গল্পের ঝুলি : ভজামামা ও গন্ধবিচার : হিমাংশু চৌধুরী





"তোদের আজ একটা অমূল্য জিনিস দেখাবো, দাঁড়া।" এই বলে ভজামামা সযত্নে তার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা এবড়োখেবড়ো পাথরের টুকরো বের করে আমাদের হাতে দিলো।

রোজকার মতো সেদিনও আমরা আড্ডা মারছিলাম রেলপুকুরের মাঠে বটতলার নীচে বসে। ভজামামা একটু দেরি করে ঢুকেই ওপরের ঘোষণাটা করলো।

"কী এটা? দেখি দেখি!" বলে টাবলু ভজামামার হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ঘোষণা করলো, "দেখে তো মনে হচ্ছে রেললাইনের ধার থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছো। কী এটা?"

"রেললাইনের ধার থেকে! ব্যাটা অলম্বুষ! তুই জানিস এটার মূল্য?"

গল্পের গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে। ভজামামাকে একটু তাতিয়ে দেবার জন্য বললাম, "একটা পেপারওয়েটের আর কত দাম হবে? দশ-বিশ টাকা ম্যাক্সিমাম। "

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ভজামামা শুরু করলো, "শোন তবে।"


১৯৬৫ সাল, চীন ভারত যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। আমি তখন লিমুলাস কাঁকড়ার খোঁজে বাহামার উত্তরে ছোট ছোট দ্বীপগুলোর সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সঙ্গী বলতে একটা ছোট মোটরবোট আর রিকার্ডো। রিকার্ডো স্প্যানিশ প্রসপেক্টর। মোটরবোটটা আমার, আর আমাকে দ্বীপগুলো চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ওর। আমাদের আলাপ হয়েছে নাসাউতে। ওর সাথে চুক্তি হয়েছে, আমি করবো কাঁকড়ার খোঁজ, আর ও করবে ওই পাথুরে দ্বীপগুলোতে সেমিপ্রেশাস পাথরের খোঁজ। খরচ আধাআধি। সেমিপ্রেশাস পাথর কাকে বলে জানিস তো তোরা?"

"না ভজামামা", আমরা সমস্বরে বললাম।

"শোন, সেমিপ্রেশাস স্টোন হলো প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এরকম কিছু রঙবেরঙ এর পাথর, যা গয়না তৈরিতে ব্যবহার হয় অথবা গ্রহরত্ন হিসেবে ধারণ করা হয়। যেমন, রুবি, নীলা, মুনস্টোন, অ্যামেথিস্ট, গোমেদ, চুনি, পান্না ইত্যাদি। সাধারণত এগুলো আগ্নেয় শিলাতেই বেশি পাওয়া যায়। আর জানিস তো, উত্তর বাহামা দ্বীপপুঞ্জের অধিকাংশ দ্বীপই মগ্ন আগ্নেয়গিরির চূড়া। অবশ্য কিছু কোরাল এটলও আছে। ফলে এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে এই ধরণের দামী পাথর পাওয়া যায়। তা রিকার্ডো বাহামা সরকারের কাছ থেকে এইসব দ্বীপে প্রসপেক্টিং করার লাইসেন্স নিয়েছিলো। আমার লাইসেন্সের ব্যাপার নেই, কারণ আমি খালি ম্যাপিং করবো, লিমুলাস কোথায় কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, ওদের গতিবিধি রেকর্ড করবো শুধু। কেনই বা ওরা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডিম পাড়ার জন্য প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার উজিয়ে কতগুলো নির্দিষ্ট জায়গাতেই যায়, সেই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা চালাচ্ছি তখন আমি।

গোটাকতক দ্বীপ ঘুরে শেষতক অনামা এই দ্বীপে সেদিন নোঙর ফেলেছি। জনমানবশূন্য পাথুরে দ্বীপ, গাছপালাও খুবই কম, দুচারটে ছোট ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝখানে একটা অনতিউচ্চ টিলা, আর তীরভূমি খুবই সংকীর্ণ। সমুদ্রের বিশ ফুট দূর থেকেই শুরু হয়েছে পাথুরে জমি। রিকার্ডো দ্বীপে নেমেই বোঁ করে চলে গেলো উত্তর দিকে টিলাটার ওপারে। আমি খাবারদাবার নামিয়ে নিলাম বোট থেকে, আর তাঁবুটা। তাঁবু খাটাতে গিয়ে দেখি, তাঁবুর খোঁটাগুলো জমিটা ঢোকানো যাচ্ছে না, এত শক্ত পাথুরে জমি। এদিক ওদিক খোঁজার পরে আমি যা খুঁজছি তা দেখতে পেলাম। সমুদ্রের ধারে কয়েকটা বড় বড় ছাইরঙা পাথর পড়ে রয়েছে। সাইজে বড় হলেও আনুপাতিক ওজন বেশ কম। দেখেশুনে ছ'টা বেশ বড়সড় পাথর তুলে নিয়ে এসে তাঁবুর দড়িগুলো তাতে বেঁধে যখন খাড়া হলাম, তখন সূর্য মধ্যগগনে। আমি খাতাপত্র নিয়ে লেগে পড়লাম কাজে। তীরভূমি শেষ হয়ে যেখানে পাথুরে জমি শুরু হচ্ছে, সেখানেই কাঁকড়াগুলো বাসা বেঁধেছে। সারাদিন ধরে ওদের গতিবিধি রেকর্ড করে লিপিবদ্ধ করলাম। সন্ধ্যা নেমে আসলে স্টোভ জ্বালিয়ে টিনের খাবার গরম করতে না করতেই রিকার্ডো এসে হাজির।

_নাঃ, মুকাজ্জি, এখানেও বিশেষ কিছু নেই, গর্ত খোঁড়ার মজুরি পোষাবে না। কাল পরশু চলো আরো ক'টা দ্বীপ ঘুরে নিই। এতক্ষণে রিকার্ডোর চোখ পড়লো তাঁবুর খুঁটো লাগানো পাথরগুলোর উপরে। নেড়েচেড়ে দেখে বললো,

_এগুলো কি পাথর জানো মুকাজ্জি?

_কি জানি, পড়ে তো ছিলো সমুদ্রের ধারে।

_হুম।


রাতে শুয়ে আছি তাঁবুতে, অনেকক্ষণ ধরেই খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে, খুব একটা গ্রাহ্য করছি না। কিন্তু যখন হু হু করে সামুদ্রিক হাওয়া এসে গায়ে লাগলো তখন চোখ না খুলে পারা গেল না। ঠান্ডা লেগে হি হি করে কাঁপছি। চোখ খুলে দেখি, আমার তাঁবু গায়েব, উপরের দিকে আকাশ দেখা যাচ্ছে, ফটফট করছে তারা। রিকার্ডোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার সাথে গায়েব তাঁবু ধরে রাখা পাথরগুলো আর বোটটা। হাওয়ায় তাঁবু উড়ে গিয়ে পড়ে আছে দূরে টিলাটার গায়ে। উঠে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম। জানি একটু পরেই ওকে ফিরতে হবে।

ঊষার প্রথম সূর্যকিরণের সাথেই দেখি দাঁড় টানতে টানতে আসছে রিকার্ডো। বোট কূলে ভিড়িয়েই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ঐ বারো স্টোনের দশাসই চেহারা নিয়ে। বেড়াল যেভাবে ইঁদুর ধরে সেভাবে আমার নড়াটা ধরে চাপ দিতে শুরু করলো। মুখে গালাগালি,

_ব্লাডি নিগার, শিগগির বল গ্যাসোলিনগুলো কী করেছিস? বললে তোর জানটা বকশিস দেবো।

_আর না বললে? কঁকিয়ে কঁকিয়ে প্রশ্ন করি।

_বলবি না মানে? না বললে তোকে সমুদ্রে চুবিয়ে মারবো।


দশফুট দূর থেকে তার শরীরটাকে তুলে এনে বসালাম মাটিতে। তারপরে বোতল থেকে জল ঢেলে ওর মুখে ছিটিয়ে দিলাম। যুযুৎসুর কঠিন প্যাঁচে ধরাশায়ী হয়েছিলো ও। জ্ঞান ফিরলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

_এবারে বলো তো দেখি বাছা, রিকার্ডো তোমার কে হয়?

ক্ষণপূর্বের যুযুৎসুর প্যাঁচের কথা মনে করেই বোধ হয় বললো,

_ভাই, আমার থেকে দু'মিনিটের ছোট। আমার আসল নাম রিচার্ড।

_হুম, যমজ ভাই। অবশ্য হতেই হবে, না হলে ভিসা আর পাসপোর্ট অফিসে ছাড়বে কেন? তা রিকার্ডো এখন কোথায়?

_গত বছর প্রসপেক্টিং করতে গিয়ে ও আমাজনের গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেছে, আর ফেরেনি। ওর লাইসেন্সটা পড়েই ছিলো, ফি-ও দেওয়াই ছিলো। আমি ওর নাম ভাঁড়িয়ে এসেছি, শুধু এটুকুই আমার দোষ।

_আমি যদি বলি রিচার্ড, তুমি তোমার ভাইকে গুমখুন করেছো, তোমার আসল ব্যবসা অ্যাম্বারগ্রীস এর।

বাহামা সরকার তাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করার অনুমতি দেয় না, অথচ দুনিয়ার সেরা অ্যাম্বারগ্রীস পাওয়া যায় এখানেই। তাই দুনিয়া জুড়ে সব চোরাচালানকারীদের নজর এখানেই পড়ে থাকে। গত কয়েকবছর ধরেই এই অ্যাম্বারগ্রীস বাহামা থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছিলো, তাই বাহামা সরকার আমাকে নিযুক্ত করেছে এই চোরাচালান বন্ধ করার জন্য।

যাই হোক, আমি কাজে নেমে দেখলাম, এই ছোট ছোট দ্বীপগুলো থেকে অ্যাম্বারগ্রীস নিয়ে জলপথে তিনশো থেকে চারশো কিমি গেলেই ইউ এস, যেখানকার সুগন্ধি কোম্পানিগুলি বসে আছে অ্যাম্বারগ্রীস কেনার জন্য। এ ছাড়াও ক্যারিবিয়ান হয়ে ফ্রান্সে পাচারের একটা রুটও তৈরি হয়েছে। জগদ্বিদিত সুগন্ধিগুলি সবই ফরাসী কোম্পানির তৈরি। তবে সম্প্রতি বাহামা সরকার অ্যাম্বারগ্রীস পাওয়া যায় জানা আছে, এরকম দ্বীপগুলিতে নজরদারি বাড়ানোয় জোগান কম পড়ে যাচ্ছে। চোরাচালানকারীদের দরকার নতুন সোর্স। আমি জানতাম সমস্ত রসদ নিয়ে বোট ভাড়া কর‍তে হলে তা রাজধানী নাসাউ থেকেই করতে হবে, আর ওখানকার বোট ভাড়া দেবার এজেন্সিগুলো ভালো করে পরিচয়পত্র যাচাই করে পাসপোর্ট জমা রেখে তবেই বোট ভাড়া দেয়, যেটা কিনা স্মাগলাররা করতে পারবে না।

তাই আমি রিসার্চারের ছদ্মবেশে নাসাউতে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। একা বোট ভাড়া নেওয়ার সঙ্গতি নেই, তাই সেথো খুঁজতে লাগলাম। তুমিও এরকমই একটা সুযোগ খুঁজছিলে, তাই লুফে নিলে অফারটা। আসলে আমার পাতা ফাঁদে পা দিলে। তুমি যে রিকার্ডো নও সেটা আমি প্রথম দিনই আন্দাজ করেছিলাম। রিকার্ডো গার্সিয়া সেলভাজ, বিখ্যাত প্রসপেক্টার, আমার পূর্বপরিচিত। আমরা দু'জনে একসাথে ধনদেবতা কুবেরের রত্নভান্ডার খুঁজতে গিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে তিব্বতে। তুমি যখন আমায় চিনতে পারলে না, অথচ নাম বলছো রিকার্ডো গার্সিয়া - তখনই বুঝেছি, তুমি আসলে রিকার্ডো নও, অন্য কেউ নাম ভাঁড়িয়ে রিকার্ডো সেজে ঘুরছো।

তুমি যে প্রসপেক্টিং-এর অছিলায় আসলে অ্যাম্বারগ্রীস কোথায় কোথায় পাওয়া যায় তার ম্যাপিং করছো, সেটাও আমি গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছি। যতই সাংকেতিক স্প্যানিশে নোট নাও না কেন, ও সংকেত আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ব্রেক করতে পারি। তুমি নিজেই যখন ম্যাপিং করতে শুরু করলে, তখন আমি বুঝলাম তুমিই পান্ডা। এই মহামূল্যবান সম্পদের সন্ধান যাতে অন্য কেউ না পায়, তাই তুমি এ কাজের ভার আর কাউকে দাওনি। আহা, আহা, আবার তেড়ে আসার চেষ্টা করছো কেন? 
একটা থাবড়া মেরে ফের ওকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা কর‍তে হবে না, ওই দেখো বাহামা নেভির জাহাজ আসছে, তোমাকে নেবার জন্য। দূর থেকে তখন জাহাজের ভোঁ শোনা যাচ্ছে।

বাই দা ওয়ে, তোরা কি অ্যাম্বারগ্রীস কাকে বলে জানিস?"

"না ভজামামা!" আমরা সমস্বরে বললাম।

"অ্যাম্বারগ্রীস হলো এক ধরনের তিমি মাছের, সাধারণত স্পার্ম তিমির, অন্ত্রে ক্ষরিত রস ঘনীভূত হয়ে তৈরি হওয়া পাথরের মতো একটা জিনিস। এইসব তিমিমাছগুলো অনেক বড়বড় খাবার গিলে ফেলে, যেগুলো তারা পুরো হজম করতে পারে না। এই বর্জ্য পদার্থগুলো তাদের পেটের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় যাতে আটকে না যায়, তাই এদের পিত্তথলি থেকে একধরণের লুব্রিক্যাণ্ট ক্ষরিত হয়। বেশ কিছুদিন পরে এই রসটাই ঘনীভূত হয়ে সলিড হয়- এটাই অ্যাম্বারগ্রীস। সাঙ্ঘাতিক দামী এই অ্যাম্বারগ্রীস কিন্তু সাধারণত তিমির মলের সাথে বা বমির সাথে বেরিয়ে আসে। একদম পাথরের মতো দেখতে হলেও জলের থেকে আপেক্ষিক ঘনত্ব কম হওয়ায় এটা জলে ভাসে।

অ্যাম্বারগ্রীস এত দামী কেন জানিস? কারণ এটা একটা জৈব সুগন্ধি। এমনিতে ফ্রেশ অ্যাম্বারগ্রীস নাকের কাছে নিয়ে শুঁকলে মলের গন্ধ পাওয়া যাবে। কিন্তু মজার কথা হলো, এই অ্যাম্বারগ্রীসই আবার স্বল্প পরিমাণে সবরকম সুগন্ধির বেস হিসেবে কাজ করে।"

"তারপরে কী হলো?"

"তারপরে আর কি! রিচার্ড ধরা পড়লো, আর ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে পুরো টিমটাই। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাহামা সরকার আমাকে একটুকরো অ্যাম্বারগ্রীস দিয়েছিলো। এই পাথরটাই হলো সেই অ্যাম্বারগ্রীস, যেটা তোরা পেপারওয়েট ভাবছিলিস, বুঝলি?" 

এই বলে ভজামামা উঠে গটগটিয়ে হাঁটা লাগালো।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

11 comments:

  1. দারুণ দারুণ দারুণ। আরো চাই এই সিরিজ

    ReplyDelete
  2. দারুণ দারুণ দারুণ। আরো চাই এই সিরিজ

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ দেবী।

    ReplyDelete
  4. ধন্যবাদ দেবী।

    ReplyDelete
  5. স্বর্ণদ্বীপকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর অলংকরণের জন্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. apnakeo dhonyobad etto bhalo ekti series upohar deoar jonye :)

      Delete
  6. ভীষণ ভালো লাগলো।অনেককিছু জানতেও পারলাম। গল্পের ভাষা ও গঠনে রীতিমতো মুন্সিয়ানার ছোঁয়া। এইরকম আরো কয়েকটা পেলে খুব ভালো লাগবে।

    ReplyDelete
  7. ভজামামা ইজ ব্যাক। দারুণ লাগলো। আর স্বর্ণ এর আঁকা টাও দারুণ। 😊

    ReplyDelete