করার প্রসঙ্গ উঠল। তখনকার দিনে একজন গরীব মানুষের কাছে পঞ্চাশটাকা পাওয়া মানে এক বিরাট ধনসম্পত্তি লাভ করার মতোই ব্যাপার, ঐ টাকা দিয়ে সে তিনটে মােষ কিংবা দশটা গরু কিনে বরাবরের মতো স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারত। কিন্তু সেই উদ্ধারকর্তাটিকে সবাই যতটা বাহাদুরি দিচ্ছিল, সে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি বাহাদুর। সেই রাতে তার মাথায় যে আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ বর্ষিত হল তার চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছুই সে চায় না। বিশেষ করে দুটি ছোট্ট খুদেকে উদ্ধার করার বিনিময়ে প্রাপ্য ঐ পঞ্চাশ টাকার একটি পয়সাও সে কিছুতেই ছুঁতে পারবে না। যে সন্তানদের আবার কখনও দেখতে পাবে এই আশাটাও চলে যেতে বসেছিল সেখানে তাদের অক্ষত দেহে ফেরত পাবার পর হরকোয়ার বা কুন্তীর পক্ষেও দান হোক বা ঋণ কোনোভাবেই ঐ টাকাগুলো নেওয়া সম্ভব ছিল না। এবার একটু সুস্থ হয়ে আবার কাজে বেরতে হবে। পাড়া-পড়শিরা আনন্দের আতিশয্যে বাজার থেকে যেসব দুধ, মিষ্টি আর পুরি কিনে এনেছে, তাই দিয়েই মাঝের ক'টাদিন কোনক্রমে চলে যাবে।

দুবছরের পুতালি এবং বছর তিনেকের পুনোয়া শুক্রবার দুপুরবেলা জঙ্গলের মধ্যে পথ হারায় আর সেই রাখালটি তাদের গভীর বনের ধারে খুঁজে পায় সোমবার, আন্দাজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ.......... মাঝে কেটে যায় সুদীর্ঘ সাতাত্তর ঘন্টা। এই সাতাত্তর ঘন্টা ঐ শিশুদুটি যে জঙ্গলে কাটায় সেখানে কোন কোন হিংস্র, বন্য জীবজন্তু থাকত তার বর্ণনা আমি আগেই আপনাদের দিয়েছি। অতগুলো হিংস্র পশুপাখির মধ্যে কেউই এই দীর্ঘ সাতাত্তর ঘন্টায় ঐ শিশুদুটিকে দেখেনি, বা তাদের গলার আওয়াজ শুনতে পায়নি কিংবা তাদের গায়ের গন্ধ পায়নি এমনটা ভেবে নেওয়া নেহাতই অযৌক্তিক এবং মূর্খামি। অথচ রাখাল যখন তাদের জঙ্গলের গভীর থেকে উদ্ধার করে এনে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিল তখনও পর্যন্ত তাদের গায়ে একটাও দাঁত কিংবা নখের আঁচড় পড়েনি।

একবার আমি এক বাঘিনীকে একটি এক-মাস বয়সী ছোট্ট ছাগলছানাকে ধরবার জন্য লুকিয়ে পিছু নিতে দেখি। সেই নাবাল ফাঁকা জায়গায় ছাগলছানাটা বেশকিছুটা দূর থেকেই বাঘিনীকে দেখতে পায় এবং চেঁচাতে শুরু করে। বাঘিনীটিও আর লুকিয়ে না থেকে ফাঁকা জমিতে বেরিয়ে এসে সটান তার দিকে এগিয়ে যায়। বাঘিনীর থেকে মাত্র কয়েক গজের ব্যবধানে পৌঁছে ছাগলছানাটা এগিয়ে যায় এবং গলা বাড়িয়ে মুখ উঁচু করে তাকে শুঁকতে শুরু করে। কয়েকটা রুদ্ধশ্বাস, স্তব্ধ হৃদস্পন্দন হতে যেটুকু সময় লাগে সেই সময়টুকু একটা এক মাসের বাচ্চা ছাগলছানা বনের অবিসংবাদী রাণীর নাকে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!! তারপর রাণীমা মুখ ফিরিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে যায়।

হিটলারের সাথে যুদ্ধ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তিন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের বক্তৃতার নির্যাস পড়েছিলাম। তাঁরা যুদ্ধের বর্বরতা ও নৃশংসতার নিন্দা করে বলেছিলেন, শত্রুপক্ষ মানুষে-মানুষে হওয়া যুদ্ধের মধ্যে 'জংলি কানুন' প্রয়োগ করছে। আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা বন্য প্রাণিকুলের জন্য যে কানুন তৈরি করেছেন তা যদি মানুষের জন্যও করতেন তাহলে হয়ত মানুষে-মানুষে কোনো যুদ্ধই হত না। কারণ সেক্ষেত্রে মনুষ্যকুলের মধ্যে যারা প্রবল পরাক্রান্ত তারাও দুর্বলদের প্রতি একই রকমের সহৃদয়তার পরিচয় দিত যা আবহমান কাল ধরে প্রকৃত 'law of the jungles.'

2 comments:

  1. অসাধারণ.....দুর্দান্ত।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ অর্পণ দা। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো। 😊

    ReplyDelete