গল্পের ঝুলি : কুঁজোচুড়ো পাহাড়ের পিকনিক : প্রদীপ কুমার বিশ্বাস




ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে, আমাদের পরিবার-পরিজনেরা চলে আসতেন লোহাপাহাড়ে, আমাদের খনিজ-অনুসন্ধানী বেসক্যাম্পে। প্রতি বছরই এঁদের আসার পর আমাদের ক্যাম্পের বাৎসরিক পিকনিক হয়। সাধারণতঃ এইসব জায়গাগুলো হয় বেস ক্যাম্পের কাছাকাছি জায়গায় কোনও সুস্বাদু জলের ঝোরার পাশে বা পাহাড়ি নদীর কোনো অজানা হাঁসুলিবাঁকে। কিন্তু একবার আমাদের পিকনিক হল সবদিক দিয়ে অন্যরকমের যা পরিস্থিতির কারণে একদিনের জায়গায় তিনদিন ধরে হয়েছিল। সেই পিকনিকে একদিকে যেমন প্রচুর আনন্দ আর রকমারি খাওয়া হয়েছিল, সেই সঙ্গে হঠাৎ আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে পড়ে এমন সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল যা মনে পড়লে আজও গায়ে বেশ কাঁটা দেয়। তবে আমার দুই আরণ্যক বন্ধু শিবা আর নন্দিনীর সহায়তায় আমরা বেস ক্যাম্পে ফিরে আসতে পারি।

সে বছর নভেম্বরের শুরুতেই কলকাতা হেড-অফিস থেকে নায়ার স্যার ওয়্যারলেস মেসেজে বললেন, “এইবারের শীতের পিকনিক কিন্তু কুঁজোচুড়ো পাহাড় চুড়োর কাছে ছায়াঘেরা সেই মাঠটায় হবে অ্যান্ড নো আর্গুমেন্টস প্লিজ। তবে ভেন্যুটা ওই ঝরনার কাছের মাঠে নাকি এই পশ্চিম ঢালের সেই জায়গাটায় যেখান থেকে পাহাড়ি নদীর তিনটে বাঁক দেখা যায়, সেটা তোমাদের ওপর ছেড়ে দিলাম।”

মাইলের পর মাইল জুড়ে আছে লৌহখনিজের এই লোহাপাহাড়। এর পশ্চিম সীমানা দিয়ে বয়ে যায় পাহাড়ি নদী। পাহাড়ি নদীর উজানে ছটা বাঁক মানে একই নদীকে ছয়বার পার করে তবে আসে কুঁজোচুড়ো পাহাড়। এইখানে আমরা চারজন ভূতত্ত্ববিদ আছি টাংস্টেন খনিজের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে। এইখানে এসেই আমাদের চোখে পড়ে যায় ঘন জঙ্গলের আড়ালে কুঁজোচুড়ো পাহাড়ের এককোণ থেকে শুরু করে পড়ে সাতটি ধারায় নেমে আসছে এক নয়ন মনোহর জলপ্রপাত যার নামকরণ আমরা করলাম সাতধারা।



সাতধারার বেশ কিছুটা নিচে একটা লম্বা-চওড়া সমতল মাঠ। দিনের বেশিরভাগ সময়েই এখানে চারপাশের লম্বা চওড়া গাছগুলোর ছায়া পড়ে। কুঁজোচুড়ো পাহাড়ের পশ্চিমদিকের ঢাল যেমন কম, ঠিক তার উল্টোটাই উত্তর-পূর্ব দিকে। পাহাড়ের গা, খাড়াই পাথর ধরে সোজা নেমেছে পাহাড়তলির ঘন ঘাসজঙ্গলে ভরা উপত্যকায়। একবার এখান থেকে কাজ শেষে একটা অনাহারে থাকা বনবিড়ালির বাচ্চাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে আনি। বাচ্চাটা আমাদের ক্যাম্পে থেকে, দুধ খেয়ে বেশ সজীব চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমি ওর নাম রাখলাম নন্দিনী। পরব উপলক্ষে এক হপ্তা কাজে আসেনি আমাদের স্থানীয় পথ প্রদর্শকেরা। কাজে ফিরে এসেই, তাদের নেতা মংলু বিড়াল ছানাটাকে দেখে শিউরে উঠে আমায় বলে, “সাহেব, এটা বাচ্চা বাঘিনী। আমি এটাকে এখুনি পূর্ণাপানির ধারে ছেড়ে আসছি”। নন্দিনীকে আমরা কিন্তু ভুলিনি। সে যাতে অনাহারে না থাকে আমরা তার ব্যবস্থা করলাম।উত্তর ঢালে খনিজের নমুনা নেবার জন্য কিছু ভারি যন্ত্র নামাবার জন্য একটা গাছে যে কপিকল লাগানো ছিল তাতে দড়ি বাঁধাই ছিল। প্রতি বিকেলে সেই কপিকল দিয়ে একটা বড়ো দুধের বোতল দড়ি দিয়ে নামিয়ে, “নন্দিনী” বলে চিৎকার করে ডাকলে, ঘাসবন থেকে জন্টি রোডসের মতো লাফ দিয়ে বোতলটা ধরে নিত নন্দিনী। কিছুদিন পরে আর এসবের দরকার হয়নি। এখন ও নিজেই হরিণ ধরে খায় তবুও আমরা নন্দিনী বলে ডাকলেই ও ঘাসবন থেকে গর্জন করে সাড়া দেবে। এই সময় এক ঝড়ের পরদিন আমরা শিবাকে পাই মুমূর্ষু অবস্থায়। আমরা সবাই মিলে বাজপাখিটিকে সুস্থ করে তুলি। সেই থেকে ও আমাদের কাছে আছে। আমাদের ইঙ্গিত ইশারা ও বোঝে, ওর কিছুটা আমরা বুঝি। আমাদের কাছে থাকবার কিছুদিন পরেই শুরু হয়ে গেল ওর এক নতুন খেলা। আমরা “নন্দিনী” বলে ডাকলেই ও সোজা ঘাস বনের দিকে উড়ে গিয়ে নন্দিনীর কাছে পৌঁছে যেত। দু’জনের মধ্যে দারুণ ভাব। আমাদের ইশারায় ও কয়েকবার উড়ে গিয়ে আমাদের পাঠানো কাঁচা মাংস নন্দিনীর কাছে পৌঁছে এসেছে। আমরা পরে এই জিনিসটাই কাজে লাগাই এখান থেকে লোহাপাহাড় বেস ক্যাম্পে যোগাযোগের জন্য।

নায়ার স্যারের মেসেজ আসবার এক সপ্তাহের মধ্যে, টাংস্টেনের খোঁজে এই মাঠের চারপাশের ঘন জঙ্গল ভেদ করে একটু দূরে যেতেই আমাদের নজরে আসে ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা কী যেন বাড়ির মতো দেখা যাচ্ছে। পরদিন অনেক লোকজন সাথে নিয়ে এইখানে আমরা খুঁজে পাই এখানের প্রাক্তন মহারাজার দোতলা শিকার বাড়ি আর তার চারপাশ ঘিরে পরিচারকদের থাকবার ঘর, বিশাল রান্নাঘর এবং ভাঁড়ার। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকলেও এতো মজবুত করে তৈরি যে এখনও পুরো শিকার বাড়ির সবকটা ঘর আর তার দরজা জানালা অটুট আছে। দোতলার চারটি ঘরের একটি ঘরেই মাত্র দরজা আছে। সেটি অনেকটা ব্যাঙ্কের ভল্টের মতো। তাতে গোল চাকা লাগানো আছে। এছাড়া বাকি সব ঘরে শুধু শিকল লাগানো ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল সেগুলো কে যেন একটু আগে পরিষ্কার করে গেছে। কোনও ঘরের মেঝেতে ঝুল বা মাকড়সার জাল বা মেঝেতে পুরু ধুলোর স্তর দেখলাম না।

সাতধারার মাঠে আমাদের চারজনের থাকার জন্য চারটে তাঁবু আর গাছের মাথায় হ্যামক টাঙ্গানো থাকলেও আমরা এখানে থাকতে তেমন ভরসা পেতাম না। দিনের দিন কাজ শেষ করে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ফিরে যেতাম লোহাপাহাড় বেস ক্যাম্পে। এই বাড়িটা দেখতে পেয়ে আমরা ঠিক করলাম এবার থেকে এখানেই থাকা হবে আর সেইজন্য ভাঁড়ার ঘরে পুরো মাসের রেশন, জ্বালানি কাঠ, রাত্রে পেট্রম্যাক্স জ্বালাবার কেরোসিন মজুত করে রাখা শুরু হল।



পিকনিকের এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে গেল তার তোড়জোড়। নায়ার স্যার ছাড়াও কোম্পানির আরো কয়েকজন উচ্চপদস্থরাও টাংস্টেনের কাজ দেখা আর পিকনিক দুটোই করতে আসবেন। এইপ্রথম লোহাপাহাড়ে কোম্পানির এত উঁচু পদের লোকেরা আসছেন। তাঁদের যাতে কিছুতে অসুবিধে না হয় সেজন্য লোহাপাহাড় বেসক্যাম্প ইন চার্জ কর্নেল প্রতাপ সিং একদিন নিজে এলেন কুঁজোচুড়ো পাহাড়ে। আমরা ঠিক করলাম যে পিকনিকের রান্নাবান্না আর খাওয়া দুটোই হবে সাতধারার কাছের বিশাল মাঠে। ঝর্নার পাশে অনেক পাথর আছে সেইগুলো বসবার জন্য হবে। ঝর্নার কাছে এক কোণে, রান্নার চুল্লিগুলো বানানো হবে। অভ্যাগতদের মধ্যে এবং আমাদের পরিবারের লোকেরা যারা চাইবেন, তাঁরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছ’বার নদী পার হবার রোমাঞ্চের স্বাদ নেবেন। লোহাপাহাড় ক্যাম্পে তিনটে রবারের স্পিড বোট আছে। সেগুলো একদম তৈরি করে রাখা হবে বাকি অভ্যাগতদের আনবার জন্য। রান্নার সব জিনিস এমনকি ঝাঁকা ভর্তি মুরগীদের ও কিনে রাখা হবে শিকার বাড়ির খাঁচায় । পিকনিকের আগের রাত্রেই, পাহাড়ি নদীতে দু-তিন জায়গায় বড়ো বড়ো পাঙ্গাস মাছ ধরবার জন্য জাল ফেলে রাখা হবে। এছাড়া জংগলের মধ্যে ছোটো প্রাকৃতিক লেক থেকেও মাছ ধরা হবে। মেনুটা কর্নেল স্যার তাঁর মনে মনেই রাখলেন কিন্তু আয়োজন দেখে আমরা বেশ বুঝতে পারলাম যে কী আছে তাঁর মনে। কর্নেল প্রতাপ আর নায়ার স্যার তাঁদের পরিবারের লোকদের নিয়ে এলেন লোহাপাহাড় ক্যাম্প থেকে সবার শেষে। আমি ওঁদের অভ্যর্থনা করে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতেই নায়ার স্যার তাঁর মিসেসকে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে ইশারা করে কিছু বলতেই নায়ার বৌদি ভয় পেয়ে বলে ঊঠলেন “ ওরে বাবা, সত্যিই বাঘ নয়তো?” কোনোমতে তাকে ম্যানেজ করে স্যার আর কর্নেলদের নিয়ে এলাম ঝর্নার ধারের মাঠের উত্তরের খাড়া ঢালের দিকে, যার উপত্যকায় আছে ঘাসবন যেখানে শুধু বিকেলের দিকে নন্দিনীকে দেখা যায়। কিন্তু এইসময়টায় নন্দিনী বেরোয় না, অনেক দূরের একটা গুহাতে ঘুমায়। ততক্ষণে সার্ভে টিম তাদের থিওডোলাইটের শক্তিশালী টেলিস্কোপ আর অনেকগুলো উচ্চশক্তির বাইনোকুলার বার করেছে। সবাই আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম যে ঘাসবনে যেন একটা লম্বা ঝড় ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করতে করতে লম্বা গাছগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কয়েকজন শঙ্কিত হয়ে পড়লেও, সার্ভে টিমের আর আমাদের ক্যাম্পের পুরানো লোকেদের সবারই মুখে চাপা হাসি যা একটু পরেই উল্লাসে পরিণত হল। ঘাসবন থেকে এবার যাদের পরিস্কার দেখা গেল সেটা একপাল বাঁদর। সার্ভে টিম যেন তৈরিই ছিল ওদের আপ্যায়ন করতে। ওরা প্রত্যেকে নিজের নিজের হ্যাভারস্যাক খুলে জঙ্গলের কলা, লেবু, বাতাবি,নাসপাতি হনুমান বাহিনীর দিকে ছুড়ে মারতেই, কপিবাহিনী জন্টি রোডসকে লজ্জা দিয়ে সেগুলো অনায়াসে ক্যাচ ধরে ফেলছিল। এরপর সাম্বা আর সালসা মিশিয়ে একটা জম্পেস সমবেত নাচ দেখালো। কিন্তু পূব দিক থেকে ধুলোর ঝড় তুলে কারা যেন আসছে? এক লহমার মধ্যে পুরো কপিবাহিনী গাছে চড়ে গেল। কারা আসছে ধুলোর ঝড় তুলে? চিতার একটা দল কি আসছে তাদের চিরশত্রুদের আসার খবর টের পেয়ে?

একটু পরেই আমাদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে এলো একপাল চিতল হরিণ বা চিতল এক্সপ্রেস। গাছের ওপর কপিবাহিনী দেখতেই থেমে গেল তারা। আমাদের থেকে পাওয়া ফলগুলো থেকে, ওরা কিছু বাঁচিয়ে রেখেছিল চিতল হরিণ বন্ধুদের জন্য। সেগুলো ছুঁড়ে-ছুঁড়ে এগিয়ে দিয়ে আপ্যায়ন করল আর ওরাও সানন্দে লাফিয়ে সেগুলো গ্রহণ করল । আমরাও বেশ কতগুলো পাকা পেয়ারা চিতলদের দিকে ছুঁড়ে দিলাম । কপিবাহিনী সেই দেখে আনন্দে কিচ-কিচ করে উঠলো ।

সবার পরে পৌঁছাল এক জোড়া চিতল দম্পতি । তাদের দিকে পেয়ারা ছুঁড়তেই, ডুয়েট নাচের ভঙ্গিতে দুজনেই অনেকটা উঁচুতে একসাথে লাফিয়ে, সেগুলো কামড়ে ধরল। এই দেখে আমরা সবাই দু'দলের দিকেই, সবার ব্যাগ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে বাকি ফলগুলোও ছুঁড়ে দিতে থাকলাম। এ’বার শুরু হয়ে গেল, হরির লুটের মত, মাটিতে গড়িয়ে পড়া ফলগুলো কুড়োবার বা সোজা মুখে ফেলে দেবার ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। এর মাঝে দু'পক্ষের যৌথ নাচও হচ্ছিল । বাঁদরেরা দু’পায়ে হেলে-দুলে আবার কখনো বা ডিগবাজি খেয়ে আর হরিণেরা, সামনের দু'পা জোড়া দিয়ে, আকাশের দিকে তুলে পেছনের পায়ের খুরে ভর দিয়ে, দু’ধারে হেলে-দুলে তাদের নাচ দেখাল। কিছুপরে, অন্য এক তালে, স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে, শরীরকে হাওয়ায় সামান্য ভাসিয়ে দিয়ে, ডান দিক থেকে বাঁ দিকে হেলে, আর এক ধরনের নাচ দেখালে।

হঠাৎ করে কী হল, রেফারি যেমন খেলা শেষের বাঁশি বাজায়, সেইভাবে হনুমান দলপতি মুখে একটা অদ্ভুত সুরে হিপ-হাপ করল। মুহূর্তের মধ্যে মাঠ ফাঁকা করে দু’দলই বিদায় নিলো । হরিণের দল ঘাস বনের ফাঁকে শুঁড়িরাস্তায় দৌড়াতে-দৌড়াতে আর কপি-বাহিনীও সেইদিকে গেল, তবে আকাশ পথে গাছের শাখায়-শাখায় দোল খেতে-খেতে। তবে হ্যাঁ, যাবার আগে কপি-বাহিনীর পক্ষে বীর হনুমান,আমাদের সবাইকে মাথা নিচু করে তাঁর দু’হাত বাড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় থেকে তারপর রীতিমতো ট্রাফিক পুলিসের ভঙ্গিতে হাতের ইশারা করে নিজের দলের সদস্যদের তাকে অনুসরণ করতে বললো। এসব কে এদের শেখালো কে জানে? এ জিনিস আমি তো নয়ই, বহুবছর বনে-জঙ্গলে জরিপের কাজে ঘোরা, সার্ভে টিমের কেউ দেখে নি। নায়ার স্যার আর কর্নেলের বিশ্বাসই হচ্ছিল না, খালি বলছিলেন, “ইয়েহ সব নয়ে ছোকরালোগ কা ইনলোগ সে ইয়ারি-দোস্তি সে।” আমাদের সাথে বন্ধুত্বের খাতিরে আজ চিতল হরিণেরা আর কপিবাহিনী এসে যুগলবন্দী নাচ দেখিয়ে গেল এই কথাটা ওঁদের ঠিক না হলেও শুনতে ভালই তো। ততক্ষণে অভ্যাগতদের সবার হাতে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সালফি গাছের রস। অনেকটা খেজুর রসের মতো যা পান করে সবাই এতোটা পথ আসার ক্লান্তি জুড়িয়ে গেল। এর সাথেই আমরা দিয়েছিলাম পাতাপোড়া, চিকেন সুপ আর এখানের আদিবাসীদের তৈরি মোমোর মতো ভেতরে সবজির পুর দেয়া সিদ্ধ পিঠে । পাতাপোড়া মানে এখানের একরকম গাছের বড়ো বড়ো পাতা যাতে নদীর আঙ্গুল সাইজের এক কাঁটার মাছ সামান্য তেল মসলা মাখিয়ে কাঠকয়লার আগুনে ফেলে পোড়ানো হয়। পাতা পুড়লেও ভেতরের মাছ পোড়ে না, মসলা সমেত পাতার ভেতরে রাখা মাছ সুসেদ্ধ আর মাখনের মতো নরম হয়ে যায়। আমাদের রোজকার কাজের পথপ্রদর্শকদের নেতা মংলু সর্দার এসে নায়ার স্যারকে সবিনয় অনুরোধ জানালে যে পশ্চিম ঢাল বেয়ে নিচে নামলেই তাদের গ্রাম লোহাগাঁও। সেখানের লোক আপনাদের যুদ্ধের নাচ দেখাবার জন্য অপেক্ষা করছে। আকাশে হাল্কা মেঘ আছে, রোদের তেমন তেজ নেই, সাহেবদের তেমন কোনো কষ্ট হবে না। আদিবাসীদের নাচ দেখতে আর কেউই বসে রইলো না। তখন কি জানতাম যে এই হাল্কা হাল্কা সাদা মেঘের পেছনেই লুকিয়ে আছে এক দুর্যোগকারী?

আমরা এবার দুপুরের খাবারের জোগাড়ে লেগে পড়লাম। জঙ্গলের পুকুর থেকে তেলাপিয়া আর পাহাড়ি নদী থেকে এসেছে পাঙ্গাশ মাছ । লম্বা পাঙ্গাশ মাছের পেট পরিষ্কার করে, তেল মশলা মাখিয়ে, তাদের ফাঁপা বাঁশের মধ্যে চালান করে, সেই বাঁশের ওপর আর নিচের খোলা মুখে কাঠের লম্বা টুকরো দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফুট-খানেক গভীর আর প্রায় সেইরকমই চওড়া, এইরকম অনেকগুলো ভাঁটি আছে সাঞ্ঝাচুলার বাইরে। এক একটা ভাঁটিতে এইরকম তিন-চারটে, পাঙ্গাশ মাছ ভরতি ফাঁপা বাঁশের নল ভাঁটিতে ঢুকিয়ে, পুরো ভাঁটি কাঠ-কয়লা দিয়ে ভরে ওপরে ও নিচে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কাঠকয়লার ধিকি-ধিকি আগুনে, পাঙ্গাশ মাছের নিজের তেল আর মাখানো মসালার মাখামাখির খেলার শেষে, বাঁশগুলো বের করে আনা হয়। বাঁশ পুড়ে গেলেও, মাছ পোড়ে না। পরম উপাদেয় এই খাদ্যটি, ঠিক পরিবেশনের আগে বাঁশ থেকে বার করা হয়। তেলাপিয়া মাছকে কাঠকয়লার হাল্কা আগুনে গ্রিল করা হবে। এর পরেই ওই ভাঁটিতেই হবে মুরগি কিন্তু সেটা হবে মাটির সরায়। মাটির সরাতে তেল মাখিয়ে, মসলা মাখানো মুরগির টুকরো তাতে রেখে, ঠিক ওইরকম আর একটা মাটির সরা উল্টো করে, সেটা ঢেকে দেওয়া হবে। দুটো সরার মাঝের জোড়ের ফাঁক, মাটি দিয়ে লেপে বন্ধ করে সোজা চালান করে দেওয়া হবে ভাঁটিতে। ভাঁটির নিচ থেকে ওপর অবধি কাঠকয়লা দিয়ে ঢেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। বেশি পরিমাণ দরকার হলে এক সেট সরার ওপর আর এক সেট দেওয়া হয় । বেস ক্যাম্পে ড্রিলিং এঞ্জিনিয়ার নাইডু এবং তার দলবল ভোর রাতে কাঁচা পেঁপেবাটা মাখিয়ে রাখা মাংসে বিরিয়ানির সব মসলা দিয়ে তাকে এবার হান্ডায় রেখে বড়ো উনুনে বসাবে। সুগন্ধি বাসমতী চাল আধসেদ্ধ হয়ে তৈরি হয়ে মাংসের সাথে দেশী ঘিয়ের সাথে মাখোমাখো হয়ে বিরিয়ানি নাম নিয়ে পুনর্জন্মের পথে পা বাড়াবে।

আমাদের রান্না প্রায় শেষ, পশ্চিম ঢালের পাহাড়ে কলরব শোনা যাচ্ছে। লোহাগাও থেকে সবাই এবার ফিরলো বলে। এমন সময় দেখি আমাদের মাসা আসছে ছুটতে ছুটতে। “সাহেব, একদঙ্গল কালোমেঘ পাহাড়ি নদীর পশ্চিম পাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। এটা ভালো না। খুব শীঘ্রই জোর জল-ঝড় নামবে।” কর্নেল প্রতাপের সাথে আমরা এক দ্রুত মিটিং সেরে নিলাম। সেই অনুযায়ী পুরো রান্না করা খাবারের সাথে সবাই আশ্রয় নেবে শিকার বাড়িতে। নিচের বড়ো হল ঘরে খাবার ব্যবস্থা করা হবে। ঝড়-জল মিটলে তার পর লোহাপাহাড়ে ফিরে যাবার কথা হবে। আমরা সবাই ঝড় আর বৃষ্টি আছড়ে পড়লো। কিন্তু মজবুত গঠনের এই শিকার বাড়ি এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে স্বভাবসিদ্ধ রাজোচিত আচরনে উপেক্ষা করল।

সার্ভে টিমের আটজন নতুন নিযুক্তদের আর ক’দিন পরেই একসাথে কাজে যোগদানের পর তাদের থাকা-খাবার ব্যবস্থা এই বাড়িতেই। সেই অনুযায়ী আগে থেকেই এখানে চাদর, বিছানা, লেপ, কম্বল আর রেশন তোলাই ছিল। নিচের চারটে ঘর সেভাবে তৈরিই আছে। দুটো ঘরে মেয়েরা শোবেন আর তার পাশের ঘর দুটোতে পুরুষরা। তবে আমারা দুইবন্ধু ঠিক করলাম যে আমরা ওপরের একটা ঘরে থাকবো। সারাদিন বড়ো খাটনি গেছে, এখন একটু হাত পা ছড়িয়ে তোফা ঘুমের দরকার। তার ওপর, সন্ধের একটা অংশ কেটেছে সবার থাকা-খাওয়া আর শোবার জোগাড়যন্ত্র করতে। ওপরের ব্যাঙ্কের ভল্টের মত দরজা দেওয়া ঘরটির পাশের ঘরটি বেশ বড়ো। একমাত্র এতেই সেই যুগপ্রাচীন মেহগনি কাঠের সিংহাসন সদৃশ বিশাল পালঙ্ক আছে। যখনই এই ঘরটি খুলেছি লক্ষ্য করে দেখেছি কে যেন এই ঘরটি সদাই পরিষ্কার করে রাখে আর এখান থেকে সবসময়একটা বিদেশী পারফিউমের মতো গন্ধ ছাড়ে।

আমার সাথে কথা বলতে বলতেই আমার সঙ্গী শচিন ঘুমে কাদা। আমারও দু চোখ জুড়ে ঘুম ছেয়ে আসছিল। এই ঘর থেকে দুরের পাহাড়ি নদীর আওয়াজ শোনা যায় যা এখন গর্জনে পরিণত হয়েছে যা শুনতে শুনতে একটা কথা মনে হতেই আমি একদম লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। নদীর পাড়েই বোটগুলো বেঁধে রাখা হয়েছিল। এই গোলমালে সেগুলোর খবর নেওয়া এই দুর্যোগে আর হয়েও ঠেনি। আমি জানি বোটগুলো বেশ শক্ত করে ম্যানিলা রোপ আর লোহার দড়ি দিয়ে পাড়ে হুক করে বাঁধা আছে। কিন্তু প্রবল হাওয়া আর প্রচন্ড স্রোতের টানে সেগুলো ভেসে যায়নি তো? যা অবস্থা এখন কাল সকালে সব কিছু স্বাভাবিক হলেও নদীর জল অত তাড়াতাড়ি নামবে না। আরও একটা কথা সারাদিনে শিবার সাথে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। একটা আস্ত বড়সড় মুরগী ওকে ধরিয়ে দিয়েএকটু দূরে গিয়ে খেতে বলেছিলাম। ও যেখানেই যাক সন্ধের পর আমি যেখানেই থাকি খুঁজে খুঁজে ঠিক চলে আসে আমার কাছে। আজ ও গেল কোথায়? এই ঝড়ে পড়ে হয়তো আছে কোথাও, কাল সকালে ফিরে আসবে নিশ্চয়।এইসব ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রার মতো আসি আসিকরছে, এমন সময় মনে হল পাশের সেই ভল্ট দেয়া ঘরটায়কি যেন ফিসফাস স্বরে কথা শুনলাম। কে যেন আমাকে স্থানীয় ভাষায় বলছে “দেয়ালের কাছে এসে কান পাতো, আমি কিছু বলবো”। ধড়মড় করে উঠে ওই ঘরের লাগোয়া দেওয়ালে কান পাতলাম কিন্তু কোনো আওয়াজ নেই। বিছানায় আবার ফিরে যাচ্ছি, এইসময় মনে হল, আমার ঘরের লাগোয়া ওয়াসরুমে কেউ যেন আছে । প্রথমবার কানে যেতে বিশ্বাস হয়নি। ক্ষণেক পরে আবার শুনি সেই আওয়াজ। এবার আর ভুল হল না। এটা নূপুরের আওয়াজ। ঠিক এইসময় আমার রুমের দরজার কাছে স্পষ্ট নূপুরের আওয়াজ শুনলাম। শচিনের দিকে তাকালাম। ও যেভাবে ঘুমাচ্ছে ওকে আর জাগালাম না। ঘরের কোণে একটা বড় লাঠি ছিল, সেটা নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসতেই রাস্তার কালো পিচের চাইতে বেশি গাঢ় অন্ধকার আমাকে যেন ঘিরে ধরলো। নদীর তীব্র গর্জন খান‍্খান্ করে দিচ্ছে রাত্রের নিস্তব্ধতাকে। এমন সময় বেশ স্পষ্ট শুনলাম কাঁচের গ্লাস ভাঙ্গার আওয়াজ আর অনেক লোকের চাপা গলায় কথা বলার আওয়াজ। হঠাৎ শুনলাম একটা অট্টহাসির আওয়াজ আর সেই সাথে চাপা কান্না আর ঘুঙ্গুরের আওয়াজ। এত গাঢ় অন্ধকার যে নিজের গায়ের লোমই ঠাহর হচ্ছে না । এইসব আওয়াজ আসছে সেই ব্যাঙ্কের ভল্টের মতো দরজার কাছ থেকে। একটা নারী কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ খুব জোরে হয়ে ধীরে ধীরে থেমে যেতে যেতে আর্তনাদ করে উঠলো। মনে হচ্ছে যেন কেউ তার গলা চেপে ধরেছে, আর একবার কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজ শুনতে পেলাম। এর আগে অনেকক্ষণ ধরে টুই টুই করে কয়েকটা রাতজাগা পাখি ডাকছিল । ভয় পেয়ে তারা এবার চুপ করে গেল। একটা কিছু যে নিষ্ঠুর কাণ্ড হতে চলেছে তা এরাও টের পেয়েছে। নাহ্ কপালে যা থাকে আমার হবে। দেখি কী একটা হেস্তনেস্ত করতে পারি। আমার বালিশের তলায় একটা ব্লিঙ্কার দেওয়া বড়ো টর্চ আছে। আলোটা জ্বাললে বোঝা যাবে যে কী হচ্ছে। টর্চ আর লাঠি হাতে নিয়ে, ধীর পদক্ষেপে রুম থেকে বাইরে এলাম। সর্বনাশ! দেখি টর্চ আর জ্বলছে না। বারান্দায় কেউ আছে বলে মনে হল না। কী মনে করে, আমি টর্চের অ্যালার্মের বোতামটা টিপলাম ।

বিকট আওয়াজ করে সাইরেন বাজবার সাথে-সাথে, ব্লিঙ্কারের বেশ জোর আলো জ্বলা-নেভা করতে থাকল। আমার রুমের দরজায় কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু টর্চ সিঁড়ির দিকে ঘোরাতেই, গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। কাঠের সিঁড়ির দিক থেকে নূপুরের আওয়াজ শোনা গেল। মনে হচ্ছে, কেউ যেন দ্রুত গতিতে কিন্তু ছন্দের সাথে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আমি আলোটা সেইদিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই, মনে হল, সার্চ লাইটের মত একজোড়া তীব্র নীল আলো আমার দিকে একবার দেখল। এরপরই আমার টর্চের ব্লিঙ্কার আর সাইরেনের আওয়াজ ক্ষীণ হতে লাগলো। এবার মনে হচ্ছে যেন কেউ ঘুরে দাঁড়ালো। ওই নীল আলো যেন আসলে তারই চোখ আর সেই চোখ এগিয়ে আসছে ক্রমশই আমার দিকে আমি এবার খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম, "বাঁচাও, বাঁচাও"। কিন্তু চিৎকার শেষ করার আগেই দেখি নীল চোখজোড়া এবার আমার থেকে হাতখানেক দূরত্বে। আমার হাতের মুঠিতে জোর করে চেপে ধরা লাঠিটা আর অন্য হাতে ধরা টর্চটা, কেউ যেন কেড়ে নিল। চোখের নিমেষে, সেগুলো সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে লাগলো।

এইটুকু বুঝতে পারলাম যে আমি এবার লুটিয়ে পড়ছি বারান্দার মেঝেতে আর সিঁড়িতে এবার অনেকগুলো ভারি পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সেই আওয়াজে নীল চোখ জোড়া যেন সরে যাচ্ছে ।

ভোরের আলো আর দোয়েলের শিষ, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। চোখ খুলে দেখি, আমি, আমার রুমের বিছানায় নেই। ধড়মড় করে উঠে, চোখ খুলে দেখি আছি গেস্ট-হাউসেই। তবে নিচে হলঘরে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কফির ট্রে নিয়ে ঢুকলেন নায়ার বৌদি আর তার সাথে নায়ার স্যার আর কর্নেল প্রতাপ। নায়ার স্যার আমায় বললেন, “আগে কফি শেষ করি আমরা সবাই আর তার পর শুনবো তোমার মুখে কাল রাতের ব্যাপার।”

কফির পর আমার মুখে সব শুনে কর্নেল আমাকে একগুচ্ছ সজারুর পালক দেখিয়ে বললেন, “তোমার গল্পের আসল নায়িকা হল সজারু তবে একটি নয় বেশ অনেকগুলি। নিশুতি রাতে তারা এসে আড্ডা জমায়,কাল তুমি যে ঘরটায় শুয়েছিলে তার ঠিক তলায়। নিশাচর এই প্রাণীগুলি চোখ রাতে দেখলে মনে হবে কোথাও যেন একজোড়া নীল আলো জ্বলছে”। কিন্তু শুধু কি নীল আলো? আরও অনেক কিছু কাল রাতে শুনেছি। সেই সব নিয়ে কর্নেল কিন্তু কোনো ব্যাখা দিতে পারলেন না। এ’নিয়ে তর্কে আমার উৎসাহ নেই এখন। আমি শচিন কে বললাম, “তুই আমার সাথে আয় বাইনো নিয়ে। বোটগুলো খুঁজে দেখি।”

ঘরের বাইরে যাবার জন্য নামতেই সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন। আমি কোনওমতে বাইরে এসে সোজা গেলাম পশ্চিমের ঢালে। সবকটা বাঁক এখান থেকে পরিস্কার দেখা যায়। আমাদের এই ক্যাম্পের কাছেই পাহাড়ি নদীর বিপদ সীমানার মার্কা লাগানো পিলার আছে। নদী এখন তার ওপর দিয়ে বইছে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে যে হঠাৎ বরসার এই বাড়-বাড়ন্ত দুপুরের পরই কমতে শুরু করবে। তখন স্পিড বোট চলতে পারে কিন্তু ঘোড়াতে নদী পার হবার ঝুঁকি নেয়া উচিত নয়। কিন্তু সেই বোট এখন আছে কোথায়? বোট ভেসে গেলে হয় সেটি আমাদের লোহাপাহাড় বেস ক্যম্পের কাছে কোনো বাঁকে বা বেস ক্যাম্পের পর যে ড্যাম আছে তার দেওয়ালে আটকে আছে। কিন্তু সেই খোঁজে বেরোবার প্রায় সব কটা লোক এইখানে। বাকিরা যারা আছে তারা নেহাত নতুন, বুঝিয়ে না বললে পারবে না বোট খুঁজতে। ওয়্যারলেস সেট কাজ করছে না, পুরু মেঘের জন্য স্যাটেলাইট ও নেই। এইসময়ে বোট খোঁজার খবর পাঠানো জন্য যাকে দরকার সেই শিবা কাল সকাল থেকে গায়েব। শিবা গেল কোথায়? কাল তাকে একটা গোটা মুরগী দিয়ে যে দিকে পাঠানো হয়েছিল সেই পূবের খাড়া ঢালে গিয়ে বেশ কয়েকবার শিবা কে ডাকলেও লাভ কিছু হল না। বিরক্ত হয়ে এবার আমি শিবাকে ডাকতে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম,”নন্দিনী, নন্দিনী” আমার আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে আসবার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল নন্দিনীর গর্জনে। দেখি নন্দিনী আসছে আর তার পিঠে চড়ে আসছে শিবা। শিবা উড়ে আসতেই আমার পিছনে থাকা শচিনের উদ্দেশ্যে বললাম, “তোর পকেটে পেন আর মেসেজের ট্যাগ আছে বার কর।” পেন আর ট্যাগে নিয়ে যে হাত এগিয়ে এল সেটা দেখে আমি একবার পেছন ফিরতেই চমকে উঠলাম। বোধকরি আমাদের চিৎকার-চেঁচামিচিতে নায়ার স্যার চলে এসেছেন এখানে আর উনি সব দেখেওছেন। ট্যাগে লোহাপাহাড় বেস ক্যাম্পকে বোটগুলো উদ্ধার করবার সাঙ্কেতিক জাইগুল লিখছিলাম আর শুনছিলাম, “ ওয়েল ডান বয়েজ। নিজের চোখে না দেখলে আনবিলিভেবেল। আমি মুভিতে এইরকম দেখেছি।” ততক্ষণে কর্নেল চলে এসেছেন, “স্যার আমার ডি এস এল আর ক্যামেরায় নন্দিনী আর শিবা কয়েদ হয়ে আছে। ওয়েট স্যার, চলল আমাদের শিবা। আর কয়েক মিনিটেই বেসক্যাম্পে খবর পৌঁছে যাবে।”

বিকেলের সামান্য আগেই চারটে স্পিড বোটে সবাই রওয়ানা হয়ে গেলেন বেস ক্যাম্পের দিকে। পরের মাসে কোম্পানির ইন হাউস ম্যাগাজিনের কভার পেজ জুড়ে ছিল নন্দিনী আর তার পিঠে চড়া শিবা।


(সমাপ্ত)


ছবি : লেখক

No comments:

Post a Comment