বই কথা কও : 'মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র' আলোচনা : চয়ন সমাদ্দার



আমাদের দেশের সভ্যতাটা খুব পুরনো। জানো তো? পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। পেল্লাই সব শহর ছিল, রাজারাজড়া ছিল। খেটে খাওয়া মানুষের দল ছিল। আর ছিল একটা বিশেষ ধরণের গল্প বলার ধরণ। কী রকম জান? ধর, মা তোমাকে টিফিনে ম্যাগি দিয়েছেন। কিন্তু, তোমার বার্গার পেলে ভালো লাগবে। তা, আমি যদি লিখি, তুমি একটা গাছের তলায় গিয়ে চাইলে, অমনি বৃক্ষ দেবতা তোমায় ম্যাকের বার্গার দিয়ে দিলেন, তুমি নির্ঘাত হাসবে। যে জীবনটা আমরা বাঁচি, তাতে অমন হয়? কিন্তু জানো সেইই অনেককাল আগের গল্প শুনতে গেলে তোমায় এরকম একটা দুনিয়া মেনে নিতে হবে। সেই দুনিয়ায় শকুন্তলা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বনের গাছ থেকে কাপড়, গয়না আসে। আঁচল টানে হরিণশিশু।

আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে মানুষের মুখে জন্তুর মুখোশ এঁটে একটা বই লেখা হয়। নাম পঞ্চতন্ত্র। জানো তো, দেশ চালাতে নানারকম ফন্দিফিকির করতে হয়। তার কোনওটা অতি বিশ্রীও হতে পারে। এই বিশ্রী চেহারাটাকে একেবারে উদোম করে দেখান এ বইয়ের লেখক বিষ্ণুশর্মা। একটা কথা মনে রেখো, এই নামে সত্যিই কেউ ছিলেন কিনা, জানা যায় না। পাঠক কল্পনা করে নিয়েছে, এক বয়স্ক, রসিক কিন্তু পরম পণ্ডিতকে। তারই নাম দিয়েছঃ - বিষ্ণুশর্মা। তখন, ছোটদের লেখা বলে আলাদা কিছু ছিল না। তবু, বইটার শুরুতে আছে মহিলারোপ্য নগরের রাজা ছিলেন অমরশক্তি। তাঁর তিন ছেলে - বসুশক্তি, উগ্রশক্তি আর অনেকশক্তি। তিন রাজকুমার পণ করেছিলেন কিছুতেই লেখা পড়া শিখবেন না। সব পণ্ডিতমশাই হাল ছেড়ে দিলে আসেন বিষ্ণুশর্মা। তিনি রাজ্যচালনার রীতিনীতিকে গল্পের চেহারা দিয়ে রাজকুমারদে বলতে আরম্ভ করেন। এই চোখ দিয়ে দেখলে, দেড় হাজার বছর আগের বইটা ছোটদের জন্য লেখা, বলা চলতেও পারে। এখন, ঐ গল্পগুলো, প্রথমে তোমাকে যে জগতটা মেনে নিতে বললাম, তার নিয়মে বলা। গল্প থেকে গল্প। মানুষ আছে, জন্তুও আছে। তারা আবার মানুষের মতো ব্যবহার করে। তোমরা, যারা সিক্স, সেভেনে পড়ো, তারা জানবে এই ধরণের গল্পকে ফেবল্ (fable) বলে। মিত্রভেদম, মিত্রপ্রাপ্তিকম, কাকোলূকীয়ম, লব্ধপ্রাণাশম এবং অপরীক্ষিতকারম এই পাঁচটি গল্পে রাজনীতি, কূটনীতি, মানুষের খারাপ দিকগুলো এমন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার জুড়ি পৃথিবীতে বিশেষ নেই। এবার , প্রশ্ন হলো, এ লেখা তো এখন কালজয়ী ক্লাসিক। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসির মত। একে শিশু জগতে পৌঁছে দেওয়া তো বড়দের কর্তব্য! কি করা যায়, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে আমাদের বাংলাদেশেই হলো এর বড়দের জন্য অনুবাদ। করলেন গৌরী ধর্মপাল। আর ছোটদের জন্য লেখা হলো এমন একটা বই যার সমতুল্য কিছু বাংলায় খুব কম আছে। নাম তার 'মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র'। লিখলেন একই মানুষ। যদি বড়দের আর ছোটদের বইদুটো পাশাপাশি রেখে পড়ো, কিছুতেই মানতে পারবে না বইদুটো একই লোকের লেখা!

বুঝলে, যে কারণে এ বইটা ইউনিক, সেটা হলো এটা ঠিক পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ নয়। লেখিকা বলেছেন এটি বিষ্ণুশর্মার বইয়ের মেয়ে। এটা একটা নতুন বই মূলের সঙ্গে যার যোগ ভেতরের ভাবের, যাকে স্পিরিট বলে। অসাধারণ কথক বিষ্ণুশর্মা কিন্তু ঐ যে বললুম তাঁর বিশ্ব কখনও কখনও ভয় ধরানো। অনেক সময়ই সেখানে চীটিং, লোকের ক্ষতিকরা, জালিয়াতি - এসব জিতে যায়। । লেখিকার ভাষায় 'বীভৎস রাজনীতি' র ছায়া সেখানে প্রকাণ্ড। কিন্তু, লেখিকা জয় করতে চান তোমাদের জ্যোৎস্না ধোয়া, রূপকথা শোনা মনের রাজ্য। তোমায় মনে রাখতে হবে, এ বই, ১৯৬১ সালে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ লাভ করে সন্দেশ পত্রিকায় যার আদর্শ হলো কোন রকম অমঙ্গল বোধ কাহিনীরাজ্যে রাজসিংহাসন পাবে না। লেখিকার নিজের মতও তাই। তিনি বিশ্বাস করেন বাস্তবে না হোক গল্পজগতে রাক্ষস, ডাইনি, দত্যি দানো সবসময়ই রাজপুত্তুরের কাছে হেরে যায়। শুভ পরাস্ত করে অশুভকে। এটাও আমাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ। এই বই শেষ হয় চারবন্ধুর মিলন দৃশ্য দিয়ে। আকাশ, মাটি, জল, জঙ্গলের প্রতীক হয় কাক, ইঁদুর, কচ্ছপ আর হরিণ। একই প্রাণের আলোয় ঢাকা আলোময় বিশ্বের দিকে চেয়ে যেন " কিশোর পাঠক পাঠিকারা এবং প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে যে চিরকিশোর আছে, সে হাঁপ ছেড়ে বলতে পারে, 'যাক, সবাই দমনক নয়।'"। এই দমনককে তুমি পাবে একদম প্রথম গল্পে। একটা শেয়াল। ইভিল স্পিরিট বলতে যা বোঝায় দমনক তাই।

আর এই বইয়ের ভাষা! জাস্ট ওয়াও! লীলা মজুমদার বলেন, "এর ভাষা হ'ল খাঁটি বাংলা।.... বড় অন্তরঙ্গ ভাষা... হৃদয় থেকে বিগলিত ধারায় আপনি এরকম ভাষা বেরিয়ে আসে। অথচ এর তলায় তলায় সংস্কৃত মায়ের মধুর কন্ঠের প্রতিধ্বনিও শোনা যায়"। আমি তো আরো বেশি বলব। এতটুকু খোকাপনা না করে এ ভাষা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অননুকরণীয় ভাষার একমাত্র উত্তরসূরি। আমি আর কারো কাছে এ ভাষা আর শুনিনি। প্রেমেন্দ্র মিত্রও তাই মনে করেন।

একটু উদাহরণ শোন। লেখিকা তাঁর শুরুর কথায় কল্পনা করছেন নব্বই বছরের বিষ্ণুশর্মার কন্যে কিঞ্জল্ককিঙ্কিণীর পোষা ইঁদুর হিরণ্যক পঞ্চতন্ত্রের পুঁথি কেটে টুকরো করেছে। পণ্ডিত মশায়ের মাথায় হাত। তখন " বাবাকে মুষড়ে পড়তে দেখে কিঞ্জল্ককিঙ্কিণী বললে, বাবা আমার কিছু কিছু মনে আছে। ঠিক তোমার মত হবে না, তবে---

বেশ তো, বল না শুনি।

কিঞ্জল্ককিঙ্কিণী বললে। লিখলে। বেশ যত্ন করে গোটা গোটা অক্ষরে। কয়েকটা বানান ভুল হল অবশ্য। তা কী আর করা।

দিন যায়, দিন যায়। আবার একদিন কিঞ্জল্ককিঙ্কিণী এসে বললে, বাবা তোমার ইঁদুরের কাণ্ড দেখে যাও।

বিষ্ণুশর্মা দেখে তো অবাক। কোত্থেকে আটা পেলে কে জানে, সেই ছেঁড়া পুঁথিখানা আবার জুড়েছে। তার সঙ্গে কিছু আজেবাজেও জুড়ে ফেলেছে। ইঁদুর তো!

বিষ্ণুশর্মা হিরণ্যকের মাথা থাবড়ে বললেন, কী রে হঠাৎ সুবুদ্ধির উদয় হল যে?

ইঁদুর বললে, কিচ কিচ কিচ কিচ কিচ কিচ কিচ কিচ

তার মানে, আমার তো কাটাই স্বভাব। কিন্তু দিদির কথায় বড় লজ্জা পেয়েছি। তাই আবার জুড়ে দিলুম।

কালেনৈবাখুনা ছিন্নং কালেনৈব নবীকৃতম।
মহান গুরুর্বিষ্ণুশর্মা কাহং কিঞ্জল্ককিঙ্কিণী।। "


এই নবীকৃত পঞ্চতন্ত্রেরই নাম মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র। জুলাই ১৯৭৬ এ রূপা থেকে এর প্রথম সংস্করণ বার হয়। আর এরপর ৮২-৮৩ তে গৌরী ধর্মপাল মূল পঞ্চতন্ত্র অনুবাদ করেন নবপত্রের সংস্কৃত সাহিত্য সম্ভারের জন্য। এবং এই জন্য জানুয়ারি ১৯৮৫ তে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি কিছু পরির্তন করেন। বর্তমান শিশু সাহিত্য সংসদ এই সংস্করণের পাঠই অনুসরণ করে। ভাবা যায়! আগে ছোটদের জন্য লিখে লেখনীশুদ্ধির পর বড়দের জন্য লেখা! এ কেবল বাংলাতেই সম্ভব। আর বাংলা ভারতের অংশ। সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে!

3 comments:

  1. ধন্যবাদ। এত অজানা কথা জেনে খুবই ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. বাহ্। অনেক কিছু জানা গেল তো! অনেক ধন্যবাদ দাদা। 😊

    ReplyDelete
  3. প্রত্যাশিত সুন্দর পর্যালোচনা। বইদুটি পড়ার আগ্ৰহের জন্ম দেয়।

    ReplyDelete