গল্পের ঝুলি : নববর্ষের গল্প : শ্রেয়সী মুখার্জী






আজ সকালেও বেশ দেরি করেই ঘুমটা ভাঙলো মিতুলের। পুজোর ঘর থেকে চেনা ধূপের মিষ্টি গন্ধটা ভেসে আসছে।বিছানায় শুয়ে শুয়েই একপ্রস্থ ভেবে নিল আজ কোন কোন জামা কখন কখন পরবে ও। তারপর একলাফে বিছানা থেকে নেমে ব্রাশ হাতে সোজা বাগানের দিকের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো মিতুল। বাইরে আজ ঝলমলে রোদ্দুর, সকালের নরম বাতাসে মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। বাগানের বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া বুড়ো আমগাছটাকে প্রথম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালো। আজকাল আর কেউ নববর্ষ বলতে চায় না, মিতুলের বন্ধুরা সব বেঙ্গলি নিউ ইয়ার উইশ করে। কিন্তু ওকে বাবা বলে দিয়েছে সবার আগে নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান করতে শিখতে হয়।

বারান্দার কোণে রাঙাদিদু বড়ি শুকোতে দিচ্ছে। ওদিকে বাবা দ্বিতীয়বার চা সহযোগে খবরের কাগজটা আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছে। মা রান্নাঘরে আনন্দীমাসিকে নিয়ে মহা ব্যস্ত, দুপুরে বাড়িতে বিশাল আয়োজন। নানাবিধ বাঙালি পদ সহযোগে নববর্ষের দুপুরের জমিয়ে আড্ডা ও খাওয়াদাওয়ার রেওয়াজটা নাকি সেই ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসছে। ছোটোকাকু, সেজমাসি, মণিদিদা আর বুকুনরা সবাই এলো বলে। পাশের বাড়ির বন্ধু রিকু আর তার বোনকেও আসতে বলেছে মিতুল। এই আড্ডা হইচই বাঙালিয়ানা সবটাই ভালো লাগে মিতুলের, কিন্তু তার থেকেও ভালো লাগে উৎসবের আগের এই প্রস্তুতিটা দেখতে।

হাতে বেশি সময় নেই, স্নান করে গোলাপি জামাটা পরে নিয়ে কোঁকড়া চুলগুলো সামলে দুটো ক্লিপ লাগিয়ে নেয় মিতুল। নিচে এসে মা'র কথামতো ফ্রিজ থেকে দই মিষ্টিগুলো বের করে রাখে।তারপর ফ্রিজের কোণার দিক থেকে বের করে আনে বড়ো লাল প্যাকেটটা। মায়ের ফোনটা নিয়ে কার সাথে যেন কথা বলে নিয়ে আশ্বস্ত হয় মিতুল। তারপর মায়ের সঙ্গে ইশারায় কীসব যেন কথা হয়ে যায়। ছাতা আর লাল প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও।

ঝিলের পাড়েও আজ মহা উৎসব। আজ নাকি পয়লা বৈশাখ। কৌতূহল চাপতে না পেরে মিঠি শেষ অবধি ছেঁড়া জামাটায় কুড়িয়ে পাওয়া সেফ্টিপিনটা লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করেই ফেলে, "পয়লা বৈশাখ মানে কী রে দিদি?" সারা বছর দিন তারিখের হিসেব না রাখলেও দিদি বেশ করে মিঠিকে বুঝিয়ে দেয় যে পয়লা বৈশাখ মানে নতুন বছরের শুরু। কিন্তু নতুন বছর কীকরে শুরু হয় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না মিঠির। এটাও তো সেই আর পাঁচটা দিনের মতো, কোন ভোরে মা বাবা কাজে বেরিয়ে যায়। মিঠিও সকাল থেকে খিদে চেপে দিদির হাত ধরে স্টেশনে পয়সা চেয়ে বেড়ায়। আর বেলা বাড়লে ক্লান্ত হয়ে একটুকরো বাসি রুটি রেললাইনের ওপারে বসে দু’জনে ভাগ করে খায়। তাই নিজের ছয় বছরের জীবনে 'নতুন' শব্দটা শুনলেও, মানেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি মিঠি।

তবে আজ দিদি কোথায় যেন শুনেছে কারা যেন বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে খাওয়াবে। দিদির কোল থেকে নেমে অনেক খাবারের গন্ধকে পেছনে ফেলে একটা লাল বড়ো প্যাকেটের দিকে চোখ চলে যায় মিঠির। একটা গোলাপি জামা পরা মেয়ের হাত থেকে ঝুলছে। দিদি জোর করে দু’গ্রাস খাইয়ে দেয়। আজ অনেকদিন পর এতো খাবার পেয়েও মিঠির মনটা ওই লাল প্যাকেটে আটকে। বস্তিতে পড়াতে আসা দিদিমণিদের মতো করে বানান করে লাল প্যাকেটের ওপরের লেখাটা পড়ে মিঠি, 'ন-ব-ব-র্-ষে-র শু-ভে-চ্ছা'। মানেটা ঠিক না বুঝলেও কেমন করে যেন 'নতুন' কথাটার মানেটা আজ মিঠি বেশ বুঝতে পারে।


খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটলে শুরু হল গিফ্ট দেওয়ার পালা। জামাকাপড়, খেলনা, সুন্দর ছবি দেওয়া গল্প ও ছড়ার বই আরও কত কিছু!

মিতুল অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করছিল হাঁটু অবধি ধুলোমাখা, অপুষ্টিতে চুল বাদামী হয়ে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটার মন খাওয়ার দিকে নেই। বারবার ঘুরেফিরে ছোট্ট চোখদুটো যেন ওর হাতে ধরা লাল প্যাকেটে এসে আটকে যাচ্ছিল। একবার যেন মনে হল মেয়েটা অস্ফুটে প্যাকেটের গায়ের লেখাটা পড়ার চেষ্টা করছে। তখনই মিতুল মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল ওর আনা গিফ্টটা ওই দুই বোনকেই দেবে।


মিঠি কতদিন ভোরে কত সুন্দর সব স্বপ্ন দেখে, ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন, মায়ের হাত ধরে সুন্দর জামা পরে মেলায় যাওয়ার স্বপ্ন। দিদি বলে ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! কিন্তু কোনোদিন তো বলেনি চোখ খুলে দিনের আলোয় দেখা স্বপ্নও এভাবে সত্যি হতে পারে! ওই গোলাপি জামা পরা দিদিটা যখন ওদের হাতেই ওই লাল প্যাকেটটা তুলে দিল, তখন সারাদিনের সব আলো বুঝি মিঠির মুখে এসেই জমা হয়েছিল।


আজ মিঠিদের বস্তিতে জমজমাট আসর, বিকেলে পড়াতে আসা দিদিমণিদের সবাই কে কী গিফ্ট পেলো দেখাতে ব্যস্ত। মিঠি আর তার দিদি চুপচাপ লাল প্যাকেটটা দিদিমণিদের হাতে দিল। ওদের কথামতো একজন দিদিমণি প্যাকেটটা খুলে দেখলেন ভেতরে একটা বড় কাগজের বাক্স আর তার সাথে একটা চিঠি। কাগজের বাক্সটাই প্রথমে খুললেন দিদিমণি। এবার বুঝি ছিল চমকের বাকি থাকা আসল অংশটার পালা। বাচ্চারা সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখল ভেতরে একটা বিশাল বড় অদ্ভুত আকৃতির হাতে বানানো ক্ষীরের মিষ্টি। 
দিদিমণি সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বললেন, তার বলতে শুরু করলেন,

- “তোমরা যে এই বড় মিষ্টি দেখছো এটা একটি বিশেষ আকৃতি দিয়ে বানানো হয়েছে, সেটা কীসের জানো?”

বাচ্চারা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।

দিদিমণি বলে চললেন,

-“এ হল আমাদের পরম প্রিয় মাতৃভূমি ভারতবর্ষের মানচিত্র। আর এই যে দেখছো মিষ্টির ওপরে কাজু, কিসমিস, পেস্তা, নানারকমের বাদাম আরও কত কী দেওয়া আছে, এগুলো দিয়ে এক একটা রাজ্যের রাজধানীকে চিহ্নিত করা আছে, আর কোনটার কী নাম তা এই কাগজের প্যাকেটের ভেতরের দিকে লেখা আছে।"

বস্তিতে পড়াতে আসা দিদিমণিরা সবাই তখন খাবারের মাধ্যমে বাচ্চাদের নিজের দেশকে চেনানোর এই অভিনব পদ্ধতি দেখে অভিভূত। বাচ্চাদের মনেও তখন নতুন জিনিস শেখার নিজের দেশকে চেনার একরাশ আনন্দ। এবার চিঠিটা পড়ার পালা-

প্রিয় বাচ্চারা,

তোমরা যে আজ নিজের দেশকে চিনলে তার ভবিষ্যৎ কিন্তু তোমাদের হাতেই গড়া হবে। তাই নিজের দেশকে ভালো রাখতে গেলে সবার আগে নিজেকে একজন মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জীবনে বড় মানুষ হয়তো সবাই হতে পারে না, কিন্তু ইচ্ছে থাকলে একজন বড় মনের মানুষ অবশ্যই হওয়া যায়।তোমরা সবাই ভালো থেকো এবং চারপাশের মানুষদের ভালো রাখার চেষ্টা কোরো। আর এই ছোট্ট উপহারটা সবার সাথে ভাগ করে নিও।

ইতি

তোমাদের বন্ধু


-“বড় মনের মানুষ কী রে দিদি?”

দিদির হাত ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে জিজ্ঞেস করেই ফেলে মিঠি।

- “এই যে তুই তোর উপহারে পাওয়া মিষ্টিটা সবার সাথে ভাগ করে খেলি, এটাই বড় মনের পরিচয়।আর যে মানুষের সেটা থাকে সেই তো বড় মনের মানুষ।”

দিদির হাতটা শক্ত করে ধরে মিঠি, মনে মনে ঠিক করে নেয় এবার যদি তাকে কেউ বড় হয়ে কী হতে চাও জিজ্ঞেস করে, তাহলে চোখ বন্ধ করে বলবে 'আমি বড় হয়ে একজন বড় মনের মানুষ হতে চাই'।

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : লীনা রায় মল্লিক

2 comments:

  1. খুব সুন্দর, খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. খুব খুব মিষ্টি একটা গল্প। 😊

    ReplyDelete