বিবিধ নিবন্ধ : দিশারী : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী




স্কুল থেকে ফিরে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সোফার ওপর ধপাস করে বসে পড়লো পুপুন ওরফে সাম্য চ্যাটার্জী। স্কুলের টিচারদের নতুন নতুন বায়নাক্কার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে, ক্লাবের মাঠে ক্রিকেট-ফুটবল বা ভুট্টোদের ভূতুড়ে ভাঙা বাড়িতে লুকোচুরি খেলা, টিভিতে টম অ্যান্ড জেরী দেখা, তুতুলদের বাড়িতে ক্যারামের আসর সব বন্ধ হয়ে আসছে একে একে। বাকিদেরও অবস্থা যে এর থেকে খুব যে আলাদা, তা নয়। ক্লাস সেভেনের ছাত্র পুপুন, স্কুলের পর এক্সট্রা ক্লাস করে যখন বাড়ি ফেরে, খেলার ইচ্ছা থাকলেও সঙ্গী জোটে না,কারণ সবাই তো কোনো না কোনো টিউশনে ব্যস্ত।

বাড়ি এসে যে একটু কার্টুন দেখবে তারও উপায় নেই, সোমবার আর শুক্রবার থাকে ক্যারাটের ক্লাস, মঙ্গলবার ড্রইং টিচার আসেন, আর বুধবার, বৃহস্পতিবার অঙ্ক আর সায়েন্সের স্পেশাল টিউশন। ক্লাস টেনের পর, সায়েন্স নিয়ে না পড়লে নাকি ভবিষ্যৎ অন্ধকার, তাই চাকুরিজীবী পুপুনের বাবা-মা এই বন্দোবস্ত করেছেন। শনিবারটুকু তাও দাদা আসে বাড়ি, হোস্টেল থেকে, ওর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, খুনসুটি করে, টিভি দেখে সময় কেটে যায়, নাহলে রবিবার বাবা মায়ের দুজনেরই ছুটি, আর ওদের সারাদিন কেবল খবরের চ্যানেল দেখতে ইচ্ছা হয়। ব্যস! টিভি দেখার আশায় ছাই দুই ভাইয়ের। এত খুনজখম আর মিছিল-মিটিংয়ের নিউজ দেখে কোন লাভ যে আখেরে হয় তা বোঝা দুঃসাধ্য, প্রশ্ন করলে বলে,"তোমরা এখনো ছোট, এসব বোঝার বয়স হয়নি!”, ধুত্তোর, আর ভাল্লাগেনা!

গোদের ওপর বিষফোঁড়া, পরশু স্বাধীনতা দিবসের দিন স্কুলে সারাদিন নানারকম প্রতিযোগিতার আয়োজন। এফ ব্লকের বিল্টু, তাতাই সবাই মিলে প্ল্যান করেছিল, প্যারেড করে ছুটি হয়ে গেলে, ঘুড়ি ওড়াবে সবাই মিলে, সব ভেস্তে গেল।

তার বদলে মুখে চামচ নিয়ে তাতে চেরিফল ধরে রেখে লাগাতে হবে দৌড়। ইশ! চেরি এমনিতেই ভালো লাগে না পুপুনের। কিন্তু সে তাও একরকম, সমস্যা হয়েছে স্পিচ কম্পিটিশন নিয়ে। বিপ্লবীদের নিয়ে কিছু কিছু তথ্যসমৃদ্ধ, স্বল্পসময়ের বক্তৃতা দিতে হবে,হিস্ট্রি বইয়ে যা লেখা আছে তার বাইরে থেকে,এই হচ্ছে কম্পিটিশনের নিয়ম। এসব সে এখন পাবে কোথায়! বাবা-মায়ের সময় নেই, ওদের বললে বলবে স্কুলের টিচারদের জিজ্ঞাসা করে নিও, আর ওখানেই গোলমাল। হিস্ট্রি টিচার,ভাস্বতী ম্যাম এমনিতেই পুপুনদের গ্রুপটাকে সুনজরে দেখেন না, কেবল কথায় কথায় চটে যান , তাই কোনো প্রয়োজন থাকলেও ওঁর কাছে যেতে একটুও ইচ্ছা করে না ওদের। কাছে দাদা থাকলে তাও গুগলে দেখে বলে দিত, সেও পরীক্ষার জন্য আসছে না, তাই নিজেই বসলো কিছুক্ষণ বাড়ির কম্পিউটার চালিয়ে, কিন্তু নানারকম ভাবে গুগল করেও সেই গান্ধী-নেহেরু আর নেতাজির কথা ছাড়া সেইভাবে কিছু পেলো না। ওই সব তো হিস্ট্রি বইতেও আছে, কিন্তু ওর বাইরে খুঁজতে হলে ঠিকঠাক নাম জানা প্রয়োজন, তাও জানা নেই।

উপায় কিছু বের করতেই হবে, এইরকম ভাবনা চিন্তা যখন চলছিল,এমন সময় বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই, তাতানের গলা, “পুপুন আমার দাদু এসেছে, মা মালপোয়া বানাচ্ছে, চট করে চলে আয়”।

মালপোয়া খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েই, পুপুনের প্রচণ্ড ব্যাজার মেজাজ নিমেষেই ফুরফুরে হয়ে গেল, হাত মুখ ধুয়ে সময় নষ্ট না করে, প্রায় ছুটেই বেরোলো, পাশের ব্লকের বিল্ডিংয়ে থাকা তাতানের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে, কোনওরকমে বাড়িতে চাবি লাগিয়ে।

পৌঁছে দেখে মালপোয়ার গন্ধে, ঘর ভরপুর, তবে বানানো শেষ হয়নি, তাই তাতান দাদুর কাছে বসে গল্প করছে। সেও বসে গেল সঙ্গে। এই কথা, সেই কথার পর, স্কুলের প্রসঙ্গ আসতেই, তাতান আর পুপুনের অভিযোগের পর অভিযোগ শুরু হলো স্কুলের বিরুদ্ধে, দুজনেই ক্লাসমেট, তাই একই সমস্যাতে জেরবার। দুই কিশোরই ক্লাস টিচারের নতুন দাবির কথা জানাতে, দাদু সান্তা ক্লজের মতো হো হো করে হাসতে থাকলে, এরা দুজন কিছুই ঠাহর করতে না পেরে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।

হাসি থামিয়ে দাদু বললেন, “আচ্ছা, এই কথা! বেশ আমি তোমাদের দুজনের জন্যেই কয়েকটা গল্প বলবো, নিজেরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিও, এর থেকে কে কোনটা স্কুলে বলবে, তা হলেই হয়ে যাবে।” দুজনেই মহাখুশি, গুছিয়ে বসলো দাদুর দুই পাশে।

গরম, মুচমুচে মালপোয়াতে এক কামড় বসিয়ে, দাদুও বলতে শুরু করলেন।


“সে বহু আগেকার কথা, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়, আঞ্চলিক শক্তিরা শাসন করছে তখন।

বিথুর পরগণার মন্ত্রী, যাদের মারাঠি ভাষায় বলা হতো পেশোয়া, তার সভার উপদেষ্টামণ্ডলীর বিচক্ষণ সদস্য ছিলেন মোরোপন্থ তাম্বে। তাঁর একমাত্র মেয়ে, মাত্র চার বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে বাবার তত্ত্বাবধানে বড় হতে লাগলো। পোশাকি নাম ‘মণিকর্নিকা’ হলেও, আদর করে ডাকা হয় ‘মন্নু’, তবে দস্যিপনার জন্যে কেউ কেউ ‘ছাবিলি’ বলেও ডাকে। দুই অসমবয়সী বন্ধু, ধোন্দু পান্থ আর রামচন্দ্র পাণ্ডুরং টোপে’এর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে খেলতে গিয়ে একদিন ঘটে গেল বিপদ। ক্ষিপ্ত ঘোড়া, ধোন্দুকে ফেলে তো দিলোই, লাফাতে লাফাতে পিষেই বুঝি দেয় তাকে, এমন সময় মন্নু তড়িৎগতিতে ঘোড়া থেকে নেমে এসে ঘোড়ার পা টেনে সরিয়ে, ধোন্দুকে বের করে আনে ওর নিচে থেকে। ভীত-সন্ত্রস্ত ধোন্দু গুরুতরভাবে আহত হয়ে কাঁপতে থাকলেও, সাহসী মন্নু তাকে এই বলে বোঝাতে থাকে, যে চোট খুব সাংঘাতিক কিছু নয়, একদিনেই সেরে যাবে। মন্নু নিজেও আহত হয়েছিল, কিন্তু সেসব দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বন্ধুকে সাহস জোগাতে থাকে, কিছুদিনের মধ্যে দুজনেই সেরে ওঠে।



এরপরেও আরেকবার এক ক্ষিপ্ত হাতিকেও অসম্ভব দুঃসাহস দেখিয়ে, শান্ত করে মন্নু। বড় হতে হতে তলোয়ার চালানো, তীরন্দাজি সবেতেই দক্ষতা অর্জন করে এই মন্নু, ওরফে মণিকর্নিকা। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে মন্নুকে বিয়ে করেন ঝাঁসির মহারাজা রাজা গঙ্গাধর রাও নেওয়ালকার। কিন্তু সুখের জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয় না, এক ছেলে শৈশবেই মারা গেলে, মহারাজা তার ভাইয়ের ছেলেকে দত্তক নেন রাজত্ব রক্ষা করতে। মহারাজের মৃত্যুর পর বালক রাজকুমার দামোদর রাওকে রাজা ঘোষণা করা হলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ শাসকরা তা আমল দিতে অস্বীকার করেন, এবং ষাট হাজার টাকা মাসোহারার বদলে রাজ্যপাট ত্যাগ করতে পরামর্শ দেন। সময়টা ১৮৫৭, একেই টালমাটাল চারিদিক, রাইফেলের কার্তুজে গরু-শুয়োরের চর্বি লাগানো থাকে এরকম কথা শুনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিপাইরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, শুরু হয় প্রচণ্ড সংঘর্ষ। এরই মধ্যে ইংরেজ লর্ড ডালহৌসির ভ্রান্ত নীতির বলি হওয়া থেকে, ঝাঁসির রাজত্বকে রক্ষা করতে অস্ত্র ধরেন মনিকর্নিকা। নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, লড়তে লড়তে প্রাণ দেন তিনি। এঁকে অবশ্য আমরা এখন অন্য নামে চিনি…”

“ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ” চিৎকার করে উঠলো তাতান।

“বাহ্, কি করে জানলি?” পুপুনের গলায় বিস্ময় প্রকট, বইয়ের পাতার ধারকাছ দিয়ে যায় না তাতান, কী করে সম্ভব হলো তাহলে! তাছাড়া ওদের হিস্ট্রি বইতে এত্ত গল্প তো লেখা নেই।

“আরে এই গল্প নিয়েই তো কঙ্গনা রানাওয়াতের সিনেমা বেরোচ্ছে।” হাসতে হাসতে বলে তাতান, আর ওর উত্তর শুনে বাকি দুজনও হাসতে থাকে।

দাদু আবার শুরু করলেন,”ধোন্দু আর রামচন্দ্রকেও তোরা চিনিস, তবে অন্য নামে, একজন নানা সাহেব, আরেকজন তাঁতিয়া টোপে। এরা তিনজনেই সিপাহী বিদ্রোহের পুরোধা হিসেবে কাজ করেছেন, এবং ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তেই লক্ষ্মীবাঈ প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁর সাহসে, দুর্দমনীয় মনোভাবে, অপরপক্ষে থাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরাও অবাক হয়ে গিয়েছিল। তাঁর বীরত্বের কথা মাথায় রেখেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা রেজিমেন্টের নাম রেখেছিলেন ঝাঁসি কি রাণী রেজিমেন্ট।


এবার বলি শোন, আরেকজনের কথা, স্কুলে আড্ডাবাজ কিন্তু মেধাবী বলে পরিচিত উত্তর কলকাতার দত্তবাড়ির এই ছেলে সঠিক উত্তর দেওয়া সত্ত্বেও বেতের মার জুটলো স্কুলে, ভূগোলের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। ছেলেটি যত বলে সে যা উত্তর দিয়েছে, তা নির্ভুল, মারের তীব্রতা ততই বাড়ে। অবশেষে ছাড়া পেয়ে, প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বাড়ি ফিরে মা’কে সব জানালে, মা তাকে বলেন, "তুমি যা বলেছ, তা তো মিথ্যে নয়, তাই যে যাই বলুক, দুঃখ করছো কেন। সত্যের জন্যে সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনোকিছুর জন্যে সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।"


মায়ের এই শিক্ষা ভোলেনি সেই ছেলেটি, পরবর্তীকালে আরেকটি এরকম ঘটনা তার প্রমাণ। পারদর্শী বক্তা নরেন্দ্রনাথ যখন গল্প বলা শুরু করতো, শিক্ষক কি পড়াচ্ছেন সে সব ছেড়ে, বন্ধুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই দিকেই মগ্ন হয়ে গেলেও, নরেন্দ্রনাথ দুই দিকে সমান মনোযোগ রেখে চলতো। এরকমই এক দিন, গল্পের গুনগুন শিক্ষকের কানে যেতে একে একে তিনি পড়া ধরা শুরু করলেন এবং পড়া না শুনে গল্প করার শাস্তিস্বরূপ দাঁড় করিয়ে দিতে লাগলেন। একে একে সবার পালা হয়ে নরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নির্ভুল উত্তর দিলেও বাকিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিক্ষক এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, পড়া পারলেও, তিনি যে গল্প করছিলেন একথা তো মিথ্যা নয়, তাই তাঁরও শাস্তি প্রাপ্য।…”

“ইনি বিবেকানন্দ, আমি জানি।” পুপুন বলল।

“ঠিক বলেছ দাদুভাই। ভবিষ্যতে আরেকজনের মধ্যেও মায়ের এই শিক্ষা তিনি দেখেছিলেন, এবং তাই অনেক পরীক্ষার পরে, তাঁকেই গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। ওঁর ভাবাদর্শেই তো রামকৃষ্ণ মিশন তৈরি, যেখানে তাতানের মামাতো দাদা বান্টি পড়াশোনা করে। জানো, শিকাগোতে যখন গিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, তখন অনুষ্ঠানসূচিতে তাঁর বক্তৃতা সবার শেষে রাখা হতো, কারণ প্রথমেই তাঁর বক্তৃতা হয়ে গেলে দর্শকেরা সবাই চলে যেত, বাকিদের কথা শোনার জন্য কাউকে বসিয়ে রাখা যেত না। "সবশেষে স্বামী বিবেকানন্দ কিছু বলবেন", এইটুকু ঘোষণা ছিল যথেষ্ট, সবাইকে ধৈর্য্য ধরে বসিয়ে রাখার জন্যে।”

“দুজন হলো, আর এই দুটো আমার কিন্তু!” তাতান আবদারের স্বরে বললো।

“এবার তুমি যা যা বলবে সেগুলো পুপুনের, আমার এর চেয়ে বেশি আর মনেও থাকবে না।” বলেই দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে দুটো মালপোয়া তুলে নিলো সে।

পুপুন আর দাদু দুজনেই হেসে উঠলো তাতানের কাণ্ড দেখে, দাদু আবার বলতে শুরু করলেন।


“বেশ, এবার তাহলে পুপুনবাবু, মন দিয়ে শোনো। পরাধীন ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের এক গ্রামের কথা বলছি। ছোট্ট ছেলেটি বাবার হাত ধরে গ্রামের মধ্যেই বেড়াতে বেরিয়েছিল। পরিচিত এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়ায় বাবা দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করলেন, ছেলে নেই পাশে, বাবার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে মাটি খুঁড়ছে আপনমনে। জিজ্ঞাসা করা হলে ছেলে জানায়, বন্দুকের গাছ লাগাবে সে, যাতে বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব না থাকে। সরল শিশুমনের আপাতভাবে অবান্তর চিন্তা সেদিনই ইঙ্গিত করেছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থাকা বাঙ্গা গ্রামের বিপ্লবী কিষান সিংয়ের এই সন্তান, ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক শক্ত খুঁটি হয়ে উঠবে। কিষান ও তাঁর ভাই অজিত সিং দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন, এবং তাই বাড়িতে ইংরেজ শাসক বিরোধী পরিবেশেই বড় হয়ে উঠছিল ছোট্ট ছেলেটি।


ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি অনুগত হওয়ায় খালসা হাই স্কুলের কর্তৃপক্ষকে বিশেষ পছন্দ ছিলো না এই পরিবারের, তাই দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্যসমাজের স্কুলে ভর্তি হয় ছেলেটি। ক্লাসে একদিন যখন সবাই বড় হয়ে কে কী হবে তাই নিয়ে কথাবার্তা চলছে, কেউ বলছে ডাক্তার, কেউ সরকারি অফিসার, কেউ বা আবার ব্যবসায়ী হবে, এইসব বলছে, ছেলেটি নির্দ্বিধায় বললো, "এইসব তো সামান্য ব্যাপার, আমি ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করবো। বিপ্লবী হবো।" এর পরে বড় হয়ে বহুবার ইংরেজ পুলিশদের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেছেন ছদ্মবেশ ধরে, কিন্তু চেনা তো দূর, সন্দেহ পর্যন্ত করেনি কেউ।”

তাতান, পুপুন একে অপরের দিকে চেয়ে উত্তর না পেয়ে, দাদুর দিকে ফিরে তাকাতে তিনিই বললেন, "এই ছেলে হলেন শহীদ ভগৎ সিং, জেনারেল সৌন্ডার্সকে খুন এবং দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।”

“আচ্ছা অজয় দেবগণের সিনেমার কথা বলছো।”

তাতান বলে। দাদু আর পুপুন মুখ টিপে হাসতে হাসতে তাতানের মায়ের গলা পায়, “হ্যাঁ কেবল টিভি আর সিনেমা, এই তো আছে তোর জীবনে, পুপুনকে দেখে কিছু শেখ।”

তাতানকে দেখে অবশ্য বোঝা গেল সে পাত্তা দেয়নি, বরং গুছিয়ে বসে আরেকটা মালপোয়া চালান হলো মুখে।


দাদু আবার শুরু করলেন,”এবারে যাঁর কথা বলবো তাঁর কথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তোরা হয়তো নামও শুনিসনি।


মাস্টারদা সূর্য্য সেনের সহকারী হিসেবে কাজ করার আগে থেকে ইনি বিভিন্ন ইংরেজ বিরোধী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জানিস, ইনি আবার ছোটবেলায় ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের গল্প শুনে শুনে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হতেন। চট্টগ্রামের এক ক্লার্কের ঘরে পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন এই প্রীতিলতা, ডাকনাম ‘রানি’। অসম্ভব মেধাবী ছাত্রী আর দুঃসাহসী এই মানুষটির গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি, ব্রিটিশ সরকারের বিপক্ষে যাওয়ায়, তাঁর সার্টিফিকেট তাঁকে দেওয়া হয়নি। জালালাবাদের পাহাড়ে বিপ্লবীদের নৃশংসভাবে মেরে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতে, পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাবে আগুন লাগিয়ে দেন তিনি আর তাঁর সঙ্গীরা, পাঞ্জাবী যুবকের ছদ্মবেশ ধারণ করে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কিন্ত ধরা দেবেন না এই মনস্থির করেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কলকাতা ময়দানের কাছে এক মূর্তিও আছে এঁর।”


দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে নিশ্চুপ হয়ে গেছে দেখে নৈঃশব্দ্য ভাঙতে এবারও দাদুই প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা বল তো ভারতের কনিষ্ঠতম শহীদ কে?”

“ক্ষুদিরাম বসু” সমস্বরে উত্তর দিলো দুই বন্ধু।

“না রে, আমরা একটু ভুল জানি, ব্রাহ্মণী নদীর এক মাঝির ছেলে বাজী রাউৎ হলেন ভারতবর্ষের সর্বকনিষ্ঠ শহীদ।


১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ পুলিশরা ওড়িশার ভুবন গ্রাম থেকে সাধারণ নিরপরাধ কিছু মানুষকে প্রজামণ্ডল নামক বিপ্লবী সংগঠনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। প্রজামণ্ডলের কিছু নেতা এর প্রতিবাদে পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করে, এবং ক্ষিপ্ত জনতাকে শান্ত না করতে পেরে, পুলিশ গুলি চালালে দু’জন মারা যায়। জনতা আরো ক্ষেপে যায়, পুলিশরা এই অবস্থায় নীলকণ্ঠপুর ঘাট হয়ে ধেনকানাল পালাতে চেয়ে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ওই ঘাটে এসে উপস্থিত হয়। সমস্ত ঘটনার খবর পাওয়া বাজী ব্রিটিশ পুলিশকে ঘাট পারাপার করাবে না এই জেদ নিয়ে প্রথমে তর্কবিতর্ক এবং তার থেকে পুলিশ ক্ষেপে গিয়ে তার ও তার চার সঙ্গীর ওপর গুলি চালায়, যার পরিণাম মাত্র বারো বছর বয়সে মৃত্যু।”

গোলগোল চোখ করে তাতান প্রশ্ন করে “আচ্ছা দাদু, একটা কথা বলো, এই যে তুমি এত্ত গল্প বললে, তুমি কোথা থেকে জেনেছো? গুগল করলে?”

“না না, আমি খুব বই পড়তে ভালোবাসি ভাই। বই পড়ে পড়ে জেনেছি, আমাদের সময়ে গুগল কোথায় ছিল?” সহাস্যে জবাব দাদুর।

গল্প করতে করতে খেয়াল করে ওঠা হয়নি, কখন সাতটা বেজে গেছে, আজ পড়তে যাওয়া হলো না , বাবা -মায়েরও ফেরার সময় হয়ে যাওয়ায় হাতে দুটো মালপোয়া নিয়ে পুপুন পা বাড়ালো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। পড়তে যাওয়া হয়নি বলে বকুনি নাচছে কপালে, কিন্তু একটা টেনশন আর নেই, তাতানের দাদুর দেওয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে, ওর আর তাতানের প্রতিযোগিতায় হিরো হওয়া পাকা করা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে, সব ক'টা তথ্য গুছিয়ে লিখতে বসলো পুপুন, আর মনে মনে এটাও ঠিক করলো, আসছে পুজোয় জামা নয়, খানকতক বই চাইবে উপহারে।

(সমাপ্ত )


তথ্যসূত্র :

www.hindujagruti.org, youtube, www.nuaodisha.com, www.historydiscussion.net, wikipedia, www.towardsfreedom.in

9 comments:

  1. বেশ ভালো হয়েছে, অনেক ছোট ছোট অজানা তথ্য জানতে পারলাম। :)

    ReplyDelete
  2. Khub bhalo laglo lekhata pore...onek kichu janlam

    ReplyDelete
  3. pupun r tatan r sathe sathe amio onek kichu janlum

    ReplyDelete
  4. দারুণ লিখেছিস রে স্বর্ণ। খুব ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম 😊

    ReplyDelete