গল্পের ঝুলি : দেঙ্গা অচাই : রাজীবকুমার সাহা






বিধবার একমাত্র ছেলে। ভারি কুঁড়ে সে। কাজে মন নেই, কম্মে মন নেই - শুধু খায়দায়, আর পড়ে পড়ে ঘুমোয়। সঙ্গীসাথী জুটিয়ে মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়াবে, সে ইচ্ছেটুকুও তার নেই।

বিধবা পড়ল মহা ফাঁপরে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তার না ছিল নিজস্ব জমিজিরেত, না ছিল একমুঠো অর্থ সঞ্চয়। পরের জমিতে মজুর খেটেই দিন কাটে তার।

একদিন সে এক ফন্দি আঁটলে। গাঁয়ের চৌধুরীর (মোড়ল) হাতেপায়ে ধরে একটুকরো জুমের জমি চেয়ে নিলে আধাআধি ফসলের শর্তে। ঘরে ফিরে ছেলেকে ডেকে বললে, “বাবা, একটু জুমের ব্যবস্থা হয়েছে চৌধুরীর কাছ থেকে। এখন তো জমি তৈরির সময়, চারদিকে দ্যাখ জুম পোড়াচ্ছে সবাই। তুইও বাবা কাল সকালে জুম কাটতে যাস। আমি গোদক-পান্তা মেখে রেখে যাব, খেয়ে যাস।”

বিধবা বিলক্ষণ জানত যে, অলস মানুষের গড়ার চেয়ে ধ্বংসের দিকে আকর্ষণ থাকে প্রবল। তাই ছেলে কথার সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেও সে আশ্চর্য হল না বিন্দুমাত্র।

পরদিন বিধবা কাজে বেরিয়ে গেলে ছেলেও টাক্কল (দা বিশেষ) হাতে বেরিয়ে পড়ল বর্গা-ক্ষেতের উদ্দেশ্যে। মনটা বেশ ফুরফুর করছে তার আজ।

বিধবা সন্ধের মুখে ঘরে ফিরে দেখে ছেলে মাচার বিছানায় মহা আয়েশে গড়াচ্ছে। বিধবা জানতে চাইলে, “কী রে, জুম কেটেছিস তো? ফিরলি কখন?”

ছেলে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ মা, সব আগাছা কেটে শুকোতে দিয়ে এসেছি। দু'দিন যাক, আগুন দেব। তুমি কিচ্ছু ভেবো না।”

শুনে বিধবা একটা মোরগ কেটে ফেললে তক্ষুনি। রাতে জমিয়ে রান্না হবে। কিন্তু আলসে ছেলে যে জুমে গিয়ে শুধুমাত্র একটা ঘিলা লতার গোড়া কেটেই ফিরে এসেছে সে আর বিধবা জানতে পারলে না।

তারপর জুমে আগুন দেওয়ার সময় এলে বিধবা ছেলেকে সে-কাজের সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করে দিলে। শুকনো জুমের আগাছায় গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেই হয় না, সে-কাজ করতে হয় বিশেষ নিয়মরীতি মেনে। নইলে অনর্থ অবধারিত। মা ছেলেকে সাত জুমের মাটি, সাত পুকুরের জল আর সাতটা মশাল হাতে দিয়ে পই পই করে বলে দিলে সে যেন সমস্ত দেবদেবীর বন্দনা করে, আচার-বিচার মেনে তবে জুমে আগুন দেয়। কোনও প্রাণী যেন বিন্দুমাত্র আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেদিকে যেন বিশেষ খেয়াল রাখে। জুমে পৌঁছেই যেন সে তাদের বন্দনা করে জুম ত্যাগ করার অনুরোধ জানাতে ভুল না করে।

ছেলে তো জুমে পা দিয়েই শুকনো ঘিলা লতায় আগুন ঠেকিয়ে দিয়েছে। অত হাঙ্গাম আর কে করবে! সারা জুমে ছাড়া ছাড়া আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।

ওদিকে বিধবা রীতি অনুযায়ী বাড়িতে এক কলসি জল চালুনি দিয়ে ঢেকে ওপরে একটা হাতপাখা রেখে দিয়েছে। জুম পুড়ে ছেলে ফিরলে এ দিয়ে কর্ম আছে।

এদিকে জুমে ঘটে গেছে এক অঘটন। ঘিলা লতাটার নিচেই ছিল নাগরাজের গর্ত। ছেলেপিলেরা তার সব পুড়ে মরেছে। নাগরাজা তখন বেরিয়েছে আহারের সন্ধানে। ফিরে এসে সে গর্তের ধারেই ঘেঁষতে পারলে না দাউ দাউ আগুনের তাপে। প্রচণ্ড ক্রোধে সে বিধবার বাড়ি উপস্থিত হয়ে সাতপাকে বিধবার ঘর জড়িয়ে ফুঁসতে লাগল আক্রোশে। বিধবা আতঙ্কে কাঁটা হয়ে ঘরবন্দি হয়ে রইল। গাঁয়ের মানুষেরা কাছেও ঘেঁষতে পারলে না সেই বিশালদেহী নাগের। বিধবা বিলক্ষণ টের পেয়ে গেল যে জুমে নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটিয়েছে ছেলে। তার বলে দেওয়া নিয়মরীতি মান্য করেনি সে।

জুমে সাত পুকুরের জল ছিটিয়ে ছেলে ফিরে এল খানিক বাদেই। উঠোনে পা দিতেই নাগরাজার অভ্রভেদী গর্জনে সাত পা পিছিয়ে গেল তক্ষুনি। চোখেমুখে মরণাতঙ্ক। কোনওমতে উঁচু গলায় মায়ের কাছে উপস্থিত কর্তব্য জানতে চাইলে বিধবা উপায় বাতলায়। বলে, “শিগগির একটা কালো মোরগ, অল্প খই, এক বোতল চুয়াক (মদ্য বিশেষ), এক টুকরো কাঁচা হলুদ, টাক্কল আর কলাপাতার আগা একটা নিয়ে দৌড়ে বনে যা। গিয়ে তোর মামাকে ডাকবি। তিনিই বাকি কাজ দেখিয়ে দেবেন। যা বাবা, দেরি করিসনি একটুকুও।”

মায়ের কথামতো ছেলে ব্যস্ত হাতে সব জোগাড়যন্ত্র করে বনের গভীরে গিয়ে ‘মামা, মামা’ বলে চেঁচিয়ে ডাকতেই পাশের লুঙ্গা (দুই টিলার মধ্যবর্তী উপত্যকা) থেকে সাড়া দিল দীর্ঘদেহী এক বৃদ্ধ। পরনে তার লেংটি, মিশমিশে কালো তার গায়ের রং। লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনে এসে দাঁড়াতেই ছেলে শুধোয়, “তুমিই কি আমার মামা?”

বৃদ্ধ সম্মতি জানাতেই ছেলেটা সব বৃত্তান্ত খুলে বলে এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানতে চায়।

বৃদ্ধ আদেশ করে, “কয়েকটা মুলি বাঁশের আগা কেটে এনে একটা জায়গা বেড় দিয়ে পুঁতে দিয়ে ওই নাগকে খিলি দে আগে। আমি মন্ত্র পড়ে দিচ্ছি।”

ছেলে তাই করল। বৃদ্ধ মন্ত্র পড়া শেষ করে ওই বাঁশের বেড়ের মধ্যের জায়গায় কলাপাতার আগাটা বিছিয়ে দিয়ে ওপরে টাক্কলটা রাখতে বলেই আবার মন্ত্র পড়া শুরু করল। স্থির দেহ, নিমীলিত চোখ, ঠোঁটদুটো কাঁপছে শুধু। পাশে বসে এই অচেনা বৃদ্ধের মুখের পানে ভয়ার্ত চোখে অপলক তাকিয়ে রইল ছেলে।

মন্ত্র পড়া শেষ করে বৃদ্ধ আচমকা চোখ খুলতেই আঁতকে উঠল ছেলে। অমন রক্তজবার মতো লাল চোখ সে ইহজীবনে দেখেনি। বৃদ্ধর গম্ভীর গলা গমগম করে উঠল, “এবার টাক্কলটা দিয়ে কলাপাতাটা সাত টুকরো করে ফেল।”

ছেলেটা সাত পোঁচে কলাপাতা কেটে ফেলল।

পুজো শেষে বৃদ্ধ ছেলেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলে, “যা, এবারে বাড়ি যা। আর ভয় নেই। তবে মনে রাখিস, আজকের পর হাজার ডাকাডাকি করলেও আমার দেখা পাবি না আর। যখন যা প্রয়োজন তোর মা-ই বলে দিতে পারবে। আমি তাকে সে-শক্তি দিলাম।”

দ্বিধাগ্রস্ত মনে বাড়ি ফিরে এল ছেলে। দেখে নাগের শরীর সাত টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে অদৃশ্য কোন অস্ত্রের আঘাতে। গ্রামবাসী আনন্দে চিৎকার চেচাঁমেচি জুড়েছে। হাসিমুখে উঠোনে নেমে দাঁড়িয়েছে তার মা। সবকথা খুলে বলে সে। চারদিকে জয়ধ্বনি ওঠে বুড়াদেবতা বুড়াসার।

সেদিন থেকে কেউ কোনও বিপদ-আপদে বা অসুখ-বিসুখে পড়লে পুজো দেয় বুড়াসার। অচাই (পুরোহিত) হয় ছেলেটা। যারা এই পুজোর পুরুতগিরি করে তাদের বলে দেঙ্গা অচাই (কুঁড়ে পুরোহিত)।

-----

(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

No comments:

Post a Comment