বিবিধ নিবন্ধ: ভারতের আনাচে কানাচে : শাশ্বত বসু



পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন মহাকাব্য গ্রন্থগুলির মধ্যে মহাভারত অন্যতম। মহাভারত আজ থেকে আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের দেশ ভারতবর্ষে লেখা হয়েছিল। লিখেছিলেন ব্যাসদেব বা বেদব্যাস নামের একজন ঋষি। তা এই মহাভারতের মধ্যে অনেক আশ্চর্যজনক ও মজার মজার কাহিনী আছে। তবে বুঝতেই পারছো বন্ধুরা, পাঁচ হাজার বছর আগের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া খুব শক্ত। গবেষণা করে দেখা গেছে, মহাভারতে লেখা অনেক কিছুই সত্যি। প্রত্নতত্ত্ববিদ S. R Rao তাঁর সঙ্গীসাথীদের নিয়ে গুজরাটে সমুদ্রের তলায় অভিযান চালিয়ে অদ্ভুত এক মহানগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। সেই মহানগরীর নাম ছিল দ্বারকা, যার সময়কাল ও ভৌগোলিক অবস্থান মহাভারত অনুযায়ী মিলে যায়। তারপর ১৯৯৯ সালে তিনি "The lost city of Dwarka" নামে একটি বইও লেখেন এবং মহাভারতকে ঐতিহাসিক সত্য বলে ব্যাখ্যা করেন। ইংল্যান্ডে প্রকাশিত "History Today" পত্রিকার ৫২তম ভলিউমের নভেম্বর ২০০২ সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, ৭৫০০ বছর আগের ভারতের এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের কথা। এছাড়াও মহাভারতে আরো যেসব জায়গার নাম ও বর্ণনা আছে সেসব জায়গা এখনো ভারতে রয়েছে। বেশ কিছু নদী, পাহাড় ইত্যাদির নাম যেগুলি মহাভারতে পাওয়া যায় সেসব এখনো আছে। তবে সে যাই হোক, চলো আমরা সেই মহাভারতের একটা মজার ঘটনা দিয়ে আলোচনা শুরু করি। আনুমানিক ৩১০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে অর্থাৎ ৫১০০ বছরেরও আগে হস্তিনাপুর বলে একটি রাজ্য ছিল। সেখানে রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁর ভাই পাণ্ডুর ছেলেদের অর্থাৎ পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দিয়ে পাঠিয়ে দেন খাণ্ডব নামের একটি জঙ্গল এলাকায়। এই খাণ্ডব জঙ্গল আজকের দিল্লীর কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। আর নিজের পুত্রদের জন্য অর্থাৎ কৌরবদের জন্য রাজধানী হিসাবে রাখলেন হস্তিনাপুরকেই। তা পাণ্ডবরা সেই জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তুললেন এক অপূর্ব সুন্দর নগরী। নাম হলো ইন্দ্রপ্রস্থ। ময় নামের একজন শিল্পী বা স্থপতি (architect) তৈরী করলেন অদ্ভুত এক মহল যা নাকি ছবির মতো সুন্দর ছিল। যে দেখতো সেই অবাক হয়ে যেত, তাকিয়ে থাকতো মুগ্ধ হয়ে। কিছুদিন পরে পাণ্ডবরা কৌরবদের নিমন্ত্রণ করলেন ইন্দ্রপ্রস্থে আসার জন্য। কৌরবদের রাজা দুর্যোধন সেই মহল দেখে খুব অবাক হলেন আর পড়লেন নানারকম বিপদে। তিনি দরজা মনে করে মহলে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা খেলেন পাথরের দেওয়ালে। তারপর মহলের ভিতরে মেঝে মনে করে পা রাখলেন একটি জলাশয়ের উপর। দেখে যে বোঝার উপায় নেই সেখানে জল আছে! তিনি যখন বুঝলেন তখন যা হওয়ার হয়ে গেছে, তিনি পড়ে গেলেন জলের মধ্যে, ভিজে গেলেন পুরোপুরি। এমনিতেই তিনি খুব রাগী ছিলেন, এই ভাবে বোকা বনে যাওয়ায় তো ভীষণ রেগে গেলেন। পরে তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নামে পরিচিত আর কুরুক্ষেত্র নামের জায়গা ভারতে এখনো আছে, সে অবশ্য অন্য কথা। যেটা আমাদের আলোচনার বিষয়, সেটা হলো এই অদ্ভুত মহল আর স্থাপত্য। যা কিনা রাজা হয়েও দুর্যোধন বুঝতে পারেননি দেখে। আমরা দেখলে যে কী অবস্থা হতো, তা আর না ভাবাই ভালো।

তোমরা অনেকেই হয়তো ভাবছো সেই সব অদ্ভুত সুন্দর সৃষ্টি কোথায় গেল? কিছুই কি আর নেই? সত্যি কথা বলতে এত পুরোনো দিনের জিনিস আজ খুঁজে পাওয়া শক্ত, তবে পাঁচ হাজার না হোক, এক-দেড় হাজার বছরের পুরোনো স্থাপত্য গুলিও কিন্তু কম আশ্চর্যের নয়। সেগুলি কিন্তু সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে রয়েছে। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি কিংবা ডিসেম্বরের ছুটিতে আমরা প্রায় প্রতি বছরই এদিক ওদিক বেড়াতে যাই। একটু খোঁজ খবর করে রাখলে এমন অনেক জায়গায় টুক করে ঘুরে আসাই যায় যেখানে অনেক অবাক করা পুরোনো স্থাপত্য আছে। এমনই এক জায়গার নাম খাজুরাহো। মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড নামে পরিচিত অংশে এই শহরটি অবস্থিত। চান্দেল রাজারা বংশ পরম্পরায় এখানে প্রায় একশোর কাছাকাছি মন্দির তৈরী করেন। সবই প্রায় ১২০০ থেকে ১০০০ বছর আগে। আমি যখন প্রথম খাজুরাহো পৌঁছালাম, দূর থেকে বিরাট উঁচু আর বড়সড় আকারের একটা মন্দির দেখতে পেলাম। নাম কন্দরীয় শিবের মন্দির। তার আশেপাশে তার থেকে ছোট আরো অনেকগুলো মন্দির রয়েছে।

         কন্দরীয় শিবমন্দির ,খাজুরাহো - দূর থেকে

দূর থেকে দেখে মনে হলো, ভালো, তবে সব পুরোনো মন্দির তো এরকমই অনেকটা হয়, হয়তো কিছুটা ছোট। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও তো পুরোনো মন্দির কিছু আছে। কিন্তু কাছে যেতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে যা দেখছি, তা যে আগে কোনওদিন দেখিনি!

 কন্দরীয় মহাদেব মন্দিরের একটি দেওয়ালের অংশ - কাছ থেকে 

দূর থেকে যাকে সাধারণ দেওয়াল মনে হচ্ছিল, কাছে যেতে বুঝলাম সেগুলো অসংখ্য মূর্তি দিয়ে তৈরী। এই মূর্তির কাজকে বলে ভাস্কর্য। এমনভাবে মূর্তিগুলি খোদাই করা আছে সমস্ত মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে, যে কোথাও কোন অমিল নেই, নিখুঁত সামঞ্জস্য (symmetry)। এতটাই নিখুঁত বলে দূর থেকে বোঝার উপায় নেই যে এত এত মূর্তি রয়েছে সারা দেওয়ালগুলো জুড়ে। আর কী সুন্দর সব মন্দিরের রঙ!

                    খাজুরাহো মন্দিরের ভাস্কর্য

হরেক রকমের পাথর দিয়ে তৈরী মন্দিরগুলোয় সূর্যের আলো পড়ে কখনো সোনালি, কখনো খয়েরি, কখনো লাল দেখায়। একটা পাথরের সঙ্গে আরেকটা পাথর ইন্টারলক পদ্ধতিতে আটকে এই বিরাট মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছিল। ইন্টারলক মানে হলো একটি পাথরের খাঁজে আরেকটি পাথরকে আটকে দেওয়া। এইভাবে সবথেকে উপরের চূড়ার বিরাট আকারের ভারী পাথরটা তুলে নিচের পাথরের খাঁজের মধ্যে ঠিক জায়গা মতো আটকানো যে কত কঠিন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। শোনা যায়, কোনও এক ইংরেজ সাহেব এখান দিয়ে যাওয়ার সময় মন্দিরগুলো দেখতে পান। তিনিও আমার মতই অবাক হয়ে বলেছিলেন, এমন সৃষ্টি কী করে সম্ভব!

খাজুরাহো মন্দিরগুলোতে যেমন পাথরের সাথে পাথর আটকে গড়ে তোলা হয়েছে, মহারাষ্ট্রের ইলোরা তে যে আশ্চর্যজনক কৈলাস মন্দির আছে, সেটি আবার একটি বিরাট পাথরকে কেটে বানানো। অর্থাৎ একটি মাত্র বিরাট পাথর (ছোট টিলার আকারের) থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে সুন্দর সুন্দর মূর্তি ও কারুকার্য বিশিষ্ট এই মন্দির তৈরি হয়। তাও আবার দোতলা। এই rock-cut পদ্ধতিকে বলা হয় monolithic structure; তোমরা তো জানোই mono মানে হলো single বা এক। পৃথিবীতে এত বড় monolithic structure আর কোথাও নেই।

                       কৈলাস মন্দির ,মহারাষ্ট্র

শুধু স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের সৌন্দর্যই নয়, সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই এত বছর আগে কেমন করে একটা টিলার মত বড় পাথর কেটে এমন নিখুঁত মন্দির তৈরি করা হলো। আমরা তো বইতে পড়েছি, আজ থেকে হাজার বছর আগে ছেনি আর হাতুড়ি ছাড়া নাকি কোনও যন্ত্র ছিল না! কিন্তু ছেনি হাতুড়ি দিয়ে তো এরকম পাথর কাটা অসম্ভব! আরো একটা প্রশ্ন হলো, এত বড় পাথর কাটার পর যে কয়েক'শ টন পাথর বাদ গেল, সেগুলো গেল কোথায়! ওই বিপুল পরিমাণ ভারী পাথর সরিয়ে ফেলাও তো সহজ নয়। কেবলমাত্র গলিয়ে বা বাষ্পীভূত করে দিলেই তা সম্ভব কিন্তু এমন পাথর গলানো তো যন্ত্র ছাড়া অসম্ভব! এই সব প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি এবং কৈলাস মন্দির তার দীর্ঘস্থায়ী রহস্যজনক সৌন্দর্য নিয়ে একইভাবে আজও বর্তমান। কবে যে এই মন্দির নির্মাণ হয়েছে তা সঠিক জানা নেই তবে অনেকে বলেন রাষ্ট্রকূট বংশের রাজাদের সময় প্রায় ১৩০০ বছর আগে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। পৃথিবীতে আজও এরকম স্থাপত্য তৈরী করা সম্ভব হবে না। এ এক বিরল সৃষ্টি এবং আশ্চর্য! খাজুরাহো ও ইলোরা দুই ধরনের টেকনিক ব্যবহার করে তৈরি হলেও মনে রেখো, দুই ক্ষেত্রেই সামান্য ত্রুটি হলেই কিন্তু সেটা আর নিখুঁত করা সম্ভব হতো না। ইন্টারলকে গোলমাল হলে মানে ঠিকমত খাঁজে খাঁজে না বসলে পাথরগুলো অসমঞ্জস বা অসমান হয়ে পড়তো। আবার পাথর কাটায় কিছু পরিমাপের ত্রুটি হলে কৈলাসও তার সৌন্দর্য হারাতো।

দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে হয়সালেশ্বর মন্দির আরেক বিস্ময়কর কীর্তি।


            হয়সালেশ্বর মন্দিরের একটি অংশ

বলা হয়, হয়সাল রাজবংশের রাজারা প্রায় ৯০০ থেকে ১০০০ বছর আগে এই মন্দির নির্মাণ করেন। এখানেও সমস্ত দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে, কোথাও রামায়ণ কোথাও মহাভারত, কোথাও বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনার ছবি মূর্তি রূপে ছড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের আনাচে কানাচে। সৌন্দর্যের কথা সবটা তো লিখে বলা যায়না, তোমরা নিজের চোখে দেখলে তবেই বুঝবে। আমরা বরং অন্যকিছু বিষয় নিয়ে কথা বলি।

                    অদ্ভুত মূর্তি - হয়সালেশ্বর

এই অপরূপ স্থাপত্য ভাস্কর্য তো অনেক মন্দিরেই লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এখানে কিছু অদ্ভুত মূর্তি রয়েছে। যেমন, একজন ব্যক্তি চোখে দূরবীন জাতীয় কোনও কিছু লাগিয়ে এক চোখ বন্ধ করে কিছু দেখছেন, আবার একদল মূর্তি অদ্ভুত পোশাক পরে রয়েছেন অনেকটা বর্তমান মহাকাশচারীদের মত। তৎকালীন সময়ে এরকম আধুনিক বিষয়ের কল্পনা করাও কি সম্ভব? এছাড়াও এখানে আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় দেখা যায়, সেটা হলো পাথর কাটার সূক্ষ্মতা।

                হয়সালেশ্বর মন্দিরের একটি স্তম্ভ

লম্বা লম্বা স্তম্ভগুলির গায়ে অতি সূক্ষ্ম অসংখ্য বৃত্তাকার অংশ দেখা যায় যেগুলি ছেনি হাতুড়ি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। আবার একেকটি মূর্তির গায়ে ও মাথায় এমনভাবে পাথর কেটে অলঙ্কার, মুকুট ইত্যাদি তৈরী করা হয়েছে যা ৩ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট ছোট ছিদ্র বিশিষ্ট।

       অতি সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত মূর্তি ,হয়সালেশ্বর

অনেকেই মনে করেন বর্তমানের অত্যাধুনিক লেদ মেশিনের মতো কোন যন্ত্র ছাড়া এত সূক্ষ্ম ছিদ্র ও পাথর কাটার কাজ সম্ভব নয়। কিন্তু এখানেও সেই একই প্রশ্ন ৯০০ বছর আগে কি এত আধুনিক মেশিনের ব্যবহার ছিল! আমাদের প্রচলিত ইতিহাস তো তা স্বীকার করে না। কিন্তু নিজের চোখকেও তো অস্বীকার করা চলে না। তাহলে কি করে সম্ভব হলো এই সৃষ্টি! উত্তর অজানা!


ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় কিছু সূর্য মন্দির আছে। তার মধ্যে গুজরাটের সূর্য মন্দির ও উড়িষ্যার কোনারক অন্যতম। আনুমানিক ৭৭০ বছর আগে কোনার্কের মন্দির তৈরী হয়। এই মন্দিরটিও ভাস্কর্যের প্রাচুর্যে ভরপুর। পাথর দিয়ে তৈরি একটি ১০০ ফুট উঁচু রথ, তাতে বিশাল বিশাল চক্র ও ঘোড়ার মূর্তি। সর্বমোট ২৪ টি চক্র এই মন্দিরে রয়েছে। বলা হয় সূর্য মন্দির আজকের দিনের মত সাধারণ মন্দির নয়, এগুলি বিদ্যাচর্চার, বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞানের মডেল।

এখানে ২৪ টি চক্র দিয়ে দিনের ২৪ ঘন্টার হিসাব বোঝানো হয় এবং সূর্য ঘড়ির মতো একেকটি চক্রকে বোঝানো হয়েছে। এই সময়ের হিসাব ও দিন রাত্রির হিসাব যে ভারতবর্ষেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আমরা সবাই জানি পৃথিবীকে সময় ও অঙ্কের হিসাব ভারত প্রথম জানিয়েছিল। অনেকের মতে এখানে সূর্যকে মূর্তি রূপে কল্পনা করে সাতটি ঘোড়ায় টানা রথে তার পরিভ্রমণ বোঝাতে এমন মূর্তির ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে শিল্পগুণ ও সৌন্দর্যও একইরকম ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কর্ণাটকের হাম্পি তে সাজানো রয়েছে আরেক বিস্ময়। সেখানের বিজয় বিট্ঠল মন্দিরে রয়েছে মিউজিক্যাল পিলার, মানে যার পিলারগুলোতে আঘাত করলে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ হয়।

বলা হয় রাজা দেবরায়ের আমলে আনুমানিক ৫০০ বছর আগে এই মন্দিরটি তৈরী হয়েছে। এখানে ৫৬ টি মিউজিক্যাল পিলারের সন্ধান পাওয়া যায়। একে অনেকে সা-রে-গা-মা পিলারও বলেন, কারণ একেকটি স্তম্ভের চারপাশে সাতটি অপেক্ষাকৃত সরু স্তম্ভ আছে, যেগুলিকে আঘাত করলে গানের যে সাত সুর (সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি) আছে সেরকম সুর তৈরী হয়। একটি ভাস্কর্যে দেখা যায় একজন মানুষ একটি ঢোল নিয়ে রয়েছেন। সেই ঢোলে আঘাত করলে আশ্চর্যজনক ভাবে ঢোলের বা ড্রামের শব্দ হয়। প্রত্যেকটি পিলার কিন্তু একই রকম দেখতে গ্রানাইট পাথর দিয়ে বানানো। অথচ প্রত্যেকটা থেকে এমন বিভিন্ন সুর ও শব্দ কী করে তৈরি হচ্ছে সে এক আশ্চর্যের কথা। ইংরেজ আমলে কিছু সাহেব এমন অদ্ভুত পিলার দেখে আশ্চর্য হয়ে এই পিলারগুলোর মধ্যে থেকে দুটি পিলার খুলে নিয়ে যান পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। কিন্তু তাঁরা সেগুলোর মধ্যে কোনও তফাৎ খুঁজে পাননি। একই পদার্থ দিয়ে তৈরি একইরকম আকার ও আয়তনের স্তম্ভকে কোন পদ্ধতি ও পরিমাপের তারতম্য অনুসারে বানিয়ে এমন ভিন্ন ভিন্ন শব্দ তৈরি হচ্ছে, তা আজও বিস্ময়।

কয়েকটি মন্দির নিয়ে আলোচনা হলো মাত্র। এছাড়াও আরো অনেক অনেক মন্দির স্থাপত্য সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে যাদের সম্পর্কে বলেও শেষ করা যায় না। কখনো সময় সুযোগ হলে তোমরা দেখে এসো আর লিখে ফেলো তোমাদের অভিজ্ঞতার কথা। কিশলয় তো রইলো তোমাদের জন্য। আরেকটি কথা মনে রাখা দরকার যে এই সমস্ত প্রাচীন মন্দিরগুলি কিন্তু মোটেও ধর্ম চর্চার জায়গা ছিল না। এগুলি ভারতীয় আদর্শ, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল। বর্তমান সাধারণ মন্দিরের সাথে এই সমস্ত মন্দিরকে গুলিয়ে ফেললে ভুল হয়। এগুলি অনেক চিন্তাভাবনা ও প্রাচীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি। সেগুলি বুঝতে হলে অনেক গভীরে গবেষণার প্রয়োজন। আধুনিক ভাষায় এই স্থাপত্য ভাস্কর্য রীতির বিষয়ে পড়াশোনাকে বলে "iconography"; সম্ভব হলে কোনওদিন সে বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। আসলে আজকের ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে প্রাচীন ভারতকে বোঝা খুব কঠিন। বারবার বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে আমাদের দেশীয় বিদ্যা চর্চার কেন্দ্রগুলি ও সমাজের প্রতিরূপ মন্দিরগুলি ভীষণ ভাবে আক্রমণের মুখে পড়ে। প্রচুর মন্দির, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ধ্বংস হয়েছে, তা সত্ত্বেও অদ্ভুত পদ্ধতিতে তৈরী পাথরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। অনেক উদাহরণ দেশ জুড়ে আজও রয়েছে। যে কয়েকটি উদাহরণ তোমাদের সামনে তুলে ধরলাম তা থেকে এটুকু বুঝতে হয়তো সুবিধা হবে যে আমাদের দেশ কত উন্নত ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরাধীন হয়েছি, অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতিকে বুঝতে চাইলে এই মন্দিরগুলি সম্পর্কে জানা উচিত। যুক্তি, দর্শন এমনকি গ্রন্থ সম্পর্কেও সন্দেহ আসতে পারে কিন্তু স্থাপত্য ভাস্কর্য সূর্যের মতই জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রমাণ, দ্বিধাহীন সত্য। স্থাপত্যকে জানলে, নিজের দেশের প্রাচুর্যকে কিছুটা জানা হয়। তখন জানার ইচ্ছে আরো বাড়তে থাকে আর পরম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় বলতে গর্ব হয়, "আমরা ভারতবাসী।"


তথ্য সূত্র:-

১) মহাভারত - হিন্দী অনুবাদ সহিত - গীতাপ্রেস

২) Ancient Indian Architecture - from blossom to bloom - Dr. sanjeeb Maheswari & Dr. Rajib Garg

৩) Temple architecture and sculpture - NCERT

৪) Phenomenal travel videos (youtube channel) - Praveen Mohan


ছবি : শাশ্বত বসু
হাম্পি ও কোনার্ক : গুগল

2 comments:

  1. অসাধারণ শাশ্বত দা, আপনার লেখা পড়লেই কত কিছু জানতে পারি। খুব খুব ইচ্ছে আছে এইসব জায়গা ঘুরে দেখার। আরও বিশদে শুনব একদিন সব আপনার থেকে।

    ReplyDelete
  2. 👽 👧 reform o'clock Digo back IDKchick flick clock health IDK slick ramen rack smell hip-hop Am given to hief if though IDK

    ReplyDelete