গল্পের ঝুলি : টুবলুকে টক্কর : শেলী ভট্টাচার্য (অন্তহীনা)





"টুবলু এতো কাহিনী জানে কী করে রে?" ভ্যাবলার ক্যাবলা ক্যাবলা প্রশ্নে মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল বিল্টুর। এমনিতেই সে কয় মাস ধরে টুবলুর হাজার রকম মিথ্যে জারিজুরি ভরা প্যাঁচগুলো টের পেয়েও কোনও উত্তর দিতে পারছে না। তার উপর জুটেছে টুবলুর এই শহুরে বীরুদা। সে হল গিয়ে টুবলুর বাবার পিসতুতো দাদার বৌয়ের মাসতুতো বোনের ছেলে। উফফফ, সম্পর্কগুলোর জট যে এতোক্ষণ মনে রাখতে পেরেছে বিল্টু, সেই ভেবেই নিজের উপর কেমন একটা গর্ববোধ হচ্ছে। কেন যে ইতিহাসের সাল তারিখগুলো এভাবে মনে থাকে না তার, কে জানে? তাহলে আর রোজ স্কুলে হরেন মাস্টারের ভয়ে থাকতে হ’ত না। অঙ্ক, বিজ্ঞান সব ঠিকঠাক পড়ে নেয় সে, মাথাতেও সেগুলো চটপট খেলে যায় তার। কিন্তু ওই এক ইতিহাসেই প্রকৃত অর্থে এক্কেবারে পানাপুকুরে চরা পাতিহাঁস সে। আর টুবলু ব্যাটা ওই ইতিহাসেই ক্লাসে বরাবর হায়েস্ট মার্কস পায়। সালতারিখ সব চোখ বন্ধ করে গলগল করে বলে দেয় সে। বিল্টুকে ক্লাসে পেলেই তার কাছে গিয়ে ইচ্ছা করে খোঁচা দিয়ে এই বাবরের জন্ম তো এই আকবরের মৃত্যু সাল জিজ্ঞেস করে মুখ টিপে হাসে টুবলু। একমাত্র অঙ্কটা দিলেই সে জব্দ হয়ে যায় বিল্টুর কাছে। সেই টুবলু কিনা আজ প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আর্যভট্টের জন্ম মৃত্যু সাল বলে দিয়ে অঙ্কের বীরেন স্যারের মন জয় করে নিল। বিল্টুর সবচেয়ে খারাপ লাগে যে, টুবলু যেটুকু জানে, তার চেয়ে দেখায় অনেক বেশি। আর সবাইকে বলে বেড়ায় যে, সে নাকি অনেক বই পড়ে। তাই অনেক জ্ঞানী সে। তবে কেউ বই চাইতে গেলেই বলে, ওদের আলমারির চাবি নাকি ওর বাবা সবসময় সাথে নিয়ে রাখেন। অনেক দামি বই আছে কিনা তাতে! তাই টুবলু ওর বাবা ফিরলেই রাতে আলমারি খুলে পড়তে বসে সে’সব বই। আর সবার মতো কূপমণ্ডুক হয়ে পড়ার বই নিয়ে শুধু বসে থাকার ছেলে সে নয়। 'সবার' শব্দটা উচ্চারণের সময় আড়চোখে তাকায় বিল্টুর দিকে। বিল্টুর এটাই সহ্য হয় না। ওর পরিষ্কার মনে আছে, টুবলু একবার আমের আচার চাটতে চাটতে আমেজে গল্প করে ওকে বলে দিয়েছিল যে ওর শহুরে বীরুদা পড়াশোনায় দারুণ। অনেক কিছু জানে সে। ওদের বাড়িতে টুবলুরা যখনই যায়, অনেক গল্প শোনে তার কাছে। ওই একবারই মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল সেসব কথা। আর এসব জানে বলেই বিল্টুর বড্ড রাগ হয় টুবলুর উপর। সে পারতে মিথ্যা বলে না, বলাটাও পছন্দ করে না, সেখানে বিদ্যা আহরণের বিষয়ে তো নয়ই। তার উপর সব কথাতেই নিজের বংশের সাথে সারা দুনিয়ার বিখ্যাত লোকেদের একটা নয় একটা সূত্রাকার সম্পর্ক বার করে ফেলে টুবলু। আর সবাই হাঁ করে ওর ঢপের কীর্তনগুলো হজম করে।

কিন্তু কোনোভাবেই টুবলুর মিথ্যেটা কেউ টের পায় না। প্রতিদিন স্কুলের পরে বিকালের খেলার মাঠে খেলা সেরে এক ডজন কলা নিয়ে বসে একের পর এক কলা ছুলে খেতে থাকে পেটুক টুবলু। আর কলার খোসাগুলো ছুঁড়ে এদিক ওদিক ছড়াতে থাকে। সাথে চলতে থাকে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রমাণের ঢপবাজি গল্প ... আজ এই বই পড়েছি ... শুধু দেশি বই পড়ে কী হবে ... ইত্যাদি। তারপর শুরু করে এক একটা গল্প। আর তখন ওকে ঘিরে বসে থাকা সব হাঁ করা মুখগুলো দেখে তারিয়ে তারিয়ে মজা নেয় ও। হাবলু, ভ্যাবলা তো গোগ্রাসে গিলতে থাকে সেসব গল্প। তারপর ওরা বিল্টুকে ঘরে ফেরার পথে যেতে যেতে বলতে থাকে, 'টুবলু কত জানে রে, কত বই পড়ে ও'। অথচ বিল্টু আজ অবধি টুবলুর বাড়িতে ইতিহাস ছাড়া অন্য কোনো পাঠ্যবইয়ের টিকিটিও সামনাসামনি দেখতে পায়নি। ওর সব কাহিনীর ঝোলা যে ওই বীরুদা, সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। ইসস, বিল্টুর যদি এমন কোনো শহুরে দাদা বা দিদি থাকতো, তাহলে অন্তত টুবলুকে একটু টক্কর দিতে পারতো ও।

একবার স্বাধীনতা দিবসের জন্য অনুষ্ঠানের রিহার্সাল হচ্ছিলো স্কুলের ব্যায়ামের ঘরে। সেসময় বিল্টুকে স্যার ক্ষুদিরাম বসুর জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করলে, বিল্টুর আগেই টুবলু সব বলে দেয়। তাতেও পুরোপুরি দমে না সে। খেলার মাঠে বসে বলতে থাকে, তার কোন আত্মীয় নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্ল্যানচেট করে নিয়ে আসতো। আর তাদের কাছ থেকে তাজা তাজা গল্প শুনতো সেইসব দিনের। টুবলুর ভাগ্য যে সেসব গল্প সেও জানে। আর বড় হয়ে সেও প্ল্যানচেট করা শিখে নিয়ে যখন তখন বড় বড় মনীষীদের ডেকে আনবে। তার জন্য কিছু বিদেশি বইও পড়বে।

কথাগুলো শোনামাত্র বিল্টুর মাথা গরম হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এতো বড় ঢপবাজ ছেলে টুবলু! বলে কিনা প্ল্যানচেট করে মনীষীদের আনবে। সোজা হনহন করে হেঁটে গিয়ে সে গ্রামের পুরানো হাসপাতালটার পেছনের ছোট্ট মাঠে গিয়ে বসলো। ঠিক তখনই এক বছর কুড়ির ছেলে এসে পা ঝুলিয়ে বসলো ওর পাশের ভাঙাচোরা পাঁচিলটার উপর। সন্ধের কমলা আলো তখন নীল আকাশের গায়ে আলপনা এঁকে চলেছে পশ্চিমাকাশ জুড়ে। বিল্টু কথা বলার আগেই ছেলেটা ওকে 'ভাই' সম্বোধন করে কথা শুরু করলো।

"মন খারাপ নাকি ভাই?"

"হুম" , মনমরা মুখটা উপর-নিচ করে জানালো বিল্টু।

"তা, সমস্যাটা কি বন্ধুকে নিয়ে?"

চমকে বলে উঠলো বিল্টু "কী করে জানলে?"

"দাদারা সব জানে।"

কথাটা বড্ড আপন লাগলো বিলটুর। তারপর টুকটাক কথার মধ্য দিয়েই সহজে আলাপ হয়ে গেল দুজনের। বিল্টু ওর মনের সব কথা খুলে বললো এক দাদা পেয়ে। তারপর সেই দাদা ওকে একটা বুদ্ধি দিল।

পরেরদিন দাদার পরিকল্পনা অনুসারে বিল্টু টুবলুকে উদ্দেশ্য করে সবার সামনে খেলার মাঠে বলতে শুরু করলো,

"জানিস, চৌধুরীদের আমবাগানের পাশে যে পরিত্যক্ত বাড়িটা আছে না, ওতে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার থাকতো।"

যথারীতি টুবলু প্রশ্ন করে বসে "তুই কী করে জানলি?"

"আমি গতকাল ঘরে ফেরার পথে সব জেনেছি।"

"কার কাছে?" প্রায় সমস্বরে।

"এক দাদার কাছে। সে ওই বাড়ির কারোর আত্মীয় ছিল। তবে সেই দাদা বলেছে, যে আমাদের মধ্যে যারা সাহসী, তারা ওই বাড়ির কাছে এলে, দাদা আরও অনেক গল্প শোনাবে। অবশ্য সন্ধের পর আসতে হবে তাদের।"

কথাটা বলতেই ভ্যাবলা ভয়ে বলে উঠলো "বাবারে, চৌধুরীদের আমবাগান! সেখানে তো ভূত আছে।"

বিল্টু কথাটা পাত্তা না দিয়ে টুবলুর পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো,

"আরে আমাদের মধ্যে এমন একজন সাহসী থাকতে ভয় কীসের? কিরে টুবলু ঠিক বলিনি? তুই তো প্ল্যানচেট শিখবি, তো এমন জায়গায় চল, একবার ঘুরে আসি আজ।"

টুবলু ঢোক গিলে একবার সবার দিকে তাকালো। তারপর নিজের কলারটা একটু নাড়িয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বললো,

"হ্যাঁ, হ্যাঁ, চল। কোনও ব্যাপার না।"

কথামতো সন্ধে সাড়ে ছ’টার দিকে খেলার মাঠ থেকে উঠে সবাই এগোতে থাকলো চৌধুরীদের আমবাগানের দিকে। পথে ভ্যাবলার হঠাৎ পেটে মোচড় দেওয়ার অজুহাত খাড়া হল। সে ঘরের পথে হাঁটা দিল। হাবলুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ওর ন’পিসির আসার আজগুবি গল্পকথা। সেও পালালো নিজের ঘরে। পড়ে রইলো বিল্টু আর টুবলু। টুবলুর ইচ্ছা না থাকলেও উপায় নেই। প্রেস্টিজের ব্যাপার। অতঃপর দুজনে যখন চৌধুরীদের আমবাগানে ঢুকলো তখন, রাতের অন্ধকার প্রায় ছুঁইছুঁই। ওরা ধীর পায়ে হেঁটে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছনে যেন কে একটা ডাকলো টুবলুর নাম ধরে। টুবলু ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে বিলটুকে জড়িয়ে ধরলো। বিল্টু তো আগে থেকেই জানতো এ সেই দাদার গলা। তাই স্বাভাবিক স্বরে বললো "কীরে, এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?"

"কে যেন ডাকলো আমায়" কাঁপা গলায় বলে উঠলো টুবলু।

"হবে কেউ, আমাদের মতোই এ বাগানে এসেছে হয়তো।"

"এই ভূতের বাগানে কে আসবে রে এই অন্ধকারে?"

বলতে বলতেই আবার হাতখানেক দূরের আমগাছের ফাঁক গলে সেই গলার স্বর ভেসে এলো। কতকটা প্রতিধ্বনিত হয়ে,

"ভয় পেয়ো না টুবলু, বিল্টু। আমি তোমাদের কিছু কথা বলি শোনো। আমি ওই বাড়িটাতে আজ থেকে সত্তর বছর আগে থাকতাম। অনেক কষ্ট করে সেসময় দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়িয়েছি আমরা।"

বিল্টু কথাগুলো শুনতে শুনতে টুবলুর দিকে চেয়ে দেখলো ওর চোখেমুখে ভির্মি খাওয়ার আগের অবস্থা প্রায়। কথাগুলো হয়ে যাচ্ছে তখনও ....

"এতো বড়ো শক্তিকে আমরা কীকরে পরাজিত করেছিলাম জানো? আমরা সবাই এক হয়ে ছিলাম বলে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা লড়েছি। সত্যপথে চলেছি। মিথ্যার আশ্রয় নিইনি কখনো। আশা করি তোমরাও আজ সেই সত্যপথে চলে আমাদের স্বপ্নের স্বাধীন ভারতকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই তো?"

বিল্টু মুখ টিপে দাঁড়িয়ে দেখলো টুবলু হ্যাঁ কথাটা বলতে চাইলেও, গলা দিয়ে আওয়াজ সরছে না তার। তারপর আবার সেই গলার স্বর বলে উঠলো,

- "এবার তোমরা বাড়ি যাও। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মনে রাখবে মিথ্যাচরণ কখনও নয়। আর হ্যাঁ টুবলু শোনো, মনে রেখো দেশটা আমাদের, তাই সব দিক থেকে তাকে আমরাই পরিষ্কার রাখবো। তাই খেলার মাঠে ওরকম করে কলার খোসা এদিক ওদিক ফেলো না কিন্তু। কেউ পড়ে গেলে বিপদ হতে পারে তো। আমি জানি তোমরা ভালো হবে। ভালো দেশ গড়বে।"

টুবলু কোনোরকমে মাথাটা নত করে সম্মতি জানিয়েই দ্রুত হাঁটা লাগালো ঘরের দিকে।

পরের দিন থেকে তার ধুম জ্বর এলো। বিল্টু সেসময় সকাল সন্ধেয় গিয়ে বন্ধুর খবর নিচ্ছিলো। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল, সে ওই দাদার সাথে মিলে টুবলুকে সঠিক শিক্ষা দিতে গিয়ে, বন্ধুর কোনো ক্ষতি করে বসলো না তো? কিন্তু সেই দাদার দেখা আর পাচ্ছে না সে কিছুতেই।

তারপর স্বাধীনতা দিবসের দিন স্কুলে আসা এক নতুন শিক্ষকের কথায় বিল্টু জানতে পারলো যে, সত্যি ওই আমবাগানের পাশের ভাঙাচোরা বাড়িটাতে এক স্বাধীনতা সংগ্রামী থাকতেন। ক্ষুদিরাম বসুর মতোই খুব অল্প বয়সে তিনিও প্রাণ দিয়েছিলেন সত্যাগ্রহ চলাকালীন। তিনি ছিলেন এ গ্রামের গর্ব। তাই তার একটা মূর্তি গড়া হয়েছে স্কুলের মাঠে। আজ তার উন্মোচন হবে। বিল্টু চমকে উঠলো সেই মূর্তি দেখে, এতো সেই দাদা! তার সারা গায়ে একটা শিহরণ খেলে গেল নীরবে। তাই বোধ হয় সেদিন পরিকল্পনার পর যখন বিল্টু দাদাকে বলেছিল যে, সে মিথ্যা স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প বলে টুবলুকে আমবাগানে নিয়ে যেতে পারবে না। তখন দাদা বলেছিল 'মিথ্যা নয় তো। আর এতো দেশের, দশের ভালো চাওয়া'।

হঠাৎ পেছন থেকে টুবলুর ধাক্কায় সম্বিত ফিরলো বিল্টুর। সে এখন বেশ সুস্থ। বিল্টুর কাঁধে হাত রেখে বললো সে "ধন্যবাদ ভাই। তুই সেদিন ওই আমবাগানে নিয়ে গিয়েছিলি বলে, আমি নিজের অনেক ভুল বুঝতে পেরেছি। মিথ্যা বলা অন্যায়। যে দেশকে স্বাধীন করতে এতো নাম না জানা মানুষের অবদান আছে, সেই দেশকে আমরা আরো উন্নত করবো, সততা দিয়ে।"

দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে। মাইকে বেজে উঠলো গান ... ‘বন্দেমাতরম... '

(সমাপ্ত)


অলঙ্করণ : শেলী ভট্টাচার্য

4 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো দিদি। সব্বাই কে পড়ে শোনানোর মত গল্প এটা, খুব ভালো। 😊

    ReplyDelete